Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সিলভিয়া প্ল্যাথ || Sankar Brahma

সিলভিয়া প্ল্যাথ || Sankar Brahma

সিলভিয়া প্ল্যাথ (মার্কিন কবি, ছোটগল্পকার ও ঔপন্যাসিক)

(এক).

সিলভিয়া প্ল্যাথ ২৭শে অক্টোবর ১৯৩২ সালে আমেরিকার বোস্টন পাশ্ববর্তী জামাইকান প্লেইন এর ম্যাসাচুসেট্‌স মেমোরিয়েল হসপিটাল-এ জন্মগ্রহণ করেন।তার মা অরেইলিয়া স্কুবের’ ,(১৯০৬ সাল-১৯৯৪ সাল) অস্ট্রিয়া থেকে আগত প্রথম প্রজন্মের আমেরিকান এবং বাবা অট্টো প্ল্যাথ (১৮৮৫ সাল–১৯৪০ সাল), এসেছিলেন জার্মানির জ্রাবো থেকে। প্ল্যাথের বাবা ছিলেন বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এবং একজন কীটবিজ্ঞানী। প্ল্যাথের মা ছিল তার বাবার তুলনায় অন্তত একুশ বছরের ছোট।

২৭ শে এপ্রিল ১৯৩৫ সালে প্ল্যাথের ভাই ওয়ারেনের জন্ম হয়, এবং ১৯৩৬ সালে তার পরিবার, ২৪ প্রিন্স স্ট্রিট জামাইকা প্লেইন,ম্যাসাচুসেট্‌স ছেড়ে ৯২ জনসন এ্যাভিনিও, উইনথর্প,ম্যাসাচুসেট্‌স এ চলে আসে।প্ল্যাথের মা অরেইলিয়া ও এই উইনথর্পেই বেড়ে ওঠে ছিলেন তার পরদাদা ও এই শহরেই পয়েন্ট শার্লিতে বসবাস করতেন, যা সিলভিয়া প্ল্যাথের কবিতায় পাওয়া উল্লেখ রয়েছে। উইনথর্পে থাকাকালীন মাত্র আট বছর বয়সে প্ল্যাথের কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল বোস্টন হেরল্ড’ পত্রিকার শিশু শাখায়। লেখালেখির পাশাপাশি অল্প বয়সে তার শিল্পীমনের প্রকাশ ঘটেছিল তিনি চিত্রকলার জন্য ১৯৪৭ সালে দ্য স্কলাস্টিক আর্ট এ্যান্ড রাইটিং এ্যাওয়ার্ড জিতেছিলেন।

প্ল্যাথের কবিতা লেখার শুরু মাত্র আট বছর বয়সে, তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় বোস্টন ট্রাভেলার-য়ে।স্মিথ কলেজে ভর্তির সময়ে তিনি ৫০টি অধিক ছোট গল্প লিখেছেন যার অধিকাংশ বিভিন্ন ভাসমান পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।স্মিথে তিনি ইংরেজিতে সম্মান এবং লেখালেখিতে পুরস্কারসহ বিভিন্ন বৃত্তি লাভ করেন। তিনি কলেজে সাময়িকী সম্পাদনা করেছেন এবং ১৯৫৫ সালে সম্মান শেষে তিনি টু লাভার’স এ্যান্ড অ্যা বিচকম্বার বাই রিয়েল সী-এর জন্য গ্লাসকক পুরস্কার লাভ করেন। পরে ক্যাম্ব্রিজে পড়ার সময় প্ল্যাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রকাশনার জন্য লিখতেন। এ সময় হ্যানিম্যন তার প্রথম সংকলন দ্য কলোসাস এ্যান্ড আদার পোয়েমস প্রকাশ করে, ১৯৬০ সালের দিকে যুক্তরাজ্যে ইয়েল ইংগার পোয়েটস প্রতিযোগিতার সংক্ষিপ্ত তালিকায় বেশ’কবার স্থান করে নেন এবং হার্পারে, দি স্পেক্টেটর এবং টাইমস লিটারেরি সাপ্লিমেন্ট তার লেখা প্রকাশ করে। এ সময়ে প্রধান মার্কিন ও ব্রিটিশ সাময়িকীগুলো প্ল্যাথের দ্য কলোসাস এর সব কবিতা প্রকাশ করেছিল।
কবি ও লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পূর্বেই স্মিথ কলেজ, নিউনহাম কলেজ এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার শিক্ষা সম্পন্ন করেন। সিলভিয়া প্ল্যাথ (Sylvia Plath) তার প্রকাশিত দ্য কলোসাস এ্যান্ড আদার পোয়েট্রি এবং এরিয়েল কাব্যসংকলনে স্বীকারোক্তিমুলক কাব্য ধারা চর্চার কারণে বিশেষভাবে আলোচিত। তিনি ১৯৮২ সালে দ্য কলেক্টেড পোয়েম” এর জন্য কবিতায় মরণোত্তর পুলিৎজার পুরস্কার জিতেছেন। এছাড়া মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে ‘দ্য বেল জার’ নামে প্ল্যাথের একটি আধা-আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল।

সিলভিয়া ১৯৫৬ সালে তাঁর সমসাময়িক কবি টেড হিউজেকে (জন্ম, ১৯৫৬ সাল–১৯৬৩ সাল, মৃত্যু) বিয়ে করেন। এই সময় তারা মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে বসবাস করলেও পরবর্তিতে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান, এই দম্পতির দুই সন্তান ফ্রায়েডা হাজেস এবং নিকোলাস হাজেস। প্ল্যাথ প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের বেশিরভাগ সময় অবসাদ আর বিষন্নতায় ভুগতেন, আর ১৯৬৩ সালে তিনি মাত্র ত্রিশ বছর বযসে আত্মহত্যা করেন। যদিও তাঁর জীবন এবং মৃত্যু, সেইসাথে তাঁর লেখা এবং উত্তরাধিকারকে কেন্দ্র করে এখনো বিতর্ক চলছে।
প্ল্যাথের প্রতিবেশী ডাক্তার জন হোর্ডার যিনি তাকে আত্মহত্যার কিছু দিন আগে অবসন্নতা প্রতিষেধক প্রেসক্রাইভ করেছিলেন। দুই অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তান নিয়ে ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় থাকার কারণে জন প্রায় তাকে দেখতে যেতেন এবং হাসপাতালে ভর্তি করানোর জন্যেও চেষ্টা করেন; কিতু প্ল্যাথ ভর্তি হতে অস্বীকৃতি জানালে তার জন্য সার্বক্ষনিক একজন নার্সের ব্যবস্থা করেছিলেন। তবে সমালোচকরা বলেন, অবসন্নতা প্রতিষেধক কাজ করার জন্য তিন সপ্তাহের মতো সময় প্রয়োজন, কিতু তার আগেই প্ল্যাথের মৃত্যু হয়। তাই জনের দেয়া প্রতিষেধক তার জন্য প্রকৃতপক্ষে কোন উপকার করেনি।
তার সমাধিস্থল – হেপটন্সটল চার্চ, ওয়েস্ট ইয়র্কশায়ার, ইংল্যান্ড।

(দুই).

‘সাল ১৯৬৩। দিনটা ছিল ১১ ফেব্রুয়ারি। লন্ডনের আরও একটা ঝাঁ-চকচকে দিন শুরু হওয়ার অপেক্ষায়। ২৩ ফিটজরয় রোডের বাড়িটার দরজার সামনে সকালবেলায় দাঁড়িয়ে আছেন একজন নার্স। ভেতরের মানুষদের ডেকেই যাচ্ছেন; কিন্তু কেউ সাড়া দিচ্ছে না। যত সময় যাচ্ছে, চিন্তা বাড়ছে তাঁর। শেষপর্যন্ত একজনের সহায়তায় দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকলেন তিনি। সমস্ত দরজা, জানলা বন্ধ। যেটুকু ফাঁক ছিল, সেটাও টেপ দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। আর ঘরের ভেতরে রাখা ওভেনের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে আছেন এক ফুটফুটে তরুণী। বিষাক্ত গ্যাস তাঁর শরীরের স্পন্দন থামিয়ে দিয়েছে। দেহ আরও, আরও নিথর যাত্রার দিকে চলে যাচ্ছে। আর সেই নৌকার এক কোণে বসে আছেন সিলভিয়া প্ল্যাথ…

জীবনের ত্রিশটি বসন্ত জুড়ে তিনি দেখতে চেয়েছিলেন ফুলের দৃশ্য, সৌন্দর্য। এই জগতের ভেতরেই বয়ে চলেছে সম্ভাবনার নদী। তার পাশটিতে একটু বসে, শান্ত হয়ে ফুটতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বদ্ধ পৃথিবী সেই সুযোগ দেয়নি তাঁকে। অসীম যন্ত্রণার মধ্যেই নিজের মুক্তি খুঁজেছিলেন। আর সেই যন্ত্রণাই শব্দ হয়ে বয়ে যেত কলমে। পাতার পর পাতা ভরে উঠত কবিতায়। সিলভিয়া এভাবেই কাঁদতেন। খাদের ধারে গিয়েও দেখতেন কবিতার অনন্ত ঝর্ণা। বিষে ভরা শরীর নিয়ে সেই সমুদ্রেই ঝাঁপ দেওয়া শেষমেশ…

If I’ve killed one man, I’ve killed two—
The vampire who said he was you
And drank my blood for a year,
Seven years, if you want to know.
Daddy, you can lie back now.

সুন্দর, ঝকঝকে একটা হাসি ছিল তাঁর। আর ছিল অসামান্য দুটি চোখ। সেইটুকু দিয়েই স্বাদ নিতেন জীবনের। কিন্তু বিছানা যে গোলাপ ফুলের পাপড়ি দিয়ে ঘেরা ছিল না! ছোটো থেকেই সেই কাঁটার স্পর্শ জাগিয়ে রাখত তাঁকে। বিনিদ্র চোখে দেখতেন পৃথিবীর ভগ্নদশা। বাবা অটো প্ল্যাথ ছিলেন অধ্যাপক। বেশ কড়া ধাঁচের; বাড়িতে শাসন, নিয়ন্ত্রণ আর নিয়মের রাজত্বই দেখেছিলেন সিলভিয়া। কেমন ছিল বাবার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক? ‘Daddy’ কবিতাটির ছত্রে ছত্রে সেই কথাই লিখে গেছেন তিনি। শেষ করছেন ‘Bastard’ বলে। জীবন যেন শক্ত পাথরে এনে ফেলেছিল তাঁকে। আর ছিটকে বেরোত কবিতা। সেই আট বছর বয়স থেকে যে মন্ত্র শুনেছিলেন তিনি। তখন থেকেই লেখা প্রকাশ হওয়া।

স্বল্পকালের জীবন তাঁর। অথচ তার মধ্যেই নিজেকে মেলে ধরেছিলেন তিনি। ধীরে ধীরে পঞ্চাশ-ষাটের দশকে ইংরেজি কবিতার অন্যতম প্রধান চরিত্র হিসেবে অবতীর্ণ হন সিলভিয়া প্ল্যাথ। ইতিমধ্যে বাবাও চলে গেছেন। কবিতার হাত ধরে জীবনে এসেছেন আরেকজন— টেড হিউজ। দুই কবি একসঙ্গে হেসেছেন। সেই ঝকঝকে হাসি, রোদের মতো। ‘কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে?’ কেন পায়ের নিচ থেকে সরে যায় সমস্ত পাটাতন? বারবার আয়নায় নিজেকে দেখতেন সিলভিয়া। আমি তো উড়তে চেয়েছিলাম। নিজের মতো পৃথিবীটাকে দেখতে চেয়েছিলাম। আর পৃথিবী? সে কী করল? টেডের সঙ্গে বিবাহিত জীবন সুখের ছিল না। একসময় সব ছেড়ে, দুই সন্তানকে নিয়ে চলে এলেন লন্ডনের শেষ ঠিকানায়। দুই সন্তান, তিনও হতে পারত। কিন্তু একজন তো বাঁচলই না! আবার আঘাত…

মৃত্যুর কাছেই বারবার ফিরে যেতে চেয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তিনি। তারপর বারবার নিজেকে শেষ করতে চেয়েছেন। ডাক্তারও দেখে যেতেন, ওষুধও দিতেন। কিন্তু এতে কি হয়? ’৬২-র কনকনে শীতের রাতে দুই সন্তানকে নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন তরুণী সিলভিয়া প্ল্যাথ। কেউ খোঁজও নিল না তাঁর। শুধু পড়ে রইল কিছু কবিতা। এই ’৬২-তেই জীবনের স্মরণীয় কিছু লেখা লিখেছিলেন। মৃত্যু, তুমি কি আসবে আমার কাছে? কেউ জানতেও পারেনি এসব। ওই ঝকঝকে মুখের আড়ালে ভেঙে কুঁকড়ে পড়া চেহারাটা সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিলেন সিলভিয়া। আহা, আমার তো কবিতা আছে! কবিতা! সেই আশ্চর্য, রহস্যময় অবয়ব…

সন্তানরা বড়ো হোক, মানুষ হোক। তার মতো দুর্ভাগা চলেই যাক বরং। ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরবেলায় বিছানা থেকে উঠলেন তিনি। সন্তানরা তখনও ঘুমিয়ে। আহা, মুখদুটি দেখে যাও একটু! বিষাক্ত গ্যাস তোমাদের কিছুতেই থামিয়ে দিতে পারবে না। সমস্ত দরজা, জানলা বন্ধ করলেন। একটুও যেন ফাঁক না থাকে। যত বিষ আছে, শুষে নিক তাঁর শরীর। ভেতরে ঢুকছে কার্বন মনোক্সাইড। মাথা ওভেনের ভেতর। আহ, কী ঠান্ডা দেখো! এই তো, সিলভিয়ার পিঠ থেকে বেরিয়ে পড়ল দুটি ডানা। সিলভিয়া উড়ছে! এতদিনে শান্তি। নাড়ি শুকিয়ে আসছে। পৃথিবী, দেখো তোমার সিলভিয়া এতদিনে উড়তে শিখেছে। মৃত্যু, তুমি কি এতই সুন্দর!’
[ অরিত্র সোম | 1st September, 2021].

(তিন).

‘সাহিত্য কি শুধু জীবনকে উদযাপন করে? মৃত্যুকে নয়? হ্যাঁ, সাহিত্য জীবনের পাশাপাশি উদযাপন করে মৃত্যুকেও, উদযাপন করে জীবনের সব দুঃখ, কষ্ট, ঘৃণা আর না পাওয়ার হতাশাকেও। আর কবিতা হলো মনের চিন্তা-আবেগের সবচেয়ে সুন্দর আর সবচেয়ে তীব্র বহিঃপ্রকাশ। কবিতার একেকটা শব্দ তো মানুষের হৃদয়েরই প্রতিধ্বনি, তাই কবির হৃদয় যদি হয় বিশ্বাসঘাতকতা আর ঘৃণার আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত, কবিতা তো তখন হবেই সেই আঘাতের পদ্য। আজ আমরা এমনই এক দুঃখী আর মানসিকভাবে বিধ্বস্ত কবির জীবনের গল্প শুনবো, যার ব্যক্তিগত যন্ত্রণা আর ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা যেন ভাষা পেয়েছিলো তাঁর কবিতায়। তার কবিতা জীবনের নয়, বলে মৃত্যুর কথা। তার কবিতা উদযাপন করে ধ্বংস, কষ্ট আর পীড়ার কথা। চিরদুঃখী সেই কবি জীবনের কোথাও পাননি সুখ বা প্রশান্তি। কেউ কেউ তাঁর দুর্বল মনের কথা বলেন, কিন্তু তাঁর হৃদয়ের আঘাত উপেক্ষা করার মতো নয় কখনোই। উপেক্ষা করার মতো নয় তাঁর স্বেচ্ছায় টানা জীবনের এক করুণ ইতি আর সেই সমাপ্তির পিছনের নিঠুর গল্প। সেই কবির নাম সিলভিয়া প্লাথ, অপূর্ব রূপসী ইংরেজি সাহিত্যের এই নক্ষত্রকে জীবনের চেয়ে বেশি শান্তি দিয়েছিলো মৃত্যু। স্বীকৃতিও দিয়েছিলো মৃত্যু জীবনের চেয়ে বেশি, তাই তো তিনিই প্রথম সাহিত্যে পান মরণোত্তর পুলিৎজার পুরষ্কার।
সিলভিয়া প্লাথের বিষাদময় জীবনের শুরু হয়েছিলো সেই ছোটবেলা থেকেই। বাবা ছিলেন বলতে গেলে ছোট্ট সিলভিয়ার শৈশবের প্রধান নিয়ন্ত্রক। অধ্যাপক বাবার কঠোর শাসন ও নিয়ন্ত্রণ পরবর্তীতে কবির মন ও মননে গভীর ছাপ ফেলে। সিলভিয়ার বিখ্যাত কবিতা ‘Daddy’ ই যেন কবি ও তাঁর পিতার সম্পর্কের টানাপোড়নের সবচেয়ে বাস্তব কাব্যিক রূপ।
সিলভিয়ার বাবা অট্টো প্লাথ এসেছিলেন জার্মানির জ্রাবো থেকে। তিনি ছিলেন বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক। অট্টো প্লাথ বিয়ে করেছিলেন তাঁর থেকে একুশ বছরের ছোট অরেইলিয়া স্কুবেরকে, যিনি ছিলেন একজন কীটবিজ্ঞানী এবং একইসাথে তাঁর ছাত্রীও।
খুব অল্প বয়সেই তাঁর মধ্যে লেখনী প্রতিভার উন্মেষ ঘটে। মাত্র আট বছর বয়সে সিলভিয়ার কবিতা প্রকাশিত হয়েছিলো বোস্টন হেরল্ড পত্রিকার শিশু শাখায়। শিল্পের প্রতি আগ্রহও ছিলো বরাবরই। মাত্র পনেরো বছর বয়সে ১৯৪৭ সালে জিতেছিলেন চিত্রশিল্পের জন্য দ্য স্কলাস্টিক আর্ট অ্যান্ড রাইটিং অ্যাওয়ার্ড। জন্ম থেকে শিল্প ও সাহিত্যে ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন তিনি, যদিও তাঁর শৈল্পিক মন জীবনে আশার চেয়ে, আনন্দের চেয়ে হতাশা, বিষাদ আর যন্ত্রণা খুঁজে পেতেন বেশি। অবশ্য এই যন্ত্রণাই তাঁর লেখনীর শক্তি জুগিয়েছে।
যতদিনে প্লাথ স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হবেন, ততদিনে তিনি কেবল ছোটগল্প লিখেছিলেন পঞ্চাশটিরও বেশি। এইসব গল্পগুলো ছাপা হয়েছিলো সেসময়ের বিভিন্ন ভাসমান পত্রিকায়। নিজের দক্ষতা ও প্রতিভাগুণে ১৯৫০ সালে তিনি স্মিথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি অর্জন করেন এবং অনেক মানসিক চড়াই- উৎরাই পার করে ১৯৫৫ সালে সম্মানের ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীতে প্লাথের প্রতিভা তাঁকে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ার সুযোগ করে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার এই সময়টা থেকেই হতাশা প্লাথকে জীবনযুদ্ধে হারিয়ে দিতে থাকে। বিষাদগ্রস্ততা তাঁর জন্য হয়ে উঠেছিলো এক ভয়াবহ মানসিক ব্যাধি। চোরাবালির মতো এটা কবিকে গ্রাস করতে শুরু করে তরুণী বয়স থেকেই। তারই ফলস্বরূপ জীবনের শুরুতেই স্মিথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এই দুঃখী কবি ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। এরপরও তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার জীবনের ইতি টানতে উদ্যোগী হয়ে ব্যর্থ হন।
দুর্বল-দুঃখী কবিহৃদয় তাঁর আশ্রয় খুঁজেছিলো সমসাময়িক নামকরা কবি টেড হিউজের প্রেমে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তাঁরা দুজন দুজনার প্রেমে পড়েন, সেই প্রেমকে সার্থক করতে একসময় ঘরও বাঁধেন লন্ডনের বুকে, ঘর আলো করে আসে ফুটফুটে দুটি সন্তান। কিন্তু সেই ভালোবাসার ঘরের সমাপ্তিটা শেষ পর্যন্ত সুখের হয়নি। ১৯৫৬ সালে বিয়ে করে ১৯৬২ সালেই দু’জনের পথ দু’দিকে ঘুরে যায়। যদিও বলা হয়, বিয়ের পরেও প্লাথের মানসিক হতাশার কোনো কিনারা হয়নি। কিন্তু এও তো নিশ্চিত করে বলা যায় না যে জীবনসঙ্গীও তাঁর মানসিক যুদ্ধটা সহজ করতে তেমন সাহায্যকারী হিসাবে ভূমিকা নিয়েছিলেন কি না, বিশেষ করে তখন, যখন জানা যায় হিউজ অন্য এক নারীর প্রেমে পড়েই তাঁদের বিয়েটা ভাঙনের দিকে নিয়ে যান। আজন্ম আহত প্লাথের হৃদয়টা একটু স্নেহ আর বিশ্বাসের মলম পায়নি কোথাও। জীবনের চেয়ে মৃত্যুটাই তাঁর কাছে সহজ হয়ে উঠছিলো বহুগুণ। আর তাঁর লেখনী ছিলো সেই ভঙ্গুর মানসিক অবস্থার বহিঃপ্রকাশ। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর একমাত্র উপন্যাস ‘The Bell Jar’। এটা ছিল মূলতঃ তাঁর নিজের জীবনের ওপর ভিত্তি করেই লেখা একটা উপন্যাস, যা এক অনুভূতিপ্রবণ মেয়ের মানসিক ভাঙা-গড়ার গল্প শোনায়।

যে বছর কবি প্রথমবার মা হন, সে বছরই প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘The Colossus’। তাঁর রচিত শিশুতোষ বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘The Bed Book’, ‘Mrs. Cherry’s Kitchen’, ‘Collected Children’s Stories’ ইত্যাদি। প্লাথের রচিত শেষ কবিতা সংকলন ‘Ariel’ নামে প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর পরে, ১৯৬৫ সালে। এই কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘Daddy’ এবং ‘Lady Lazarus’ এর মতো অসাধারণ কবিতাগুলো তাঁকে এনে দেয় জীবনের সবচেয়ে বড় সম্মাননাগুলো। প্রথম ব্যক্তি হিসাবে তিনি মরণোত্তর সাহিত্যে পুলিৎজার পুরস্কারে ভূষিত হন।
প্লাথের মৃত্যু নিয়ে রহস্যের ধোঁয়াজাল তাঁর জীবনের চেয়ে কিছু কম নয়। জীবনের কাছে হেরে গিয়ে ১৯৬৩ সালের ১১ ই ফেব্রুয়ারি প্লাথ নিজেকে বিষাক্ত গ্যাস দিয়ে শেষ করে দিয়েছিলেন, কিন্তু আত্মহত্যার আগে তাঁর স্নেহপূর্ণ মন নিশ্চিত করেছিলো দুই শিশু সন্তানের নিরাপত্তা। তাই তো একই বাসায় থাকলেও প্লাথের গ্যাস প্রয়োগে আত্মহত্যার সময় শিশুদের কোনো ক্ষতিই হয়নি। রান্নাঘরের দরজায় কাপড় গুঁজে দিয়েছিলেন, যেন বন্ধ দরজা দিয়েও কোনোভাবে গ্যাস তাঁর সন্তানদের কাছে না পৌঁছায়। কিন্তু শুধু বিষাক্ত গ্যাসই কি জীবন নিয়েছিলো প্লাথের? এই পৃথিবীর রুক্ষতা কি দায়ী ছিলো না তাঁর অনুভূতিশীল মনের মৃত্যুর জন্য? ১৯৬২ সালের কনকনে শীত যখন দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে একা কাটিয়েছিলেন, তখন কে ছিলো তাঁর পাশে?
কবি হিউজের পরবর্তীতে দেওয়া সাক্ষাৎকার অনুযায়ী সে সময় নাকি হিউজ আর প্লাথ তাঁদের সম্পর্ককে আরেকবার সুযোগ দেওয়ার কথা ভাবছিলেন। হিউজ নিয়মিত প্লাথ আর সন্তানদের সাথে দেখা করতে যেতেন, কিন্তু প্লাথের হতাশাগ্রস্ত মন বারবার নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। অন্যদিকে সুসান এলিস্টন নামের অন্য এক নারীর সাথেও দ্রুত জড়িয়ে যান হিউজ। প্লাথ যে রাতে আত্মহত্যা করেন, সে রাতে সুসানকে নিয়ে যে বাসায় থাকেন সেই একই বাসায় হিউজ- প্লাথ তাঁদের বিয়ের পর প্রথম দিনগুলো কাটান। প্লাথ কি কোনোভাবে জেনে গিয়েছিলেন এই কথাটি? অন্যদিকে মৃত্যুর আগে শেষ একটা চিঠি লিখে যান প্লাথ, সেই চিঠিও আর পাওয়া যায়নি কোনদিন। বলা হয়, চিঠিটি নাকি প্লাথের সাথেই পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিলো। কী লেখা ছিলো সেই চিঠিতে? প্লাথ কী বলে গিয়েছিলেন সেই চিঠিতে? মানসিক অসুস্থতা নাকি মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা- সিলভিয়া প্লাথের অপার সম্ভাবনাময় জীবনের আকস্মিক ইতি টানার দায়টা কার ওপর বর্তায়, তার বিতর্ক অত সহজে শেষ হবার নয়।
[ Rifat Fariha Antora/28th september, 2018.]

(চার).

‘এত অল্পদিন? এত হেলাফেলার জীবন? এভাবে নষ্ট করে ফেলা? সিলভিয়া প্রতিভাময়ী, সিলভিয়া কবি, সিলভিয়া ঔপন্যাসিক, সিলভিয়া মানসিক ভারসাম্যহীন।

সিলভিয়া বলেছিলেন, “কখনো পারব কি, এই যে এত বই; সব পড়ে শেষ করতে? ইচ্ছে তো খুব, একার মধ্যে বহু হয়ে থাকার; জীবন কাটাব যখন যেভাবে খুশি| সাধ হয় সবকিছুতে পটু হতে, সাধ্য নেই| বাঁচতে ইচ্ছে করে সব রং, আলো, ছায়া, রস, রূপ , সুরভি নিয়ে| যত রকম মানসিক আর শারীরিক অস্তিত্ব সম্ভব ..সবটুকু শুষে নিয়ে যেন সোচ্চারে বাঁচি| কিন্তু আমার যে কী নিদারুণ সীমাবদ্ধতা!”
তাই কি সব আলো ছাপিয়ে হতাশার কৃষ্ণছায়া? মাত্র তিরিশ বছর পেরোতে না পেরোতেই আত্মহনন? সিলভিয়ার কবিতা confessional poetry -র ধারক| তাঁর দুটি বিখ্যাত কবিতা সংকলন হল “The Colossus and other poems” আর “Ariel”| ১৯৮২ তে মরণোত্তর পুলিৎজার পুরস্কার| একটি আধা – আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস “The Bell Jar”| মাত্র ৮ বছর বয়সে পিতৃহীন সিলভিয়া| এবং ঈশ্বরে আর বিশ্বাস করতে পারেননি।
বাবার সমাধি দেখে ফিরে এসে সিলভিয়া লিখেছিলেন, “Electra on Azalea Plath” পরে প্লাথ লিখেছিলেন, তাঁর জন্মের পর প্রথম ন’ বছর “যেন ওই স্বচ্ছ কাচের বোতলে বন্দী জাহাজের মতো| সুন্দর, ধরাছোঁয়ার বাইরে, বস্তাপচা| নজরকাড়া, সাদা এক দুরন্ত পুরাণকথা। “

স্কুলের পাট চুকিয়ে স্মিথ কলেজ থেকে সর্বোচ্চ সম্মান নিয়ে স্নাতক| ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কেমব্রিজের নিউনহ্যাম কলেজ| কবিতা আসে। বন্যার মতো| ১৯৫৬ সালে সিলভিয়া বিয়ে করেন কবি টেড হিউজেসকে| দু’টি ফুটফুটে ছেলেমেয়ে। ফ্রিডা আর নিকোলাস| কিন্তু হতাশা? সে তো সর্বক্ষণের সাথী! লেখা চলছে, লেখা চলছে। অক্টোবর ১৯৬২| কবিতা লিখছেন প্লাথ| একের পর এক| ইতিমধ্যে মন ভেঙে গেছে| স্বামী চলে গেছেন অন্য নারীর সঙ্গে।
স্মিথ কলেজের মেধাবী ছাত্রী সিলভিয়া মাকে লিখেছিলেন, “সারা পৃথিবী আমার পায়ের নীচে। ফেটে চৌচির। যেন পাকা রসালো তরমুজের লালিমা।”
কিন্তু চলার পথ আর সুগম হল কই? হতাশা এবং আত্মহত্যার চেষ্টা। ১৯৫৩-র অগাস্ট। একগাদা ঘুমের ওষুধ। তিন দিন ওভাবেই পড়ে থাকা| কিন্তু মৃত্যু আসেনি এই প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, “আমি নি:শর্ত আত্মসমর্পণ করলাম আমার চারপাশের এই অন্ধকারের ঘূর্ণির কাছে; যাকে ভেবেছিলাম এক চিরন্তন বিস্মৃতি মাত্র।”
পরের ছ’মাস মানসিক হাসপাতালে| আবার পড়াশুনোর জগতে ফেরা। ফ্রিডার বয়স দুই, নিকোলাস ন’ মাসের| কী ভীষণ ঠান্ডা লণ্ডনে! জল জমে বরফ, বাড়িতে দূরভাষ নেই| প্লাথ লিখছেন উপন্যাস “The Bell Jar”.

কিন্তু এভাবে আর কতদিন? Anti -depressant -এর ওপর বেঁচে থাকা| রোজ ডাক্তার এসে দেখে যান| তারপর একদিন| প্লাথের মাথা গ্যাসচুল্লিতে ঢোকানো, গ্যাসের নব খোলা, কার্বন মনোক্সাইডের তীব্র বিষক্রিয়ায় মৃত্যু। আর বাচ্চারা? অন্য ঘরে| নিরাপদে| প্লাথের চোখের পাতা কি কেঁপেছিল একটুও?

প্লাথের লেখায় বারবার এসেছে নানা চিত্রকল্প। এসেছে চাঁদ, রক্ত, হাসপাতালের গন্ধ, ভ্রূণ, করোটি| প্লাথের কবিতায় ডিলান টমাস, ইয়েটস , আর মারিয়ান মুরের প্রত্যক্ষ প্রভাব। ১৯৬০ -এর পর কবিতায় surrealistic নিসর্গচিত্র| সঙ্গে বন্দীদশার অব্যক্ত যন্ত্রণা আর মৃত্যুর নি:শব্দ পদসঞ্চার।
প্লাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আলভারেজ লিখেছিলেন, “প্লাথের জীবন আরোই জটিল এই কারণে, যে, প্লাথ যখন পরিণতমনস্কতায়ও লিখছেন, তখন তিনি সচেতনভাবে নিজের সৃষ্টির মধ্যে নিয়ে আসছেন রোজের জীবনযাপনে নিত্যব্যবহার্য যত খুঁটিনাটি| যেমন, হঠাৎ করে আসা অতিথি, আচমকা টেলিফোন, অপ্রত্যাশিত শারীরিক আঘাত, কাটাছেঁড়া, কালশিটে কিংবা হয়ত একটা রান্নাঘরের সানকি, মোমদানি। সব কিছুই কেমন অনায়াসে জায়গা করে নিয়েছে তাঁর লেখায়… অর্থবহ হয়ে, রূপান্তরিত অস্তিত্ব নিয়ে। তাঁর কবিতায় ব্যবহৃত হয়েছে এমন সব প্রসঙ্গ বা চিত্রকল্প, যা সেই মুহূর্তে হৃদয়ঙ্গম করা না গেলেও কোনো বুদ্ধিমান মানুষ যিনি সিলভিয়ার অস্থির জীবনযাপনের খোঁজ রেখেছেন, তিনি ঠিক কবিতার শেষে পাদটীকা হিসেবে এই কবিতার আশ্রিত বিষয়ের ওপর চমৎকার ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম।”
আত্মহননের ঠিক আগে সিলভিয়া ডায়রিতে লিখেছিলেন, “ঠিকঠাক ভাবতে পারিনি, বলতে পারিনি, লিখতে পারিনি …যন্ত্রণার আগুনে পোড়াতেও পারিনি নিজেকে| শেষ করে ফেলা নিজেকে এইবার| দায়িত্ব সর্বনাশা| দায়িত্ব ভয়াল রাক্ষস| আমি ফিরে যাব মাতৃগর্ভের ওই নিশ্চিন্ত নিরাপদ অন্ধকার তরলে| থেকে যাব ভাসমান আনন্দিত অস্তিত্ব হয়ে।”
অস্থিরমনা কবি সিলভিয়া প্লাথ। কয়েকটি কবিতার নমুনা এখানে থাক| আমার অপটু প্রয়াসে| ভাষান্তরে।

(১).

আমার চোখ বন্ধ আর সবাই যখন ঘুমে
চোখের পাতা খুললে পরে নতুন প্রাণের আলো
(তবে কি আমি তোমায় গড়ি স্বপ্নে, রাত নিঝুমে?)

লাল নীল সব জরি মেখে চাঁদ তারা বলরুমে
হঠাত করে টগবগিয়ে ঘনায় আঁধার কালো
আমার চোখ বন্ধ আর সবাই যখন ঘুমে

আমি তখন তোমার সাথে স্বপ্নের সঙ্গমে
চন্দ্রাহতা উন্মাদিনী , চুমুই মন মজালো
(তবে কি আমি তোমায় গড়ি স্বপ্নে, রাত নিঝুমে?)

ভূকম্পনে স্বর্গ মাতে, আগুন নরকভূমে
নিভে আসে, দেবদূত আর শয়তানেরাও গেল
আমার চোখ বন্ধ আর সবাই যখন ঘুমে

ভেবেছিলাম আসবে তুমি, গান যেমন সমে
ফিরে এসেও বয়সভারে স্মৃতিও নাম হারালো
(তবে কি আমি তোমায় গড়ি স্বপ্নে, রাত নিঝুমে?)

বরং অনেক ভালো হত বাজপাখিটির ওমে
গা ডুবিয়ে বসন্তে, আর মনেই রং বিছালো
আমার চোখ বন্ধ আর সবাই যখন ঘুমে
তবে কি আমি তোমায় গড়ি স্বপ্নে রাত নিঝুমে?

(মূল কবিতা : Mad girl’s love songs)

(২ ).

আমি?
একা একাই পথ হাঁটি
মধ্যরাতের পথ
আমার পায়ের তলায় ঘূর্ণিপাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়
আমার চোখ বন্ধ
ওই বন্ধ চোখের পাতায় সলতে পোড়া চেহারা নিয়ে এলিয়ে পড়ে থাকে স্বপ্নের বসতিরা
আমার খামখেয়ালের শিকার
অনেক ওপরে ছাদের তেকোণা আলসের গায়ে টুকরো হয়ে ঝুঁকে থাকে
পেয়াঁজখসী চাঁদ

আমার
স্বপ্নের বসতগুলো ছোট হতে থাকে, হতেই থাকে
গাছগুলো আকারে খাটো
দূরে চলে যাই যে..আমার চাউনির বাঁধনে
পুতুল নাচের ইতিকথা. মানুষ-পুতুল সব
যারা বুঝতেই পারে না… কেমন করে ক্ষয়ে যায়
হাসে, চুমু খায়, অথবা বদ্ধ মাতাল
ওরা ভাবতেই পারে না যে একটিবার আমি পলক ফেললেই
ওরা মৃত ও নিথর

আমি
যখন মনমর্জি খুশ
ঘাসে মাখাই সবুজ রং
আকাশ চকচকে নীল আর সূর্য হাসলে
সোনা
আর যখন আমার মনে শীতঝড় বাসা বাঁধে, আমার তখন
অমোঘ শক্তি
মুছে ফেলি সব রং, ফুলেদেরও মানা করে দিই
“পাপড়ি মেলো না”

আমি
জানি তো তুমি হঠাত করেই আসো
আমার পাশটিতে, উজ্জ্বল…
সম্পূর্ণ অস্বীকার করি যে তোমার উপস্থিতি শুধুই আমার কল্পনায়
সোচ্চারে বলি, তোমারও এই একই অনুভব
কী তীব্র প্রেম , আমারই মতো .কল্পনাও তখন এক মাংসল উপস্থিতি
যদিও এ কথা স্পষ্ট
তোমার শ্রী ধী… আরও যা যা… তা নিছকই আমার
সচেতন দাক্ষিণ্যসঞ্জাত !

(মূল কবিতা : I? I walk along)

(৩).

এই যে তুমি হেঁটে যাও আমার সাজানো গোছানো ঝুলবারান্দা বরাবর
বুনো রাগ দিয়ে এলোমেলো করে দাও আমার ফলের বাগান
বীণার ঝঙ্কার আর ময়ূরের পেখমের শোভা… এক ঝোঁকে ছিঁড়ে ফেল তন্তুজাল
বিদীর্ণ করে দাও সেই শালীন শোভনতা, যা এতক্ষণ প্রতিরোধ করেছিল অবাধ্য দমকা বাতাস
এখন দেওয়ালের চুনবালি খসা, দাঁড়কাকের কর্কশ স্বর
ভয়াল ধ্বংসাবশেষের চুড়োয়, বিবর্ণ আলো, যা
তোমার ঝোড়ো চোখে, জাদু গালিচায় চেপে উড়ে যায়
অচেনা ডাকিনী, দুর্গের পরিখা পেরিয়ে, যখন রোজের দিনের শুরু

ফাটলধরা কার্ণিশ, আগে ছিল অগুণতি পাথরের স্তম্ভ
তুমি যেই না এসে দাঁড়াও… নায়কের মতো ফিটফাট, সুবেশ, সুঠাম
আমি ঘটিহাতা সাবেকী ব্লাউজে, ব্রুচে আঁটা সোনালি রেশম
তোমার চোখেতে চোখ, বিয়োগান্ত যাত্রাপালা শুরু
আমাদের বাজে পোড়া নষ্ট ভিটেমাটি, ফাটল ধরা দেওয়াল, কার্ণিশ..

কোনো স্বগতকথনই কি জোড়াতালি দিয়ে
এই চিড়ে দিতে পারে
চন্দনপ্রলেপ?

(মূল কবিতা : Conversation among the ruins)

(8).

নারীটি কী নিখুঁত ভাস্কর্য

তার মৃত
অবয়ব ধারণ করেছে বঙ্কিম হাসির বিভ্রম
গ্রীক সুষমার অলীক মায়া
বয়ে যায় তার অঙ্গভূষার রেখার বিভঙ্গ ধরে
তার নগ্ন
পা দু’টি ডেকে ডেকে বলে
এতটা পথ পেরিয়ে… অবশেষে

দু’টি মৃত শিশু গুটিসুটি মেরে শ্বেত সর্প যেন
দু’টিতে ঘুমিয়ে আছে
আনত স্তনভাণ্ড জুড়ে… এখন যা শূন্যগর্ভ

নারীটি তাদের
শরীরে ফিরিয়ে নেয়… ফুলের পাপড়ির মতো
গোলাপ পাপড়িটি যেন আলতো ভাঁজেতে,
ঠিক সেই… যখন বাগানে
রুখুশুখু চেহারায়, সুরভিতে শ্রান্ত রক্তপাত
রাতের ফুলটি থেকে…
মিঠে… গাঢ়…
ত্রিবলী পেরিয়ে

চাঁদের তো কারণই ছিল না… দু:খবিলাসের
তার দৃষ্টি ছুঁয়ে যায় সুন্দরীর অস্থি ও করোটি

নারীর এ অভ্যাস আজন্মলালিত
কৃষ্ণছায়াটি ভেঙে যায়… অক্লেশে…
মন্থর…
অন্তিম…

(মূল কবিতা : Edge)

(৫).

এই ওড়নার আড়ালে ঠিক কী আছে? কুশ্রীতা? না কি খুব সুন্দর কিছু?
ঝিকমিক ঝিকমিক| স্তন আছে? শরীরী বিভঙ্গ?

আমি জানি, একেবারে অন্যরকম কিছু| আর এও জানি, এই আমি চাই|
যখন আমি রান্নাঘরে, আমার পিঠে বিঁধতে থাকে দুটো চোখ|
আমাকে পুড়িয়ে দেয় ওর অনুভবের উত্তাপে|

আমি নিজেও কি এই? এই চেনা মুখ?
সেই এক নির্বাচন, চোখের নীচে তমিস্রা, শুকনো ক্ষতের দাগ?

ময়দা মাপছি পেয়ালায়, ঝড়তিপড়তি যা কিছু… বাতিল|
নিয়ম মানো আর নিয়ম মানো… শুধু নিয়ম মেনে যাও…

এটাই কি দৈবাদেশ?
হে ঈশ্বর! ভাবলেও হাসি পায়!

কিন্তু তবু দেখো… ঝিকমিক ঝিকমিক… থামেও না… আমাকে চাইছে খুব!
কী জানি… স্রেফ ফ্যাকাশে সাদা হাড়, কিংবা মুক্তোর বোতাম!

এবার উপহারে মন নেই আমার| অন্তত এই বছরে|
আর এই যে… বেঁচে আছি… নিছক দুর্ঘটনা!

সেই সময় খুশিমনে নিজেকে শেষ করে দিতে পারতাম| যে কোনো উপায়ে|
এখন তো চারপাশে শুধু ওড়না আর ওড়না| পর্দা হয়ে দোলে| ঝিকমিক ঝিকমিক|
স্বচ্ছ চিকন রেশমী শার্সি, জানুয়ারী মাস, শীতের জানালায়
এত সাদা, এত সাদা! ঠিক যেন শিশুর শয্যাটি|
উজ্জ্বল বিভায় আর মৃত্যুর নি:শ্বাসে|
ইস, ঠিক যেন হাতির দাঁতের মতো!

নির্ঘাৎ হাতিরই দাঁত ওটা, নাকি ভূতুড়ে স্তম্ভ?
তুমি দেখতে পাও না? একেবারেই? অবশ্য তাতে আমি কিছুই মনে করি না…

আমাকে দিতে পারো না? ওটা?
লজ্জা কিসের? ছোট উপহার? কিচ্ছুটি মনে করব না! দেখো!

সত্যি বড় কৃপণ তুমি ! আমার যে প্রস্তুতি অন্তহীন ..
এস, আমরা না হয় পাশাপাশি, কিংবা দু’জন দু’পাশে… এই দীপ্তিকে জড়িয়ে নিয়ে সাথে…

ঝাঁ চকচকে, ঠিক যেন আয়নার মতো
এস, শেষ সায়মাশ হোক আমাদের| হাসপাতালের রোগশয্যায় যেমন..

জানি, তুমি কেন আমায় দিতে চাও না!
তুমি আসলে ভয় পাও..

সারা পৃথিবী সোচ্চার হবে, তোমার মাথা কাটা যাবে… কত কারিকুরি, পিতলের নকশাকাটা… পুরনো বস্তাপচা বর্ম!

তোমার নাতিপুতিরা অবাক! অবাক!
ভয় পেও না, ভয় কীসের?

আমি শুধু চুপচাপ হাত পেতে নিয়ে চলে যাব…
তুমি মোড়ক খোলার শব্দ পাবে না, কাগজের ফরফরানি শুনতে পাবে না…

সোনালি ফিতে একটানে ছিঁড়ব না, এমনকী শেষে তীক্ষ্ণ চিৎকারও নয়
আমার তো মনে হয় না তুমি এই পরিণামদর্শিতার জন্য আমাকে কোনো বাড়তি মর্যাদা দেবে…

যদি জানতে কীভাবে এই ওড়নাগুলো আমার দিনগুলোকে গ্রাস করে নিচ্ছে!
তোমার কাছে তো ওরা শুধুই স্বচ্ছতা, নির্মল বাতাস!

আর আমার কাছে? ওই সব মেঘগুলো ভারী তুলোর মতো
রাশি রাশি ধেয়ে আসে| ওরা কার্বন মনোক্সাইড| বিষাক্ত| মৃত্যুর গন্ধ|

বুক ভ’রে.. বুক ভ’রে শ্বাস নিই
আমার শিরায় ধমনীতে অদৃশ্য বিষের কণা ছড়িয়ে যায়… এক থেকে বহু হয়ে|

চোখের ওপর ধূলিকণা, আমার জীবন থেকে খসিয়ে ফেলে সোনালি বছর যত
তুমি তো রুপোলি মোড়কে রয়ে গিয়ে.. শুধু যোগ করে যাও…

তুমি কি পারো না, কিছু ছেড়ে দিতে? পুরোপুরি?
সব কিছু কি বেগুনী রঙে দাগিয়ে দিতেই হবে?

মারতে পারো বলেই মারতে হবে?
আজ আমি তোমার কাছে একটিমাত্র জিনিস চাই… দেবে?

ওই তো দাঁড়িয়ে আছে আমার জানালাটির পাশে নি:সীম আকাশ হয়ে
আমার বিছানার চাদর জুড়ে আতপ্ত দীর্ঘশ্বাস, কেন্দ্রবিন্দু মৃত ও শীতল…

ভাঙাচোরা জীবন… চ্যাটচেটে হয়ে, শুকিয়ে… বাকি ইতিহাস
ওকে ডাকপিয়নের হাতে পাঠিও না, আমি আঙুল ছোঁয়াতে চাই না…

মুখের কথাও চাই না, পুরোপুরি পেতে গেলে…
আমার যে ষাট পেরিয়ে যাবে! তখন আমি অসাড়, ব্যবহারে অপারগ |

শুধু ওড়না সরিয়ে নাও… ওড়না… ওড়না …
মৃত্যু?

আশ্লেষ করব গভীর বিষাদ, গম্ভীর মূর্ছনা, সময় পেরিয়ে যাওয়া দৃষ্টিপথ…
দেখো.. ঠিক বুঝে নেব.. তুমিও অচপল কিনা…

তখনই তো হাতের মুঠোয় মহত্ব, তখনই তো নতুন করে জন্মদিন…
ছুরির ফলাটা আর নকশা করে কাটবে না… সটান প্রবেশ..

শুদ্ধতায়, পরিচ্ছন্নতায় … ঠিক যেন শিশুর কান্না,
আর আমার হাতের মুঠো থেকে একটু একটু করে খসে পড়বে

পৃথিবী!

(মূল কবিতা : A birthday present )

(৬).

টিউলিপগুলো এমন উত্তেজনা ছড়ায়! এখানে শীত এখন|
দেখো, চারদিক কেমন সাদা, কী অদ্ভুত শান্ত! কেমন ঘনিয়ে এসেছে তুষার!
আমিও শিখছি| শান্ত হতে| একা বিছানায়| চুপচাপ|
আলো শুয়ে আছে সারা দেওয়াল জুড়ে; শয্যায়; আমার দু’টি হাতে|
আমি অনামা; চারপাশে জীবনের বিস্ফোরণে
ভূমিকাবিহীনআমার নাম,
নিত্যদিনের পরিধান… সব দিয়ে দিয়েছি নার্সদের
আমার সমস্ত অতীত এখন অ্যানাস্থেসিস্টের নখদর্পণে
আর শরীরটা সার্জেনের জিম্মায়|

ওরা আমার মাথাটা সাজিয়ে রেখেছে বালিশ আর সুজনিটার মধ্যবর্তী ক্ষীণ অথচ নিশ্ছিদ্র বিস্তারে
একজোড়া বর্ণহীন অক্ষির মাঝে বিনিদ্র দৃষ্টির মতো
হে নির্বোধ নয়নতারা! সবকিছু শুষে নিতে হবে?
নার্স আসে, নার্স যায়.. কোনো সমস্যা নেই
ওরা সেই সিন্ধুসারস… স্থলভূমি পেরিয়ে সাদা টুপি ভেসে যায় পালকের মতো
ওদের হাতগুলো থেমে থাকে না| হাতগুলো সব কেমন একই রকম!
বুঝতেই পারি না.. মোট ক’টা!

আমার এই শরীর.. ওদের কাছে স্রেফ একটা নুড়িপাথর| যেমন জলের স্রোত
নুড়ির ওপর দিয়ে বয়ে যেতে যেতে আদর করে বাধ্য হয়ে… মসৃণ.. আরও মসৃণ..
ওরাও আমাকে আদর করে| চকচকে ছুঁচ| আমাকে অসাড় করে দেয়| ঘুম পায়..
আমি হারিয়ে ফেলেছি সমস্ত অস্তিত্ব.. স্থাবর সম্পত্তিতে এখন বিষম অনীহা আমার!
কালো চামড়ার ব্যাগটা এখন ঠিক যেন একটা পেটমোটা বাতিল কালো বালিশ
আমার স্বামী ও সন্তান ফ্রেমে বসে মাপা হাসি হাসে
ওদের হাসি আমার শরীরে গেঁথে দেয় ছোট্ট ছোট্ট কাঁটা..

এখন সব কিছু গড়িয়ে পড়ে হাতের আঙুল বেয়ে.. সব সুখ.. তিরিশ বছরের মালবাহী নৌকো!
কী অন্যায় জেদে আঁকড়ে রেখেছিল আমার নাম ঠিকানা
আর দূষিত পুঁজরক্তের মতো সাফ করে দিয়েছে আমাকে
আমার প্রিয় জিনিসগুলোর সান্নিধ্য থেকে

সবুজ প্লাস্টিকে মোড়া শূন্য ট্রলি… মরা মাছের চোখের মতো.. তাকিয়ে থাকে..
আমার চায়ের বাসন, বিছানার চাদর বালিশ, আমার যত বই..
দৃষ্টিসীমার বাইরে কেমন ডুবে যায় একে একে.. আর জল উঠে আসে আমার মাথা ছাড়িয়ে
আমি এখন সন্ন্যাসিনী.. কী শুদ্ধিতে আছি! আগে তো বুঝিনি কখনও!

না, আমি কোনো ফুল চাইনি| শুধু চেয়েছিলাম..
শুয়ে থাকতে| দু’টি করতল.. ঊর্ধ্বমুখ.. আকাশের দিকে এবং একেবারে শূন্য!
কী নির্ভার!
ও:, তুমি বুঝতেই পারছ না.. কী যে খাঁ খাঁ শূন্যতা!
এই শান্তি.. যেন আচ্ছন্ন করে দেয়|
বিনিময়ে কিছুই চায় না.. নাম কিংবা টুকিটাকি তুচ্ছ শৌখিনতা..
শুধু গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসে নি:শব্দ শ্বাপদ মৃত্যু|
অবশেষে.. আমি কল্পনার চোখে দেখি
ওরা ধীরে ধীরে হাঁ-মুখ বন্ধ করে দিচ্ছে.. পরিতৃপ্তিতে…

টিউলিপগুলো যে কী নির্লজ্জের মতো লাল! এত কষ্ট দেয় আমায়!
উপহারের কাগজের মোড়ক ছাপিয়ে ভেসে আসে ওদের জলতরঙ্গ কন্ঠস্বর
মৃদু.. অনেকটা ওই মোটা কাঁথা ভেদ করে ভেসে আসা শিশুর কান্না..
ওদের রক্তিমা আমার ক্ষতর সঙ্গে কথা বলে| ক্ষত সাড়া দেয়!
ওদের উপস্থিতি অতীন্দ্রিয়, ভাসমান; অথচ ওদের ভার আমার বুকে আধমণী পাথরের মতো
আমায় এলোমেলো করে দেয় লাল জিভের লেহনে, খুনখারাপি রঙে
এক ডজন লাল সীসের বঁড়শি যেন গলায় বিঁধে আছে!

এতকাল কেউ আমাকে নজরই করেনি| এখন আমি নজরবন্দী|
টিউলিপগুলোর মুখ আমার দিকে ফেরানো; পেছনের জানালাটা
যেখানে একবার আলো উঁকি মারে হাসিমুখে.. ঠোঁটের প্রসারণে, মৃদু সংকোচনে
আমি শয্যাবন্দী.. কী অদ্ভুত এক কাগুজে ছায়ার মতো
পড়ে আছি সূর্য আর টিউলিপের কড়া নজরদারির শিকার হয়ে|
আমার মুখ নেই.. ইচ্ছে করে… নিজের মুখ নিজেই নিশ্চিহ্ন করে দিই
ওই উজ্জ্বল টিউলিপ.. সব প্রাণবায়ু কেমন শুষে নিচ্ছে!

ওরা ছিল না যত দিন… বাতাস ছিল দিব্যি| শান্ত|
নিজের মনে আসত যেত.. শ্বাসে নি:শ্বাসে… কোনো আদর আবদার ছাড়াই
তারপর টিউলিপগুলো এসে বিস্ফোরণে বাতাস করল ভারী
এখন সে হয়েছে অনুগত ভৃত্য!
সেবা করে ঘুরপাক খায় টিউলিপগুলোর পাশে পাশে
ঠিক যেমন নদী নিজের মনে ছেনালি করে জলে ডোবা মরচে-লাল ইঞ্জিনটার সঙ্গে
আমার চোখ টানতে চায় ওদের দিকে.. ওরা খুশিয়াল চোখে
খেলা.. বিশ্রাম… খেলা.. কোনরকম শর্ত ছাড়াই…

দেওয়ালগুলো পর্যন্ত কেমন শত্রু হয়ে উঠেছে! উষ্ণতা ছড়ানোর ফিকির!
এই টিউলিপগুলোকে খাঁচায় বন্দী করো তো! হিংস্র জন্তু সব!
দাঁত নখ থাবা.. আফ্রিকান বনবিড়াল!
আর আমি.. আমি বুঝতে পারছি.. আমার হৃদপিণ্ড খুলছে.. বন্ধ হচ্ছে..
ভলকে ভলকে রক্তিমা উঠে আসছে, পাপড়ি মেলছে.. আমাকে বড্ড ভালোবাসে তো!
আমার ভিজে ঠোঁটে জলের স্বাদ উষ্ণ, লোনা… সমুদ্রের জলের মতো..
ওরা এসেছে সাগরপারের দেশ থেকে.. অনেক দূরের.. নাগালের বাইরে যে দেশ…. ‘

জীবন!
(মূল কবিতা : Tulips ).

[ ঈশানী রায়চৌধুরী / ২৮ অক্টোবর, ২০১৭ সাল
সিলভিয়া প্লাথ : জীবন, ভাবনা আর কবিতা। সংগৃহীত। ]

(পাঁচ).

(তাঁর কবিতা সংকলন)

১). দ্য কলোসাস এ্যান্ড আদার পোয়েমস (১৯৬০ সাল)
২). উইলিয়াম হেইনিম্যান এরিয়েল (১৯৬৫ সাল) ফেভার এ্যান্ড ফেভার
৩). থ্রী উইমেন: এ্যা মনোলগ ফর থ্রী ভয়েসেজ (১৯৬৮ সাল) টুররেট বুকস
৪). ক্রসিং দয ওয়াটার (১৯৭১ সাল) ফেভার এ্যান্ড ফেভার
৫). উইন্টার ট্রিজ (১৯৭১ সাল) ফেভার এ্যান্ড ফেভার
৬). দ্য কালেক্টেড পোয়েমস (১৯৮১ সাল) ফেভার এ্যান্ড ফেভার
৭). সিলেক্টেড পোয়েমস (১৯৮৫ সাল) ফেভার এ্যান্ড ফেভার

(সংকলিত প্রবন্ধ এবং উপন্যাস)

১). দ্য বেল জার: এ্য নভেল (১৯৬৩ সাল), ভিক্টোরিয়া লোকাস
২). লেটারস হোম: করেসপন্ডেন্স ১৯৫০ সাল–১৯৬৩ সাল (১৯৭৫ সাল)

(শিশুতোষ বই)

১). দ্য বেড বুক (১৯৭৬ সাল), ইলাস্ট্রেড কোয়েন্টিন ব্লেইক, ফেভার এ্যান্ড ফেভার
২). দ্য ইট-ডাজোন্ট-মেটার-সুয়েট (১৯৯৬ সাল) ফেভার এ্যান্ড ফেভার
৩). কালেক্টেড চিল্ড্রেন স্টোরিজ (ইউ কে,২০০১ সাল) ফেভার এ্যান্ড ফেভার
৪). মিসেস. চেরি’স কিচেন (২০০১ সাল) ফেভার এ্যান্ড ফেভার

(তার উল্লেখযোগ্য পুরস্কারপ্রাপ্তি)

ফুলব্রাইট স্কোলারশিপ
গ্লাস্কোক পুরস্কার (১৯৫৫ সাল)
কবিতার জন্য পুলিৎজার
১৯৮২ কবিতা সংকলন


———————————————————–
[ সংগৃহীত ও সম্পাদিত। তথ্যসূত্র – উইকিপিডিয়া
ঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার – ঈশানী রায়চৌধুরী, অরিত্র সোম ও Rifat Fariha Antora.

সূত্র নির্দেশনা –

“Sylvia Plath and the depression continuum” by Brian Cooper, MD at ncbi.nlm.nih.gov
Becker. (2003).

The Bell Jarন. Harper Perennial Classics Edition. আইএসবিএন ০-০৬-০৯৩০১৮-৭ p xii. Introduction by Frances McCullough
Sally Brown and Clare L. Taylor, “Plath, Sylvia (1932–1963)”, Oxford Dictionary of National Biography, Oxford University Press, 2004.
Kirk (2004) p.2.

Steven Axelrod। “Sylvia Plath”। The Literary Encyclopedia, 17 Sept. 2003, The Literary Dictionary Company (April 24, 2007), University of California Riverside। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৬-০১.

“A celebration, this is”। Sylviaplath.info। সংগ্রহের তারিখ ২০১৪-০৩-১১.
Kirk (2004) p23.
Kirk (2004) p32.

Anne Stevenson “Plath, Sylvia” The Oxford Companion to Twentieth-Century Poetry in English. Oxford University Press
Wagner-Martin (1988) p2-5.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress