দুঃস্বপ্ন দেখে মানুষের যত ঘুম ভাঙে
দুঃস্বপ্ন দেখে মানুষের যত ঘুম ভাঙে, সুন্দর স্বপ্ন দেখে বোধহয় তারচেয়ে বেশি ভাঙে। রওশন আরার ঘুম ভেঙেছে সুন্দর এটা স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নে তিনি নৌকায় করে কোথায় যেন যাচ্ছেন। তার বয়স খুব অল্প। তার পাশে লাজুক লাজুক চেহারার একজন যুবক। স্বপ্নে তিনি অবাক হয়ে টের পেলেন এই যুবকটি তাঁর স্বামী। তিনি লজ্জিত এবং বিব্রতবোধ করতে লাগলেন। তার এই ভেবে কষ্ট হলো যে, তিনি এমন চমৎকার ছেলেটিকে ফেলে এতদিন কোথায় কোথায় ঘুরছিলেন। ইশ, খুব অন্যায় হয়েছে। যুবকটি তার গা ঘেঁষে বসতে চাচ্ছে কিন্তু লজ্জা পাচ্ছে। তিনি যুবকটিকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচিয়ে তার গা ঘেঁষে বসার সুযোগ দেবার জন্য বললেন–এই শোনো, আমাকে একটা পদ্মফুল তুলে দাও না। নদীতে পদ্ম ফোটে না, কিন্তু স্বপ্নের নদীতে সব ফুল ফোটে। যুবকটি তার গা ঘেঁষে বসল। নদীতে ঝুঁকে পড়ে পদ্মফুল তুলতে লাগল। ছেলেটি যেন পড়ে না যায় এজন্য তিনি তার হাত ধরে রাখলেন। কি যে ভালো লাগল হাত ধরে থাকতে। স্বপ্নের এই পর্যায়ে গাঢ় তৃপ্তিতে তাঁর ঘুম ভাঙল। তিনি বিছানায় উঠে বসলেন। নাজমুল সাহেব সঙ্গে সঙ্গে বললেন, কী হয়েছে?
কিছু না।
তিনি খাট থেকে নামলেন। নাজমুল সাহেব বললেন, এক ফোঁটা ঘুম আসছে। কী করি বলো তো? দশটা থেকে শুয়ে আছি। এখন বাজছে তিনটা।
রওশন আরা বললেন, বয়স হয়েছে, এখন তো ঘুম কমবেই ঘুমের ওষুধ খাবে?
দাও।
রওশন আরা স্বামীকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে বাতি নিভিয়ে দিলেন। তিনি বিছানায় ফিরে আসছেন না, বারান্দার দিকে যাচ্ছেন। নাজমুল সাহেব বললেন, যাচ্ছ কোথায়? রওশন আরা নিচু গলায় বললেন, স্বাতীকে দেখে আসি।
রাত দুপুরে চুরি করে মেয়ের ঘরে ঢোকা ঠিক না। প্রাইভেসির একটা ব্যাপার আছে। মা হলেই যে প্রাইভেসি নষ্ট করার অধিকার হয় তা কিন্তু না।
রওশন আরা শীতল গলায় বললেন, এটা কোর্ট না। আইনের কচকচানি বন্ধ রাখো। ঘুমানোর চেষ্টা কর।
রওশন আরা একটু আগে যে স্বপ্ন দেখেছেন বাস্তবের সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। স্বপ্নের যুবকটি তার পাশে এসে বসায় তিনি যে আনন্দ পেয়েছেন–পঁচিশ বছর এই মানুষটির সঙ্গে বাস করার সব আনন্দ যোগ করেও তার সমান হবে না। স্বপ্ন ও বাস্তব এত আলাদা কেন?
স্বাতীর ঘর অন্ধকার। সে গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে নি। মিউজিক সেন্টার নিঃশব্দ। রওশন আরা মেয়ের বিছানার দিকে চুপি চুপি এগুলেন। মেয়ের গায়ে চাদর আছে। আজ অবশ্যি গরম পড়েছে। গায়ে চাদর না থাকলেও চলত। মেয়েটা অদ্ভুত হয়েছে, যেদিন ঠাণ্ডা পড়ে সেদিন তার গায়ে চাদর থাকে না। গরমের সময় কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমায়। রওশন আরা ঘরের জানালার দিকে তাকালেন। জানালা খোলা। বৃষ্টি এলে খোলা জানালায় বৃষ্টির ছাট আসবে। মেয়েটার বিছানাটা জানালা থেকে একটু সরিয়ে দিতে হবে। রোজ রাতেই একবার করে ভাবেন। দিনে মনে থাকে না।
তিনি ঘর ছেড়ে বেরুতে যাবেন তখন স্বাতী পাশ ফিরল। শান্ত গলায় বলল, মা তোমার ইন্সপেকশন শেষ হয়েছে?
রওশন আরা লজ্জিত গলায় বললেন, তুই জেগে ছিলি?
তুমি যতবার এসেছ ততবারই আমার ঘুম ভেঙেছে। আমি ঘুমের ভান করে তোমার কীর্তিকলাপ দেখছি। আজ ঠিক করেছিলাম হাউ করে একটা চিৎকার দিয়ে তোমাকে ভয় দেখাব।
রওশন আরা লজ্জিত গলায় বললেন, আমি যে রাতে এসে তোকে দেখে যাই তোর খুব রাগ লাগে, তাই না?
মাঝে মাঝে খুব রাগ লাগে, আবার মাঝে মাঝে এত ভালো লাগে যে বলার না।
আজ রাগ লাগছে না–ভালো লাগছে?
খুব ভালো লাগছে। আজ আমার ঘুমই আসছিল না। শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম কখন তুমি আসবে। মা, আমার পাশে এসে বসো। তোমার যদি ঘুম না পেয়ে থাকে তাহলে আমার সঙ্গে গল্প করো।
রওশন আরা মেয়ের বিছানায় বসলেন। স্বাতী বলল, পা তুলে আরাম করে বসো।
রওশন আরা বললেন, বাতি জ্বালা। অন্ধকারে কী গল্প করব? মুখ না দেখে গল্প করে মজা নেই।
বাতি জ্বালাতে হবে না। অন্ধকারের গল্পের আলাদা মজা আছে। সহজে গল্প করা যায় আলোতে এত সহজে গল্প করা যায় না।
বেশ অন্ধকারেই তোর গল্প শুনি। কী গল্প বলবি?
শুধু আমি একা গল্প করব কেন? দুজনে মিলে করব। আমি কিছুক্ষণ গল্প করব। তুমি কিছুক্ষণ করবে। লিলির মহা বিপদের গল্প শুনবে মা?
বলো শুনি।
ওর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। আগামী শুক্রবার জুমা নামাজের পর পবিত্র শুভ বিবাহ।
এতে বিপদের কী হলো? বিয়ের বয়স হয়েছে বিয়ে হবে এটাই তো স্বাভাবিক।
ওর বিয়েটা অবিশ্য খুব স্বাভাবিকভাবে হচ্ছে না। বাবা-মা আত্মীয়স্বজন সবাই ধরে-বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। লিলি যে খুব আপত্তি করছে তা না। দিব্যি মায়ের সঙ্গে গয়নার দোকানে গিয়ে গয়নার অর্ডার দিয়ে এসেছে।
ভালোই তো!
ঝটপট তার বিয়ে কেন দিয়ে দিচ্ছে জানো মা?
না।
তার বাবা-মার ধারণা হয়েছে মেয়ে তাদের কন্ট্রোলের বাইরে চলে যাচ্ছে। একদিন তাকে দেখা গেছে ছাদে তার বান্ধবীর সঙ্গে সিগারেট খাচ্ছে। তারপরে সে আরেকটা ভয়াবহ অন্যায় করল, নিষেধ সত্ত্বেও ইউনভার্সিটিতে গেল। বাসায় ফিরল রাত দশটায়। এই গুরুতর অপরাধে তার শাস্তি হয়েছে–যাবজ্জীবন স্বামীর হাতে বন্দী।
তোর কি ধারণা স্বামীরা বন্দী করে ফেলে?
সব স্বামী হয়তো করে না। তখন সংসার বন্দী করে ফেলে। ছেলেমেয়ে জন্মায়–তারা বন্দী করে ফেলে। আমার বন্দী হতে ইচ্ছে করে না।
তোকে তো আর কেউ জোর করে বন্দী করতে চাচ্ছে না। কাজেই দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তবে বন্দী জীবনেও আনন্দ আছে।
স্বাতী শান্ত গলায় বলল, তুমি যে বাবার সঙ্গে বাস করছ, ধরাবাঁধা একটা জীবনযাপন করছ, রাধছ-খাচ্ছ-ঘুমুচ্ছ, আবার রান্না, আবার খাওয়া, আবার ঘুমানো–এই জীবনটা তোমার পছন্দের? আমার তো মনে হয় দারুণ একঘেঁয়ে একটা জীবন।
এক ঘেঁয়েমি তো সব জীবনেই আছে। তুই যদি একা বাস করিস, সেই একার জীবনেও তো এক ঘেঁয়েমি চলে আসবে।
দুজনের জীবনের এক ঘেঁয়েমি অনেক বেশি। দুজনেরটা একসঙ্গে যুক্ত হয়ে। একঘেঁয়েমি ডাবল হয়ে যায়।
তোর যত অদ্ভুত কথা!
মোটেই অদ্ভুত কথা না। আমি খুব ইন্টারেস্টিং একটা জীবন চাই মা। আমি একা থাকব। কিন্তু আমার একটা সংসার থাকবে। আমার একটা মেয়ে থাকবে। মেয়েটাকে সম্পূর্ণ আমার মতো করে আমি বড় করব। সে হবে আমার বন্ধুর মতো। আমার মতো স্মার্ট একটা মেয়ে সে হবে। খানিকটা জাহিনের মতো।
জাহিন কে?
স্বাতী একটু থতমত খেয়ে বলল, তুমি চিনবে না মা। একজন আর্টিস্টের মেয়ে।
স্বাতী চুপ করে গেল। রওশন আরাও চুপ করে রইলেন।কসময় তিনি নিচু গলায় বললেন, কোন আর্টিস্ট, যে তোর ছবি এঁকেছে?
স্বাতী প্রায় অস্পষ্টস্বরে বলল, হ্যাঁ।
রওশন আরা বললেন, তোর লুকিয়ে রাখা ছবিটা আমি দেখে ফেলেছি এইজন্য কি তুই রাগ করেছিস?
না। তুমি তালা খুলে আমার ঘরে ঢুকে আমার জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করো সেটা আমি জানি। ছবিটাও দেখবে তাও জানতাম। তোমার দেখার জন্যই ছবিটা ঘরে খেছি। আমার একটা উদ্দেশ্য ছিল। তুমি ছবিটা দেখে আমার কাছে জানতে ইবে তখন পুরো ব্যাপারটা বলা আমার জন্য সহজ হবে। তুমি ছবি দেখেছ অথচ মামাকে কিছুই বল নি।
জাহিন ঐ ভদ্রলোকের মেয়ে?
হ্যাঁ, খুব চমৎকার একটা মেয়ে। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি ঐ ভদ্রলোকের প্রেমে পড়িনি। মেয়েটার প্রেমে পড়েছি। এতক্ষণ যে মা-মেয়ের সংসারের গল্প করলাম এই ভেবেই বোধহয় করেছি।
ভদ্রলোকের স্ত্রী আছেন?
না।
তুই কি তার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছিস?
হুঁ।
খুব ঘনিষ্ঠভাবে?
হুঁ।
রওশন আরা ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেললেন। তাঁর চোখ ভিজে উঠেছে। এখনি হয়তো চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়বে। ঘর অন্ধকার, মেয়ে দেখতে পাবে না। এই টুকুই যা সান্ত্বনা।
মা তুমি কি আমাকে ঘেন্না করছ? আমার সঙ্গে এক বিছানায় বসে থাকতে তোমার কি ঘেন্না লাগছে?
তুই কি ঘেন্নার মতো কোনো কাজ করেছিস?
হা। মাঝে মাঝে মনে হয় খুব ঘেন্নার কাজ করে ফেলেছি। আবার মাঝে মাঝে মনে হয় না। মা, তুমি কি লক্ষ করেছ আমার শরীর খারাপ করেছে? কিছু খেতে পারছি না, ঠিকমতো ঘুমুতে পারছি না।
লক্ষ করেছি।
ঘর অন্ধকার করে আমি তোমার সঙ্গে খুব সহজভাবে কথা বলছি। তুমি কিছু মনে করো না। সহজভাবে কথা বলা ছাড়া আমার উপায় নেই। তুমি রাগ যা করার পরে করো। এখন আমার কথা শোনো।
শুনছি।
মা দেখো, ছেলে এবং মেয়ের ভালোবাসাবাসি প্রকৃতি খুব সহজ করে নি। কাটা বিছিয়ে দিয়েছে। ভালোবাসতে গেলেই কাঁটা ফুটবে। অথচ দেখো, মেয়ে এবং মেয়ের ভেতর কি চমৎকার বন্ধুত্ব হতে পারে। দুজন ছেলের ভেতর বন্ধুত্ব হতে পারে। দুজন ছেলের ভেতর বন্ধুত্ব হয়। কিন্তু যেই একটি ছেলে একটা মেয়ের কাছে যায় তাকে কাঁটা বিছানো পথে এগোতে হয়। কাঁটার কথা একসময় মনে থাকে না–পায়ে তখন কাঁটা ফোটে।
রওশন আরা ক্লান্ত গলায় বললেন, এত কাব্য করে কিছু বলার দরকার নেই, যা বলার সহজ করে বল। নোংরা কোনো ব্যাপার যত সুন্দর ভাষা দিয়েই বলা হোক সেটা নোংরাই থাকে। সুন্দর হয়ে যায় না।
মা প্লিজ, তুমি আমার কথাগুলো আমার মতো করে বলতে দাও। প্লিজ! প্লিজ!
বল, কী বলতে চাস?
কাটার কথাটা বলছিলাম মা। কাটা যখন ফোটে তখন কাঁটাটাকে ফুল বানানোর জন্য আমরা ব্যস্ত হয়ে উঠি। তড়িঘড়ি করে একটা বিয়ের ব্যবস্থা হয়। সবাই তখন ভান করতে থাকে কাঁটা ফুল হয়ে গেছে।
তুই ঠিক করেছিস বিয়ে করবি?
তাই ঠিক করা হলো মা। কাটার ভয়ে ঠিক করা হলো। তোমাদের না জানিয়ে বিয়ের সব ব্যবস্থা পাকা করা হয়ে গেল। তুমি নিশ্চয়ই আমার কথা শুনে খুব অবাক হচ্ছো।
তুই তোর কথা বলে যা। আমি অবাক হচ্ছি না, সেটা পরের ব্যাপার।
বিয়ের ঠিক আগের রাতে আমার ঘুম হচ্ছিল না, আমি ছটফট করছিলাম, তখন হঠাৎ মনে হলো, এই বিয়েটা তো কোনো আনন্দের বিয়ে না। সমস্যার বিয়ে। সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বিয়ে। একদিন আমাদের সংসারে একটা শিশু আসবে। যতবার তার দিকে তাকাব ততবার মনে হবে সে সংসারে ঢুকেছিল কাঁটা হিসেবে। স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া হবে। হবে তো বটেই। তুমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা, বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা, তোমরাই দুজন দুজনকে সহ্য করতে পারো না। আমরা কি করে সহ্য করব। মা, কি হবে জানো? কুৎসিত সব ঝগড়া হবে, দুজন দুজনের দিকে ঘৃণা নিয়ে তাকাক–সেই ঘৃণার সবটাই গিয়ে পড়বে আমার সন্তানের ওপর। মনে হবে তার কারণেই আমরা ঘৃণার ভেতর বড় হচ্ছি। মা ঠিক করে বলো তো, আমার সঙ্গে এক খাটে বসে থাকতে তোমার কি ঘেন্না লাগছে?
লাগছে।
লাগলেও আর একটুক্ষণ বসো। আমার কথা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। কথা শেষ হলেই আমি তোমার জন্য কফি বানিয়ে আনব।
স্বাতী, কথা অনেক শুনে ফেলেছি। আমার আর কিছু শুনতে ইচ্ছে করছে না। শেষটা খুব ইন্টারেস্টিং মা। শেষটা তোমাকে শুনতেই হবে–
আমি অনেক বয়স পর্যন্ত তোমাদের সঙ্গে ঘুমাতাম। আমি হলাম খুব আদরের মেয়ে, নক্ষত্রের নামে নাম। বাবা মার সঙ্গে তো ঘুমুবেই। আমি মাঝখানে, তোমরা দুজন দুদিকে। একটা হাত রাখতে হতো তোমার ওপর একটা হাত রাখতে হতো বাবার ওপর। তোমার দিকে তাকিয়ে ঘুমুলে বাবা রাগ করত, বাবার দিকে তাকিয়ে ঘুমুলে তুমি রাগ করতে। নকল রাগের মজার খেলার ভেতর দিয়ে আমি বড় হচ্ছি–চার বছর থেকে পাঁচ বছরে পড়লাম, তারপর প্রচণ্ড রকম ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আলাদা থাকার জন্য, আলাদা ঘরের জন্য। আমার প্রচণ্ড ভূতের ভয়, তারপরেও আলাদা থাকার জন্য কি কান্না তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে। মনে আছে মামা?”
হ্যাঁ, মনে আছে?
ভূতের ভয়ে কাতর ভীতু একটা মেয়ে আলাদা থাকার জন্য কেন এত ব্যস্ত সেটা নিয়ে তোমরা কখনও মাথা ঘামাও নি। কারণ, কখনও জানতে চাও নি। ধরেই নিয়েছ বাচ্চা মেয়ের খেয়াল। ব্যাপারটা কিন্তু তা না মা। তোমরা মাঝে মাঝে চাপা গলায় কুৎসিত ঝগড়া করতে। ঝগড়ার মূল কারণ ধরতে পারতাম না। শুধু বুঝতাম রহস্যময় একটা ব্যাপার। তুমি বিয়ের আগে ভয়ঙ্কর একটা অন্যায় করেছিলে। সে অন্যায় চাপা দিয়ে বাবাকে বিয়ে করেছ। প্রতারণা করেছ। লোক লজ্জার ভয়ে বাবা সেই অন্যায় হজম করছেন। আবার হজম করতে পারছেন না। পাঁচ বছরের একটা মেয়ের বাবা মার ঝগড়া থেকে সেই অন্যায় ধরতে পারার কোনো কারণ নেই। আমি ধরতে পারি নি। তবে স্মৃতিতে সব জমা করে রেখেছি। একসময় আমার বয়স বেড়েছে। আমি একের সঙ্গে এক মিলিয়ে দুই করতে শিখেছি। তারপর হঠাৎ বুঝতে পেরেছি। বিয়ের আগে আগে তোমার একটা এবোরসান হয়েছিল। কাঁটা সরিয়ে তুমি বিয়ে করেছ। বিয়ের পর দুজনে দুজনকে ভালোবাসার প্রবল ভান করেছে। আমি অবাক হয়ে তোমাদের দুজনের ভালোবাসাবাসির ভান দেখতাম। মনে মনে হাসতাম। হাসির শব্দ যেন তোমরা শুনতে না পাও সে জন্য উঁচু ভলুমে গান ছেড়ে দিতাম।
তোমার যেমন নিশিরাতে চাবি খুলে আমার ঘরে ঢুকে আমাকে দেখার অভ্যাস, আমার তেমনি মাঝে মাঝে তোমাদের ঘরের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে তোমাদের কথা শোনার অভ্যাস হয়ে গেল।
আমি যে অন্যায়টা করেছি খুব সূক্ষ্মভাবে হলেও সেই অন্যায়ের পেছনে তোমার একটা ভূমিকা আছে, সত্যি আছে। তুমি তোমার প্রথম যৌবনে যে অন্যায়টা করেছিলে–আমি সব সময় ভেবেছি সেই অন্যায় আমিও করব। এ-রকম অদ্ভুত ইচ্ছার কারণ তোমার প্রতি ভালবাসাও হতে পারে, আবার তোমার প্রতি ঘৃণাও হতে পারে। ঠিক কোনটা আমি জানি না।
মা, তোমাকে সত্যি কথা বলি। ঐ ভদ্রলোকের জন্য আমার ভেতর সাময়িক প্রবল মোহ অবশ্যই তৈরি হয়েছিল। তা না হলে এত বড় অন্যায় করা যায় না। তবে সত্যিকার ভালোবাসা বলতে যা তা বোধহয় আমার তাঁর প্রতি হয় নি। কাজেই তাকে বিয়ে না করলেও কিছু যায় আসে না। বিয়ে না করাটাই বরং ভালো। আমার বর্তমান যে শারীরিক সমস্যা তা আমি তোমার মতো করে মিটাতে পারি। ভালো একটা ক্লিনিকে ভর্তি হতে পারি। পনেরো-কুড়ি মিনটের ব্যাপার। কেউ কিছু বুঝতেও পারবে না। আমি কিন্তু তা করব না মা।
রওশন আরা ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন, তুই কী করবি?
স্বাতী শান্ত গলায় বলল, যে শিশুটি পৃথিবীতে আসতে চাচ্ছে আমি তাকে পৃথিবীতে নিয়ে আসব। তাকে বড় করব। তাকে শুদ্ধতম মানুষ হিসেবে বড় করব।
তার কোনো বাবা থাকবে না?
স্বাতী সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, আমার কথা শেষ হয়েছে। বাতি জ্বালাব?
না।
এখনও কি তোমার আমার বিছানায় বসে থাকতে ঘেন্না লাগছে?
রওশন আরা জবাব দিলেন না। স্বাতী বলল, কফি খাবে মা? কফি বানিয়ে আনব?
রওশন আরা সেই প্রশ্নেরও জবাব দিলেন না স্বাতী হাসছে। শুরুতে অস্পষ্টভাবে হাসলেও শেষে বেশ শব্দ করেই হাসতে শুরু করল। সেই হাসির শব্দ পুরোপুরি স্বাভাবিক মানুষের শব্দের মতো না। কোথাও যেন এক ধরনের অস্বাভাবিকতা আছে। রওশন আরা চমকে চমকে উঠছেন। স্বাতী হঠাৎ হাসি থামিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল, মা যাও, ঘুমুতে যাও।
রওশন আরা উঠলেন। প্রায় নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হলেন। নিজের শোবার ঘরে ঢুকলেন। নাজমুল সাহেব বললেন, তুমি কী ঘুমের ওষুধ দিয়ে গেছ কে জানে? এক ফোঁটা ঘুম আসছে না। জেগেই আছি। রওশন আরা জবাব দিলেন না। দরজায় কাছেই দাঁড়িয়ে রইলেন। নাজমুল সাহেব বললেন, এতক্ষণ কী গল্প করছিলে? আশ্চর্য! এসো, ঘুমুতে এসো।
রওশন আরা শোবার ঘরের দরজা লাগিয়ে বিছানায় এলেন আর তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই স্বাতী এসে দরজায় টোকা দিল। করুণ গলায় ডাকল, বাবা!
নাজমুল সাহেব চমকে উঠে বসলেন। বিস্মিত গলায় বললেন, কী হয়েছে মা?
স্বাতী কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, আমার কেন জানি ভয় ভয় লাগছে। বাবা, আমি কি শুধু আজ রাতের জন্য তোমাদের দুজনের মাঝখানে ঘুমুতে পারি? শুধু আজ রাতের জন্য?