জয়নাল সাহেবের মধ্যে জবুথুব ভাব
জয়নাল সাহেবের মধ্যে জবুথুব ভাব চলে এসেছে। তিনি কুঁজো হয়ে মবিনুর রহমানের সামনে বসে আছেন। মবিনুর রহমান তাকিয়ে আছেন টিভির দিকে। টিভিতে নাচের দৃশ্য হচ্ছে। বিশ-পঁচিশটা মেয়ে নাচানাচি করছে। সবার হাতে সাদা ওড়না। শুধু একটি মেয়ের হাতে লাল ওড়না। সেই মেয়েটি মনে হয় নাচের দলের লিডার। তাকে ঘিরেই বাকি মেয়েগুলো নাচছে। টিভিতে কোনো শব্দ হচ্ছে না। জয়নাল সাহেব আড়চোখে মাঝে মধ্যে টিভির দিকে তাকাচ্ছেন। আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে আনছেন মবিনুর রহমানের দিকে। ঠাণ্ডা লেগে তার কাশির ভাব হয়েছে। তিনি কাশতে পারছেন না। তাঁর মনে হচ্ছে কাশির শব্দে মবিনুর রহমান বিরক্ত হবেন। কাশি আটকাতে তার খুবই কষ্ট হচ্ছে।
মবিনুর রহমান ঘাড় ফিরিয়ে জয়নাল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ভালো আছেন?
জয়নাল সাহেব বললেন, জি জনাব। তবে গত রাতে ঠাণ্ডা লেগে কফের মতো হয়েছে। এ ছাড়া ভালো আছি।
কথাগুলো বলে তিনি সামান্য সংকুচিত হলেন। তাঁর জবুথবু ভাব আরো প্রবল হলো। কারণ তিনি মিথ্যা ভাষণ করেছেন। তাঁর ঠাণ্ডা লেগেছে এটা সত্যি তবে তিনি ভালো আছেন এটা সত্যি না। তিনি ডিকশনারিটা হারিয়ে ফেলেছেন। দীর্ঘদিনের সঙ্গী হারিয়ে গেলে মন ভালো থাকে না। ডিকশনারিটা কোথায় হারিয়েছেন তিনি মনে করতে পারছেন না। নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় অসিৗর পথে ডিকশনারি তার হাতে ছিল এটা মনে আছে। তিনি ডিকশনারির পাতা উল্টাচ্ছেন এটাও মনে আছে। তখন একটা শব্দ চোখে পড়ল— Shoddy যার অর্থ Poor quality. শব্দটা পড়ে তিনি কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করেছিলেন এই পর্যন্ত ঠিক আছে। বাস থেকে নামার পথে ডিকশনারি হাতে ছিল কিনা তা আর মনে পড়ছে না। বাস্ থেকে নেমে তিনি কি কি করেছেন ভাবতে শুরু করলেন। সময় কাটুক। কাশি চেপে বসে থাকা ছাড়া তো তার এখন কিছু করার নেই।
বাস থেকে নেমে তিনি রিকশী করে পুলিশ কমিশনার সাহেবের বাড়িতে গেলেন। মইনের সঙ্গে দেখা করা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি ঠিক করে রেখেছিলেন তার স্ত্রী কেয়ার সঙ্গে কথা বলবেন। মেয়েদের মন নরম হয়। একটি মেয়েই অতি দ্রুত অন্য একটি মেয়ের সমস্যা ধরতে পারে। তিনি ঠিক করে রেখেছিলেন নীতুর সমস্যাটা যতদূর সম্ভব গুছিয়ে কেয়াকে বলবেন। আঙুল কাটা লোকমান দশদিন সময় দিয়েছিল। সেই দশদিন আজ শেষ হয়ে যাচ্ছে। যা করার আজকের মধ্যেই করতে হবে। কেয়াকে সমস্যাটা ঠিকমতো বুঝিয়ে দিতে পারলে আর কিছুই লাগবে না। সে তার স্বামীকে চেপে ধরবে। পৃথিবীতে স্ত্রী জাতির ক্ষমতা স্বীকৃত। সিংহাসনে যিনি বসে থাকেন তিনি রাজ্য চালান না। রাজ্য চালান তাঁর স্ত্রী। মোঘল আমলেই এর উদাহরণ আছে। সম্রাট জাহাঙ্গীর সিংহাসনে বসে থাকতেন। সাম্রাজ্য চালাতেন তার স্ত্রী নূরজাহান।
কেয়ার সঙ্গে তিনি দেখা করতে পারলেন না। এই ব্যাপারটাও কিছু রহস্যময়। প্রথমে তাকে বলা হলো ম্যাডাম বাসায় আছেন। কি জন্যে এসেছেন? নাম কী? কেন দেখা করতে এসেছেন এটা আগে বলতে হবে। তিনি সবই বললেন। তখন তাকে গেটে দাঁড় করিয়ে রেখে পুলিশের গার্ড ভেতরে গেল এবং ফিরে এসে বলল, ম্যাডাম বাসায় নেই। আপনে পরে আসুন।
তিনি বললেন, পরে কখন আসব?
পুলিশ গার্ড বলল, সন্ধ্যার দিকে আসুন।
কেয়া কি ইচ্ছা করে দেখা করল না? এটা হতেই পারে না। তার ধারণা পুলিশের গার্ড এখানো কোনো চাল চেলেছে। তার সঙ্গে তর্কে-বিতর্কে না গিয়ে তিনি সন্ধ্যায় আবার যাবেন বলে ঠিক করে শফিকের বাসায় গেলেন। সেখানে গিয়ে শুনেন শফিক বাসা ছেড়ে দিয়েছে। নতুন বাসা নিয়েছে। সেই বাসার ঠিকানা বাড়িওয়ালা জানে না। তিনি শফিকের খোঁজে চলে এলেন মবিনুর রহমানের বাড়িতে। বাড়ির গেট দিয়ে ঢোকার সময় প্রথম লক্ষ্য করলেন হাতে ডিকশনারি নেই। তার বুক ছ্যাৎ করে উঠল।
এই বাড়িতে ঢুকতে কোনো সমস্যা হয়নি। বাড়ির গার্ড তাঁকে সালাম দিয়ে ঢুকিয়ে গেট বন্ধ করে দিয়েছে। শফিকও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর কাছে এসে বলেছে, বাবা তুমি ওপরে যাও। বড় সাহেব তোমার খোঁজ করছেন। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, কেন? শফিক বলল, কেন আমি জানি না।
তিনি বললেন, কোনো ঝামেলা হয়েছে নাকি?
শফিক বলল, কোনো ঝামেলা হয়নি।
তিনি বললেন, চারদিকে এত লোকজন কেন?
শফিক বলল, এখানে সব সময় প্রচুর লোকজন থাকে।
তিনি বললেন, বিরাট একটা ক্ষতি হয়েছে বুঝলি, ডিকশনারিটা হারিয়ে ফেলেছি।
শফিক বলল, ডিকশনারি হারিয়ে ফেলেছ আবার কিনে দেয়া যাবে। তুমি বড় সাহেবের কাছে যাও। উনি খুব ব্যস্ত হয়ে তোমাকে খুঁজছেন।
ততক্ষণে তার চোখে পড়ল বারান্দার এক কোনায় বয়স্ক চশমা পরা এক লোক কানে ধরে উঠবোস করছে। লোকটার চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে। কপাল থেকে টপটপ করে ঘাম পড়ছে।
জয়নাল সাহেব ভীত গলায় বললেন, ঐখানে কী হচ্ছে?
শফিক বলল, শাস্তি দেয়া হচ্ছে।
কাকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে?
ওনার নাম আমজাদ আলি। বড় সাহেব ওনাকে কানে ধরে পঞ্চাশ হাজার বার উঠবোস করতে বলেছেন।
বলিস কী? ঐ বেচারার সঙ্গে কি কথা বলা যাবে?
তার সঙ্গে তোমার কথা বলার কিছু নেই বাবা।
এক গ্লাস পানি খাব। পানি খাওয়াতে পারবি?
এসো আমার সঙ্গে পানি খাওয়াচ্ছি।
জয়নাল সাহেব বললেন, আমি এই কয়দিন কোথায় ছিলাম জানিস? শুনলে তুই অবাক হবি।
শফিক কিছু বলল না। এই ব্যাপারটাও জয়নাল সাহেবকে বিস্মিত করল। শফিক জানতেও চাচ্ছে না এই কয়দিন তিনি কোথায় ছিলেন। আশ্চর্য। শফিকের সঙ্গে নীতুর সমস্যাটা নিয়ে কথা বলা দরকার। কেনো বুদ্ধি কি সে দিতে পারবে না?
মবিনুর রহমান টিভির চ্যানেলে বদলে দিলেন। এখন চলছে ন্যাশনাল জিগ্রাফি চ্যানেল। পেঙ্গুইনদের কাণ্ডকারখানা দেখানো হচ্ছে। একটু আগে একদল মেয়ে নাচছিল এখন একদল পেঙ্গুইন নাচছে। কিংবা তারা হাঁটছে। হাঁটাই নাচের মতো লাগছে।
জয়নাল সাহেব!
জি জনাব।
আপনি কি আতরের গন্ধ পাচ্ছেন?
জি জনাব পাচ্ছি।
আতরটার নাম মেশকে আম্বর। বাবুপুরা এতিমখানার প্রিন্সিপাল মুনসি ইদরিস সাহেব এই আতর দিতেন। আমি কি ওনার কথা আপনাকে বলেছি?
জি না জনাব।
আমি যে এতিমখানায় বড় হয়েছি এটা কি জানেন?
জয়নাল সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, জি না জনাব।
আমি বড় হয়েছি এতিমখানায়। এতিমখানা থেকেই মেট্রিক পাস করি। মেট্রিক পাস করার পর কারোরই এতিমখানায় থাকার নিয়ম নেই। বড় হুজুরের কঠিন নিয়ম, যেদিন রেজাল্ট আউট হবে সেদিনই এতিমখানা ছেড়ে চলে যেতে 61
মবিনুর রহমান সাহেব কথা শেষ করার আগেই জয়নাল সাহেব আগ্রহের সঙ্গে বললেন, মেট্রিকে অপনার কি রেজাল্ট ছিল জানতে পারি?
আমি ফাস্ট ডিভিশন পেয়েছিলাম, দুটা লেটার।
কোন দুই বিষয়ে লেটার পেয়েছিলেন?
অংকে পেয়েছিলাম আর ফিজিক্সে পেয়েছিলাম।
ইংরেজিতে কত নাম্বার ছিল?
মবিনুর রহমান হেসে ফেলে বললেন, আমার মনে নেই। আপনি চাইলে মার্কশিট খুঁজে বের করতে পারি। বের করব?
পরে দেখলেও চলবে। তবে দেখার ইচ্ছা হচ্ছে।
মবিনুর রহমান পকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে বললেন, ডিকশনারি সাহেব আপনি কি সিগারেট খান?
জয়নাল সাহেব বললেন, জি না। তবে আপনার সিগারেট নিশ্চয়ই খুব দামি। এক দুইটা টান দিতে পারি। গতবার যখন এসেছিলাম তখন খেতে ইচ্ছা হয়েছিল লজ্জায় বলতে পারি নাই।
মবিনুর রহমান সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিলেন। নিজেই লাইটার জ্বালিয়ে ধরিয়ে দিলেন। জয়নাল সাহেব এই দ্রতায় মোহিত হলেন।
মবিনুর রহমান বললেন, এখন আমার ইন্টারেস্টিং গল্পটা বলি। মেট্রিকের রেজাল্টের পর আমি এতিমখানা ছেড়ে চলে যাব। বড় হুজুরের পা ছুঁয়ে সালাম করলাম, তিনি আমার হাতে একটা খাম দিলেন। তার নিয়ম ছিল এতিমখানা ছেড়ে চলে যাবার সময় তিনি সবার হাতে একটা করে খাম দিতেন। খামে টাকা থাকত। তখনকার সময় হিসাবে টাকার পরিমাণ বেশ ভালো ছিল { পাঁচ হাজার। টাকাটা তিনি কিভাবে জোগাড় করতেন কে জানে। এতিমখানার আয় বলতে কিছু ছিল না। যাই হোক আমি টাকাটা হাতে নিয়ে বললাম, বড় হুজুর আমার জন্যে একটু দোয়া করেন। আমার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে দেন।
তিনি বললেন, যা ভাগ। আমি কারো জন্যে দোয়া করি না। নিজের দোয়া নিজে করবি।
আমি বললাম, আপনার দোয়া না নিয়ে আমি যাব না।
কি করবি, এখানে দাঁড়িয়ে থাকবি?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
কতদিন দাঁড়িয়ে থাকবি?
আপনি দোয়া না করা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকব। যতদিনই হোক।
তিনি বললেন, এক শর্তে দোয়া করতে পারি। শর্ত তো তুই মানতে পারবি না।
শর্ত মানব।
তিনি বললেন, জীবনে কোনো দিন মিথ্যা বলতে পারবি না। মিথ্যা না বলা হলো সুন্নতে রসূল। এই সুন্নত সারাজীবন পালন করতে হবে। পারবি?
আমি বললাম, পারব।
বড় হুজুর বললেন, পরের শর্তটা আরো কঠিন তবে প্রথম শর্ত পালন করতে পারলে পরেরটা সহজ হয়ে যায়। পরের শর্ত হলো জীবনে কোনো অন্যায় করতে পারবি না।
আমি বললাম, এটাও পারব।
তিনি আমার মাথায় হাত রেখে চোখ বন্ধ করে দোয়া করলেন। দোয়া শেষ করে পাঞ্জাবির পকেট থেকে আতর বের করে তুলা দিয়ে আমার শার্টে খানিকটা লাগিয়ে দিয়ে বললেন, যা ভাগ। চড়ে খা।
বড় হুজুরের এই পাঁচ হাজার টাকা দিয়েই আমার জীবনের অর্থবিত্তের শুরু। গল্পটা কি আপনার কাছে ইন্টারেস্টিং লাগছে?
জি জনাব। আপনার বড় হুজুর কি জীবিত আছেন?
না। আমি এতিমখানা ছেড়ে চলে আসার পরের বছরই তিনি মারা যান।
জয়নাল সাহেব ইতস্তত করে বললেন, আপনাকে একটা প্রশ্ন করার ছিল। প্রশ্ন করার সাহস হচ্ছে না।
মবিনুর রহমান বললেন, আপনার প্রশ্নটা আমি অনুমান করতে পারছি। আপনি জানতে চাচ্ছেন বড় হুজুরের শর্ত আমি পালন করতে পেরেছি কিনা। তাই তো?
জি জনাব।
আমি দুটা শর্তই পালন করতে পেরেছি। এখনো পারছি। আপনি কি আমার কথা বিশ্বাস করেছে?
জি করেছি।
সিগারেট খেয়ে আপনি মনে হয় মজা পাচ্ছেন না। ফেলে দিন।
জয়নাল সাহেব সিগারেট ফেলে দিলেন। মবিনুর রহমান বললেন, আপনার পাঞ্জাবিতে কি একটু আতর লাগিয়ে দেব?
আপনার ইচ্ছা হলে দিন।
মবিনুর রহমান পকেট থেকে আতরের শিশি থেকে খানিকটা অতির জয়নাল সাহেবের পাঞ্জাবিতে লাগিয়ে দিতে দিতে বললেন, আপনি তো এই কয়দিন লায়লার বাড়িতে ছিলেন। আপনি কি জানেন লায়লার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল?
জয়নাল বিস্মিত হয়ে বললেন, জানি না তো?
কেউ আপনাকে বলেনি?
জি না জনাব।
খুব অল্প সময়ের বিয়ে। সাত ঘণ্টা সময়সীমা।
জনাব আমি জানি না। আমাকে কেউ কিছু বলে নাই। ওনার সঙ্গে কি আপনার যোগাযোগ আছে?
না যোগাযোগ নেই। অন্যের স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখাটা বড় হুজুর নিশ্চয়ই ক্ষমা করতেন না। তিনি যদি বেঁচে থাকতেন এবং এই জাতীয় কোনো কিছু তার কানে যেত তাহলে অবশ্যই আমাকে ডেকে বলতেন, পশ্চিম দিকে ফিরে কানে ধরে পঞ্চাশ হাজার বার উঠবোস করো। বলতেন না?
জয়নাল সাহেব কিছু বললেন না। বলার মতো কিছু তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। মবিনুর রহমান খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বললেন, তবে লায়লার সঙ্গে আমার একবার যোগাযোগ হয়েছিল। তার মেয়ের জন্মের পরপরই হঠাৎ একদিন আমাকে মেয়ের জনের সংবাদ দিল এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে সে মেয়ের জন্যে আমার কাছে সুন্দর একটা নাম চাইল। আমার মাথায় তখন কোনো নাম নেই। যেটা মনে এলো সেটাই বলেদিলাম।
জয়নাল সাহেব আগ্রহ নিয়ে বললেন, কী নাম দিলেন?
আমি তার নাম দিলাম আতর।
জয়নাল সাহেব বললেন, ওর নাম নীতু। ভালো নাম শায়রা হক।
মবিনুর রহমান বললেন, আমি জানি তার নাম নীতু এবং তার ভালো নাম শায়রা হক। আমার দেয়া নাম লায়লার পছন্দ হয়নি। পছন্দ হবার কথাও না। আচ্ছা ডিকশনারি বলুন তো হঠাৎ লায়লা কেন আমার কাছে মেয়ের নাম চাইল?
বলতে পারছি না জনাব। অনুমান করে বলুন।
জনাব আমার অনুমান খুবই খারাপ। বুদ্ধিমান মানুষ ভালো অনুমান করতে পারে। আমি বোকা কিসিমের।
মবিনুর রহমান টিভির দিকে তাকিয়ে আবারো দুলতে শুরু করলেন। দুলতে দুলতেই চাপা গলায় বললেন, মাঝে মাঝে আমার কি মনে হয় জানেন? মাঝে মাঝে আমার মনে হয় লায়লার ঐ মেয়েটির বাবা আমি। এই সত্যটি লায়লা তার স্বামীর কাছে গোপন করে গেছে। আমাদের বিয়ে অতি অল্প সময়ের জন্যে হলেও আমরা কিছুক্ষণ একসঙ্গে ছিলাম। আচ্ছা থাক এই প্রসঙ্গ।
জয়নাল সাহেব বললেন, আপনি কি ওনাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন না?
মবিনুর রহমান চেয়ারে দুলতে দুলতে বললেন, পারি না। একলা যখন থাকি প্রায়ই ভাবি লায়লার মেয়েটি আসলে আমার। ভাবলে খুবই আনন্দ হয়। আমি এই আনন্দ নিয়ে আছি ভালো আছি। জিজ্ঞেস করে যখন জানব ঘটনা তা-না তখন কষ্ট পাব। খাল কেটে কষ্ট আনার দরকার কি। বলুন দরকার আছে?
জি না জনাব দরকার নেই।
মবিনুর রহমান বললেন, মুনশি ইদরিস সাহেব আমার জীবন ছারখার করে গেছেন। আমি মোটেই সাধুসন্ত না! সারাজীবন সাধুসন্তের জীবন-যাপন করে গেলাম। অনেকক্ষণ গল্প করলাম, এখন কাজের কথা সারি। আপনাকে আমি খুঁজছিলাম জরুরি কাজে।
জি জনাব বলুন।
অনেক দিন থেকেই আমি বাবুপুরা এতিমখানা চালাচ্ছি। এতিমখানার বর্তমান প্রিন্সিপাল সাহেব অসুস্থ। হাসপাতালে আছেন। আমি একজন নতুন প্রিন্সিপাল খুঁজছি। যিনি বড় হুজুর মুনশি ইদরিস সাহেবের মতো খাটি মানুষ।
জয়নাল সাহেব বললেন, এই যামানায় এমন মানুষ পাওয়া বড়ই কঠিন। মবিনুর রহমান বললেন, কঠিন হবে কেন? ভালো মানুষ, মন্দ মানুষ সব জামানাতেই থাকে। থাকে না?
জি থাকে।
আপনার সন্ধানে কি কেউ আছে?
জি না জনাব।
মবিনুর রহমান বললেন, আপনি নিজেই তো আছেন। আপনি পারবেন না? ছাত্ররা আপনাকে ডাকবে ডিকশনারি হুজুর এটা খারাপ কি?
জয়নাল সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন।
মবিনুর রহমানের দৃষ্টি এখন টিভির দিকে। তিনি একটা হিন্দি চ্যানেল ধরেছেন। পুরনো দিনের কোনো একটা ছবি হচ্ছে। রাজা বাদশারন ছবি। নর্তকী নাচছে। কুৎসিত দর্শন এক প্রৌঢ় মদের গ্লাস হাতে আধশোয়া হয়ে নাচ দেখছে। ক্যামেরা এমন ভাবে ধরা হয়েছে যে প্রৌঢ়ের মুখ দেখা যাচ্ছে নর্তকীর দুপায়ের মাঝখান দিয়ে। মবিনুর রহমানকে দেখে মনে হচ্ছে দৃশ্যটা দেখে তিনি খুব মজা পাচ্ছেন।
লায়লা সকাল থেকেই অপেক্ষা করছেন।
দরজার কড়া নাড়ার শব্দ শোনার জন্যে অপেক্ষা। আগে দরজার কলিংবেল ছিল। বেল টিপলেই বিদেশী গানের সুর বাজত। এখন কলিংবেল নষ্ট। কেউ যদি বেল চাপে কোনো শব্দ হবে না। বাধ্য হয়ে তাকে কড়া নাড়তে হবে। লায়লা এই কড়া নাড়ার শব্দের জন্যেই অপেক্ষা করছেন।
আঙুল কাটা লোকমানের দশ দিনের সময়সীমা শেষ হয়েছে। এখন সে যে কোনো সময় আসবে। লায়লা স্কুলে যাননি। মেয়েকে একা বাসায় ফেলে স্কুলে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। তিনি চেয়েছিলেন মেয়েকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিতে। নীতু রাজি হয়নি। সে মাকে ফেলে যাবে না।
আজ সকাল থেকে লায়লার মনে হচ্ছে তিনি একটা বড় ধরনের ভুল করেছেন। তার উচিত ছিল মেয়েকে সঙ্গে করে পালিয়ে যাওয়া। বাড়ির মায়া করা ঠিক হয়নি। তবে সেটাও সম্ভব হতো না। আঙুল কাটা লোকমানের লোকজন তাদের ওপর নজর রাখছে। তারা এটা হতে দিত না। লোকমানের সব লোকজনকে তিনি চেনেন না তবে একজনকে চেনেন। সে বেশির ভাগ সময় তাঁর বাড়ির সামনের রাস্তার পাশে যে চায়ের দোকান, সেখানে বসে থাকে। একদিন তার সঙ্গে কথাও হয়েছে। সে পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে বলেছে, খালাম্মা কই যান? ইস্কুলে?
তিনি জবাব দেননি। সে হাসি মুখে বলল, কিছু লাগলে বলবেন, আমি আছি।
তিনি বলেছিলেন, কিছু লাগবে না।
সে বলেছে, যখন দরকার হবে বলবেন। টাইম কোনো বিষয় না। আমি রাইতেও এই দোকানে থাকি। আওয়াজ দিলে চলে আসব। আমার নাম তুরা। নামটা মনে রাখেন খালাম্মা— তুরা।
তিনি বলেছিলেন, জানা থাকল।
বিপদে মানুষের বুদ্ধি ভ্রষ্ট হয়। তাঁর কি হয়েছে? হাতে দশদিন সময় পেয়েছিলেন। এই দশদিন কি তিনি নষ্ট করেননি?
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হচ্ছে, লায়লা শান্ত মুখে দরজা খুললেন। আঙুল কাটা লোকমান বা তার কোনো লোকজন না। শফিক দাঁড়িয়ে আছে।
লায়লা বললেন, কেমন আছি শফিক। শফিককে লায়লা সব সময় আপনি করে বলেন। আজ এই সময়ে তাকে দেখে এতই ভাল লাগছে যে তুমি করে বললেন।
শফিক বলল, ম্যাডাম ভালো আছি। আপনাকে একটা খবর দিতে এসেছি। লায়লা বললেন, খবরটা কি দরজা থেকে দেবে না ভেতরে ঢুকবে?
খবরটা দিয়ে চলে যাব ম্যাডাম। আমার জরুরি কাজ আছে। তবে আপনি বললে ঘরে ঢুকব। যতক্ষণ থাকতে বলবেন, থাকব।
খবরটা কী?
স্যার আপনাকে বলতে বলেছেন যেন আঙুল কাটা লোকমান বিষয়ে আপনি যেন কোনো চিন্তা না করেন। তার ব্যবস্থা হয়েছে।
কী ব্যবস্থা হয়েছে?
সেটা তো ম্যাডাম আমি এখনো জানি না। তবে আমি দেখে এসেছি সে স্যারের বাড়ির বারান্দায় বসে আছে। ভয়ে তার কলিজা উড়ে গেছে।
ও আচ্ছা।
ম্যাডাম আমি কি কিছুক্ষণ থাকব না চলে যাব?
এসেই যাই যাই করছ কেন? তোমার এমন কী জরুরি কাজ?
শফিক হাসিমুখে বলল, ম্যাডাম আমার কানে ধরে উঠবোস করার কাজ আছে। ঠিক করেছি একজনের শাস্তি ভাগাভাগি করব।
তোমার কথা কিছু তো বুঝতে পারছি না।
ম্যাডাম আরেক দিন এসে বুঝিয়ে দেব।
লায়লা মেয়ের খোঁজে ছাদে গেলেন।
নীতু ছাদে ফুলের টবে ফুল চাষ করে। সে গাছে পানি দিচ্ছিল। মাকে দেখে চোখ তুলে তাকালে লায়লা বললেন, আতর ঘটনা কি হয়েছে শোন।
নীতু বিরক্ত গলায় বলল, মা তোমাকে অসংখ্যবার বলেছি এই কুৎসিত নামে আমাকে ডাকবে না। আর কারো নাম হয়?
লায়লা বললেন, আচ্ছা যা আর ডাকব না।
নীতু বলল, সরি বলো মা।
লায়লা বললেন, সরি।
লায়লা বললেন, সমস্যার সমাধান হয়েছে।
নীলু বলল, কে করল সমস্যার সমাধান। ডিকশনারি চাচা?
লায়লা জবাব দিলেন না। তিনি মুগ্ধ চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। চৈত্র মাসের মেঘশূন্য আকাশের রোদ খুব কড়া হয়। সেই ঝাঝালো বোদ পড়েছে নীতুর গালে। গাল রোদে পুড়ে যাচ্ছে। কি সুন্দরই না দেখাচ্ছে রৌদ্রময়ীকে।