Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সুখের দিন || Shirshendu Mukhopadhyay

সুখের দিন || Shirshendu Mukhopadhyay

মহারাজ, আমাদের সেইসব সুখের দিন কোথায় গেল?

তখন আকাশে কাঠচাঁপা ফুলের মতো চাঁদ উঠত। জ্যোৎস্নারাতে ছিল আমাদের নদীর ধারে সাদা বালির ওপর চড়ুইভাতি। আকাশ তখন কত নিভৃতে নেমে আসত! ঝাড়বাতির মতো থোপা। থোপা হয়ে আলো দিত গ্রহ-নক্ষত্র।

সে কি তুমি মহারাজ, যে রোজ আমাদের ঘুম ভাঙার আগে খুব ভোরে হরেকরকম রঙের। বালতি হাতে ঘুরে-ঘুরে রং করে দিয়ে যেতে গাছপালা, মাঠ, নদী আর আকাশ? সে কি তুমি মহারাজ যে প্রতিদিন আমাদের অন্ন আর জল আরও সুস্বাদে ভরে দিয়ে যেতে?

ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিন টের পেতুম, তুমি এসেছিলে। প্রতিদিন দু-হাত ভরে পেতুম নতুন একখানা জগৎ। তখন রোজ ছিল আমাদের জন্মদিন।

কড়াইশুঁটি ছাড়াতে বসলেই ঠাকুরমার মনে পড়ত গত জন্মের কথা। কে না জানে কড়াইশুটির খোলের মধ্যেই থাকে আমাদের সব পূর্বজন্মের কাহিনি। সবুজ মুক্তোদানার মতো সেই কড়াইশুটি ভরে থাকত গল্পে–গল্পে। কাঁচের বাটি উপচে পড়ত মুক্তোদানায়। কী সুন্দর যে। দেখাত। কী বলব তোমাকে তার চেয়েও সুন্দর ছিল আমাদের কোল কুঁজো ঠাকুমার ভাঙাচোরা মুখখানা। সত্য–সত্য, তিন সত্য মহারাজ, তখন কারও মরণ ছিল না। যে জন্মাত পৃথিবীতে তারই ছিল অমরত্বের বর।

কোথায় গেল সেইসব সুখের দিন?

তখন ফুলের ছিল ফুটবার নেশা, ফলের ছিল ফলবার আকুলতা। আমাদের বাগান তাই ছিল ভরভরন্ত। ফল ফুল উপচে পড়ত বেড়া ডিঙিয়ে। সারাদিন পতঙ্গের শব্দ হত বাগানে, পাখি ডাকত। পিপুল গাছের তলায় ছিল মস্ত এক পাথরের আসন। সেইখানে মাঝে-মাঝে জন্মান্তর থেকে মানুষেরা আসতেন।

একদিন ভোরবেলা আমাদের সাদা খরগোশ গিয়েছিল বাগানে, ফিরল সবুজ হয়ে। আমরা দৌড়ে বাগানে গিয়ে দেখি পাথরের আসনে বসে আছেন আমাদের প্রবৃদ্ধ এক প্রপিতামহ। পৃথিবীর ধুলোখেলা শেষ করে তিনি চলে গেছেন কবে! আমাদের দেখে বড় মায়াভরে চেয়ে রইলেন, বললেন–কিছু চাইবে?

তখন কী-ই বা চাওয়ার ছিল মহারাজ? তখন প্রতিদিন আমাদের ছোট পাত্র উপচে পড়ে আনন্দে। আর কী চাইব? আমরা বললুম–আমাদের সব কিছু নতুন রঙে রঙিন করে দাও। মস্ত সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে তিনি বললেন–যত গতি বেশি, সাদা সেখানে বেশি, যেখানে যত গতির অভাব সেখানে তত রং, এমনি করে সেভেন কলারস। দেখ ভাই, মন যত উচ্চস্তরে ওঠে, তত সব জ্যোর্তিময় দেখা যায়। গাছটা দেখলে সেও আলোর গাছ। যত মন স্কুল শরীরের দিকে থাকে, তত স্থূল হয়, তত কুচুটে হয়। মন যত বস্তু ভাবে তত কম্পন কমে যায়।

ভারী শক্ত কথা, তবু আমরা একটু-একটু বুঝলুম। পাথরের আসনে ঘিরে ঝুপঝুপ করে বসে পড়ে বললুম–তবে গল্প বলল ।

তেমন গল্প আর কখনও শুনিনি আমরা। সে হল আকাশ–নদীর গল্প। সে নদী সমুদ্রের মতো বিশাল; তার প্রবাহ অন্তহীন। তা আকাশের এক অনন্ত থেকে আর-এক অনন্তের দিকে চলে গেছে। সাদা দাড়িতে হাত বোলাতে-বোলাতে তিনি বলেন–একদিন দেখতে পাবে সেই উজ্জ্বল নদী। খুব কাছে, তবু অত সহজ নয় তার কাছে যাওয়া।

মহারাজ আমাদের ঘরের কাছেই ছিল পৃথিবীর ছোট নদী। তার তীরে সাদা ধপধপে বালিয়াড়ি। ছিল বালিয়াড়িতে জ্যোৎস্না রাতের চড়ুইভাতি। নদী কেমন তা আমরা জানি। তবু সেদিন আকাশ–নদীর গল্প শুনে আমাদের জীবনে অল্প একটু দুঃখ এল।

আমাদের সাদা খরগোশ হয়ে গিয়েছিল সবুজ। আমরা রং বড় ভালোবাসতুম। সেদিন বুঝলুম রংই সব নয়। আসল হচ্ছে কম্পন, আসল হল গতি। সুখের চেয়ে অনেক বড় হল জ্ঞান।

কে আমাদের পোষা ময়নাকে শিখিয়েছিল–বেলা যায়! বেলা যায়! ময়না দিনরাত আমাদের ডাকত–ওঠো, ওঠো ভোর হল। বেলা যায়। বলতে-বলতে দাঁড় বেয়ে সে সার্কাসের খেলুড়ির মতো ঘুরপাক খেত, হেঁটমুণ্ডু হয়ে ঝুলত। মুক্তি চাইত কি মহারাজ?

আমরা বিশ্বাস করতুম, আমাদের মৃত্যু নেই, জরা নেই, আমাদের বেলা কখনও যায় না। একভাবে বা অন্যভাবে সবাই চিরকাল বেঁচেবর্তে থাকে।

তখন কী পুরু সর পড়ত দুধে! পোলের ওপর দিয়ে নূপুর বাজিয়ে যেত বহু দূরগামী রেলগাড়ি। কাঁথায় ছিল আশ্চর্য ওম। বৃষ্টি থামলেই রামধনু উঠত। তখন ন্যাংটো হতে আমাদের কোনও লজ্জা ছিল না।

কোথায় গেল সেইসব সুখের দিন মহারাজ?

আমাদের পথে কোনও দোকান ছিল না, আমরা কখনও ফেরিওয়ালাও দেখিনি। কীভাবে কেনাকাটা করতে হয় তা শেখায়নি কেউ। পয়সা কোন কাজে লাগে কে-ই বা ভেবেছিল তখন?

পাঠশালার পাশেই ছিল হরিণের চারণভূমি। রোজকার ঘাস খেয়ে বনের হরিণরা ফিরে যেত বনে। সে কি তুমি মহারাজ, রোজ রাতে এসে গোপনে যে মাঠের ফুরোনো ঘাস আবার পূরণ করে দিয়ে যেতে? রোজ বেলা শেষে দেখতুম, ন্যাড়া মাঠে ঘাসের গোড়াগুলো ছাঁটা চুলের মতো হয়ে গেছে হরিণের দাঁতে। পরদিন পাঠশালায় আসবার পথে দেখি, কচি দূর্বাঘাসে দুধেল হয়ে আছে মাঠ। তুমি করতে মহারাজ? না কি তখনকার মাটিই ছিল ওইরকম উর্বর?

বুনো হরিণদের কখনও ভয় পেতে দেখিনি। কিন্তু একদিন এল ফাঁদ নিয়ে বাইরের মানুষ। মুহূর্তে কী করে টের পেয়ে পালপাল হরিণ মায়ামৃগের মতো মিলিয়ে গেল।

হরিণ ধরুয়াদের ধৈর্য বটে! দিনের-পর-দিন তারা সেইসব মায়াহরিণ ধরতে আসে, ফাঁদ পাতে। রোজ শূন্যহাতে ফিরে যায়। তারপর একদিন তারা আমাদের বলল –ধরে দাও। হরিণ প্রতি এক মোহর।

মহারাজ, আমাদের এই প্রথম পাপ। আমরা প্রত্যেকেই পেয়েছিলাম একটা দুটো করে মোহর। আর সেই রাতে কে বলো তো মহারাজ, আকাশকে উড়িয়ে নিয়ে গেল ওই অত উঁচুতে? আর তোকই কাঁঠচাপার মতো দেখাল না চাঁদকে! হাতের নাগালে ছিল ঝাড়বাতির মতো নক্ষত্ররা। তারা সেদিন থেকে হয়ে গেল ভিনদেশের দেওয়ালির আলো না কি জোনাকি পোকা। সেই রাতেই দেখলুম, চাঁদের বুক জুড়ে বসে আছে একটা পেটমোটা মাকড়সা। বহু দূর পর্যন্ত ছড়ানো তার জাল।

মোহর পকেটে নিয়ে পরদিন পাঠশালায় গিয়ে দেখি, এক বাদামওয়ালা ফটকের ধারে বসে আছে। পরদিন এল চিনির মঠ আর বুড়ির মাথার পাকাচুল বেচতে আরও দুজন। আমাদের পথে পথে দোকানের সারি গজিয়ে উঠল। মোহর খরচ হয়ে গেল। পকেটে এল আরও মোহরের লোভ।

সুখের দিন কি গেল মহারাজ? না কি তখনও নয়?

তখনও ভোরবেলা তুমি ঠিক রং দিয়ে যেতে চারধারে। প্রতিদিন আমাদের জন্মদিন ছিল। তুমি ভরে দিতে অন্নজলে সুস্বাদু। তখনও ন্যাংটো হতে লজ্জা ছিল না।

কবে যেন একদিন আমাদের সঙ্গী খেলুড়ি এক মেয়ে নদী থেকে উঠে এল স্নান সেরে। ক্ষমা করো মহারাজ, বিদ্যুৎ খেলেছিল দেহে।

সুখের দিনে তুমি কেড়ে নাওনি কিছু। সব ভরে দিতে। প্রতিদিন ছিল তোমার অক্লান্ত ক্ষতিপূরণ। কিন্তু সেই থেকে নিলে।

নদীর ধারে ছিল কাশবন, সাদা মেঘ, নীলকাশ। ঋতু আসে যায়। ছবির–পর–ছবি আঁকা হয়। একদিন শরীর ভরে মেঘ করল, বাজ ডাকল মুহুর্মুহু। কাশবনে কিশোরীর চুম্বনের স্বাদ বিষের বাটির মতো তুমিই কি এগিয়ে দাওনি মহারাজ? দিয়েছিলে। আর সেই সঙ্গে কেড়ে নিলে আমার অন্নজলের সেই অফুরান স্বাদ আর ঘ্রাণ। মহারাজ ভোরবেলা চারধার রং করতে রোজ ভুলে যেতে তুমি। উঠে দেখতুম নতুন রোদে পুরোনো পৃথিবীই আলো হয়ে আছে। কেন ন্যাংটো হতে লজ্জা এল? কেন আর দূরগামী ট্রেন রেলপোলে নূপুরের মতো বাজত না মহারাজ?

একদিন তাই আমরা শীতের শীর্ণ নদী হেঁটে পেরিয়ে গেলুম। বনের ভিতর দিয়ে শান্ত পথ গেছে এঁকে-বেঁকে বহু দূরে। আমরা চলতে লাগলুম।

স্বচ্ছ সরোবর, উপবন, তারপর তোমার রাজবাড়ি। দেউড়িতে কেউ পথ আটকাল না, যেতে দিল। সাতমহলা বাড়ির ভিতর দিয়ে হেঁটে-হেঁটে যাই। বিস্ময়ভরে দেখি, তোমার ঐশ্বর্য থরেথরে সাজানো। ছোট একটা বাগানে তুমি হাঁটু গেড়ে আদর করছিলে হরিণকে। তোমাকে ঘিরে কত গাছপালা। কত পাখির ডাক, কত পতঙ্গের ওড়াউড়ি।

আমাদের দিকে তাকিয়ে তুমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে এলে। ভৃঙ্গারের জলে হাত ধুতে-ধুতে তুমি বলেছিলে-এরকমই হয়।

সুখের দিন ছিল মহারাজ। কোথায় গেল?

তুমি বড় স্নেহে কাছে এলে। প্রত্যেকের চোখে তুমি রেখেছিলে তোমার গভীর দু-খানি চোখ। প্রত্যেকের প্রতি আলাদা ভালোবাসা তোমার। বিমুগ্ধ চোখে দেখি তোমাকে। দেখা ফুরায় না। বাক্যহারা আমরা।

তুমি মাথা নুইয়ে বললে–আমার কিছু করার ছিল না।

আমরা বললুম, ফিরিয়ে দাও।

তোমার কণ্ঠস্বর কোমল হয়ে এল। দু-চোখে মৃদু পিদিমের মতো স্নিগ্ধ আলো। তুমি বললে, চারণের মাঠে হরিণেরা ফিরবে না। অত সুন্দর আর রইল না জ্যোৎস্না। মাটির উর্বরতা কিছু কমে যাবে। তবু জেনো, আমি আমি তোমাদেরই আছি।

আমরা বললুম, ফিরিয়ে দাও।

তুমি মাথা নাড়লে। হাত তুলে মৃদু মুদ্রার একটি ইঙ্গিতে মিলিয়ে গেলে তুমি। মিলিয়ে গেল সেই প্রাসাদ, উপবন, সরোবর।

সেই থেকে সুখের দিন গেল মহারাজ। এখন তোমার সঙ্গে আমাদের এক আকাশনদীর তফাত।

মহারাজ, আমাদের সেই সব সুখের দিন কোথায় গেল?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *