মুক্তকেশীর সংসার এমন কিছু বিপুল নয়
মুক্তকেশীর সংসার এমন কিছু বিপুল নয়, ছেলে মেয়ে বৌ নাতি নিজে সবাইকে নিয়ে সদস্য-সংখ্যা মাত্র দশ, গৃহপ্ৰবেশ উপলক্ষে বিবাহিতা দুই মেয়ে আর কুচি একটা নাতনী এসেছে এই যা। এই কটা লোককে একখানা সেকেণ্ড ক্লাস ঘোড়ার গাড়িতে ভরে ফেলা খুব একটা শক্ত ছিল না, পুরুষ দু-তিনজন গাড়ির ছাতে উঠে বসলেই স্থান-সন্ধুলান এবং ভাশুর-ভদ্রবৌ সমস্যা, দুটোরই সমাধান হত। তবু যে হিসেবী মুক্তকেশী দুটো গাড়ির আদেশ দিয়েছিলেন সে কেবল লক্ষ্মীর হাড়ির শুচিতা বাঁচাতে।
মেয়ে-বৌদের না হয় এক-একখানা চেলির শাড়ি পরিয়ে নেওয়া হল, কিন্তু ছেলেদের বেলায়? তাদের তো কোট-কামিজ-জুতো ছেড়ে একবস্ত্রে যেতে বলা যায় না? যতই পুরুষ পরশ-পাথর হোক, লক্ষ্মীর হাঁড়ি বলে কথা! যার মধ্যে সমগ্র সংসারটার ভাগ্য নিহিত।
কুতার্কিক মেজবেঁটা অবিশ্যি তুলেছিল তর্ক, বলেছিল, তবে যে আপনি বলেন, পুরুষ আড়াই পা বাড়ালেই শুদ্ধ-ৰ দাবড়ানি দিয়ে থামিয়েছেন তাকে।
তর্ক তুললেই মেজ বোঁ সুবৰ্ণও অবশ্য দুটো গাড়ির ব্যাপারে উৎসাহিতই। কারণ গাড়িভাড়ার ব্যাপারেও মুক্তকেশীর কার্পণ্যের অবধি নেই। যখনই যেখানে যাওয়া হয়— নেমন্তন্নবাড়ি, কি যোগে গঙ্গা নাইতে, চিড়িয়াখানায়, কি মরা যাদুঘরে, ওই গুড়ের নাগরী ঠাসা হয়ে। ননদরা যখন বাপের বাড়ি আসে তখনই এসব আমোদ-আহ্লাদ হয়, লোকসংখ্যাও তখন বাড়ে, বেড়াতে যাওয়ার সব সুখই যেন সুবর্ণর লুপ্ত হয়ে যায়। তাছাড়া জানলার একটি পাখি খোলবারও তো জো নেই, মুক্তকেশী তাহলে বৌকে বাবার বিয়ে খুড়োর নাচন দেখিয়ে ছাড়বেন।
দুই জা, দুই ননদ আর শাশুড়ী, মাত্র এই পাঁচজন পুরো একখানা গাড়িতে, ছোট দ্যাওর তো গাড়ির মাথায় আছে পথপ্রদর্শক হিসেবে। সুবৰ্ণ যেন হাত-পা মেলিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচে! আর সঙ্গে সঙ্গেই অপূর্ব একটা পুলক আবেগে মনটা উদ্বেল হয়ে ওঠে তার। হ্যাঁ তাই, এটাই হচ্ছে সেই আসন্ন ভাগ্যের সূচনা। খোলামেলা বারান্দার ধারের ঘর, অথবা ঘরের ধারে বারান্দা অপেক্ষা করছে সুবৰ্ণর জন্যে!..
যে বারান্দা থেকে গলা বাড়িয়ে সুবর্ণ বড় রাস্তা দেখতে পাবে। এখন মনে হয়। সুবর্ণর, একটু যে গলির মধ্যে, সেটাই বরং ভাল, অনেকক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলেও কেউ কিছু বলবে না বোধ হয়। একেবারে বড় রাস্তার ধারে হলে হয় তো সে শাসনের ভয় ছিল।
চেলির শাড়িতে আগাগোড়া মোড়া, মাথায় ঘোমটা, শাশুড়ী ননদ বড় জায়ের দ্বারা পরিবেষ্টিত সুবৰ্ণ হেটমুণ্ডে নতুন বাড়ির দরজায় ঢুকে পড়ে, তবু মাথার উপরে অবস্থিত সবুজ রেলিং-ঘেরা বারান্দার অনুভূতি রোমাঞ্চিত করে তোলে তাকে, সমস্ত মন উদগ্র হয়ে থাকে সিঁড়ির দিকে।
কিন্তু সহজে সিঁড়ির দিকে যাওয়া হয় না, কারণ নীচের তলায় ঠাকুরঘরে বহুবিধ নিয়মকর্মের পালা চলতে থাকে, শান্তিজল না নিয়ে উঠে পড়বার প্রশ্নই নেই।
তবু একসময় সে পালা সাঙ্গ হয়।
শান্তিজল মাথায় নিয়েই টুক করে অন্যজনেদের মাঝখান থেকে সরে আসে সুবর্ণ, পা টিপে টিপে দোতলায় ওঠে।
ননাদরা বাড়ি ঢুকেই হুল্লোড় করে ওপরতলা দেখে গেছে। পুরুষরা দেখার প্রয়োজন অনুভব করে নি, কারণ তারা তো রোজই দেখেছে। তারা শান্তিজল মাথায় নিয়েই ছুটেছে বাজারে দোকানে। পুরো ওপরতলাটা আপাতত খাঁ খ্যা করছে।
খানচারেক ঘর, মাঝখানে টানা দালান, এদিকে ওদিক খোঁচা-খোঁচা একটু একটু ঘরের মত, এরই মাঝখানে দিশেহারা হয়ে ঘুরপাক খায় সুবর্ণ, এ দরজা ও দরজা পার হয়ে একই ঘরে বার বার আসে বিমূঢ়ের মত, বুঝতে পারে না কোন দরজাটা দিয়ে বেরোতে পারলে সেই গোপন রহস্যে ভরা পরম ঐশ্বর্যলোকে দরজাটি দেখতে পাবে!
ঘুরেফিরে তো শুধু দেয়াল।
রিক্ত শূন্য খা খ্যা করা সাদা দেয়াল, উগ্র নতুন চুনের গন্ধবাহী।
তবে কি বারান্দাটা তিনতলায়? আরো তাই নিশ্চয়! তাহলে তো আরোই ভাল।
ইস! এইটা খেয়াল করে নি এতক্ষণ হাঁদা-বোকা সুবর্ণ। একই ঘরে দালানে পাঁচবার ঘুরপাক খেয়ে মরছে! চেলির কাপড় সামলাতে সামলাতে তিনতলায় ছুটি দিল সুবর্ণ। কেউ তো নেই। এখানে, ছুটিতে বাধা কি! একেবারে ছাত পর্যন্তই তো ছুটি দেওয়া যায়।
না। ছাত পর্যন্ত ছুটি দেওয়া গেল না, ছাতের সিঁড়ি বানানো হয় নি। খরচে কুলোয় নি বলে আপাতত বাড়ির ওই অপ্রয়োজনীয় অংশটা বাকি রাখা হয়েছে।
কিন্তু বারান্দা?
যেটা নাকি সুবর্ণর ভালবাসার স্বামী সবাইকে লুকিয়ে শুধু মিস্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে গাঁথিয়েছে? কোথায় সেটা?
সুবৰ্ণ কি একটা গোলকধাঁধার মধ্যে এসে ঢুকে পড়েছে?
এর মানে? তুমি এই ওপর চূড়োয় এসে বসে আছ মানে?
নিরালার সুযোগে প্ৰবোধচন্দ্র এই প্রকাশ্য দিবালোকেই স্ত্রীর একেবারে কাছে এসে দাঁড়ায়। যদিও তার ভুরুতে কুঞ্চন-রেখা, কণ্ঠে বিরক্তির আভাস, মেজবৌ মেজবৌ করে হল্লা উঠে গোল নীচে, একা তুমি এখানে কী করছ?
সুবৰ্ণ সে কথার উত্তর দেয় না।
সুবৰ্ণ পাথরের চোখে তাকায়।
বারান্দা কই?
বারান্দা!
প্ৰবোধ একবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে বিস্ময়ের গলায় বলে ওঠে, সে কী! খুঁজে পাও নি? আরে তাই তো! ভূতে উড়িয়ে নিয়ে গেল নাকি?
সুবৰ্ণর চোখ ফেটে জল আসে, তবু সে-জলকে নামতে দেয় না সে, কঠোর গলায় বলে, মিথ্যে কথা বললে কেন আমার সঙ্গে?
প্ৰবোধ তবু দামে না।
হেসে হেসে বলে, মিথ্যে কি গো, সত্যি সত্যি! ছিল, ভূতে কিম্বা ক্যাগে নিয়ে পালিয়েছে! এই তোমার গা ছয়ে বলছি—
বলেই এদিক-ওদিক তাকিয়ে খপ করে সেই দুঃসাহসিক কাজটা করে নেয়, গা-টা একবার ছুঁয়ে নেয়। একটু বেশি করেই নেয়।
এর পর আর চোখের জল বাধা মানে না। সুবর্ণ দু হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ে বলে, তুমি আমায় ঠকালে কেন? কেন ঠকালে আমায়? জানো বাবা মাকে ঠকিয়েছিল বলেই মা—
থাক থাক! এবার প্রবোধ বীরত্বে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে, তোমার মার বাহাদুরির কথা আর বড় মুখ করে বলতে হবে না। বেটা ছেলে পুরুষ-বাচ্ছা ভেড়ুয়ার মতন পরিবারের কথায় ওঠবোস করবে, কেমন? বারান্দা, বারান্দা! বারান্দার জন্যে এত বুক-ফাটাফাটি কেন শুনি! কই, বড়বৌ তো একবারও ওকথা মুখে আনে নি? তার মানে সে ভালঘরের মেয়ে, তোমার মতন এমন ছক্কাপাঞ্জা নয়! বারান্দায় গলা বুলিয়ে পরপুরুষের সঙ্গে চোখোচে্যুখির সাধ নেই তার! আর ইনি বারান্দার বিরহে তিনতলায় উঠে এসে পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসলেন! নীচের ওদিকে বড়বৌ কুটনো-বাটনা, রান্না, মাছ-কোটা নিয়ে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে। যাও শীগগির নীচে নেমে যাও।
হ্যাঁ, নীচে সুবৰ্ণকে নেমে যেতে হয়েই ছিল। নীচের তলায় সেই বিভীষিকাময় দৃশ্যের ছবি কল্পনাচক্ষে দেখার পর আর বসে থাকার সাহস হয় নি তার, শুধু অপরিসীম একটা ধিক্কারে দীর্ণবিদীর্ণ হতে হতে সে মনে মনে বলেছে, ভগবান তুমি সাক্ষী, বারান্দা দেওয়া ভাল বাড়ি আমি করবো করবো করবো! আমার ছেলেরা বড় হলে, মানুষ হলে, এ অপমানের শোধ নেব!
প্ৰতিজ্ঞা!
কিন্তু সুবৰ্ণলতার সেই আগের প্রতিজ্ঞা? ও যে বলেছিল, বারান্দা না থাকলে সে বাড়িতেই আমি থাকবোই না! হায় রে বাঙালী-ঘরের বৌ, তার আবার প্রতিজ্ঞা! শুধু চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়ার মত বাড়ির মধ্যে সব থেকে ওঁচা ঘরটা নিজের জন্যে প্রার্থনা করেছিল বোকী অভিমানিনীটা।
বাড়ির পিছন দিকের উত্তর-পশ্চিম কোণের সেই ঘরটা কারুর প্রার্থনীয় হতে পারে এটা মুক্তকেশীর ধারণাতীত। ঘর বিলি করার ব্যাপ্তারে তিনি তখনো মনে মনে হিসেব করছিলেন। জ্যেষ্ঠর শ্রেষ্ঠ ভাগ এ নীতিতে বড় ছেলেকে পূর্ব-দক্ষিণের সেরা ঘরখানাই দিতে হয়, সেজ ছোট দুই ছেলেই তাঁর একটু শৌখিন। তা ছাড়া আজই না হয় তারা আইবুড়ো আছে, দুদিন বাদে তো বিয়ে হবে? তিনতলার ঘর থাকলে ভাল হয় তাদের। এদিকে আবার নিজেরও মাথা-গরমের বাতিক, ঘুপটি ঘরে ভয়, তাছাড়া তাঁর ঘরেই তো তার আইবুড়ো মেয়ের স্থিতি। খারাপট ঘরটা নিলে রেগে মরে যাবে না সে?
ওদিকে আবার মেয়ে-জামাই আসা আসি আছে। মেয়েদের আঁতুড় তোলা আছে। তাদের থাকা उभ0छ्।
খপ করে তাই কোনো কিছু ঘোষণা করে বসে নি মুক্তকেশী।
এহেন সময়, যখন খাওয়া-দাওয়ার পর সবাইকে নিয়ে দোতলায় উঠেছেন তিনি, তখনই এই প্রার্থনা জানায় সুবৰ্ণ।
মুক্তকেশী একটু অবাক না হয়ে পারেন না, তারপর মনে মনে হাসেন। এদিকে একটু তর্কবাগীশ হলেও স্বার্থের ব্যাপারে বোকা-হাবা আছে বেঁটা! তবু বিস্ময়টা প্ৰকাশ করেন না। শুধু প্রীতিকণ্ঠে বলেন, তা এটাই যদি তোমার পছন্দ তো তাই থাক। তবে হাওয়া কি তেমন খেলবে? পেবোর একটু গরম হবে না?
ছেলের গরমের প্রশ্নই করেন মুক্তকেশী, বৌয়ের অবশ্যই নয়।
সুবৰ্ণ মাথা নেড়ে বলে, গরম আর কি, হাতপাখা তো আছেই।
তবে তাই! তোমার বিছনা-তোরঙ্গগুলো এ ঘরে তুলে দিক তাহলে।
তুলে দেবার লোক আছে।
ঝি খুদু একটা জোয়ান পুরুষের শক্তি ধরে। সেও তো এসেছে ঘোড়ার গাড়ির মাথায় চড়ে। খুদুর বলেই বলীয়ান মুক্তকেশী।
তা বলে বিছানা পেতে সে দেবে না, দোতলায় তুলে দিয়েই খালাস। সুবৰ্ণই জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল, বিছানা পেতে নিল। নির্লিপ্ত নিরাসক্ত ভাবে।
কিন্তু প্ৰবোধের তো আর নিরাসক্তি আসে নি, তাই রাত্রে ঘরে ঢুকেই ফেটে পড়ে সে, শুনলাম মেজাগিনী শখ করে এই ওঁচা ঘরটা বেছে নিয়েছেন! মানেটা কি?
প্ৰবোধের বয়েস চব্বিশ, কিন্তু কথার বাঁধুনি শুনলে চল্লিশ ভাবতে বাধা হয় না। না হবে কেন, তিনপুরুষে খাস কলকাত্তাই ওরা—যে কলকাত্তাইরা ধান গাছের তক্তার প্রশ্নে উত্তর খুঁজে পায় না, চাষ করে শুধু কথার।
তা ছাড়া মুক্তকেশীর ছেলেমেয়েদের সকলেরই ধরন-ধারণ পাকা পাকা। তারুণ্যকে ওরা লজ্জার বস্তু মনে করে, সভ্যতাকে বলে ফ্যাশান!
রুচি পছন্দ সৌন্দর্যবোধ এসব হাস্যকর শব্দগুলো ওদের অভিধানে নেই। আর জগতের সারবস্তু যে পয়সা এ বিষয়েও কারো দ্বিমত নেই। তা বলে সবাই যে লোক খারাপ তা মোটেই নয়। সুবর্ণর ভাসুর সুবোধ তো দেবতুল্য, সাতে নেই, পাচে নেই, কারোর সঙ্গে মতান্তর নেই, স্নেহ মমতা সহৃদয়তা সব কিছু গুণই তার মধ্যে আছে।
সন্দেহ-বাতিকগ্রস্ত মেজ ভাইকে মাঝে মাঝেই বকে সে, কী যে বলিস পাগলের মতন! মানুষ কি খাঁচার পাখী যে রাতদিন বন্ধ থাকবে? সবাই চিড়িয়াখানায় যাবে, মেজবৌমা যাবে না? এমন বাতিকগ্রস্ত হলি কেন তুই বল দেখি!
সুবোধের এই ক্ষুব্ধ প্রশ্নের ফলেই সুবর্ণর তার জা-ননদদের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া ঘটে, নচেৎ তো হয়েই গিয়েছিল বারণ।
যাত্রার তোড়জোড় শুনলেই তো রায় দিয়ে বসেন তার পতি পরামগুরু যে যায় যাক, তোমার যাওয়া-ফাওয়া হবে না!
কিন্তু দাদা বললে না করতে পারে না। সেটা আবার সেকালের শিক্ষার গুণ। যত অপছন্দকার ব্যাপারই হোক, বাপ-দাদার আদেশ ঠেলবার কথা ভাবতেই পারত না কেউ।
সুবৰ্ণ এর জন্যে ভাসুরের উপর কৃতজ্ঞ ছিল।
কিন্তু এদিকে এত উদার হলেও পয়সার ব্যাপারে কার্পণ্যের কমতি ছিল না সুবোধের। মাসকাবারী বাজার এনে মুটেকে দুটোর জায়গায় তিনটে পয়সা দিতে আধা ঘণ্টা বধকাব্যকি করতে আলস্য ছিল না তার, মুক্তকেশীর গঙ্গাস্নানের পালকি-বেহারারা দুই আনার বেশী পয়সা চাইলে তাদের নাকের ওপর দরজা বন্ধ করে দিতে দ্বিধামাত্র করতে দেখা যেত না।
দ্বিধা অবশ্য আরো অনেক কিছুতেই করে না সে। যেমন, বাড়ির বাইরের রকে গামছা পরে বসে তেল মাখতে দ্বিধা করে না, উঠোনের চৌবাচ্চার ধারে দাঁড়িয়ে স্নান করতে দ্বিধা করে না।
দেখে সুবর্ণর মনটা যেন কী এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় ছটফট করে। এ যেন দেবদূতের গায়ে ছেঁড়া পোশাক, ফুলের গায়ে কাদা?
তবু ভাসুরকে সুবৰ্ণ ভক্তি করে।
ভক্তি করে বড় ননদকে।
সেই ছোট্ট বেলায় বেগুনী বেনারসী মোড়া সুবর্ণ যখন কাঁদতে কাঁদতে এদের বাড়িতে এসে দুধে-আলতার পাথরে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে হঠাৎ ড়ুকরে উঠে বলেছিল, আমাকে তোমরা ছেড়ে দাও গো, তোমাদের পায়ে পড়ি, তখন চারদিক থেকে ছি-ছিক্কারের অগ্নিবাণে সুবৰ্ণ তো প্ৰায় ভস্ম হতে বসেছিল, মুক্তকেশী তো এই মারে কি সেই মারে, সেই দুঃসময়ে ওই বড় ননন্দই রক্ষা করেছিল তাকে। বলেছিল, তোমরা সব কী গো! দুধের বাছা একটা, আর ভেতরের ঘটনাও জেনেছ সবাই, ওর প্রাণীটার দিকে তাকাচ্ছ না?
বাড়ির বড় মেয়ে, জামাই দ্বিতীয় পক্ষের হলেও একটা কেষ্টবিষ্ট, কেউ তাই আর তাকে দাবড়াতে পারে নি, কিন্তু বৌকে কচি বাচ্ছা বলায় হেসেছিল সবাই। বলেছিল, আসছে জন্মে আবার ন বছরের হবে ও মেয়ে।
ননদ আবারও তাড়া দিয়েছিল, আচ্ছা আচ্ছা, বয়সের হিসেব পরে হবে, প্ৰবোর চাইতে তো আর বড় নয়? এখন বরণটা কর!
তদবধি বড় ননদকে দেবীজ্ঞান করে সুবর্ণ। সে যখন আসে, যেন হাতে চান্দ পায়। সে যে হিতৈষী, অন্য ননদদের মত ছুতো-ধরা নয়, সেটা বুঝতে দেরি হয় না। সুবর্ণর।
আজও তো সে ননদ সুবৰ্ণকে আড়ালে ডেকে চুপি চুপি বলেছিল, তুই আমন হাবা কেন রে মেজ বৌ? চেয়ে-চিন্তে অখাদ্য ঘরখানা নিলি!
মেজ বৌ অবলীলায় বলেছিল, তা একজনকে তো নিতেই হবে।
কিন্তু এখন ননদের ভাইয়ের তীব্র প্রশ্নের উত্তরে অবলীলায় যা বললো সেটা অন্য কথা। এখন বললো, কেন, ঘরটা খারাপ কিসে? ভালই তো! একটা জানলা খুললে পড়াশীর ভাঙা দেয়াল, আর একটা জানলা খুললে গেরস্তের কলপাইখানা, মিটে গেল ল্যাঠা। সব দিক দিয়ে নিৰ্ভয়! পরপুরুষের সঙ্গে চোখোচোখির বাসনা থাকলেও সে বাসনা মিটবে না।
ওঃ! প্ৰবোধ তীব্ৰ চাপা গলায় বলে, সেই বিষ মনে পুষে আক্রোশ মেটানো হল! আচ্ছা!
সুবৰ্ণ বালিশটা উল্টে-পাল্টে ঠিক করতে করতে বলে, কথাতেই আছে সৎসঙ্গে স্বৰ্গবাস! বিষ-পুঁটুলির সঙ্গগুণে জমছে বিষ!
প্ৰবোধও পাল্টা জবাব দেয়, আমার মনে বিষ? আর নিজের জিভখানি? সে তো একেবারে বিষের ছুরি!
সুবৰ্ণ শুয়ে পড়ে বলে, তা সেটা যখন বুঝেই ফেলেছি, ছুরি-ছোরার থেকে সাবধান থাকাই মঙ্গল।
বটে? আমি পুরুষবাচ্ছা, আমি শালা সাবধান হতে যাবো পরিবারের মুখ আছে বলে?
তা হলে হয়ো না! সুবর্ণ অবলীলায় বলে, ছোটলোকের মতন হাড়াই-ডোমাই করো রাতদিন!
তবু তুমি তোমার জিভ সামলাবে না?
হক কথায় সামলাবো না।
হঠাৎ একটা কাণ্ড ঘটে।
প্ৰবোধচন্দ্ৰ বীরপুরুষের ভঙ্গীতে উঠে বসে স্ত্রীর মাথার তালের মত খোঁপাটা ধরে সজোরে নেড়ে দিয়ে বলে, তোমার আসপদ্দার মাত্রা বাড়তে বাড়তে বড বেড়ে গেছে দেখছি! গলাধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বার করে দিতে পারি তা জানো?
তুমি আমার চুলের মুঠি ধরলে! সুবর্ণ উঠে বসে।
সুবৰ্ণর ফর্সা ধপধাপে গালের উপর বড় বড় কালো চোখ দুটো যেন জ্বলে ওঠে, ভয়ানক কিছু একটা বুঝি বলতে চায় সুবর্ণ, তারপর সহসাই গম্ভীর গলায় বলে, জানবো না কেন? খুব জানি। বাঙালীর মেয়ে হয়ে জন্মেছি, আর এটুকু জানবো না?
প্ৰবোধ বোঝে বেগতিক, গৃহপ্ৰবেশের সুখের দিনের রাতটাই মাটি। তাই সহসাই সুর বদলায়। নিতান্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে সরে এসে বলে, কেবল রাগ বাড়িয়ে দিয়ে মন্দ কথাগুলো শোনার সাধ। এই কটু কথাগুলো তুমিই মুখ দিয়ে বার করাও। আমি শালা এদিকে সারাদিন হাপু শুনছি কখন রাত আসবে, আর মহারাণী মেজাজ দেখিয়ে–নাঃ, তুমি বড্ড বেরসিক!
সুবৰ্ণর বয়েস চোদ্দ বছর।
অতএব প্ৰবোধের জয় হতে দেরি হয় না।
কিন্তু সে কি সত্যিই জয়?
জয় যদি তো অনেক রাত্রে পরিতৃপ্ত পুরুষটা, যখন নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে থাকে, ঘরের বাতাস উষ্ণ হয়ে ওঠে কেন একটা ভয়ঙ্কর আক্ষেপের দীর্ঘশ্বাসে?
যে দীর্ঘশ্বাসটা কথা হয়ে উঠলে এই রকম দাঁড়ায়, এরা এরকম কেন? সারাজীবন এদের নিয়ে কাটাতে হবে। আমায়া!
কিন্তু এটা সুবৰ্ণলতারই বাড়াবাড়ি বৈকি।
সাধারণ ঘরসংসারী মানুষ এ ছাড়া আর কি হয়? সবাই তো এই কথাই জানে, মানুষকে খেতে হয়, ঘুমুতে হয়, বংশবৃদ্ধি করতে হয় এবং সেই কাজগুলো নিশ্চিন্তে সমাধা করবার উপায় হিসাবে টাকা রোজগার করতে হয়।
আবার খেটেখুটে ক্লান্ত হলে তাস-পাশা খেলতে হয়, মাছ ধরতে হয়, রকে বসে রাজনীতি করতে হয়, ছেলে শাসন করতে হয়, মেয়ের বিয়ে দিতে হয়, আর বুড়ো হলে তীর্থ-ধর্ম গুরুগোবিন্দ করতে হয়।
এরা জানে মাকে ভক্তি করতে হয়, স্ত্রীকে শাসন করতে হয় এবং সর্ব বিষয়ে মেয়েমানুষ জাতটাকে তবে রাখতে হয়। শুধু মুক্তকেশীর ছেলেরাই এরকম, একথা বললে অন্যায় বলা হবে। অধিকাংশই এরকম। তারতম্য যা সে কেবল ব্যবহারবিধিতে।
সুবৰ্ণ বৃথাই দুষছে তার শ্বশুরবাড়িকে। অকারণেই ভাবছে— হায়, মন্ত্রবলে সমস্ত পৃথিবীটা ওলট-পালট হয়ে গিয়ে যদি মাঝখানের এই দিনগুলো মুছে যেত! যদি রাত পোহালেই দেখতে পেত সুবৰ্ণ, ন বছরের সুবর্ণ তাদের সেই মুক্তরামবাবু স্ত্রীটের বাড়ি থেকে স্কুলে যাচ্ছে বই-খাতা নিয়ে। সুবৰ্ণর মা হাসি-হাসি মুখে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।
একবার যদি এমন হয়, জীবনে আর কখনো সুবর্ণ তার ঠাকুমার ছায়া মাড়াবে না। ঠাকুমার কৃষ্ঠদেশের বাড়িতে একা না গেলে তো মাকে লুকিয়ে এমন হুট্ক্কারি বিয়ে দিয়ে বসতো না কেউ সুবর্ণর!
এতদিনে তা হলে হয়তো পাসের পড়া পড়তো সুবর্ণ।
না, মা কক্ষনো তার বিয়ে দিতো না তাড়াতাড়ি। বাবু বললেও না। ঠাকুমাই তার শনি। ঠাকুমা তাঁর সইয়ের মেয়েকে নাতনীর শাশুড়ী করে দিয়ে সইয়ের কাছে সুয়ো হলেন। সাধে কি আর ঠাকুমার কাছে যেতে ইচ্ছে করে না সুবর্ণর? মানুষটাকে যেন তার জীবনের শনি মনে হয়।
যেদিন বড় দুঃখ হয়, অপমান হয়, রাতদুপুরে এইসব চিন্তায় ছটুফট করে মরে সুবৰ্ণ, আর সমস্ত ছাপিয়ে মায়ের উপর একটা দুরন্ত অভিমানে দীর্ণ হতে থাকে।
মা তো দিব্যি চলে গেল!
সুবৰ্ণ মরলো কি বাঁচিলো একবার ভাবলও না। মা যদি কলকাতায় থাকতো, সুবৰ্ণকে এমন করে একদুয়োরী হয়ে পড়ে থাকতে হতো!
বিয়ে হলে এসে মায়ের জন্যে কি কম গঞ্জনা সইতে হয়েছে সুবৰ্ণকে? তখন মানে বুঝতো না সব কথার, এখন তো বোঝে! বোঝে তো কী কলঙ্কের ডালি মাথায় নিয়ে সুবর্ণর জীবন শুরু!
সুবৰ্ণর সামনেই তো গিন্নীরা বলাবলি করেছে, হ্যাঁগা ঘরণী গিন্নী, সংসারী বিয়ের যুগ্যি দুদুটো ব্যাটা, আমন শিবতুল্য স্বামী, আর মাগী কি না কুলে কালি দিয়ে চলে গেল!
বেয়ানের দোষ ঢাকতে যত না হোক, নিজের বংশের মান সামলাতেই তাড়াতাড়ি বলতেন, কুলে কালি অবিশ্যি নয়, তবে স্বামী-পুতুরের মুখে চুনকালি দিয়ে তো বটেই। মেয়েকে ইস্কুলে দিয়ে হাতী করবেন, এই বাসনায় ছাই পড়লো, শাশুড়ী বেগতিক দেখে নাতনীটাকে নিজের কাছে আনিয়ে নিয়ে ঝটপট বে দিয়ে ফেলল, এই রাগে গরগরিয়ে মানুষ ঠিকরে চলে গেলেন কাশীবাস করতে!
কাশীবাস! হুঁ! এই বয়সে কাশীবাস!
মহিলারা নাক সিটকোন। অর্থাৎ পুরোপুরি অগ্রাহ্যই করেন কথাটা। এতক্ষণ যে সুবর্ণর মার বিয়োসের ব্যাখ্যায় তৎপর হচ্ছিলেন, তা মনে রাখেন না।
মুক্তকেশী। আবার সামলান।
বলেন, কাশীতে যে বাপ বুড়ো আছেন গো মাগীর!
থাকুক। ঝঙ্কার দিয়েছেন তারা, বলি স্বামী-পরিত্যাগিনী তো বটে! সে মেয়েমানুষের আর রইল কি? তুমি ভাই মহৎ, তাই আবার ওই বৌকে ঘরে তুলেছি, কোন না হাতেও জল খাবে।
মুক্তকেশী সদৰ্পে ঘোষণা করেছেন, জলি? জল আমি কোনো বেটির হাতেই খাই না। আপন পেটের মেয়েদের হাতেই খাই নাকি? যেদিন থেকে হাত শুধু করেছি, একবেলা স্বপাক হবিষ্যি, আর একবেলা কাঁচা দুধ গঙ্গাজল, ব্যস!
গরবিনী মুক্তকেশী অতঃপর আপনি কৃন্ত্রসাধনের ব্যাখ্যা করতে বসতেন, সুবর্ণ হাঁ করে শুনতো। হ্যাঁ করেই, কারণ তখন তো জানতো না সুবৰ্ণ, আচমনী খাদ্য মানে কি, অম্বুবাচী কাকে বলে, নিরন্তু উপোসের দিন বছরে ক’টা?
দীর্ঘশ্বাস-মর্মরিত ঘর ক্রমশ স্থির হয়ে আসে, সারাদিনের পরিশ্রান্ত মেয়েটার চোখে ঘুম আসে নেমে, সঙ্কুচিত হয়ে ঘুমন্ত মানুষটার ছোঁওয়া বাঁচিয়ে শুয়ে পড়ে সে। লোকটার ওই পরিতৃপ্ত ঘুমন্ত দেহটার দিকে তাকিয়ে কেমন ঘৃণা আসে, অপবিত্র লাগে লোকটাকে।
এই কিছুক্ষণ আগেই যে ওর আদরের দাপটে হিমশিম খেতে হয়েছে, তা ভেবে বুকটা কেমন করে ওঠে।
কিন্তু কী করবে সুবৰ্ণ?
চারিদিকে কত লোক, বিদ্রোহ করে কি লোক-জানাজানি কেলেঙ্কারি করবে? তা ছাড়া সব দিনগুলোই তো আজকের মত নয়? সব দিনেই কিছু আর বিদ্রোহ আসে না। নিজের মধ্যেও কি নেই ভালবাসার আর ভালবাসা পাবার বাসনা?
কী করবে। তবে সে? ওকে ছাড়া আর কাকে? আর ওই মানুষটা ভালবাসার একটাই অর্থ জানে, আদর করবার একটাই পদ্ধতি।
নেব না বললে দাঁড়াবে কোথায় সুবৰ্ণ?