সি জিপসি
পৃথিবীতে যে কতরকমের বিষয় নিয়ে গবেষণা হয় তা কোন গবেষক বন্ধু না থাকলে জানতেই পারতাম না। বন্ধু বলল এবারের গবেষণা উপজাতি নিয়ে শুরু করেছি।আমি ও অবাক সে আবার কেমন। বন্ধু বলল,তাদের জল-ই জীবন।মানে জলেই জন্ম আর জলেই মৃত্যু। মানে মানুষের গোটা জীবনটা জলের উপর ভাসিয়ে কাটিয়ে দেওয়া। আমার কাছে বিষয়টা দারুন রোমহর্ষকর লাগল। বললাম এমনই এক উপজাতি পৃথিবীতে রয়েছে, যাঁদের জীবন জলেই কেটে যায়? বন্ধু, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগর সংলগ্ন বিস্তীর্ণ জলরাশিতে বসবাসকারী উপজাতিদের নিয়ে গবেষণা শুরু করেছে।
বলল আশ্চর্যের বিষয় যে এরা জলের নীচে কোনও রকম প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়াই কাটিয়ে দিতে পারে প্রায় ১৩ মিনিট যা পৃথিবীর অন্য কোনও মানুষের পক্ষে মোটেই সম্ভব নয়। এরা হল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার, বিশ্বের সর্বাধিক দক্ষ সাঁতারু উপজাতি ‘বাজাউ’।
আমি শুনে হাঁ।এভাবে কেউ বসবাস করতে পারে?
বলল সমুদ্রে বসবাসরত এই উপজাতির সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। কাঠের নৌকতেই এঁদের অবিরাম ভাসমান জীবন।
এই উপজাতিরা কোনও দেশের নাগরিক নন। পৃথিবীর মূল ভূখণ্ডে অবাঞ্ছিতের মতো এরা নাগরীকত্বের সমস্ত অধিকার ছাড়াই যুগ যুগ ধরে অথৈ জলে কাটছে ‘বাজাউ’ উপজাতির জীবন। সমুদ্র শিকারের দক্ষতা থাকার ফলে এরা বেঁচে আছে। নৌকতেই কাটছে এদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম, নেই কোনও শিক্ষা, নেই কোনও সভ্য সমাজের সানিধ্যের সুযোগ। নাগরিকত্ব না থাকায় মেলে না কোনও সরকারী সুবিধা। জলে ঘুরে ঘুরে কেটে যায় এদের জীবন। তাই এদের বলা হয় ‘সি জিপসি’ বা ‘সি নোম্যাড’।
শুনতে বেশ ভাল লাগছিল। এমন মানুষও আছে পৃথিবীতে। তাদের বাসস্থান, তাদের জীবিকা শুনেও আশ্চর্য হই।তারা এইভাবে বেঁচে থাকে কি করে?
সমুদ্রের অগভীর এলাকায় সমুদ্র তটে বাজাউ-রা তৈরি করেন অস্থায়ী ঘর। এই ঘরগুলো এমনভাবেই তৈরি করা যাতে কয়েক মুহূর্তে তা আবার খুলে ফেলা যায়। ভয়ঙ্কর সুনামি এই বাজাউদের কোনও ক্ষতি করতে পারে না। ঘরের নিচ দিয়ে চলে যায় প্রকৃতির ভয়ঙ্কর তাণ্ডব। তাঁরা নিজেদের বয়স জানে না। কারণ, শিক্ষার আলো এই উপজাতির উপর পড়েনি। রাতের অন্ধকার কাটাতে আজও ব্যবহার করে মাছের চামড়া বা তেল দিয়ে তৈরি মশাল। সমুদ্র সংলগ্ন বেশ কিছু গ্রাম এদের মাছের বিনিময়ে জ্বালানীর কাঠ এবং জামা কাপড় দেয়।
বন্ধুয় গবেষণা এই বাজাউদের নিয়ে। তাঁদের ডিএনএ পরীক্ষা ও তাঁদের শ্বাসযন্ত্রের আলট্রাসোনগ্রাফি করে দেখা গিয়েছে, বাজাউদের প্লীহা সাধারণ মানুষের প্লীহার তুলনায় কয়েক শতাংশ বড়। আর এই পার্থক্য থাকার কারণেই তাঁরা জলের নীচে বেশ কিছুটা সময় কোনও রকম যান্ত্রিক সাহায্য ছাড়াই কাটিয়ে দিতে পারে। সাধারণ মানুষের তুলনায় এদের ডিনএ-গত কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এদের শরীরে কার্বনিক অ্যানহাইড্রেজ নামে এক বিশেষ এনজাইম তৈরি হয়, যা এনজাইমটি রক্তস্রোতে খুবই ধীরে কার্বন-ডাই অক্সাইড পাঠায়। ফলে শ্বাস ধরে রাখতে দীর্ঘ সময় সাহায্য করে।
এর ফলেই প্রকৃতির নিয়মে হোক বা শারীরিক অদ্ভুত পরিবর্তনের ফলে দিনের পর দিন জলেই জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে এই উপজাতি যা স্বপ্নেও ভাবতে আমাদের ভয় লাগবে! এই গোষ্ঠী বাস্তবেই এমন জীবন কাটাচ্ছে। বন্ধুকে বললাম, ভাগ্যিস গবেষণার কাজ করতে এগিয়েছিলি।পৃথিবীর এমন একটা উপজাতির কথা তাই জানতে পারলাম।