সকাল বেলাতেই নেয়ামত সাহেবের ঘরে
সকাল বেলাতেই নেয়ামত সাহেবের ঘরে লিলির ডাক পড়েছে। লিলি ভয়ে ভয়ে উপস্থিত হলো! নেয়ামত সাহেব অস্বাভাবিক কোমল গলায় বললেন, মা বসো।
লিলি বসল।
মা, কাছে এসে বসো।
লিলি বাবার কাছে একটু সরে এলো। খুব কাছে আসতে লজ্জা লাগছে। বাবা তুমি তুমি করে বলছেন। তাতেও লজ্জা লাগছে।
তোমার বিয়ের কার্ড ছাপা হয়েছে দেখো। হাতে নিয়ে দেখো। লজ্জার কিছু নেই। হারামজাদারা একটা বানান ভুল করেছে। শুভ লিখেছে দন্ত্যে স দিয়ে, ধরে চাবকানো দরকার। তবে ছেপেছে ভালো। কার্ড পছন্দ হয়েছে মা?”
জি বাবা।
শুভ বানানটার জন্য মনের ভিতর একটা খচখচানি রয়ে গেল। যাই হোক কি আর করা! তোমার কয়টা কার্ড দরকার বল তো মা।
আমার কার্ড লাগবে না বাবা।
কার্ড লাগবে না মানে। অবশ্যই লাগবে। বন্ধু-বান্ধবদের নিজের হাতে দাওয়াত দিয়ে আসবে। এইসব ব্যাপারে আমি খুব আধুনিক। ড্রাইভারকে বলে দিয়েছি সারাদিনের জন্য গাড়ি তোমার। বিশটা কার্ডে হবে মা?
জি হবে।
ফ্যামিলিসুদ্ধ দাওয়াত দেবে। দাওয়াতে কার্পণ্য করবে না। নাও মা, কার্ডগুলো নাও–হারামজাদারা শুভ বানানে গণ্ডগোল করে মনটা খারাপ করে দিয়েছে। যাই হোক, কি আর করা। মা, দাওয়াত দেয়ার সময় মুখে বলবে, উপহার আনতে হবে না। দোয়াই কাম্য। কার্ডে লিখে দেয়া উচিত ছিল। অনেকেই আবার এসব লিখলে মাইন্ড করে বলে লেখা হয় নাই।
বাবা, আমি যাই?
আচ্ছা মা, যাও। যেসব বাড়িতে যাবে সেখানে মুরুব্বি কেউ থাকলে পা ছুঁয়ে সালাম করবে। মুরুব্বিদের দোয়া যে কত কাজে লাগে তা তোমরা জানো না। জগৎ সংসার টিকেই থাকে মুরুব্বিদের দোয়ায়।
স্বাতী গভীর আগ্রহে বিয়ের কার্ড দেখছে। লিলি তাকিয়ে আছে স্বাতীর দিকে। কী চেহারা হয়েছে স্বাতীর! যেন সে কতদিন ধরে ঘুমুচ্ছে না, খাচ্ছে না।
তুই এমন হয়ে গেছিস কেন স্বাতী?
কেমন হয়ে গেছি? পেত্নী?
প্রায় সে-রকমই।
রাতে ঘুম হয় না, বুঝলি লিলি, এক ফোঁটা ঘুম হয় না। গাদাগাদা ঘুমের ওষুধ খাই। তারপরেও ঘুম হয় না। মার ধারণা আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।
তোর নিজের কী ধারণা?
আমারও সে রকমই ধারণা। কাল রাত তিনটার সময় হঠাৎ হো হো করে এমন হাসি শুরু করলাম–আমি হাসি মা কাঁদে। মা যত কাঁদে, আমি ততই হাসি।
তোর সমস্যা কী?
আমার অনেক সমস্যা। তোকে সব বলতে পারব না।
আমি তোকে একটা পরামর্শ দেব?
দে।
তুই হাসনাত সাহেবের কাছে ফিরে যা।
স্বাতী রাগী গলায় বলল, কেন ফিরে যাব? ভালোবাসার জন্য ফিরে যাব? ওকে ভালোবাসি তোকে কে বলল? ভালোবাসা কখনও এক তরফা হয় না। ও কি। ভালোবাসে আমাকে? কখনও না। আমার একটা ছবি এঁকেছে। ছবিটা তুই ভালো করে লক্ষ করেছিস? ভালো করে দেখ। ছবির মেয়েটার চিবুকে লাল তিল আছে। আমার চিবুকে লাল তিল আছে? কোত্থেকে এই তিল এল? তার স্ত্রীর চিবুকে তিল ছিল। ওর কোনো প্রেমিকা দরকার নেই। ওর দরকার জাহিনের দেখাশোনার জন্য একজন মা। ওকে বিয়ে করলে আমাকে কী করতে হবে জানিস? ওর স্ত্রীর ভূমিকায়
অভিনয় করতে হবে। আমি কোনোদিনও তা করব না।
আচ্ছা ঠিক আছে। তুই শান্ত হ।
স্বাতী চুপ করল। বড় বড় করে নিশ্বাস নিতে লাগল। লিলি বলল, আমি এখন যাই স্বাতী?
কোথায় যাবি? হাসনাতের ওখানে?
লিলি কিছু বলল না, চুপ করে রইল। স্বাতী বলল, আমি তোর চোখ দেখেই বুঝেছি তুই তার কাছে যাবি। বিয়ের দাওয়াতের অজুহাতে যাবি। তাই না?
লিলি চুপ করে রইল।
.
স্বাতী তীব্র গলায় বলল, তোর সাহসের এত অভাব কেনরে লিলি। একটু সাহসী হ। আমার সঙ্গে এতদিন থেকেও তোর সাহস হলো না এটাই আশ্চর্য। আমি কী প্রচণ্ড সাহসী একটা কাজ করতে যাচ্ছি তা কি জানিস?
না।
মাকে জিজ্ঞেস করিস। মা বলবে। নাও বলতে পারে। মাও তো তোর মতোই একটা মেয়ে। শাড়ি দিয়ে শরীর ঢাকতে ঢাকতে সবকিছু ঢাকার অভ্যাস হয়ে গেছে।
স্বাতী, আমি যাই।
যা। ওকে জিজ্ঞেস করিস তো কোন সাহসে আমার চিবুকে সে লাল তিল আঁকল?
লিলি সিঁড়ি দিয়ে নামছে। একতলায় স্বাতীর মার সঙ্গে তার দেখা হলো। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, মেয়েটার মাথা খারপ হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত খারাপ হচ্ছে। আমি কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না। ও প্রায়ই আমাকে চিনতে পারে না।
এইসব কী বলছেন খালা!
সত্যি কথা বলছি মা। সত্যি কথা বলছি। ও আমাকে শাস্তি দিতে গিয়ে নিজে শাস্তি পাচ্ছে।
তিনি ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
.
হাসনাত বাসায় ছিল। লিলিকে দেখে সে খুব অবাক হলো। লিলি বলল, জাহিন কোথায়?
ও তার মার হোটেলে। ওর মা এসেছে ওকে নিয়ে যেতে।
আমি জানি। জাহিন আমাকে সব বলেছে।
ওর সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে জানি না তো। জাহিন আমাকে কিছুই বলে নি। ভেতরে এসো লিলি।
আমি আপনাকে একটা কার্ড দিতে এসেছি।
বিয়ের কার্ড।
হ্যাঁ। বুঝলেন কী করে বিয়ের কার্ড?
অনুমান করেছি।
আপনি বিয়েতে এলে আমি খুব খুশি হব।
আমি যাব, আমি অবশ্যই যাব।
আরেকটা কাজ যদি করেন তাহলেও আমি খুব খুশি হব।
বলো, আমি অবশ্যই করব।
স্বাতীর সঙ্গে যদি একটু দেখা করেন। ও ভয়াবহ সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।
লিলি, আমি সেটা জানি। আমি গিয়েছিলাম ওর কাছে। স্বাতী আমার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয় নি।
লিলি এসো, ভেতরে এসে বসো।
জি না, আমি বসব না।
হাসনাত ক্লান্ত গলায় বলল, স্বাতীর ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারছি না। রুবির ব্যাপারটাও বুঝি নি। কাউকে ধরে রাখার ক্ষমতা আমার নেই। এইটুকু শুধু জানি। বাস্তবে কাউকে ধরে রাখতে পারি না বলেই বোধহয় ছবিতে ধরে রাখতে পারি।
লিলি বলল, আমি যাই?
হাসনাত বলল, তুমি কি ঘণ্টাখানেক বসতে পারবে? ঘণ্টাখানেক বসলে অতি দ্রুত একটা ছবি এঁকে ফেলতাম। মাঝে মাঝে আমি খুব দ্রুত কাজ করতে পারি।
জি না। আমি এখন যাব।
হাসনাত গেট পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দিতে এল। হঠাৎ তাকে অবাক করে দিয়ে লিলি নিচু হয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করল।
হাসনাত বলল, আমি প্রার্থনা করছি তোমার জীবন মঙ্গলময় হবে।