সেকালের টেলিভিশন
দুর্লভ জিনিষের প্রতি মানুষের চাহিদার অন্ত নেই। সেকালের টেলিভিশন সেটকে দুর্লভ বস্তুর তালিকায় আনলে খুব একটা ভুল হবে না। কয়েকটি পাড়ার মধ্যে মাত্র দু-তিনটি টেলিভিশন ছিল। মুষ্টিমেয় কয়েকজন ধনী লোকের বাড়ীতে। কার সেকালে এই ইলেকট্রনিক সেটের দাম ছিল প্রচুর। তাই দুর্লভ।
আমাদের গ্রামের সত্যনারায়ণ প্রসাদ নামে এক ধনী ব্যবসায়ী এই দুর্লভ বস্তুটি সর্বপ্রথম তার বাড়ীতে কিনে আনেন। তখন আমি খুব ছোট। সবার মুখে শুনতে পেয়ে একদিন একা একা সেই দুর্লভ বস্তুটি দেখার চেষ্টা করলাম। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দোতালার বারান্দায় দেখতে পেলাম সেই বস্তুটি। একখানা বাক্সের মত। সামনে নীল রঙের কাচ। টিভির সামনে লোকের ভিড় নেই। বুঝতে পারলাম টিভি এখন বন্ধ। অনেকক্ষণ এক দৃষ্টিতে টিভির নীল রঙের কাচের দিকে চেয়ে থেকে কি এক বিচিত্র অনুভূতি নিয়ে বাড়ী চলে এলাম। লোকের মুখে শুনতে পেলাম সেই সত্যনারায়ণ প্রসাদ অন্যসব দর্শকের নিকট থেকে মাথা পিছু ২৫ পয়সা করে আদায় করতেন। কিন্তু কিছু দিন পর লোকনিন্দার ভয়ে তিনি এই পয়সা আদায় করা বন্ধ করে দিলেন। তবে গৃহস্থের অতি গাম্ভীর্যপূর্ণ ব্যবহারে লোকজন মনক্ষুন্ন হয়ে দিনের পর দিন তার বাড়ীতে ভীড় কমাতে লাগলেন। মানুষ গরীব হলেও আত্মসম্মান বোধটুকু খোয়াতে চায় না।
টিভি দেখার চাহিদা আমারও খুব একটা ছিল না। কখনও বাবার সঙ্গী হিসেবে আবার কখনও দাদার সঙ্গী হিসেবে টিভি দেখার অভ্যাস হতে লাগল। সেই সময় রবিবার দিন সকাল নয়টায় ‘রামায়ণ’ ধারাবাহিক শুরু হতো। রামায়নের বিভিন্ন বর্ণনা আমাদের পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত থাকায় এই ধারাবাহিকটি একদিকে যেমন শিক্ষামূলক অন্যদিকে ছিল এক অভূতপূর্ব মনোরঞ্জনের উপকরণ। সেই থেকেই এই দুর্লভ বস্তুটি প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গী হতে লাগল।
টেলিভিশনের নির্ধারিত অনুষ্ঠানটুকু মনের মাঝে যে কিরূপ অনুভূতির সৃষ্টি করত তা বলে বুঝানো যাবে না। রবিবারের ‘ সকালটি ‘ পাড়ার সকল সমবয়সী বালকদের কাছে এক উৎসবের সকাল বলে মনে হতো। উৎসবটা এই যে সকলে মিলে একসঙ্গে বসে একটি মনোনিত টিভি অনুষ্ঠান উপভোগ করা। কিন্তু কার বাড়ীতে দেখতে পাব সে যে বড় প্রশ্ন চিহ্ন। আমরা বালকবৃন্দ একত্রিত হয়ে কোন এক গৃহকর্তার বাড়ীর সীমানায় ধৈর্য সহকারে দাঁড়িয়ে থাকতাম এই ভেবে যে সময় মত দরজা খুলে দিলে আমরা ঐ টিভির সামনে বসতে পারি। আজকের দিনের মত নিশ্চিতভাবে অনুষ্ঠানটুকু দেখার সৌভাগ্য খুব কম ছিল। কখন যে টিভির এন্টেনা ঘুরে যেত তা বলা কঠিন। তৎক্ষণাৎ গৃহকর্তা ঘরের বাইরে গিয়ে এন্টেনার দিক্ ঠিক করতে সচেষ্ট হতেন। কিন্তু কোন মতেই টিভির পর্দা থেকে ঝিরঝির দূর হত না। এভাবেই অনেকদিন বহু আকাঙ্খিত অনুষ্ঠানের সময় পার হয়ে যেত। সপ্তাহের একটি দিনের আনন্দ স্নান হয়ে যেত। টিভির কোন অনুষ্ঠান একার ছিল না। প্রতিটি অনুষ্ঠান একরাশ ঘরভর্তি লোকের ছিল। ক্ষুদে দর্শকদের জন্য ঘরের মেঝেতে বড় চটের ব্যবস্থা করা হতো যেন সবাই বসে দেখতে পায়। এতটা মনযোগের সঙ্গে সবাই টিভির পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকত যে কেউ ‘টু’ শব্দটি পর্যন্ত করতে পারত না। সম্মানিত ব্যক্তিদের জন্য চেয়ার ও বিছানার উপরের জায়গা নির্ধারিত ছিল। তাদের মুখ থেকে অনুষ্ঠানের বিশেষ ঘটনার প্রতিক্রিয়া শুনে আমরা অনায়াসে তার সারমর্ম বুঝতে পারতাম।
বাড়ীর বড়রাই ঠিক করত কোন অনুষ্ঠান দেখতে হবে। তাদের নিয়ন্ত্রণও ছিল বেশ শক্ত। আজকালতো বাড়ীর ছোটদের জিদের উপর অনুষ্ঠান নির্বাচিত হয়। ছোটদের শাসন করার চাবিকাঠি অনেকাংশেই খর্ব হয়েছে। বর্তমানকালে তো রিমোট কন্ট্রোল-এর অত্যাধুনিক ব্যবস্থা থাকায় বাড়ীর বাচ্চাকাচ্চারাও যখন তখন অনুষ্ঠান পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়। শুধু তাই নয় এই রিমোটের সাহায্যে বড়দের অনেক মনোনিত অনুষ্ঠানও বাঞ্চাল করতে সক্ষম হয়। আর যদি দৈবাৎ কোন কার্টুন অনুষ্ঠান টিভির পর্দায় দেখা গেল তাহলে সেই অনুষ্ঠান পরিবর্তনের শতচেষ্টাও ব্যর্থ হয়ে যায়।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর এক সন্ধ্যায় আমাদের বাড়ীতে টিভির সেট্ এল। সে যে কি আনন্দ। কি বিচিত্র অনুভূতি। মুহূর্তের মধ্যে প্রতিবেশীর ঘরে পৌঁছে গেল এখবর। দলে দলে আমাদের বাড়ীতে লোকের ভীড় হতে লাগল। মনে হল বাড়ীতে নূতন বৌ এসেছে। ক্রমেই বাড়ীতে প্রতিবেশীদের আসা যাওয়া বেশ বেড়েই চলতে লাগল ।
প্রাসঙ্গিক এক ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়।তখন গ্রীষ্মকাল । আমরা রাত্রে খাওয়া দাওয়া সেরে পড়তে বসেছি মাত্র। এমন সময় আমাদের বাড়ীর প্রবেশদ্বারে ভীষণ ধাক্কানোর শব্দ শুনতে পেলাম। দাদা জিজ্ঞেস করল :
— কে?
উত্তর এলো : আমি মন্টি (সাত/আট বছরের মেয়ে। কয়েকটি বাড়ী পেরিয়ে তাদের ঘর।)
— কেন দরজা খুলতে বলছিস ?
আমি টিভি দেখব । দরজা খোল ।
— তুই কর সঙ্গে এসেছিস ?
আমি একা।
দাদা স্তম্ভিত হয়ে বলে উঠল : তুই জানিস এখন রাত কটা বাজে?
মেয়েটি বুঝতে পারেনি যে রাত দশটা বেজে গেছে।আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ । চারিদিকে শুভ্র জ্যোৎস্না ।কোথাও অন্ধকারের লেশমাত্র নেই। তাছাড়া মেয়েটি বোধহয় এইমাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। তাই সময় ঠিক করতে না পেয়ে মনের আনন্দে একা একা রাত দশটার সময় টিভি দেখতে চলে এসেছে। মেয়েটি কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইছে না যে এখন রাত হয়েছে। অবশেষে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে দরজা না খুলেই তাকে তাদের ঘরে ফিরে যেতে বাধ্য করা হল।সেই সঙ্গে আগামীকাল দিনের বেলায় তাকে টিভি দেখার নিমন্ত্রণ করা হল ।
আজ প্রায় সবার ঘরে ঘরে রঙিন টিভির সেট রয়েছে।কিন্তু সেই দিনের টিভি দেখার নির্মল আনন্দ কি আজও ততটুকু আছে ?