Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সুরঞ্জনার শীত – কথা || Shibani Gupta

সুরঞ্জনার শীত – কথা || Shibani Gupta

সুরঞ্জনার শীত – কথা

দু’দিন থেকেই শীতটা বেশ জাঁকিয়ে বসেছে।
এমনিতেই সুরঞ্জনা বেশ শীতকাতুরে বরাবরই।
আলমারীর খুলে গরম পোশাক বের করতে যেতেই চোখ আটকে যায় গোলাপী ফুল আঁকা চাদরখানাতে– জন্মদিনের উপহার! মায়ের দেওয়া!
ভীষন পছন্দের এই চাদরটা গায়ে জড়ালেই কেমন যেন মায়ের স্নেহের ছোঁয়া পেতে মনটা হু- হু করে ওঠে।

বাইরে মাইকে জোরালো গান।
উঠোন জুড়ে খড়ের ঘরে চড়ুইভাতির আনন্দে মশগুল বাড়ির কচি-কাঁচারা- সে কি উল্লাস!
কাল পৌষ সংক্রান্তি!
তাই,আজ সারাদিন সবাই মিলে খড় দিয়ে ঘর তৈরী করেছে।ওখানেই চা- জলখাবার,রান্না বান্না করে খাবে। সে এক ভারী আমোদের ব‍্যাপার। সারারাত আজ হুল্লোড় চলবে।

সুরঞ্জনার চোখদুটো কর কর করে চশমার কাঁচ ঝাপসা্—-
বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই হিমেল বাতাসে স্মৃতির পাতাগুলো পত্ পত্ ওড়তে থাকে…….
মেরামেরির ঘরে চাটাইয়ের উপরে চাদর বিছিয়ে বসেছে গানের আসর—-
একটা বড়ো থালায় করে সবার জন‍্যে চা,ডালমুট,ডিম ভাজা, পাউরুটি নিয়ে আসে সন্ধ‍্যা।
–এ‍্যাই– তোরা সবাই গরম গরম খেয়ে নে্–
মূহূর্তে হুড়োহুড়ি পড়ে যায় , সম্মিলিত উল্লাসে ফেটে পড়ে সবাই- বাঃ দারুণ তো! নাহ্ যাই বলিস,আমাদের সন্ধ‍্যার জবাব নেই মাইরী–
ঠান্ডায় জমে যাচ্ছিলাম রে,বেশ করেছিস!
আহ্ গরম চা সাথে জলখাবার! তোফা!
সন্ধ‍্যা চোখ পাকায়- খুব হয়েছে,আর তেল দিতে হবেনা,একাই খাসনে,আমিও আসছি–

সবাই প্রায় একবয়েসী।
,একপাড়াতেই থাকে। তবে,মেরামেরির ঘরে আজ শুধু আড্ডা,খেলার আয়োজন।ফাউ হিসেবেই চা- জলখাবার উপরি পাওনা।
তাবলে, রান্নাবান্নার কোন বালাই তখন ছিলো না। সে যে যার সুবিধেমতো বাড়ি থেকেই খেয়ে আসতো।
কাঞ্চন,তপন,সুদাম,কৃষ্ণ ,অমু’ রা ফের খেলায় মগ্ন।
কৃষ্ণা,সুধা,সন্ধ‍্যা,সুরঞ্জনারা মিলে এক ফন্দি বের করে ,যে যার বাড়ি থেকে পিঠে চুরি করে এনে এখানে জমা করবে। ভোরবেলা চান করে মেরামেরির ঘর জ্বালিয়ে আগুনের আঁচ গায়ে মেখে সবাই মিলে তারিয়ে তারিয়ে পিঠে খাবে।

ঊষাদেবী রান্নাঘরে এন্তার সরঞ্জাম মেলে পিঠে তৈরীতে ব‍্যস্ত।
পিঠের মনমাতানো সুগন্ধ নাক দিয়ে টানে সুরঞ্জনা।
সার সার পাত্রে — বকুল পিঠে, চন্দ্র পুলি,কদম পিঠে ,মালপোয়া,
ক্ষীরকদম্ব ! আহা! চোখজুড়ানো একেবারে।
মার্জারের মতো লঘু পায়ে পা টিপে টিপে মায়ের পেছনে এসে গলা জড়িয়ে ধরে সুরঞ্জনা আহ্লাদে গলে পড়ে– ওমা! কি সুন্দর সব পিঠে! ওফ্ তুমি পারো ও বটে,সাক্ষাৎ দশভূজা!
ঊষাদেবী মৃদু হাসেন,কি ব‍্যাপার !
তোদের মজলিস ছেড়ে চলে এলি যে? ক্ষিদে পেয়েছে বুঝি?
না,গো,ওই তোমাকেই দেখতে এলুম,একাই সব করছো কিনা,ওমা,তোমায় কি সাহায্য করবো বলো,আমাকে দেখিয়ে দিলেই পারবো ঠিক।
ঊষা দেবী মেয়ের সুমতি দেখে খুশিই হন।হেসেই বলেন,না রে মা,সব তো হয়েই এলো,সেই বিকেল থেকে এতোটা অব্দি– ওফ্ আর নয়, ও পাটিসাপ্টা ক’টা করেই — পিঠটা টনটন করছে বাপু,ছাড়তো-
সুরঞ্জনা উদ্বিগ্ন সুরে বলে,তাই নাকি! তাহলে একটু মুভ এনে স্প্রে করে দেবো মা?
তুই যা তো,ওসব কিছুই লাগবে না।
সুরঞ্জনার কাজ হাসিল ততোক্ষণে।
মায়ের সাথে কথা বলে মায়ের অন‍্যমনস্কতার সুযোগে বেশ কটা পিঠে সরিয়ে নিয়েছে–এবারে দে ছুট্–
তা, বেশ কিছু পিঠেই জমা হলো চারবন্ধুতে মিলে।
এখন ,ওগুলো ভালো করে লুকিয়ে ঢেকে রেখে ওরাও আড্ডাতে সামিল হলো।
দশ-পঁচিশ আর লুডোর তালে রাত একসময়ে শেষ প্রহরে আসতেই সবাই ছুটলো রেঞ্জার্সের পুকুরে–
ঝুপ- ঝাপ- ঝুপ–
ওফ্ মাগো,কি কনকনে ঠান্ডা জল রে বাবা!
দুদ্দাড় সবাই জামাকাপড় পাল্টেই মেরামেরির ঘরে খড়ে দেশলাই ঠুকতেই– দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো।
আহ্ কি আরাম!
সবাই সোৎসাহে হাত-পা সেঁকে নিচ্ছে আগুনের ওমে–

সুরঞ্জনা একফাঁকে পিঠে আনতে গিয়েই চক্ষু চড়কগাছ! একি! পিঠে কোথায়?
হন্তদন্ত সুরঞ্জনাকে চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটে আসতে দেখে সবাই বিস্মিত,কিরে? কি হয়েছে?
নেই! কিচ্ছুটি নেইরে!
নেই? আরে,বলবি তো কি নেই? সুরঞ্জনা কাঁদো কাঁদো–পি-ঠে-!
এ‍্যাঁ ! বলিস কি! নেই মানে!
কৃষ্ণা,সুধা,সন্ধ‍্যাদের আক্কেলগুড়ুম
দেখেছিস ভালো করে? কাল যেখানে রেখেছিলুম?
ধপাস করে সুরঞ্জনা বসে পড়ে- তবে আর বলছি কি,পাত্রসুদ্ধু গায়েব!
এতোক্ষণে ব‍্যাপারটি বোধগম‍্য হয় তপন,সুদামদের- হ‍্যাঁরে,অন‍্য কোথা ও রেখে ভুলে যাসনি তো?
চার বান্ধবী একসাথে মাথা নাড়ে — না,না–
তন্ন তন্ন করে খোঁজাই সার হলো।
‌ এবারে বসল তদন্ত কমিটি সবাই মিলে।
গেলো কোথায়?
কে নিতে পারে? আমরা তো জেগেই ছিলাম!
কার এতো বুকের পাটা হতে পারে শুনি?
সবাই পরস্পরের মুখোমুখি চাওয়াচাওয়ি করে।
সুরঞ্জনা তার পুলিশ অফিসার জ‍্যেঠুর অনুকরণে সন্ধিৎসু চোখে সকলের মুখ দেখে সহসাই চেঁচিয়ে ওঠে,ইউরেকা! চোরের খোঁজ পেয়ে গেছি —
সবাই বিস্ময়ে ভ‍্যাবাচ‍্যাকা — কি ! চোরকে পেয়ে গেছিস? কে রে!
সুরঞ্জনা ক্ষোভে ফেটে পড়ে,কে আবার! কাঞ্চন।ভোরে চান করতে যাবার আগেও দেখেছি,আমাকে বললো,তোরা যা্– আমি গামছাটা নিয়েই আসছি–
সকলে সমস্বরে ঠিকড়ে ওঠে,তাইতো,ওকে তো আর দেখাই যায়নি!
–ওফ্ কাজটা তাহলে কাঞ্চনের?
–কি মিটমিটে শয়তান দেখলি!
–এতো পেটুক! এত্তো এত্তো পিঠে –একাই সাবড়ে নিলো?
–এর একটা হেনস্থা হওয়া চাই- চল– চলতো ওর বাড়িতে–
সাতসকালে পুরো পল্টন চললো কাঞ্চনকে সরজমিনে পাকড়াও করতে—
ও হরি,নেই,বাড়িতে বলে গেছে ভোরের বাসটা ধরেই মাসির বাড়ি যাচ্ছে-, সংক্রান্তির পরে আসবে।
রাগে ফেটে পড়ে সবাই-ইচ্ছেমতো ঝাল ঝাড়তে থাকে—
–কি সাংঘাতিক ছ‍্যাচড়া দেখলি?
–কি করে খেতে পারলো রে?
—পেট ছাড়বে নির্ঘাৎ—
ওর সাথে কেউ কথা বলবিনে–
পায়ে ধরে মাপ চাক,কানে ধরে ওঠবোস করুক ,তারপর দেখা যাবে–

চোখদুটো ভাসছে স্মৃতির ভারে —
সুরঞ্জনা যতোবার চোখ মুছলেন ততোবারই ফের ঝাপসা্—
স্মৃতি যে বড়ো মধুময়!
সুরঞ্জনার বুকের চাতালে হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটে স্মৃতিরা-
কতো না কথা বলে ওর সাথে।যখনি,একান্ত নিরালাতে থাকেন তিনি ।মন আজকাল আর নিয়ন্ত্রণে থাকেনা কিছুতেই,
কেবলি পাঁকাল মাছের মতো পিছলে যায়– যেন গোল্লাছুট খেলে স্মৃতিরা সুরঞ্জনার সাথে।
আর,সুরঞ্জনাও দিব‍্যি হারিয়ে যান-

প্রচন্ড শীতের রাতে শীত বুড়িটা লাঠি ঠকঠকিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়িয়ে শীত ঢেলে চলে—-
— ওফ্ কি মেয়েরে বাবা,শীতে কাঁপছে তবু হাত বাড়িয়ে কম্বলটা নিচ্ছে না–
ঊষা দেবী শুতে এসে সস্নেহে তার শীতকাতুরে মেয়েকে কম্বল চাপা দেন।
সুরঞ্জনা মাকে জড়িয়ে ধরে কম্বলের তলায়।

স্মৃতির দোরে টোকা পড়তে তো পড়ছেই——
এ‍্যাই সোনা মা,ওঠ ওঠ,ভোর হয়ে এলো যে! চান করতে যাবি নে?
সোনা মেয়ে কম্বলের নীচে থেকেই আপত্তি জানায়– না,না, ওরে বাবারে,কি ঠান্ডা! ও মা,আমি কিছুতেই চান করবো না–
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে মিষ্টি হাসেন মা- তাই বল্লে কি হয় রে মা? শীতের দিনে,ঠান্ডা তো একটু লাগবেই- মকর সংক্রান্তি বলে কথা! চান করে এসে তিলের নাড়ু মুখে দিতে হয়,এটাই রেওয়াজ– যা্ চান করে আয়–
মা এবারে মেয়েকে জড়িয়ে সোহাগ চুমো খেতেই শীতকাতুরে সুরঞ্জনা তড়াক করে নেমেই চান করতে ছুটে- এক্ষুনি আসছি মা–

দিনগুলো কতো তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়।
সময়ের পালে উদোম বাতাস–
বছর বছর ক‍্যালেন্ডার বদল হয় সময়ের ধারাপাতে–
সুরঞ্জনারা চার ভাই-বোন।
বড়দা রজত আর মেজো সুরঞ্জনার মাঝে আচরণগত খুব মিল।বিশেষ করে খাবার ব‍্যাপারে।
আবার দিদি জয়ন্তী ও ছোটভাই চন্দন শান্ত,ধীর স্থির।
সুরঞ্জনা ও রজত দুজনেই মা- ঘেঁষা,আর একটু ভালোমন্দ খেতে ভালোবাসে।
একদিনের কথা মনে পড়তেই কুলকুল করে হেসে ওঠেন সুরঞ্জনা।
মা সেদিন সেদ্ধপুলি করেছেন।
দেখামাত্র সুরঞ্জনার জিভ সরস- ওমা! কি মজা! সেদ্ধপুলি?
ঊষা দেবী আড়চোখে মেয়েকে দেখে মনে মনে হাসেন।
–এ‍্যাই নে্ ,গরম গরম দুটো খেয়ে দেখতো,কেমন হয়েছে?
গরম ধোঁয়া বেরোনো পিঠে,
সুরঞ্জনা চাকুম চাকুম খাচ্ছে ফূঁ দিয়ে–
–একি রে! কি করছিস রে হিড়িম্বা? এতো পিঠে খেলে পেট ছাড়বে,খাসনে–
আচমকা রজত পিছন থেকে ফোঁড়ন কাটতেই ফুঁসে ওঠে সুরঞ্জনা– দেখলে মা,দাদা আমাকে কি বলছে?
আর,তোকেও বলি,তুই আমাকে হিড়িম্বা বললি কেন? আমি হিড়িম্বা হলে তুই — তুই একটা—-
অনেক চেষ্টা করেও যুৎসই কিছু বলার মতো না পেয়ে মুখ ভার করে সুরঞ্জনা।
রজত তাতে বেশ মজাই পায়।বোনকে ক্ষেপাতে বলে,আসলে ,
তোর ভালোর জন‍্যেই বলিরে,দিন দিন যা মুটকি হচ্ছিস টুনটুনের মতো–
রাগে দুঃখে সুরঞ্জনা কাঁদো কাঁদো,– ওমা! শুনলে?
ঊষাদেবী ভাইবোনের খুনসুটিতে মিটি মিটি হাসছিলেন।এবারে মেয়ের দিকে তাকিয়ে কপট ধমকের সুরে ছেলেকে বলেন– আচ্ছা,এসব কি শুরু করলি রে রজু? কেন মিছে ওকে ক্ষেপাচ্ছিস? তুই খাবি পিঠে? আয়,দুটো খেয়ে নে–
রজত জুলুজুলু চোখে পিঠের দিকে– শুধু দুটো কেন মা? আমি আরো খাবো–
ঊষা দেবী প্লেটে করে গোটা পাঁচেক সেদ্ধপুলি ছেলেকে দিতেই
রজত সাত আটটা পিঠে উদরস্ত করে ফেলে —
সুরঞ্জনা হাঁ– এ‍্যাই দেখো,আমাদের পাড়ার পাগলা দাশুর মতন কেমন গপগপিয়ে খেলো,আর আমি দুটো খেতেই—
রজত বোনের বিনুনী ধরে টানে–
আমার তো তোর মতো পেট ঢিলের অসুখ নেইরে,বুঝলি-
ঊষা দেবী মেয়ের কথা শুনে অপ্রসন্ন একটু,শতহোক নিজের ছেলের সাথে পাড়ার পেটুক পাগলা দাশুর তুলনাটা মোটেও পছন্দ হয়না– ছিঃ মা,দাদাকে এমন করে বলতে নেই।ও খেতে ভালোবাসে,খাকনা্–তোর ইচ্ছে হলে আরো খা্– এসব তো তোদের জন‍্যেই—

শীত কথার কতো যে স্মৃতি জীবনের পরতে পরতে——
একবার,মেরামেরির পরদিন!
সে কি কান্ড রে বাবা!
সকালে রোদে বসে কমলা খাচ্ছিল সুরঞ্জনা।

রজত ডাকছে, এ‍্যাই সরু, শোন্- এদিকে আয়–
সুরঞ্জনার মুখ কমলার রসে ভর্তি, ঢোঁক গিলে বলে-,কি হলো, ডাকছিস কেনরে ?
রজত এগিয়ে এসে বোনের কানে কানে কি বলতেই চোখমুখ খুশিতে চিকচিক– চল তাহলে–
রজত রান্নাঘর থেকে দু’টো পিঁড়ি নিয়ে আসে– চল্ ওরাও সবাই নিশ্চয়ই এসে গেছে–

বাড়ির কাছেই উঁচু টিলা।
সুরঞ্জনা ও রজত দেখে ওদের পুরো পল্টন হাজির।সবার হাতেই একটা করে পিঁড়ি।
টিলার উপরে এখনো কুয়াশার আস্তরন।মাঝে মাঝে হাল্কা রোদ্দুরের ঝিলিক।
সেদিকে একনজর তাকিয়েই সুরঞ্জনা গাঁয়ের চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে বলে ওঠে,
— তোরা খেল বাপু, আমার ভীষন শীত করছে–
কৃষ্ণা ও সুধা চটে ওঠে, বটে! ননীর পুতুল! এখন শীত কোথায়? খেলতে গেলেই তো ঘেমে যাবি , দাঁড়া,দেখাচ্ছি মজা!
দুজনে একটান মেরে সুরঞ্জনার গা’ থেকে চাদরটা ছুঁড়ে ফেলে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যায়।
দারুণ মজার খেলা।
টিলার উপর একজন উল্টো পিঁড়িতে বসবে ,আর আরেকজন পিঁড়িটা নিচের দিকে ঠেলে দিলেই পিঁড়ি আরোহীকে নিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে নেমে যাবে–
এ খেলা ওদের খুব পছন্দের।
একের পর এক পিঁড়ি আরোহীকে নিয়ে গড়িয়ে চলে– দারুণ থ্রীল!

দুপুরে এ বাড়িতে সবার একসাথে বসে খাবার রেওয়াজ।
মোক্ষদা ঝি রান্নাঘরে জল- পিঁড়ি পেতে দিলেই ঊষা দেবী সবার জন‍্যে ভাত- তরকারী বাড়েন থালায় থালায়।
আজ রান্নাঘরে পিঁড়ি পেতে দিতে গিয়েই ভুরু কুঁচকে যায় মোক্ষদার– ওমা! দু’টো পিঁড়ি কে নিলো!
তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো,ও গিন্নী মা, দেখোদিকিনি কান্ড! দু’টো পিঁড়ি নেই গো–
ঊষা দেবী অবাক ,নেই মানে? কোথায় যাবে, খুঁজে দেখো–
মোক্ষদার কি মনে পড়তে বলে ওঠে,ও, এবারে বুঝেছি,এ রজুবাবার কান্ড না হয়ে যায় না।তাই তখন রান্নাঘরে ঢুকেছিলো– বুঝলে,এ তোমার ছেলের কান্ড!
ঊষা দেবী মোক্ষদার কথার জবাব না দিয়ে একটা বাঁশের কঞ্চি হাতে সোজা টিলার দিকে এগোন।

খেলা দারুণ জমে উঠেছে।
সুরঞ্জনা সহসাই দূর থেকে মাকে হনহনিয়ে এদিকে আসতে দেখেই দাদাকে ডাকতে থাকে,দাদা,ওই দ‍্যাখ্ মা আসছে– চল্ পালাই–
দুদ্দাড় সবাই পড়িমড়ি পিঁড়ি নিয়ে নামতে থাকে—–
উফ্ সেদিন কি বকুনিই না খেয়েছিলো তারা।

স্মৃতিরসে মধুময় সুরঞ্জনার শীত গাঁথার স্তবকে স্তবকে ঘটনার ঘনঘটা!
মাঝে মাঝেই হারিয়ে যায় মনটা তার।
কখনো,পুরনো আ‍্যলবাম খুলে বসলো তো হুড়মুড়িয়ে ডালা মেলে শীত কথার আবেশ মাখানো ছবিরা—
— নাহ্ তোকে নিয়ে আর পারিনে,
কি হাল করেছিস চুলের? শীত এলেই চান করতে চাসনে- চুলে জট বেঁধে যাচ্ছে,কতদিন তেল পড়েনি– আয়– আজ তোকে চুলে তেল মাখিয়ে চান করিয়ে দেবো–
আঁতকে ওঠে শীতকাতুরে মেয়েটা– না,না,ও সোনা মা, লক্ষ্মী মা,আমি চান করবোনা, ওফ্ দেখছো না কাঁপছি? কি ঠান্ডা !
ঊষা দেবী ধমক দেন,–কোন অজুহাত চলবে না আজ।গরম জল বসিয়েই এসেছি উনুনে- আয়, বলছি—

অজান্তেই নিজের মাথায় হাত পড়ে মধ‍্যবয়স্কা সুরঞ্জনার।
এখনো হিংসে করার মতোই একপিঠ চুল তার।
এখনো,শীত এলেই সেই চান ভীতি রয়েই গেছে।
মা তো নেই! মায়ের মতন এই ভুবনে আর কেইবা আছে যে এতো খেয়াল রাখবে!
এ‍্যাই দ‍্যাখো কি কান্ড! তার খেয়াল রাখবে কি,এখন তো সুরঞ্জনাই সবার খেয়াল রাখেন শুধু নিজের খেয়াল ছাড়া।
আসলে,নিজের কথা তো কখনোই ভাবেননি। যে ভাবতো,সেই মা-তো কবেই ডাক্তারের গাফিলতিতে- ভুল চিকিৎসায়– সামান‍্য অসুখে—
উফ্ সে কি বেদনার কথা !

সুরঞ্জনার ব‍্যাকুল তৃষিত দৃষ্টি আকাশে–
মা! মাগো,যেখানেই থাকো, তুমি তো আমার অনুভবেই আছো মা!
শীত ও তুমি আলাদা তো নও মা!
এমনিতেও তুমি আমার মনেই রয়েছো , আমার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে– আর,শীত এলেই হাজারো সুখের স্মৃতিতে তুমিই তো আমায় ভরিয়ে রাখো,জড়িয়ে থাকো তোমার বুকের উষ্ণতায়—

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress