সুধানাথবাবু মন্ত্রী হলেন
সুধানাথবাবু কখনও আশা করেননি যে তিনি মন্ত্রী হবেন। এমনকী তার পরিচিতজনেরা যারা কখনও কখনও তাঁকে স্নেহচ্ছলে বোকা-সুধা বলে, অবশ্য তার অগোচরে, তাঁরাও ভাবেননি যে তিনি মন্ত্রী হবেন।
সুধাবাবু, আমাদের সুধানাথ মিত্র একটা স্কুলে মাস্টারি করতেন, মন্ত্রী হওয়ার পরেও স্কুলের হাজিরা খাতায় তার নাম রেখে দিচ্ছেন, অর্থাৎ মন্ত্রিত্ব ছেড়ে যেকোনও সময় মাস্টারিতে ফিরে যেতে পারেন। তাকে যারা বোকা-সুধা বলে তারাই বোকা।
আসলে মন্ত্রী হওয়ার সুধাবাবুর কোনও কথাই ছিল না। তিনি অবশ্য পুরনো এম এল এ তিনবার ভোটে লড়ে দুবার জিতেছেন, এবার সমেত।
এম এল এ অনেকেই হয়। সারা ভারতে অন্তত হাজার পাঁচেক এম এল এ আছে, প্রাক্তন এম এল এর সংখ্যা তা পঁচিশ-পঞ্চাশ হাজার হতে পারে।
কিন্তু সুধানাথ মিত্র সাধারণ রাজনৈতিক নেতা ননয়। এম এল এ থাকাকালীন এবং তার আগে ও পরে, মফসসলে থাকা সত্ত্বেও তিনি বহুবার দূরদর্শন সমেত খবরের কাগজ এমনকী দিশি-বিলিতি ইংরেজি পত্র-পত্রিকার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাঁর সম্পর্কে এদিক ওদিকে অনেক আলোচনা হয়। ও হয়েছে।
একবার চিনির দাম বেড়ে যাওয়ার প্রতিবাদে তিনি তার এলাকায় একটি সরকারি মিটিংয়ে মন্ত্রী, সভাধিপতি, জেলাশাসক সমেত সমবেত অতিথিদের না জানিয়ে নুন-চা খাইয়েছিলেন। বলাবাহুল্য, সবাই সোনামুখ করে সে চা খেয়েছিলেন, কেউ কোনও প্রশ্ন করেননি, চিনির বদলে নুন কেন, জানতে চাননি।
পরদিন সুধানাথবাবুর বক্তব্য কাগজে বেরিয়েছিল, পঞ্চাশ গ্রাম নুনে পাঁচশো গ্রাম চিনির কাজ হয়ে যায়, আমরা এরপর থেকে চিনি না খেয়ে শুধু নুন খাব। নুনের দামও কম।
নুন না চিনি?
এই রকম হেডলাইন দিয়ে বাংলা কাগজগুলিতে পরদিন দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল।
কোনও কোনও কাগজে বেশি নুন খেলে রক্তচাপ বাড়বে কি না, বেশি চিনি খেলে রক্তে শর্করা বৃদ্ধি হবে কি না, এই নিয়ে প্রথিতযশা চিকিৎসকেরা দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন।
অন্য একবার এক আন্তর্জাতিক ব্যাপারে, দক্ষিণ আফ্রিকায় গণধর্ষণের প্রতিবাদে সুধানাথবাবু নিকটবর্তী হাইওয়ে অবরোধ করেছিলেন। এলাকার যত গবাদি পশু, গোরু-মোষ, ষাঁড়-বলদ এমনকী পাঁঠা-ছাগল পর্যন্ত এনে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে দেন। প্রচুর খড়-বিচালি এবং ঘাসের বন্দোবস্ত হয়েছিল। ফলে হাইওয়ের প্রায় পাঁচশো মিটার এলাকা গোহাটের চেহারা ধারণ করে। বাস, ট্রাক, গাড়ি দূরের কথা অটো যাতায়াত পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়।
সংবাদ পেয়ে সদর থেকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আসেন। তিনি চৌখস লোক। তিনি সর্বসমক্ষে সুধানাথবাবুকে কথা দেন যে ভবিষ্যতে যাতে এরকম না হয় তার জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন।
এহেন সুধানাথবাবু এতটা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও এবং পুরনো এম এল এ হলেও মন্ত্রী হওয়ার কথা ছিল না।
অবশ্য তিনি যে-দলের সদস্য সে-দল শাসক গোষ্ঠীর অন্তর্গত। তা ছাড়া তিনি তার দলের মধ্যেকার দ্বিতীয় উপদলের লোক। দলের কর্তামি মোটামুটি প্রথম উপদলই করে থাকে।
প্রথম উপদলের প্রবীণ নেতা হরিনাথবাবুই দল-প্রধান। তিনিও এম এল এ।
তবে প্রথম প্রথম হরিনাথবাবু অর্থাৎ হরিনাথ চাকলাদারও অবশ্য মন্ত্রী ছিলেন না।
হরিনাথবাবু বা সুধানাথবাবু যে রাজনৈতিক মতে বিশ্বাস করেন, সেই মতবাদে ঈশ্বর বা ভাগ্যের কোনও ঠাই নেই। কিন্তু হরিনাথবাবু সেবার জনগণের আগ্রহের আতিশয্যে একটি শ্রীশ্রীসন্তোষী মায়ের পুজোর উদ্বোধন করেছিলেন।
এর অব্যবহিত পরে শ্রীশ্রীসন্তোষী মায়ের দয়াতেই হোক বা ভাগ্যবলেই হোক, একটা ব্যাপার ঘটে।
একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন দেশে কুমির প্রকল্প খাতে বহু লাখ ডলার মানে বহু কোটি টাকা অনুদান আসে। কুমির প্রকল্পের কাজ মোটামুটি কুমির নিধন বন্ধ করা, জীবিত কুমিরদের সুস্থ দেহে বাঁচিয়ে রাখা, কুমিরদের বংশবৃদ্ধিতে সহায়তা করা।
কিন্তু কুমির প্রকল্পের বিশাল টাকার কথা জানার পরে বিভিন্ন মন্ত্রীর মধ্যে নানা রকম বাদবিতণ্ডা এবং মনোমালিন্য দেখা দিল। বনদপ্তর বললেন, কুমির প্রকল্প আমাদের। মৎস্য দপ্তর দাবি জানালেন, কুমির হল জলজন্তু, মাছের মধ্যেই পড়বে। প্রাণিকল্যাণ বিভাগের বক্তব্য খুব জোরালো, কুমিরের দেখভাল করার অধিকার একমাত্র তাদেরই। অবশেষে পঞ্চায়েত বিভাগ এবং জলসেচ বিভাগও একই রকম দাবি পেশ করলেন।
গোলমালের ভয় দেখে স্থিতধী রাজনৈতিক নেতারা বহু আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নিলেন নতুন কোনও মন্ত্রীর অধীনে নতুন শাখা খোলা হবে, কুমির দপ্তর। ডিপার্টমেন্ট অফ ক্রোকোডাইলস।
এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হল। কুমির প্রকল্প প্রার্থী বিভিন্ন মন্ত্রীর মধ্যে কাজিয়া থামল। আবার হরিনাথবাবুদের দল থেকে একজনকে মন্ত্রিসভায় নেওয়া গেল। উচ্চতম পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে খবর ছিল যে মন্ত্রিসভায় স্থান না পেয়ে হরিনাথবাবুদের দল চাপা রাগে ধুকছে। যেকোনও সময়ে বিদ্রোহী হতে পারে।
হঠাৎ রাতারাতি নতুন দপ্তর সৃষ্টি হয়ে গেল। হরিনাথবাবু মন্ত্রী হয়ে গেলেন। সুধানাথবাবু মন্ত্রী হওয়ার আশা করেননি। সুতরাং তাঁর ক্ষুব্ধ হওয়ার কোনও কারণ ছিল না। বরং এই খবর জানার পর তিনি একটি দামি ফাউন্টেন পেন উপহার দিয়ে হরিনাথবাবুকে অভিনন্দন জানালেন। হরিনাথবাবুও হৃষ্টচিত্তে সেই উপহার গ্রহণ করলেন।
কিন্তু হরিনাথবাবুর কপালে এই সৌভাগ্য দীর্ঘস্থায়ী হল না। যে কারণে এরকম হল সেটা কারও কারও কাছে হাস্যকর মনে হলেও হরিনাথবাবুর পক্ষে ভয়াবহ।
.
ঘটনাটা পরিষ্কার করে বলা প্রয়োজন।
শরৎচন্দ্র তার এক বিখ্যাত উপন্যাসে এরকম লিখেছিলেন যে, যে মদ খায় সেই কখনও না কখনও মাতাল হয়, না হলে সে মদের বদলে জল খায়।
হয়তো আমার উপস্থাপনে একটু এদিক ওদিক হয়ে গেল। কিন্তু বক্তব্য এই রকমই। বহু পরিচিত এই বাক্যটি শরৎচন্দ্রের পাঠকেরা ভালই জানেন।
এখানে কারও কারও মনে এমন সন্দেহ হতে পারে যে আমি হরিনাথবাবু কিংবা সুধানাথবাবু, এঁদের পানদোষ সম্পর্কে কোনও গোলমেলে কথা বলতে যাচ্ছি।
না। সেরকম কোনও তথ্য আমার জানা নেই। এই কাহিনির পক্ষে প্রাসঙ্গিকও নয়। তদুপরি এঁরা নীতিবাদী রাজনৈতিক নেতা, এঁরা নিজেদের আদর্শে ঝুঁদ হয়ে আছেন। এঁরা মদ্যপান করতে যাবেন কোন দুঃখে?
মদ-টদ নয়, আমরা যাচ্ছি একটা সুপরিচিত যন্ত্রের প্রসঙ্গে। লিফট নামক যন্ত্রটি সকলেরই পরিচিত। অনেকেই প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে লিফট দিয়ে ওঠানামা করেন। লিফট বহুতল বাড়িতে অপরিহার্য। লিফট ব্যবহারে সিঁড়ি দিয়ে নামা-ওঠার ধকল ও সময় দুই-ই বাঁচে। আমাদের এই কাহিনিতে লিফট খলনায়ক।
লিফট ব্যবহারের একটা সমস্যা আছে। মহামতি শরৎচন্দ্রকে অনুসরণ করে বলতে পারি, যে লিফটে করে ওঠানামা করে, সেই কখনও না কখনও লিফটে আটকিয়ে যায়। নয় সে লিফটে না গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করে। বেশি কথা কী, পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মহোদয় স্বয়ং তাঁর খাসতালুক খোদ রাইটার্সে বোধহয় একাধিকবার লিফটবন্দি হয়েছেন।
.
এইবার আসল কথায় ফিরে আসি।
হরিনাথবাবু যথাদিবসে মন্ত্রী হওয়ার শপথ নিলেন। শপথের দিন সুধানাথবাবু তাঁর সঙ্গেই ছিলেন। শপথ নেওয়ার পরে মামুলি চা-পান ইত্যাদি এবং সৌজন্যমূলক আচরণ শেষ করে হরিনাথবাবু সুধানাথবাবু এবং আরও কয়েকজন সহকারে নিজের দপ্তরে এলেন।
নতুন মন্ত্রী। নতুন দপ্তর।
কুমির ডিপার্টমেন্টের জায়গা মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র রাইটার্স বিল্ডিং নামক বিশাল প্রাসাদে হয়নি। আরও অনেক দপ্তরের মতো হরিনাথবাবুর দপ্তরেরও স্থান হয়েছে লবণহ্রদ উপনগরীতে নবনির্মিত একটি ভবনে।
ভবনের ছয়তলায় অফিস। তবে অসুবিধে নেই। প্রশস্ত সিঁড়ির পাশেই লিফটের বন্দোবস্ত রয়েছে।
নির্দিষ্ট ভবনে এসে সাঙ্গোপাঙ্গ সহ মাননীয় মন্ত্রী লিফটে উঠলেন। লিফটম্যানের মন্ত্রীমহোদয়কে চিনতে অসুবিধে হয়নি। আজ যে নতুন মন্ত্রী কাজে যোগদান করতে আসছেন, কেয়ারটেকার অফিস থেকে সে খবর তাকে আগেই জানানো হয়েছিল।
সে মন্ত্রীমহোদয়কে সসম্ভ্রমে কুর্নিশ করে চেলা-চামুণ্ডা, সুধানাথবাবু সহ তাঁকে লিফটে তুলল। লিফটে লোকসংখ্যা একটু বেশি, প্রায় ডবল হয়ে গেছে। কিন্তু সবাই মন্ত্রীর সঙ্গী কাউকে নেমে যেতে বলার সাহস লিফটম্যানের নেই।
সবাই ঘেঁষাঘেঁষি দাঁড়িয়ে। লিফট উপরে উঠছে।
নতুন যুগের হালফ্যাশনের লিফট। সাবেকি লিফটে কোলাপসিবল গেট। বাইরেটা দেখা যায়, বাইরে থেকে ভেতরটা দেখা যায়। আলো-বাতাস খেলে।
কিন্তু আধুনিক লিফট। রীতিমতো এয়ারটাইট। কাঠের দরজা বন্ধ হলে বহির্জগৎ থেকে আলাদা হয়ে যায়। প্রাকৃতিক আলো-হাওয়ার কোনও সুযোগ নেই। ভিতরে অবশ্য বৈদ্যুতিক আলো-পাখা আছে।
সে যা হোক নতুন লিফটে নতুন অফিসে মসৃণভাবেই উঠছিলেন সপারিষদ মন্ত্রীমশায়। কিন্তু তিনতলা অথবা চারতলার কাছাকাছি হঠাৎ কাঁচ করে লিফটটা আটকে গেল। বোধহয় লোডশেডিং, কারণ আলো-পাখাও বন্ধ হয়ে গেল।
হরিনাথবাবু, সুধানাথবাবু এঁরা সব মফসসলি নেতা। খোলা আলোবাতাসের মানুষ। লিফটের স্বল্পপরিসর প্রকোষ্ঠে পনেরো-ষোলোজন লোকের সঙ্গে হরিনাথবাবু দরদর করে ঘামতে লাগলেন। তিনি মোটা মানুষ। হাঁপানির রোগী। গরমে হাঁসফাস করতে লাগলেন।
লিফটম্যান অবশ্য অভয় দিল, ও কিছু নয়। লোডশেডিং। এখনই ডায়নামো চলবে। লিফট চালু হয়ে যাবে।
এই অভয়বাক্যে হরিনাথবাবুর কিন্তু কোনও সুরাহা হল না। তাঁর হাফ শুরু হল। দম বন্ধ হয়ে এল।
সুখের কথা লিফটম্যানের কথার সত্যতা প্রমাণ করে একটু পরেই লিফট আবার চালু হল। আলো জ্বলল, পাখা ঘুরল।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই লিফট ছয়তলায় নির্দিষ্ট স্থানে এসে থামল। ততক্ষণে হরিনাথবাবুর হয়ে গেছে। তাকে ধরাধরি করে লিফট থেকে বার করে মন্ত্রীর আসনে বসানো হল।
কিন্তু তিনি কেমন এলিয়ে পড়লেন। মন্ত্রীর ঘরের সঙ্গে যুক্ত একটা ছোট বিশ্রামকক্ষ আছে। সেই বিশ্রামকক্ষে একটা আরামকেদারা আছে। একটু পরে তাকে সেখানে নিয়ে অর্ধশায়িত করা হল।
শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরের ঠান্ডার মাত্রা বিচক্ষণ আর্দালি নবনিযুক্ত মন্ত্রীর দশা দেখে চরমে তুলে দিল। কিন্তু তবুও হরিনাথবাবু ঘেমে চলেছেন এবং ওফ ওফ করে হাঁফ তুলছেন।
হরিনাথবাবুর শ্যালক সঙ্গেই ছিলেন। তিনি এবার তার নিজের শ্যালককে ফোন করলেন। এই ভদ্রলোক কলকাতায় এক নামী হাসপাতালের প্রথিতযশা চিকিৎসক। সম্প্রতি ডাক্তারবাবুর চিকিৎসাধীন এক এইডসের রোগী তিনতলার জানলা থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে।
এইডসের রোগীরা সাধারণত স্বজনপরিজনহীন একঘরে হয়। এক্ষেত্রেও দীর্ঘ দেড়মাস চিকিৎসা। কালে এই ব্যক্তিকে কেউ দেখতে আসেনি। কিন্তু তার আত্মহত্যার খবর জানার পর তার আত্মীয়পরিজনেরা দলে দলে সমাগত হয়ে হাসপাতালের চত্বর ঘিরে ফেলে। তাদের হাতে হাতে শাবল, লোহার রড, লাঠি হাতবোমা।
তখন আর কোনও উপায় ছিল না। শ্যালকের শ্যালক নিরুপায় ডাক্তারবাবু তার চিকিৎসাধীন। মেটিয়াবুরুজের এক রক্ষণশীলা রমণীর বোরখা চুরি করে সেটা পরে পালিয়ে আসেন। তার আগে অবশ্য মহিলাকে ঘুমের ইঞ্জেকশান দিয়ে অচেতন করে রেখেছিলেন।
ডাক্তারবাবু এই বোরখা পরে ভিড়ের পাশ কাটিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসেন। ডাক্তারবাবু বেঁটেখাটো মানুষ ডাকাবুকো বিহারি মহিলার বোরখা তার চমৎকার ফিট করে যায়। সেদিন এইভাবেই তিনি প্রাণে বাঁচেন। তারপর থেকে তিনি এই লবণহ্রদেই একটি গেস্ট হাউসে গোপনে ছদ্মনামে অধিষ্ঠান করছেন।
হরিনাথবাবুর শ্যালকের কাছে তার ফোন নম্বর ছিল। তাকে গেস্ট হাউসে ফোন করলে তিনি সব শুনে দ্বিধাগ্রস্তভাবে বললেন, আমি কিন্তু বোরখা পরে যাব। কোথায় কে চিনে ফেলে, ভয়ে আছি!
উত্তর পেলেন, তাই এসো। তবে তাড়াতাড়ি।
ডাক্তার ভদ্রলোক ডা. শান্তিভূষণ রায় সংক্ষেপে ডা. এস বি রায়, এসে সব দেখে বললেন, তেমন কিছু হয়নি। একটু রেস্ট দরকার।
.
হরিনাথবাবুর রেস্টের বন্দোবস্ত হল একটি মহার্ঘ নার্সিংহোমে। তাতে কী আসে যায়, এখন তো তিনি মন্ত্রী, এখন থেকে তার সমস্ত খরচ বহন করবে সরকার।
তিন সপ্তাহের মধ্যে হরিনাথবাবু মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠলেন। কিন্তু তার মনের মধ্যে একটা দমবন্ধ ভয় ঢুকে গেছে। লিফটে আটকিয়ে যাওয়ার কথা মনে হলেই বুকের মধ্যে কেমন ধড়ফড় করে ওঠে। এক একদিন রাতে ঘামতে ঘামতে গোঙাতে গোঙাতে ঘুম ভেঙে লাফিয়ে উঠে পড়েন। সাংঘাতিক দুঃস্বপ্ন দেখেছেন, কারা যেন গলায় ফাঁস দিয়ে বুকের ওপর পাথর, বিশাল একটা দশমনি কালো পাথর, চাপা দিয়ে দিয়েছে।
শান্তি ডাক্তার এখনও সকাল-সন্ধ্যা দুবেলাই আসেন। তার নিজের ভয় এখনও কাটেনি। ঘুমে-জাগরণে সর্বদা তার আশঙ্কা হয় এই বুঝি দলে দলে লোক লাঠি-সোঁটা শাবলবল্লম নিয়ে ছুটে আসছে, যেরকম ছোটবেলায় তাদের দেশের বাড়িতে দেখেছেন, শুয়োর-মারার দল বেরিয়েছে মুখে তাদের বুনো শুয়োরের মতো চাপা চিৎকার, ঘোঁৎ-ঘোঁৎ, ঘোঁৎ-ঘোঁৎ।
ডাক্তারবাবু হাসপাতালে যাওয়া পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছেন। কোথায় আছেন, কী করছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানাননি। গেস্ট হাউসে নিরিবিলি থাকেন। আর নার্সিংহোমে হরিনাথবাবুকে দেখতে আসেন। এখনও ট্যাক্সি করে, বোরখা পরে যাতায়াত করেন। তিনি কেজো মানুষ, হাতে কোনও কাজ না থাকায় তিনি দুবেলাই হরিনাথবাবুর কেবিনে বেশ কয়েকটা ঘণ্টা কাটিয়ে যান। কিছুটা চিকিৎসা, বাকি সময় কথাবার্তা-আলোচনা। দুই আতঙ্কী পরস্পর ভয় ও স্বপ্ন বিনিময় করেন।
ধীরে ধীরে হরিনাথবাবুর অফিসের লোকজন নার্সিংহোমে আসতে লাগল। তারা কাগজ-পত্র, ফাইল নথি অল্প অল্প করে আনতে লাগল।
নার্সিংহোমের মনঃসমীক্ষক বলেছেন, আতঙ্কের দিক থেকে মনটাকে সরাতে হবে। ধীরে ধীরে কাজকর্ম আরম্ভ করতে হবে। পারলে, অল্প কিছু সময়ের জন্য অফিসে গেলে শরীর ও মন উভয়ের উপকার হবে।
এদিকে যে বিশ্ব প্রতিষ্ঠান কুমির প্রকল্পের জন্য অর্থ সাহায্য করছে, তারা তো বটেই সেই সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার এমনকী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া প্রাণিমঙ্গল কমিটি, নিখিল বিশ্ব জলজন্তু বান্ধব সমিতি এই রকম নানা দিক থেকে প্রচণ্ড চাপ আসছে কুমির প্রকল্পের কাজ আরম্ভ করতে।
স্বয়ং মানেকা গান্ধী মন্ত্রী থাকাকালীন দৈনিক একবার করে ফোন করে খোঁজ নিয়েছেন কুমির প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে। মন্ত্রী অসুস্থ জেনে আমলাদের ধমকেছেন, আপনারা কী করতে আছেন? এখন তো অবস্থা আরও ভয়াবহ, মন্ত্রিত্ব চলে যাওয়ার পর থেকে মানেকা দৈনিক দুবার-তিনবার ফোন করছেন, কখনও ব্যক্তিগতভাবে, কখনও জীবে প্রেম প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে।
কাজ মোটেই কম নয়।
এখন বর্ষাকাল। আগামী শীতের শেষাশেষি বিশ্ব কুমির প্রেমিক ফাউন্ডেশনের (World Crocodile Lovers Foundation) কর্মকর্তারা প্রকল্পের কাজ দেখতে আসবেন। তার আগে বড়দিনের সময় রাজ্যপাল কিংবা অনুরূপ কেউকেটা প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন।
তার আগে সুন্দরবনের গভীরে অন্তত তিনটি কুমিরের হাসপাতাল করতে হবে অসুস্থ এবং বৃদ্ধ কুমিরদের পরিচর্যার জন্যে, গোটা দশেক কুমির প্রসূতিসদন স্থাপন করা হবে বনের মধ্যে খাঁড়ির মুখে।
ইতিমধ্যেই কোথায় কোন ব্লকে, কোন মৌজায় প্রসূতিসদন হবে, হাসপাতাল হবে তাই নিয়ে বাদা এলাকায় রীতিমতো গোলমাল শুরু হয়ে গেছে।
এদিকে মূল কুমির প্রকল্প কোথায় হবে, কোথায় বসবেন এই প্রকল্পের অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি, ডিরেক্টর, উপ ডিরেক্টর, সহ ডিরেক্টর, রিসার্চ অফিসার, ইনস্পেক্টর, কেরানি, পিয়ন–এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
সর্বসমেত একশো বাহান্নটি পদ মঞ্জুর হয়েছে। সেগুলির নীচের দিকের পদগুলি স্থানীয় ভূমিপুত্রদের দিয়ে পূরণ করতে হবে।
অনেক বাছাবাছির পর শেষ পর্যন্ত কুমিরখালি এবং কুমিরালয় নামে দুটো মোটামুটি গঞ্জ শহর মনোনীত হয়েছে। এর মধ্যে যেকোনও একটিতে প্রকল্পের হেড অফিস হবে।
কোথায় প্রকল্প হবে তা নিয়ে কুমিরখালি এবং কুমিরালয়ের একই দলের দুই এম এল এর মধ্যে জেলা পরিষদের বারান্দায় ছাতাছাতি হয়েছিল। সেই ছাতার লড়াইয়ে একজনের ছাতা ভেঙে যায়, আরও একজনের মাথা ফেটে যায়। এম এল এ বলে পুলিশ এঁদের চালান দেয়নি। কিন্তু সেই ছত্রযুদ্ধের চার কলমব্যাপী ছবি এবং বিশদ বিবরণ খবরের কাগজে বেরিয়েছিল।
হরিনাথবাবু নার্সিংহোমে থাকতে থাকতেই এসব ঘটনা ঘটে। তিনি অবশ্য ধুরন্ধর রাজনীতিক, তিনি জানেন, এসব ক্ষণকালের ব্যাপার। একদা বাংলায় এম এ পড়েছিলেন, তিনি জানেন,
স্ফুলিঙ্গ তার পাখায় পেল
ক্ষণকালের ছন্দ
উড়ে গিয়ে ফুরিয়ে গেল
সেই তারি আনন্দ।
তিনি জানেন এসব গোলমাল বেশিদিন থাকতে পারে না। শেষ পর্যন্ত যা হবে তাই সবাই গুটিগুটি মেনে নেবে।
এসবের থেকে অনেক বড় সমস্যা আজ কয়েকদিন হল হরিনাথবাবুকে তাড়া করছে। বিশ্ব সংস্থার নির্দেশ অনুযায়ী বছরে অন্তত দুহাজার নবীন কুমির চাই, এক্ষেত্রে নবীন মানে সদ্য জন্মানো।
কুমির প্রকল্পের প্রধান গবেষক, ইতিপূর্বে তিনি সাইবেরিয়ার হাস কেন দশ হাজার কিলোমিটারের বেশি উড়তে পারে না এবং জলহস্তী ও গণ্ডারের ক্রমবিবর্তন, দশ লক্ষ বছরের মধ্যে সব জলহস্তীই গণ্ডার হবে, অন্যথায় সব গণ্ডারই জলহস্তী হয়ে যাবে, এই জাতীয় গবেষণাপত্র সম্পাদনা করেছেন।
গবেষক মহোদয়কে সঙ্গে নিয়ে কুমির প্রকল্পের নবনিযুক্ত সচিব এলেন নার্সিংহোমে মন্ত্রীমহোদয়ের সঙ্গে দেখা করতে। সচিব মানে সেক্রেটারি সাহেব একদা বিখ্যাত ছাত্র, তুখোড় ব্যক্তিত্ব কিন্তু তার একটাই দোষ, তিনি কখনও কিছু না করে শুধু পাতার পর পাতা প্রেমের কবিতা লিখেছেন, ছাত্রজীবনে এক হাজার, চাকরিজীবনে তিন হাজার।
আজ নতুন মন্ত্রীকে শোনানোর জন্যে কবি-সচিব একটি পদ্য লিখে এনেছেন,
কুমিরের সুখদুঃখ
কুমিরের ভালবাসাবাসি।
কুমিরের চোখে অশ্রু
কুমিরের মুখ ভরা হাসি ॥…
বেশ দীর্ঘ কবিতা। কবিতাটি ভালই লাগল হরিনাথবাবুর, তার চেয়ে ভাল লাগল কবি-সচিবকে। শুধু আপত্তি জানালেন কুমিরের চোখে অশ্রু কথাটায়। কুম্ভিরাশ্রু বলে একটা কথা আছে, কথাটা কুমির-বিরোধী, কুমিরের খল চরিত্র প্রকাশ পায়।
সচিব সঙ্গে সঙ্গে সানন্দে কুমিরের চোখে অশ্রু কেটে কুমিরের চোখে মায়া করে দিলেন। হরিনাথবাবু সেটা গ্রহণ করে বললেন, কুমির প্রকল্প নিয়ে পুস্তিকা প্রকাশিত হবে, তার প্রথমেই এই কবিতাটা দিয়ে দেবেন।
এমন তারিফ কবিদের ভাগ্যে সচরাচর জোটে না। কবি-সচিব যেন হাতে চাঁদ পেলেন।
এবার হরিনাথবাবু বললেন, আচ্ছা, ওই কুমির প্রকল্প নামটা কেমন হালকা, ইংরেজিতে ক্রোকোডাইল শব্দটা কেমন জবরদস্ত।
সচিব অভিমত দিলেন, কুম্ভির প্রকল্প করা যায়। কিন্তু কুমির প্রকল্প সহজবোধ্য, আজকাল হালকার যুগ, এই তো ক্যালকাটা, কলিকাতা সব কলকাতা হয়েছে।
হরিনাথবাবুর মাথার মধ্যে অনেক কিছু খেলছিল। তিনি বললেন, আচ্ছা, কুম্ভিলক বলে একটা কথা আছে না।
সচিব হেসে বললেন, তা আছে কিন্তু তার সঙ্গে কুমিরের কোনও সম্পর্ক নেই৷ কুম্ভিলক মানে চোর, লেখা-চোর। লেখা চুরিকে বলে কুম্ভিলকবৃত্তি, মানে অন্যের লেখা চুরি করে লেখা।তারপর হরিনাথবাবুর টেবিলের ওপর একটা বই ছিল, সেই বইটির দিকে তাকিয়ে সচিব বললেন, আপনার ওই তারাপদবাবু, কুম্ভিলক বৃত্তির জন্যে তিনি বিখ্যাত, যত সব অন্যের লেখা টুকে লেখেন।
সেদিনের মতো আলোচনা শেষ হল।
দুদিন পরে সচিব এলেন কুমির প্রকল্পের মূল সমস্যা নিয়ে।
সমস্যাটি গুরুতর। দু হাজার কুমির ছানা পেতে গেলে অন্তত দশ হাজার কুমিরের ডিম লাগবে। কিছু ডিম ফুটবে না, কিছু ডিম পচে যাবে, কিছু ডিম সাপে-শেয়ালে খেয়ে নেবে, কিছু বাচ্চা মরে যাবে। গবেষক জানিয়েছেন পাঁচ: এক অনুপাতে দু হাজার ছানার জন্যে দশ হাজার ডিম লাগবে।
দপ্তরের আশা ছিল সব ডিম সুন্দরবনের খাঁড়িতে যেখানে কুমির কিলবিল করছে সেখানেই পাওয়া যাবে। কিন্তু জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, একটি ডিমও পাওয়া সম্ভব নয়। সব ডিম কলকাতার বড় বড় হোটেল, রেস্তোরাঁয় চালান যায়, সেগুলো সেখানে সুস্বাদু ওমলেট, মোগলাই পরোটা, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, পুডিং ইত্যাদি খাদ্যে পরিণত হয়।
সব শুনে হরিনাথবাবু মাথায় হাত দিয়ে বললেন, সর্বনাশ! কুমিরের ডিম না পেলে একেবারে বেইজ্জত হয়ে যাব যে!
সচিব বললেন, এর পরে আরও বড় সমস্যা রয়েছে স্যার। দশ হাজার ডিম তা দিয়ে ছানা বার করতে অন্তত একশো মা কুমির লাগবে। সুন্দরবন থেকে কিছু কুমির হয়তো ধরে আনা যাবে, কিন্তু কোনটা মা কুমির, কোনটা বাবা-কুমির…
সচিবকে কথা শেষ করতে দিলেন না মন্ত্রী, তিনি অধীর হয়ে বললেন, তাহলে করবেন কী? সমাধান কিছু ভেবেছেন?
সচিব বললেন, সেই সমাধান নিয়েই আপনার কাছে এসেছি অনুমোদনের জন্যে।
নার্সিংহোমের বারান্দায় প্রকল্পের ডিরেক্টর, ফাইল হাতে বসেছিলেন। সচিব গিয়ে তাঁকে ডাকতে তিনি ফাইল নিয়ে ঘরে ঢুকলেন।
ফাইলে বলা হয়েছে, কুমিরের ডিম অথবা মা কুমির সংগ্রহ করা যখন প্রায় অসম্ভব, সরাসরি হাজার তিনেক কুমিরছানা কিনলেই হবে। এ জন্যে গ্লোবাল টেন্ডার দিতে হবে। মোটামুটি আফ্রিকার এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার কুমির-অধ্যুষিত দেশগুলির প্রধান দৈনিকপত্রে কুমিরছানার বিক্রয় প্রস্তাব আহ্বান করা হবে।
প্রস্তাবটি শুনে অনেক রকম ভাবলেন হরিনাথবাবু, যদি বিশ্বসংস্থাটি জানতে পারে যে কুমিরছানার প্রজনন না করে সরাসরি কুমিরছানা কেনা হয়েছে, তার পরিণাম মারাত্মক হতে পারে। কুমির প্রকল্প উঠে যেতে পারে।
মন্ত্রীর সংশয় জানতে পেরে সচিব ও ডিরেক্টর উভয়েই আশ্বস্ত করলেন, সে ভয় নেই। এজেন্সি মারফত লন্ডন কিংবা নিউ ইয়র্ক অফিস থেকে এজেন্সির নাম ঠিকানায় বিজ্ঞাপন হবে। কেউ বুঝতেও পারবে না, কারা কুমিরছানা কিনছে, কেন কিনছে।
হরিনাথবাবু সিক্রেট চিহ্নিত ফাইলটি তার বালিশের তলায় রেখে দিয়ে বললেন, আজকের দিনটা একটু ভাবি। কাল অফিসে যাব ভাবছি, তখনই ফাইলটা নিয়ে যাব।
কিন্তু এমনই দুর্দৈব যে পরের দিন অফিসে ওঠার সময় ওই একই লিফটে সেই তিনতলা ও চারতলার মধ্যে হরিনাথবাবু আবার লোডশেডিংয়ে আটকে গেলেন।
সচিবের কাছে নির্দেশ পেয়ে দপ্তরের প্রধান সহায়িকা গোপালী দেবী এবং মন্ত্রীর আর্দালি ভজন সিং তাঁকে নিয়ে যেতে এসেছিল।
লিফট আটকিয়ে যেতে চোখে অন্ধকার দেখলেন হরিনাথবাবু, দম বন্ধ হয়ে তিনি সটান গড়িয়ে পড়ে গোপালী দেবীর বক্ষলগ্ন হলেন। ঘটনাটা ইচ্ছাকৃত হলে শ্লীলতাহানির মামলা হয়ে যেত।
যা হোক, পাঁচ মিনিট পরে লিফট চালু হল। ছয়তলায় পৌঁছতে ভজন সিং দৌড়ে গিয়ে অফিসের লোকজন ডেকে আড়ল। গোপালী দেবীর বক্ষচ্যুত করে সবাই ধরাধরি করে হরিনাথবাবুকে তার ঘরে নিয়ে গেল।
আবার সেই আরামকেদারা, জলের ঝাপটা। বেশ কিছুক্ষণ পরে সংবিৎ ফিরতে আর্দালিকে ডেকে টেবিলে তুলে রাখা সিক্রেট ফাইলটা তুলে যথাস্থানে কঁপা হাতে সই করে গতদিনের প্রস্তাবটি অনুমোদন করে দিলেন।
তারপর ইজিচেয়ার থেকে নতুন কেনা সরকারি তোয়ালেটা তুলে নিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে কাউকে কিছু না বলে, ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লেন। আর লিফট নয়, এবার সিঁড়ির রেলিং ধরে ধরে জিরিয়ে জিরিয়ে নামতে লাগলেন।
প্রায় আধ ঘণ্টা লাগল, ছয়তলা নামতে। ইতিমধ্যে অফিসে টিফিনের সময় হয়ে গেছে। গোপালী দেবী লিফটের নীচে সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে টিফিন সারছিলেন, তার বাঁ হাতে শালপাতায় একটা ডিম সেদ্ধ, ডান হাতে একটা আধখাওয়া সিঙ্গাপুরি কলা। তিনি মাথায় তোয়ালে মোড়া মন্ত্রীকে টলতে টলতে নামতে দেখে তাড়াতাড়ি কলাটা ফেলে দিয়ে আর ডিমটা গলাধঃকরণ করে এগিয়ে গেলেন, স্যার?
প্রায় অজ্ঞান হওয়ার মুখে আবার এসে গিয়েছিলেন হরিনাথবাবু, গোপালী দেবীকে দেখে তিনি পরমাত্মীয়ের মতো জড়িয়ে ধরলেন। গোপালীও তাই চান। তিনি একাধিকবার বিবাহবিচ্ছিন্না, তার প্রাক্তন স্বামীরা এবং বর্তমান প্রেমিকেরা দেখুক মন্ত্রী তাকে জড়িয়ে ধরে হাঁটছেন, প্রকাশ্য দিবালোকে, সরকারি অফিসের চত্বরে।
গোপালী দেবী ড্রাইভারকে ডেকে মন্ত্রীকে নিয়ে নার্সিংহোমে পৌঁছে দিয়ে এলেন।
এর পরেও হরিনাথবাবু আরও দুয়েকবার অফিস করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু গাড়ি করে অফিস পর্যন্ত এসেছেন, তারপর লিফটের সামনে গিয়ে যেই দাঁড়িয়েছেন তার বুক ধড়ফড় শুরু হয়েছে। লিফটের দরজা পর্যন্ত যাওয়ার সাহস পাননি, ফিরে এসেছেন।
খেলোয়াড়, অভিনেতা, চিত্রতারকা, রাজনৈতিক নেতা এঁদের অসুস্থ হওয়ার নিয়ম নেই। এঁরা অসুস্থ, এমন কথা চালু হয়ে গেলে এঁদের পেশা বরবাদ হয়ে যায়।
হরিনাথবাবু প্রথম প্রবেশের দিন যে জ্ঞান হারিয়েছিলেন, সেটা নিয়ে কেউ খুব মাথা ঘামায়নি। মন্ত্রিত্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে যোগদানের দিনে কেউ কেউ অজ্ঞান হতেই পারে। কিন্তু এর পরবর্তী ঘটনা অফিস কর্মী, জনসাধারণ মারফত মিডিয়ার কর্ণগোচর হল।
খবরের কাগজে লেখালেখি শুরু হয়ে গেল।
অসুস্থ হরিনাথ কি মন্ত্রীপদের দায়িত্ব পালনে সক্ষম?
এই সঙ্গে আর একটা খারাপ ব্যাপার যুক্ত হল। হরিনাথবাবুর নার্সিংহোমে কোনও কোনও অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিক তার শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিতে যান। তারা দেখেন একজন বোরখা পরা ব্যক্তিকে সকাল-সন্ধ্যা হরিনাথবাবুর ঘরে ঢুকতে ও বেরোতে।
এই ব্যক্তিটি হলেন শান্তি ডাক্তার। কিন্তু বোরখার মধ্যবর্তী সাধারণ উচ্চতার শান্তি ডাক্তারকে রিপোর্টাররা মহিলা বলে ধরে নেন। এবার সংবাদ বেরোয় হরিনাথ মন্ত্রীর ঘরে গোপনে বোরখা পরিহিতা স্বাস্থ্যবতী মহিলাটি কে?
অবশেষে গোপালী দেবীর সঙ্গে জড়াজড়ি করে গাড়িতে চড়ে অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার গল্প পল্লবিত হয়ে খবরের কাগজ রসালো সংবাদের সৃষ্টি করল।
এর পরে বিদেশ থেকে কুমিরছানা ক্রয়ের সিদ্ধান্তটি কী করে ফাঁস হয়ে যায়।
অনেকে বলেন, এ সমস্ত ব্যাপারেই সুধানাথবাবুর হাত ছিল। তা থাকুক বা না থাকুক, বিদেশ থেকে মহার্ঘ বিদেশি মুদ্রায় কুমিরছানা কেনার বিষয়টি খবরের কাগজ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং জনসাধারণ ভালভাবে নিল না। সুন্দরবনের খালে-বিলে, খাড়িতে যেখান অগুনতি কুমিরছানা কিলবিল করছে, ভুবন বিখ্যাত কুম্ভির বংশের দেশজ কুমিরছানা না কিনে আফ্রিকা থেকে কুমিরছানা কেনার প্রস্তাবের প্রতিবাদে সকলে মুখর হয়ে উঠল।
এর পরে হরিনাথবাবুর আর গত্যন্তর ছিল না। তা ছাড়া লিফটে ওঠার ভয় তার বুকের মধ্যে সেঁধিয়ে গিয়েছিল। দলের ভিতর এবং বাইরে থেকে চাপ আসছিল। হরিনাথবাবু পদত্যাগ করলেন।
হরিনাথবাবুদের দলে মাত্র দুজন এম এল এ, দ্বিতীয়জন হলেন সুধানাথবাবু। স্বাভাবিকভাবেই তার এবার মন্ত্রী হওয়ার কথা। তাদের দলের প্রথম উপদল থেকে হরিনাথবাবু মন্ত্রী হয়েছিলেন। এবার দ্বিতীয় উপদল থেকে সুধানাথবাবুর মন্ত্রী হওয়ার পালা।
তদুপরি রাজনৈতিক দলে চিরাচরিত প্রথা হল যে দল থেকে মন্ত্রী বা এম এল এ অবসর গ্রহণ করেন, পদত্যাগ করেন বা মারা যান, সেই দল থেকেই শূন্যপদ পূরণ করতে হয়।
সুতরাং সুধানাথবাবুই মন্ত্রী হচ্ছেন। দুষ্ট লোকে জিজ্ঞাসা করছে, সুধানাথ মিত্রের তো কুমির বিষয়ে কোনও অভিজ্ঞতা নেই! হরিনাথবাবুরও ছিল না, কিন্তু প্রবীণ হরিনাথবাবুর ক্ষেত্রে এ প্রশ্ন ওঠেনি।
অবশ্য এ প্রশ্নের জবাবও সুধানাথবাবু দিয়েছেন। তিনি ধুতি তুলে হাঁটুর কাছে দুটো কালো ফুটকি দেখিয়ে সবাইকে বলছেন, কুমিরের কামড়ের দাগ। ছোটবেলায় মামার বাড়ি বসিরহাটে ইছামতী নদীতে স্নান করতে গিয়ে কুমির ধরেছিল, কুমিরের ব্যাপারে হাড়ে হাড়ে অভিজ্ঞতা আমার।
দুষ্ট লোকে বলছে, ও দাগ তো কুকুরের দাঁতের। গত বছর ইস্কুলের মাঠে বক্তৃতা করার সময় হঠাৎ একটা পাগলা কুকুর মঞ্চে উঠে সুধানাথবাবুর হাঁটু কামড়ে ধরে। বহু লোক সেটা দেখেছে। আবার কেউ কেউ বলছে ফরেনসিক পরীক্ষা করালেই জানা যাবে কুমিরের কামড়ের না কুকুরের দাঁতের দাগ।
মন্ত্রী হওয়ার প্রার্থীর ফরেনসিক চিকিৎসার কোনও বিধি নেই। আগামী সোমবার সুধানাথ মিত্র মন্ত্রী হচ্ছেন। তাঁর আমলে বাংলার খাল-বিল-নদী কুমিরে কুমিরে ভরে উঠুক ঈশ্বরের কাছে সেই প্রার্থনা করছি।
পুনশ্চ:
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেল শ্রীযুক্ত সুধানাথ মিত্র মন্ত্রী হওয়ার পর প্রথমেই রাজ্যের এবং দেশের স্বার্থবিরোধী কুমিরছানা ক্রয়ের গ্লোবাল টেন্ডারটি বাতিল করবেন। পরিবর্তে তিনি সুন্দরবনের কুমিরাঞ্চলে নদী ও খাড়ি থেকে একশোটি নতুন খাল কাটবেন। খাল কাটলেই কুমির আসবে। প্রতিটি খালে যদি অন্তত কুড়িটি করে কুমির প্রবেশ করে তা হলেই দু হাজারের কোটা পূরণ হয়ে যাবে। বিশ্বসংস্থা যদি এ নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলে যথাসময়ে সে প্রশ্নের রাজনৈতিক মোকাবিলা করা হবে।