Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সিন্ধুপারের পাখি || Prafulla Roy » Page 8

সিন্ধুপারের পাখি || Prafulla Roy

হিমালয় থেকে যাযাবর পাখিরা শীতের তাড়নায় পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে চলে এসেছিল। শীতের আয়ু ফুরিয়ে গিয়েছে। অসংখ্যদ্বীপে লক্ষ লক্ষ ডিম পেড়ে আবার তারা হিমালয়ে ফিরে যাচ্ছে।

আন্দামানের ওপর দিয়ে হাজার হাজার মাইল বাতাসে ভাসতে ভাসতে পাখিরা উড়ে চলেছে।

পরিযায়ী পাখিরা যখন আন্দামানের ওপর দিয়ে পাড়ি জমায়, তখন এই দ্বীপে বসন্ত আসে।

এবারও আন্দামানে বসন্ত এসে গেছে।

এ-সময় পরদেশি পাখিরাই শুধু আসে না, দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ থেকে ধূসর রঙের রাশি রাশি মেঘ উড়ে আসতে থাকে। মেঘের টুকরোগুলি একাকার হয়ে যায়, জমাট বাঁধে, তারপর ফুলে ফুলে আকাশটাকে ছেয়ে ফেলে।

এবার পাখিরাই এসেছে। এখন পর্যন্ত মেঘেদের কোনো চিহ্নই নেই।

একটু আগে সকাল হয়েছে।

সাউথ পয়েন্ট কয়েদখানার বড় টিলাটার মাথায় এখন বসে আছে সোনিয়া।

কয়েদখানার কাজ আর করতে হবে না। তার সব ডিউটি মকুব হয়ে গেছে। বেলা বাড়লে চান্নু সিং নিতে আসবে সোনিয়াকে।

টিলার মাথায় বসে পাখি দেখছিল সোনিয়া। অনেক উঁচু দিয়ে তারা আঁক বেঁধে চলেছে। পাখিরা ডানা নাড়ে না, বাতাসে অবিরাম ভাসে। ভেসে ভেসে আকাশের তল্লাশ নিতে নিতে তারা এগিয়ে চলে।

পাখিদের ডানার রং যে কী, এত নিচু থেকে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না সোনিয়া।

ও পাশে খানিকটা দূরে জনকতক কয়েদিনী তাঁত বুনছে। এক তালে মাকুর শব্দ উঠছে–খটাখট, খটাখট। আর এক পাশে আরো কয়েকজন কয়েদিনী কোপরার জন্য নারকেল কাটছে।

কোনো দিকে লক্ষ্য নেই সোনিয়ার। পাখিদের ডানার দুর্বোধ্য রংটা যে ঠিক কী, বুঝবার উৎসাহ পর্যন্ত নেই।

সোনিয়া ভাবছিল, খানিকটা পর চান্নু সিং তাকে নিতে আসবে। মঙ্গলবার শাদির প্যারেড হয়ে গিয়েছে। চান্নু বলে গিয়েছিল, আজ ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে আসবে, নয়া কাপড়া আনবে, সোনার টিকুলি আনবে, রুপোর কাঙনা (বালা) আনবে, মল আনবে, গুজরিপঞ্চম আনবে, হার আনবে, খুসবুওলা তেল আনবে। একেবারে শাদির দুলহনটি সাজিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে চাপিয়ে তাকে ডেপুটি কমিশনারের অফিসে নিয়ে যাবে। সেখানে গুরুজির নামে কসম নিয়ে ছাপানো কাগজে (ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন ফরম) বুড়ো আঙুলের টিপছাপ মেরে শাদিটা পাকা করে নেবে।

আজ সোনিয়ার শাদি। মন ঠিক বশে নেই সোনিয়ার। আজ যে চান্নু সিং-এর সঙ্গে তার শাদি, এ কথা ভেবেও তেমন ফুর্তি হচ্ছে না।

যে-নারী কোতল করে দ্বীপান্তরী সাজা নিয়ে আন্দামানে এসেছে, তার দিল বড় বিচিত্র বস্তু। চান্নুর সঙ্গে তার শাদি হবে, সাউথ পয়েন্ট কয়েদখানায় আর তাকে আটক থাকতে হবে না, পুরনো দিনের মতো আবার সে ঘর পাবে, সংসার পাবে, একান্ত অনুগত একটি পুরুষ পাবে। সেই মঙ্গলবার শাদির প্যারেড হয়েছে, আজ আর এক মঙ্গলবার। মাঝখানে গোটা সপ্তাহটা নয়া শাদির কথা ভেবেছে সোনিয়া, চান্নু সিং-এর কথা ভেবেছে। এত ভেবেও দিলে সুখ নেই। অবুঝ এক ব্যথা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ব্যথাটা যে কেন, সঠিক বুঝে উঠতে পারে না সোনিয়া।

যতবার নতুন শাদির কথা ভেবেছে সোনিয়া, ততবার সেই বেদরদী মানুষটাকে মনে পড়ে গিয়েছে। রামদেও তেওয়ারী। রামদেও-এর হাত থেকে এতদূরে এসেও নিস্তার নেই। অসহ্য, আকণ্ঠ এক যন্ত্রণার মতো তাকে পাকে পাকে জড়িয়ে রেখেছে লোকটা।

খানিকটা পর গাড়ি নিয়ে আসবে চান্নু সিং। সোনিয়া ভাবল, সে যাবে না। হাজার মাইল বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে রামদেও তিওয়ারীর ভাবনা যতই তাকে বিদ্ধ করুক, সবই সে সইবে। যে অন্যায় সে করে এসেছে, তার পুরো সাজা সে নেবে।

সোনিয়া ঠিক করে ফেলল, চান্নু সিং-এর সঙ্গে সে কিছুতেই যাবে না। গাড়ি ফিরিয়ে দেবে। শাদির প্যারেডে সে রাজিবাজি হয়েছিল, আজ সেই রাজিবাজি খারিজ করে দেবে।

পাশ থেকে ফিসফিসানি শোনা গেল, ‘এ সোনিয়া—’

চমকে ঘুরে বসল সোনিয়া। দেখল, টিণ্ডালান রামপিয়ারী তার পিঠ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের মধ্যে আধ হাতের ফারাকও নেই। কখন যে সে এসেছে, টের পাওয়া যায়নি।

আগের মতোই চাপা গলায় ডাকল রামপিয়ারী, এ সোনিয়া—

সোনিয়া জবাব দিল না। তার বুকের ভেতরটা শিউরে উঠেছে।

রামপিয়ারী এবার খেঁকিয়ে ওঠে, এ শালী, খচরী—

মুখটা ফাঁক হয়ে গেল সোনিয়ার। ঝাপসা একটা শব্দ বেরুল সেখান থেকে, হাঁ–

শালী রেণ্ডি, একজনে তোমার মন ওঠে না! বিশটা মরদ না হলে তোমার সুখ নেই। কুত্তী!

সোনিয়ার গলাটা ধরে এক টানে তাকে নিজের দিকে নিয়ে এল রামপিয়ারী। মাঝখানের ফারাকটা এখন আর নেই।

রামপিয়ারী ফুঁসে ওঠে, এ সোনিয়া, সাতটা দিন তাকে তাকে রয়েছি। সুবিধে করে তোকে ধরতে পারছি না। ওই খচরী, হারামীর বাচ্চী হাবিজাকে পাহারাদারনী রেখেছিলি। এইবার বাপের শাদি মায়ের নিকাহ্ এক সাথ দেখিয়ে ছাড়ব।

যেদিন প্রেমার খানা ছিনিয়ে খেয়ে তার চোয়াল ফাটিয়ে রেণ্ডিবারিক কয়েদখানার সবগুলো টিণ্ডালান আর পেটি অফিসারনীর সঙ্গে একাই যুঝেছিল হাবিজা, সে দিন থেকেই মেম জেলার তাকে পেটি অফিসারনী করে দিয়েছে। আর সেদিন থেকেই রামপিয়ারীর হাত থেকে বাঁচাবার জন্য সোনিয়াকে পাহারা দিচ্ছে হাবিজা। এই কদিন সোনিয়ার কাছে ঘেঁষতে পারেনি রামপিয়ারী। হাবিজার দাপটে সোনিয়ার কাছে যাবার উপায়ও ছিল না।

রামপিয়ারী দাঁতে দাঁত ঘষল। পাতাহীন, গোল গোল চোখ দুটো আগুনের ভাটার মতো জ্বলছে। খ্যাসখেসে গলায় সে ডাকল, এ সোনিয়া–

হাঁ–সোনিয়ার গলায় স্বর ফোটে কি ফোটে না।

তা হলে চান্নুকেই তুই শাদি করবি?

একটু আগে সোনিয়া ঠিক করেছিল, চান্নুর গাড়ি ফিরিয়ে দেবে। রামদেও তিওয়ারীর অসহ্য ভাবনা নিয়ে এই সাউথ পয়েন্ট কয়েদখানায় বাকি জীবনটা সে সাজা খাটবে। কিন্তু এই মুহূর্তে রামপিয়ারীকে দেখতে দেখতে আগের সেই মতটা বদলে ফেলল সোনিয়া। চান্নু সিং-এর সঙ্গে সে আজই চলে যাবে। জান বাঁচাতে হলে না গিয়ে উপায় নেই।

রামপিয়ারী বলে, চান্নুর সাথ তা হলে আজ যাবি?

সোনিয়ার মুখ থেকে উত্তরটা বেরিয়ে গেল, হাঁ—

ঠিক?

ঠিক।

অনেকক্ষণ কিছু বলতে পারল না রামপিয়ারী। বিস্ময়ে মুখটা ফাঁক হয়ে বিরাট হাঁ হয়ে আছে। পাতাহীন চোখের তারা দুটো স্থির।

রামপিয়ারী বুঝেই উঠতে পারছে না, তার মুখের ওপর কথা বলার মতো এতখানি সাহস কোথায় পেল সোনিয়া?

সোনিয়া বিড় বিড় করে বলতে লাগল, জরুর যাব।

শালী! সাপের মতো হিসিয়ে উঠল রামপিয়ারী। সাপের মতোই পাতাহীন চোখ দুটো ঝিক ঝিক করতে লাগল।

হঠাৎ প্রচণ্ড এক জেদ পেয়ে বসে সোনিয়াকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে নিতে আসবে চান্নু সিং। এখন আর রামপিয়ারীকে ডরায় না সে। ভয়ডর তার ঘুচে গিয়েছে। এতদিন রামপিয়ারীর সামনে পড়লে বুক কেঁপে উঠত, মুখে কথা জোগাত না।

রামপিয়ারীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যে-কথাটা বলার সাহস কোনোদিনই হত না, এই মুহূর্তে সেটা কত সহজে বলতে পারল সোনিয়া, জরুর যাব, নইলে তুমিই আমাকে খতম করবে টিণ্ডালান।

রামপিয়ারী দাঁতে দাঁত চাপল, হারামীকা বাচ্চী—

সোনিয়া মরিয়া হয়ে উঠল, সাধে কি আর এতোয়ারী বহিন তোমাকে ও-কথা বলে?

কী বলে কুত্তীটা?

তুমি না কি আওরত না, দুসরা কিছু।

রামপিয়ারীর দিকে এখন আর তাকানো যাচ্ছে না। গলার শিরাগুলো পাকিয়ে পাকিয়ে জোঁকের মতো ফুলে উঠেছে। চোখ ফেটে যেন রক্ত ছুটবে। প্রচণ্ড রাগটাকে কিছুতেই বাগ মানাতে পারছে না সে। ফোঁস ফোঁস করে গরম নিশ্বাস পড়ছে তার।

রামপিয়ারী গজরায়, আমি আওরত না তো কী?

তুমি যে কী, তা তুমিই জানো।

এরপর অনেকক্ষণ কেউ কিছু বলল না। পরস্পরের চোখের দিকে চেয়ে রইল। আশ্চর্য, অন্য অন্য দিন রামপিয়ারীর দৃষ্টি সহ্য করতে পারত না সোনিয়া। কিন্তু আজ যেন তার কী হয়েছে! অনেকখানি দুঃসাহস যেন তার ওপর ভর করে বসেছে।

হঠাৎ রামপিয়ারী বলল, তোর কাছে একটা সিধা জবাব চাই।

কিসের জবাব?

চান্নুর সাথ তুই তা হলে যাবিই?

বলেছিই তো–যাব।

কয়েদখানার বাইরে গেলে তোর কত মওকা রে কুত্তী। বাইরে যেতে পারলেই কত মরদ জুটবে। মাগী রেণ্ডি কাহাকা!

সোনিয়া রুখে দাঁড়াল, হোশিয়ার হয়ে কথা বলবে টিণ্ডালান। গালি দেবে না বলছি। ভাল হবে না।

শালী, তিন রোজের ছোঁকরি, আমাকে হোশিয়ার করছে। অনেক সয়েছি, আর । তোর জান আজ তুড়ব। রামপিয়ারী সমানে চিল্লাতে লাগল, রেণ্ডিবারিক কয়েদখানায় যখন এসে ঢুকেই পড়েছিস, আর আমার দিল যখন তোর জন্যে মজেই গেছে, তখন আর এখান থেকে জান নিয়ে বেরুতে দেব না। চান্নু সিং তোকে নিয়ে মজা লুটবে, তা হবে না।

এবার ভয়ই পেল সোনিয়া। কাঁপা গলায় বলল, করবে কী?

দ্যাখ কী করি। বলতে বলতে দুই থাবায় সোনিয়ার চুলের মুঠি বাগিয়ে মাটিতে আছড়ে ফেলল রামপিয়ারী।

সোনিয়া বলল, আমাকে মেরো না টিণ্ডালান।

মারব না! না মারলে তুই কি সজুত থাকবি? চার জন্যে তোর দিল বিগড়েছে। না পেটালে তোর বিগড়ানো দিলটা কি আমার দিকে ঝুঁকবে?

সোনিয়া সমানে চিল্লায়, মেরো না, মেরো না–

জবাব দেয় না রামপিয়ারী। এক হাতে সোনিয়াকে মাটিতে ঠেসে রাখে। অন্য হাতে পাশ থেকে এক টুকরো কাঠ যোগাড় করে নেয়। তারপর সোনিয়ার মুখে-মাথায় পিঠে–সমস্ত দেহে সেটা দিয়ে একটার পর একটা ঘা মারতে থাকে।

প্রথমে দুই হাত বাড়িয়ে কাঠের টুকরোটা ঠেকাচ্ছিল আর চেঁচাচ্ছিল সোনিয়া, মেরে ফেলল, মেরে ফেলল–জান চৌপট করে দিল।

চারপাশ থেকে কয়েদিনীরা ছুটে এসেছিল। কিন্তু টিণ্ডালান রামপিয়ারীর সেই আগুনখাকীর মতো চেহারা দেখে কেউ এগিয়ে এল না।

নাকমুখ ফেটে রক্ত ঝরছে। এতক্ষণ দু’হাতে মার ঠেকাচ্ছিল সোনিয়া। এখন হাত দুটো ঝুলে পড়েছে। ভয়ে আর যন্ত্রণায় চেঁচাচ্ছিল। এখন গলার ভেতর থেকে অস্ফুট গোঙানি বেরিয়ে আসছে।

কাঠের টুকরোটা এক পাশে ছুঁড়ে ফেলে রামপিয়ারী বিড় বিড় করে বলল, হারামীর বাচ্চী, চান্নুর কাছে যাবে! যা না শালী–বলে ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের ভাঙা ভাঙা ধারাল নখ সোনিয়ার মাংসল হাতে গেঁথে একটা ঠেলা মারল।

সোনিয়ার হুঁশ নেই। জ্ঞান হারিয়ে গোঁ গোঁ করে গোঙাচ্ছে।

এবার এক কাণ্ড করে বসল রামপিয়ারী। সোনিয়ার নরম শরীর পাঁজাকোলা করে বুকের ওপর তুলে নিল। তারপর ছুটতে ছুটতে জেলের হাসপাতালে চলে গেল। নিজের হাতে রক্ত ধুয়ে, ঘা সাফ করে ওষুধ লাগাল, ব্যান্ডেজ বাঁধল। এদিক ওদিক তাকিয়ে যখন বুঝল ধারে কাছে কেউ নেই, তখন এক দমে সোনিয়ার মুখে গোটা বিশেক চুমু খেয়ে বলল, তোকে কত পেয়ার করি, তা তুই বুঝিস না ছোঁকরি! তোকে নিজের কাছে সারা জিন্দেগী রাখতে চাই বলেই তো এমন করে পিটলাম।

বেহুঁশ সোনিয়ার কাছ থেকে উত্তর মিলল না।

বিচিত্র মন রামপিয়ারীর। সে মন সর্পিল, পিছল অন্ধকার গলিখুঁজিতে অবিরাম ছুটে বেড়ায়।

খানিকটা পর সূর্য যখন সরাসরিদ্বীপের মাথায় এসে উঠেছে, ঠিক তখনই সাউথ পয়েন্ট জেলখানার ফটকে চান্নু সিং-এর ঘোড়ার গাড়ি এসে দাঁড়াল।

চান্নু সিংএর দিলে আজ বেজায় ফুর্তি। সোনিয়ার মতো খুবসুরতী যুবতাঁকে চিরদিনের মতো পাবে। সেই নেশায় বুঁদ হয়ে আছে সে।

সোনিয়ার জন্য করণ ফুল এনেছে, মল এনেছে, হার এনেছে, কাঙনা এনেছে চান্নু সিং। রেশমি শাড়ি, সালোয়ার আর কাঁচুলিও এনেছে। গারাচারামা গাঁও-এ একখানা সরকারি ঘর ভাড়াও করেছে তার জন্য। সোনিয়াকে নিয়ে সেখানেই তুলবে।

রেণ্ডিবারিক কয়েদখানার ফটকে পারমিশন কার্ড দেখিয়ে ভেতরে ঢুকল চান্নু সিং। কিছুক্ষণ পর যখন সে বেরিয়ে এল, তার জবরদস্ত বিরাট চেহারাটা একেবারে চুপসে গিয়েছে। টলতে টলতে ঘোড়ার গাড়িতে উঠে পড়ল চান্নু সিং। কাঁচ কোচ শব্দ উঠল। ভাঙা ভাঙা পাথুরে সড়কে দুটো ঘোড়া প্রাণপণে গাড়ি টানতে লাগল। গাড়িটা সিসোস্ট্রেস উপসাগরের পার হয়ে এবারডিন বাজারের দিকে চলে যাচ্ছে।

একলাই ফিরে গেল চান্নু সিং। সোনিয়া তার সঙ্গে আসেনি। রামপিয়ারীর মার খেয়ে হাসপাতালে সেই যে বেহুশ হয়ে পড়ে রয়েছে, এখনো তার জ্ঞান ফেরেনি।

যাযাবর পাখিরা পুরনো ডেরায় ফিরে গিয়েছে। আন্দামানের আকাশে এখন তাদের চিহ্ন পর্যন্ত নেই।

দক্ষিণ পশ্চিম কোণ থেকে রাশি রাশি মৌসুমি মেঘ আন্দামানের আকাশে উড়ে এসেছিল। সেই মেঘগুলি জমাট বেঁধে অনড় হয়ে আছে। মাঝে মাঝে আকাশজোড়া বিরাট মৃদঙ্গটায় ঘা পড়ছে। গুরু গুরু আওয়াজে মেঘ ডাকে। সমুদ্রের গভীর তলদেশ থেকে একটা গোঁ গোঁ গম্ভীর গর্জন ঠেলে বেরিয়ে আসে। আকাশ আর সমুদ্র একযোগে শাসাতে থাকে।

দ্বীপে বসন্ত এসে পড়েছে। বছরের শেষ ঋতুটা কারসাজি করেছে, পৃথিবীর যেখানে যতটুকু মাটি আছে, সব ভেঙেচুরে রসাতলে পাঠিয়ে দেবে।

মোট দু শ’ চারটে দ্বীপ। একটানা বিপুল জলরাশির মধ্যে টুকরো টুকরো ভূখণ্ডগুলি ক্ষীণ প্রতিবাদের মতো মাথা তুলে রয়েছে। বছরের শেষ ঋতুতে প্রকৃতি হঠাৎ খেপে উঠে মতলব করেছে, এই প্রতিবাদগুলোকে গুঁড়িয়ে চুরমার করে দেবে। আকাশ-ভরা জমাট মেঘে আর ফুলে ফুলে ওঠা বিশাল সমুদ্র জুড়ে ধ্বংসের আয়োজন চলছে যেন।

সিকমেনডেরা (হাসপাতাল) থেকে পিনিকের ব্যারাম সারিয়ে এসে দিনকতক সড়ক বানানোর কাজ করল লখাই।

সড়কের পর রম্বাস ছেচার কাজ পেল সে। রম্বাস হল এক ধরনের বিষাক্ত বন্য উদ্ভিদ। পুরু এবং দীর্ঘ একটি উঁটার মতো। রম্বসের সবুজ ডাটাটি বিষের রসে সরস এবং পুষ্ট হয়ে থাকে। যে-সব কয়েদি তুখোড় শয়তান, তাদের রম্বাস ঘেঁচতে দেওয়া হয়। রম্বাসের ওপর মুগুরের ঘা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিষাক্ত রস ছিটকে কয়েদির সারা শরীরে লাগে। যেখানে রস লাগে সেখানে দগদগে ঘা হয়ে যায়।

পেটি অফিসার নসিমুল গণি ভেবে রেখেছিল, লখাইকে সেলুলার জেলের মহিমা টের পাইয়ে দেবে, বুঝিয়ে দেবে দরিয়ায় কত পানি। সে-কথা ভোলেনি সে।

দিন তিনেক রম্বাস হেঁচল লখাই। সারা শরীরে ঘা হল।

এরপর হুইল ঘানিতে জোড়া হল লখাইকে। রোজ ঘানি ঘুরিয়ে পুরো পাঁচ পাউন্ড সরষের তেল বার করতে হয়।

জেরবার হবার উপক্রম হল লখাইর। শরীরটা ভয়ানক কাহিল হয়ে পড়েছে। লোহার বিরাট ঘানিটা টানতে টানতে এক-এক সময় মনে হয়, বুক ফেটে প্রাণটা বেরিয়ে যাবে। তখন ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠতে ইচ্ছা করে।

সড়ক পিটিয়ে, রম্বাস ঘেঁচে আর হুইল ঘানি টেনে দিনগুলো কোনোক্রমে পার করে দিচ্ছিল লখাই।

হঠাৎ একদিন সকালে ছুটতে ছুটতে পেটি অফিসার লখাইর কুঠুরিতে এল। হুইল ঘানি টানতে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বসে ছিল লখাই। খুব নরম গলায় পেটি অফিসার বলল, আজ থেকে তোকে আর হুইল ঘানি টানতে হবে না লখাই। জেলার সাহেব তোর ওপর মেহেরবানি করেছে।

এত বড় মহানুভবতার কারণ বুঝতে না পেরে অবাক তাকিয়ে থাকে লখাই।

পেটি অফিসার নসিমূল বলল, আ বে মুরুখ, আজ থেকে ফরেস্টের কাজে যাবি। ফরেস্টের কাজে বহুত মজা। ডিপটি (ডিউটি) কম, আরাম বেশি।

হাঁ। অস্ফুট একটা শব্দ করল লখাই।

জবাবদারির কাম মিলবে।

হাঁ।

তলব (মাইনে) মিলবে।

হাঁ।

নসিব তোর বহুত আচ্ছা। পয়লাই কেউ জবাবদারির কাজ পায় না। জেলার সাহেব তোর ওপর মেহেরবানি করেছে। একটু থামে পেটি অফিসার। পাকানো ছুঁচলো গোঁফে চাড়া মেরে ধূর্ত চোখে লখাইর ভাবগতিক লক্ষ করে। তারপর আবার শুরু করে, তোকে কত পেয়ার করি লখাই। জেলার সাহেবকে খুশামোদ করে তোকে এই কাজটা পাইয়ে দিয়েছি।

পেটি অফিসারের খিস্তি আর ডাণ্ডার গুঁতো খেতেই কয়েদিরা অভ্যস্ত। তার এমন তোয়াজ আর মোলায়েম কথা কেমন যেন বেসুরো শোনায়। মনটা ভয়ানক সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে লখাইর। তাকে ফরেস্টের কাজে পাঠিয়ে পেটি অফিসার নসিমূল গণি কোন দুৰ্জ্জেয় মতলব হাসিল করতে চায়, কে বলবে।

পেটি অফিসার আবার বলে, ফরেস্টে চলে যা লখাই। এমন সুযোগ এ-জিন্দেগীতে আর পাবি না। এখন গেলে এক মাস কয়েদ খেটেই আন্দামান রিলিজ পেয়ে যাবি।

এখানে নয়া কয়েদিদের দু’মাস বিশ দিন সেলুলার জেলে আটক থাকতে হয়। তারপর ছাড়া পেয়ে তারা ‘বিজন’ কি ‘টাপু’তে, অর্থাৎ কয়েদি ব্যারাকে আসে। কেউ কেউ ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের কাজে জঙ্গলের ‘বীটে’ চলে যায়।

দু’মাস বিশ দিন পর কয়েদিরা ছাড়া পায়। এই ছাড়া পাওয়ার নাম ‘আন্দামান রিলিজ’। ‘আন্দামান রিলিজ’ পেলে টিণ্ডাল আর পেটি অফিসাররা কথায় কথায় ডাণ্ডা হাঁকাতে পারে না। কয়েদিদের চলাফেরা, আচার-আচরণের ওপর যে বাধা-নিষেধের কড়াকড়ি থাকে, তার খানিকটা শিথিল করে দেওয়া হয়।

আন্দামান রিলিজ মানে সাজা থেকে রেহাই পাওয়া নয়। টাপু কি বিজনও এক ধরনের কয়েদখানা। তবে টাপু কি বিজনে এলে কয়েদিরা খানিকটা স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে।

আন্দামান রিলিজ পেয়ে সেলুলার জেলের বাইরে এসে কয়েদিরা যাবেই বা কোথায়? জঙ্গলে ঢুকলে হিংস্র জংলীরা তীরের ফলায় জান নেবে। সমুদ্রে নামলে হাঙরেরা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে, অক্টোপাসেরা আটটা প্রবল শুড়ের চাপে পিষে মারবে।

তবু টিণ্ডাল পেটি অফিসারদের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে কয়েদিরা আন্দামান রিলিজ-এ জন্য একটি একটি করে দিন গোনে, উন্মুখ হয়ে থাকে।

সারা রাত্রি এক দণ্ড ঘুমোতে পারল না লখাই। খালি ভাবল। মাথার ভেতর অসংখ্য চিন্তা জটলা পাকাল, তোলপাড় করল, দাপাদাপি করে বেড়াল। লখাইর মাথা গরম হয়ে উঠল।

পুরো রাত্রিটা ভেবে ভেবে সে ঠিক করে ফেলল, ফরেস্টের কাজেই যাবে। সেখানে যত দুর্ভোগই থাক, অন্তত টিণ্ডাল বা পেটি অফিসাররা নেই। রম্বাস ঘেঁচা কি হুইল ঘানি টানার ঝামেলা নেই। তা ছাড়া, হঠাৎ সোনিয়ার কথা মনে পড়ে গেল। লখাই ভাবল, আন্দামান রিলিজ তাকে পেতেই হবে।

কাল বিকেলে ফরেস্টের কাজে এসেছে লখাই।

শহর পোর্ট ব্লেয়ার থেকে মাইল বিশেক দূরে এই জায়গাটা। নাম তুষণাবাদ। এই তুষণাবাদেই ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ‘বীট’ বসেছে।

বীট অর্থে বেতপাতার চাল, বাঁশের বেড়া আর বাঁশের পাটাতনের গুটিকতক ঝুপড়ি। ফরেস্ট গার্ড, জবাবদার আর কুলিদের সাময়িক আস্তানা।

তুষণাবাদ অঞ্চলে ইদানীং জঙ্গল ‘ফেলিং’ অর্থাৎ বন কাটা শুরু হয়েছে। অরণ্য সংহার করে মানুষ মাটির দখল নেবে। এখানে গড়ে উঠবে গাঁও, কুঠিবাড়ি, ক্ষেতিবাড়ি পুরোদস্তুর একটি বন্দি উপনিবেশ, সরকারি পরিভাষায় যার নাম পেনাল কলোনি।

কত কালের এই আন্দামান! কবে যে বঙ্গোপসাগরের অথৈ অতল থেকে এইদ্বীপমালা মাথা তুলেছিল, ইতিহাসের নজর সেখানে পৌঁছয় না। হাজার হাজার বছর ধরে, ইতিহাস সৃষ্টির বহুকাল আগে থেকে এই দ্বীপ অরণ্যের ঘাঘরায় লজ্জা ঢেকে আসছে।

আন্দামানের অরণ্য–জটিল, কুটিল, ভয়ঙ্কর। কত কাল ধরে কত বনস্পতি এখানে মাথা তুলেছে। দিনে দিনে অরণ্যের সংসার বেড়েছে। এই দ্বীপপুঞ্জ যেদিন বিপুল সমুদ্র ফুঁড়ে মাথা তুলেছিল, সেদিন এদের দখল নেওয়ার জন্য দ্বিতীয় কোনো দাবিদার জোটেনি, হয়তো সেদিন থেকেই আষ্টেপৃষ্ঠে শিকড়ে বাকড়ে জড়িয়ে ধরে অরণ্য এইদ্বীপে তার দখল কায়েম করেছে। সেই অরণ্য ‘ফেলিং’ শুরু হয়েছে।

কাল তুষণাবাদ এসেছে লখাই। এখানে সবে একটি দিন কাটল।

এখন যাই-যাই বিকেল। সূর্যটা পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। জঙ্গলের ওপাশে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিরাট বিরাট প্যাডক আর গর্জন গাছগুলির মাথায় ম্লান একটু আলো আটকে রয়েছে।

জবাবদার, ফরেস্ট গার্ড, কুলি–এখানে সবাই কয়েদি। দ্বীপান্তরী সাজা নিয়ে তারা কালাপানিতে কয়েদ খাটতে এসেছিল। সেই কয়েদিরাই জঙ্গল সাফ করে উপনিবেশ বানাচ্ছে।

সাজার মেয়াদ ফুরোবার পর কয়েদিরা ঘর-সংসার পাতবে। সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবে। আগে থেকেই জঙ্গল নির্মূল করে তার ভূমিকা করে রাখা হচ্ছে।

ফরেস্টের কাজে এসে প্রথমেই পারমোশ (পোমোশান) পেয়েছে লখাই। কুলি নয়, একেবারে জবাবদার হয়ে বসেছে। এখানে এটা একটা খুব বড় ব্যাপার।

কুলিরা বিচিত্র সুর আউড়ে আউড়ে করাত চালাচ্ছে, হেঁই-হেঁই-হেঁইও—

হেঁই-হেঁই-হেঁইও–

বিরাট একটা পেমা গাছের ডালপালা ছাঁটাই হয়ে গিয়েছে। এখন কুলিরা মূল গুঁড়িটায় করাত চালাচ্ছে।

কুলিদের বিচিত্র সুর ছাপিয়ে মাঝে মাঝে জবাবদারের হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে, হুদি-হুদি-হুদি–

সঙ্গে সঙ্গে বন বিভাগের হাতিরা বোঙা (গাছের গুঁড়ি) ঠেলতে ঠেলতে একপাশে পাকার করতে থাকে।

সমস্ত অঞ্চলটা টহল মেরে ঝুপড়িতে ফিরে এল লখাই।

লখাই আসার আগে মাসখানেক ধরে তুষণাবাদে ‘ফেলিং’ শুরু হয়েছিল। খানিকটা জায়গা সাফও হয়ে গিয়েছে। সেই অংশটুকুর পরই আবার জঙ্গল। সেই জঙ্গল যুঁড়ে পৃথিবীর আলো ঢোকে না, মানুষের নজর ভেতরে পৌঁছয় না।

দক্ষিণ আন্দামানের এই ছায়াগভীর অরণ্যে কিং কোব্রা আর সরীসৃপের চোখে জ্বলন্ত ফসফরাস ছাড়া কোনো আগুনই নেই। পেমা গাছের অন্ধকার কোটরে পেঁচার চোখ ধক ধক করে। স্যাঁতসেঁতে পিছল মাটিতে বিষাক্ত কানখাজুরার পাল পেট টেনে টেনে চলে। জঙ্গলের মাথা থেকে ঝুপ করে দলা-পাকানো জোঁক পড়ে। এই প্রথম তারা মানুষের রক্তের স্বাদ পেয়েছে।

আর আছে জারোয়া। ঝোঁপের আড়াল থেকে হয়তো একটা কালো কুচকুচে মুখ দেখা দিয়ে হঠাৎই আবার অদৃশ্য হয়ে যায়। হ্যাঁ, মানুষেরই মুখ। উলঙ্গ, হিংস্র মানুষ। এরাই আন্দামানের আদি বাসিন্দা। নৃতত্ত্ববিদরা অনুমান করেন, আন্দামানের এই জাতিটি পৃথিবীর আদিমতম জাতিগুলির অন্যতম।

কালো কালো, খর্বাকৃতি এই নিগ্রোয়েড জাতের মানুষগুলি তুমি, আমি কি আর দশজন ভদ্র মানুষের ছোঁয়া বাঁচিয়ে নিজেদের হাজার মাইল দূরে সরিয়ে রেখেছে। মনে হয়, পৃথিবীর প্রথম অরণ্য দক্ষিণ আন্দামানের এই তুষণাবাদেই জন্মেছিল। আর এই অরণ্য দিনে দিনে দুর্ভেদ্য হয়ে পৃথিবীর আদিম সন্তানদের আশ্রয় দিয়েছে, সভ্যতার সব আক্রমণ ঠেকিয়ে রেখেছে। আধুনিক পৃথিবীর আলো কোনোদিন তাদের নাগাল পায় না।

সেই অরণ্য নির্মূল করা হচ্ছে।

ঝুপড়ির সামনে বসে জঙ্গলের দিকে তাকাল লখাই। দৃষ্টিটা উদ্ভ্রান্ত হয়ে উঠেছে। হঠাৎ মাথার মধ্যে এক রাশ ভাবনা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল।

এখানে জবাবদারির কাজ পেয়েছে। কুলি খাটানো, হাতি খাটানো, জঙ্গল পোড়াবার সময় তদারক করা–এই সব হল জবাবদারির কাজ। এ কাজে ঝামেলা কম, মেহনত কম, তখলিফ কম। তবু পেটি অফিসার কেন যে তাকে জঙ্গলে পাঠিয়েছে, এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না লখাই।

রোদ মরে আসছে। জঙ্গলের মাথায় মলিন আলোটুকু নিবে যাচ্ছে। দক্ষিণ আন্দামানের এই অরণ্য একটা ধূসর পর্দার নিচে হারিয়ে যেতে বসেছে। সমস্ত আকাশ জুড়ে সাদা কুয়াশার একটি চিকন রেখা দেখা দিয়েছে।

লখাই কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না, জঙ্গলে এই আরামের নোকরিতে পাঠিয়ে পাঠান পেটি অফিসার কোন দুয়ে মতলব হাসিল করতে চায়। নসিমুল গণির কথাই ভাবছিল সে। আর দেখছিল, রোদের তাপ জুড়িয়ে দিয়ে সব আলোটুকু নিবিয়ে বিরাট একটা কারসাজি করেই যেন বিকেলটা সন্ধে হয়ে যাচ্ছে।

হঠাৎ চমকে উঠল লখাই।

সারি সারি অনেকগুলো ঝুপড়ি। তাদের একটার ভেতর থেকে গোঙানির শব্দ আসছে। থেমে থেমে, টেনে টেনে অনেকক্ষণ পর পর কে যেন কাতরে উঠছে। করুণ, বিষণ্ণ অথচ ভয়ানক সেই কাতরানির শব্দটা কোন ঝুপড়ি থেকে যে আসছে, ঠিক ধরতে পারছে না লখাই।

কিছুক্ষণ কান খাড়া করে থাকে লখাই। শুধু কাতরানির শব্দই নয়, লখাইর মনে হল, দুর্বোধ্য ভাষায় কে যেন বিড় বিড় করে বকছে আর অনেকক্ষণ পর পর গোঙাচ্ছে। অদ্ভুত এক বিলাপের মতো শোনাচ্ছে ব্যাপারটা। চারপাশের নিঝুম জঙ্গলে বিলাপের রেশটা ছড়িয়ে পড়ছে।

তুষণাবাদের এই জঙ্গলে কালই এসেছে লখাই। এখানে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের এই ‘বীটে’ সারি সারি অনেকগুলো ঝুপড়ি। নিজেরটা ছাড়া অন্য কোনো ঝুপড়িতে এখনো ঢুকে দেখেনি লখাই।

লখাই উঠে পড়ল। খুঁজে খুঁজে ‘বীটে’র শেষ মাথায় এল। এখানকার ঝুপড়ি থেকেই গোঙানিটা আসছে। ঝুপড়িটা আশ্চর্য রকমের ছোট এবং নিচু। সামনের দিকে একটা ফোকর ছাড়া আলো এবং বাতাস চলাচলের অন্য কোনো ব্যবস্থা নেই।

ফোকরটা সুড়ঙ্গের মতো। একরকম হামাগুড়ি দিয়েই ভেতরে ঢুকল লখাই।

এক পাশে একটা লণ্ঠন জ্বলছে। লণ্ঠনের কাঁচ যে কতকাল সাফ করা হয়নি, কে তার হদিস দেবে। ফলে যত না আলো পাওয়া যাচ্ছে, তার চেয়ে ঢের বেশি ধোঁয়া। ঘোলাটে অনুজ্জ্বল খানিকটা আলো এবং প্রচুর ধোঁয়ায় ঝুপড়ির ভেতরে কিছুই স্পষ্ট নয়।

হঠাৎ তীক্ষ্ণ একটা স্বর শোনা গেল, কৌন? কৌন রে?

এবার এক কোণে একটা খাঁটিয়া দেখতে পেল লখাই। সেটার ওপর একজোড়া জ্বলন্ত চোখের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল।

এক-পা এক-পা করে খাঁটিয়াটার কাছে এগিয়ে এল লখাই। দেখল, বেঁটে আকারের একটা কঙ্কাল চিত হয়ে রয়েছে। কঙ্কাল হয়তো ঠিক নয়, মাংসহীন হাড়ের ওপর ঢিলে চামড়া আঁটা একটা দেহ। দেহটা শুকিয়ে কুঁকড়ে রয়েছে। কিন্তু এই শীর্ণ, শুকনো শরীরে দুটো চোখ এখনো টিকে আছে। চাপা, কুতকুতে চোখজোড়া অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ এবং অন্তর্ভেদী। লখাইর মনে হল, চোখ দুটো তার বুকের ভেতর সিধে ঢুকে গিয়ে তন্ন তন্ন করে সব কিছু দেখে নিচ্ছে।

খাঁটিয়ার লোকটা বলল, তুই কৌন? কেন ঢুকেছিস আমার ঝোঁপড়িতে? মজা দেখতে? আমি খতম হয়ে যাচ্ছি আর তুই–

হঠাৎ হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল লোকটা। শীর্ণ দেহ নিঙড়ে অতি দুর্বল, কাতর শব্দ ছাড়া কিছুই বেরুল না। লোকটা বিড় বিড় করে গালাগালি দিতে লাগল, শালে, কুত্তার বাচ্চে, হারামীর বাচ্চে, কেউ বাঁচবে না। এই আন্দামানবালা সবাই লোপাট হয়ে যাবে। আমাকে এখানে এনে বুখার দিয়ে খতম করছে শালেরা।

কাশির একটা প্রবল দমকে শরীরটা ধনুকের মতো বেঁকে গেল লোকটার। চোখ ঠেলে বেরিয়ে পড়েছে। কাশতে কাশতে উঠে বসল সে।

ঝুপড়ির আবছা রহস্যময় আলোতে লোকটাকে অমানুষিক দেখাচ্ছে। লখাইর বুকের ভেতরটা ছম ছম করে উঠল।

কেশে কেশে অনেকক্ষণ পর ধাতস্থ হল লোকটা। কুত্তার মতো জিভ বার করে টেনে টেনে হাঁপাতে লাগল। তারপর বকতে শুরু করল, কেউ জিন্দা থাকবে না, এংরাজলোক সবাইকে এখানে এনে মারবে। হাঁ–তুই দেখিস–

হঠাৎ যেন হুঁশ ফিরল। কেশে কেশে হয়রান হয়ে পড়েছিল। বুকে হাতের চাপ দিয়ে হৃৎপিণ্ডের মারাত্মক দাপাদাপিটা কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না সে। ধুঁকতে ধুঁকতে লোকটা আবার বলল, তুই কে?

আমি জবাবদার লখাই।

লিখাই! তুই এখানে! লোকটা যেন চমকে উঠল।

লখাই অবাক। লণ্ঠনের ঝাপসা আলোয় লোকটাকে চিনতে পারা যাচ্ছে না। কিছুতেই সে বুঝে উঠতে পারছে না, কোথায় কবে একে দেখেছে। কেমন করে এর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল।

লোকটা আবার বলল, আমাকে চিনতে পারছিস না লখাই! আমি মঙ চো।

মঙ চো!

হাঁ। তোর ইয়াদ নেই? একসাথ এক জাহাজে আমরা কালাপানির কয়েদ খাটতে এসেছিলাম।

আঁই হারামী, তুই মঙ চো!

হাঁ হাঁ, জরুর।

দুটো সমস্যার কোনো সুরাহাই করে উঠতে পারছে না লখাই। প্রথমত, আন্দামানের কয়েদখানায় যখন তারাদ্বীপান্তরী সাজা খাটতে আসে, তখন এই বর্মীটা দরিয়া দেখে ভয়ে কাঁদছিল। লখাইর কনুইর গুঁতো খেয়ে দুর্বোধ্য ভাষায় হাউ মাউ করে কী যে বলেছিল, বোঝা যায় নি। বর্মা মুলুকের ভাষা ছাড়া দুনিয়ায় অন্য কোনো ভাষার যে চল আছে, দু’মাস আগে তা জানত না মঙ চো। আশ্চর্য, সেই মঙ চোই দুমাসে আন্দামানী হিন্দুস্তানী বুলি রপ্ত করে ফেলেছে।

দ্বিতীয়ত, এলফিনস্টোন জাহাজের চার নম্বর হ্যাচের ওপর বসে যে মঙ চো কেঁদেছিল, সে এক তাগড়া বর্মী জোয়ান। তার চওড়া কাঁধে, পেশল বুকে, মাংসল দেহে অফুরন্ত শক্তি। তার মোঙ্গলসুলভ হলদে রঙে, খাড়া হনুতে অদ্ভুত এক কাঠিন্য ফুটে ছিল। এলফিনস্টোন জাহাজের সেই মঙ চো আর এই মঙ চোর মধ্যে কত তফাত! কিছুতেই দুই মঙ চোকে এক করে মেলাতে পারছে না লখাই।

লখাই বলল, তোর হাল এমন হল কেন মঙ চো?

ব্যারামে।

কী ব্যারাম? হলদে জ্বর। মঙ চো বলতে লাগল, সেলুলার কয়েদখানায় আসার দুরোজ বাদেই পেটি অফিসার আমাকে জঙ্গলের কাজে পাঠিয়েছে। এখানে এসেই ব্যারামে পড়েছি। এই দ্যাখ, শুকিয়ে চিমসে মেরে গেছি। আমি আর বাঁচব না লখাই। বলে একটু থামল মঙ চো। টেনে টেনে দম নিতে লাগল।

লখাই বলল, বাঁচবি না কেন?

এই ব্যারামে ধরলে কেউ বাঁচে না। কত কয়েদি যে এই জঙ্গলের কাজে এসে খতম হয়ে গিয়েছে, হিসেব নেই।

মঙ চো আর খাড়া বসে থাকতে পারল না। দড়ির খাঁটিয়ায় টান টান শুয়ে পড়ল। অনেকক্ষণ মড়ার মতো নিস্পন্দ হয়ে রইল সে। তারপর আস্তে আস্তে হাতের ভর দিয়ে ফের উঠে বসল। বলল, পালিয়ে যা লখাই। জান যদি বাঁচাতে চাস, এই জঙ্গল থেকে আজই ভেগে পড়। নইলে তোর হালও আমার মতো হবে।

লখাই শিউরে উঠল।

মঙ চো বলতে লাগল, পেটি অফসাররা বেছে বেছে তাগড়া তাগড়া তাগদদার কয়েদি জঙ্গলে পাঠায়। দু মাহিনার (মাসের মধ্যে তারা এই ব্যারামে পড়ে। পয়লা পয়লা হাত পা ফুলে হলদে হয়ে যায়। তারপর ব্যারামী কয়েদি চুপসোতে থাকে। শুকোতে শুকোতে আমার হাল হয়। আখেরে খতম হয়ে যায়।

সত্যি বলছিস?

জরুর সত্যি। ফায়া কসম। তুই নয়া এসেছিস। এখানকার জঙ্গলের হালচাল জানিস না। এই ব্যারামে পড়লে মরে যাবি, জরুর মরবি। আজই, এক্ষুনি পালা লখাই। নইলে

মঙ চোর কথা শেষ হওয়ার আগেই ডিম ডিম শব্দে টিকারা বেজে উঠল। কাল রাতেও এই টিকারার শব্দ শুনেছে লখাই। অরণ্যের কোন গভীর এলাকা থেকে যে এই শব্দটা উঠে আসছে, লখাই ঠিক বুঝে উঠতে পারল না।

ভয়ার্ত গলায় মঙ চো চেঁচিয়ে উঠল, জারোয়া, জারোয়া—

জারোয়া কী?

ল্যাংটো জংলী। তীর ধনুক নিয়ে তারা মানুষ খুঁড়ে মারে। যা লখাই, বাঁচতে হলে পালিয়ে যা। না হলে জংলী আর ব্যারামের হাত থেকে কিছুতেই রেহাই পাবি না। উন্মাদের মতো চেঁচায় মঙ চো।

কিছুক্ষণ বোবার মতো দাঁড়িয়ে রইল লখাই। তারপর গুঁড়ি মেরে বাইরে বেরিয়ে এল।

ডিম—ডিম–ডিম–

একসঙ্গে বিশটা টিকারায় যেন ঘা পড়ছে। গম্ভীর, ভীষণ শব্দটা অরণ্যের আত্মা থেকে উঠে এসে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে যাচ্ছে।

মঙ চোর ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে এসে চারদিকে তাকাল লখাই। কিন্তু কোত্থেকে যে টিকারার শব্দটা আসছে, কে জানে।

‘ফেলিং’ চলছিল। করাত কুড়াল ফেলে ভীত, সন্ত্রস্ত কুলি আর জবাবদাররা হল্লা করতে করতে ঝুপড়ির দিকে ফিরে আসছে, জারোয়া—জারোয়া–

জারোয়া—জারোয়া—

লখাইর পাশ দিয়ে ছুটতে ছুটতে কুলি জবাবদাররা যে-যার ঝুপড়িতে ঢুকে পড়ল। লখাই যে কী করবে, ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। মঙ চোর ঝুপড়ির সামনে উদ্ভ্রান্তের মতো দাঁড়িয়ে রইল।

অনেক আগেই সন্ধে পার হয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ আগের আবছা অন্ধকার গাঢ় হয়েছে। বিকেলে আকাশ জুড়ে কুয়াশার ফিনফিনে একটা পর্দা ছিল। সেই পর্দা এখন ঘন একটা স্তরের মতো এই দ্বীপের ওপর চেপে বসেছে।

আকাশের পুব থেকে পশ্চিম এক দল মৌসুমি হানাদার মেঘ চলেছে। মেঘে চিড় ধরিয়ে ফিকে ফিকে আবছা চাঁদের আলো এসে পড়েছে নিচে।

এখন কিছুই স্পষ্ট নয়। দক্ষিণ আন্দামানের এই অরণ্য আরো দুয়ে হয়ে উঠেছে। লখাইর মনে হল, রাত্রির এই অরণ্য কী এক সাঙ্ঘাতিক রহস্যকে যেন আড়াল করে রেখেছে।

ডিম—ডিম–ডিম–

সমানে টিকারা বাজছে। তার শব্দ, ফিকে ফিকে চাঁদের আলো, অস্পষ্ট জঙ্গল–সব মিলিয়ে অনিবার্য একটা কিছু ঘটতে চলেছে। লখাইর মনে হল, কিছুতেই তা ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। অন্তরাত্মা ছম ছম করতে থাকে লখাইর।

ডিম–ডিম–ডিম—

টিকারা বেজে চলেছে।

হঠাৎ বিরাট একটা থাবা এসে পড়ল লখাইর কাঁধে। চাপা কর্কশ স্বরে কে যেন বলল, নালায়েক বুদু কাহাকা, মরার ইচ্ছা হয়েছে!

সাঁ করে লখাই ঘুরে দাঁড়াল। দেখল, ফরেস্ট গার্ড আবর খান পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।

আবর খান এবার বলল, মরতে চাস?

না। লখাইর গলা দিয়ে অস্ফুট একটা শব্দ বেরুল।

তবে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? জলদি ঝুপড়িতে ঢোেক।

দুচোখে উভ্রান্ত, বন্য দৃষ্টি। তামাটে মুখটা রেখাময়। খাড়া চোয়াল, মাংসল গান, থ্যাবড়া নাক। মোটা মোটা আঙুলের ডগায় ভাঙা ভাঙা নখ। অবিন্যস্ত পিঙ্গল চুল সারা মাথায় ছড়িয়ে রয়েছে। এই হল আবর খানের চেহারা নমুনা।

কাঁধ ধরে টানতে টানতে সামনের একটা ঝুপড়ির ভেতর লখাইকে ঢুকিয়ে দিল আবর খান। ভাঙা নখগুলো মাংসল কাঁধে গেঁথে গিয়েছিল। চামড়া কেটে রক্ত বেরিয়েছে। এখন রীতিমতো জ্বালা জ্বালা করছে।

বাঁশের একটা মাচানে বসে পড়ল লখাই। পাশের মাচানে বসে আবর খান বলল, সন্ধের পর আর বাইরে থাকবি না লখাই।

কেন?

এ-সময় জারোয়ারা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসে।

ডিম—ডিম–ডিম—

এক তালে টিকারা বেজেই যায়।

লখাই বলে, কোথায় টিকারা বাজছে?

বুশ পুলিশের ক্যাম্পে।

বুশ পুলিশের ক্যাম্প কোথায়?

হুই যে–লখাইকে ঝুপড়ির ফোকরটার সামনে নিয়ে এল আবর খান। হাত বাড়িয়ে সামনের দিকটা দেখাল। অনেকটা দূরে অরণ্যের প্রান্ত ঘেঁষে ধোঁয়ার স্কুপের মতো কয়েকটা ঝুপড়ি দেখা যায়। গুটিকয়েক মশাল জ্বলছে। অন্ধকারে জমাট বাঁধা কয়েক ফোঁটা রক্তের মতো দেখায় মশালের আলোগুলোকে।

ডিম—ডিম—ডিম–

টিকারার বাজনা ক্রমশ জোরাল হয়ে উঠছে।

আবর ফের বলল, জঙ্গলে কোপ মারলেই জারোয়ারা খেপে ওঠে। জারোয়ারা এই জঙ্গলের বালবাচ্চা।

হঠাৎ বুশ পুলিশের ক্যাম্পের দিকে থেকে হল্লা উঠল হো-ও-ও-ও—

হো-ও-ও-ও–

অন্ধকার আর কুয়াশা ছিঁড়ে ছিঁড়ে মশালের আলোগুলো ক্রমাগত এদিক ওদিক ছুটছে। এতক্ষণ হল্লা শোনা যাচ্ছিল। আচমকা প্রাণফাটা চিৎকার উঠল। অ–মর গিয়া, মর গিয়া–

আবর খান উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল, জরুর জারোয়া।

লখাইর মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ল, জারোয়া!

হাঁ—হাঁ–। আবর খান এক লাফে বাইরে বেরিয়ে এল। তার সঙ্গে লখাইও বেরুল। আবর খান বলল, আমি যাচ্ছি।

লখাই আঁতকে উঠল, কোথায়?

বুশ পুলিশের ক্যাম্পে।

ওখানে জারোয়া এসেছে। মাত্ যাও–

আবর খান হাসল। বলল, আ রে মুরুখ, বিশ তিরিশ সাল আন্দামানের জঙ্গলে রয়েছি। জঙ্গলে থেকে থেকে আমি জংলী বনে গেছি। জংলীকে জংলী মারবে না। যা যা, তুই ঝুপড়ির অন্দর যা।

লখাইকে ঠেলে ঝুপড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে বেরিয়ে গেল আবর খান। তারপর ঊর্ধ্বশ্বাসে বুশ পুলিশ ক্যাম্পের দিকে ছুটল। মুহূর্তে কুয়াশা আর অন্ধকার এই আজব ভয়ডরহীন মানুষটাকে গ্রাস করে ফেলল।

এখন সকাল। গাঢ় কুয়াশার স্তরগুলি রোদের ঘা লেগে ছিঁড়ে যেতে শুরু করেছে।

আবর খান এসে ডাকাডাকি লাগাল, এ লখাই–লখাই হো—

কম্বলের মধ্যে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে ছিল লখাই। আবরের হাঁকাহাঁকিতে ধড়মড় করে উঠে বসল।

ইতিমধ্যে আবর খান ঝুপড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছে।

লখাই বলল, কী ব্যাপার খান সাহেব?

ওঠ, ওঠ-জলদি চল–লখাইর একটা হাত ধরে টানতে টানতে বুশ পুলিশ ক্যাম্পের দিকে ছুটল আবর খান।

ক্যাম্পটা ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ‘বীটে’র মতোই। বেতপাতার চাল, বাঁশের পাটাতন এবং বাঁশের বেড়ার গুটিকতক ঝুপড়ি ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে।

ক্যাম্পে এসে পড়ল লখাই আর আবর খান।

কাল রাত্তিরে এখানেই ডিম ডিম করে টিকারা বেজেছিল। এখানেই মশালের আলো দেখতে পেয়েছিল লখাই। এখান থেকেই প্রাণফাটা চিৎকার আর হল্লা উঠেছিল।

এই ক্যাম্পে আছে দশ জন বর্মী বুশ পুলিশ এবং একজন জমাদার।

ক্যাম্পের সামনে পুলিশের দঙ্গলটা জটলা করছে। ফিস ফিস করে দুর্বোধ্য ভাষায় কী যেন বলছে। একটি বর্ণও বুঝতে পারল না লখাই।

হঠাৎ লখাইর চোখে পড়ল, একটা কালো বেঁটে উলঙ্গ মানুষকে ঝুপড়ির একটা বাঁশের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা হয়েছে। দুচোখে উন্মাদ বন্য দৃষ্টি। হাতে-পায়ে লম্বা লম্বা, ধারাল নখ। এক দৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে মানুষটা। তার ছোট ছোট, চাপা চোখ ভীষণ আক্রোশে জ্বলছে। .

থেকে থেকে লোকটা কেমন এক ধরনের অস্ফুট শব্দ করে উঠছে।

লখাই বলল, ওটা কে?

আবর খান বলল, ওটাকে দেখাবার জন্যই তো তোকে নিয়ে এলাম। ও একটা জারোয়া, কাল রাতে ধরা পড়েছে।

ফরেস্ট গার্ড আবর খানের মতো মানুষ সারা জীবনে আর একটিও দেখে নি লখাই।

কতকাল ধরে দক্ষিণ আন্দামানের এই জঙ্গলে পড়ে রয়েছে, নিজেও বলতে পারবে না সে। দশ বছর? পনেরো বছর? বিশ বছর? না, সঠিক হিসেব দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। সভ্য ভব্য দুনিয়ার সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। তোমার আমার পৃথিবীতে যে-নিয়ম বা সময়ের মাপে বছর পূর্ণ হয়, সে নিয়ম বা মাপ জঙ্গলে খাটে না। জঙ্গলের নিয়ম কানুন আলাদা। জঙ্গলে থেকে থেকে সময়কে মিনিট-সেকেণ্ড-ঘণ্টা কি মাস বছর দিয়ে মাপজোখ করতে ভুলে গিয়েছে আবর।

লখাই যখন জিজ্ঞেস করে, কত বছর জঙ্গলে কাটল খান সাহেব?

আবর খান জবাব দেয়, দশ বিশ সাল হবে। কখনো বলে, পঁচিশ তিরিশ সালও হতে পারে।

কোন বছর, কত তারিখে বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে সাজা খাটাতে এসেছিল, একেবারেই মনে নেই আবর খানের। হাজার চেষ্টা করেও সে মনে করতে পারে না, কী অপরাধে তার দ্বীপান্তরী সাজা হয়েছিল।

দুনিয়া থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে আবর খান। পেছনের জীবনের বিশেষ কিছুই স্মৃতিতে নেই। মুলুক তার কোথায়, মালাবার না লুধিয়ানা, সঠিক খেয়াল করতে পারে না। জিজ্ঞেস করলে লাল লাল দাঁত মেলে উৎকট হাসি হাসে। বলে, জংলীর আরার মুলুক কী? জঙ্গলই আমার মুলুক। হাঃ হাঃহাঃ–

শুধু এটুকু মনে আছে, যখন সে আন্দামানে আসে, তখনো সেলুলার জেল বানানো হয় নি। ভাইপারদ্বীপের জেলে দু’মাস কয়েদ খেটে ফরেস্টের কাজে আসে আবর খান। প্রথমে ছিল কুলি, পরে জবাবদার। তারপর আর একটা পারমোশ (প্রোমোশন) পেয়ে এখন হয়েছে। ফরেস্ট গার্ড। এ ব্যাপারে তার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।

এত বড় দুনিয়ায় ইয়ারবন্ধু-রিস্তাদার, কেউ নেই আবর খানের। বেশি টাকা তার দরকার নেই। আর পারমোশও চায় না।

বিশ-তিরিশ বছর জঙ্গলে জঙ্গলে কাটিয়ে দিল আবর খান। এতগুলো বছরে বার পাঁচ-সাত মাত্র গিয়েছে পোর্ট ব্লেয়ারে। শহরে একদিনও তার মন বসে নি। শহুরে মানুষগুলোকে কেমন যেন আজব আজব লাগে। বহুকাল বছর আগের সেই শহরও কী আর তেমন আছে? পোর্ট ব্লেয়ারে কত নয়া নয়া কুঠি উঠেছে, টিলার গা বেয়ে কত সড়ক বানানো হয়েছে। পুরনো সেই শহরটা কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে। শহরের জমানা, কেতা, হালচাল-কেমন যেন দুর্বোধ্য ধাঁধার মতো মনে হয়েছিল আবর খানের। জঙ্গলে পালিয়ে এসে সে বেঁচেছে।

বছর কয়েক আগে শেষবারের মতো পোর্ট ব্লেয়ার গিয়েছিল আবর খান। দেখে এসেছে আটলান্টা পয়েন্টের মাথায় সেলুলার জেল বানানো হচ্ছে। তারপর আর যায় নি।

চারপাশে খাড়া খাড়া মাথা তুলে আন্দামানের জঙ্গল আবর খানকে বাকি দুনিয়া থেকে আলাদা করে রেখেছে। জঙ্গলের ওপারে শহরে বন্দরে, সভ্য মানুষের পৃথিবীতে, কোথায় কী ঘটছে, সে-সম্বন্ধে আদৌ তার মাথাব্যাথা নেই। সে-সম্পর্কে আবর খান একেবারেই উদাসীন।

লখাই হয়তো জিজ্ঞেস করে, খান সাহেব কি শাদি-উদি করেছ?

হাঁ তো। এই জঙ্গলের সাথ আমার শাদি হয়েছে।

তুমি বড় তামাশা কর খান সাহেব।

আরে, না না লখাই। এই জঙ্গলের সাথ জরুর আমার শাদি হয়েছে। বিবি বলিস, লেড়কা বলিস, আর ইয়ারবন্ধুই বলিস–এই জঙ্গলই আমার সব। তা না হলে এই জঙ্গল ছেড়ে দুনিয়ার কোথাও যেতে পারি না কেন?

আবর খানের গলাটা অদ্ভুত শোনায়। তার গাঢ়, ভারী, কাঁপা কাঁপা স্বরে এতটুকু তামাশা নেই। ধীরে ধীরে গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে কথাগুলো বলে যায় সে।

কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে অবাক তাকিয়ে থাকে লখাই। আবরের কথাগুলো বুঝতে চেষ্টা করে, কিন্তু সবটা বুঝতে পারে না।

সারাটা দিন কুলি খাঁটিয়ে, হাতি খাঁটিয়ে এবং জবাবদারি করে কাবার করে দেয় লখাই। ফুরসত পেয়ে যখনই সে ঝুপড়িতে ফেরে তখনই ঝোথেকে যেন আবর খানও এসে পড়ে। লোকটা যেন ওত পেতেই থাকে।

সে বলে, চল লখাই, তোকে জঙ্গল চিনিয়ে আনি।

চল।

ফুরসত পেলেই লখাইকে গভীর জঙ্গলে নিয়ে যায় আবর খান। ঘুরে ঘুরে গাছ চেনায়। কোনটা প্যাডক, কোনটা চুগলুম, কোনটা গর্জন–একে একে কত গাছ, কত লতাই না চিনে ফেলে লখাই!

জঙ্গলের মধ্যে ঢুকলে আবর যেন পাগল হয়ে যায়। অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে সে হাঁটতে থাকে। অন্য অন্য সময় আবর খানকে বুঝতে পারা যায়। কিন্তু জঙ্গলে ঢুকলে কী এক দুর্বোধ্য রহস্য যেন তার ওপর ভর করে বসে।

ফিস ফিস করে আবর খান বলতে থাকে, বুঝলি লখাই, জঙ্গলই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। জান-জমানা-জিন্দেগী–যা-ই বলিস, জঙ্গলই আমার সব।

একই ঝুপড়িতে আবর খান আর লখাই থাকে।

সারাদিন জবাবদারি করে প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে পড়ে লখাই। রাত্তিরে পাশের মাচানে শুয়ে শুয়ে জঙ্গল সম্বন্ধে কত মজার মজার কথাই না বলে আবর খান। বুশ পুলিশ ক্যাম্পে ডিম ডিম করে টিকারা বাজে। একসময় আবরের কথা আর টিকারার আওয়াজ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে লখাই।

কিন্তু আজ ঘুম আসছে না। রোঁয়াওলা কম্বলের নিচে কুণ্ডলী পাকিয়ে রয়েছে লখাই। কপালের দু পাশে দুটো অবাধ্য রগ সমানে লাফাচ্ছে। কিছুতেই তাদের বাগ মানানো যাচ্ছে না।

একটু আগে পর্যন্ত পাশের মাচান থেকে সমানে বকর বকর করেছে আবর খান। এখন একেবারেই চুপচাপ। খুব সম্ভব ঘুমিয়ে পড়েছে।

বুশ পুলিশ ক্যাম্পে টিকারার বাজনা কেমন যেন ঝিমিয়ে আসছে। কুলিদের ঝুপড়িতে গান-বাজনা কিংলা হল্লায় কেমন যেন ভাটা পড়েছে।

কম্বলের উষ্ণ আরামে চোখ বুজে ঘুমোবার চেষ্টা করল লখাই। কিন্তু না, কিছুতেই ঘুম আসছে না।

একবার বিবি বাজারের মোতি ঢুলানির কথা ভাবতে চেষ্টা করল লখাই। একবার সোনিয়াকে মনে করতে চাইল। কিন্তু না, এখন ভাবার মতো মনের অবস্থাই নয় লখাইর। আজ দারুণ খাটুনি গিয়েছে। পাঁচ দিন ধরে পঁচিশটা কুলি সমানে করাত চালিয়ে বিরাট একটা প্যাডক গাছকে আজ ধরাশায়ী করতে পেরেছে। তারই জবাবদারি করতে করতে গোটা একটা দিন লেগেছে।

আরো কতক্ষণ কেটে গিয়েছিল, লখাই বলতে পারবে না। হঠাৎ তার মনে হল, কোত্থেকে যেন সর সর শব্দ আসছে। মাথার ওপর থেকে কম্বলটা সরিয়ে ফেলল লখাই। দেখল, আবর খান পা টিপে টিপে ঝুপড়ির বাইরে চলে যাচ্ছে।

অনেকটা সময় পার হয়ে গেল। কিন্তু না, আবার ফিরল না। আন্দামানের এই ভয়ঙ্কর জঙ্গলে এত রাতে কোথায় গেল সে? মনের ভেতর হাজার তোলপাড় করেও একটা সদুত্তর খাড়া করতে পারল না লখাই। হঠাৎ তার মনে পড়ল, আন্দামানের জঙ্গলে রাত যখন নিস্তব্ধ হয়ে আসে, তখনই জংলী জারোয়ারা ‘বীটে’ এসে হানা দেয়।

জঙ্গল সাফ করে সভ্য মানুষ তার অধিকার বাড়িয়ে চলেছে। তার দাবির শেষ নেই। তার জঙ্গল নির্মূল হয়ে যাচ্ছে। এমনি করেই আদিম বাসিন্দাদের পৃথিবী দিনে দিনে নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে। জঙ্গল যত সাফ হচ্ছে, জংলীদের আক্রমণ আর প্রতিবাদ ততই বাড়ছে। বর্বর অরণ্যবাসীদের প্রতিবাদ বড় মারাত্মক। রাত্রি যখন গম্ভীর হতে থাকে, ঠিক তখনই তারা ‘বীটে’ হানা দেয়। ধারাল তীরের মুখে প্রতিবাদ জানায়।

জারোয়াদের কথা যতই ভাবছে, ততই দুজ্ঞেয় এক ত্রাস লখাইকে কাবু করে ফেলছে।

এখনো ফেরে নি আবর খান। অগত্যা উঠে পড়ল লখাই, এবং কখন যে ঝুপড়ির বাইরে বেরিয়ে এসেছে, খেয়াল নেই।

অন্য ঝুপড়িগুলোতে লণ্ঠন জ্বলছে। কুলিরা খানাপিনা এবং হল্লা, একসঙ্গে তিনটেই চালাচ্ছে। সব ঝুপড়িতেই একবার মুখ বাড়াল লখাই। না, কোথাও নেই আবর খান।

আবছা চাঁদের আলোয় খুঁজে খুঁজে শেষ পর্যন্ত আবর খানকে বার করল লকাই। পাঁচ দিন ধরে বিরাট একটা প্যাডক গাছকে খণ্ড খণ্ড করে কাটা হয়েছিল। একটা খণ্ডের ওপর উদ্ভ্রান্তের মতো বসে আছে সে।

লখাই চেঁচিয়ে উঠল, খান সাহেব—

আবর খান চমকে উঠল, কে?

একটু আগের সেই উদভ্রান্ত ভাবটা তার কেটে গিয়েছে। মুখ ঘুরিয়ে সে বলল, ও তুই, বস। বুঝলি লখাই, এই প্যাডক গাছটা আমার বিশ তিরিশ বছরের সাথী। পুরনো সাথীটাকে দেখতে এসেছিলাম। এক রোজ আমার হাল এটার মতোই হবে।

লখাই বলল, খান সাহেব, ঝুপড়িতে ফিরবে না?

কেন?

ফিস ফিস করে লখাই বলল, জারোয়া এলে–

অল্প একটু হাসল আবর খান। আস্তে আস্তে বলতে লাগল, তোকে তো হামেশাই বলি লখাই, বহু বছর জঙ্গলে থেকে আমি জংলী বনে গেছি। জংলীকে জংলীরা মারবে না।

কিছুক্ষণ চুপচাপ।

হঠাৎ এক কাণ্ড করে বসল আবর খান। লখাইর হাত ধরে একরকম টেনেই তুলল। বলল, দিনের জঙ্গল তো দেখেছিস। চল, আজ তোকে রাতের জঙ্গল দেখিয়ে আনি।

কিছু একটা বলতে চাইল লখাই। কিন্তু তার আগেই তাকে টানতে টানতে গভীর জঙ্গ লে ঢুকিয়ে ফেলেছে আবর খান।

দিনের আলো থাকতে থাকতেই কুলিদের সঙ্গে ‘বীটে’র ঝুপড়িতে ফিরে যায় লখাই। জারোয়ার ভয়ে সারারাত আর বেরোয় না। তাই রাতের অরণ্য সে কোনোদিন দেখে নি।

লখাই জানে না, কিন্তু আবর খান জানে, মুহূর্তে মুহূর্তে অরণ্যের রূপ বদলায়, চরিত্র বদলায়। সকালে যে অরণ্য শান্ত নির্বিকার, দুপুরে সে-ই আবার হিংস্র, রাত্রে দুজ্ঞেয় এবং রহস্যময়। বিশ তিরিশ বছর জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে এই বিচিত্র রূপ আর বিচিত্র চরিত্রের মধ্যে অরণ্যের আত্মাকেই বুঝি খুঁজে ফিরছে আবর খান।

জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দুজনে এগিয়ে চলে। একবার চড়াই, একবার উতরাই। টিলার পর টিলা। রাতের অরণ্য দু’টি মানুষকে কোথায় নিয়ে চলেছে, কে বলবে। অরণ্যের মনে কী আছে, কে জানে!

ডালপালা এবং পাতার ফাঁক দিয়ে চিকরি-কাটা আবছা আবছা চাঁদের আলো এসে পড়েছে। একটা চিতল হরিণ দুলে দুলে সামনে দিয়ে চলে গেল। কোথায় একটা রাত-অন্ধ তিরাপ পাখি ককিয়ে উঠল। ভিজে মাটির গন্ধ, বুনো ফুলের ঝাঁঝাল গন্ধ, রাত্রির গন্ধ–সব একাকার হয়ে নাক ধাঁধিয়ে দিচ্ছে।

একটু আগেও কুলিদের হল্লা শোনা যাচ্ছিল। বুশ পুলিশ ক্যাম্পে লণ্ঠনের মিটমিটে আলো চোখ পড়ছিল। এখন আর কুলিদের হইচই শোনা যাচ্ছে না, আলো দেখা যাচ্ছে না। চলতে চলতে শেষ পর্যন্ত কি দুটো মানুষ অরণ্যের অন্তরাত্মায় ঢুকে গেল?

এখানে পৃথিবীর আলো বাতাস-শব্দ, কিছুই পৌঁছয় না। এখানে পৃথিবীর মানুষ আসে । মানুষের শব্দে, স্পর্শে এই আদিম অরণ্যের শান্তি টুটে যায়।

অন্ধকারে জঙ্গলের স্পষ্ট আকার দেখা যায় না। চারপাশ থেকে তার স্পর্শ পাওয়া যায়, কিন্তু তাকে ঠিক বোঝা যায় না। দুর্বোধ্য ভাষায় অবিরাম সে যেন কী বলে! অরণ্যের রাত্রি বিচিত্র এক জাদুকরী। সে যেন আবর খানকে জাদু করেছে। কী এক নেশার ঘোরে কুঁদ হয়ে আছে সে।

যে মন নিয়ে জঙ্গলে পুঁদ হওয়া যায় তা হয়তো আবরের আছে, কিন্তু লখাইর নেই। অপরিসীম ভয় তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে। রাত্রির আবছা, দুর্বোধ্য জঙ্গল যতই সে দেখছে, ততই বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠছে।

গুছিয়ে, পারম্পর্য বজায় রেখে ভাবতে জানে না লখাই। চারপাশের জঙ্গল আকাশের দিকে খাড়া খাড়া মাথা তুলেছে। সেই জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে সে শিউরে উঠল। হয়তো তার মনে হল, এই বনভূমি আর এক সৃষ্টিছাড়া ফরেস্ট গার্ড–দুজনে কারসাজি করে তাকে ইয়ার-বন্ধু, নারী-নেশা-সুখ-উত্তেজনা–পৃথিবীর সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে।

চাপা গলায় লখাই ডাকল, খান সাহেব–

হাঁ–ঘোরের ভেতর থেকে জবাব দিল আবর খান। তারপর আর কোনো কথা নেই। তার সমস্ত চেতনাকে অরণ্য আবার গ্রাস করে ফেলল।

লখাই ফের ডাকল, খান সাহেব–

এবার চটকা পুরোপুরি ছুটে যায় আবর খানের। সে বলল, কী বলছিস লখাই?

ঝুপড়িতে ফিরব।

লখাইর মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে কী যেন বুঝতে চাইল আবার খান। শব্দ করে হাসল। বলল, ডর লাগছে?

হাঁ।

তবে চল।

‘বীটে’র দিকে ফিরতে ফিরতে আবর খান বলতে লাগল, বুঝলি লখাই, জঙ্গলের মতো শাস্তি তোকে কেউ দিতে পারবে না। পয়লা পয়লা জঙ্গলকে ডর লাগবে। আমার মতো বিশ তিরিশ বছর এখানে থাকলে বুঝবি, জঙ্গলের মতো খাঁটি দোস্ত আর নেই।

লখাই জবাব দিল না।

এবার আবর খানের স্বরে আক্ষেপ ফুটল, সিরকার মতলব করেছে, আন্দামানের জঙ্গল। সাফ করে গাঁও বসাবে, ক্ষেতি বানাবে। জঙ্গল সাফ হলে আমি যে কোথায় যাব!

চুপচাপ আবর খানের পিছু পিছু হাঁটতে লাগল লখাই।

ফরেস্টের এই ‘বীটে’ আরো কয়েকটা দিন কেটে গেল।

জবাবদারি করে, বন পুড়িয়ে, কুলি খাঁটিয়ে, হাতি খাঁটিয়ে সারাটা দিন শেষ করে ফেলে লখাই। খানাপিনার পর রাতে যতক্ষণ জেগে থাকে, বুশ পুলিশ ক্যাম্প থেকে টিকারার শব্দ শোনে। মশালের আগুন দেখে। চোখ বুজে এক-এক সময় বিবিবাজাজের মোতি ঢুলানির কথা ভাববার চেষ্টা করে। কখনো সোনিয়ার কথা মনে পড়ে তার।

কিন্তু মোতি চুলানি কি সোনিয়ার জন্য মনটা ঠিক আগের মতো বিকল হয় না লখাইর।

এক-একটা সময় আসে, মনটা যখন আশ্চর্য নিরাসক্ত হয়ে যায়। পৃথিবীর কোনো কিছুর জন্য তখন মোহ থাকে না, আসক্তি থাকে না। আজকাল লখাইর মনের অবস্থা অনেকটা এইরকম হয়ে পড়েছে। টাকাপয়সা, নেশা, নারী–কোনো কিছুর জন্যই সে ইদানীং অস্থির, উন্মাদ হয়ে পড়ে না। তেমনটা হলেই বা কী লাভ? এই জঙ্গলে কে তার নেশা যোগাবে, এখানে কোথায় মিলবে মেয়েমানুষ? জঙ্গলে আসার পর মনের দিক থেকে অনেকটা স্থিরতা এসেছে লখাইর। খুব সম্ভব শান্ত, অরণ্যক পরিবেশের একটা অমোঘ প্রভাব আছে। দক্ষিণ আন্দামানের এই অরণ্য আর ফরেস্ট গার্ড আবর খান লখাইকে অনেকখানি শান্ত করে ফেলেছে।

এই অরণ্য লখাইর অস্থির, উগ্র মনটাকে একটু একটু করে বুঝিবা একেবারেই জুড়িয়ে ফেলত। ঠিক এমন সময়েই এল উজাগর সিং।

ফরেস্ট অফিসার উজাগর সিংকে লখাই এর আগে দেখে নি। এমন যে ফরেস্ট গার্ড আবর খান, বিশ পঁচিশটা বছর যে আন্দামানের জঙ্গলে জঙ্গলে কাটিয়ে দিল, এখানকার সব কিছুই নিবিড় করে জানে, পয়লা পয়লা উজাগরকে সে-ও চিনতে পারে নি। কিন্তু উজাগর ঠিকই চিনেছিল আবর খানকে। শয়তানের চোখ তো!

শিখ উজাগর পাগড়ি সামাল দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল, তুমিই ফরেস্ট গার্ড?

আবর খান জবাব দিল, হাঁ, অফসার সাহিব।

তোমাকে কোথায় দেখেছি, মালুম হচ্ছে।

শান্ত, নির্বিকার স্বরে আবর খান বলল, জঙ্গলে বহুৎ সাল কাম-কাজ করছি। কোথাও দেখে থাকবেন।

না না, জঙ্গলে না।

কপালে ভাঁজ পড়ল উজাগরের। দাড়ির জঙ্গলে দু’হাতের দশটা আঙুল ঢুকিয়ে খামচে ধরল সে। কিছুক্ষণ এই অবস্থায় কাটল। হঠাৎ দুই হাত মাথায় তুলে চেঁচিয়ে উঠল, এবার ধরেছি। পঁচিশ সাল আগে তুমি আর আমি কালাপানির কয়েদ খাটতে এসেছিলাম। ইয়াদ আছে? উজাগর সিংয়ের স্মৃতি বড়ই তুখোড়। ঠিক চিনেছে। আস্ত দুশমন যে।

এবার একটু একটু মনে পড়ল আবর খানের। আন্দামানে তারা একই সঙ্গে, একই জাহাজে এসেছিল বটে। পঁচিশ বছর আগে দুজনেই ছিল দ্বীপান্তরের কয়েদি। এখন সে ফরেস্ট গার্ড, আর উজাগর ফরেস্ট অফিসার। দুজনের মধ্যে আসমানজমিন ফারাক। কিন্তু এই ফারাকটা এক কথায় ঘুচিয়ে দিল উজাগর সিং। তু মেরা দোস্ত আবর। সেই রোজগুলোর কথা মনে পড়ে? যখন দুই দোস্ত কয়েদখানায় পাশাপাশি বসে নারকেলের ছোবড়া ছিলে কুটে তার বার করতাম, হুইল ঘানি টানতাম, রম্বাস হেঁচতাম–

বিহ্বল স্বরে আবর খান বলল, অফসার সাহিব—

উজাগর খেঁকিয়ে উঠল, ছোড় তেরি অফসার সাহিব। আমি শালে উজাগর—

ফরেস্ট অফিসার দিন দশেক থাকবে তুষণাবাদের ‘বীটে’। জঙ্গল সার্ভে করে কাজের নির্দেশ দিয়ে যাবে। সেই অনুযায়ী ‘ফেলিং’ শুরু হবে।

নামেই ফরেস্ট অফিসার, আদতে জঙ্গলের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক নেই উজাগর সিংয়ের। বন-বিভাগের কানুন মানলে ফরেস্ট অফিসারকে জঙ্গলেই থাকতে হয়। কিন্তু কানুন মানছে কে? নিয়ম কানুনের বান্দা কোনোকালেই নয় উজাগর সিং। সারা বছর শহর পোর্ট ব্লেয়ারেই কাটায়। মাঝে মাঝে ‘ফেলিং’ কী সার্ভের সময় জঙ্গলে আসে।

আসার সময় পোর্ট ব্লেয়ার থেকে পেটি ভরে বিলাতি শরাব এনেছিল উজাগর সিং। পুরো দশ দিন এই জঙ্গলে কাটাতে হবে। ফুর্তি নেই, ফার্তা নেই, নাচাগানা নেই, সবচেয়ে যেটা আসল, সেই আওরতই নেই। চারদিকে পাহাড়ের চড়াই উতরাইতে খালি বন আর বন। গহীন, গভীর, নিরালোক, জটিল অরণ্য। দিদু আর প্যাডক, টমপিং আর গর্জন, পেমা আর জারুল গাছের জটলা। এর মধ্যে উজাগর সিংয়ের মতো দুর্দান্ত ফুর্তিবাজের দিন কাটে কেমন করে!

বিলাতি শরাবের দৌলতে নেশার অভাব মিটেছে। কিন্তু নারীসঙ্গহীন পুরো দশটা দিন এই জঙ্গলে কাটাতে হবে, এমন বিশ্রী ভাবনায় মেজাজ বিগড়ে ছিল। নারীমাংসের অভাব নেশা দিয়ে কতটা পূরণ করা যায়, সেই কথাই ভাবছিল উজাগর সিং।

আজ ঝুপড়িতে বসে সমস্ত সকাল নির্জলা দারু গিলেছে। থাবা থাবা ঝলসানো পাখির মাংস খেয়েছে উজাগর।

এখন দুপুর। খানাপিনার পর জঙ্গল সার্ভে করার কথা ছিল। সেই অনুযায়ী কুলি আর জবাবদারদের নিয়ে ফরেস্ট অফিসারের ঝুপড়ির সামনে এল আবর খান। বাইরে থেকে সে ডাকল, অফসার সাহিব–

কৌন মূর্তি রে?

আমি আবর জি—

সোল্লাসে হল্লা করে উঠল উজাগর, আরে, আও আও ইয়ার। অন্দর আ যাও—

ঝুপড়ির ভেতর চলে এল আবর খান। বাঁশের মাচানের ওপর জাঁকিয়ে বসে আছে। উজাগর সিং। চোখদুটো টকটকে লাল। মাচানের নিচে গোটা তিনেক শূন্য বোতল গড়াগড়ি খাচ্ছে।

উজাগরের হাতে একটা বোতল আধাআধি খালি। আবর খানের দিকে সেটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, পী লে ইয়ার–

নেহী জি, আমি দারু খাই না।

উজাগরের মুখচোখের হালচাল কেমন যেন বদলে গেল। এর চেয়ে আবর খান যদি তার শির বরাবর একটা ডাণ্ডা বসিয়ে দিত, এতটা অবাক অবাক হত না। শরাব খায় না, এ কেমন মানুষ! দিল্লাগী করছে না তো হারামীটা!

উজাগর আবার সাধল, লেও লেও ইয়ার, শরম ছোড় শালে—

নেহী নেহী, আপ দারু পী লিয়ে—

আরে ইয়ার, একা একা কি নেশা করা যায়! সাথী চাই, সাথী—

অফসার সাহিব, শরাব আমি বিলকুল খাই না। আমার কাছে শরাব হারাম।

শরাব হারাম! হেঃ-হোঃ-হো—খ্যা খ্যা করে বিকট শব্দে হেসে উঠল উজাগর সিং। হাসির তোড়ে বিরাট মাংসল ভুঁড়িটা দোল খেতে লাগল।

উজাগর বলল, এমন তাজ্জবের কথা শুনি নি। আ রে ইয়ার, শরাব হারাম না, আরাম। বহুৎ বহুৎ মজাদার আরাম–

আবর খান জবাব দিল না।

এবার খেঁকিয়ে উঠল উজাগর, উল্লু, বুদ্ধ, নালায়েক কাহাকা। শরাব না গিললে দিল মর্জি ঠিক থাকে? তবিয়ত আচ্ছা থাকে? সব বেচাল হয়ে যায় না?

আবর খান চুপচাপ বসে রইল।

উজাগর বলতে লাগল, কোনো কথা আমি শুনতে চাই না। একঠো সাথী চাই, নেশার সাথী। নেশার ব্যাপারে তুই তো শালে বুরবক। দেখি সাথী মেলে কিনা?

টলতে চলতে উঠে পড়ল উজাগর সিং। নেশার দাপটে নিজেকে খাড়া রাখতে পারছে না। মাচানের খুঁটি ধরে টাল সামলাতে সামলাতে সাথীর খোঁজে ঝুপড়ির বাইরে এল সে।

পিছু পিছু আবর খানও বেরিয়ে এল।

ঝুপড়ির সামনে কুলি আর জবাবদাররা দাঁড়িয়ে আছে। এদের সঙ্গে নিয়ে জঙ্গল সার্ভে করতে যাওয়ার কথা ছিল।

রোমশ ভুরু দুটো কুঁচকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেকক্ষণ ধরে কুলি জবাবদারদের পরখ করল উজাগর সিং। দুলতে দুলতে তাদের সামনে এসে বুক গর্দান এবং হাত টিপে টিপে দেখতে লাগল। খুব সম্ভব তারা কতটা মজবুত, নেশার ধাক্কা কতটা সইতে পারবে, টিপে টিপে এ-সবই আন্দাজ করতে চাইছে উজাগর।

একেবারে শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে ছিল লখাই। তার হাত টিপে বুকের সিনা দেখে উজাগর সিং বেজায় খুশি। লখাইকে খুব পছন্দ হয়েছে তার।

উজাগর বলল, তুই কৌন?

পেছন থেকে আবর খানই লখাইর হয়ে জবাবটা দিয়ে দিল, ও লখাই, ফরেস্টের জবাবদার।

বহুত আচ্ছা।

লখাইর একটা হাত চেপে ধরে উজাগর সিং। বলে, চেহারা নমুনা ভৈঁসের মতো করে ফেলেছিস। তা এই চেহারায় কী কী কাম পারিস?

জবাবদারি পারি, বোঙা (গাছের গুঁড়ি) টানতে পারি, করাত চালিয়ে

উজাগর সিং গর্জে উঠল, উল্লু, বুদ্বু, হারামী–এ-সব কামের কথা কে শুনতে চায়? শালের বাচ্চে, নেশা করতে পারিস?

অবাক হয়ে উজাগরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে লখাই। কী জবাব পেলে উজাগর খুশি হবে, বুঝতে পারছে না।

লখাইর মুখে বিরাট এক ঘুষি হাঁকিয়ে উজাগর সিং বলল, জবাব দিতে পারছিস না? আমার মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে কী দেখছিস শুয়ারকা বাচ্চা? উল্লু, নেশা করতে পারিস? শরাবের নেশা পারিস?

ঘুষি খেয়ে ঘুরে পড়েছিল লখাই। মুখে হাত বুলোতে বুলোতে উঠে দাঁড়াল। ফিস ফিস করে বলল, হাঁ, জি। ও তো–

ঠিক হ্যায় ইয়ার। লখাইকে জাপটে ধরে ঝুপড়ির ভেতর নিয়ে এল উজাগর। বলল, তু মেরে সাচ্চা দোস্ত।

লখাইকে একটা মাচানের ওপর বসিয়ে আবার বাইরে এল উজাগর সিং। কুলি জবাবদারদের নিয়ে আবর খান দাঁড়িয়ে আছে।

উজাগর বলল, আজ আর জঙ্গল সার্ভে হবে না। তোরা যা। বলেই ঝুপড়িতে ঢুকল সে। তারপর সামনের দিকের বাঁশের ঝাঁপটা টেনে বন্ধ করে দিল।

লখাইর জীবনে উজাগর সিংয়ের আবির্ভাব ঘটল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress