শফিক কোয়ার্টার পেয়েছে
আগারগাঁয়ের স্টাফ কোয়ার্টারের তিন নম্বর ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাট দেখে মীরা হতভম্ব। শোবার ঘরই চারটা। মেঝেতে টাইলস বসানো। বাথরুম তিনটা। একটায় আবার বাথটাব আছে। রান্নাঘরটাও এত সুন্দর। কিচেন কেবিনেট ঝকঝক করছে। মাছ, তরকারি কোটার জন্যে টেবিলের মতো আছে। টেবিলটা মনে হয় মার্বেলের। মীরার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। সে চোখের পানি সামলাতে সামলাতে নিশোর দিকে তাকিয়ে বলল, বাসা পছন্দ হয়েছে মা?
নিশো বলল, আমাদের ফ্রিজ কোথায়?
মীরা বলল, ফ্রিজ কেনা হবে। যা যা দরকার সবই আস্তে আস্তে কেনা হবে।
নিশো বলল, আমরা কী বড়লোক হয়ে গেছি মা?
মীরা বলল, হ্যাঁ হয়েছি।
মনোয়ারা ফ্ল্যাট বাড়ির নানা খুঁত বের করলেন যেমন একটা বাথরুমের কমোড পশ্চিম দিক করে বসানো। বারান্দা চিপা। রান্নাঘর দক্ষিণে। চুলার ধোয়া শোবার ঘরে ঢুকবে।
মীরা বলল, মা আপনার ফ্ল্যাট পছন্দ হয়নি?
মনোয়ারা বললেন, অন্যের বাড়ির আবার পছন্দ অপছন্দ কী? তুমি এরকম আহ্লাদি করছ যেন নিজের বাড়ি। এখন বলো আমার ঘর কোনটা?
মীরা বলল, যে ঘরটা আপনার পছন্দ আপনি সেই ঘরেই থাকবেন।
বারান্দাওয়ালা ঘরটা আমাকে দিও। সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকলে দম বন্ধ হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে বারান্দায় বসব। আর শোনো তোমার শ্বশুরের জন্যে আলাদা ঘর দাও। ইংরেজিওয়ালাকে নিয়ে এক ঘরে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না।
মীরা দুদিনের মধ্যে ঘর সাজিয়ে ফেলল। জানালায় নতুন পর্দা। বাথরুমে শাওয়ার কার্টেন। বারান্দায় দড়িটানা চিক। শাশুড়ির নামাজের জন্যে নতুন জায়নামাজ। একটা দামি টিসেট কিনল। এক ডজন গ্রাস কিনল। ছয়টা প্লেট কিনল। এই বাড়িতে পুরনো কিছুই মানাচ্ছে না। সব নতুন লাগবে। সব নতুন কেনার টাকা কোথায়?
দুটা খাট এবং একটা সোফাসেট দরকার। এইসব কেনা গেল না। মীরা ঠিক করে ফেলল যেভাবেই হোক সামনের মাসে সে এই দুটা জিনিস কিনবেই। প্রয়োজনে গলার হারটা বিক্রি করবে। তার সব গয়না বিক্রি হয়ে গেছে। এই হারটা শুধু আছে। লুকানো আছে। শফিকও জানে না। জানলে অনেক আগেই বিক্রি হতো। ভাগ্যিস বিক্রি হয়নি। এখন কাজে লাগবে। মানুষ অভাবে পড়লে গয়না বিক্রি করে। সে বিক্রি করবে সুসময়ে।
নিশোর অনেক দিনের শখ মেটানোর জন্য ইনসটলমেন্টে একটা ফ্রিজ কেনা হয়েছে। নিশো সবাইকে বলছে, ফ্রিজটা আমার একার। ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি যদি কেউ খেতে চায় আগে আমাকে বলতে হবে। আমি পানি ঢেলে দেব। আমাকে না বলে কেউ ফ্রিজেও হাত দেবে না।
মীরার ধারণা বাড়ি দেখে আনন্দে যে মানুষটা সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলতেন তিনি নিশোর দাদাজান। তাঁর কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এক রাত ছেলের বাড়িতে কাটিয়ে ভোরে ফজরের নামাজ পড়ে তিনি যে বের হয়েছেন আর বাড়িতে ফিরে আসেননি। আগের হোটেলেও যাননি। শফিক নানা জায়গায় তাকে খোজাখুঁজি করছে। কেউ কিছু বলতে পারছে না। এটা নিয়ে মনোয়ারা মোটেই চিন্তিত না। তিনি মীরাকে বলেছেন, তোমার শ্বশুর কোথায় আছে আমি জানি। তোমরা খামখা অস্থির হয়ো না।
মীরা ভীত গলায় বলল, উনি কোথায় আছেন?
হোটেলে থাকার সময় বাজারের কোনো মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। তার বাড়িতে গিয়ে উঠেছে।
আম্মা এইসব কি বলেন?
পুরুষ জাতিকে আমি চিনি। তুমি চেন না। যেটা বললাম এটাই সত্যি। শফিককে নিষেধ করে দিবে খামখা যেন ছোটাছুটি না করে।
জি আচ্ছা নিষেধ করব।
মীরা এই প্রথম তার নিজের সংসারের জন্যে কাজের মেয়ে রেখেছে। মেয়েটার নাম ফুলি। বয়স বারো-তের। প্রচুর কাজ করতে পারে। তাকে দিয়ে কাজ করানোর সময় মীরার একই সময় একটু লজ্জা লজ্জা লাগে আবার অহংকারও হয়। ফুলিকে সে মাঝে মাঝে উপদেশ দেয়। তখন নিজেকে অনেক বড় মনে হয়। মনে হয় তার অনেক ক্ষমতা।
ফুলি শোন, মন দিয়ে কাজ করবে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবে। অবসর সময়ে আমার শাশুড়ির সেবা করবে। তোমার কিসে ভালো হয় সেটা আমি দেখব। বিয়ের বয়স হোক, ভাল ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দেব। ঠিক আছে?
জি আম্মা ঠিক আছে।
আমাকে আম্মা ডাকবে না। আমাকে ডাকবে আপা আর নিশোর বাবাকে ডাকবে ভাইজান। নিশোকে ডাকবে নিশো মামণি।
আগে মীরার দুপুরে ঘুমের অভ্যাস ছিল না। এখন ঘুমের অভ্যাস হয়েছে। রোজ দুপুরে ফ্যান ছেড়ে মেঝেতে পাটি পেতে সে কিছুক্ষণ ঘুমায়। সেই সময় ফুলি মাথায় তেল দিয়ে চুল টেনে দেয়। আরামে মীরার শরীর অবশ হয়ে আসে। মীরার মনে হয় তার মতো সুখী মেয়ে ঢাকা শহরে নেই।
এর মধ্যে একদিন মীরা বাথটাবে গোসল করেছে। সিনেমায় দেখা দৃশ্যের মতো স্নান। বাথটাব ভর্তি ফেনা মেশানো পানি। সে গলা ড়ুবিয়ে শুয়ে আছে। শরীর ফেনার নিচে রাখতে হচ্ছে কারণ সিনেমার নায়িকাদের মতো তার গায়েও কোনো কাপড় নেই। শুরুতে খুব লজ্জা লাগছিল। পরে আর লাগেনি। মীরা ঠিক করে রেখেছে শাশুড়ি যেদিন থাকবেন না সেদিন শফিককে নিয়ে একসঙ্গে বাথটাবে গোসল করবে। সেদিন নিশোকেও বাড়িতে রাখা যাবে না। কোথাও পাঠিয়ে দিতে হবে। মেয়ে ভীষণ পাজি হয়েছে, সবাইকে বলে দেবে বাবা-মা একসঙ্গে গোসল করেছে। কাজের মেয়েটাকেও সেদিন বাসায় রাখা ঠিক হবে না।
একদিন মঞ্জু মামা এসেছিলেন ফ্ল্যাট দেখতে। তাঁকে ঠিকানা দেয়া হয়নি। তিনি খুঁজে খুঁজে বের করে ফেলেছেন। ফ্ল্যাট দেখে তিনি মুগ্ধ।
মীরা বলল, মামা এগুলি হচ্ছে কোম্পানির থার্ড ক্যাটাগরির ফ্ল্যাট। সেকেন্ড ক্যাটাগরিগুলি আরো অনেক সুন্দর। সব রুমে এসির ব্যবস্থা।
মঞ্জু মামা বললেন, তাহলে ফার্স্ট ক্যাটাগরির ঘটনা কী? কারা থাকে সেখানে?
কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার টাইপের অফিসাররা। ইন্ডিপেনডেন্ট বাড়ি। বাড়ির সামনে লন আছে। ফুলের বাগান আছে। ফুলের বাগানের জন্যে মালি আছে।
বলিস কী? শফিক জেনারেল ম্যানেজার হবে কবে?
মীরা বলল, জানি না কবে হবে। যা হয়েছে এতেই আমি খুশি। আচ্ছা মামা সেকেন্ড হেল্ড এসি কোথায় পাওয়া যায় কত দাম কিছু জানো? ভাবছি একটা এসি লাগাব। ও গরমে ঘুমাতে পারে না। কষ্ট করে। অফিসে সারাদিন পরিশ্রম করে। রাতে ঘুম দরকার।
এসি লাগাবি যখন নতুন লাগা। আমি খোঁজ-খবর করে দেখি কোন কোম্পানি ভালো।
মীরা গাঢ় গলায় বলল, দেখো খোঁজ নিয়ে।
তোদের টেলিফোন আছে না? নাম্বার দে নিয়ে যাই।
নাম্বার এখনো লাগেনি মামা। এক সপ্তাহের মধ্যে লাগবে।
বাথরুম কয়টা?
তিনটা বাথরুম। বাথটাব আছে। হট ওয়াটারের সিস্টেম আছে।
কথাগুলি বলে মীরা কি যে আনন্দ পাচ্ছে। টাকা ধার করার জন্যে কতবার উনার কাছে যেতে হয়েছে। একবার সে দুই গাছি সোনার চুড়ি নিয়ে গিয়েছিল। মঞ্জু মামা যদি কোথাও চুড়ি বন্ধক রেখে কিছু টাকার ব্যবস্থা করতে পারেন। মামা চুড়ি রাখেননি। চুড়ি তার হাতে পরিয়ে দিয়েছিলেন। চুড়ি পরানোর সময় কি বিশ্রীভাবেই না হাত ধরলেন। তখন মীরার ইচ্ছা করছিল মঞ্জু মামাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে। সে সরিয়ে দিতে পারেনি। তার টাকার দরকার ছিল। টাকা খুবই বড় জিনিস।
মঞ্জু মামা।
বল।
তুমি কিন্তু আজ দুপুরে খেয়ে যাবে। আমাদের নতুন কাজের মেয়ে ফুলি নাম। তার বয়স অল্প হলেও রাধে ভালো। কি খেতে চাও মামা বলো। পোলাও রাধব?
গরমের মধ্যে পোলাও করবি? আচ্ছা ঠিক আছে। তোর শ্বশুর-শাশুড়িকে এখন কাছে এনে রাখ। বিরাট বাড়ি।
বাবা-মাতে আমাদের সঙ্গেই থাকেন। তাদের আলাদা ঘর আছে।
তারা কোথায়?
আমার শাশুড়ি নিউ মার্কেটে গেছেন নিশোকে নিয়ে। নিজে পছন্দ করে বিছানার চাদর কিনবেন।
তোর শ্বশুর কই?
উনি কোথায় জানি গিয়েছেন।
বাসা খালি?
কাজের মেয়েটা আছে।
মীরা লক্ষ্য করল মঞ্জু মামা এক-দৃষ্টিতে তার নাভির দিকে তাকিয়ে আছেন। মীরা ঠিক করে ফেলল সে বাথরুমে ঢুকে শাড়িটা আরেকটু নিচু করে পরবে। যাতে মঞ্জু মামা ভালোমতো নাভি দেখতে পারেন। মীরা তার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াবে যাতে মঞ্জু মামা তার পেটে হাত রাখতে পারেন। তখন মীরা কষে একটা চড় লাগাবে। চড় খাবার পর মামার মুখের ভাব কেমন হয় এটা মীরার অনেক দিনের দেখার শখ।
মঞ্জু মামা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, তুই কাছে এসে বস গল্প করি। তোর শ্বশুর থাকলে ভালো হতো। জমিয়ে গল্প করতে পারতাম। ইন্টারেস্টিং মানুষ।
গত চারদিন ধরে জয়নাল সাহেব নারায়ণগঞ্জে আছেন। লায়লার এক তলা বাড়ির ছাদের ঘরে তাঁকে থাকতে দেয়া হয়েছে। তিনি আনন্দে আছেন। ছাদের ঘরটা বেঙ্গল হোটেলের ২৩ নম্বর ঘরের চেয়ে ছোট। জানালাও ছোট। তবে জানালা খুললে আকাশ দেখায়। তার ঘরে কোনো সিলিং ফ্যান নেই। নীতু টেবিল ফ্যান ফিট করে দিয়েছে। ফ্যানে প্রচুর হাওয়া হয়। শেষ রাতে তাকে চাদর গায়ে ঘুমুতে হয়। নীতু লায়লার মেয়ে। জয়নাল সাহেবের ধারণা নীতুর মতো রূপবতী মেয়ে বাংলাদেশে আর একজনও নেই।
রূপবতীরা অহংকারী হয়। তিনি এই মেয়ের মধ্যে অহংকারের অ এখন পর্যন্ত পাননি। তার ধারণা এই মেয়েকে দশে দশ চোখ বন্ধ করে দেয়া যায়। নীতু তাঁকে ডাকে ডিকশনারি চাচা। দিনের মধ্যে সে বেশ কয়েকবার ছাদে আসে। জয়নাল সাহেবের ঘরে টোকা দিয়ে বলে, ডিকশনারি চাচা দরজা খুলুন আপনার সঙ্গে ঝগড়া করতে এসেছি। এই মেয়ে ঝগড়া করার নানা অজুহাত নিয়ে আসে। জয়নাল সাহেবের বড়ই মজা লাগে। নীতুর সঙ্গে তাঁর সর্বশেষ ঝগড়া হয়েছে নীতুকে দশে দশ দেয়া নিয়ে।
ডিকশনারি চাচা আপনি আমাকে দশে যেন কত দিয়েছেন?
দশে দশ।
আমি ছাড়া আর কেউ কি আপনার কাছে দশে দশ পেয়েছে?
শফিক পেয়েছে।
শফিক কে?
আমার ছেলে।
নিজের ছেলে বলে দশে দশ দিয়েছিলেন।
মাগো শফিক খুবই ভালো ছেলে।
সব বাবা-মার কাছে নিজের ছেলে খুবই ভালো। যে ছেলে প্রতিদিন ফেনসিডিলি খায় তার বাবাও বলে, আমার ছেলের ঐ একটা দিক সামান্য খারাপ। ঐটা ছাড়া তার মতো ছেলে হয় না। ডিকশনারি চাচা আপনার ছেলে কি ফেনসিডিল খায়?
আরে না ফেনসিডিলি খাবে কেন?
অবশ্যই খায়। আপনি জানেন না। আপনার ছেলে তো আর আপনাকে জানিয়ে খাবে না। আসুন লজিকে আসুন। আপনার ছেলে কি আপনাকে জানিয়ে ফেনসিডিলি খাবে, মদ খাবে?
তা খাবে না। তবে খেলে আমি টের পেতাম।
কিভাবে টের পেতেন। আপনি তো ছেলের সঙ্গে থাকেন না। আপনি থাকেন হোটেলে। যে ছেলে বাবাকে হোটেলে ফেলে রাখে তাকে আপনি কীভাবে দশে দশ দেবেন?
আমার ছেলে তো আমাকে হোটেলে ফেলে রাখে নাই। আমি নিজের ইচ্ছায় হোটেলে থাকি। যখন সে বড় বাসা নিবে তখন তার সঙ্গে থাকব।
আপনার ছেলে কি হোটেলে প্রতি সপ্তায় আপনাকে দেখতে যেত?
তা যেত না। কাজেকর্মে থাকে, প্রতি সপ্তাহে আসা তো সম্ভব না। মাসে একদুবার করে আসত।
অসুস্থ বৃদ্ধ বাবা হোটেলে একা পড়ে থাকে তাকে দেখার জন্যে যে ছেলে আসে মাসে একবার তাকে কি দশে দশ দেয়া যায়? ডিকশনারি চাচা আপনি তাকে নতুন করে নাম্বার দিন।
তুমিই দাও গো মামা।
আমি তাকে দিলাম দশে তিন। ফেল মার্ক। গ্রেস দিয়েও তাকে পাস করাতে পারবেন না। ঠিক আছে?
ঠিক আছে।
এখন আপনি নিচে আসুন। আমার এক বান্ধবী এসেছে রুমা নাম। তার সঙ্গে আমার একশ টাকা বাজি হয়েছে। সে দশটা কঠিন কঠিন ইংরেজি শব্দ লিখে এনেছে। আপনি যদি দশটা শব্দের মানে বলতে পারেন রুমা বাজিতে হারবে। আর যদি একটা মিস করেন আর্মি হারব। তখন আমাকে একশ টাকা দিতে হবে। সেই টাকা আমি দেব না। আপনি দেবেন।
আমার কাছে একশ টাকা নাই গো মা।
আপনি আপনার দশে তিন পাওয়া ছেলের কাছ থেকে এনে দেবেন। আপনি চাইলে সে আপনাকে একশ টাকা দেবে না?
তা দিবে।
তাহলে আসুন দেখি। আর শুনুন রুমা বাজিতে হারলে যে একশ টাকা দেবে তার পুরোটাই আপনার।
আমার টাকা লাগবে না মা।
অবশ্যই লাগবে, আপনার হাত খালি না?
নীতুর সঙ্গে যতবারই তাঁর কথা হয় ততবারই মনে হয় যার সঙ্গে এই মেয়ের বিয়ে হবে সে হবে পৃথিবীর সৌভাগ্যবান পুরুষদের একজন। অতি রূপসীদের বিয়ে হয় না সেই কারণে নীতুর বিয়ে নাও হতে পারে এটা নিয়েও জয়নাল সাহেব চিন্তিত। এই মেয়েটির বিয়েতে তিনি উপস্থিত থাকতে চান এবং পুরনো দিনের মতো একপাতার ছাপা উপহার দিতে চান। উপহার লেখা হবে ইংরেজিতে। তিনি নিজেই লিখবেন। কয়েকটা লাইন ইতিমধ্যেই মাথায় এসেছে–
An Angel was she
For her Greetting from me.
Her happy wedding today
And I want to say,
No one is like she.
নীতুর বিয়ে নিয়েই সমস্যা। এখানকার এক ওয়ার্ড কমিশনার নীতুকে বিয়ে করতে চাচ্ছে। তার নাম লোকমান। সবার কাছে সে পরিচিত আঙুল কাটা লোকমান নামে। ছুরি চালাচালি করতে গিয়ে তার বাঁ হাতের দুটা আঙুল কাটা পড়েছে বলেই এই নাম। আগে সে আওয়ামীলীগের বিরাট কর্মী ছিল। বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর কঠিন বিএনপি হয়েছে। বিএনপির টিকেটে ইলেকশন করে ওয়ার্ড কমিশনার হয়েছে।
আঙুল কাটা লোকমান লায়লার কাছে নিজেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। লায়লার পা ছুঁয়ে সালাম করে অতি বিনয়ের সঙ্গে বলেছে— খালাম্মা আপনার মেয়েকে বিবাহ করতে চাই। কোনো জোর-জবরদস্তি না। আপনার অনুমতি এবং দোয়া নিয়ে বিবাহ। আপনার মেয়ে সুন্দরী? তার প্রটেকশান দরকার। প্রটেকশান না দিলে দেখা যাবে কোনো দিন কে মুখে এসিড মেরে দিয়েছে। আমি তখন আটকাতে পারব না। আপনাকে চিন্তাভাবনা করার সময় দিলাম খালাম্মা। ভালোমতো চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিবেন। বিবাহের যাবতীয় খরচ আমার। মেয়ের নামে আমি একটা বাড়ি লেখাপড়া করে দিব। আপনিও মেয়ের সঙ্গে থাকবেন। এই আমার শেষ কথা। দশদিন পরে আবার এসে আপনার সিদ্ধান্ত শুনব। যদি কোনো বেয়াদৰি করে থাকি তার জন্য ক্ষমা চাই। আঙুল কাটা লোকমান লায়লার পা ছুঁয়ে সালাম করে বিদায় হলো।
দশদিন পার হতে আর মাত্র তিন দিন বাকি। লায়লা ভেঙে পড়েছেন। নীতুর ঘর থেকে বের হওয়া নিষেধ। সে চব্বিশ ঘণ্টাই ঘরে থাকে।
জয়নাল সাহেব ঘটনা সবাই শুনেছেন। তিনি যে লায়লাদের সঙ্গে থাকছেন তার প্রধান কারণ এটাই। একটা পরিবারকে এমন অসহায় অবস্থায় রেখে তিনি চলে যেতে পারেন না। বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না যে এদের টাকাপয়সাও নেই। নীতুর বাবা মৃত্যুর আগে ধারদেনা করে শুধু এই বাড়ি বানিয়ে যেতে পেরেছেন। এই বাড়ি নিয়েও সমস্যা। একজন পুরনো দলিল বের করেছে। দলিলে দেখা যাচ্ছে যে জমিতে এই বাড়ি সেই জমি তার। অন্যের জমিতে জবরদখল করে বাড়ি করা হয়েছে। এই নিয়ে কোর্টে মামলা চলছে। লায়লা একা কোর্ট-কাচারি করছেন। স্কুলে যাচ্ছেন। সপ্তাহে তিন দিন বাড়িতে ছাত্র পড়াচ্ছেন। তারপরেও দিনে আনি দিনে খাই অবস্থা।
লায়লা জয়নাল সাহেবকে বলছেন, ডিকশনারি ভাই আপনি যে কয়েকদিন আমার এখানে আছেন তাতে আমার মেয়ে যেমন খুশি আমি তার চেয়েও খুশি। বুকে ভরসা হয় যে একজন কেউ মেয়েটার সঙ্গে আছে। স্কুলে যখন যাই সারাক্ষণ বুক ধড়ফড় করে মেয়েটা বাসায় একা।
জয়নাল সাহেব বলেছেন, আপনি মেয়ের বিষয় নিয়ে একেবারেই চিন্তা করবেন না। আমি সব ফয়সালা করে তারপর যাব। তার আগে না।
লায়লা বিস্মিত হয়ে বলেছেন, আপনি কীভাবে ফয়সালা করবেন?
জয়নাল সাহেব তৃপ্তির হাসি হেসে বলেছেন, ঢাকা সাউথের পুলিশ কমিশনার আমার ছাত্র। আমাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করে। তার নাম মইল। তার স্ত্রীর নাম কেয়া। ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে জিওগ্রাফিতে মাস্টার্স করেছে। তাদের একটাই ছেলে ছেলের নাম টগর। সানবিম নামের একটা ইংরেজি স্কুলে পড়ে। অতি বুদ্ধিমান ছেলে। আমি শুধু মইনকে ঘটনাটা জানাব। আঙুল কাটা লোকমান পায়ে ধরে কূল পাবে না।
লায়লা হতাশ গলায় বলেছেন, পুলিশ এইসব ক্ষেত্রে কিছুই করে না।
জয়নাল সাহেব বলেছেন, আপনি ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দেন। দেখেন পুলিশ কিছু করে কিনা। আমি মইনকে সাথে করে নিয়ে আসব। সে ফেরত যাবে আঙুল কাটা লোকমানকে নিয়ে।
আপনার কাছে পৃথিবীটা এত সহজ?
সহজ তো অবশ্যই।
আপনি ছাত্রের কাছে কবে যাবেন?
যেতেও হবে না আমি টেলিফোন করলেই ঘটনা ঘটে যাবে। যে কোনো একটা ফোন-ফ্যাক্সের দোকান থেকে টেলিফোন করব তার দুই ঘণ্টার মধ্যে দেখবেন বাসার সামনে পুলিশের গাড়ি। মইনের টেলিফোন নাম্বার আমার মুখস্থ। মোবাইল নাম্বারও আছে আবার টিএন্ডটির নাম্বারও আছে।
তাহলে দেরি করছেন কেন? টেলিফোনটা করে ফেলুন।
জয়নাল সাহেব টেলিফোন করেছিলেন। পুলিশ কমিশনার মইন টেলিফোন ধরেছেন এবং শীতল গলায় বলেছেন, স্যার এইসব ঝামেলায় আপনি জড়াবেন না। আপনি কথা শুনুন, ঢাকায় চলে আসুন।
ঢাকায় চলে আসব?
অবশ্যই! আপনি বৃদ্ধ মানুষ আগ বাড়িয়ে ঝামেলায় যাবেন কেন?
এদেরকে এইভাবে ফেলে রেখে চলে আসব?
অবশ্যই।
পুলিশ কিছুই করবে না। তাহলে তোমরা পুলিশরা আছ কী জন্যে?
স্যার পুলিশ কি করবে না করবে সেটা নিয়ে আপনার সঙ্গে তর্কে যাব না।
তুমি আমার ছাত্র না হলে তোমাকে একটা খারাপ কথা বলতাম। ছাত্র এবং পুত্র এই দুই শ্রেণীকে কখনো কোনো খারাপ কথা বলা যায় না।
আমাকে খারাপ কোনো কথা বললে যদি আপনার ভালো লাগে তাহলে খারাপ কথা বলুন। শুধু দয়া করে আমার কথাটা শুনুন— ঐ বাড়ি ছেড়ে চলে আসুন। আঙুল কাটা লোকমান ভয়ংকর সন্ত্রাসী। সে আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
জয়নাল সাহেব লায়লাকে বলতে পারেননি যে পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। তিনি ব্যাপারটা গোপন রেখেছেন। তবে তাঁর মাথায় অন্য একটা পরিকল্পনা এসেছে। মা-মেয়ে দুজনকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া।
শফিকের বাসায় নিয়ে তুলবেন। ভয় মনোয়ারাকে নিয়ে। একবার যদি তার মুখ ছুটে যায় তাহলে সে কি বলবে না বলবে তার ঠিক নেই। আরেকটা বুদ্ধি আছে— তার বড় মেয়ে সুরমার কাছে নিয়ে যাওয়া। সুরমা অতি ভালো মেয়ে। বিপদগ্রস্ত একটা পরিবারকে সে দূরে ফেলে দেবে না।
জয়নাল সাহেব বাজির পরীক্ষা দিচ্ছেন। রুমা নামের মেয়েটা কঠিন কঠিন শব্দই কাগজে লিখে এনেছে। সে যাই আনুক কোনো সমস্যা জয়নাল সাহেবের নেই। সবই তাঁর মুখস্থ। তারপরও একেকবার রুমা শব্দের অর্থ জিজ্ঞেস করলে তিনি চিন্তিত ভঙ্গি করেন। যেন শব্দের অর্থ তার মনে পড়ছে না এই কাজটা তিনি করছেন নীতু এবং তার মার জন্যে। তারা দুজনই টেনশানে মরে যাচ্ছে। মামেয়ে দুজনের ভাব এ রকম যেন তিনি শব্দের অর্থ না পারলে পরাজয়টা তাদের।
নটি শব্দের অর্থ বলা হয়েছে। দশ নাম্বার শব্দ। এটা পারলেই রুমা বাজিতে হারবে। জয়নাল সাহেব লক্ষ্য করলেন টেনশানে মা-মেয়ে দুজনই ঘামছে। তারা কি ধরেই নিয়েছে দশ নম্বর শব্দের অর্থ তিনি পারছেন না।
রুমা বলল, চাচা শেষ শব্দ— Garet.
জয়নাল সাহেব বললেন, মা Garet শব্দের মানে হলো বাড়ির মাথায় ছোট্ট ঘর। চিলেকোঠা। আমি এখন যে ঘরে থাকি সেই ঘর। মাগো তুমি কি বাজিতে হেরেছ?
রুমা বলল, জি চাচা।
নীতু এবং লায়লা দুজনের মুখেই বিজয়ীর হাসি। যেন দশটা শব্দের অর্থ মামেয়ে দুজনে মিলেই দিয়েছে।
মবিনুর রহমান বারান্দায় বসে আছেন। শফিক তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে। সে অনেকক্ষণ ধরেই দাঁড়িয়ে আছে। মবিনুর রহমান তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন; কিন্তু কিছু বলছেন না। একবার শফিকের মনে হলো স্যার বোধহয় ভুলে গেছেন যে শফিক সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। শফিক বুঝতে পারছে না সে কি তার উপস্থিতি বোঝানোর জন্যে কোনো কিছু করবে? স্যারের চোখ বন্ধ। একেকবার তিনি যখন চোখ বন্ধ রাখেন অনেকক্ষণের জন্যে বন্ধু রাখেন।
মবিনুর রহমান বললেন, তোমার বাবার কোনো খোঁজ পাওয়া গেছে বাবুল?
শফিক বলল, জি না স্যার।
হোটেলে খোঁজ নিয়েছিলে?
জি স্যার।
উনি কি মাঝে মাঝে উধাও হন।
জি কয়েকবার হয়েছেন।
আমিও সেরকমই ভেবেছিলাম। তুমি যদি তোমার বাবার কোনো খোঁজ পাও তাকে বলবে যেন আমার সঙ্গে দেখা করেন।
জি স্যার বলব।
আমজাদ আলির শাস্তি কি বন্ধ আছে?
স্যার ওনার শরীর খারাপ। পা ফুলে পানি এসে গেছে।
মবিনুর রহমান পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন— আমজাদ তার শাস্তি শেষ করতে পারবে বলে মনে হয় না। টিমে তেতালায় উঠবোস করলে চলবে কীভাবে? দিনে একশবার করে করলে তার লাগবে পাঁচশ দিন। প্রায় দেড় বছর। বাবুল হিসাব ঠিক আছে?
জি স্যার।
আমজাদ আলিকে বলে দাও সময়সীমা বেঁধে দিচ্ছি— চার মাস। তাকে চার মাসে শেষ করতে হবে। আজই তার বাসায় খবর পাঠিয়ে দেবে।
জি স্যার।
তোমার সঙ্গে কাগজ-কলম আছে?
জি স্যার আছে।
এখন অন্য একটা হিসাব করো। যেসব কাজ আমি তোমাকে করতে বলেছি এবং তুমি করোনি তার তালিকা।
শফিক অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। বড় সাহেব তাকে কোনো কাজ দিয়েছেন সে করেনি এমন কিছু সে মনে করতে পারছে না।
মবিনুর রহমান বললেন, লেখো এক নাম্বার তোমাকে ডাল রান্না করতে বলেছিলাম। করোনি।
দুই নাম্বার, করলা ভাজি নিয়ে একটা কথা বলেছিলাম। তুমি করলা ভাজি খাবে আমি দেখব। সেটা করোনি।
তিন নাম্বার, আমি বলেছিলাম তোমার মেয়ে নিশোকে আমার কাছে নিয়ে এসো। তুমি আনোনি।
চার নাম্বার, লায়লার সঙ্গে যাতে যোগাযোগ রাখতে পারো তার জন্যে তোমাকে চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে গাড়ি দিয়েছিলাম তুমি একবার মাত্র গিয়েছ। তাও সে যখন তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছে। ঠিক বলেছি বাবুল?
জি স্যার।
আমার কাজ করার জন্যে তুমি যে আনফিট তা কি বুঝতে পারছ?
শফিক চুপ করে আছে। মবিনুর রহমান আগের মতো মাথা দুলাচ্ছেন। হঠাৎ দুলানো বন্ধ করে বললেন, তুমি তোমার বাবার খোঁজ লায়লার কাছে পাবে বলে আমার ধারণা। লায়লা রান্না করে তাকে তরকারি পাঠিয়েছে। শিং মাছের ডিম। তোমার বাবা যে রকম মানুষ তিনি ধন্যবাদ দেয়ার জন্যে অবশ্যই লায়লার কাছে যাবেন। আমি যদি শুনি তিনি লায়লার অতিথি হয়ে ঐ বাড়িতেই বাস করছেন আমি মোটেই অবাক হব না।
শফিকের শরীর ঝিমঝিম করছে। সে নিশ্চিত এই অর্ধউন্মাদ মানুষ কানে ধরে উঠবোসের ব্যাপারটা তাকে দিয়েও করাতে চাইবে। এটা তার এক ধরনের খেলা। এই বৃদ্ধ তাকে নিয়ে অবশ্যই খেলতে চাইবে। তার জন্যে এটাই স্বাভাবিক।
বাবুল।
জি স্যার।
কোম্পানির ফ্ল্যাটে উঠেছ শুনলাম। ফ্ল্যাট পছন্দ হয়েছে?
জি স্যার।
তোমার স্ত্রীর পছন্দ হয়েছে?
জি স্যার।
তোমার স্ত্রীর নাম যেন কী?
মীরা।
ও হা মীরা। তোমার এবং তোমার কন্যার নাম মনে রাখার জন্যে একটা ব্যবস্থা করেছিলাম বলে তাদের নাম মনে আছে। তোমার স্ত্রীর নাম রাখার কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি বলে তার নাম প্রতিবার জিজ্ঞেস করতে হয়। আচ্ছা বাবুল শোনো, যারা আমার জন্যে কাজ করে আমি তাদের জন্যে অনেক কিছু করি। ঠিক না?
জি স্যার।
কখনো কি ভেবেছ কেন করি?
শফিক চুপ করে রইল। মবিনুর রহমান শান্ত গলায় বললেন, আমার যেহেতু কেউ নেই— যারা আমার কাছে তাদেরকেই আপনজন মনে করি। আমি মনে করি তাদেরকে নিয়েই আমার সংসার। এতিমখানায় যখন ছিলাম তখন এতিমখানার সবাইকে আমার সংসার মনে হতো। এখন বুঝেছ?
জি স্যার।
এতিমখানায় আমি একবার একটা বড় অন্যায় করেছিলাম। আমাদের হুজুর মুন্সি ইদরিস আলি আমাকে দশ হাজার বার পশ্চিম দিকে ফিরে কানে ধরে উঠবোস করতে বললেন। সময় বেঁধে দিলেন— তিন দিন। আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তখন কী হলো জানো? এতিমখানার সবাই এগিয়ে এলো। তারা শাস্তি শেয়ার করবে। বড় হুজুর তাতে রাজি হয়েছিলেন। ইন্টারেস্টিং না?
জি স্যার।
তুমি ক্যাশিয়ার সোবাহানকে বল, আমজাদ আলির হয়ে অন্য কেউ যদি শাস্তি নিতে চায় আমি তাতে রাজি আছি। সেই ক্ষেত্রে শাস্তির পরিমাণ কমাতেও পারি। এখন তুমি আমার সামনে থেকে যাও। যাবার আগে সেলফোনটা দিয়ে যাও। একটা জরুরি টেলিফোন করব।
মবিনুর রহমান টেলিফোনে ফজলু নামের একজনকে ধরলেন। মবিনুর রহমান বললেন, ফজলু একটা কাজ করে দিতে হয় যে।
ফজলু বলল, স্যার কাজটা বলেন।
আজ সন্ধ্যার মধ্যে একজনকে আমার সামনে উপস্থিত করবে। তার নাম লোকমান। লোকে ডাকে আঙুল কাটা লোকমান। নারায়ণগঞ্জের আঙুল কাটা লোকমান।
স্যার আমি সন্ধ্যার আগেই তাকে উপস্থিত করব।
মবিনুর রহমান টেলিফোন রেখে দিলেন।