সিন্ধুপারের পাখি (Sindhuparer Pakhi) : 09
কতকাল পর মদ খাচ্ছে লখাই!
দু’মাস হল বঙ্গোপসাগরের এই সৃষ্টিছাড়া দ্বীপে কয়েদ খাটতে এসেছিল সে। তারও আগে দেশের কয়েদখানায় পুরো তিনটে বছর আটক থেকেছে। এই তিন বছর দু মাসে এক ফোঁটা মদ পড়ে নি তার গলায়। অবশ্য এর মধ্যে যে নেশা করে নি, এমন একটা নির্জলা মিথ্যা লখাই কিছুতেই বলতে পারবে না। ভিখন আহীর তার অনেক দিনের সাকরেদ। সে-ই চুরিচামারি, হাতসাফাই কি ফিকিরবাজি করে একটু চরস, কি একটু চণ্ডু, কি এক টিপ গাঁজা যোগাড় করে দিয়েছে। কিন্তু লুকিয়ে একটু আধটু নেশা করে জুত পায় না লখাই। তা ছাড়া নেশার যা রাজা, সেই মদই এই তিন বছর দুমাসে এক ফোঁটা জোটাতে পারে নি সে। কয়েদখানায় মদ জোটানো কী সোজা কথা! কাজে কাজেই চুটিয়ে নেশা করতে পারে নি সে।
মদের স্বাদই ভুলে গিয়েছিল লখাই। গলার শিরাগুলো, তৃষ্ণার্ত স্নায়ুগুলো মদের অভাবে শুকিয়ে শুকিয়ে দড়ি পাকিয়ে যেতে বসেছিল।
গলার মধ্যে এক-একটা বোতল উপুড় করছে লখাই, আর সঙ্গে সঙ্গে গলনালীর ভেতর দিয়ে তরল আগুন ছুটে যাচ্ছে। কপালের দু পাশে তামার তারের মতো সরু সরু রগগুলো চিন চিন করে যেন ফেটে পড়ছে। উন্মাদের মতো মদ খাচ্ছে লখাই।
উলটো দিকের একটা মাচানে বসে সমানে দারু গিলছে উজাগর সিংও। নেশার ঘোরে চোখ মেলতে পারছে না। মাঝে মাঝে সে চেঁচিয়ে উঠছে, এ লখাই দোস্ত—
হাঁ–
শির টলছে?
না।
আঁখ লাল হয়েছে?
না।
শাবাশ।
কিছুক্ষণ চুপচাপ।
দাঁত দিয়ে বোতলের ছিপি খুলে দুজনে নির্জলা শরাব গলার মধ্যে ঢেলে দেয়। উজাগর আর লখাই যেন পাল্লা দিয়ে নেশা করে চলেছে।
উজাগর আবার ডাকে, আ রে ইয়ার—
জি। সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দেয় লখাই।
ক বোতল সাফ করলি?
তিন।
শাবাশ।
টলতে টলতে বাঁশের মাচান থেকে উঠে আসে উজাগর সিং। লখাইর পিঠে বিরাট এক থাপ্পড় কশিয়ে বাহবা দেয়, বহুৎ আচ্ছা, তুই আমার খাঁটি দোস্ত, আর সব ঝুটা। তোর মতো শরাবী সাথী এই পয়লা দেখলাম।
নির্জলা দারুর নেশার সঙ্গে উজাগরের বাহবাটা বড় ভাল লাগে লখাইর।
এবার উজাগর সিং খাতির করে বলল, পাশে এস ইয়ার, এতদূর থেকে কি দোস্তি মহবৃতির কথা হয়!
উজাগরের মাচানে এসে বসল লখাই।
উজাগর বলল, কত রোজ এই জঙ্গলে রয়েছ?
বিশ পঁচিশ রোজ।
হঠাৎ তুই থেকে তুমি হয়ে গেল লখাই।
উজাগর বলে, শাদি উদি করেছ?
জি, না।
বয়স কত?
তিরিশ চাল্লিশ হবে।
উজাগর সিং চিৎকার করে উঠল, তিরিশ চাল্লিশ বছর বয়েস, এখনো শাদি কর নি?
জি, না।
খানিকটা সময় কাটে। চোখ বুজে কী যেন ভাবে উজাগর সিং। তারপর হঠাৎ বলে, এই জঙ্গলে তো রয়েছ, তা মেয়েমানুষ পুষেছ?
উজাগরের কথাগুলো পুরোপুরি বোঝে নি লখাই। কিছুক্ষণ অবাক হয়ে সে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। যখন বোঝে নারী এবং নেশাঘটিত ব্যাপারে এই লোকটা তাকে উৎসাহই দেবে, কোনো বিপদে ফেলবে না, তখন বলে, না। এই জঙ্গলে কোথায় পাব মেয়েমানুষ!
ওয়া গুরুজিকা ফতে! আওরত ছাড়া দিন কাটে কেমন করে? এমন তাজ্জব কথা কোনোদিন শুনি নি।
লখাই জবাব দিল না।
উজাগর সিং আবার বলল, আমার তো এক রোজও জোয়ানী মেয়েমানুষ ছাড়া চলে না। দশটা রোজ এই জঙ্গলে যে কেমন করে কাটাব, গুরুজি মালুম।
একটা হাত লখাইর ঘাড়ে রাখল উজিগর সিং। নিজের দিকে লখাইকে একটু টানল। হঠাৎ তার গলার স্বরটা ঝুপ করে খাদে নামল, লখাই দোস্ত–
জি, অফসর সাহিব তুণাবাদের আগে এক গাঁও আছে। তার নাম তো পুটমুট (পোর্ট মোয়াট)?
হাঁ, জি।
পুটমুট তুমি গেছ কোনোদিন?
হাঁ, জি। দু’দিন আগে এক ফরেস্ট গার্ডের সাথ একবার গিয়েছিলাম।
পথ দেখিয়ে আমাকে পুটমুটে নিয়ে যেতে পারবে?
জরুর পারব।
শাবাশ, শাবাশ।
দুই হাতে লখাইকে জড়িয়ে ধরে হল্লা করে উঠল উজাগর সিং, গুরুজির মেহেরবানিতে জঙ্গলে তোমার মাফিক দোস্ত পেয়েছি। লেকিন তুমি যদি একটু মেহেরবানি না কর, জঙ্গলে জিন্দেগী বেকার হয়ে যাবে।
রক্তে রক্তে নির্জলা বিলিতি মদের ক্রিয়া শুরু হয়েছে। কপালের দু পাশে দুটো অবাধ্য রগ সমানে লাফাচ্ছে। চোখের ডিম দুটো লাল হয়ে উঠেছে। মাথা অল্প অল্প টলছে। অনেকদিন পর চুটিয়ে নেশা করেছে লখাই। মাত্রাটা ঠিক রাখতে পারে নি। তবু পাকা নেশাখোর সে। নেশার ব্যাপারে মাত্রা হারালেও হুঁশ পুরো বজায় আছে। আস্তে আস্তে সে বলল, কী বলছেন অফসর সাহিব?
স্বর খাদে নামল উজাগরের। একরকম ফিশফিশই শোনাল, পুটমুটের চৌধুরির নাম তো মঙ ফা। লোকটা বর্মী? তাই না?
হাঁ, জি।
মঙ ফা’র একটা খুবসুরতী শালী আছে। শালীটা রাঁড় (বিধবা), নাম মিমি খিন। মিমি খিন বহুত খুবসুরতী। আসার সময় তাকে দেখে এসেছি। একটু থেমে উজাগর বলে, তুমি মিমি খিনকে দেখেছ ইয়ার?
জি, না।
দেখেছ দেখেছ। নেশার ঘোরে অদ্ভুত কথা বলে উজাগর সিং, না দেখলেও দেখেছ দোস্ত। তাগড়া খুবসুরতী জোয়ানী নতুন করে আর কী দেখবে? দিনরাত যে লেড়কীর খুয়াব দেখ, দিনরাত তোমার আঁখের সামনে যে ঘুরে বেড়ায়, সে-ই মিমি খিন।
উজাগর সিংয়ের কথাগুলো সবটা শুনেছে লখাই। কিন্তু বুঝে উঠতে পারে নি। বিড় বিড় করে সে বকছে, আঁখের সামনে যে ঘুরে বেড়ায়–
উজাগরের চোখ দুটো ধক ধক করছে। চাপা, তীব্র স্বরে সে বলল, এ ইয়ার, আওরতটাকে যে চাই–
জড়ানো, দুর্বোধ্য স্বরে লখাই বলল, কেমন করে?
বিকট আওয়াজ করে খেঁকিয়ে খেঁকিয়ে হাসল উজাগর সিং। হাসির দমকে মাংসল, রোমশ পেট নাচতে লাগল। হাসির চোট কমলে বলল, বিশ পঁচিশ রোজ জঙ্গলে থেকে একেবারে জংলীই বনে গেছিস লখাই। বুদ্বু, মুরুখ কহিকা! তুমি থেকে ফের তুই হয়ে গেল লখাই।
একটু দম নিয়ে উজাগর আবার শুরু করল, পেয়া। রুপেয়া দিলে আসমানের চাঁদ মেলে। আর এ তো মঙ ফা’র রাঁড় শালী, মরদে ঠোকরানো এক আওরত।
ঠিক ঠিক–মাথা নেড়ে নেড়ে সায় দেয় লখাই। মাথাটা নাড়তে হচ্ছে, না নেশার দাপটে আপনা থেকেই সেটা নড়ছে, বুঝবার জো নেই। নেশায় বেচাল হয়ে পড়েছে, তবু উজাগরের কথাগুলো শুনতে শুনতে লখাইর মনে হয়, এই ফরেস্ট অফিসারটার সঙ্গে কোথায় যেন ভিখন আহীরের আশ্চর্য রকমের একটা মিল রয়েছে। এখন, এই মুহূর্তে সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে • লখাই।
অনেকটা সময় কাটে। নেশা পুরাপুরি জমে উঠেছে। চোখ বুজে ভোম মেরে বসে থাকে দুজনে।
হঠাৎ উজাগর সিং বলল, চল লখাই, আজ রাতে একটু ফুর্তি করে আসি।
কোথায়?
পুটমুট। আমি এদিকের পথ চিনি না। তুই পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবি?
যাব। বাঁ দিকে মাথা হেলিয়ে সায় দিল লখাই।
সবে রাতের শুরু।
দুপুর থেকে লখাই আর উজাগর নেশা করেছে। বিকেলের দিকে নেশার ভাবটা ফিকে হয়ে এসেছিল। পর পর দু বোতল গলায় ঢেলে আবার সেটা চাঙা করে নিয়েছে। দুপুরে চোখে লাল রং ধরেছিল। লাল আর সাদা হয় নি।
‘বীটে’র ঝুপড়িগুলিতে লণ্ঠন জ্বলছে। রাঁচি কুলি আর জবাবদারদের নাচা, গান, বাজনা আর বেপরোয়া হল্লা তুমুল হয়ে উঠেছে। এই নিঝুম অরণ্যে হল্লা করে তাদের বেঁচে থাকতে হয়। নইলে অরণ্যের স্তব্ধতা তাদের বোবা বানিয়ে দিত। শুধু কি সে জন্যই তারা হল্লা করে? জীবন এবং মৃত্যুর সীমান্তে তারা থাকে। যে-কোনো মুহূর্তে জারোয়াদের তীরে তাদের জান যেতে পারে। বোধ হয় হল্লা করে জারোয়ার ভয় ভুলে থাকতে চায় তারা।
বুশ পুলিশের ক্যাম্পে মশাল জ্বালানো হয়েছে।
ডিম-ডিম-ডিম–অন্য দিনের মতোই একতালে টিকারা বাজছে।
লখাইকে সঙ্গে নিয়ে পোর্ট মোয়াট রওনা হল উজাগর সিং।
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পথ। দু’হাতে ডালপালা সরিয়ে, পায়ে টক্কর আর মাথায় গুঁতো খেতে খেতে দুজনে এগিয়ে চলেছে। ধারাল কাটার ঘায়ে চামড়া ছিঁড়ছে, খুন ঝরছে। পায়ে পোকা কামড়াচ্ছে। অরণ্যের মাথা থেকে দলা পাকিয়ে থোকায় থোকায় জোঁক পড়ছে গায়ে। মানুষের রক্তের স্বাদ পেয়ে কতকালের সাধ যে তারা মিটিয়ে নিচ্ছে! তবু ভ্রূক্ষেপ নেই, হুঁশ নেই। ফুর্তির নেশায় দুজনে মশগুল হয়ে রয়েছে, শরাবের নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। মঙ ফা’র জোয়ানী শালীটার কথা ভাবছে উজাগর সিং। ভাবতে ভাবতে উত্তেজিত হয়ে উঠছে।
এর আগে অন্য অন্য দিন আবর খানের সঙ্গে জঙ্গলে আসত লখাই। জঙ্গলে ঢুকলেই অদ্ভুত এক ভয় তাকে ঘিরে ধরত। কিন্তু আজ মদের নেশা, মেয়েমানুষ নিয়ে সম্ভাব্য ফুর্তির নেশা, সব মিলিয়ে আকণ্ঠ, অসহ্য এক উত্তেজনা লখাইর শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ছে।
জঙ্গলে পঁচিশটা দিন কাটিয়ে লখাইর মনে হয়েছিল, সে জুড়িয়ে যেতে বসেছে। প্রত্যেক মানুষই তার নিজস্ব নিয়মে জীবনটাকে ভোগ করে। লখাইরও এই ভোগ করার নিজস্ব একটা পদ্ধতি ছিল। আবর খানের সংস্পর্শে এসে সেটা ভুলতে বসেছিল লখাই।
উজাগর সিং এসে আবার তাকে তাতিয়ে তুলেছে। যে-নিয়মে উজাগর জীবনকে ভোগ করতে চায়, মোটামুটি লখাইও সেই নিয়মেরই পক্ষপাতী। উজাগর আসায় নিজের চরিত্র এবং জীবন সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠেছে লখাই।
পথ চলছে আর সমানে বকর বকর করছে উজাগর, বুঝলি ইয়ার, এই জিন্দেগীর আয়ু দুদশ রোজ। তাই কোঈ পরোয়া নেই। খানা খাও, নেশা কর, নাচা কর, গানা কর, হল্লা কর, আওরতের সাথ ফুর্তিফার্তা কর। তার পরেই তো ফৌত হয়ে যাবে। কোঈ পারোয়া নেই। জিন্দেগীর মানে কী জানিস লখাই?
কী?
ফুর্তি।
ফুর্তি?
হাঁ হাঁ, জরুর ফুর্তি। শরাব গিলে আওরতের সাথ ফুর্তি। বলে একটু থেমে উজাগর। ফের শুরু করে, ফুর্তি কোথায় মেলে জানিস?
লখাই উত্তর দেয় না।
আরে মুরুখ, ফুর্তি এই দুনিয়ার দুটো চীজে–শরাবে আর মেয়েমানুষে। হাঃ-হাঃ-হাঃ–
দক্ষিণ আন্দামানের এই অরণ্যকে চমকে দিয়ে হেসে ওঠে উজাগর সিং।
পৃথিবীর আদিম অরণ্য বুঝি আন্দমানেই জন্মেছিল। সেই অরণ্যের মধ্যে দিয়ে দুটো লম্পট নেশাখোর প্রাগৈতিহাসকি বর্বর আদিম ফুর্তির খোঁজে চলেছে।
এটা উনিশ শ’ এগার সাল।
এবারডিন বাজারে এতদিন মোট পাঁচখানা দোকান ছিল। পুরনো কয়েদি সুলেমান মোপলার কাপড়ের দোকান, ফাই মঙ বর্মীর কাঠ এবং বেতের আসবাবের দোকান, মাদ্রাজি চীনা রেড্ডির সরাইখানা, মাড়োয়ারী খুবলালের চাল-ডাল-মশলার দোকান, বাঙালি খ্রিস্টান গোমেসের প্রবাল-শামুক-শঙ্খ, ইত্যাদি হরেক রকম সামুদ্রিক কড়ির দোকান।
এবার আরো একটা দোকান যোগ হল। চান্নু সিংয়ের চায়ের দোকান।
টিনের চাল, প্যাডক কাঠের দেওয়াল, বাঁশের নিচু নিচু মাচানে খদ্দেরদের বসার ব্যবস্থা। এই হল চান্নু সিংয়ের চায়ের দোকানের চেহারা।
সামনে বিরাট এক চুল্লির মাথায় তামাম দিন জল ফোটে। ফুটে ফুটে সাদা ধোঁয়ার আকারে বাষ্প হয়ে উড়ে যায়। সারা আন্দামানে এই একটা মাত্র চা-খানা।
সময়টা বিকেল।
এবারডিন বাজারের মধ্য দিয়ে একটা সড়ক সিসোস্ট্রেস উপসাগরের দিকে চলে গিয়েছে। সড়কটার দু পাশে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত বিরাট বিরাট কয়েকটা রেন-ট্রি।
গরম জলে এনামেলের পেয়ালাগুলি ধুচ্ছিল চান্নু সিং। আর সামনের সড়কটার দিকে। বার বার তাকাচ্ছিল। এখন রোদ ঝিমিয়ে পড়েছে। রেন-ট্রির গোল গোল পাতাগুলো শেষ বেলার আলো মেখে ঝিকমিক করছে।
আর খানিকক্ষণ পরেই মেরিন ডিপার্টমেন্ট ছুটি হয়ে যাবে। খালাসিরশিম্যান বোটম্যানেরা চা খেতে আসবে। শুধু কি মেরিনের জাহাজীরাই আসবে, ট্রান্সপোর্টের কুলি-জবাবদারা আসবে, সেলুলার জেলের পেটি অফিসার-টিণ্ডাল-জমাদার-ওয়ার্ডারেরা আসবে। শহর পোর্টব্লেয়ার থেকে দূরে দূরে পেনাল সেটেলমেন্ট গড়ে উঠেছে। পাহাড়গাঁও, গারাচারামা, লম্বা লাইন, ইত্যাদি নানা গাঁও। উপনিবেশ এখন জমজমাট। সাজার মেয়াদ ফুরোবার পর অনেক কয়েদি সেখানে বিয়ে শাদি করে সংসারী হয়ে বসেছে, সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গিয়েছে। পেনাল কলোনি থেকে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চার পাঁচ মাইল ঠেঙিয়ে পুরনো কয়েদিরা রোজ বিকেলে চান্ন সিংয়ের চা-খানায় আসে। একটা পয়সার বদলে এনামেলের এক পেয়ালা চা নিয়ে তারিয়ে তারিয়ে চুমুক দেয়। এটা তাদের শখ। ঠিক শখ নয়, বিলাস বলাই বুঝি ঠিক।
চা-খানার নিচু নিচু মাচানে এক-এক পেয়ালা চা নিয়ে খদ্দেররা জাঁকিয়ে বসে। অনেক রাত পর্যন্ত তারা চুটিয়ে আড্ডা মারে। খিস্তি-খাস্তা, কিত্সা-গুজব, অশ্লীল গুলতানিতে চান্নু সিংয়ের চায়ের দোকান মশগুল হয়ে থাকে।
একটু পরেই খদ্দেরেরা এসে পড়বে।
একবার পেয়ালা ধুচ্ছে চান্নু, একবার চা-চিনি-দুধের সরঞ্জাম হাতের কাছে গুছিয়ে রাখছে, যাতে দরকারমতো হাত বাড়ালেই সব কিছু পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে যে-পাত্রে টগবগ করে জল ফুটছে, তার ঢাকনা ফাঁক করে চাপ চাপ বাষ্প বার করে দিচ্ছে। এখন মরার ফুরসত নেই চান্নু সিংয়ের।
চা-ছাঁকনিটা সাফ করতে করতে সে ভাবল, একটা নৌকর রাখা দরকার। যদি দুতিন টাকা তলবও (মাইনে) দিতে হয়, তাতেও সে রাজি। একা সব দিক সামাল দিয়ে উঠতে পারছে না। এঁটো পেয়ালাগুলো ধুয়ে দিলেও তার কাজের অনেকখানি আসান্যু হয়। হ্যাঁ, একটা নৌকরই রাখবে চান্নু সিং।
শুধু ছোট এই চা-খানাই নয়, চান্নু সিংয়ের সাধ অনেক বড়। তার স্বপ্ন ছোট মাপের এই চা-খানাতেই আটকে নেই। তার ইচ্ছা, এই চা-খানাটা একদিন বিরাট একটা হোটেল হয়ে যাবে। রোটি-গোস্ত-তড়কা-মিঠাই–যে খানা চাই, সব কিছু মিলবে।
একবার মুম্বই গিয়েছিল চান্নু সিং। সেই শহরে বিরাট এক সরাইখানা দেখেছিল। সেখানে বিজলি বাতি জ্বলে, মাঝ রাত পর্যন্ত কত খদ্দের আসে। হরেক কিসিমের খানা, হরেক কিসিমের মানুষ। খানা যুগিয়ে যুগিয়ে হোটেলের নৌকরগুলো হয়রান হয়ে পড়ে। তাজ্জব হয়ে সব লক্ষ করেছিল চান্নু সিং। তার চোখে ধাঁধা লেগে গিয়েছিল। সরাইখানার এক কোণে উঁচু এক গদি। সেখানে তাকিয়া ঠেসান দিয়ে মালিক বসে ছিল। সামনে বিরাট এক কাঠের বাক্স। বাক্সের পেটটা নোট আর রেজগিতে ঠাসা।
মুম্বই শহরের সেই হোটেল দেখার পর চান্নু সিং খোয়াব দেখতে শুরু করেছে। দুনিয়ার যেখানেই সে থাক, সেই হোটেলের মতো একটা হোটেল সে খুলবেই। মালিকের গদিটা তার বড় মনে ধরেছে। তেমন একটা গদিও বানিয়ে নেবে চান্নু সিং। গদিতে জাঁকিয়ে বসে খদ্দেরদের কাছ থেকে দাম আদায় করবে, সব দিকে নজর রাখবে।
সিসোস্ট্রেস উপসাগরের দিকে যে-সড়কটা চলে গিয়েছে, সেটা এখন ধু ধু করছে। বিকেলের রোদ মরে আসছে। খানিকটা ছায়া ছায়া, বিবর্ণ আলো রেন-ট্রিগুলোর মাথায় আটকে আছে।
চান্নু সিং সামনের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার দৃষ্টিটা পাথুরে সড়ক, রেন-ট্রি এবং অনেক দূরের আকাশ পেরিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে। স্বপ্ন দেখছে সে।
চান্নু মনে মনে হিসাব করছিল। মোট তিন শ’ টাকা তার জমেছে। আর শদুই জোটাতে পারলেই এবারডিন বাজারে একটা বড় ঘর ভাড়া নিয়ে হোটেল খুলে বসবে।
পাথুরে সড়কে হঠাৎ কাঁচ কোচ শব্দ উঠল। চান্নু সিংয়ের স্বপ্নটা ছিঁড়ে গেল লহমায়। একটা বলদে-টানা গাড়ি পাথরে টক্কর খেতে খেতে চড়াই ভাঙছে।
শেষ পর্যন্ত গাড়িটা চান্নুর চা-খানার সামনে এসে দাঁড়াল। ছইয়ের ভেতর থেকে কে যেন ডাকাডাকি লাগিয়েছে, এ চান্নু–চান্নু—
স্বপ্ন ছুটে যাওয়ায় মেজাজ খিঁচড়ে গিয়েছিল চান্নুর। সে খেঁকিয়ে উঠল, কৌন, কৌন
রে হারামী?
আমি মাউ খে–ছইয়ের ভেতর থেকে লাফ মেরে নিচে নামল মাউ খে।
এবার কিন্তু খুব খুশি হয়ে উঠল চান্নু সিং। দুই হাত বাড়িয়ে চেঁচায়, আও ইয়ার—
গাড়ির ভাড়া চুকিয়ে চা-খানায় ঢুকল মাউ খে।
চান্নু সিং বলল, পাঁচ রোজ তোর পাত্তা নেই। পুট বিলাসের (পোর্ট ব্লেয়ারের) সব আদমীর কাছে তোর কথা জিজ্ঞেস করেছি। লেকিন কোনো শালে তোর খবর দিতে পারে নি।
ইতিমধ্যে একটা মাচানের ওপর উবু হয়ে বসে পড়েছে মাউ খে। ঘাড়টা ভেঙে দুই হাঁটুর ফাঁকে গুঁজে দিয়েছে।
চান্নু সিং মাচানটার কাছে এগিয়ে এল। মাউ খের পিঠে হাত রেখে আস্তে আস্তে ঠেলা মারল। ডাকল, এ মাউ খে–
মাউ খে অস্ফুট শব্দ করল, হাঁ—
পাঁচ রোজ কোথায় ছিলি?
তুষণাবাদের জঙ্গলে গিয়েছিলাম।
কেন?
ভাইটাকে দেখতে।
কাকে? মঙ চোকে?
হাঁ। হাঁটুর ফাঁক থেকে মাথা তুলছে না মাউ খে। কেমন যেন মুষড়ে পড়েছে সে।
এবার খেপে উঠল চান্নু সিং। দুই হাতে মাউ খেকে ঝকানি দিয়ে চেঁচাতে লাগল, নালায়েক, বুদ্ধ কাহাকা! শির তুলছিস না কেন?
আস্তে আস্তে মাথা তুলল মাউ খে। তার চাপা, কুতকুতে চোখ দুটো টকটকে লাল, কেমন যেন ভেজা ভেজা। খুব সম্ভব হাঁটুতে মাথা গুঁজে সে কেঁদে থাকবে।
একদৃষ্টে কিছুক্ষণ মাউ খের দিকে তাকিয়ে রইল চান্নু সিং। কী বুঝল, সে-ই জানে। হঠাৎ গলার স্বর খানিকটা নরম করে ফেলল, কী হয়েছে রে মাউ খে? কেঁদে কেঁদে আঁখ লাল করেছিস!
চান্নু ভেইয়া, তুষণাবাদের জঙ্গলে গিয়েছিলাম। মঙ চোকে দেখে এলাম–
একটু থামল মাউ খে। কী ভেবে ফের শুরু করল, ভাইটা ভারি বুখারে পড়েছে। শরীর শুকিয়ে গিয়েছে। স্রিফ কখানা হাড্ডি সার। এত দুলা যে রশির খাঁটিয়া থেকে উঠতে পারে না, দিনরাত শুয়ে থাকে।
হাঁ?
জরুর মরে যাবে মঙ চো। দুরোজও আর টিকবে না। আন্দামানের জঙ্গল বুখার দিয়ে ভাইটাকে খতম করে ফেলল রে চান্নু।
হাঁ।
এ জঙ্গল বহুত হারামী–বহুত দুশমন–
বলতে বলতে ফুঁসে উঠল মাউ খে। ফুঁসতে ফুঁসতে কেঁদে ফেলল। একটানা বলে যেতে লাগল, আমার আর কেউ নেই। ওই একটা মোটে ভাই। ভেবেছিলাম, ভাইটা যখন আন্দামানেই কয়েদ খাটতে এল, তখন এক সাথ থাকব। লেকিন জঙ্গল তাকে খতম করে ফেলল। জঙ্গল কিতনা বড় দুশমন, আমি দেখব। এই দুশমনের সাথ মুলাকাত করব। মাউ খে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর বলছে, আন্দামান হোমস-এর নোকরি ছেড়ে দিয়ে এসেছি চান্নু।
কাদাকাঁচাঙ না হ্যাঁডোর ওদিকে কোথায় যেন সরকার থেকে আন্দামান হোমস বসানো হয়েছে, চান্নু সিং ঠিক জানে না। জঙ্গল থেকে জারোয়া, আরোয়া, ওঙ্গে, গ্রেট আন্দামানিজনানা জাতের আদিবাসীদের ধরে ধরে সেখানে আদব কায়দা শিখিয়ে, সভ্যভব্য বানানো হচ্ছে।
মাউ খে আন্দামান হোমস-এ নোকরি করে। পাকা সরকারি নোকরি। চান্নু সিংয়ের চা-খানায় আসার আগে সেই নোকরিতে ইস্তফা দিয়ে এসেছে সে।
চান্নু সিং বলল, নোকরি তো ছাড়লি, লেকিন এখন কী করবি?
ফরেস্টে নোকরি নেব। সিরকার জঙ্গল কাটাচ্ছে। জঙ্গল আমার ভাইকে খতম করেছে, আমি জঙ্গলকে খতম করব। হাঁ–জরুর। ডাইনে বাঁয়ে–দু পাশে ঘন ঘন মাথা ঝাঁকাতে লাগল মাউ খে।
বিড় বিড় করে চান্নু সিং বকতে লাগল, শালে পাগল কাঁহাকা–
মাউ খে সমানে কাঁদছে। তার কান্না চান্নু সিংয়ের মতো জবরদস্ত শিখকে কিছুটা কাবু করে ফেলেছিল। বুকের ভেতরটা খানিক নরমও বুঝি হয়েছিল তার। কিন্তু সে আর কতক্ষণ?
চান্নু সিং হচ্ছে সেই ধাতের মানুষ, কোনো দিন কোনো কারণে যে কান্না, কি মন খারাপ, কি মুষড়ানো ভাব সইতে পারে না। তার ধারণা কান্না, মন খারাপ–এ সব হচ্ছে মেয়েমানুষের ব্যাপার। যে সত্যিকার পুরুষ, প্রকৃত মরদ, সে কেন কাঁদবে? সে চাকু চালাবে, ঘুষি হাঁকাবে, অন্য লোককে কাঁদিয়ে মজা দেখবে। চোখ থেকে যার আঁসু বেরোয়, সে কি শালে পুরুষ! সে আওরতেরও বেহদ্দ।
চান্নু সিংয়ের জীবন দর্শন বুঝি অনেকটা এই রকম। খানিকটা ক্রুর এবং অমার্জিত হলেও তার চিন্তাধারায় নিরাসক্তি মেলে। কে মরল, কে বাঁচল, তার কথা ভেবে ভেবে অহেতুক মাথাব্যথা করা তার ধাতে নেই। তার মতে নিজের বুঝটা পুরাপুরি বুঝে নাও। নিজের উপভোগের জন্য, দরকার হলে ছিনিয়ে নাও। দুনিয়ার কেউ যখন তোমাকে মেহেরবানি করে কিছুই হাতে তুলে দিচ্ছে না, তখন মেরে কেটে যেমন করে পার, আদায় কর। আদায় করা কী সোজা কথা! প্রতি মুহূর্তে তোমার ভোগের জন্য এটা দরকার, ওটা দরকার। মেয়েমানুষ দরকার, শরাব দরকার, চণ্ডু-চরস-পিনিক দরকার, কাপড়া-খানা দরকার। তোমার দিলের খুশির জন্য মহবৃৎ দরকার। তোমার এত দরকার। দরকারের জিনিসগুলো জোটাতে তুমি হিমসিম খেয়ে যাচ্ছ, তোমার কালঘাম ছুটছে। এর মধ্যে সময় কোথায় তোমার, ভাই-বন্ধু, ইয়ার-রিস্তেদারের জন্য বেফায়দা চোখ থেকে আঁসু বার করার? সময় নেই। অন্যের জন্য তুমি যদি মন খারাপ করে থাকো, শুধুই কেঁদে যাও, তা হলে আঁসু দিয়ে একটা দরিয়া বানাতে পারবে। কিন্তু তোমার জন্য ভাবে কে? প্রতি মুহূর্তে তোমার ভোগ এবং উপভোগের জিনিসগুলি যোগায় কে? তাই কোনো ব্যাপারে কোনো পয়োয়া নেই। ইয়ার, নিজের ধান্দায়, নিজের চিন্তায় মানুষ ঝুঁদ হয়ে আছে। তার ওপর অন্যের ভাবনা মাথায় চাপলে উপায় থাকবে? অন্যের জন্য, সে যে-ই হোক, কেঁদে কেঁদে নিজেকে কাবু করে ফেলা আর যা-ই হোক, বুদ্ধিমানের কাজ নয়। মোটামুটি এই সব চিন্তার খাত ধরেই চান্নু সিংয়ের জীবন দর্শন গড়ে উঠেছে।
মাউ খের কাঁধে একটা হাত রেখে চান্নু সিং বলল, আরে ইয়ার, রো মাত। এক রোজ মানুষ পয়দা হয়, আর এক রোজ মরে। এই তো দুনিয়ার কানুন। তুই কেঁদে কি ভাইয়ের মৌত (মৃত্যু) ঠেকাতে পারবি?
না।
তবে শালে কাঁদছিস কেন? যার যখন সময় হবে তখন সে জরুর মরবে। তবে কেঁদে ফায়দা কী?
আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে মাউ খে। ধরা ধরা, বিমর্ষ গলায় বলে, ঠিক কথা, কেঁদে কুছু ফায়দা নেই।
শাবাশ দোস্ত। উৎসাহে মাউ খের পিঠে বিরাট এক থাপ্পড় বসায় চান্নু সিং। বলে, দিল খুশ রাখো পেয়ারে।
তাড়াতাড়ি এক পেয়ালা চা বানিয়ে ফেলে চান্নু সিং। সেটা মাউ খের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, গরম চা পী লেও, মেজাজ চাঙ্গা হয়ে যাবে।
চান্নু সিংয়ের কাছে এসে বিষণ্ণ, মুড়ানো ভাবটা কেটে যেতে থাকে মাউ খের। ফুঁ দিয়ে জুড়িয়ে জুড়িয়ে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দেয় সে।
এতক্ষণ রেন-ট্রিগুলোর মাথায় বিকেলের নিস্তেজ আলোটুকু আটকে ছিল। রেন-ট্রির ছোট ছোট গোল পাতাগুলো চিকচিক করছিল। এখন পাতলা কুয়াশার একটা পর্দা নেমেছে। সামনের পাথুরে সড়কটা যেখানে থেকে ঢালু হয়ে সিসোস্ট্রেস উপসাগরের দিকে নামতে শুরু করেছে সেই জায়গাটা কেমন যেন আবছা দেখায়।
এক ঝক সিন্ধুশকুন এবারডিন বাজারের ওপর দিয়ে কোন দিকে যেন উড়ে গেল। ভোর হলেই এই পাখিরা সাগরে চলে যায়। আবার দিন ফুরিয়ে রোদ যখন মরে যায়, ঠিক সেই সময় সাগর থেকে তারা দ্বীপে ফিরে আসে।
চায়ের পেয়ালাটা শেষ করে ফেলল মাউ খে। বিমর্ষ ভাবটা এখন একেবারেই কাটিয়ে ফেলেছে সে। ডাকল, এ চান্নু–
হাঁ–চুল্লিতে কয়লা দিয়ে আঁচটাকে গনগনে করে তুলল চান্নু সিং। তারপর মুখ তুলে বলল, হ, কী বলছিস?
পিয়ারীলাল এসেছিল?
না–বিরক্ত গলায় গজ গজ করতে লাগল চান্নু সিং, ছরোজ আগে সেই যে তোর সাথ এসেছিল, আর এদিকে ভেড়ে নি। হারামী কুত্তা, শালের মাপের ঠিক নেই। কথা দিয়ে কথা রাখে না।
হুঁ। অস্পষ্ট একটা আওয়াজ করল মাউ খে।
চান্নু সিং খেঁকিয়ে উঠল, হু কী রে শালে?
বলছিলাম ছরোজ তা হলে সোনিয়ার কোনো খবর পাস নি?
বিরস মুখে চান্নু জবাব দিল, না।
এখন আমি উঠি।
কিউ?
ডিলানিপুর যাব। পিয়ারীলালকে পেলে তোর কাছে ধরে আনব।
বহুত আচ্ছা। জলদি যা দোস্ত।
বাঁশের মাচান থেকে নেমে পড়ল মাউ খে।
সন্ধের ঠিক আগে আগে খদ্দেররা হুড়মুড় করে এসে পড়ল। মেরিন থেকে জাহাজী খালাসিরা এল। ট্রান্সপোর্ট ডিপার্টমেন্টের কুলি-জবাবদাররা এল। সেলুলার জেলের টিণ্ডাল পেটি অফিসারেরা এল।
দু পাঁচ জন সিপাই জামাদারও এসেছে। তাদের সবাইকে খুব খাতির করে বসিয়েছে। চান্নু সিং।
সামনের সড়কটা এখন একেবারেই আবছা হয়ে গিয়েছে।
দু পাশে দুটো গ্যাসের বাতি জ্বলছে।
চা-খানার ঠিক পেছনেই হাওয়াই বুটির জঙ্গল। সেখান থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বাড়িয়া পোকা আর মশা উঠে আসতে শুরু করেছে।
প্রচণ্ড খাটতে পারে চান্নু সিং। তিনটে মানুষের কাজ সে একাই করছে। চা ছাঁকছে, পেয়ালা ধুচ্ছে, চুল্লিতে কয়লা দিয়ে দিয়ে আঁচটাকে জিইয়ে রাখছে। এরই মধ্যে সমানে খদ্দেরদের চায়ের যোগান দিয়ে চলেছে।
যত রাত হচ্ছে, খদ্দেরও ততই বাড়ছে। বাড়িয়া পোকা আর মশার উৎপাতও সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।
চান্নু সিংয়ের চা-খানায় পুরোদমে এখন আড্ডা চলছে। মশা আর বাড়িয়া পোকার উৎপাত অগ্রাহ্য করে খদ্দেররা গুলতানি পাকাতে থাকে। খিস্তি-তামাশা-হল্লায় চা-খানাটা সরগরম।
কে একজন বলল, একটা সাচ্চা খবর বলছি।
পাশ থেকে ইয়ারেরা হাঁ হাঁ করে ওঠে, কী? কী খবর?
এবার জাহাজ ভরে বিলাইতি শরাব আর খুরসুরত জোয়ানী লেড়কী আসছে।
গ্যাসের আলোয় চারপাশের মানুষগুলোর চোখ চক চক করে। তবে সবাই এক সঙ্গে চেঁচিয়ে ওঠে, ঝুট।
ঝুট তো ঝুট। মুন্সিজি নিজের মুখে বলেছে।
এবার চারপাশের ইয়ারেরা প্রথম লোকটার গা ঘেঁষে বসে। বলে, ঠিক বলছিস? মুন্সিজির মুখে শুনেছিস তো?
আরে ইয়ার, জরুর শুনেছি। সিরকার এবার খাসা মতলব করেছে। বলেই চুপ করে গেল লোকটা। তারিয়ে তারিয়ে চায়ের পেয়ালায় একটার পর একটা চুমুক দিতে লাগল। তারপর চারপাশের মুখগুলোর ওপর দিয়ে চোখ দুটো ঘুরিয়ে নিয়ে গেল।
লোকটা ওস্তাদ গল্প বলিয়ে। তরিবত করে সে শুধু চায়েই চুমুক দিতে থাকে। সরকার কী ধরনের খাসা মতলবটা করেছে, সে-সম্বন্ধে একটি কথাও আর বলে না।
চারপাশের ইয়ারেরা অস্থির হয়ে ওঠে। তাদের কৌতূহল বাগ মানছে না। একসঙ্গে সবাই হল্লা বাধিয়ে তোলে, কি রে শালে, বলছিস না কেন? সিরকারের খাসা মতলবটা কী?
সিরকার মতলব করেছে, এক-এক কয়েদিকে দুটো করে জোয়ানী দেবে। আর ভরপেট বিলাইতি শরাব খাওয়াবে।
সচ্ বলছিস?
চায়ের পেয়ালা নামিয়ে ঘষে ঘষে মুখ মুছল লোকটা। তারপর বলল, বিলকুল ঝুট। এ-জাহাজে জোয়ানী লেড়কীও আসবে না, শরাবও আসবে না। মোষ আর ঘোড়া আসবে।
তবে যে বললি! শালে হারামী শয়তান কাঁহাকা! ইয়ারেরা সমানে চিল্লাতে থাকে।
লোকটা আর কিছুই বলে না। অন্ধকার সড়কটার দিকে তাকিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে পায়ের আঙুল নাচাতে থাকে।
অন্য একটা মাচানে আর এক ধরনের গল্প চলছিল।
একজন গম্ভীর স্বরে বলছে, গারাচারামা গাঁও-এর সিদ্ধিবাবা একটা বড় তাজ্জবের কথা বলেছে।
কী, কী, কী–চারপাশের লোকগুলো তাকে ঘিরে ধরে।
দুনিয়ার এন্তেকাল এসে গিয়েছে। একটা মানুষও আর বাঁচবে না। ঘন ঘন ভূমিকম্প হবে, বাড় (বন্যা) হবে। ভেঙে চুরমার হয়ে দুনিয়া দরিয়ার নিচে চলে যাবে।
সচ্?
জরুর সচ্। লেকিন একটা কথা, এই আন্দামান দ্বীপ ঠিকই থাকবে। দুনিয়ার সবাই মরবে, আমরাই খালি টিকে থাকব।
সচ্?
লোকটা এবার আর জবাব দিল না।
কোনো দিকে নজর দেবার ফুরসতটুকু পর্যন্ত নেই চান্নু সিংয়ের। খদ্দেরদের সমানে চায়ের যোগান দিচ্ছে। আর ঘন ঘন সড়কটার দিকে তাকাচ্ছে। তাকাচ্ছে আর ভাবছে, এবারডিন বাজারের এই ছোট্ট চা-খানাটা এক বোজ মুম্বই শহরের সেই বিরাট সরাইখানা হয়ে যাবে। তখন অনেক পয়সার মালিক হবে চান্নু সিং। কিন্তু এত পয়সা, এত দৌলত কার জন্য? মধ্যে মধ্যে এই রকম একটা দার্শনিক চিন্তার উদয় হচ্ছে। সে নিজে তো একা মানুষ। খানা-আস্তানা বাবদ তার আর কটা পয়সার দরকার? যতই ভাবছে, মেজাজটা ততই খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
ইয়ারগুলো মাচানে ঠাসাঠাসি গাদাগাদি মেরে বসে হই হই করছে। রাত বাড়ছে। বাড়িয়া পোকা আর মশাগুলো জ্বালিয়ে মারছে। কিন্তু কোনোদিকে হুঁশ নেই চান্নু সিংয়ের। সামনের সড়কটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে অস্থির হয়ে উঠল সে। অনেকক্ষণ হল পিয়ারীলালের খোঁজে বেরিয়েছে মাউ খে। এখনও তো ফিরছে না!
চাপা গলায় চান্নু খিস্তি দিল, শালে, কুত্তীকা বাচ্চে–
অনেক রাত্তিরে আড্ডা ভাঙল।
খদ্দেররা যে-যার আস্তানার দিকে রওনা হয়ে গেল। চান্নু ছাড়া চা-খানায় এখন আর কেউ নেই।
বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে এখন পূর্ণোদ্যমে বসন্তের হাওয়া বইছে। বাতাসে এখনো খানিকটা হিম হিম আমেজ মিশে আছে।
একটা মাচানের ওপর কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে রয়েছে চান্নু সিং। তার চোখ সামনের এবড়ো খেবড়ো পাথুরে সড়কটার দিকে স্থির হয়ে আছে।
দু পাশে গ্যাসের বাতি জ্বলছে। ফাই মঙ বৰ্মীর দোকানে, চীনা রেড্ডির সরাইখানায় আর খুবলালের দোকানে টিম টিম করে তেলের লণ্ঠন জ্বলছে। গোমেস আর সুলেমান মোপলার দোকান বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এবারডিন বাজারটা এখন একেবারেই নিঝুম।
ফাই মঙ বর্মীর দোকানে এখন জুয়ার আসর বসেছে। থেকে থেকে সীসার খুঁটি চালানোর ভোতা ধাতব শব্দ উঠছে, গ গ গ। চাপা গলায় জুয়াড়িরা কথা বলছে। অন্য অন্য দিন খদ্দেররা চলে যাবার পর দোকান বন্ধ করে জুয়া খেলতে যায় চান্নু সিং। জুয়াতে মাতলে হুঁশ থাকে না। এক একদিন রাতই কাবার করে ফেলে। জুয়ার নেশা বড় জবর নেশা। কিন্তু আজ ও-ব্যাপারে একেবারেই উৎসাহ নেই। মনের দিক থেকে কোনোরকম তাগিদই পাচ্ছে না চান্নু সিং।
উপসাগরের গর্জন ভেসে আসে। বসন্তের বাতাস এলোপাতাড়ি ছুটে রেন-ট্রিগুলোর ঝুঁটি ধরে ইচ্ছামতো নাস্তানাবুদ করে যায়। আকাশে একটি একটি করে অনেকগুলো তারা দেখা দিয়েছে।
কোনো দিকে খেয়াল নেই চান্নু সিংয়ের।
প্রায় মধ্য রাতে পিয়ারীলালকে সঙ্গে নিয়ে চান্নু সিংয়ের চা-খানায় ফিরে এল মাউ খে।
একমাত্র ফাই মঙ বর্মীর দোকানটা ছাড়া বাকি দোকানগুলোতে লণ্ঠন নিবে গিয়েছে। এবারডিন বাজার এখন গভীর অন্ধকারে ডুবে আছে।
লাফ মেরে উঠে পড়ল চান্নু সিং। বলল, এ শালে মাউ খে, কখন গেছিস আর কখন ফিরলি, হুঁশ আছে? নালায়েক কুত্তা কঁহাকা!
ঝুটমুট গালি দিবি না চান্নু। আগে আমার কথাটা শুনে নে। এখান থেকে পয়লা গেলাম ডিলানিপুরের টাপুতে। গিয়ে দেখলাম পিয়ারীলাল ভেইয়া নেই। সে তখন পাহাড়গাঁওতে। আমিও পাহাড়গাঁও ছুটলাম। সেখান থেকে ধরে আনছি ভেইয়াকে।
দুই হাতে মাউ খেকে জড়িয়ে ধরে চান্নু সিং। বিরাট মাংসল বুকের ওপর তাকে ডলতে থাকে, পিষতে থাকে। ডলতে, ডলতে পিষতে পিষতে সে বলে, তোকে বহুৎ পেয়ার করি। লেড়কী হলে জরুর তোকে শাদি করে ফেলতাম মাউ খে।
মাউ খেকে ছেড়ে দিয়ে এবার ব্যস্ত হয়ে উঠল চান্নু সিং। খাতির করে পিয়ারীলালকে একটা মাচানে বসাল। বলল, নমস্তে পিয়ারীলালজি, দিল তবিয়ত ঠিক হ্যায় তো?
হাঁ, জি।
পিয়ারীলালের অনেক বয়স হয়েছে। তোবড়ানো গাল, কোঁচকানো চামড়া। সমস্ত মুখে সরু সরু কত যে দাগ, তার লেখাজোখা নেই। মনে হয়, একদল মাকড়সা কত কাল ধরে জাল বুনে রেখেছে। মাথার সামনের দিকে বিরাট একটা টাক, চাঁদির ওপর ধবধবে সাদা কয়েক গাছা চুল। এত যে বয়স পিয়ারীলালের, তবু হাতের কবজি মজবুতই আছে। চোখের দৃষ্টি এখনো সতেজ। মাড়ি থেকে একটা দাঁতও আলগা হয়ে যায়নি। চেহারা দেখে পিয়ারীলালের সঠিক বয়স বার করা দুরূহ ব্যাপার।
পঁচিশ তিরিশ বছর আগে কালাপানির এই দ্বীপে কয়েদ খাটতে এসেছিল পিয়ারীলাল। জেল থেকে একেবারে খাঁটি মানুষ হয়ে বেরিয়ে এসেছে সে। মুলুক থেকে আসার সময় চরিত্রে যে-সব দোষ, ত্রুটি এবং খাদ মিশে ছিল, সে-সব ঘুচে গিয়েছে। পিয়ারীলাল এখন সাচ্চা মানুষ। এই একটা মাত্র কয়েদি, যে কোনোদিন কয়েদখানার কানুনের বিরুদ্ধে একটা কথাও বলেনি। মুখ বুজে হুইল ঘানি টেনেছে, রম্বাস ছিচেছে, সড়ক সমান করেছে। যে খানা পেয়েছে, তা-ই খেয়েছে। পেটি অফিসার-টিণ্ডালরা কোনোদিন এমন একটা ছুতো পায়নি যার জোরে পিয়ারীলালকে ঠেঙিয়ে মজা পেতে পারে। সেলুলার জেলের খাতায় কোনোদিন পিয়ারীলালের বিপক্ষে একটা রিপোর্টও ওঠেনি। জেলার, জেল সুপারিন্টেনডেন্ট পিয়ারীলালের ওপর বেজায় খুশি। এত ভালো কয়েদি আন্দামান কোনোদিন আসেনি।
পনেরো বছরের মেয়াদে সাজা খাটতে এসেছিল পিয়ারীলাল। মুখ বুজে সাজা খাটার দামও সে পেল। পুরো তিনটে বছর মকুব হয়ে গেল তার। মোট বারো বছর কয়েদ খেটেই খালাস পেয়ে গেল। সরকার থেকে সেলফ সাপোর্টার্স টিকেট পেয়েছে। তবু শাদি করেনি সে। ডিলানিপুরের টাপুতে থাকে আর সাউথ পয়েন্ট কয়েদখানায় কয়েদিনীদের তাঁত বুনতে শেখায়। মাস গেলে পাঁচ টাকা তলব (মাইনে) পায়। এতেই কোনোরকমে চালিয়ে নেয়। অল্পেই সে তুষ্ট।
বড় খাঁটি মানুষ পিয়ারীলাল। তার শরাবের নেশা নেই, জুয়ার নেশা নেই। টাকার জন্য ফেরেববাজি, ফিকিরবাজি করতে সে জানে না। এজন্য আন্দামানের কয়েদিরা তাকে খাতির করে, সমীহ করে। তারা বলে, পিয়ারীলালজি বড় আচ্ছা আদমী। একেবারে সাধু পীরের সামিল।
পঁচিশ তিরিশ বছর বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে কাটিয়ে দিল পিয়ারীলাল। কথায় বলে সঙ্গগুণে রং ধরে। খুনিয়ারা-জালিয়াত, ঠগবদমাশদের সঙ্গে একত্রে কাটিয়েও তার মনে নতুন রং ধরল না। তার চরিত্রে একটি মাত্র পাকা রং। সেটি হল নিখাদ খাঁটিত্বের। তার। চরিত্র থেকে বদমাইশি, শয়তানি, দুশমনি চিরকালের জন্য মুছে গিয়েছে।
এক পেয়ালা চা বানাল চান্নু সিং। লিকারে প্রচুর দুধ আর চিনি মিশিয়ে ওপরে মালাই ভাসিয়ে দিল। পিয়ারীলালের হাতে পেয়ালাটা দিতে দিতে বলল, ধরুন পিয়ারীলালজি।
পেয়ালায় চুমুক দিয়ে পিয়ারীলাল বলল, আমার সাথ কী দরকার? লোক পাঠিয়ে ধরে আনলি যে?
দুই হাত সমানে কচলাতে থাকে চান্নু সিং। বলে, হেঁ হেঁ পিয়ারীলালজি, আপনি তো। সবই জানেন। সোনিয়ার সাথ আমার শাদি একদম পাক্কা হয়ে আছে। অ্যাদ্দিন শাদিও হয়ে যেত। লেকিন জখম হয়েই তো সোনিয়া সব গড়বড় বাধিয়ে বসল। বহুত দিন সোনিয়ার কোনো খবর পাই না।
পিয়ারীলাল নিচু গলায় বলে, হাঁ—
আপনি যদি একটা বন্দোবস্ত করে—
চান্নু সিংকে কথাটা আর পুরো করতে দিল না পিয়ারীলাল। তার আগেই চায়ের পেয়ালাটা তার নাক বরাবর ছুঁড়ে চিৎকার করে উঠল, শালে উল্লু, বদমাশ! এই জন্যে আমাকে দরকার? উত্তেজনায় তার শরীরটা কাঁপছে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, আমার কাছে মতলববাজি চলবে না। আমি যাচ্ছি। বাইরের দিকে পা বাড়াল পিয়ারীলাল।
পাশের মাচানে বসে পিয়ারীলালের ভাবগতিক একদৃষ্টে লক্ষ করছিল মাউ খে। যখন সে দেখল, সব ছকই প্রায় বানচাল হতে বসেছে, লাফিয়ে নিচে নেমে পিয়ারীলালের দুটো হাত জড়িয়ে ধরল। বলল, গোসা করবেন না পিয়ারীলালজি। আপনি আমাদের বড়ে ভাই।
মাউ খে অতি তুখোড় লোক। যেমন ধূর্ত, তেমনি মতলববাজ। চান্নু সিংয়ের সঙ্গে একই জাহাজে সে দ্বীপান্তরী সাজা খাটতে এসেছিল। চান্নু তার পুরনো দোস্ত। বঙ্গোপসাগরের এইদ্বীপে অনেক বছর এক সঙ্গে কাটিয়েছে মাউ খে আর চান্নু। দুজনের মধ্যে পাকা দোস্তি গড়ে উঠেছে। দোস্তির কারণও আছে।
ভোঁতা, চোয়াড়ে বুদ্ধির চান্নু সিং যখনই কোনো মুশকিলে পড়ে তখনই ধূর্ত মাউ খে পরামর্শ দিয়ে, ফিকির বাতলে সব মুশকিলের আসান্যু করে দেয়। এই কারণেই জবরদস্ত চেহারার চান্নু সিংয়ের সঙ্গে বেঁটেখাটো মাউ খের এত বন্ধুত্ব।
গারাচামারা গাঁও-এ একখানা ঘর ভাড়া করেছে চান্নু সিং। তার দিলে অনেক স্বপ্ন। সোনিয়াকে তার কাছে নিয়ে এসে পাকা সংসারী হয়ে বসবে। তিন শ’ টাকা জমিয়েছে। আর শ’ দুয়েক জমাতে পারলেই এবারডিন বাজারের এই ছোট্ট চা-খানাটাকে বাড়িয়ে একটা মস্ত সরাইখানা বানিয়ে ফেলতে পারবে। কিন্তু গুরুজির ইচ্ছা অন্য। সোনিয়াকে আনতে দিনকয়েক আগে সাউথ পয়েন্ট কয়েদখানায় গিয়েছিল চান্নু। সেখানেই শুনেছিল, সোনিয়া জখম হয়ে সিকমেনডেরায় আছে।
সেদিন সোনিয়াকে আনতে পারেনি চান্নু সিং। কাজেই বড় অস্থির হয়ে আছে। সোনিয়াকে একবার দেখতে পেলেও তার দিল জুড়তো। অনেক ফন্দি এঁটেও সে সুবিধা করতে পারেনি। বারকতক সাউথ পয়েন্ট কয়েদখানার চারপাশে ঘুর ঘুর করে এসেছে চান্নু, সোনিয়ার দেখা মেলেনি। উলটে পাহারাদাররা ডাণ্ডা উঁচিয়ে তাকে অনেকদূর পর্যন্ত তাড়া করে নিয়ে গিয়েছে।
ভেবে ভেবে শেষ পর্যন্ত একটা ফন্দি বার করেছিল মাউ খে। খোঁজখবর নিয়ে সে জেনেছে, পিয়ারীলাল রোজ সাউথ পয়েন্ট কয়েদখানায় কয়েদিনীদের তাঁত বোনা শেখাতে যায়।
মাউ খে অনেক তোষামোদ করেছে পিয়ারীলালকে। তোয়ামুদিতে শেষ পর্যন্ত রাজিও হয়েছিল পিয়ারীলাল। কথা দিয়েছিল, এক রোজ চান্নু সিংয়ের চা-খানায় সে যাবে। দিনকয়েক আগে একবার মাত্র এসেছিল। বলে গিয়েছিল, আবার আসবে। কিন্তু আসেনি।
এর মধ্যে মঙ চোকে দেখবার জন্য কয়েকটা দিন তুষণাবাদের জঙ্গলে গিয়ে ছিল মাউ খে। পিয়ারীলাল আসেনি, মাউ খেরও পাত্তা নেই। এই কটা দিন অদ্ভুত এক অস্থিরতায় কেটেছে চান্নু সিংয়ের। জুয়ার আড্ডায় গিয়ে সুখ হয়নি, শরাব গিলে নেশা জমাতে পারেনি। জিন্দেগীটা কেমন যেন বিস্বাদ, বদখত হয়ে গিয়েছিল। সোনিয়ার খবর না পাওয়া পর্যন্ত তার স্বস্তি নেই, ফুর্তি নেই। তার কাছে সব কিছুই এখন বেতালা, বেখাপ্পা।
পুরনো কথাটা নতুন করে ঝালাতে লাগল মাউ খে, পিয়ারীলালজি, আপনি আমাদের বড়ে ভাই–
তীক্ষ্ণ, সন্দিগ্ধ চোখে একবার মাউ খে, আর একবার চান্নু সিংকে দেখে নিল পিয়ারীলাল। তারপর বলল, কী মতলব তোদের?
না না–কুছ মতলব নেই, জরুর নেই। ডাইনে-বাঁয়ে দু’পাশে প্রচুর মাথা নেড়ে, চোখ ঘুরিয়ে, মাজা বাঁকিয়ে অদ্ভুত অদ্ভুত ভঙ্গি করে মাউ খে। চাণুকে একটা ঠেলা মেরে বলে, তুই বল চামু, আমাদের কোনো মতলব আছে?
কাজ হাসিল করতে হবে। তাই চায়ের পেয়ালার ঘা খেয়েও চুপচাপ মুখ বুজে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে চান্নু সিং। মাউ খের কথাটা কানে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সে জবাব দেয়, না না, জরুর না।
পিয়ারীলাল বলল, তুই আমাকে এখানে ডেকে আনলি কেন?
মাউ খে বলল, আপনি আমাদের বড়ে ভাই। একটা খবর না দিলে ছোটে ভাইদের জান যে খতম হয়ে যাবে।
কী খবর? নীরস গলায় জিজ্ঞেস করল পিয়ারীলাল। তার চোখ দুটো কুঁচকে রয়েছে।
বাপ রে বাপ! পিয়ারীলালজি, আপনার আঁখ দেখলে ডর লাগে। আঁখ একটু মুলাইম করুন, নইলে ছোটে ভাইরা বিলকুল ঘাবড়ে যাবে।
দিল্লাগি করতে হবে না। যা বলার বল–
পিয়ারীলালজি–সমানে দুই হাত কচলাতে থাকে মাউ খে। অনেক টালবাহানার পর বলে, সাউথ পয়েন্টে এক কয়েদানী আছে, তার নাম সোনিয়া। তার–
মাউ খের কথাটা আর শেষ হয় না। তার আগেই চেঁচিয়ে ওঠে পিয়ারীলাল, থাম শালে। সোনিয়ার কথা চান্নু আগেই বলেছে। এ-নিয়ে আর কিছু শুনতে চাই ন।
লেকিন বড়ে ভাই–
কোনো লেকিন নেই। আমি তোর কোন জন্মের বড়ে ভাই রে হারামী! পিয়ারীলাল খেপে ওঠে।
মাউ খে শব্দ করে হাসে। বলে, গালি দিচ্ছেন বড়ে ভাই, দিন গালি। ও তো আপনার মর্জি। লেকিন সোনিয়ার একটা খবর দিন।
পিয়ারীলালকে এবার অনেকটা শান্ত দেখায়। সে বলে, ভেইয়ারা একটা কথা শোন, আমি কানুনের বান্দা। সিরকার আমাকে বিশোয়াস করে রেণ্ডিবারিক কয়েদখানায় কাম দিয়েছে। কয়েদানীদের কথা বাইরের লোকের কাছে বলার হুকুম নেই।
দুই হাতে কপাল চাপড়ায় মাউ খে। বলে, লেকিন বড়ে ভাই, স্রিফ কানুনের বান্দা হয়ে থাকলে তো জিন্দেগী বেচাল হয়ে যাবে। একটু দিলের বান্দা হোন।
কী বলছিস তুই মাউ খে?
বলছি, এই চান্নু আমার দোস্ত। ওর সাথ সোনিয়ার শাদি পাকা হয়ে আছে। সোনিয়ার জন্যে ও গারাচারামা গাঁও-এ কুঠি ভাড়া নিয়েছে। করোজ আগে সোনিয়াকে আনতে রেণ্ডিবারিকে গিয়েছিল চান্নু। কে নাকি সোনিয়াকে মেরে জখম করে ফেলেছে। একটু দম নেয় মাউ খে। তারপর ফের বলতে থাকে, আপনিই বলুন বড়ে ভাই, চান্নুর দিলটা সোনিয়ার জন্যে পাগলা বনে আছে কিনা?
ও তো ঠিক কথা। পিয়ারীলাল মাথা নেড়ে সায় দেয়।
এই হাবরাডিন বাজারে রয়েছে দুলহা আর সাউথ পয়েন্টে রয়েছে দুলহন। লেকিন কারোর সাথ কারোর মুলাকাৎ নেই। আপনিই বলুন বড়ে ভাই, চান্নুর দিলটা বাওরা বনে আছে কিনা?
হাঁ হাঁ, ও তো ঠিক।
তাই একটা কথা বলি পিয়ারীলালজি, স্রিফ কানুনের বান্দা হয় কোনো ফায়দা নেই। একটু দিলের বান্দা হোন। সোনিয়ার খবর বলুন।
পিয়ারীলালকে এবার আরো নরম দেখায়। আস্তে আস্তে সে বলে, সোনিয়া সিকমেনডেরায় আছে। জখমের ঘা শুকোতে আরো পাঁচ দশ রোজ লাগবে। একটু থামে পিয়ারীলাল। হঠাৎ কী যেন তার মনে পড়ে যায়। এবার কিছুটা উত্তেজিত হয়ে ওঠে সে, লেকিন একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না মাউ খে। মনে হচ্ছে জরুর কিছু গড়বড় আছে।
কী গড়বড়?
তুই যেমন সোনিয়ার খবরের জন্যে আমাকে তামাম আন্দামান ছুঁড়ে বার করেছিস, তেমনি আর এক হারামীও সোনিয়ার খোঁজে আমার কাছে এসেছিল।
এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিল চান্নু সিং। কান খাড়া করে পিয়ারীলাল আর মাউ খের কথাবার্তা শুনছিল। আচমকা চিৎকার করে উঠল, সে হারামীটা কে?
পিয়ারীলাল বলল, ভিখন আহীর।
শালের কী মতলব? সোনিয়াকে তার কী দরকার? সোনিয়া আমার আওরত। শালের জান তুড়ে দেব। চান্নু সিং উন্মাদ যেন হয়ে উঠল, কী জন্যে এসেছিল ভিখন আহীর? কী বলল?
ভিখন সোনিয়ার কথা জানতে চাইল। সোনিয়ার সাথ নাকি তার এক দোস্ত লখাইর শাদি ঠিক হয়ে আছে।
লিখাই কুত্তাটা আবার কে?
লখাই এক কয়েদি। এখন সে ফরেস্টের কাজে তুষণাবাদে আছে।
ওয়া গুরুজিকা ফতে! চান্নু সিং স্তব্ধ রাত্রির এবারডিন বাজারটাকে চমকে দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে। তারপর একদমে শখানেক বাছা বাছা অশ্রাব্য খিস্তি আউড়ে বলে, লখাই শালের জান তুড়ব।
পিয়ারীলাল জবাব দিল না।
চান্নু আবার বলল, আপনি লখাইকে চেনেন পিয়ারীলালজি?
না।
পিয়ারীলালের পাশে উবু হয়ে বসে রয়েছে মাউ খে। লখাইর নাম শুনেই সে চমকে উঠেছিল। যেটুকু সন্দেহ ছিল, তুষণাবাদের নাম শুনে সেটুকুও ঘুচল। এবার সে বলল, আমি চিনি লখাইকে। তুষণাবাদের জঙ্গলে সে জবাবদার।
চান্নু বলল, সচ্?
মাউ খে বলল, সচ্।
পিয়ারীলাল চলে গিয়েছে।
এখন কত রাত, কে তার হদিস দেবে। গ্যাসের বাতি দুটোর চারপাশে বাড়িয়া পোকাগুলো সমানে ঘুরপাক খাচ্ছে। উপসাগরের গর্জন ক্ষীণ হয়ে হয়ে এবারডিন বাজার পর্যন্ত এসে পৌঁছচ্ছে। এতক্ষণ আকাশটা পরিষ্কার ছিল। এতটুকু মেঘের চিহ্নমাত্র চোখে পড়ে নি। এই মুহূর্তে কোত্থেকে যেন বিরাট এক টুকরো মেঘ সেখানে হানা দিতে শুরু করেছে।
বাঁশের মাচানে দুটো মূর্তি ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে থাকে। চান্নু সিং আর মাউ খে।
এখন দুপুর।
জঙ্গলের দিকে থেকে পুরো একটা টহল মেরে ‘বীটে’ ফিরে এল লখাই। ‘বীটে’র সামনে খানিকটা জায়গা সাফ করে ফেলা হয়েছে। হাত-পা ছড়িয়ে সেখানে বসে পড়ল সে।
খানিকটা দূরে কুলিরা জঙ্গল পোড়াচ্ছে। চাপ চাপ ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকাতে পাকাতে আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে।
ডাইনে-বাঁয়ে, সামনে-পেছনে, চারপাশে তাকাল লখাই। সব দিকেই অরণ্য জটিল হয়ে আছে। এই অরণ্যে পৃথিবীর আলো ঢোকে না, মানুষের নজর চলে না।
দক্ষিণ আন্দামানের এই জঙ্গল কবে যে মাটি খুঁড়ে প্রথম মাথা তুলেছিল, সে-সম্বন্ধে এতটুকু মাথাব্যথা নেই লখাইর। আসলে এখানকার কোনো ব্যাপারই তাকে নাড়া দেয় না। তুষণাবাদের এই ‘বীটে’র সামনে বসে সেই লোকটার কথাই ভাবছে লখাই।
সেই লোকটা ছিল এক ওস্তাদ কালোয়াত। লখাইর সঙ্গে এককালে তার খুবই খাতির জমেছিল। সে প্রায়ই বলত, বুঝলি লখাই, এই জীবনটা কালোয়াতী গানের জলদ একটা রেলার মতো। একটু বেসুরা, বেতালা হবার জো নেই।
আন্দামান আসার আগে লখাইর মনে হত, এমন একটা খাঁটি কথা কোনোদিন সে শোনেনি। কথাগুলোর ওপর তার অদ্ভুত এক বিশ্বাস ছিল। বিশ্বাস হয়তো ঠিক নয়, এক ধরনের অন্ধ মোহ ছিল।
আন্দামান আসার আগে চরসে-মদে নারী মাংসে, শয়তানি-দুশমনি-রাহাজানি, দুনিয়ার তাবত নেশায় আকণ্ঠ ডুবে থেকে তার মনে হত, জীবনটা সত্যিই কালোয়াতী গানের জলদ রেলাই বটে। কোনোমতেই এতটুকু বেতালা, বেখাপ্পা কী বেসুরো হওয়ার উপায় নেই।
লখাইর জীবন চড়া একটা পর্দায় বাঁধা ছিল। আন্দামান আসার পর সব ব্যাপারেই তাল কাটতে শুরু করেছে। এখানে না মেলে মেয়েমানুষ, না করা যায় চুটিয়ে নেশা।
আদিম বর্বরেরা নিজেদের প্রবৃত্তিগুলোকে খুশি করতে না পারলে যেমন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, প্রথম প্রথম লখাইও তেমনি খেপে উঠত। এখন আর লখাই ক্ষিপ্ত হয় না। খ্যাপামির বদলে তার মনে অদ্ভুত এক নিরাসক্তি দেখা দিয়েছে।
যে কটা দিন সেলুলার জেলে ছিল, মোটামুটি একরকম কেটে গিয়েছে। নানা জাতের, নানা ধাতের, নানা চেহারার, নানা বুলির বিচিত্র সব কয়েদি এবং তাদের আজব আজব কাণ্ডকারখানা দেখতে মন্দ লাগত না।
কিন্তু তুষণাবাদের জঙ্গল বড় অদ্ভুত।
এতকাল লখাইর ধারণা ছিল, নারী আর নেশার একটি মাত্র খাত ধরেই জীবন বয়ে চলে। অন্তত চলা উচিত। এই জঙ্গলে এসে জীবন সম্বন্ধে পুরনো ধারণাটা বদলাতে শুরু করেছে। আজকাল মনে হয়, জীবন শুধু কালোয়াতী গানের রেলার মতো জলদই নয়, মাঝে মাঝে তার গতি খুবই ঢিমে, মন্থর। এক-এক সময় জীবনের গতি আদৌ থাকে কিনা, লখাই সঠিক বুঝে উঠতে পারে না।
আন্দামানের এই অরণ্যে নারী, নেশা, পৃথিবীর সব সুখ, সব উত্তেজনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে রয়েছে লখাই। এখানে সাথী বলতে জনকতক রাঁচি কুলি, দুএক জন ফরেস্ট গার্ড, একজন জবাবদার, জন দুই জমাদার। আর অরণ্যের প্রান্ত ঘেঁষে আছে একটা বুশ পুলিশ ক্যাম্প। সেখানে থাকে জন কয়েক বর্মী পুলিশ, দুজন জমাদার, একজন হাবিলদার। মোট চল্লিশটা প্রাণী। আর চারপাশ ঘিরে আছে দক্ষিণ আন্দামানের আদিম অরণ্য–দুর্ভেদ্য, নিরালোক, ভয়ঙ্কর।
সারাটা দিন তবু একরকম কাটে। হই হই করে জঙ্গল সাফ করতে, জবাবদারি করতে, কুলি খাটাতে মোটামুটি খারাপ লাগে না। কিন্তু রাতগুলো আর কাটতে চায় না। সারা রাত জারোয়াদের ভয়ে বুশ পুলিশ ক্যাম্পে ডিম ডিম শব্দে টিকারা বাজে। তুষণাবাদের এই অরণ্যের ওপর তখন অদ্ভুত, অশরীরী এক ত্রাস ভর করে বসে। টিকারার শব্দ জঙ্গলের বাইরে বেরুবার পথ পায় না। অরণ্য সেই শব্দকে গ্রাস করে ফেলে।
অবস্থা যখন এইরকম, যখন দুর্বহ একটা বোঝার মতো জীবনটাকে টেনে হিঁচড়ে ঢিমে তালে চালিয়ে যাচ্ছিল লখাই, যখন নারী-নেশা-খুনখারাপি ইত্যাদি পৃথিবীর যাবতীয় উত্তেজনার স্বাদ বিলকুল ভুলতে বসেছিল, তখন ফরেস্ট অফিসার উজাগর সিংয়ের দেখা মিলল।
বিচিত্র মানুষ উজাগর সিং।
লখাইর মনে হল, মন্থর জীবনে আচমকা অন্ধ উন্মাদ বেগ বইয়ে দিয়েছে সে।
নানা ভাবনা লখাইর মাথায় দলা পাকাচ্ছে।
এখন দুপুরটা জ্বলছে। আকাশটাকে পেটানো তামার পাতের মতো দেখায়। জঙ্গলের মাথা জ্বলছে। আকাশে আটকে-থাকা সাগরপাখিগুলো বুঝি পুড়েই যাবে।
লখাই, এ লখাই–পেছনের কোনো একটা ঝুপড়ি থেকে জড়ানো গলায় কে যেন ডেকে উঠল।
লখাই চমকে ওঠে। চনমন করে এদিকে সেদিকে তাকায়। ডাকটা ঠিক কোত্থেকে আসছে, বোঝা যাচ্ছে না।
স্বরটা এবার আর এক পর্দা চড়ল, এ শালে কুত্তীকা বাচ্চে, গাদ্ধেকো পাটঠে, এই যে ইধর–
খিস্তির নমুনাতেই বোঝা গেল, লোকটা ফরেস্ট অফিসার উজাগর সিং।
হাঁ, জি–এবার একরকম লাফ মেরেই উঠে পড়ল লখাই। খুঁজে খুঁজে উজাগর সিংয়ের ঝুপড়িতে এসে ঢুকল।
দিবারাত্রি শরাব গেলে উজাগর। সকাল থেকে এ-পর্যন্ত মোট দুটো বোতল ফাঁকা করে ফেলেছে। পেটি থেকে আরো একটা বোতল বার করেছে। বোতলটার মুখ এখনও কাটা হয়নি। সেটাকে একবার ওপরে ছুঁড়ে দিচ্ছে, আবার লুফে নিচ্ছে। শরাবের বোতল নিয়ে লোফালুফি খেলছে উজাগর সিং।
এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল লখাই। একটা হাত ধরে টেনে তাকে নিজের পাশে বসিয়ে দিল উজাগর। জড়ানো গলায় বলল, বস, বস ইয়ার।
খানিকটা চুপচাপ।
লোফালুফি থামিয়ে কামড়ে কামড়ে বোতলের ছিপিটাকে কেটে ফেলল উজাগর। তারপর সেটা গলার ভেতর উপুড় করে দিল। আধাআধি শেষ করে কামিজের খুঁট দিয়ে মুখ মুছে লখাইর দিকে তাকাল সে। অনেকটা সময় ধরে লখাইর মুখে কী যেন দেখতে লাগল।
একসময় উজাগর বলল, আজই আমি পোর্ট প্লেয়ার ফিরে যাব।
হাঁ, জি।
এখানে আমার কাম খতম হয়েছে।
হাঁ, জি।
দিন দশেক তুষণাবাদের এই ‘বীটে’ রয়েছে উজাগর সিং। কেমন করে জঙ্গল ‘ফেলিং’ হবে, কোন গাছ কাটা চলবে, কোনটা চলবে না, ফরেস্ট গার্ড এবং জবাবদারদের ঠিকমতো বুঝিয়ে দিয়েছে। এখানকার কাজ তার শেষ।
উজাগর সিং আবার শুরু করল, আমার নসিব বড় আচ্ছা। জঙ্গলে তোর মতো সাথী না পেলে জিন্দেগী বেকার হয়ে যেত।
লখাই জবাব দেয় না।
উজাগর আপন খেয়ালেই বলে যায়, আজই আমি চলে যাব লখাই। যাওয়ার আগে তোকে দু চারটে কথা বলতে চাই। এই জঙ্গলে তুই সাচ্চা দোস্তের কাম করেছিস। রোজ রাতে তুই পথ দেখিয়ে মিমি খিনের কুঠিতে না নিয়ে গেলে জরুর মরে যেতাম। তুই আমার আসলী ইয়ার।
মাথা নেড়ে লখাই সায় দেয়, হাঁ, জি–
একটু নড়েচড়ে বসে উজাগর সিং। তার বিপুল ভুঁড়িটা দোল খায়। লখাইকে নিজের দিকে সামান্য টেনে এনে বলে, আরে ইয়ার, কাছে তো এস। দূর থেকে কি দিলের কথা হয়?
দুজনে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে।
উজাগর বলতে থাকে, জিন্দেগীভর হামেশা সব লোককে আমি একটা কথাই বলেছি লখাই। কথাটা কী বল দিকি?
কিছুক্ষণ জবাবের অপেক্ষায় থাকে উজাগর সিং। কিন্তু না, লখাইর উত্তর মেলে না।
এবার খুব একচোট খিস্তি করে উজাগর সিং, নালায়েক, বুদ্বু, বুরবক। হরবখত কথাটা বলছি, দুটো মোটে কথা। উল্লু, হারামী কঁহাকা, কথা দুটো মগজে রাখতে পারছিস না! আরে কুত্তা, এ জিন্দগী এক রং-তামাশাকা খেল। এই আছে, এই নেই। ঠিক কিনা?
ভয়ে ভয়ে লখাই বলে, হাঁ, জি–
এই দশ দিনেই উজাগরের ধাত মোটামুটি বুঝে নিয়েছে লখাই। কখন, কোন কথায়, জবাবের একটু হেরফেরে সে খেপে উঠবে, আগে থেকে বুঝবার জো নেই। তাই সবসময় তটস্থ হয়ে থাকে লখাই। পারতপক্ষে কিছু বলে না। খুব হুঁশিয়ার হয়ে দু চারটে হা, জি না, জিতেই কাজ চালিয়ে নেয়। উজাগর-চরিত বড় বিচিত্র বস্তু।
উজাগর বলল, হামেশা যে কথাটা বলি, সেটাই আবার বলছি। বুঝলি নালায়েক, কথাটা যে–কদিন বাঁচবি, ইয়াদ রাখবি। এ-জিন্দেগীর আয়ু দু দশ বোজ। তাই কোর্স পরোয়া নেই। ফুর্তিফার্তা আওরত শরাবে নিজেকে ডুবিয়ে রাখবি।
উজাগর সিংয়ের জীবন দর্শনের ওপর অটুট শ্রদ্ধা লখাইর। উজাগর সিংয়ের জীবনবোধ আর তার জীবনবোধ হুবহু এক। উজাগর সিং জীবনটাকে যে পদ্ধতিতে ভোগ করতে চায়, সে-ব্যাপারে পুরোমাত্রায় সমর্থন আছে লখাইর।
উজাগর সিংয়ের ভাবনাচিন্তার ওপর শ্রদ্ধা, আস্থা, সমর্থন–সবই তো আছে। কিন্তু দক্ষিণ আন্দামানের এই নিদারুণ জঙ্গলে জীবনকে উজাগর সিংয়ের নিয়মে ভোগ করার উপায় কী? সুযোগ কোথায়? ভাবতে ভাবতে মাথা গরম হয়ে ওঠে লখাইর। কপালের দু পাশে দুটো অবাধ্য রগ সমানে লাফাতে থাকে।
উজাগর ডাকে, এ লখাই—
হাঁ, জি—
এই জঙ্গলে তুই না থাকলে দশটা রোজ বিলকুল বরবাদ হয়ে যেত। তোকে পেয়েছি বলেই ফুর্তিটা জমাতে পেরেছি।
হাঁ, জি।
দ্যাখ লখাই, আজই আমি এখান থেকে চলে যাব। বলে একটু দম নেয় উজাগর সিং। হাতের আধাশূন্য বোতলটাকে গলায় ঢুকিয়ে বাকিটুকু শেষ করে ফেলে। তারপর শুরু করে, আজই যাব। লেকিন যাওয়ার আগে তোকে তিনটে বকশিশ দিয়ে যাব।
হাঁ, জি উজাগর সিং বলে, আন্দাজ কর দিকি লখাই, কী কী পাবি?
হাজার চেষ্টা করেও লখাই বুঝে উঠতে পারে না, তাকে কী দিতে চায় উজাগর সিং। কিছুই বলে না সে। অবাক হয়ে উজাগরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
উজাগর সিং শয়তানি চালে শব্দ করে হাসে। হাসির দাপটে তার চোখ দুটো বুজে যায়। হাসতে হাসতেই সে বলতে থাকে, তোকে লায়েক বানাতে পারলাম না লখাই, বুছুই রয়ে গেলি। উজবুক কাহাকা!
সস্নেহে লখাইর পিঠে এলোপাতাড়ি চাপড় মারতে মারতে উজাগর ফের বলতে থাকে। এবার তার গলাটা অনেকখানি খাদে ঢুকে যায়, বুঝলি উল্লু, তিন বোতল বিলাইতি শরাব তোকে দেব।
সত্যি বলছেন অফসর সাহিব? লখাইর চোখ দুটো চকচক করতে থাকে।
সচ্ না তো ঝুট না কি রে শালে! উবু হয়ে কাঠের পেটি থেকে তিনটে বোতল বার করে উজাগর লখাইর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, এই লে।
উজাগরের হাত থেকে বোতল তিনটে একরকম ছিনিয়েই নেয় লখাই।
এবার হাতড়ে হাতড়ে কামিজের পকেট থেকে একটা পাঁচ টাকার নোট বার করল উজাগর। লখাইর হাতে সেটা গুঁজে দিয়ে বলল, রুপেয়া আউর শরাব–দুটো চীজ তোকে দিলাম। আউর একটা চীজ দেব।
কী?
এখন বলব না। পরে দেব।
জি।
আন্দামানের আকাশে কোথা থেকে যেন ঝাঁকে ঝাঁকে বগেড়ি পাখি এসে পড়েছে। পাখিগুলি বেজায় খুশিতে বাতাসে ডিগবাজি খায়। শুধু কি বগেড়ি, তিতির গোয়েলেথ বনটিয়া চড়ুইকত পাখিই না এসেছে। ছোট ছোট পাখি। ছোট ডানা, নরম পালক, তুলতুলে হালকা দেহ।
এখন বিকেল।
আজকাল বেলা থাকতে থাকতেই কুয়াশা পড়ে। হিমের সাদা চিকন একটি পর্দা জঙ্গ লটাকে কেমন যেন দুজ্ঞেয় করে তোলে।
‘বীটে’র সামনে কুলি-জবাবদার-জমাদার-ফরেস্ট গার্ডরা কাতার দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
এখনই ফরেস্ট অফিসার উজাগর সিং রওনা হবে। ব্যবস্থা হয়েছে, পোর্ট মোয়াটের সড়ক পর্যন্ত শরাবের পেটি, বিছানা এবং পেটরা বয়ে নিয়ে যাবে লখাই। সেখান থেকে মোষের গাড়িতে পোর্টব্লেয়ার ফিরে যাবে উজাগর সিং।
উজাগর রওনা হল। মালপত্র মাথায় চাপিয়ে পিছু পিছু চলল লখাই।
প্রথমেই একটা হাওয়াই বুটির ঝোঁপ পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকল দুজনে। পায়ে পায়ে গুঁতো এবং মাথায় টক্কর খেতে খেতে চলেছে তারা।
জঙ্গলের ভেতর থেকে আকাশ দেখা যায় না। ডালপালা এবং পাতায় মাথার ওপরে। নিরেট একটা ছাদ হয়ে রয়েছে। সেই ছাদ ফুঁড়ে পৃথিবীর আলো ঢোকে না।
জঙ্গলের মধ্যে হিম হিম, কালো ছায়া। পায়ের নিচে সঁতসেঁতে পিছল মাটি। সে-মাটিতে একমাত্র সরীসৃপই জন্মায়। হিলহিলে দেহ নিয়ে এঁকেবেঁকে শিকারের খোঁজে তারা ঘুরে বেড়ায়। তাদের চোখে ফসফরাস জ্বলে। সরীসৃপের জ্বলন্ত চোখ ছাড়া এই আদিম অরণ্যে আর কোনো আলো নেই।
পোকামাকড়ের কামড় খেতে খেতে, জোঁকের পেটে তাজা রক্তের খাজনা দিতে দিতে কখনো গুঁড়ি মেরে, কখনো উবু হয়ে দুজনে চলেছে।
শেষ পর্যন্ত পোর্ট মোয়াটের সড়কে এসে পৌঁছয় তারা।
জঙ্গলের ওপারে সূর্যটা কতক্ষণ আগে যে নেমে গিয়েছে, কে তার হদিস দেবে। সড়কের দু’পাশে হাওয়াই বুটির ঝোঁপ। ঝোঁপের ভেতর এখন ঝিঁঝিদের একটানা বিষয় বিলাপ শুরু হয়েছে।
দেখতে খেতে রাত নেমে যায়।
আকাশের এক মাথা থেকে আর এক মাথা পর্যন্ত কেউ যেন আলকাতরার পোঁচ টেনে দিয়েছে।
পোর্ট মোয়াটের সড়কে উঠে উজাগর সিং বলল, আজ আর ফিরব না লখাই। এখানেই রাত হয়ে গেল। পোর্ট ব্লেয়ার পৌঁছতে পৌঁছতে রাত কাবার হয়ে যাবে। তা ছাড়া দিল বলছে, রাতটা এই পুটমুটেই (পোর্ট মোয়াট) কাটিয়ে যাই। বলে বিকট শব্দে হেসে উঠল উজাগর সিং।
লখাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
উজাগর আবার বলল, কোঈ পরোয়া নেই। আও ইয়ার, আমার পিছু পিছু আ যাও। উজাগর পা ফেলছে আর বিড় বিড় করে সমানে বকছে, কোঈ পরোয়া নেই। দুনিয়া লুটেগা, মজা করেগা, ফুর্তি করেগা—
পোর্ট মোয়াটের চৌধুরির নাম মঙ ফা।
বড় সড়ক থেকে নেমে কয়েক পা গেলেই মঙ ফা’র ঝুপড়ি মেলে।
উজাগর সিং সড়ক থেকেই চিল্লাতে লাগল, মঙ ফা, মঙ ফা রে–
হাঁ জি–লণ্ঠন হাতে একটা মধ্যবয়সী বর্মী বেরিয়ে এল। বলল, সেলাম, সেলাম অফসরজি, আইয়ে–
মঙ ফা’র ঝুপড়িতে আগে ঢুকল উজাগর সিং। লটবহর নিয়ে লখাইও ঢুকল।
ঝুপড়িটার সামনে ঢাকা বারান্দা। বারান্দায় বাঁশের পাটাতন, বাঁশের মাচান। মাল নামিয়ে মাচানের ওপর জাঁকিয়ে বসল লখাই।
দশ দিন ধরে সমানে উজাগর সিংয়ের সঙ্গে মঙ ফা’র ঝুপড়িতে এসেছে লখাই। এই মাচানটার ওপর কখনো শুয়ে, কখনো বসে, বাড়িয়া পোকা আর মশায় অবিরাম উৎপাত সয়ে পুরো দশটা রাত কাটিয়ে দিয়েছে। তারপর সকালে কুয়াশা আর অন্ধকার ছিঁড়ে খুঁড়ে যখন জঙ্গলের মাথায় লাল ছোপ ধরতে থাকে, তখন উজাগর সিংয়ের সঙ্গে তুষণাবাদের ‘বীটে’ ফিরে গিয়েছে।
একমাত্র মঙ ফা ছাড়া এই ঝুপড়ির আর কাউকেই চেনে না লখাই। ঝুপড়ির ভেতরেও সে ঢুকে দেখেনি। দশটা রাত বাইরের এই বারান্দায় বসেই কাটাতে হয়েছে তাকে।
অন্য অন্য দিন যেমন হয়, আজও তার ব্যতিক্রম হল না।
উজাগর সিং বলল, তুই এখানে বসে বসে আরাম কর লখাই। একটু পর মঙ ফা খানা দিয়ে যাবে। সুবেতে আবার মুলাকাত হবে।
ঝুপড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল উজাগর সিং। তার পিছু পিছু মঙ ফা। আর মাচানের ওপর অদ্ভুত আক্রোশে লখাইর চোখজোড়া জ্বলতে লাগল।
যাওয়ার সময় মঙ ফা লণ্ঠনটা নিয়ে গিয়েছে। অন্ধকারে বসে রয়েছে লখাই। ঝুপড়ির ঝাঁপটার দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে।
উজাগর সিং আর মঙ ফা ভেতরে ঢুকবার সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
বাইরে থেকে বোঝা যায়, ঝুপড়ির ভেতর লণ্ঠন জ্বলছে। চেরা বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে অল্প অল্প আলো আসছে। হঠাৎ মনে হল, ভেতরে চাপা গলায় ফিশ ফিশ করে কারা যেন কথা বলছে। কান খাড়া করে বসল লখাই। কিন্তু না, একটি বর্ণও বোঝা যাচ্ছে না।
এবার চারপাশ খুব ভাল করে দেখে নিল লখাই। না, কোথাও কেউ নেই। নিঃসন্দেহ হয়ে গুটি গুটি পায়ে বেড়ার গায়ে চোখ রাখল। কিন্তু বেড়ার এমন ফাঁক নেই যার মধ্য দিয়ে মানুষের নজর চলে।
কিছুই দেখা গেল না। অগত্যা হতাশ হয়ে আবার মাচানে ফিরে এল লখাই।
দশটা রাত ঝুপড়ির বাইরে এই মাচানটার ওপর বসে বসেই কাটিয়ে দিয়েছে লখাই। ঝুপড়ির ভেতরের রহস্য সে জানে না। তবে সে আন্দাজ করতে পারে, ঝুপড়িটার ভেতর অনেকগুলো ছোট ছোট খুপরি আছে।
উজাগর সিংয়ের মুখে মিমি খিনের অনেক কিস্সাই শুনেছে লখাই। কিন্তু তাকে এখন পর্যন্ত দেখেনি। মেয়েটাকে কেমন দেখতে, তার মেজাজ কেমন, ভাবতে চেষ্টা করল সে। হাজার চেষ্টা করেও মনের মধ্যে মিমি খিনের একটা পছন্দসই চেহারা খাড়া করতে পারে না। আর এই না-পারার জন্যই মেজাজটা ভীষণ বিগড়ে যায়।
রাত যত বাড়ছে, মশা আর বাড়িয়া পোকাদের উৎপাতও ততই বেড়ে চলেছে।
আরো খানিকটা পর মঙ ফা এল। তার এক হাতে লণ্ঠন, অন্য হাতে কাঠের থালা। থালায় ডেলা পাকানো খানিকটা ভাত, চিংড়ি মাছ ভাজা, আস্ত একটা পেঁয়াজ আর লাল টকটকে কিছুটা মাংসের সুরুয়া।
অন্য রাতগুলোর মতো একটি কথাও বলল না মঙ ফা। কাঠের থালা আর লণ্ঠনটা লখাইর পাশে নামিয়ে রেখে ঝুপড়ির মধ্যে ঢুকে ঝপ এঁটে দিল।
কিছুক্ষণ বন্ধ ঝাঁপটার দিকে তাকিয়ে থাকে লখাই। তারপর কে জানে কেন হঠাৎ খেপে ওঠে। থালাটা তুলে গায়ের সমস্ত শক্তিতে বাইরে ছুঁড়ে দেয়।
প্রায় সারাটা রাত বাড়িয়া পোকা আর মশাদের জ্বালায় একটুও ঘুমোতে পারেনি লখাই। জেগে জেগেই রাত কাবার করে এনেছে।
শেষ রাতের দিকে তাকাতে পারছিল না সে। চোখের পাতাদুটো যেন দু টুকরো ভারী পাথর হয়ে গিয়েছে।
দুই হাঁটুর ফাঁকে মাথাটা গুঁজে লখাই ঢুলছিল। আচমকা ঘাড়ের কাছে ঝাঁকুনি খেয়ে ধড়মড় করে উঠল, কে, কে?
আ বে আমি। সকাল হয়ে গিয়েছে, এখনও শালে নাক ডাকাচ্ছিস!
সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে উজাগর সিং। চোখ দুটো ডলে জঙ্গলের দিকে তাকাল লখাই। দেখল, কুয়াশা আর অন্ধকার কেটে গেছে। দেখা দিয়েছে দিনের প্রথম রোদ।
উজাগর আবার ডাকল, এ লখাই–
হাঁ, জি—
শালে আমি এখন পোর্ট ব্লেয়ার ফিরব। যাবার আগে তোকে আখেরী বকশিশটা দিয়ে যাব। আয় আমার সাথ।
উজাগরের পিছু পিছু ঝুপড়ির ভেতর ঢুকল লখাই। বাইরের মাচানে বসে লখাই যা আন্দাজ করেছিল, সেটা হুবহু মিলে যাচ্ছে। ভেতরে ঘোট ঘোট খান পাঁচেক খুপরি। এখানে ছেঁড়া ছেঁড়া, আবছা অন্ধকার। চারপাশ থেকে নাপ্পি, আধা শুকনো গোসাপের চামড়া এবং শুঁটকি মাছের দুর্গন্ধ ঝুপড়ির বাতাসকে ভারী করে তুলেছে। বেড়ার গায়ে বাঁকানো বর্মী দা আর টাঙি ঝুলছে।
শেষ খুপরিটায় এসে ঢুকল উজাগর সিং আর লখাই।
একটা বাঁশের মাচানের ওপর জাঁকিয়ে বসল উজাগর সিং। বলল, শরাব আর রুপেয়া আগেই দিয়েছি। এই আমার আখেরী বকশিশ–বলে ওপাশের একটা মাচানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল সে।
বাইরের আলো থেকে ঝুপড়ির অন্ধকারে এসেছে লখাই। চোখে কেমন ধাঁধা লাগছে। আস্তে আস্তে অন্ধকারটাকে সইয়ে নেওয়ার পর যা দেখল, তাতে মেরুদণ্ডের ভেতর দিয়ে। একটা চমক খেলে গেল।
উজাগর বলল, এই হল মিমি খিন, এই লেড়কীটাকে তোকে দিলাম।
লখাই দেখল, ওপাশের মাচানটার ওপর একটা বর্মী মেয়ে হাঁটুর ফাঁকে মুখ গুঁজে ফুলে ফুলে কাঁদছে। তার দেহটা থর থর কাঁপছে।
উজাগর সিং বলল, এ মিমি খিন। মুখ তোল—
মিমি খিন মুখ তুলল না। ভাঙা ভাঙা, আবছা অদ্ভুত স্বরে বলতে লাগল, এখন তুমি যাও পাঞ্জাববালা। তোমার কাম তো মিটেছে।
কান্নাকাটি আদৌ পছন্দ করে না উজাগর সিং। ভারি খারাপ লাগে। অথচ সে এলেই মেয়েটা কাঁদতে শুরু করে। যতক্ষণ সে এখানে থাকে, মিমি খিনের কান্না থামে না। ধমকে, গালি দিয়ে, আদর করে বা ডর দেখিয়েও কান্নাটা থামাতে পারে না উজাগর সিং। উজাগর বুঝেই উঠতে পারে না, জোয়ানী মেয়েমানুষ খালি যদি কাঁদেই, তাদের মতো তুখোড় ফুর্তিবাজের চলে কেমন করে?
মিমি খিনের পিঠে একটা হাত রেখে বোঝাতে চেষ্টা করল উজাগর সিং, আ রে মুরুখ জেনানা, কাঁদছিস কেন? কেঁদে কোন ফায়দা? এ জিন্দেগীর আয়ু তো দু চার রোজ। কেঁদেই জিন্দেগী ফৌত করে ফেলতে চাস? কাঁদবিই যদি তো দুনিয়ায় এসেছিলি কেন? জানিস না, দুনিয়ায় কত মজা, কত ফুর্তি, কত রং-তামাশার খেল? ফুর্তি কর জেনানা।
তুম যাও।
এতক্ষণ কাঁপা কাঁপা, ভাঙা গলায় টেনে টেনে কাঁদছিল। হাঁটুর ফাঁকে মুখ গোঁজা ছিল। সাঁ করে মুখটা তুলে কাতর, তীব্র গলায় ককিয়ে উঠল মিনি খিন, তুম যাও। তার পরেই ঘাড় ভেঙে দুই হাঁটুর ফাঁকে আবার মাথাটা গুঁজে দিল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেই লাগল।
এক মুহূর্তের জন্যই মিমি খিনের মুখটা দেখেছে লখাই। আর দেখেই চমকে উঠেছে। মিমি খিনের মুখের ঘাঁদ আর দশটা বর্মী মেয়ের মতো নয়। মাজা শ্যামলা রং। সুঠাম নাক, টানা টানা দু’টি শান্ত চোখ। সারা রাত বোধহয় কেঁদেছে মেয়েটা। তাই চোখ ফুলে রয়েছে। হঠাৎই লখাইর মনে হল, কালকের রাতটাই শুধু নয়, দশটা রাত ধরেই সমানে কাঁদছে সে। দশট রাতই কি শুধু, কত রাত যে কেঁদে কেঁদে পার করে দিয়েছে মিমি খিন, কে তার হিসাব দেবে।
সুঠাম নাক, মাজা শ্যামলা রং, টানা টানা শান্ত দু’টি চোখ–সব মিলিয়ে বড় বিষণ্ণ বড় করুণ একটি মেয়ে। লখাই ভাবতে চেষ্টা করল, কোথায় কবে যেন অবিকল এই রকম আরো একটি মুখ দেখেছে, কিন্তু এই মুহূর্তে কিছুতেই মনে করতে পারল না।
লখাইর জীবনে উজাগর সিংয়ের ভূমিকা শেষ হল।
রামপিয়ারীর হাতে জখম হয়ে বেশ কিছুদিন জেল হাসপাতালে কাটাতে হল সোনিয়াকে। এখনো পুরোপুরি সেরে ওঠেনি। তবে ঘা অনেকটা শুকিয়ে এসেছে। দিন দুই হল হাসপাতাল থেকে ছাড়াও পেয়েছে সে।
ঘা সেরে এলেও আর একটা উপসর্গ দেখা দিয়েছে। তলপেটের সেই যন্ত্রণাটা সাঙ্ঘাতিক বেড়ে গিয়েছে।
এখন বিকেল।
আকাশে একদল মৌসুমি মেঘ দেখা দিয়েছে। টুকরো টুকরো মেঘগুলি এতক্ষণ ছন্নছাড়ার মতো বাতাসের খেয়ালে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ কী হল, তারা সব একসঙ্গে মিলেমিশে আকাশের পশ্চিম কোণটাতে জমাট বেঁধে গেল। অল্প সময়ের মধ্যে আকাশের চেহারা ভীষণ বদলে যেতে লাগল।
জোট বেঁধে এক ঝাঁক সাগরপাখি উড়ে বেড়াচ্ছিল। আচমকা আকাশের চেহারা দেখে ভয়, পেয়ে তারা কোন দিকে যে উড়ে পালাল, সোনিয়া বলতে পারবে না।
পশ্চিম কোণে নিরেট মেঘের স্তূপটাকে দেখলে মনে হয়, যে-কোনো মুহূর্তে বেশ ঘটা করেই মারাত্মক একটা কিছু শুরু হয়ে যাবে।
সোনিয়া কিছুই দেখছিল না। মেঘ, আকাশ, সাগরপাখি–কোনো কিছুই তার মনটাকে ছুঁতে পারছে না। একদৃষ্টে দরজার দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে। চোখের তারা দুটো অস্বাভাবিক চকচকে। মনে হয়, জ্বলছে।
অনেকক্ষণ তাকিয়ে রয়েছে সোনিয়া। কিন্তু না, রামপিয়ারী এখনো এল না। অন্য অন্য দিন এই সময় তো সে এসে পড়ে।
সোনিয়া অস্থির হয়ে উঠল।
ঠিক বিকাল বেলা, যখন সিসোস্ট্রেস উপসাগরে ছোট ছোট ঢেউয়ের ঘা লেগে সোনালি রোদ ভেঙে যেতে থাকে, ঠিক তখনই তলপেটটা চিন চিন করে ওঠে সোনিয়ার। প্রথমে চিন চিন করে, তারপর সেই ব্যথাটা বাড়তে বাড়তে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। শক্ত, নিরেট একটা মাংসের ডেলা নরম তলপেটটাকে ডলে মুচড়ে ওঠানামা করে। সোনিয়ার মনে হয়, দেহ থেকে পেটের ওই অংশটা আলগা হয়ে খসে পড়বে। আর ঠিক তখনই আসে রামপিয়ারী।
সোনিয়াকে জখম করে হাসপাতালে এনে আফিমের নেশা ধরিয়ে দিয়েছে রামপিয়ারী। বিকেলে তলপেটের ব্যথাটা যখন সোনিয়াকে কাবু করে ফেলতে থাকে, সেই সময় একটু আফিম দেয়। আফিমের নেশায় কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থাকে সোনিয়া। নেশার ঘোরে তলপেটের সেই ব্যথার কথা মনে থাকে না। আফিমের নেশা ব্যথার বোধটাকে ভোতা করে ফেলে।
বিকেল হলেই আজকাল অস্থির হয়ে ওঠে সোনিয়া। যতক্ষণ না রামপিয়ারী আসে, দরজার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে।
আজও তলপেটে চিনচিনানি শুরু হয়েছে। বিছানায় খাড়া হয়ে উঠে বসল সোনিয়া। গলাটাকে যতখানি সম্ভব লম্বা করে দরজার বাইরে যতদূর দেখা যায়, দেখবার চেষ্টা করল। কিন্তু না, রামপিয়ারী আসছে না।
ব্যথাটা বাড়তে শুরু করেছে। দু হাতে তলপেটটা ঠেসে ধরল সোনিয়া। তবু ব্যথাটা দাবানো গেল না।
প্রথমে খেপে উঠল সোনিয়া। চিৎকার করতে লাগল, শালী হারামী খচরীটা এখনো এল না। আমার পেটটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। আমি জরুর মরে যাব।
ব্যথাটা যত বাড়ছে ততই হতাশ হয়ে পড়ছে সোনিয়া। তবে কি আজ রামপিয়ারী আসবে না?
যন্ত্রণা বাড়তে বাড়তে সাঙ্ঘাতিক হয়ে উঠল। সোনিয়ার শরীর বেঁকে দুমড়ে যাচ্ছে। বিছানায় ওলট পালট খেতে লাগল সে। দুই হাতে তলপেটটা খামচে ধরে গোঁ গোঁ করে গোঙাতে লাগল, মরে যাব, জরুর মরে যাব।
চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে। হাতের মুঠো থেকে তলপেটের মাংস আলগা হয়ে যাচ্ছে। গলা দিয়ে অস্ফুট গোঙানি ছাড়া আর কিছুই বেরুচ্ছে না। অসহ্য যন্ত্রণা সোনিয়াকে গ্রাস করে ফেলেছে।
সন্ধে পার করে রামপিয়ারী এল।
সোনিয়ার শরীরটা তখন ধনুকের মতো বেঁকছে, আবার সঙ্গে সঙ্গে সিধে হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে রইল রামপিয়ারী। তারপর সোনিয়াকে তুলে খাড়া করে বসিয়ে দিল।
রামপিয়ারীকে দেখে সোনিয়া খেপে উঠল, শালী, পেটের দরদে আমি মরে যাচ্ছি। তোর হুঁশ নেই! বলতে বলতে রামপিয়ারীর মুখে চড় চাপড় কষাতে লাগল। সে যেন উন্মাদ হয়ে উঠেছে।
আশ্চর্য, আজ কিছুই বলল না টিণ্ডালান রামপিয়ারী। মুখ বুজে সোনিয়ার মার খেয়ে গেল। তার মুখে, দুটো পাতাহীন গোল গোল চোখে দুর্বোধ্য, সূক্ষ্ম হাসি ফুটে বেরিয়েছে। রামপিয়ারীর মনে কী আছে, কে জানে।
সোনিয়া চেঁচাতে লাগল, আমার নেশা এনেছিস?
চুপ। দুই হাতে সোনিয়ার মুখটা চেপে ধরল রামপিয়ারী। চাপা গলায় বলল, হারামজাদী নেশার জন্যে পাগলা বনে যায়! ইয়াদ রাখবি, এটা কয়েদখানা। নেশা নেশা করে চিল্লাবি না। বলতে বলতে কাগজের মোড়ক খুলে আফিমের ছোট একটা গুলি বার করল রামপিয়ারী। আঁপিয়ে পড়ে রামপিয়ারীর হাত থেকে সেটা একরকম ছিনিয়েই নিল সোনিয়া। সঙ্গে সঙ্গে মুখে পুরে দিল।
আফিমের নেশায় অনেকটা সময় কুঁদ হয়ে রইল সোনিয়া। নেশাটা তলপেটের যন্ত্রণা ক্রমশ অসাড় করে দিচ্ছে।
এবার আস্তে আস্তে চোখ মেলল সোনিয়া। ডাকল, এ রামপিয়ারী–
হাঁ—
আজ এত দেরি করে এলি কেন?
মনস্তত্ত্বে অশিক্ষিত পটুত্ব আছে রামপিয়ারীর। ফিশফিশ করে সে বলল, তোর নেশার চীজ জোটাতে গিয়েছিলাম। তাই দেরি হয়ে গেল।
আসলে ব্যাপারটা পুরোপুরি আলাদা। আফিম অনেক আগেই যোগাড় করে রেখেছিল। রামপিয়ারী শুধু দেখছিল, নেশার জিনিস না পেলে কতটা কাবু হতে পারে সোনিয়া, কতটা ছটফট করতে পারে। ইচ্ছা করেই দেরিতে এসেছে সে।
সোনিয়া বলল, কাল থেকে তাড়াতাড়ি আসবি।
রামপিয়ারী জবাব দিল না। তার মনের সর্পিল গলিখুঁজিতে কোন দুয়ে ভাবনা ঘুরে বেড়াচ্ছে, কে জানে। এই মুহূর্তে রামপিয়ারী কী ভাবছে, একমাত্র সে-ই বুঝি বলতে পারে।
একদৃষ্টে সোনিয়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছে রামপিয়ারী। তার গোলাকার, পাতাহীন চোখজোড়া অস্বাভাবিক জ্বলছে।