সেই বিভৎস সময়
সেই বিভৎস সময়ের কথা কবিতা আজও ভুলতে পারেনা। কীভাবে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আসতে হয়েছিল ভিটেমাটি ছেড়ে। বাপ মা ভাইয়ের সঙ্গে থাকতো বাংলাদেশের শ্রীহট্ট জেলার তারাপুর এস্টেটের বাড়িতে। তাদের নিজস্ব বিশাল চা বাগান ছিল।প্রায় পাঁচশো বিঘা জুড়ে। প্রচুর লোক বাগানে কাজ করতো। ছিলো রাধাকৃষ্ণের মন্দির। নিত্যদিন অন্নভোগ দেওয়া হতো ঠাকুরকে। সমৃদ্ধির অন্ত ছিল না, যেন রাজপরিবার। বাবা ধুমধাম করে বিয়ে দেন চাটার্ড একাউন্টেট পাশ ছেলের সঙ্গে। বিয়ের পর চলে যায় লন্ডনে। দুবছর পর সে একাই আসে বাপের বাড়ি থাকতে। তখন সে গর্ভবতী।
এর মধ্যে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ভাষা আন্দোলনের বিক্ষোভ সাথে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা আলাদা রাষ্ট্র দাবি করে। বিক্ষোভ চলাকালীন পাকিস্তান শাসক দমননীতি চালায়। খান সেনাদের অত্যাচারে অধুনা বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজ্যে দমন পীড়ন শুরু হয়। তারপর তা যুদ্ধের রূপ নেয়। সর্বক্ষণ মেশিনগানের গুলিবর্ষণ। বাড়ির পুরুষদের তুলে নিয়ে পরিবারের সামনে গুলি করে মেরে ফেলা, নারী ধর্ষণ, বিবস্ত্র করে অত্যাচার, শিশু, তরুণদের খুন সব চলছে। এক রক্তিম বীভৎসতা। রক্তের হোলি খেলা যেন হচ্ছে দেশে। সুরমা নদীর জল রক্তে লাল। কাতারে কাতারে লাশ ভাসছে। বাতাস পুঁতি গন্ধময় , বারুদের গন্ধ নাকে জ্বালা ধরায়। একদিন রাতের বেলায় তাদের বাড়িতে হানা দেয় খান সেনা। দরজা ভেঙ্গে ঢুকে পড়লো তারা। তুলে নিয়ে গেলো তারা বাবা, দাদা, কাকা ও খুড়তুতো ভাইকে। তাঁদের খবর আর পাওয়া যায়নি, বডিও মেলেনি। প্রচুর কর্মকর্তাকে গুলিতে ঝাঁঝরা করলো। তাঁর দাদু সব মেয়েদের বললো আমি ওদের দরজা বন্ধ করে আটকে রাখছি যতক্ষণ পারি। তোমরা পিছনের দরজা দিয়ে চা বাগানের মধ্যে দিয়ে যেভাবে পারো পালিয়ে যাও। তাঁরা তৎক্ষণাৎ সম্ভ্রম ও প্রাণ বাঁচাতে বেরিয়ে পড়ে অন্ধকারে। কিছুদূর যেতেই দাদুর আত্ম চিৎকারে বুঝতে পারে দাদুকে অত্যাচার করা হচ্ছে। নিরুপায় তারা প্রাণপণে জীবনের সন্ধানে চা বাগানে হামাগুড়ি দিয়ে সাপ, জংলি জানোয়ারের ভয় তুচ্ছ করে পালাতে থাকে।
সিলেট তথা শ্রীহট্ট অনুচ্চ টিলা অঞ্চল। সেখান থেকে লুকিয়ে কখনো টিলা কখনো সমতল এইভাবে দৌড়ে পালিয়ে কোনোরকমে শিলচরে এসে পৌঁছায়। ভিটেমাটি ছেড়ে জীবনের সন্ধানে তখন শরণার্থীর ভিড় ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে। ভারত সরকারও সাহায্যে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। কবিতা স্বজনদের সঙ্গে পরে কোলকাতার উপকণ্ঠে সল্টলেকে চলে আসে সরকারি লোক মারফৎ। বর্তমানে সল্টলেক অভিজাত এলাকা। কিন্তু ১৯৭১ সালে এটা বিশাল নিম্ন জলাভূমি। এখানে শরনার্থীদের শিবির স্থাপন করা হয় সেইসময়। কোনোরকমে মাটি ভরাট করে সরকার বাস্তুহারাদের থাকার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু এই জলাভূমিতে পায়খানা তৈরী করা সম্ভব ছিল না।কারণ, মাটি খুঁড়লেই জল উঠতো। তাই পায়খানার জন্য জলাধারের পাশেই সকলে সেই ক্রিয়া করতো। একই জলাশয়ে স্নান, মলত্যাগ, শৌচকার্য , খাওয়ার জলের উৎস্য।
বৃষ্টি বাদলের দিনে তো কথাই ছিলো না, সব মিলেমিশে ভয়ংকর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। এমন পরিবেশে অনেকেই আন্ত্রিক রোগের স্বীকার হয়ে মারা যায়। কবিতাও অসুস্থ হয়ে পড়ে। প্রচন্ড পেটে ব্যাথায় শিবিরের লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে তারও চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়। শরীরের উপর এত অত্যাচার, অনিয়ম, অপুষ্টির ফলে তার পেটের সন্তান মারা যায়। সে মৃত সন্তান প্রসব করে। পরিস্থিতির একটু স্থিতাবস্থা এলে, তার স্বামী অনেক কষ্টে ভারতীয় ভিসা করে এসে তাকে নিয়ে যায়। তার বাপ ভাইদের খোঁজ শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। মা-কাকীমারা আত্মীয় স্বজনদের সাহায্যে অন্যত্র বসতি স্থাপন করে।