শতাব্দী যায় গড়িয়ে
—-সময়-সমুদ্রের সামান্য একটা ঢেউ ।
হে কালের অধীশ্বর
অন্য মনে তুমি কি থাক ভুলে ?
পৃথিবী আবর্ত্তিত অন্ধ নিয়তির চক্রে ।
মানুষের ইতিহাস হিংসার বিষে ফেনিল ।
ক্ষুব্ধ যারা, লুব্ধ যারা, মাংসগন্ধে মুগ্ধ যারা
একান্ত আত্মার দৃষ্টিহারা, শ্মশানের প্রান্তচর
আর্বজনা-কুণ্ড ঘিরে, বীভত্স চীত্কারে’
নির্লজ্জ হিংসায় তারা, হানাহানি করে,–
‘মানুষ জন্তুর হুহুঙ্কার’ দিকে দিকে বেজে ওঠে ।
তুমি কি তখনও নির্লিপ্ত নির্বিকার ?
মন বলে, —না ।
যুগে যুগে তুমি পাঠাও তোমার দূত
—সূর্য্যাংশের অনির্ব্বান প্রাণ-শিখা ।
দেশে দেশে হৃদয়ে হৃদয়ে সমস্ত দীপ যখন নির্ব্বাপিত,
মৃত্যুর তমিস্রায় সমস্ত পৃথিবী যখন নিমগ্ন,
অকম্পিত সে শিখা
তখনও জ্বলে পরম দুঃসাহসে,
অন্ধ রাত্রির সমস্ত বিভীষিকাময় ভ্রূকুটীর বিরুদ্ধে
দাঁড়ায় একা ;
বলে,–এ দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃখিবীর ধূলি ।
এই শিখা বার বার আমাদেরই মাঝে জন্ম নেয়,
ধন্য করে
এই ধরণীর ধুলি-মলিন শতাব্দী ।
যে আধারে সে শিখা মূর্ত্ত হয়ে ওঠে,
সে আধার যায় ভেঙে ;
তবু সে শিখা ত’ হারিয়ে যাবার নয় ।
আকাশের তারায় আর একটু অপরূপ দীপ্তি
সে শিখা রেখে যায়,
পৃথিবীর শ্যামলতায় বুলিয়ে দিয়ে যায়
আর এক অনির্ব্বচনীয় স্নিগ্ধতা,
আকাশের নীলিমা তার কাছে পায়
রহস্য-নিবিড় আর এক মহিমা ।
দেশে দেশে মানব-সত্যের যে সংশপ্তক বাহিনী
আজও সাজছে নিঃশব্দে চরম সংগ্রামের জন্যে,
যুগে যুগে যারা সাজবে,
তাদের মশালে সেই শিখারই আলো,
তাদের পতাকায় তারই অম্লান দীপ্তি ।
কত শতাব্দীর ঢেউ
সময়ের সমুদ্রে হবে লীন,
মানুষের ইতিহাস কত আত্মঘাতী মূঢ়তায়
পথ হারাবে ;
তবু হে কালের অধীশ্বর
হতাশ আমরা হব-না ।
এই অকিঞ্চন পৃথিবীর মৃত্তিকায়
যে সূর্য্য-বীজ তুমি রোপণ করো
তা ব্যর্থ হবার নয় ।
মোহাচ্ছন্ন বর্ত্তমানের সমস্ত কুজ্ ঝটিকা অতিক্রম করে’
সুদূর যুগান্তে তার সঙ্কেত প্রসারিত ;
মানবতার গভীর উত্স-মূলে
অক্ষয় তার প্রেরণা ।
হে মহাকাল, তোমার অনন্ত পারাবারে
আমরা ক্ষণিকের বুদ্ বুদ্,
তবু সেই সূর্য্য-শিখা যে আমাদের মাঝে
প্রতিফলিত হয়,
এই আমাদের গৌরব ।