Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সেদিন চৈত্রমাস || Humayun Ahmed » Page 5

সেদিন চৈত্রমাস || Humayun Ahmed

মঞ্জু মামা চেয়ারে পা তুলে

মঞ্জু মামা চেয়ারে পা তুলে আয়েশ করে বসে আছেন। তিনি সহজে যাবেন মীরার এ রকম মনে হচ্ছে না। সে শংকিত বোধ করছে। রাত আটটা বাজে, যে কোন সময় শফিক এসে উপস্থিত হবে। মঞ্জু মামাকে দেখে সে আহ্লাদিত বোধ করবে এ রকম মনে করার কোনো কারণ নেই। অথচ একটা সময় ছিল যখন শফিক তাকে পাঠাত মঞ্জু মামার কাছে। টাকা ধার করে আনতে। তখন কি শফিক জানতো না প্রৌঢ় চিরকুমারদের সাধারণ যেসব ত্রুটি থাকে এই মানুষটির সেসব ত্রুটি আছে। ভালমতোই আছে। টাকা দেবার সময় পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করা কিংবা হঠাৎ গালে হাত দিয়ে বলা তোর গালে এটা কি? ব্রণ না-কি?

কি সেন্ট মেখেছিসরে? সুন্দর গন্ধ তো বলে নাক বুকের কাছাকাছি নিয়ে আসা। মানুষটার সাহস কম বলে মীরা অল্পতে পার পেয়েছে। শফিক এইসব কিছুই জানে না। তারপরেও কিছু নিশ্চয়ই অনুমান করে।

মঞ্জু পান চিবুচ্ছেন। পানের রস ঠোঁট বেয়ে নিচে নামছে। তিনি ঝোল টানার মতো পানের রস টানছেন। এই কাজটা করতে গিয়ে আনন্দ পাচ্ছেন বলেও মনে হচ্ছে। এক্ষুণি মানুষটাকে চলে যেতে বলা উচিত। ভদ্রভাবে এই কাজটা সে কিভাবে করবে ভেবে পাচ্ছে না। মীরা বলল, মামা তুমি আমাদের কাছে কত টাকা পাও বল তো?

মঞ্জু হাঁটু দুলাতে দুলাতে বললেন, কেন টাকাটা দিয়ে দিবি?

দেব। নিশোর বাবা ঋণ শোধ করা শুরু করেছে।

তোর কি ধারণা তোর কাছে টাকা ফেরত নিতে এসেছি?

সে রকম ধারণা না। জানার জন্যে বললাম। একসঙ্গে সব টাকা দিতে পারব না। ভাগ ভাগ করে দিতে হবে।

তোদর মনে হয় অনেক টাকা হয়েছে।

মামা ও বেতন ভাল পাচ্ছে।

ভাল মানে কী? কত টাকা বেতন?

মীরা বলল, মাসে বিশ হাজার করে পাচ্ছে।

মীরা একটু বাড়িয়ে বলল। বেতন আসলে পনেরো হাজার। বিশ হাজার বলে তার ভাল লাগছে। এতই ভাল লাগছে যে চোখ ভিজে আমার মতো হয়ে যাচ্ছে। মঞ্জুর চোখে একটু যেন সন্দেহের ছায়া, বিশ হাজার টাকা বেতন? বলিস কি?

অফিস থেকে তাকে একটা গাড়িও দিয়েছে। ফুলটাইম গাড়ি। আমাদের তো গ্যারেজ নেই। গাড়ি রাস্তায় থাকে। ড্রাইভার গাড়িতে ঘুমায়।

সত্যি বলছিস?

তোমার সঙ্গে মিথ্যা বলব কেন মামা?

এখনো এক রুমের বাসায় পড়ে আছিস কেন? নতুন বাসা নে।

বাসা খুঁজে বেড়াচ্ছি, পছন্দমতো পাচ্ছি না। আমাদের দরকার তিন রুমের ফ্ল্যাট। একটাতে আমরা থাকব। একটাতে শ্বশুর-শাশুড়ি থাকবেন। আরেকটা গেস্ট রুম।

গেস্ট রুমটা সুন্দর করে সাজাবি। আমি এসে মাঝে মধ্যে থাকব।

অবশ্যই থাকবে।

তুই বললে আমি বাসা খুঁজে দিতে পারি।

তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। ও কোম্পানি থেকে ফ্ল্যাট পাবে এ রকম সম্ভাবনাও আছে। ঐ সব ফ্ল্যাট খুবই ভাল। ফার্নিশও। কোনো ফার্নিচার কিনতে হবে না। টিভি, মাইক্রোওয়েভ সব আছে।

তোরা তো মনে হয় আলাদীনের চেরাগ পেয়ে গেছিস।

একটু দোয়া কর মামা। বিয়ের পর থেকে বেচারা অনেক কষ্ট করেছে।

প্রথম জীবনে কষ্ট করলে শেষ জীবনে আরাম হয়। এই আমাকে দেখ। কষ্টও তেমন করিনি আরামও তেমন পাইনি। সারাটা জীবন সমান সমান পার করে দিলাম। শফিক আসবে কখন? তাকে কনগ্রাচুলেশান্স দিয়ে যেতাম।

মামা ওর আসতে অনেক দেরি হবে।

অসুবিধা নেই আমি বসি। আমার কাজকর্ম তো কিছু নেই। এখানে বসে থাকাও যা নিজের বাড়িতে বসে থাকাও তা। চা বানা, এক কাপ চা খাই। রং চা। পত্রিকায় পড়েছি রং চা হার্টের জন্যে ভাল।

মীরা লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, চা আরেক দিন খেও মামা। আমি এখন শাশুড়িকে দেখতে যাব। শুনেছি ওনার শরীর খারাপ করেছে।

এত রাতে যাবি কিভাবে?

মামা আমি ব্যবস্থা করব তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।

আমি পৌঁছে দিয়ে যাই।

মামী কোন দরকার নেই।

মঞ্জু নিতান্তই অনিচ্ছার সঙ্গে উঠলেন। মীরার মনে হলো তার মাথা থেকে বিরাট বোঝা নেমে গেছে। বেশ কিছুদিন থেকেই শফিকের মেজাজ খারাপ যাচ্ছে। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া করছে। নতুন ঝগড়া শুরু করার মতো সুযোগ তৈরি করা ঠিক হবে না। মঞ্জু মামা এসেছিল এই ব্যাপারটা তাকে না জানালেই হবে। ছোট্ট সমস্যা একটা আছে। নিশো। সে কথায় কথায় বলে দিতে পারে। সে কি নিশোকে মঞ্জু মামার বিষয়ে কিছু বলতে নিষেধ করবে? তাকে নিষেধ করা মানে মনে করিয়ে দেয়া। এমনিতে হয়তো কিছু বলবে না, নিষেধ করা হলেই বলবে।

মীরা নিশোর জামা বদলাতে গেল। নিশো বলল, আমরা কি কোনখানে যাচ্ছি?

মীরা বলল, হ্যাঁ যাচ্ছি।

কোথায় যাচ্ছি মা? দাদিমাকে দেখতে?

প্রথমে দাদিমাকে দেখতে যাব সেখান থেকে যাব চাইনিজ রেস্টুরেন্টে। তোমার বাবা আজ আমাদের বাইরে খাওয়াবে।

কেন?

আমরা অনেক দিন বাইরে খাই না তো এই জন্যে।

মা আমরা কী অনেক বড়লোক হয়ে গেছি?

হ্যাঁ হয়েছি।

তাহলে আমাদের বাসায় ফ্রিজ নেই কেন?

ফ্রিজের ব্যবস্থা হবে। সামনের মাসেই হবে। মা একটা কথা মন দিয়ে শোন— আজ যে মঞ্জু মামা আমাদের বাসায় এসেছিলেন এটা বাবাকে বলবে না।

বলব না কেন?

আমি নিষেধ করেছি এই জন্যে বলবে না। ছোট মেয়েদের মার কথা শুনতে হয়।

আচ্ছা বলব না।

প্রমিজ?

প্রমিজ। বাবা কখন আসবে মা?

এক্ষুণি চলে আসবে।

এক্ষুণি মানে কখন?

উফ মা। তুমি এত কথা বল কেন?

গাড়ি চড়ে নিশো খুবই উত্তেজিত। সে চোখ বড় বড় করে বলল, বাবা এটা কি আমাদের নিজের গাড়ি?

মীরা বলল, এটা তোমার বাবার অফিসের গাড়ি।

নিশো বলল, এখন থেকে এই গাড়ি কি আমাদের সঙ্গে থাকবে?

মীরা বলল, আমাদের সঙ্গেই তো থাকে।

স্কুলে যাবার সময় থাকে না কেন? স্কুলে আমি রিকশা করে যাই কেন?

তোমার স্কুলে যাবার সময় তো গাড়ির দরকার নেই। যখন প্রয়োজন হবে তখন গাড়ি পাবে।

কখন প্রয়োজন হবে?

এই যেমন আজ প্রয়োজন হয়েছে। আমরা তোমার দাদুমণির বাসায় বেড়াতে যাচ্ছি। সেখান থেকে একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে যাব।

আমি কিন্তু স্যুপ খাব না।

বেশ তো খাবে না। যেটা তোমার খেতে ইচ্ছা করবে খাবে।

নিশো তার বাবার দিকে ঝুঁকে এসে বলল, আমরা কি অনেক বড়লোক হয়ে গেছি বাবা?

শফিক জবাব দেবার আগেই মীরা বলল, এত কথা বলবে না তো মা। গাড়িতে এত কথা বলতে নেই।

গাড়িতে এত কথা বললে কী হয়?

মীরা বলল, এসি গাড়ি। দরজা-জানালা বন্ধ। কথা বললে কথা কানে বেশি বাজে। মাথা ধরে।

আমার তো মাথা ধরেনি।

আমাদের ধরেছে। আমার ধরেছে। তোমার বাবার ধরেছে।

আচ্ছা তাহলে আর কথা বলব না।

নিশো চুপ করে গেল। শফিক বলল, তোমার মেয়ে তো কথাকুমারী হয়ে গেছে। সুন্দর গুছিয়ে কথা বলা শিখেছে।

মীরা বলল, গুছিয়ে কথা বলার জন্য ও যে সিনেমার অফার পেয়েছে সেটা তো তোমাকে বলা হয়নি।

শফিক বলল, সিনেমায় অফার পেয়েছে মানে কী?

আমরা গার্জিয়ানরা তো সবাই স্কুলের বাইরে অপেক্ষা করি। একজন গার্জিয়ান গত সোমবার আমাকে বললেন, আপনার মেয়ে দেখতে খুবই সুন্দর। কুট কুট করে কথা বলে, ওকে সিনেমায় দেবেন? ঐ ভদ্রমহিলার ভাই ফিল্ম মেকার। তিনি একটা ছবি বানাচ্ছেন। ছবির নাম ঝরা বকুল। তিনি একজন শিশু শিল্পী খুঁজছেন। যে ঝরা বকুলের নায়িকার বোন। নায়িকার সঙ্গে তার একটা গান আছে।

তুমি কী বলেছ?

বলাবলির কী আছে? আমার মেয়ে সিনেমা করবে নাকি?

শফিক হালকা গলায় বলল, শুনে তো আমার কাছে ইন্টারেস্টিং লাগছে।

তুমি কি চাও মেয়ে সিনেমা করুক? তুমি চাইলে আমি ওনার সঙ্গে আলাপ করতে পারি।

শফিক জবাব দিল না। নিশো মার পাশে জানালার দিকে বসেছিল সেখান থেকে উঠে এসে বাবার কোলে বসল।

মীরা বলল, আজ আমার খাটনি অনেক বাঁচল।

শফিক বলল, খাটনি বাঁচল মানে কি?

সেজেগুজে বের হয়ছি। তোমার জন্যে নিশি রাতে সাজতে বসতে হবে না।

শফিক বলল, সাজতে ভাল লাগে না? আমার তো ধারণা সব মেয়ে সাজতে পছন্দ করে।

মীরা বলল, আমিও সাজতে পছন্দ করি; কিন্তু একটা বিশেষ কারণে সাজছি ভাবতে ভাল লাগে না।

আচ্ছা আর সাজতে বলব না।

মীরা বলল, আমার অভ্যাস হয়ে গেছে, তুমি না বললেও আমি সাজব।

নিশো বলল, মা তুমি আমাকে কথা বলতে নিষেধ করেছ আমি কথা বলা বন্ধ করেছি। তুমি কিন্তু কথা বলেই যাচ্ছি। এটা কি ঠিক হচ্ছে?

মীরা বলল, এটা ঠিক হচ্ছে না। আমরা আর কথা বলব না।

চাইনিজ রেস্টুরেন্টে তো কথা বলতে কোন সমস্যা নেই। তাই না মা?

না সেখানে কোন সমস্যা নেই।

আমি কিন্তু স্যুপ খাব না মা।

একবার তো বলেছ সুপ খাবে না বারবার বলার দরকার নেই। আমার মনে আছে।

শফিক বলল, প্রচণ্ড ক্ষিদে লেগেছে। আজ আর মাকে দেখতে যাবার দরকার নেই। চলো সরাসরি রেস্টুরেন্টে যাই।

মীরা বলল, তুমি যা বলবে তাই হবে। তবে মাকে দেখতে গেলে মা খুশি হতেন।

শফিক ছয় মাস পর এই প্রথম সবাইকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে এসেছে। প্রতিজ্ঞা করেই এসেছে সে হাসিখুশি থাকবে। উঁচু গলায় কথা বলবে না। মেজাজ থাকবে পুরো কনট্রোলে। এই প্রতিজ্ঞার পেছনের কারণ হলো যতবারই সে রেস্টুরেন্টে খেতে এসেছে মীরার সঙ্গে কোন একটা ঝামেলা হয়েছে। মীরা মাঝ পথে খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আজ তার জন্মদিন উপলক্ষে খাওয়া। এতে কোনো ঝামেলা হওয়া উচিত না। শফিককে অনেক সাবধান থাকতে হবে।

আজো মনে হয় ঝামেলা হবে। আজকের সমস্যা শুরু করেছে নিশো। সে বলেছিল স্যুপ খাবে না। এখন সে এক বাটি স্যুপ নিয়েছে। স্যুপ নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। মুখে দিচ্ছে না। শফিক এবং মীরার সুপের বাটি শেষ হয়েছে। শফিক যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষুধার্ত। খাবার ঠাণ্ডা হচ্ছে; কিন্তু সে কিছু মুখে দিতে পারছে না। কারণ নিশো ঘোষণা করেছে তাকে বাদ দিয়ে কেউ অন্য কিছু খেতে পারবে না। সে যখন স্যুপ শেষ করে রাইস নেবে তখন অন্যরা নেবে। তার আগে না।

শফিকের মেজাজ যথেষ্ট খারাপ হয়েছে। সে কিছু বলছে না। একটা সিগারেট ধরালে কিছু সময় পার করা যেত। সিগারেট ধরানো যাচ্ছে না তারা বসেছে নো স্মোকিং জোনে। শফিক যখন ঠিক করল বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টেনে আসবে তখনি তার পকেটের মোবাইল বাজল। মবিনুর রহমান টেলিফোন করেছেন।

শফিক বলল, স্যার। স্নামালিকুম স্যার।

আজ সারাদিন তোমার দেখা পাইনি, কী ব্যাপার বলো তো?

স্যার আমি নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিলাম।

কেন?

লায়লা ম্যাডাম আমাকে যেতে বলেছিলেন। ওনার কাছে আমার মোবাইল নাম্বার দিয়ে এসেছিলাম। উনি টেলিফোন করেছিলেন।

বাবুল কয়টা বাজে বলো তো?

স্যার নয়টা চল্লিশ বাজে।

রাত তাহলে বেশি হয়নি। আমি ভেবেছিলাম দশটা সাড়ে দশটা বাজে।

স্যরি নয়টা চল্লিশ বাজে।

তাহলে একটা কাজ কর। চলে আস।

জি আচ্ছা স্যার।

কতক্ষণে আসতে পারবে?

স্যার আমি খেতে বসেছি। খাওয়া শেষ করেই চলে আসব।

শফিক টেলিফোন পকেটে রাখতে চাপা গলায় বলল— কার্টুন বুড়া।

নিশো কৌতূহলী হয়ে বাবার দিকে তাকাল। কিছু বলল না। মীরা বলল, তোমার স্যার টেলিফোন করেছেন?

শফিক থমথমে গলায় বলল, হুঁ।

যেতে বলেছেন?

হুঁ?

কেন?

তোমার জানার দরকার কী? এত কৌতূহল কেন?

ওনাকে গালাগালি করছিলে কেন? বাচ্চাদের সামনে গালাগালি করা ঠিক না। বাচ্চারা এই সব দেখে শিখবে।

কার্টুনটাকে কার্টুন বলব না তো কী বলব? দুলাভাই বলে কোলে বসিয়ে রাখব?

এইসব কী? এই ধরনের কথা কী তোমার মুখে মানায়? ছিঃ।

ছিঃ ছিঃ করবে না। একটা স্পাইলনেস জেলি ফিশ। সারাক্ষণ মাথা দুলাচ্ছে, থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিতে পারলে…

মীরা সহজ গলায় বলল, তুমি ওনাকে একেবারেই পছন্দ করো না। কেন করো না সেটা তুমি জানো। গধু নব ওনার প্রচুর আছে তোমার কিছুই নেই এই হীনম্মন্যতা থেকে অপছন্দটা এসেছে। আমার কাছে কিন্তু মানুষটাকে যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে।

শফিক বলল, ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে কেন? তুমি তাকে দেখেছ? নাকি তার সঙ্গে কথা বলেছ?

আমি তাকে দেখিনি, কথাও বলিনি। যা শোনার তোমার কাছে শুনেছি।

আমার কাছে শুনেই তোমার ধারণা হয়ে গেল উনি খুবই ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার। কী এমন আমি বলেছি?

মীরা বলল, রেগে যাচ্ছ কেন? এসো ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলি। রেগে যাবার মতো কিছু হয়নি।

শফিক বলল, ঠিক আছে রাগছি না। ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলছি। আমাকে এক্সপ্লেইন করে কি করে তোমার ধারণা হল ঐ বুড়ো ইদুর মারাত্মক ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার! তোমাকে প্রমাণ করতে হবে।

মীরা নরম গলায় বলল, যারা প্রচুর অর্থ উপার্জন করে তারা কখনো অর্থ উপার্জন বন্ধ করতে পারে না। কখনো অবসর নিতে পারে না। অথচ এই মানুষটা একটা পর্যায়ে এসে অর্থ উপার্জন বন্ধ করেছেন। অবসর জীবনযাপন করছেন। তার মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্যে বিয়ে হয়েছিল সেই স্ত্রীকে তিনি ভুলে যাননি। মাঝে মাঝে ঝুড়ি ভর্তি আম পাঠান। আমি কি ভুল বলছি?

ভুল বলছ না। সবই শুদ্ধ বলছ। সমস্যা হচ্ছে বেশি শুদ্ধ বলছ।

তুমি মানুষটাকে গোড়া থেকেই অপছন্দ করে বলে উনি যাই করেন তোমার খারাপ লাগে। তোমার জায়গায় আমি হলে কি করতাম জানো? আমি মানুষটাকে বোঝার চেষ্টা করতাম।

শফিক কঠিন গলায় বলল, এক কাজ করি, আমি চাকরি ছেড়ে দেই। তুমি চাকরিটা নাও। বুড়োকে বোঝার চেষ্টা করো। বুড়ো আমার মতো হবে না। তোমাকে রাতে সাজতে বলবে না। বিনা সাজেই বিছানায় নিয়ে যাবে। পাশাপাশি ঘুমুলে তাকে বুঝতে অনেক সুবিধা হবে। দ্রুত বুঝে ফেলতে পারবে। তারপর একটা বইও লিখে ফেলতে পারবে– মবিনুর রহমানের সঙ্গে সাত রাত। মীরা চুপ করে গেল। তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। এখন তার প্রধান চেষ্টা চোখের পানি আটকানো।

নিশো বলল, বাবা তোমাদের ঝগড়া কি শেষ হয়েছে? ঝগড়া শেষ হলে এসো আমরা খাওয়া শুরু করি। আমি এই স্যুপ আর খাব না।

শফিক ঠিক মতোই খেল। মীরা খেতে পারল না। চামচ দিয়ে সে শুধু খাবার নাড়াচাড়া করল।

শফিক বলল, খেতে না চাইলে খাবে না। চামচ নিয়ে টুং টাং জলতরঙ্গ বাজানোর কিছু নেই।

মীরা প্লেটে চামচ রেখে চোখ মুছল। সে মোটামুটি নিশ্চিত ছিল আজ কোন ঝগড়া হবে না। সময়টা আনন্দে কাটবে। সুন্দর উৎসবের কি অদ্ভুত সমাপ্তি।

মবিনুর রহমান চাদর গায়ে বসে আছেন। তার ধারণা জ্বর এসেছে। থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মাপা হয়েছে। জ্বর পাওয়া যায়নি। বরং দেখা গেছে গায়ের তাপ স্বাভাবিকের চেয়ে একটু নিচে। হয়তো এটাও খারাপ। তার সামান্য শ্বাসকষ্টও হচ্ছে। এই সমস্যা আগেও ছিল। শরীর খারাপ করলে কিংবা কোনো কারণে অস্থির বোধ করলেই শ্বাসকষ্ট হয়। ডাক্তারদের ধারণা ব্যাপারটা মানসিক ও শ্বাসকষ্ট নাকি সাইকেসিমেটিক ডিজিজ। কোনো কারণে মনে চাপ পড়লে শ্বাসকষ্ট হয়।

তাঁর ধারণা ডাক্তারদের কথা ঠিক না। শ্বাসকষ্টের সমস্যাটা হচ্ছে দুর্বল ফুসফুসের কারণে। ছোটবেলায় অনেকবার তার ফুসফুসে পানি ঢুকেছে। ফুসফুস তখনই নষ্ট হয়েছে।

মবিনুর রহমানের হাতে পানির গ্লাস। তিনি কিছুক্ষণ পরপর বরফ শীতল পানিতে চুমুক দিচ্ছেন, শ্বাসকষ্ট তখন কিছু কম হচ্ছে। এই বিষয়টা ডাক্তারকে বলতে হবে।

শফিক তাঁর সামনে বসে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে চিন্তিতবোধ করছে। কি নিয়ে চিন্তা করছে জানতে পারলে ভাল হতো। ভবিষ্যতে মানুষ এমন কোনো যন্ত্র কি বের করতে পারবে যা দিয়ে মনের কথা বুঝা যায়? যত টাকাই লাগুক এ রকম একটা যন্ত্র তিনি কিনতেন। যন্ত্র কানে লাগিয়ে বসে থাকতেন। তার সামনে লোকজন আসত-যেত। তিনি কারো সঙ্গেই কোনো কথা বলতেন না।

শফিক।

জি স্যার।

এখন বলো লায়লা তোমাকে কি জন্যে ডেকেছিলো।

তিনি আমার বাবার জন্যে কিছু খাবার দিয়ে দিলেন।

কী খাবার?

শিং মাছের ডিম। ঐদিন বাবা কথায় কথায় বলেছিলেন তাঁর সবচে পছন্দের খাবার শিং মাছের ডিম। অনেক দিন তিনি এটা খান না। মাঝে মধ্যে খুব খেতে ইচ্ছা করে।

লায়লা কি বলেছিল যে সে শিং মাছের ডিম রান্না করে খাওয়াবে?

জি না স্যার বলেননি।

সে শিং মাছের ডিম রান্না করে পাঠিয়ে দিল কেন? সে কেন বলল না তুমি তোমার বাবাকে নিয়ে এসে পছন্দের খাবার খেয়ে যাও।

জানি না স্যার।

কারণটা তো খুব সহজ তুমি জানো না কেন?

স্যার কারণটা সহজ হলেও আমি ধরতে পারছি না। আমার বুদ্ধি কম।

কারণটা তোমাকে বলি– তোমার বাবাকে সে যদি দাওয়াত করে শিং মাছের ডিম খাওয়াতে তাহলে ব্যাপারটা হতে অনেক আইটেমে একটা পছন্দের আইটেম। আর এখন কি হল—– শিং মাছের ডিমটা অনেক বেশি গুরুত্ব পেল। জিনিসটা রান্না হলো নারায়ণগঞ্জ। একজন ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ গিয়ে জিনিসটা সগ্রহ করে আবার ঢাকায় ফিরে গেল।

স্যার ম্যাডাম হয়তো এত চিন্তা করে কিছু করেননি।

বাবুল শোনো মানুষ আলাদাভাবে গালে হাত দিয়ে চিন্তাভাবনা করে কিছু বের করে না। চিন্তার ব্যাপারটা সব সময় হতে থাকে। বেশির ভাগ সময় মানুষ এটা বুঝতে পারে না। এখন বলো তোমার পছন্দের খাবার কী?

আমার আলাদাভাবে তেমন পছন্দের কোনো খাবার নেই।

কয়টা বাজে?

স্যার এগারোটা বাজে।

আচ্ছা তুমি যাও।

শফিক ঘর থেকে বের হতে গিয়ে দরজায় ধাক্কা খেল। ধড়াম করে শব্দ হলো। স্বাভাবিক রিফ্লেক্স একশানে মানুষ শব্দের দিকে ফিরে তাকাবে। মবিনুর রহমান ফিরে তাকালেন না। মূর্তির মতো বসে রইলেন।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress