সিন্ধুপারের পাখি (Sindhuparer Pakhi) : 07
এখন আর সমুদ্রের দিকে তাকানো যায় না।
সৃষ্টির আদিকাল থেকে বঙ্গোপসাগরের কত লবণ যে মিশে রয়েছে, কেউ কোনোদিন মেপে দেখে নি। সমুদ্রজোড়া অফুরান নোনা জল এখন জ্বলছে।
এখন দুপুর। সকালে টিণ্ডালান, পেটি অফিসারনীদের পাহারায় রস দ্বীপের সিকমেনডেরায় (হাসপাতালে গিয়েছিল সোনিয়া। রোজই তাকে সুই (ইঞ্জেকশান) ফেঁড়াতে রসদ্বীপে যেতে হয়।
সকালে উপসাগর কত শান্ত ছিল। ছোট ছোট হালকা ঢেউগুলির মাথায় সোনালি রোদ দোল খাচ্ছিল। উড়ুক্কু মাছগুলি ফিনফিনে রুপোলি ডানায় জল কেটে সাঁই সাঁই ছুটছিল।
এখন সমস্ত চেহারাটাই আগাগোড়া বদলে গিয়েছে।
যতদূর তাকানো যায়, শুধু কোটি কোটি ঢেউয়ের মাথগুলি জ্বলতে থাকে। চারপাশের সমুদ্র ঘিরে একটা অদৃশ্য আগুনের স্রোত বয়ে চলেছে যেন। আন্দামানের আকাশে আজ এক টুকরো মেঘের চিহ্নমাত্র নেই। আশ্চর্য নীল আকাশটা ঝকঝক করে।
দুপুরের রোদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দরিয়ার তাপ বাড়তে থাকে।
রস দ্বীপ থেকে এইমাত্র মোটর বোটটা সাউথ পয়েন্ট কয়েদখানার জেটিতে এসে ভিড়ল!
এতক্ষণ কোনোদিকে নজর ছিল না সোনিয়ার। ঠোঁট দুটো কামড়ে দম বন্ধ করে একটা তীব্র যন্ত্রণার বেগকে সামাল দিচ্ছিল। দম আটকে থাকতে থাকতে ফুসফুসটা ফেটে যাবার দাখিল হয়েছে। দাঁতের চাপে ঠোঁটের মাংস কেটে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে। তবু যন্ত্রণাটা বশে আনতে পারছে না সে।
পেটি অফিসারনী এতোয়ারী সোনিয়ার কাঁধে হাত রাখল। কালো কালো, এবড়ো খেবড়ো দু’পাটি দাঁত মেলে হাসল। এতোয়ারীকে বেশ খুশি দেখাচ্ছে।
এভোয়ারীর দিকে নজর নেই সোনিয়ার। মুখও সে তুলল না, তুলতে পারল না। আসলে যন্ত্রণাটাই তাকে কাবু করে ফেলেছে।
আস্তে একটা ঠেলা মেরে এতোয়ারী বলল, এ সোনিয়া—
কাতর, অস্ফুট শব্দ ফুটল সোনিয়ার গলায়, হাঁ—
শালীর দিলে আজ বহুত ফুর্তি, তাই না?
সোনিয়া জবাব দিল না। ঘাড় গুঁজে দু হাতে পেটটা চেপে ধরল।
এ শালী, কথা বলছিস না কেন?
কী বলব?
দিলে তোর ফুর্তি জাগে নি?
কেন?
কেন! শালী নেকী, হারামী কাহিকা! দিল্লাগী করছিস?
না।
ইতিমধ্যে রশিম্যান দড়িদড়া দিয়ে মোটর বোটটাকে ক্যাপস্টানের সঙ্গে বেঁধে ফেলেছে।
এতোয়ারীর কাঁধে ভর দিয়ে টলতে টলতে রেণ্ডিবারিক কয়েদখানার ভেতরে এসে পড়ল সোনিয়া। তলপেটের সেই কষ্টটা কিছুতেই বাগে আনতে পারছে না সে। ফিনফিনে পাতলা চামড়ার তলায় চর্বি আর মাংস ডেলা পাকিয়ে যাচ্ছে। ডেলাটা একটু একটু করে শক্ত হয়ে উঠছে। তারপর সেই নিরেট, কঠিন মাংসের পিণ্ড সমস্ত তলপটে জুড়ে দূরন্ত বেগে ছোটাছুটি শুরু করেছে। ডেলাটা ওলট পালট খাচ্ছে, শিরা উপশিরাগুলো ছিঁড়ে খুঁড়ে ক্রমাগত পাক খেয়ে চলেছে। কিছুতেই, কোনো উপায়েই সেটা ঠেকানো যাচ্ছে না।
এতোয়ারীর এতক্ষণে যেন খেয়াল হল। উদ্বিগ্ন সুরে বলল, এ সোনিয়া, দরদ হচ্ছে?
হাঁ অফসারনী, পেটটা ছিঁড়ে পড়ছে।
কুঠরিতে চল, ডলাই মলাই করে দেব।
এই কদিনে এতোয়ারীর মনে কিছুটা মায়া জন্মে থাকবে। আন্দামানের পেটি অফিসারনীদে মন বলে কোনো বস্তু নেই। যদিও-বা থেকে থাকে তা রসকষহীন, নির্মম। সেখানে স্নেহ মমতার জায়গাই নেই।
আন্দামানে আসার আগে দু দুটো রেণ্ডিপাড়া চালিয়ে এবং সাউথ পয়েন্ট কয়েদখানায় বহু বছর পেটি অফিসারনীর কাজ করে কোমল ব্যাপারগুলো খুইয়ে বসেছিল এতোয়ারী। সোনিয়াকে দেখে, সোনিয়ার সঙ্গে মিশে কেন যেন এতদিন পর সেগুলো ফিরে পেয়েছে সে। নিজের অজান্তে কখন যে সোনিয়ার জন্য টান অনুভব করেছে, ভেবে পায় নি এতোয়ারী।
কুঠুরিতে এসে কড়ুয়া তেল গরম করে তলপেটে সইয়ে সইয়ে ডলে দিল এতোয়ারী। যন্ত্রণার দাপট অনেক কমে এল।
তারপর দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত একটানা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিল সোনিয়া। শরীরটা অনেক ঝরঝরে হয়ে গিয়েছে, তলপেটের ব্যথাটা মরেছে। বড় ভালো লাগছে সোনিয়ার।
মাথার চুলগুলো পিঠময় ছড়ানো। যতই ঘুমোক, দুপুর অব্দি যন্ত্রণার কারণে শরীর এখন বড় ক্লান্ত। শ্রান্ত ভঙ্গিতে কাত হয়ে শুয়ে রয়েছে সোনিয়া। আকাশ দেখছে। গোয়েলেথ পাখিগুলি শূন্যে সাঁতার কাটতে কাটতে আরো উঁচুর দিকে উড়ে যাচ্ছিল। কত ওপরে ওঠা যায়, তারই একটা প্রতিযোগিতা যেন চলছে তাদের মধ্যে। দেখতে বেশ লাগছে। বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপের বিকেলে মনটা বেশ হালকা হয়ে আছে সোনিয়ার।
এমন সময় আবার এল এতোয়ারী।
সোনিয়া ডাকল, এস অফসারনী।
কম্বলের খুঁটটা টেনে সোনিয়ার পাশে বসে পড়ল এতোয়ারী। নরম গলায় বলল, আমার একটা কথা রাখবি সোনিয়া?
কী কথা?
আজ থেকে আমাকে অফসারনী বলে ডাকবি না।
তবে কী বলে ডাকব?
বহীন বলে ডাকবি। আমি তোর বড়ী বহীন। ডাকবি তো?
হাঁ।
খুদার নামে তিন কসম খা।
তিন কসম খেলাম।
আজ থেকে আমরা বহীন।
বলতে বলতে দু হাতে সোনিয়াকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে এতোয়ারী। উষ্ণ, বিরাট বুকের ভেতর আরামে চোখ বুজে আসে সোনিয়ার।
পাঠান জেনানা এতোয়ারীর আজ যেন কী হয়েছে! তার কথা ভাবতে ভাবতে তাজ্জব বনে যায় সোনিয়া।
কিছুক্ষণ পর সোনিয়াকে ছেড়ে দিল এতোয়ারী। কোত্থেকে দুটো রেশমী কালো ফিতে জুটিয়ে এনেছিল। মোগলাই ছাঁদে সেই ফিতে দিয়ে সোনিয়ার চুল বেঁধে দিল। তারপর সোনিয়ার মুখটা ডাইনে বাঁয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে মুগ্ধ গলায় বলল, বহীন, তুই বড়ী খুবসুরতী। তোর মাফিক সোন্দর কয়েদানী আন্দামানে কোনোদিন আসেনি।
সোনিয়া জবাব দিল না।
অনেকটা সময় নীরবে কেটে যায়।
তারপর এতোয়ারীই প্রথম শুরু করল। রসদ্বীপ থেকে ফেরার সময় দুপুরে যে-কথাটা জিজ্ঞেস করে জবাব পায়নি, সেটাই নতুন করে পাড়ল, আজ তোর দিলে বহুত ফুর্তি, তাই না সোনিয়া?
কেন? সোনিয়া পালটা প্রশ্ন করল।
ছোঁকরি, নখরাবাজি করিস না।
সোনিয়ার দুটো গাল টিপে ধরে, টেনে টেনে, রসিয়ে রসিয়ে, এতোয়ারী বলে, ডাক্তার সাব তোকে শাদির কথা বলেছে না? তোর শাদি করা দরকার, শাদি না করলে ব্যারাম সারবে না।
অনেক দিনের পুরনো ব্যারাম নিয়ে আন্দামানে এসেছিল সোনিয়া। মুলুকে থাকতেই তলপেটটা যন্ত্রণায় চিন চিন করত। চর্বি এবং মাংসের একটা শক্ত পিণ্ড পেটের নাড়িগুলি ছিঁড়ে ফেঁড়ে ছুটে বেড়াত।
মুলুকে থাকতে সিকমেনডেরায় গিয়ে রোগটা সারায় নি সোনিয়া। ব্যথা উঠলে দাঁতে দাঁত চেপে সামাল দিতে চেষ্টা করেছে। না পারলে বেহুঁশ হয়ে পড়েছে। তবু হাসপাতালে যায়নি। হাসপাতাল সম্বন্ধে অহেতুক এক ভয় ছিল সোনিয়ার মনে।
একদিন দ্বীপান্তরের সাজা নিয়ে আন্দামানে এল সোনিয়া। মুলুকে থাকতে যে-ব্যারামটাকে পুষে রেখেছিল, বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে এইদ্বীপে আসার পর সোনিয়ার সেই ব্যারামটা বিশগুণ চাগিয়ে উঠেছে। রসদ্বীপের হাসপাতালে রোজ রোজ সুঁই নিয়েও কোনো সুরাহা হচ্ছে না। যন্ত্রণা বেড়েই চলেছে।
আজ ডাক্তার সাব বলেছে, সুই (ইঞ্জেকশান) কিংবা দাওয়াইতে সোনিয়ার এই ব্যারাম সারবার নয়! সাময়িক উপশম হতে পারে। এর জন্য দরকার পুরুষসঙ্গ। শাদি না করলে মরদ মিলবে না, মরদ না হলে এই ব্যারামও ঘুচবে না। ডাক্তার সাব সোনিয়ার শাদির সুপারিশ করে ডেপুটি কমিশনারের অফিসে চিঠি পাঠিয়েছে। তার নসিব বড় ভাল। তা না হলে আন্দামানের কয়েদখানায় মাত্র পঁচিশ তিরিশ রোজ কাটিয়ে কেউ কি শাদি করার হুকুম পায়!
এতোয়ারী বলল, তোর শাদি হয়ে যাবে সোনিয়া। রেণ্ডিবারিক কয়েদখানা থেকে তুই চলে যেতে পারবি। লেকিন আমি কোনোদিন এখান থেকে বেরুতে পারব না বহীন। এখানেই আমার জমানা শেষ হয়ে যাবে, জিন্দেগী ফৌত হয়ে যাবে। চান্নু সিংয়ের সঙ্গে শাদি খারিজ করে বড় ভুল করেছি বহীন। ভুলটা কোনোদিন শোধরাতে পারব না। তকদিরটাই আমার খারাপ।
এতোয়ারীর মুখেচোখে করুণ আক্ষেপ ফুটে বেরোয়। বুকটা তোলপাড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। দেখেশুনে মনটা যেন কেমন করে ওঠে সোনিয়ার। এতোয়ারীর একটা হাত বুকের মধ্যে টেনে আস্তে আস্তে সে বলে, ভাবিস না বহীন, দিলকে তকলিফ দিস না। তোরও ফের শাদি হবে। কয়েদখানা থেকে তুইও ছুটা পাবি।
না না, বিলকুল ঝুট। যত রোজ বেঁচে থাকব, আমাকে এই দোজখেই (নরকেই) থেকে যেতে হবে।
পাঠান জেনানা এতোয়ারী হাউ হাউ করে কাঁদে। তার সমস্ত আক্ষেপ এবং বেদনা বুক মুচড়ে দিয়ে চোখ ফেটে নোনা জল হয়ে ঝরতে থাকে।
অনেকক্ষণ কেউ কথা খুঁজে পায় না।
একসময় কামিজ দিয়ে চোখ মুছে এতোয়ারী বলে, মঙ্গলবার শাদির প্যারিড (প্যারেড) হবে। মনে আছে?
হাঁ–
চান্ন সিং আসবে—
চোখ নামিয়ে সোনিয়া আস্তে উত্তর দেয়, হাঁ–
সোনিয়ার থুতনিটা ধরে নাড়তে নাড়তে এতোয়ারী শব্দ করে হাসে। বলে, চান্নুর নাম শুনেই আঁখ নামালি! এ শরমবালি, আঁখ তোল।
সোনিয়া মুখ তোলে।
এতোয়ারী বলতেই থাকে, মনে রাখিস সোনিয়া, মঙ্গলবারে চান্নু আসবে। তার শিরে লাল সাফা (পাগড়ি) থাকবে, হাতে লোহার কাঙনা থাকবে। সফেদ কাপড়-কুর্তা পরে চান্নু আসবে।
সোনিয়া জবাব দেয় না।
রোদের রং মরে আসে। আন্দামানের আকাশ অস্পষ্ট হয়ে যায়। অশান্ত উপসাগরের গর্জন ক্ষীণ হয়ে আসতে থাকে। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে।
আরো কিছুক্ষণ পর সোনিয়াকে একা রেখে এতোয়ারী উঠে পড়ে।
নিজের মনের গতিক বুঝে উঠতে পারছিল না সোনিয়া। কী সে করবে, কী তার করা উচিত, সব যেন গুলিয়ে যাচ্ছে।
ঘাড়টা কাত করে আকাশের দিকে তাকিয়ে সোনিয়া ভাবতে থকে।
মনের ওপর দিয়ে দমকা বাতাসের ঝাঁপটানির মতো অনেকগুলো শিথিল, টুকরো টুকরো ভাবনা এলোমেলো ভেসে বেড়াচ্ছে। একটা ভাবনার সঙ্গে অন্যটার মিল নেই, যোগ নেই, পারম্পর্য নেই। আবার মনে হয়, ভাবনাগুলো একটা অখণ্ড চিন্তার ভিন্ন ভিন্ন অংশ। একটার সঙ্গে অন্যটার আশ্চর্য মিল রয়েছে, যোগ রয়েছে, সঙ্গতি রয়েছে।
ডাক্তার সাবের একটা মাত্র কথায় চারদিক থেকে এতগুলো ভাবনা যে তাকে ঠেসে ধরবে, আজ সকালে রস দ্বীপে সুই (ইঞ্জেকশান) নিতে যাওয়ার আগে কি একবারও ভেবেছিল সোনিয়া? তাকে শাদি করতে হবে। নইলে ব্যারাম সারবে না!
আন্দামানের আকাশটা অন্ধকার হয়ে আসে। মিটমিটে অসংখ্য তারা দেখা দেয়। রস দ্বীপ থেকে সার্চ লাইটের তীব্র আলো এসে পড়ে উপসাগরে। মনে হয়, বিরাট একটা আলোর বল্লম সিসোস্ট্রেস উপসাগরের ওপর দিয়ে রসদ্বীপ আর পোর্ট ব্লেয়ারকে গেঁথে রেখেছে।
আন্দামানের রাত্রির মহিমা বোঝা বড় দুরূহ ব্যাপার। দুর্বোধ্য, দুজ্ঞেয়, বিচিত্র এই রাত।
রাতের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হঠাৎ সেই মরদটার কথা মনে পড়ে সোনিয়ার। সেই মরদটা–যে বিশ বিশটা ভঁইস চরাত, লোটা লোটা সিদ্ধি খুঁটে ঢক ঢক করে গিলত, মাঝরাত পর্যন্ত বাজখাঁই বদখত গলায় গান গাইত, বেলা দুপুর পর্যন্ত রশির খাঁটিয়ায় ভোঁস ভোঁস করে ঘুমতো। সেই মরদটা, যার নাম রামদেও তিওয়ারী। সেই মরদটা, যে তার হাতে জান দিয়েছে। সেই মরদটা, আন্দামানে এসেও যাকে ভোলা যায় না, যার স্মৃতি হাজার মাইল বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে তার দিল বিকল করে ফেলে। সেই মরদ–যে বেদরদী, বেতমীজ, শয়তান!
আশ্চর্য, ডাক্তার সাব শাদির কথা বলার পর থেকে রামদেও-এর মুখটাই ঘুরে ঘুরে মনে আসছে। কেন এমন হয়? ঠিক বুঝে উঠতে পারে না সোনিয়া। রামদেও তিওয়ারীর সঙ্গে ব্রিজলালের কথাও মনে পড়ে। সেই ব্রিজলাল, বাজপাখির ঠোঁটের মতো বাঁকানো যার নাক, পাকানো শরীর, দুমড়ানো পিঠ, ধারাল চোখ, সোনা বাঁধানো দাঁত, গলায় চুনোট-করা চাদর, চোখের কোলে ব্যভিচারের কালচে স্তর-পুরোদস্তুর রইস আদমী। সেই ব্রিজলাল যার কথায় সে রামদেও-এর চাপাটিতে ধুতরোর বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল।
রামদেও আর ব্রিজলালের কথা ভাবে সোনিয়া। তার চোখ দুটো ধিকি ধিকি জ্বলে। ডাক্তার সাব শাদির কথা বলেছে, অথচ দুটো আদমীর একটাও আজ বেঁচে নেই। রামদেও মরেছে। আর ব্রিজলাল? নরকের কুত্তাটা কত লোভ দেখিয়েছিল, কত মজাদার কথা বলেছিল। পাটনা শহরে নিয়ে তাকে পাক্কা মকানে রাখবে, আচ্ছা আচ্ছা মিঠাই খাওয়াবে, রেশমি কাপড় পরাবে, বায়োস্কোপের খেল দেখাবে, তাকে শাদি করবে। কত খোয়াবই না দেখিয়েছিল হারামীটা! রামদেও মরার পর সেই যে ব্রিজলাল ভাগল, আর পাত্তাই মিলল না।
হঠাৎ ভাবনাটা অন্য খাত বেয়ে চলল। একটু আগে এতোয়ারী বলে গিয়েছে, মঙ্গলবার শাদির প্যারেডের সময় চান্নু সিং আসবে। সেই চান্নু সিং যে তার জন্য পুলিশের ডাণ্ডা খেয়ে অনেক খুন দিয়েছে। চান্নু সিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে লখাইর কথাও মনে পড়ল। এলফিনস্টোন জাহাজে গোটা একটা রাত তার পাশে কাটিয়েছে সোনিয়া। ঝড়ের দরিয়ার সেই সাথীটাকে কিছুতেই ভোলা যাচ্ছে না।
ভাবতে ভাবতে মাথা গরম হয়ে ওঠে সোনিয়ার। শেষ পর্যন্ত তার মনে হয়, প্রাণ বাঁচাতেই হবে। এক উন্মাদ তাড়নায় সোনিয়া ঠিক করে ফেলে, যাকে হোক শাদি করে ফেলবে। আবার মনে হয়, শাদি করবে কাকে?
হঠাৎ রামদেও, ব্রিজলাল, লখাই, চান্নু সিং–সকলের ওপর ভয়ানক খেপে ওঠে সোনিয়া। এই দ্বীপ, এই দরিয়া, এই দুনিয়ার সমস্ত কিছুর ওপর অদ্ভুত আক্রোশে মনটা ভরে যায়। কপালের দু’পাশে দুটো অবাধ্য রগ সমানে লাফায়। রগদুটো টিপে ধরে বাইরে তাকায় সোনিয়া।
বাইরে আন্দামানের রাত্রি রহস্যময় হতে থাকে।
গারাচামারা গাঁওয়ে রাত্রি নামল।
অন্ধকারে ডি-কুনহার কুঠিবাড়িটার নির্দিষ্ট আকার মুছে গিয়েছে। বর্মী প্যাগোডার মতো বাড়িটা এখন অস্পষ্ট স্তূপের মতো দেখায়।
সামনের নারঙ্গী গাছে একটা রাত-অন্ধ বাদক পাখি ককিয়ে ককিয়ে ডাকতে থাকে। বিকট শব্দ করে হরিণের পাল পাহাড় থেকে উপত্যকায় নেমে আসে। অরণ্যের দিক থেকে বন-ধুতরোর ঝাঁঝাল গন্ধ ভেসে আসতে থাকে।
ডি-কুনহার কুঠিতে ছোট একটা লণ্ঠন জ্বলছে। নীলচে রঙের মৃদু আলোটা ঘিরে পাঁচটা মাথা গোল হয়ে বসেছে।
পাঁচজনের একজন ডি-কুনহা। একজন ফাই মঙ বর্মী, এবারডিন বাজারে যার কাঠ আর বেতের আসবাবের দোকান। একজন পল, মালয়ী খ্রিস্টান। একজন ইন্দোচিনি, বাকি লোকটা জাহাজের সারেঙ-নোয়াখালি জেলার মুসলমান। নাম সোনা মিঞা।
নিচু গলায় তাদের কথা হচ্ছে। মাঝে মাঝে পাঁচটা মাথা ঝুঁকে পড়ে এক হয়ে যাচ্ছে। কী এক দুয়ে মতলব হাসিল করতে পাঁচটা মানুষ ডি-কুনহার কুঠিবাড়িতে জড়ো হয়েছে, কে বলবে।
ডি-কুনহা বলল, কি সোনা মিঞা, আবার যে দরিয়ায় এলে! সেবার মুলুকে ফিরবার সময় না বলে গেছলে, আর কোনোদিন জাহাজে উঠবে না! খুদার নামে কটা কসম খেয়েছিলেল?
সোনা মিঞা মানুষটা জবর শৌখিন। চোখা নুর, হাতের পাতায় মেহেন্দি মাখা, চোখের কোলে সুর্মার নিপুণ টান। কলিদার কুর্তা থেকে আতরের খুশবু ছুটছে। পান খেয়ে ঠোঁট লাল করেছে, সুগন্ধি মশলার গন্ধ বেরুচ্ছে। মাথায় নকশি-কাটা ফেজ।
সোনা মিঞা জবাব দিল না। অল্প একটু হাসল।
ডি-কুনহা বলল, তামাম জিন্দেগী দরিয়ায় দরিয়ায় ভেসে মাটিতে বুঝি মন বসে না মিঞা সাহেব?
হ, খাঁটি কথা কইছেন।
মাথা নেড়ে সায় দেয় সোনা মিঞা। সোনা মিঞা যত কথা বলে, তার চেয়ে অনেক বেশি হাসে। যত হাসে, তার বহুগুণ মাথা নাড়ে।
ডি-কুনহা বলল, জাহাজীর কাছে দরিয়াই ঘর, দরিয়াই কবর। দরিয়ার টান ঠেকানো কি সোজা কথা! কী বল মিঞা?
হ, বড় খাসা কথা কইছেন।
যথারীতি প্রচুর হাসে সোনা মিঞা।
একটু আগের প্রশ্নটাই আবার করে বসে ডি-কুনহা, তবে আবার যে দরিয়ায় এলে সোনা মিঞা?
ঘর-সোংসার দিলেরে বশ করাইতে পারল না ডি-কুনহা সাহেব। করাইবই বা ক্যামন কইরা?
কিরকম?
চারপাশ থেকে ইয়ারেরা ঘন হয়ে আসে।
দরিয়ার মানুষের একটা বিচিত্র ভাষা আছে। ইন্দোচিনি হোক, মগ হোক, মালয়ী হোক, জাভানিজ হোক–সকলেই সেটা বোঝে। জিন্দেগীর বিশ পঁচিশটা বছর দরিয়ায় দরিয়ায় কাটিয়েও সেই ভাষা পুরোপুরি রপ্ত করতে পারেনি সোনা মিঞা। পয়লা পয়লা তার ধারণা ছিল, তাবত দুনিয়ায় একটি মাত্র বুলি চালু আছে। সেটি নোয়াখালি জেলার বিচিত্র বাংলা বুলি। জাহাজীর কাজ নিয়ে যেবার প্রথম নোয়াখালি ছেড়ে আকিয়াব গেল সোনা মিঞা, সেবারই তার মনে হয়েছিল, দুনিয়াটা এক আজব কারখানা বটে! এখানে কত ধরনের মানুষ, কত রকম তাদের মুখের ভাষা! তার লোখাজোখা নেই।
তামাম জীবনে জাহাজে জাহাজে সমস্ত দুনিয়া ঘুরেছে। মোম্বাসা গিয়েছে, পোর্ট ভিক্টেরিয়া গিয়েছে, পোর্ট এডেন, ম্যাডাগাস্কার, সিঙ্গাপুর, কলম্বো, সুয়েজ, পোর্ট ইসমাইলিয়া-কত বন্দরে যে তাদের জাহাজে ভিড়েছে, কে তার হিসেব রাখে। সব মনেও নেই সোনা মিঞার।
প্রথম দিকে কসম খেয়ে জেদ ধরেছিল সোনা মিঞা, নোয়াখালি জেলার বঙ্গ বুলিটি ছাড়া গলা দিয়ে আর কিছু বার করবে না। জাহাজীর কাজ নিয়ে আকিয়াব যাওয়ার সময় বাপজান বলে দিয়েছিল, গলা দিয়ে হারাম খাবার নামাবে না, গলা দিয়ে হারাম বুলি বার করবে না।
বাপজানের কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে সোনা মিঞা। হারাম খানা খায় না, হারাম, জ্ঞানে অন্য বুলি দূরে ঠেকিয়ে রাখে।
কিন্তু দরিয়ার প্রতাপ বড় সাঙ্ঘাতিক। ধীরে ধীরে কখন যে সমুদ্র তার নিজের আদত বুলিটা প্রায় ভুলিয়ে দিয়েছে, সোনা মিঞা আদপেই টের পায়নি। নোয়াখালি জেলার টান দেওয়া সেই জাহাজী ভাষা সোনা মিঞার গলায় কি বিচিত্ৰই না শোনায়!
চারপাশ থেকে ইয়ারেরা হেঁকে ধরে, কিরকম, কিরকম?
ফেজটি খুলে মাথার ঠিক চাদির ওপর সই করে বসাল সোনা মিঞা। তারপর ঢিমে চালে বলে, ভাইজানেরা, পুরা জিন্দেগী দরিয়ায় দরিয়ায় ঘুরেছি। পোর্ট এডেনের সুন্দরীদের দেখেছি, পোর্ট ইসমাইলার ডানাকাটা পরীদের দেখেছি, জাভার খুবসুরতীদের দেখেছি। তামাম পোর্টের সুন্দরীদের গায়ের ওম (উত্তাপ) আমার গায়ে লেগে রয়েছে। এই বয়েসে মুলুকে ফির্যা বুড়া পেচীর নাখান (মতো) এক বিবি নিয়া লেপ মুড়ি দিতে হয়! কপালে এত দুঃখুও আছে!
সোনা মিঞা কপাল চাপড়ায়।
চুক চুক চুক–চারপাশ থেকে ইয়ারেরা কপট আপশোশ জানায়।
সোনা মিঞা বলতেই থাকে, সুন্দরীদের টানে মুল্লুক ছেড়ে আবার দরিয়ায় ভাসলাম।
ফেজটি ফের খোলে সোনা মিঞা। ফের চাদির ওপর বসায়। কিছুতেই আর টুপি পরা পছন্দ হয় না।
বহুত আচ্ছা, বহুত আচ্ছা—
ইয়ারেরা চিল্লাতে চিল্লাতে, হাসতে হাসতে হল্লা বাধিয়ে দেয়।
খানিক পর হল্লা থামে। লণ্ঠনটাকে ঘিরে পাঁচটা মাথা এক হয়ে আসে। ফিস ফিস কথা আবার শুরু হয়।
বাইরে রাত্রি আরো গাঢ় হয়েছে। অরণ্য কুঁড়ে খ্যাপা বাতাস ছুটে আসছে। নারঙ্গী গাছের মাথায় সেই রাত-অন্ধ বাদক পাখিটা একটানা ককিয়ে চলেছে। বকরা হরিণের পাল পাহাড় থেকে একেবারে ডি-কুনহার বাগিচায় এসে ঢুকে পড়েছে।
চাপা গলায় ডি-কুনহা বলল, সোনা মিঞার জাহাজ এবার কোথায় যাবে?
পোর্ট ভিট্টোরিয়া।
মাদ্রাজ থেকে সোনা মিঞার জাহাজ পোর্ট ভিক্টোরিয়া রওনা হয়েছিল। বঙ্গোপসাগরের মধ্যপথে জাহাজের কলকজা বিগড়ে যাওয়ায় পোের্ট ব্লেয়ারে নোঙর গাড়তে হয়েছে। দুপাঁচ দিনের মধ্যেই সেই জাহাজ এখান থেকে চলে যাবে।
রাত্রির অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে গারাচারামায় ডি-কুনহার কুঠিবাড়িতে চলে এসেছে সোনা মিঞা। মনে মনে একটা মতলবও ভাজা আছে তার। ডি-কুনহা তার পুরনো দোস্ত। তার সঙ্গে অনেক কালের কাজ-কারবার। পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বন্দরগুলোতে যাওয়ার পথে জাহাজ যদি পোর্ট ব্লেয়ারে ভেড়ে, সোনা মিঞা একবার অন্তত ডি-কুনহার কুঠিবাড়িতে আসবেই।
ডি-কুনহা বলল, পোর্ট ভিক্টোরিয়া তো যাচ্ছ, কিছু মাল নেবে মিঞা সাব?
হাঁ হাঁ, মালের খোঁজেই তো আসেছি। আছে কিছু?
আছে আছে। গলাটা ঝুপ করে খাদে নেমে যায় ডি-কুনহার, লেকিন খুব সাবধান দোস্ত। তুমি তো অনেকদিন পোর্ট ব্লেয়ারে আসোনি। এখানে এখন বহুত কড়াকড়ি। পুলিশ আমার ওপর নজর রেখেছে। ধরা পড়লে কী হবে, বুঝতেই পারছ–
আরে পুলিশের কথা ছাড়ান দাও।
মুখে চোখে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি ফোটে সোনা মিঞার। কাঠের দেওয়ালে একদলা থুতু ছুঁড়ে সে বলে, এক বন্দরের মাল আর এক বন্দরে খালাস কইরা মাথার চুল পাকাইয়া ফ্যালোম। এই বয়েসে পুলিশের ডর দেখাইও না।
তোমাকে আমি চিনি ইয়ার। তোমার মাফিক হুঁশিয়ার আদমী খুব কম দেখেছি। তবু একটু সাবধান থাকতে হবে।
সোনা মিঞা জবাব দেয় না।
ডি-কুনহা বলে, কী মাল চাই?
আওয়া-বিল পাখির বাসা আর কোকেন।
কতটা দেব?
এক এক কিসিমের মাল পাঁচ পাউন্ড কইরা, মোট দশ পাউণ্ড।
ঠিক আছে। একটু ইতস্তত করে ডি-কুনহা বলে, লেকিন একটা কথা। তুমি সাচ্চা দোস্ত, তোমাকে আমি পুরা বিশ্বাস করি। তবু দামটা নগদ দিতে হবে।
দরাজ গলায় হেসে ওঠে সোনা মিঞা। বলে, এই কথা?
হাঁ হাঁ, মিঞাসাব। দু দফে আমি ঠকেছি। আমার এক চীনা দোস্ত কলকাত্তা থেকে হঙকঙ যাবার পথে এখানে এসেছিল। দশ পাউন্ড আফিং আর সাত পাউন্ড কোকেন নিয়ে গিয়েছে। ঠিক হয়েছিল, হঙকঙ থেকে ফিরে দামটা দিয়ে যাবে। দু সাল পার হয়ে গেল,
লেকিন চীনা কুত্তাটা আজও ফেরেনি।
একটু দম নিয়ে ডি-কুনহা বলতে থাকে, আর এক শালা বর্মী এডেন পোর্টে যাচ্ছিল মাঝপথেই সোনা মিঞা ডি-কুনহাকে থামিয়ে দেয়। বলে, বর্মী শালার কথা কইতে হইব না। সিধা কথাখান সিধা কইরা কয়েন হার্মাদ সাব। দামটা হাতে হাতে দিবার হইব, এই বাত তো?
কামিজের চোরা জেব (পকেট) থেকে এক গোছা নোট বার করে সোনা মিঞা। ফিস ফিস করে বলে, দাম কত?
হাজার রুপেয়া। নোটগুলো দেখতে দেখতে চোখজোড়া চক চক করে ডি-কুনহার।
গুনে গুনে এক হাজার টাকা সামনের টেবিলের ওপর রাখে সোনা মিঞা। তারপর বলে, মাল কই কুনহা সাব?
মালটা পানিঘাটে আছে।
ছোঁ মেরে টেবিলের ওপর থেকে টাকাগুলো তুলে পকেটে পুরে ফেলে সোনা মিঞা। প্রচুর হেসে প্রচুর মাথা ঝাঁকিয়ে সে বলে, আমিও এক দফে অনেকগুলান রুপেয় চোট খাইছি। এক শালার পো শালা ইন্দোনেশিয়ান মাল্লারে পোর্ট শরাব খরিদ করার লেইগা দুই হাজার টাকা দিছিলাম। মাল তো পালামই না, রুপেয়াও গেল। খুব হুশিয়ার হইয়া গেছি হেই থনে। আইজকাইল বাঁ হাতে মাল লইয়া ডাইন হাতে রুপেয়া গইনা দিই। আমার কারবার নগদা।
ডি-কুনহার চোখ দুটো অদ্ভুত এক আক্রোশে দপ দপ করে। মুখটা ভয়ানক ক্রুর দেখায়। লালচে চুলে, কুঁড়ে-ওঠা দুই হনুতে, দু পাটি ঝকঝকে দাঁতে হিংস্রতা ফুটে বেরোয়। হার্মাদ ডি-কুনহা এই মুহূর্তে দুতিন শ’ বছরের ব্যবধান ঘুচিয়ে তার নৃশংস পূর্বপুরুষ যারা নাবী বাংলায় নির্বিচার হত্যা এবং লুঠতরাজ চালাতে এসেছিল, তাদের মতোই আদিম হয়ে উঠেছে।
ডি-কুনহার মুখের দিকে সোনা মিঞা ফিরেও তাকায় না। ফেজটা বার বার খুলে, বার বার দিতে বসায়।
একসময় সোনা মিঞা উঠে পড়ে, আইজ যাই কুনহা সাব। অনেক রাইত হইল। আদাব, আদাব।
দাঁতে দাঁত চেপে ডি-কুনহা বলে, একটু বস মিঞা। মাল আজই পাবে, আমি পানিঘাটে যাব। নগদ মাল দিয়ে নগদ রুপেয় নেব।
আপনের যেমুন মর্জি।
চাঁদির মাথায় ফেজটা ঠিক করতে করতে বসে পড়ল সোনা মিঞা।
এবার ডি-কুনহা বাকি তিনজনের দিকে তাকাল। বলল, এই যে ফাই মঙ, তোমার কী মাল দরকার?
কোকেন। একটু বেশি করে দেবেন। আজকাল অনেক জাহাজ আসছে পোর্ট ব্লেয়ারে। খালাসিরা এসব মাল চায়।
বহুত আচ্ছা। বলেই আর একজনের দিকে ঘুরে বসে ডি-কুনহা, তুমি তো এবার রেঙ্গ ন যাচ্ছ জন। ওদিকে কিছু চরস চালাবার বন্দোবস্ত কর।
ঠিক হ্যায়।
লণ্ঠনের নিস্তেজ আলোতে মালয়ী খ্রিস্টান জনকে ব্রোঞ্জ মূর্তির মতো কঠিন দেখায়। কেমন যেন নির্বিকার। আস্তে আস্তে জন বলে, চরসের সঙ্গে কিছু পিনিকও দিয়ে দেবেন।
আচ্ছা।
এবার ইন্দোচীনীটার দিকে তাকাল ডি-কুনহা। চাপা কুতকুতে চোখ, উঁচলো থুতনি থেকে লম্বা লম্বা কালো সুতোর মতো কয়েক গাছা দাড়ি ঝুলছে। মাংসল গর্দান, বেঁটে বেঁটে হাত দুটো কী যেন আঁকড়ে ধরার জন্য বার বার মুঠো পাকিয়ে যাচ্ছে।
বছরখানেক আগে লোকটার সঙ্গে কার নিকোবরে আলাপ হয়েছিল ডি-কুনহার। তার নাম চি-হো। চি-হো সুমাত্রা থেকে মুক্তোর খোঁজে ডিঙি বেয়ে নিকোবর দ্বীপে এসেছিল। নিকোবর থেকে ডি-কুনহা তাকে আন্দামান নিয়ে আসে।
ইন্দোচীনী চি-হো মুলুকে থাকত না, থাকত পেনাঙে। সে প্রচণ্ড দুঃসাহসী। মোটর বোট ভরসা করে সে বিপুল সমুদ্র পাড়ি দেয়। গত এক বছরে চি-হো বার দশেক আন্দামান । এসেছে। এখানে এলে ডি-কুনহার কুঠিবাড়িতেই ওঠে। ডি-কুনহার সঙ্গে তার পাকা দোক্তি।
ডি-কুনহা বলল, তোমাকে চণ্ডুর নেশা ধরিয়েছি। নেশাটা কেমন?
চি-হো উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল, বহুত আচ্ছা।
পেনাঙে নেশাটার কেমন চল?
দশ বিশজন যা চীনা আছে, তারাই শুধু চণ্ডুর নেশা করে। এ ছাড়া আর কাউকে চণ্ডু ফুঁকতে দেখিনি।
না না, এ চলবে না। দুনিয়ার সব আদমীকে নেশা ধরাতে হবে। নেশা না ধরালে আমাদের বিলকুল লোকসান। কারবার গুটিয়ে ফেলতে হবে। পেনাঙে ফিরে জানাশোনা সব আদমীকে চণ্ডু ধরিয়ে দাও। বুঝলে?
মাথা নেড়ে চি-হো জানালে, বুঝেছে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর ডি-কুনহাই আবার শুরু করল, তুমি কবে পেনাঙে ফিরছ চি-হো?
আজ রাতেই।
ঠিক আছে। এক পেটি চণ্ডু নিয়ে যাও।
একটু পর চি-হো, ফাই মঙ বর্মী এবং জন–তিন জনকে তিনটে কাঠের পেটি দিল ডি-কুনহা। চোরাই চালানের জন্য সেগুলো নিষিদ্ধ নেশার মালে বোঝাই।
তিনজন উঠে দাঁড়াল। দাম চুকিয়ে বিদায় জানিয়ে তিনটে মূর্তি ডি-কুনহার কুঠিবাড়ি থেকে অন্ধকারে নেমে গেল।
পেনাঙ, রেঙ্গুন, এবারডিন বাজার–রাতের অন্ধকারের সুযোগে গারাচারামা গাঁও থেকে নেশার তিনটে পঙ্কিল, কদর্য স্রোত তিন দিকে ছুটে গেল।
লণ্ঠনের নিস্তেজ আলোটাকে উসকে তেজী করে নিল ডি-কুনহা।
সোনা মিঞা বলল, অনেক রাত হয়ে গেল হার্মাদ সাব।
হাঁ। হঠাৎ ডি-কুনহা অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়ল, এই তো এবার পানিঘাটে যাব। আওয়াবিল পাখির বাসা তো কুঠিতে রাখা যায় না। বহুত ঝামেলা। পুলিশ একবার টের পেলে–
কথাটা আর শেষ করল না ডি-কুনহা। তার গলার স্বরটা অনেকখানি খাদে ঢুকে রহস্যময় হয়ে উঠল, রাত্রি বেশি না হলে এসব কাজে কি সুবিধে হয়!
আরো ঘন্টাখানেক পর দুজনে বাইরে বেরিয়ে পোর্ট ব্লেয়ারের সড়ক ধরল।
পেছনে ডি-কুনহার কুঠিবাড়িটা অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
পরের দিন সকালে অগাধ সমুদ্র থেকে উঠে এসে সূর্য যখন আকাশের দেওয়াল বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই দৃশ্যটা চোখে পড়ল।
ফিনিস্ক উপসাগর থেকে ফেরি লঞ্চটা বাস্তু ফ্ল্যাটের দিকে যাচ্ছিল। লঞ্চের রশিম্যানই প্রথম দেখল।
হ্যারিয়েট পাহাড়ের একেবারে নিচের দিকে যেখানে লর্ড মেয়োর কবরের ওপর কাঠের সাদা ক্ৰশটা পোঁতা রয়েছে, তারও অনেক নিচে নীল জলের উপসাগর। উপসাগরের ঠিক পাড়েই পানিঘাট।
এখন উপসাগরটা হ্রদের মতোই শান্ত দেখায়। তার নিস্তরঙ্গ জলে সোনা মিঞার মৃতদেহটা স্থির হয়ে রয়েছে। একটুও নড়ছে না।
ফেরি লঞ্চের রশিম্যান চিৎকার করে উঠল, মুর্দা (মড়া), মুর্দা–ইয়ে খুদা, সকাল বেলাতেই আঁখে কী পড়ল!
আর একটা রবিবার এসে গেল।
এর আগের রবিবার অর্থাৎ ছুটির দিন জাজিরুদ্দিনের সঙ্গে বিরসার লড়াই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু লড়াইটা হয়নি। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের একটা জরুরি কাজে সেদিন বিরসাকে কাদাকাঁচাঙ যেতে হয়েছিল। বুকের আচমকা একটা কষ্টের জন্য জাজিরুদ্দিন গিয়েছিল হাসপাতালে।
আজ সেলুলার জেলে বিরসাও আছে, জাজিরুদ্দিনও আছে। সুতরাং লড়াইটা হচ্ছেই।
বেশ কিছুক্ষণ আগেই সকাল হয়েছে।
কয়েদিরা কাঞ্জিপানি খেয়ে, বর্তন ধুয়ে, নিজের কুঠুরি সাফসাফাই করে, সাত নম্বর ব্লকের ওয়ার্কশপের সামনে জমায়েত হয়েছে। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে তারা গুলতানি পাকাতে শুরু করেছে।
কয়েদখানায় উন্মাদনার শেষ নেই।
বিরসা এবং জাজিরুদ্দিন এখনও এসে পৌঁছয় নি। কিন্তু তাদের লড়াইর ব্যাপার নিয়ে কয়েদিরা দুটো দলে ভাগ হয়ে গিয়েছে।
আজকের লড়াইতে যদি জাজিরুদ্দিন জেতে, তা হলে বিরসা জাত দিয়ে ইসলামী বনবে। বিরসা জিতলে জাজিরুদ্দিন হিন্দু হবে। পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন একমাত্র এই সৃষ্টিছাড়া দ্বীপেই বুঝি এমন বর্বর লড়াই সম্ভব।
অসহ্য উত্তেজনায় কয়েদিরা আগের রাতটা একদণ্ডও ঘুমোতে পারে না। কে জিতবে? বিরসা না জাজিরুদ্দিন?
জাজিরুদ্দিনের হাত-পা বাঘের থাবার মতো। বাঁকানো আঙুলের ডগায় দশটা নখ এবং দু পাটি দাঁত সাতিক ধারাল। বাঘের মতোই সে ক্ষিপ্র, চতুর, ভয়ানক। চক্ষের পলকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিপক্ষের গলার নলী নখ এবং দাঁতে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটতে দেখলে তার দুই চোখ খ্যাপা উল্লাসে ভরে যায়।
অন্য পক্ষে বিরসার মাংসল শরীরে অফুরন্ত শক্তি। প্রতিপক্ষকে একবার জাপটে ধরতে পারলে, পাঁজরের হাড় গুঁড়িয়ে চুরমার করে ফেলবে। রদ্দা হাঁকাতে পারলে গর্দান ভেঙে যাবে।
বিরসা এবং জাজিরুদ্দিন, দুজনের মধ্যে কে জিতবে, কে তার হসিদ দেবে।
একদল কয়েদির ইচ্ছা, বিরসা জিতুক। আর এক দলের ইচ্ছা, জাজিরুদ্দিন জিতুক। এই দুদল ছাড়া, আরো অনেক কয়েদি আছে। তাদের বিরসা কি জাজিরুদ্দিন যে-ই জিতুক, তা নিয়ে বিশেষ মাথাবাথা নেই। দুর্দান্ত দুই মরদে লড়াই হবে–এতেই তারা খুশি, মশগুল।
সাত নম্বর ব্লকের ওয়ার্কশপের সামনে ছোট ছোট জটলা পাকিয়ে কয়েদিরা গুলতানি করছে। কে জিতবে, কার জেতা উচিত, এ সব প্রশ্ন নিয়ে তাদের মধ্যে চিল্লাচিল্লি এবং হাতাহাতির অন্ত নেই।
এক জটলার ভেতর একটি কয়েদি বলছে, জাজিরুদ্দিনের মতো এত বড় মরদ আন্দামানে কোনো কালে কয়েদ খাটতে আসে নি।
কেমন, কেমন? চারপাশ থেকে অন্য কয়েদিরা তাকে ঘিরে ধরল।
হুঁ হুঁ–জুত করে হাঁটুর মাথায় তাল ঠোকে কয়েদিটা। তারপর বলে, বুড়া ওয়ার্ডারজির কাছে শুনেছি, চার পুরুষ ধরে জাজিরুদ্দিনরা আন্দামানে কয়েদ খাটতে আসছে।
তাই নাকি?
হাঁ রে, হাঁ। জাজিরুদ্দিনের বাপজান, বাপজানের বাপজান আর তার বাপজান এখানে কয়েদ খেটে গিয়েছে।
সচ্ বলছিস?
বিলকুল সম্। কয়েদিটা কী ভেবে আবার শুরু করে, ব্লেয়ার সাহাব যখন এই শহর বানাতে এসেছিল, তখন জাজিরুদ্দিনের নানা আর নানার বাপজান একসাথ সাজা খাটতে এসেছিল। কয়েদ খাটার ব্যাপারে ওদের বহুৎ খানদানী ঘরানা।
জটলার মধ্য থেকে কে যেন টিপ্পনী কাটল, আন্দামানটাই জাজিরুদ্দিন শালেদের।
অন্য কয়েদিরা হাসতে হাসতে হল্লা বাধিয়ে দেয়।
একটা ঢ্যাঙা কয়েদি ধমকে চিল্লিয়ে সবাইকে থামিয়ে দেয়। তারপর বলে, চার পুরুষ ধরে শালেরা খুনী। জাজিরুদ্দিন একা বিশটা খুন করে এসেছে। জানিস, জাজিরুদ্দিন খালি নখ আর দাঁত দিয়ে খুন করে। নখ দিয়ে গলার নলীটা ছিঁড়ে রক্ত চুষে খায়। পাঁজরে জোড় পায়ে লাথি হাঁকিয়ে দম বন্ধ করে দেয়।
সবাই তাজ্জব হয়ে জাজিরুদ্দিনের কীর্তিকলাপের কথা শোনে।
কয়েদিটা বলতেই থাকে, কয়েদিরা পয়লা পয়লা আন্দামান এসে চুপচাপ থাকে। লেকিন জাজিরুদ্দিন দুসরা কিসিমের আদমী।
ক্যায়সা, ক্যায়সা? |||||||||| এখানে এসে পয়লা রোজেই ঘুষা মেরে এক পেটি অফসরের দাঁত ভেঙে দিয়েছিল। বিশ রোজ জেলে কাটিয়েই জঙ্গলে পালিয়েছিল। দো সাল পর আবার নিজে এসে ধরা দিয়েছে। কলিজার কত তাগদ থাকলে ভাগোয়া কয়েদি ধরা দেয় বুঝিস শালেরা!
জাজিরুদ্দিনের মাফিক এমন বড় মরদ আন্দামানে কোনো কালে আসে নি।
সবাই মাথা নেড়ে সায় দেয়।
অন্য এক জটলায় এক টাক-মাথা কয়েদি বলছে, বিরসা জরুর জিতবে। বিরসার বীরত্বের ওপর তার অসীম ভক্তি।
কী করে বুঝলি? অন্য কয়েদিরা জানতে চায়।
টাক-মাথা খেঁকিয়ে উঠল, শালেরা বিরসার কবজি আর ঊরু দেখেছিস?
কয়েদিগুলো একসঙ্গে চিল্লায়, না না–
কয়েদিটা এবার বিজ্ঞের মতো মাথা ঝাঁকাল। বলল, শালে মুরুখের পাল, কবজি আর ঊরু দেখলে তাগদ মালুম পাওয়া যায়। জাজিরুদ্দিনের মতো বিশটা হারামীকে টিপে মারতে পারে বিরসা। হঠাৎ গলাটা খাদে ঢুকে গেল তার, জানিস, হিন্দু ধরমের মান রাখতে রামজি বিরসাকে আন্দামান পাঠিয়েছে। ও তোর আমার মাফিক নেড়ি থেড়ি কয়েদি না।
চারপাশের কয়েদিগুলো ঘন হয়ে বসে। তাদের মুখে চোখে বিস্ময় এবং কৌতূহল-মেশা অদ্ভুত এক ভঙ্গি ফোটে। ফিস ফিস গলায় তারা বলে, তবে–
হিন্দুধর্মের মর্যাদা রাখার পূর্ণ দায়িত্ব বিরসার। আন্দামানের অন্য কয়েদিদের মতো শুধু দ্বীপান্তরের সাজা খাটাতেই আসে নি সে। বিরসা হচ্ছে ঈশ্বর-প্রেরিত পুরুষ। আন্দামানে মহান হিন্দুত্বের মানসম্ভ্রম সমস্ত কিছুই তার তাকতের ওপর নির্ভর করছে।
বিরসা সম্বন্ধে গূঢ় এবং গোপন খবরটি দিয়ে সকলের মুখচোখের ভাব লক্ষ করে টাক-মাথাটা। আস্তে আস্তে বলে, বিরসা শালে যা-তা আদমী না, সাচ্চা সিদ্ধিবাবা। জরুর সে জিতবে। জানিস বিন্ধ্যাচলের পাহাড়ে কত রোজ সে ধ্যান করেছে!
সবার শেষে সবচেয়ে মূল্যবান এবং সবচেয়ে গোপন খবরটি দেয় টাক-মাথা, বিরসা আমাকে বলেছে, ও রামজির সাথ মুলাকাত করেছে। রামজির সাথ বাতচিত করেছে। রামজিই ওকে কালাপানির কয়েদখানায় পাঠিয়েছে।
এরপর কেউ আর কিছু বলে না। সবাই অনন্ত সম্ভ্রমে চুপচাপ বসে থাকে।
অন্য সব ছুটির দিনে ছোট ছোট জটলা পাকিয়ে কয়েদিরা গুলতানি করে। পুরোদমে খিস্তিখেউড়, কদর্য গালাগাল, শরাবী কি এবং আওরতী কিত্সা চালায়। সেলুলার জেলের ছুটির দিনগুলিতে অশ্লীল রস গেজিয়ে উঠতে থাকে।
কিন্তু আজকের দিনটা ব্যতিক্রম।
আজ জাজিরুদ্দিন এবং বিরসা ছাড়া কয়েদিরা অন্য কোনো প্রসঙ্গই তুলছে না। আন্দামানের পেনাল কলোনির জন্মকাল থেকে নারী এবং নেশার কিস্স্সার যে ঢালা স্রোত বয়ে আসছিল, আজ সেটা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
কয়েদিরা নেশা-নারী-খিস্তি-খেউড়–সমস্ত কিছু আজ ভুলেছে। বিরসা এবং জাজিরুদ্দিনকে ঘিরে তাদের যত মত্ততা, তত উত্তেজনা। সেলুলার জেলের সমস্ত কয়েদি জাজিরুদ্দিন আর বিরসার লড়াই-এর চিন্তায় বিভোর হয়ে রয়েছে।
তাদের একঘেয়ে বন্দিজীবনে মাঝে মাঝে ছুটিছাটার দিনে কয়েদিতে কয়েদিতে এমন মজার লড়াই কিছুটা বৈচিত্র্য আনে।
প্রথমে বিরসাই এসে পড়ল।
এই দুসপ্তাহের ভেতর চেহারায় বিরাট পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলেছে সে। চাঁছা মাথার পিছন দিকে মোটা একটি টিকি গজিয়েছে। বুকের ওপর দিয়ে আড়াআড়ি এক গোছা-হলদে রঙের পৈতা ঝুলিয়েছে। পৈতা এবং টিকিবর্ণশ্রেষ্ঠ হিন্দুর দুটো উগ্র প্রতীক সগৌরবে ধারণ করেছে বিরসা। বঙ্গোপসাগরের এই কয়েদখানায় কোত্থেকে যে নরম গেরি মাটি জুটিয়েছে, সে-ই বলতে পারে। গেরি মাটি গুলে থ্যাবড়া নাকে, কপালে এবং বুকে নানা দেওতার ছবি এঁকেছে। ধারীওয়ালা ইজের এবং কুর্তা হলুদ রঙে ছুপিয়ে নিজেকে হিন্দু ধর্মের নিখুঁত ত্রাণকর্তা বানিয়ে ফেলেছে বিরসা।
বিরসার চালচলন, হাবভাব দেখলে মনে হয়, আন্দামানের কয়েদখানায় সগৌরবে হিন্দুধর্মের পতাকা তুলে ধরার জন্যই তার আবির্ভাব।
সাত নম্বর ব্লকের ওয়ার্কশপের সামনে এসেই বিরসা হুঙ্কার ছাড়ল, জাজিরুদ্দিন শালে কিধর?
কেউ জবাব দিল না।
চারপাশে কয়েদিগুলো গুলতানি করছিল। বিরসার হুঙ্কারে সবাই চমকে তাকাল। মুহূর্তে চিল্লাচিল্লি থেমে গেল।
আরো খানিকটা পর সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে জাজিরুদ্দিন এসে হাজির।
আজকের লড়াইর জন্য সাজপোশাকের চূড়ান্ত ঘটা করেছে জাজিরুদ্দিন।
দুটো সপ্তাহ ধরে নখগুলোকে শানিয়েছে। চোখে সুর্মার ধ্যাবড়া টান মেরেছে, ভুরু দুটো পুরোপুরি কামিয়ে ফেলেছে। চোখা নুর আরো চোখা করেছে। ইজেরটা কালো রঙে ছুপিয়ে লাল ডোরা কেটেছে। কোত্থেকে খানাদানি এক আলখাল্লা জুটিয়ে গোটা দেহটা ঢেকে রেখেছে।
বিরসার মতো জাজিরুদ্দিনকে দেখলে মনে হয়, আন্দামানের কয়েদখানায় ইসলামের সম্মান রাখার সমস্ত দায় তার ওপর চাপিয়ে দুনিয়া যেন নিশ্চিন্ত হয়েছে। এর জন্য যতখানি দাম দেওয়া দরকার, সে দেবে।
আলখাল্লার রশি ঢিলা করে খুলে ফেলল জাজিরুদ্দিন। তারপর বুকের ওপর সশব্দে গোটা দশেক চাপড় মেরে চিৎকার করে উঠল, ইয়া আল্লা রসুল, আমি তোমার সাচ্চা বন্দা। আসমানের দিকে তাকিয়ে গলার স্বরটাকে শেষ পর্দায় তুলল। টেনে টেনে গানের সুরের মতো করে আওড়াল, আমি খুদাব। ইয়া খুদা, আমি তোমার বন্দা–
সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া দেখা গেল।
মাংসল উরুতে চটাপট চাপড় কশিয়ে বিরসা চিল্লায়, ইয়া বজরঙ্গবলী, ইয়া রামজি, কিরপা কর কবজিতে একটু তাগদ দে। জাজিরুদ্দিন শালেকে গুঁড়িয়ে ফেলি।
চারপাশের কয়েদিরা হই হই করে ওঠে।
কয়েদিদের জটলা ছুঁড়ে সেই কয়েদিটা উঠে পড়ে। সেই কয়েদি, যার নাম আজও কেউ জানতে পারে নি। যার গলায় লোহার তারের হাঁসুলিতে একটা চারকোনা কাঠের টুকরো ঝুলছে। তাতে খোদাই করা তার নম্বর-৭০৩।
নাম জিজ্ঞেস করলে কয়েদিটা বলে, কয়েদির আবার নাম কি রে শালেরা! নাম ধাম দরিয়ায় ওই পারে ফেলে কালাপানি এসেছি! কয়েদির নাম হল তার লম্বর। আমার নাম ৭০৩ লম্বর। ওই নামেই আমাকে ডাকবি।
৭০৩ নম্বরকে দেখে বুঝবার জো নেই, লোকটা মারাঠি না বালুচ, বর্মী না মালয়ী, পাঠান না মোপলা। বুঝবার জো নেই, লোকটা বৌদ্ধ না খ্রিস্টান, মুসলমান না হিন্দু।
আজব চেহারার আজব কয়েদি মুণ্ডুটা চারপাশে ঘুরিয়ে হুমকে উঠল, চুপ মার হারামী লোক। শালেরা বেফায়দা খালি চিল্লাবে!
কয়েদিদের চেঁচামেচি থামল।
৭০৩ নম্বর জাজিরুদ্দিনের দিকে তাকাল। বলল, খুদার নামে সাত কসম খেয়ে বল, তুই হারলে হিন্দু বনবি?
জাজিরুদ্দিন আওড়াল, খুদার নামে সাত কসম, হারলে হিন্দু বনব।
৭০৩ নম্বর এবার বিরসার দিকে ঘুরল। বলল, রামজির নামে সাত কসম খেয়ে বল, তুই হারলে ইসলামী বনবি?
বিরসা আওড়াল, রামজির নামে সাত কসম, হারলে জরুর ইসলামী বনব। তামাম জিন্দেগী ওই শালে জাজিরুদ্দিনের জুতি চাটব।
৭০৩ নম্বর বলল, এবার তা হলে লড়াই শুরু হোক। এ বিরসা, এ জাজিরুদ্দিন–তোরা রাজিবাজি তো?
বিরসা বলল, রাজিবাজি।
জাজিরুদ্দিন বলল, রাজিবাজি।
চারপাশে কয়েদিরা চেঁচায়, রাজিবাজি।
সেলুলার জেলের ছুটিছাটার দিনগুলোতে এমন মজার লড়াই প্রায়ই বাধে। মরদেরা পরস্পরের তাকত পরখ করে। তামাশা দেখার জন্য টিণ্ডাল, পেটি অফিসার, জমাদার এবং সিপাইরা জটলার মধ্যে ভিড় জমায়। আজও তারা এসেছে। অবশ্য আজকের লড়াইটা অন্যদিনের তুলনায় সম্পূর্ণ আলাদা। এটা দুই ধর্মের মর্যাদা রক্ষার জন্য মহাযুদ্ধ। কয়েদিরা দুটো দলে ভাগ হয়ে গেছে। এক দল জাজিরুদ্দিনকে উৎসাহ দিচ্ছে, অন্য দলটা বিরসাকে তাতাচ্ছে।
আসমানের দিকে মাথা তুলে জাজিরুদ্দিন চিল্লায়, বিরসা হারামী আ যা।
বিরসাও হুঙ্কার ছাড়ে, জাজিরুদ্দিন কুত্তা আ যা—
এর পরেই লড়াই বেধে গেল।
দুটো থাবা উঁচিয়ে ক্ষিপ্র গতিতে বিরসার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল জাজিরুদ্দিন। এক ঝটকায় তাকে ফেলে দিল বিরসা। বিরসা দৌড়ে এসে বুকে চড়বার আগেই লাফ মেরে উঠে দাঁড়ায় জাজিরুদ্দিন।
দুই জববদস্ত মরদ দু’দিক থেকে তড়পাচ্ছে, পাঁয়তারা ভাঁজছে। ঊরুর ওপর সশব্দে থাপ্পড় কষাতে কষাতে পরস্পরের দিকে এগিয়ে আসছে। সুযোগ বুঝলেই কিল ঘুষি হাঁকাচ্ছে। প্রতিপক্ষের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রেখে দুজনই দুজনের চারদিকে চক্কর দিচ্ছে। সুবিধা পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে।
একদল কয়েদি চিল্লাচ্ছে, এ জাজিরুদ্দিন, বিরসা শালের জান তুড়ে দে।
আরেক দল কয়েদি চিল্লাচ্ছে, এ বিরসা, জাজিরুদ্দিন কুত্তাটার শির ছেঁচে দে।
হল্লায় আন্দামানের আসমান ফালা ফালা হয়ে যাবার দাখিল।
জাজিরুদ্দিন কি বিরসা–অন্য কোনো দিকে কারো ভ্রূক্ষেপ নেই। বিপক্ষের ওপর দৃষ্টি স্থির রেখে তারা সুযোগ খুঁজছে।
হঠাৎ বিরসার বরাতে সেই সুযোগটা এসে গেল। পিছু হটতে হটতে বাঁ পা পিছলে চিত হয়ে পড়ল জাজিরুদ্দিন। জাজিরুদ্দিনের বুকের ওপর দুই জানুর ঠাসানি দিতে দিতে গলাটা টিপে ধরল বিরসা। জাজিরুদ্দিনের আধ হাতখানেক জিভ বেরিয়ে পড়েছে। চোখের ডেলা দুটো ঠিকরে আসার উপক্রম হয়েছে। গলার শিরগুলো পাকিয়ে পাকিয়ে ফুলে চউঠছে। গালের কশ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে। গলার ভেতর থেকে অব্যক্ত এক গোঙানি বেরুচ্ছে।
নিরেট, ভীষণ মুখটা জাজিরুদ্দিনের মুখের কাছে ঝুঁকিয়ে বিরসা ভয়ঙ্কর স্বরে বলল, এ কুত্তার বাচ্চা, আমাকে না হারিয়ে দিতে চেয়েছিলি! এবার তোর জান চৌপট করে দিচ্ছি। দেখি কোন শালে তোকে বাঁচায়!
মাথাটা একদিকে কাত হয়ে ঝুলে পড়েছে জাজিরুদ্দিনের। নির্জীবের মতো পড়ে রয়েছে সে। বিরসার বিরাট থাবার চাপে গলার শিরগুলো ছিঁড়ে পড়বে যেন।
মুহূর্তে ঘটে গেল ঘটনাটা।
বিরসা বুঝি একটু ঢিলে দিয়েছিল। সেই ফাঁকে ক্ষিপ্র, চতুর জাজিরুদ্দিন জোড় পায়ে বিরসার তলপেটে লাথি হাঁকায়। মস্ত শরীর নিয়ে উলটে হুমড়ি খেয়ে পড়ল বিরসা। সে উঠবার আগেই তার কাঁধের ওপর লাফিয়ে পড়ে জাজিরুদ্দিন। তার দুই থাবায় দশটা নখ বিবসার মাংসল কাঁধে গেঁথে গেল। ধারাল দাঁতগুলো দিয়ে বিরসার পিঠটা ফালা ফালা করে ছিঁড়ে ফেলল সে। তারপর রক্তাক্ত দাঁতগুলো মেলে হাসল। বলল, শালে আমাকে হারাবে! কোন রামজি তোকে বাঁচায়, আমি দেখব।
চারপাশ থেকে কয়েদিরা সমস্বরে চিৎকার করে, লড়াই জমে গিয়েছে, বহুত জবরদস্ত লড়াই। বড়ে আচ্ছা খেল।
গোটা দশেক ঝাড়া মেরে কাঁধ থেকে জাজিরুদ্দিনকে নিচে ফেলে দিল বিরসা। ফেলেই বুকের মধ্যে জাপটে ধরল। লম্বা লোহার সাঁড়াশির মতো কঠিন দুটো হাতের পেষণে জাজিরুদ্দিনের পাঁজরের হাড়গুলো মট মট করে গুঁড়িয়ে যেতে লাগল।
বিরসা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, কেমন লাগছে রে শালে?
জাজিরুদ্দিন কাতর গলায় চেঁচাতে লাগল, মর যায়েগা।
দুই হাতে জাজিরুদ্দিনকে আরো জোরে পেঁচিয়ে ধরে বিরসা। বিরাট বুকের ওপর ফেলে ডলতে থাকে, পিষতে থাকে, হাড্ডি চুরমার করতে থাকে। জাজিরুদ্দিন দম-আটকানো স্বরে সমানে গোঙায়, ছোড় দে, ছোড় দে বিরসা।
বিরসা শয়তানী চালে হাসে আর বলে, আর শালা তোকে ছাড়ি। আর তোকে ঢিলা দিই। অ্যায়সা বুরবক আমি না। পয়লা বল, হেরেছি–তবে ছাড়ব।
চারপাশ থেকে কয়েদিরা তুমুল শোরগোল করে সমানে উৎসাহ দিচ্ছে।
বিরসার বুকের মধ্যে জাজিরুদ্দিনের শরীরটা ভেঙেচুরে যেন দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। আধ পুরো জিভটা বেরিয়ে পড়েছে জাজিরুদ্দিনের। গলার মধ্যে একটা অবরুদ্ধ গোঙানি পাক খাচ্ছে। চোখ দুটো বুজে গেছে তার।
বুকের ওপর জাজিরুদ্দিনকে একটু একটু পেষে বিরসা, আর বলে, কি রে শালে নালায়েক, কেমন লাগছে?
জাজিরুদ্দিন জবাব দেয় না।
বিরসা বলে, এখনও বল হেরেছি।
না।
মাথা ঝাঁকিয়ে ক্ষীণ আওয়াজ করে জাজিরুদ্দিন।
আচ্ছা শালে, দ্যাখ কেমন করে বাপের নাম ভোলাই, জান-জমানা চৌপট করে দিই।
বলে আরো জোরে জাজিরুদ্দিনকে ডলতে থাকে বিরসা।
জাজিরুদ্দিনের মনে হয়, প্রাণটা এবার বেরিয়ে যাবে।
কয়েদিদের মধ্যে যারা বিরসার পক্ষে, তারা চিল্লায়, সাবাস বিরসা–
যারা জাজিরুদ্দিনের পক্ষে, তারা গভীর উদ্বেগে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। আর যারা জাজিরুদ্দিন কি বিরসা–কোনো পক্ষেই নেই, যারা শুধু মজা দেখার তাগিদেই জমায়েত হয়েছে তারা চিৎকার করতে থাকে, শাবাশ মরদ, জাজিরুদ্দিন শালেকে ফৌত করে ফেল।
বিরসা বলে, এখনও বল হেরেছি।
জাজিরুদ্দিন কাতর সুরে বলে, না।
বল যত সাল বাঁচবি, আমাকে বাপ বলে ডাকবি।
জড়িয়ে জড়িয়ে এবার জাজিরুদ্দিন কী যে বলে ঠিক বোঝা যায় না। তার গর্দানটা ভেঙে বিরসার কাঁধের ওপর ঢলে পড়ে। দুর্বোধ্য স্বরে থেকে থেকে ককাতে থাকে সে।
বিরসা আবার বলে, কি রে শালে, এন্তেকাল এসে গেল না কি?
ঠিক এই সময়েই ঘটে গেল ঘটনাটা।
জাজিরুদ্দিনের সঙ্গে অনেকগুলো D টিকিট মার্কা সাকরেদ নানা মতলবে সর্বক্ষণ ঘুর ঘুর করে। তাদেরই একজন হল ভুটিয়া। লোকটা জাতে হিন্দু, মুলুক নাসিক। হঠাৎ সাত নম্বর ব্লকের ওয়ার্কশপের পেছন থেকে মাটি খুঁড়ে উঠে এল সে। ছুটতে ছুটতে জাজিরুদ্দিনের কাছে এসে পড়ল। চক্ষের পলকে কামিজের তলা থেকে কী যেন বার করে জাজিরুদ্দিনের থাবায় গুঁজে দিল।
ভাঙা গর্দানটা তারপরেই খাড়া হয়ে গেল জাজিরুদ্দিনের। মেরুদণ্ড সিধা করে অন্তিম, হিংস্র আক্রোশে জাজিরুদ্দিন গর্জায়। ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে। কিন্তু বিরসার জাপটানির ভেতর থেকে নিজেকে মুক্ত করা অত সোজা নয়। হঠাৎ তার থাবাটা আকাশের দিকে উঠে গেল। জাহাজ-ভাঙা এক টুকরো লোহা পাথরে ঘষে ঘষে ছোরার মতো শানিয়ে এনেছে ভুটিয়া। জাজিরুদ্দিনের হাতে সেই ফলাটা ঝলকে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে কেউ কিছু বুঝবার আগেই চারপাশের পাঁচ শ’ জোড়া চোখকে স্থির করে দিয়ে জাজিরুদ্দিনের হাতের সেই ধারাল, চোখা লোহার পাত বিরসায় তলপেটে আমূল ঢুকে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তাজা গাঢ় রক্ত ফিনকি দিয়ে ছুটল।
হা-আ-আ-আ–মর গিয়া—
বিকট, প্রাণফাটা চিৎকার করে উঠল বিরসা।
বিরসার চিৎকারে বিন্দুমাত্র টলল না জাজিরুদ্দিন, এতটুকু বিচলিত হল না। নরম মাংসল তলপেটে ধারাল লোহার ফলাটা ঢুকিয়ে চিরে চিরে অনেকখানি ফাঁক করে ফেলল। রক্তের সঙ্গে ডেলা ডেলা হলদেটে মাংস বেরিয়ে আসছে। মেটে রঙের যকৃত আর নীল নীল পাকানো পঁচানো এক দলা নাড়িভুড়ি ঝপ করে পড়ে গেল। খাদ্যনালীটা ছোরার খোঁচায় ছিঁড়ে গিয়েছিল। খানিকটা অজীর্ণ থকথকে খাদ্যের পিণ্ড বেরিয়ে এল। পিত্তটা ফেঁসে গিয়েছিল। নীলচে তরল রস ছড়িয়ে পড়ল। বোটকা দুর্গন্ধে সেলুলার জেলের বাতাস ভারী হয়ে উঠল।
হা-আ-আ-আ–মর গিয়া–
বিরসার বিরাট দেহটা পাক খেতে খেতে ঘাসের জমিতে আছড়ে পড়ল। কিছুক্ষণ ঘাসের ওপর মুখ গুঁজে গোঙায় বিরসা। এক সময় গোঙানি থামল। দেহটা ধীরে ধীরে নিস্পন্দ হয়ে গেল।
রক্ত, থকথকে অজীর্ণ খাদ্য, ডেলা ডেলা হলদেটে চর্বি এবং মাংস আর নীল পিত্তের রসে মাখামাখি হয়ে পড়ে রয়েছে বিরসা। এক ঝাঁক বড় বড় নীল মাছি বিরসার নিথর, বিশাল দেহটার ওপর ভন ভন করে উড়তে লাগল।
বিরসাকে দেখতে দেখতে একটা হিংস্র তৃপ্তির হাসি জাজিরুদ্দিনের মুখে খেলতে লাগল। তালুতে জিভ ঠেকিয়ে অদ্ভুত শব্দ করল জাজিরুদ্দিন। দুই হাতে বার দশেক তুড়ি বাজাল। তারপর ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটা নখসমেত বিরসার কাঁধে গেঁথে আস্তে একটা ঠেলা মারল। দাঁতে দাঁত ঘষতে ঘষতে বলল, শালে বড় মরদ এসেছে! এ জিন্দেগীতে আর আমাকে হারাতে হবে না।
আকাশের দিকে চোখা নুরওয়ালা মুখটা তুলল জাজিরুদ্দিন, দুসরা জিন্দেগীতে আবার তোর সাথ মুলাকাত হবে বিরসা। সেদিন কে জেতে কে হারে, বোঝা যাবে। তুই জিতলে আমি তোর জুতি চাটব, আমি জিতলে তুই আমার জুতি চাটবি। পাক্কা বাত বিরসা। মরদকা বাত, হাতিকা দাঁত। হাঃ-আঃ-আঃ–
বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে এই আট শ’ কুঠুরির সেলুলার জেলটাকে কাঁপিয়ে দিয়ে বিকট শব্দে হাসতে লাগল জাজিরুদ্দিন। হাসি আর থামে না। হাসতে হাসতে জাজিরুদ্দিন কি পাগল হয়ে যাবে?
চারপাশের কয়েদিগুলো নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে ছিল। চোখের পাতা তাদের পড়ছে। না। জাজিরুদ্দিন আর বিরসার লড়াইর পেছনে এমন একটা সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার যে লুকিয়ে ছিল, আগেভাগে কেউ কি আন্দাজ করতে পেরেছিল?
সেই কয়েদিটা, যাকে দেখে বুঝবার জো নেই, সে হিন্দু না মুসলমান, বৌদ্ধ না খ্রিস্টান, মারাঠি না পাঠান, মোপলা না পাঞ্জাবী-সে-ই প্রথম স্তব্ধতা ভাঙল, বিরসা শালে জান দিল! কেমন এক ধরনের আক্ষেপের সুর ফুটল তার গলায়।
চারপাশের কয়েদিগুলো দলা পাকিয়ে নিষ্ক্রিয় এবং অসাড় দাঁড়িয়ে ছিল। চোখের সামনে বিরসার নিশ্চল দেহ এবং এত খুন দেখেও তারা পুরোপুরি বিশ্বাস করে উঠতে পারছিল না।
আচমকা সমস্ত নিষ্ক্রিয়তা কেটে গেল। সবগুলো কয়েদি একই সঙ্গে একই স্বরে চিৎকারে করে উঠল, মর গিয়া, মর গিয়া। জাজিরুদ্দিন বিরসাঁকো কোতল কর দিয়া।
তারপরই জটলা ভেঙে কয়েদিরা চারদিকে ছুটতে লাগল। চিৎকার হল্লায় সেলুলার জেল এখন সরগরম।
একটু পর পুলিশ-জমাদার-হাবিলদার, জেলার এবং জেল সুপারিন্টেডেন্ট–সবাই ঝাঁক বেঁধে এসে পড়ল।
বিরসার মৃতদেহটা ঘিরে নীল মাছির ঝক ভন ভন করছে। রক্তের আঁশটে গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছে।
জাজিরুদ্দিন সমানে হাসছে আর বলছে, শালে বড়ে মরদ এসেছে। শালে বড়ে উস্তাদ এসেছে! তার থাবার রক্তাক্ত ফলাটা দুপুরের রোদে ঝলকাতে থাকে।
চারপাশের কয়েদিরা এতক্ষণে চিল্লাতে চিল্লাতে দূরের ব্লকগুলোতে পালিয়ে গিয়েছে।
জাজিরুদ্দিনের হাতে লোহার হাতকড়া পড়ল। দুটো পুলিশ আর দুটো জমাদার বেতের মোটা ডাণ্ডা দিয়ে গুঁতোতে ওঁতোতে জেলার সাহেবের অফিসের দিকে নিয়ে গেল তাকে।
এক কদম এগোয় জাজিরুদ্দিন, তিন কদম পিছোয়। আর সমানে চিল্লায়, আমি হলাম জাজিরুদ্দিন। দুনিয়ায় কত লড়াই আমি জিতেছি। আর ওই বিরসা শালে আমাকে হারাতে চায়! হাঃ-হাঃ-হাঃ–। গলা ফাটিয়ে হেসে ওঠে জাজিরুদ্দিন। হাসির দাপটে দেহটা দুমড়ে বেঁকে যেতে থাকে। লম্বা জিভটা ফের বেরিয়ে পড়ে।
পুলিশ এবং জমাদাররা জাজিরুদ্দিনকে টেনে হিঁচড়ে জেলার সাহেবের অফিসে ঢোকায়।
সাত নম্বর ব্লকের ছোট্ট ময়দানে বিরসার দেহটা পড়েই থাকে। রক্ত জমে থকথক করে। আরো মাছি এসে জোটে। রক্তের মধ্যে সাঁতরাতে সাঁতরাতে ডানা জড়িয়ে যায় তাদের।
এখন দুপুর। সূর্যটা দ্বীপের মাথায় এসে উঠেছে। তেজী রোদে বিরসার মৃতদেহটা যেন ঝলসে যেতে থাকে।
এক পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবই দেখেছে লখাই। তারপর কয়েদিদের সঙ্গে ছুটে দূরের ব্লকগুলোর দিকে উধাও হয়ে গেছে।
বঙ্গোপসাগরের এই নিদারুণ দ্বীপে ধর্মের মহিমা এমন করেই পুরোপুরি বজায় থাকে। এখানে সমস্ত কিছুই সৃষ্টিছাড়া।
আজ মঙ্গলবার।
ফি মঙ্গলবার সাউথ পয়েন্ট কয়েদখানায় ম্যারেজ প্যারেড হয়।
কম্বলের তলা থেকে মাথা বার করে আকাশটাকে দেখবার চেষ্টা করল সোনিয়া। এখনও রোদ ওঠে নি। সূর্য ওঠার আগে ফিকে ফিকে আলো এবং প্রচুর অন্ধকার মিশে আকাশটাকে ঝাপসা করে রেখেছে।
শীতের এই শেষ দিনগুলোতেদ্বীপের মাথায় কুয়াশা পড়তে থাকে। গাঢ় কুয়াশার নিচে দ্বীপ এবং সমুদ্র নিরাকার হয়ে যায়।
রসদ্বীপটাকে এখন দেখা যাচ্ছে না। উপসাগরের নীল জল কি দূরের সমুদ্রও চোখে পড়ে না। পাথুরে দেওয়ালে উন্মাদ উপসাগর অবিরাম মাথা কোটে। শুধু তার শব্দ শোনা যায়। নারকেল বনে খ্যাপা বাতাস এলোপাতাড়ি ছুটতে থাকে।
কান খাড়া করে বাতাস আর দরিয়ার গর্জন শোনে সোনিয়া।
অনেকক্ষণ পর আকাশ থেকে গাঢ় কুয়াশার স্তর ছিঁড়ে ফালা ফালা হয়ে যেতে থাকে। রসদ্বীপটাকে এখন একটা ধোঁয়ার পাহাড়ের মতো মনে হয়। উপসাগরের নীল ঢেউগুলো চিক চিক করতে থাকে। কম্বলের তলা থেকেই সোনিয়া দেখতে পায়, আটলান্টা পয়েন্টের মাথায় সেলুলার জেলের লাল বাড়িটা কুয়াশার মধ্যে থেকে ফুটে বেরুতে শুরু করেছে।
কুয়াশা কুঁড়ে কুঁড়ে সোনার তারের মতো রোদের রেখা এসে পড়েছে মুখের ওপর। সাউথ পয়েন্ট কয়েদখানার ওপর দিয়ে এক ঝাক সী-গাল এই সকালেই খাদ্যের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছে। সকালের নরম রোদ, আকাশের গায়ে উড়ন্ত সী-গাল, দূরের আবছা রস দ্বীপ–এগুলো বড় ভাল লাগছে সোনিয়ার। মুখের ওপর রোদ এসে পড়েছে। তবু কম্বল টেনে রোদ ঠেকাবার চেষ্টা করল না সোনিয়া।
পেটি অফিসারনী এভোয়ারী এসে হাজির হল। সোনিয়ার কম্বলে জাঁকিয়ে বসে বলল, আই আওরত, দিলটা খুব খোশ রয়েছে, না?
কেন?
আই শালী, কিছুই যেন জানিস না!
কী জানব?
কী জানব! একদৃষ্টে সোনিয়ার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল এতোয়ারী। তারপর হেসে ফেলল। বলল, মাগীর দিলে বহুত ফুর্তি!
ফুর্তি কেন?
মাগী বলে কী! ফুর্তি কেন! আজ শাদির ‘প্যারিড’ হবে। একটু দম নিয়ে এতোয়ারী শুরু করে, কমিশনার সাব তোকে শাদি করার ‘পারমিশ’ (পারমিশন) দিয়েছে। নসিবটা তোর বহুত আচ্ছা। এত তাড়াতাড়ি কেউ শাদির ‘পারমিশ’ পায় না।
বাইরের দিকে তাকায় এতোয়ারী। উপসাগর, রস দ্বীপ এবং অনেক দূরের সমুদ্র পেরিয়ে এতোয়ারীর দৃষ্টি কোনো এক দুর্নিরীক্ষ দিগন্তে উধাও হয়ে যায়। বহু দূর থেকে যেন কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে থাকে তার, চান্নু সিংকে তুই পাবি সোনিয়া। আদমীটা বড় ভাল। আদমীটার ইমান আছে, দিল আছে, আবার রুপেয়াও আছে। চান্নুকে শাদি করে তোর বহুত সুখ হবে। আমার কথাটা মনে রাখিস।
সোনিয়া জবাব দেয় না।
এরপর অনেকক্ষণ চুপচাপ। সোনিয়া আর এতোয়ারী পরস্পরের মুখের দিকে নির্নিমেষ তায়ি থাকে।
হঠাৎ দু’হাতে সোনিয়াকে জাপটে ধরে এতোয়ারী। বলে, চান্নুকে শাদি করে ছটা রোজ কাটিয়েছিলাম। আমার খুনে রেণ্ডিপড়ার বিষ রয়েছে। ঘরে দিল বসাতে পারি নি। আদমীটাকে একটু সুখ দিতে পারি না। চান্নুকে শাদি করে তুই তাকে সুখ দিস সোনিয়া।
যে নারী আন্দামানে আসার আগে দুদুটো রেণ্ডিপাড়া চালাত, দাঙ্গা-রাহাজানি খুনখারাপির বিষ যার রক্তের মধ্যে জীবাণুর মতো মিশে আছে, সাত বছর সাউথ পয়েন্ট জেলে কয়েদ খেটেও যার স্বভাব বিন্দুমাত্র বদলায় নি, চান্নু সিংকে শাদি করেও ঘরে যে দিল বসাতে পারে নি, আজ তারই গলায় অদ্ভুত এক আক্ষেপ ফুটছে, জিন্দেগীটা আমার
বরবাদ হয়ে গেল রে সোনিয়া।
বরবাদ হবে কেন? তুমি রেণ্ডিবারিক কয়েদখানার পেটি অফসারনী। মাসে মাসে তলব পাও। তোমার কত দাপট!
আমি পেটি অফসারনী! আমার কত দাপট! মাসে মাসে তলব পাই! সব ঠিক সোনিয়া, আবার সবই ঝুট। বলতে বলতে দুই হাঁটুর ফাঁকে মুখটা গুঁজে দেয় এতোয়ারী। জবরদস্ত পেটি অফিসারনীর চোখ ফেটে বুঝি আঁসু ছুটবে।
এভোয়ারীর একটা হাত ধরে সোনিয়া আস্তে আস্তে বলে, সব ঝুট কেন বহীন?
বহীন, আওরতের মরদ ছাড়া উপায় নেই। বিশোয়াস করে নিজের জান-জমানা জিন্দেগী কারো হাতে তুলে দিতে না পারলে সুখ নেই, শান্তি নেই। বলে একটু থেমে, কী যেন ভাবতে থাকে এতোয়ারী।
হয়তো সে ভাবে, দুদুটো রেণ্ডিপাড়া চালানোর মধ্যে, খুনখারাপি-দাঙ্গা-রাহাজানির মধ্যে, কি পেটি অফিসারনীগিরির মধ্যে দুনিয়ার সমস্ত আনন্দ নিহিত নেই। আজকাল বয়স হয়েছে, রক্ত ঝিমিয়ে পড়েছে। হিসাব এসেছে জীবনে। সেই হিসাবের আলোতেই একটা নতুন সত্যের চেহারা দেখেছে এতোয়ারী। হয়তো সে ভাবে, সমস্ত মত্ততা যখন ঘুচে যায়, সফেন রক্ত থেকে যখন দুটো রেণ্ডিপাড়ার বিষ মুছে যেতে থাকে, জোরাল নেশা ছুটে যাবার মতো যখন দাঙ্গা-রাহাজানির কথা মন থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, তখন প্রয়োজন একটি নির্ভরযোগ্য অবলম্বন। প্রয়োজন এমন একটি পুরুষের, যাকে বিশ্বাস করা চলে, যার হাতে জিন্দেগীটা তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়।
হঠাৎ এতোয়ারী বলে, আমার আর কোনো উপায় নেই। তামাম জীবন এই ‘রেণ্ডিবারিক’ কয়েদখানায় কাটাতে হবে। কোনোদিন আর বেরুতে পারব না।
সমস্ত উপায় খুইয়ে জীবনের বিরাট একটা সত্যের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে এতোয়ারী। আস্তে আস্তে সে বলতে থাকে, আমি যে ভুলটা করেছি, তুই সেটা করিস না বহীন। চান্নুকে ভালবাসবি, ঘরে দিল বসাবি। জিন্দেগীটা আমার মতো বরবাদ করে দিস না। অদ্ভুত এক আবেগে গলা বুজে গেল এতোয়ারীর।
সোনিয়ার কেন যেন মনে হয়, চান্নু সিং-এর সঙ্গে মাত্র ছটা দিন কাটালেও এতোয়ারীর মনে তার স্থায়ী, অক্ষয় ছাপ পড়েছে। চান্নুকে সে ভুলতে পারে নি। চান্নুর জন্য তার বুকে অফুরন্ত মহবৃত। হঠাৎই অন্য একটা প্রশ্ন জাগে সোনিয়ার মনে। কাকে বেশি ভালবাসে এতোয়ারী? চান্নু সিংকে, না নিজের জীবনকে? সোনিয়ার মনে হয়, নিজের জন্যও বুঝি এতোয়ারীর অগাধ, অথৈ ভালবাসা।
কেশে গলাটা সাফ করে নেয় এতোয়ারী। বলে, এবার উঠে পড় সোনিয়া। একটু পরই প্যারিড শুরু হবে। গোসল করে নে। তারপর সাফা কাপড়াকুর্তা পরবি। আমি তোকে সাজিয়ে দেব। নে, জলদি কর।
ফস করে সোনিয়া বলে বসে, আমি শাদি করব না পেটি অফসারনী।
কেন? এতোয়ারী খেঁকিয়ে উঠল, ছোঁকরি, শাদি না করলে রেণ্ডিবারিক জেলে পচে পচে মরবি যে! তোর ব্যারাম হয়েছে, শাদি না করলে এ ব্যারাম সারবে না।
সোনিয়ার দুটো ঠোঁটের ফাঁকে সূক্ষ্ম, দুর্বোধ্য একটি হাসি ফোটে। আশ্চর্য সে-হাসিতে এতটুকু শব্দ নেই। কী আছে, কে জানে।
হাসির নমুনা দেখে মেজাজটা ঠিক রাখতে পারে না এতোয়ারী। খেপে ওঠে সে। খানিকটা অশ্লীল, কুৎসিত খিস্তি করে সে বলে, মাগী, শাদি না করলে ওই রামপিয়ারী কুত্তীটা তোকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে।
রামপিয়ারীর নাম শুনেই অন্তরাত্মা শিউরে উঠল সোনিয়ার। ফিস ফিস করে সে বলল,, শাদি করব না, ঠিক এ-কথা বলতে চাই নি।
তবে কী বলতে চাস?
এতোয়ারীর কথায় খেয়াল নেই সোনিয়ার। রামপিয়ারীর নাম শুনেই বুকের মধ্যে সেই যে কাঁপুনি ধরেছে, এখনও থামে নি। অদ্ভুত এক ভয় মেরুদণ্ড বেয়ে খাড়া ঝিলিকের মতো উঠছে, নামছে।
এতোয়ারী চিল্লায়, আঁই মাগী, কী বলতে চাস?
শাদি করব, লেকিন চান্নুকে না।
কেন?
দিল চাল্লুকে শাদি করতে চায় না।
কেন?
দিলই বলতে পারে। এবার অনেকটা সহজ হয়ে এসেছে সোনিয়া। রামপিয়ারীকে যে ভয় পাচ্ছিল, সেটা কেটে যেতে শুরু করেছে। সেই দুর্বোধ্য হাসি চিকন একটি রেখায় দুই ঠোঁটের মধ্যে ফুটি ফুটি করছে তার।
বিচিত্র নারী সোনিয়া। কৌতুকে কি তামাশায় যখন সে মেতে ওঠে তখন তাকে বোঝ যায় না।
এতোয়ারী আর কথা বাড়ায় না। তাড়া লাগায়, ওঠ ওঠ, কয়েদানী গুনতির সময় হয়েছে। একটু পর শাদির প্যারিড শুরু হবে।
আজ সকালেই গোসল সেরে কাঞ্জিপানি খেয়ে বর্তন ধুয়ে রাখল সোনিয়া। তারপর শাদির প্যারেডের জন্য তৈরি হতে লাগল।
কালো কালো চুলগুলি মাজা ছাপিয়ে নিচে নেমে গিয়েছে। পরিপাটি করে দীর্ঘ চুলে বাহারি খোঁপা বাঁধল সোনিয়া। একটু আগে এতোয়ারী অনেকগুলো হাওয়াই বুটির ফুল দিয়ে গিয়েছিল। খোঁপার চারপাশে ফুলগুলি গেঁথে দিল। কোত্থেকে যে একটু সুর্মা আর মেহেদীও জুটিয়েছিল, সোনিয়াই জানে। চোখের কোলে সুর্মার সরু টান দিল সে, হাতের পাতায় মেহেদীর রস মাখল। দিন দুই আগে ক্ষার দিয়ে কেচে শাড়ি আর কুর্তা সাফ করে রেখেছিল, কুঁচি মেরে শাড়ি পরল। শুকনো এক টুকরো কাপড় দিয়ে ঘষে ঘষে মুখখানা চকচকে করে তুলল।
এখন আর সোনিয়াকে চেনাই যায় না। সামান্য কয়েকটি উপকরণ। তারই কারসাজিতে তার দেহে এক মোহময়ী জাদুকরী ফুটে বেরিয়েছে।
অনেক, অনেকদিন পর নিজেকে সাজিয়েছে সোনিয়া। আয়নায় নিজেকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল।
রামদেও তিওয়ারীকে মনে পড়ল সোনিয়ার। মনে পড়ল ব্রিজলালকে। না না, তারা আজ আর কেউ নয়। বুকের ভেতর অতীতের অসহ্য স্মৃতিগুলোকে পুষে নিজেকে অবিরত কষ্ট দিয়ে কী লাভ? নতুন করে জীবন শুরু করবে সনিয়া। জীবন থেকে অতীতকে কেটে হেঁটে বাতিল করে দেবে। অতীতের জন্য আজ থেকে আর মোহ নেই, দুঃখ নেই, জ্বালা নেই। বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে সে যেন আজ নতুন করে জন্ম নিয়েছে। এই দ্বীপ তাকে ঘর দেবে, একটি পুরুষ দেবে, বেঁচে ওঠার পথ দেখিয়ে দেবে।
পেটের মধ্যে মাঝে মাঝে ডেলা ডেলা মাংস ইটের টুকরোর মতো শক্ত হয়ে তোলপাড় করতে থাকে। দুঃসহ এক যন্ত্রণা তখন নাড়িগুলো ছিঁড়তে ছিঁড়তে মাংস এবং চর্বির ভেতর। দিয়ে শির শির করে ছুটতে থাকে। যন্ত্রণাটা যখন চাড়া দেয় তখন একটা ধারালো ছোরা দিয়ে পেটটাকে ফেড়ে ফেলতে ইচ্ছা করে। মনে হয়, গলায় রশি দিয়ে কি দরিয়ায় ঝাঁপ দিয়ে এই যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই পায়। এ-এক দুরারোগ্য স্ত্রীব্যাধি। পুরুষসঙ্গ ছাড়া এ-রোগের আসান্যু নেই। তাই কমিশনার সাহেব শাদির অনুমতি দিয়েছেন।
রোগ সেরে যাবে। একটি পুরুষকে ঘিরে নতুন করে বেঁচে উঠবে। বেঁচে ওঠার অন্ধ, উন্মাদ নেশায় বুঁদ হয়ে রইল সোনিয়া। বাঁচা ছাড়া জীবনের অন্য সব কিছু ভুলে গেল।
কালাপানির এই দ্বীপটাকে, নিজের জীবনকে, এমনকি এই সকালটাকেও হঠাৎ বড় ভালবেসে ফেলল সোনিয়া।
অনেকক্ষণ নিজের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল সোনিয়া। নানা ভাবনা মনের মধ্যে ভিড় জমাচ্ছিল। আচমকা লখাইর কথা মনে পড়ল। ঝড়ের দরিয়ার সেই সাথীটার কথা মনে পড়লেই কেমন যেন উদাস লাগে।
কিন্তু আজকের দিনটাই আলাদা। এর স্বাদ-গন্ধ বর্ণ স্বতন্ত্র। জীবনের অন্য দিনগুলোর সঙ্গে আদৌ এর মিল নেই।
সোনিয়ার মনে হল, ঝড়ো উন্মাদ সমুদ্রে একটা রাত একটি পুরুষের সঙ্গে কাটালেই দিলে দাগ পড়া উচিত নয়। অনায়াসে দিল থেকে লখাইর ভাবনাটা ঝেড়ে ফেলে দিল সোনিয়া।
বিশেষ কোনো পুরুষ নয়, এত বড় দুনিয়ার যে-কোনো একটি পুরুষকে নিয়ে এই রেণ্ডিরারিক কয়েদখানার বাইরে কোথাও নতুন করে জীবনটাকে শুরু করার আশায় উন্মুখ হয়ে রইল সোনিয়া।
সোনিয়ার মনের অবস্থাটা যখন এইরকম, ঠিক তখনই টিণ্ডালান রামপিয়ারীর দেখা মিলল। রামপিয়ারী কখন যে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, সোনিয়া খেয়াল করতে পারে নি।
মৃদু একটা ঠেলা দিয়ে রামপিয়ারী আস্তে ডাকল, এ সোনিয়া–
মুখটা ঘুরিয়েই চমকে উঠল সোনিয়া। রামপিয়ারীর গোল গোল, পাতাহীন চোখ স্থির হয়ে জ্বলছিল। কেমন এক ধরনের বিহ্বল, নেশাতুর দৃষ্টি ফুটে রয়েছে সে চোখে।
রামপিয়ারীর জ্বলন্ত চোখ দুটোর পেছনে একটা স্পষ্ট অর্থই থাকে। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠল সোনিয়া।
রামপিয়ারী বুঝেই উঠতে পারছে না, কেমন করে, কোন ভোজবাজিতে সোনিয়া এমন খুবসুরতী হয়ে উঠল। আচ্ছন্ন, জড়ানো স্বর ফুটল রামপিয়ারীর গলায়, এ লেড়কী, একেবারে পরী বনে গেছিস!
সোনিয়া কিছু বলল না।
রামপিয়ারী বলতে লাগল, এত খুবসুরতী সেজেছিস কেন? দেখে দেখে দিলের ধড়কান বন্ধ হয়ে যায়!
সোনিয়া এবারও জবাব দিল না।
রামপিয়ারী পা ঘষতে ঘষতে সোনিয়ার কাছে চলে এল। ফিস ফিস করে বলল, সোনিয়া, তুই জাদু জানিস, জরুর জাদু জানিস। তাই না?
অস্ফুট স্বরে সোনিয়া বলে, কি জানি–
জানিস জানিস–দুই হাতে সোনিয়াকে জাপটে ধরে রামপিয়ারী বলতে থাকে, নইলে সারা রাত আমার আঁখে নিদ আসে না কেন? সারা রাত তোর কথা ভাবি কেন?
সোনিয়া চুপ করে থাকে।
অনেকক্ষণ রামপিয়ারীও আর কিছু বলে না।
বেলা চড়ছে। দ্বীপের মাটি তেতে উঠতে শুরু করেছে। ঝকঝকে নীল আকাশে খণ্ড খণ্ড ধূসর রঙের মেঘ ভেসে চলেছে। সকালের প্রথম রোদে মেঘের টুকরোগুলি ঝলমল করতে থাকে।
সিসোস্ট্রেস উপসাগরে সিঙ্গাপুর-গামী একটা বিরাট জাহাজ এসে ভিড়েছে। জাহাজের মাস্তুলটা জ্বলছে। মাস্তুলের ডগায় একটা সাগরপাখি বসে আছে, সেটাও যেন জ্বলছে।
হঠাৎ রামপিয়ারী বলল, আজ শাদির প্যারিড হবে।
জানি।
জানিস! কেমন যেন অন্যমনস্ক দেখায় রামপিয়ারীকে। তারপরেই চকিত হয়ে উঠল সে, কী জানিস?
আজ শাদির প্যারিড হবে।
এবার একেবারে ভিন্ন কথা পাড়ল রামপিয়ারী। পাতাহীন চোখজোড়া আগে থেকেই ঝক ঝক করছিল। জ্বলন্ত চোখের তারা দুটো সোনিয়ার মুখের ওপর স্থির করে রেখে তাকায় সে। চোয়াল দুটো ক্রমশ কঠিন হতে থাকে। হনু দুটো খাড়া হয়ে ফুঁড়ে বেরোয়। মুখচোখের ভঙ্গি নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। মুহূর্তে রামপিয়ারীর চেহারায় আশ্চর্য এক পরিবর্তন দেখা দেয়।
রামপিয়ারী বলল, আমার কাছে একটা কথা লুকিয়ে রেখেছিলি কেন?
কী কথা?
তুই শাদির পারমিশ (পারমিশন) পেয়েছিস।
সোনিয়া চুপ করে রইল।
শালী খচরী, আমাকে এ-কথাটা বলিস নি কেন? রামপিয়ারী গর্জে উঠল।
এমনি বলি নি। কাঁপা গলায় বলল সোনিয়া।
এমনি বলি নি! রামপিয়ারী খেপে উঠল, মনে করেছিলি, তুই না বললে আমি টের পাব না? শালী, তোর জান তুড়ব। বলতে বলতে সোনিয়ার মুখে মাথায় সমানে কিল ঘুষি চালায় রামপিয়ারী।
কাতর স্বরে সোনিয়া বলে, আমাকে মেরো না টিণ্ডালান।
সোনিয়ার স্বরে কী আছে কে জানে। সঙ্গে সঙ্গে মার থামায় রামপিয়ারী। গলাটা হঠাৎ নরম করে ফেলে, জানি, আমি রেণ্ডিবারিক কয়েদখানার টিণ্ডালান। কিছুই আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে পারবি না সোনিয়া। বলে একদৃষ্টে সোনিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু লক্ষ করে। তারপর ফের বলে, তুই শাদি করিস না সোনিয়া।
শাদি না করলে আমার ব্যারাম সারবে না।
ঝুট!
ডাক্তার সাব বলেছে।
কিছুক্ষণ কী ভেবে রামপিয়ারী নরম গলায় বলে, শাদি যদি করতেই হয়, আমাকে কর। তোকে রুপেয়া দেব, গয়না দেব।
পাতাহীন চোখদুটো ধিকি ধিকি জ্বলে রামপিয়ারীর। সে-চোখের দিকে তাকিয়ে কী বুঝবার চেষ্টা করে সোনিয়া। যতটা বোঝে, তার চেয়ে অনেক বেশি দুর্বোধ্যই থাকে।
রামপিয়ারী আবার বলে, আজ শাদির প্যারিড হবে। লেকিন তুই প্যারিডে দাঁড়াবি না।
জরুর দাঁড়াব। মরদ নিয়ে ঘর করতে আমার সাধ হয় না?
দাঁতে দাঁত ঘষে রামপিয়ারী। চাপা, তীব্র স্বরে বলে, মরদে কোন সুখ! মরদ! মরদ! মরদ নইলে জামানা বুঝি বেচাল হয়ে যায়!
হাঁ। কেমন একটা জেদ যেন সোনিয়াকে পেয়ে বসে। সে বলে, প্যারিডে আমাকে দাঁড়াতেই হবে। নইলে এই রেণ্ডিবারিক-এ থাকলে তুমিই আমাকে খতম করবে।
নির্মম চোখে তাকিয়ে থাকে রামপিয়ারী। সে বুঝেই উঠতে পারে না, কেমন করে সোনিয়া এতটা দুঃসাহসী হয়ে উঠতে পারে। তার মতো সাঙ্ঘাতিক একটা টিণ্ডালানের মুখের ওপর জেদ দেখাবার শক্তি কোত্থেকে সোনিয়া পেল, ভেবে ভেবে তাজ্জব বনে যায় সে।
ভয়ঙ্কর গলায় রামপিয়ারী বলে, সাফ কথাটা শুনে রাখ। প্যারিডে দাঁড়াবি না।
দাঁড়াব।
কেমন করে দাঁড়াস, আমিও দেখব!
রামপিয়ারী আর বসল না, বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে পড়ল। তার দীর্ঘ দেহ আর দীর্ঘতর একটি ছায়া একাকার হয়ে অনেক দূরে মিলিয়ে গেল।
একটু পরেই ম্যারেজ প্যারেড-এর সময় হয়ে গেল।
সাউথ পয়েন্ট কয়েদখানার ছোট ময়দানটা সতেজ ঘাসে এক টুকরো সবুজ গালিচার মতো দেখায়। সেটার চারপাশ থেকে অনেকগুলো নারকেল গাছ সিধা আকাশের দিকে মাথা তুলেছে। নারকেল গাছের মাথায় রোদ এসে পড়েছে।
আজকের দিনটা বড় উজ্জ্বল, বড় সুন্দর।
এত বড় আকাশে দুচার টুকরো ধূসর রঙের মেঘ ছাড়া বাকি সব কিছুই নিষ্কলঙ্ক, নীল। অনেক শূন্যে ডানা স্থির রেখে এক ঝাক গোয়েলেখ পাখি বাতাসে সাঁতার কাটে।
ময়দানটার এক দিকে গুটিকতক চেয়ার। সেগুলো দখল করে জাঁকিয়ে বসেছেন ডাক্তার, সাউথ পয়েন্ট কয়েদখানার মেম জেলার, সেলুলার জেলের সাহেব জেলার, জেল সুপারিনটেনডেন্ট। তাদের পাশে পুলিশ-জমাদার-হাবিলদারদের বাহিনী। উলটো দিকে টিণ্ডালান, পেটি অফিসারনী আর ওয়ার্ডারনীরা দাঁড়িয়ে রয়েছে।
ময়দানের ওপর কাতার দিয়ে জন বিশেক পুরুষ কয়েদি দাঁড়িয়ে আছে। এরা সকলেই সরকার থেকে সেলফ সাপোর্টার্স টিকেট পেয়েছে। পেয়েছে শাদি করার আইনমাফিক অধিকার।
মেম জেলার উঠে দাঁড়ালেন। হাতের ইঙ্গিতে একটা টিণ্ডালানকে ডাকলেন। বললেন, কয়েদানীদের নিয়ে এস।
একটু পর কয়েদিনীদের নিয়ে ফিরে এল টিণ্ডালানটা।
প্রায় পনেরো জন কয়েদিনী পুরুষ কয়েদিদের মুখোমুখি দাঁড়াল। এরাও শাদি করার পারমিশ (অনুমতি) পেয়েছে।
বঙ্গোপসাগরের এই বিচিত্র দ্বীপে আরো বিচিত্র স্বয়ম্বরের ব্যবস্থা হয়ে গেল।
একটা টিণ্ডালান হাঁকল, এ ময়দানা কয়েদি, এ জেনানা কয়েদানী–আপনা আপনা আদমী পসন্দ কর। আপনা আপনা সাথী বেছে নে, দেখে নে, তাদের রাজিবাজি করিয়ে নে।
এর পরই ম্যারেজ প্যারেড শুরু হল।
কয়েদিনীদের সঙ্গে সারি দিয়ে দাঁড়িয়েছে সোনিয়া। অজানা এক ভয়ে বুকের ভেতরটা দুরু দুরু করে, হৃৎপিণ্ড তোলপাড় হয়ে যায়। নাকের ডগায় কণায় কণায় ঘাম ফুটে ওঠে। মাথা তুলে পুরুষ কয়েদিদের ভেতর থেকে মনের মতো একজনকে যে পছন্দ করবে, সে শক্তিটুকু পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে সোনিয়া। যে-নারী কোতল করে দ্বীপান্তরী সাজা নিয়ে কালাপানি আসতে ডরায় নি, বাকি জীবনের জন্য একটি পুরুষ বেছে নিতে তার বুক এত কঁপে কেন?
কয়েদি এবং কয়েদিনীদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে টিণ্ডালানটা আবার চেঁচায়, শরমের মাথা খা লেড়কীরা। আপনা আপনা মরদ পসন্দ কর। লেড়কারা শরমবালীদের শরমের মাথা খেতে শিখিয়ে দে।
একে একে পুরুষ কয়েদিরা সোনিয়ার সামনে দিয়ে যায়। ফিস ফিস করে প্রত্যেকেই বলে, মুখ তোল জেনানা।
মুখ তুলতেই তো চায় সোনিয়া, কিন্তু পারে কই?
একটু দাঁড়িয়ে থেকে কয়েদিটা হয়তো প্রশ্ন করে, নাম কি তোমার?
সোনিয়া জবাব দেয় না। গলা শুকিয়ে কাঠ। চোয়াল দুটো যেন আটকে গিয়েছে।
একে একে প্রায় সবগুলো কয়েদিই সামনে এসে দাঁড়ায়। একই প্রশ্ন করে। জবাবের জন্য কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে অন্য কয়েদিনীর দিকে চলে যায়।
কিছুই যেন দেখতে পাচ্ছে না সোনিয়া, কিছুই শুনছে না। সমস্ত কিছু ঝাপসা, অস্পষ্ট।
স্মৃতি থেকে রামদেও তিওয়ারী নামে একটা দুর্বহ অতীতকে ঝেড়ে মুক্ত হতে চেয়েছিল সোনিয়া। আশ্চর্য, সেই মানুষটাকেই এখন সব চেয়ে বেশি মনে পড়ছে। এই সাউথ পয়েন্ট কয়েদখানা, এই বিচিত্র স্বয়ম্বর, সামনের উপসাগর, দূরের দরিয়া পেরিয়ে তার মন ফিরে গিয়েছে সেই সুদূর গাঁওখানায়। যেখানে রামদেও তিওয়ারী বিশ বিশটা ভঁইস চরাত, লোটা ললাটা সিদ্ধি ঘুঁটে ঢক ঢক করে গিলত, মেজাজটা বদখত হয়ে গেলে তারস্বরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পাটনা শহর থেকে শিখে আসা সেই গানটা গাইত। সৈয়া গ্যয়া গোবিনকা সাথ—
মনে পড়ে, রামদেও তেওয়ারী নামে আদমীটা তার বুকে মুখ গুঁজে একটু শান্তি পেতে চেয়েছিল, তার মহবৃতের মধ্যে নতুন করে বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু–
পুরোপুরি আর ভাবতে পারে না সোনিয়া। তার আগেই একটা ভারি নরম গলা কানে আসে, মুখ তোল সোনিয়া।
নিজের নাম শুনে চমকে উঠল সোনিয়া। মুখ তুলে আরো একবার চমকায়। একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে বিকট চেহারার চান্নু সিং। মুখে মাথায় অনেকগুলো ব্যাণ্ডেজ বাঁধা।
চান্নু সিং মোলায়েম হাসে, আমাকে চিনতে পারছিস না সোনিয়া? আমি চান্নু। বলেছিলাম, মাথায় লাল সাফা (পাগড়ি) বেঁধে আসব। এই দ্যাখ লাল সাফা।
হাঁ। ঘাড় কাত করে সোনিয়া বলল, চিনতে পেরেছি।
চান্নু সিং-এর দুটো কুতকুতে রক্তাভ চোখে খুশি ঝিকমিক করে। আঙুল চালিয়ে দাড়িগুলো আঁচড়ে আঁচড়ে আদর করল সে। তারপর বলল, তোর জন্যে কত খুন দিয়েছি, পুলিশের কত ডাণ্ডা খেয়েছি। এই দ্যাখ এখনও ঘা শুকোয় নি। ব্যাণ্ডেজ বাঁধা রয়েছে।
করুণাই বুঝি হয় সোনিয়ার। চান্নু সিং যখন নরম স্বরে কাকুতি করে, তখন বিদ্রুপে এবং কৌতুকে ঠোঁট দুটো বেঁকে যার তার। আশ্চর্য, একটু আগের ভয়-আতঙ্ক-লজ্জা এখন আর নেই। সোনিয়া দুই ঠোঁটের ফাঁকে একটি সূক্ষ্ম হাসি টিপে টিপে মারতে থাকে।
সোনিয়ার মন বড় তাজ্জবের বস্তু। কখন যে সেটা তামাশায় মেতে উঠবে, কখন যে খুশিতে রাঙিয়ে উঠবে, আবার কখন যে যন্ত্রণায় সেই মন থেকে অলক্ষ্যে খুন ঝরবে, নিজেই কি হদিস পায় সে? মুহূর্তে মুহূর্তে তার মন বদলায়, মেজাজ বদলায়, ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতির খাত বেয়ে ছুটে চলে। এই হয়তো কৌতুক, এই বিদ্রূপ, এই যন্ত্রণা, আবার এই অকারণ, অবারণ খুশি।
বিচিত্র নারী সোনিয়া। খানিক আগে রামদেও তিওয়ারীর চিন্তায় মনটা ভারী হয়ে ছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে তাকে বেমালুম ভুলে গেল সোনিয়া। চান্নু সিংকে নিয়ে মেতে উঠল। বলল, আমার জন্যে বহুত খুন দিয়েছ মরদ?
হাঁ হাঁ–বহুত খুন।
আমার জন্যে আর কী দিতে পার?
আর কী দেব? স্থূল মননধর্মের চোয়াড়ে মানুষ চান্নু সিং। সোনিয়ার কথার সূক্ষ্ম মারপ্যাঁচ সে বোঝে । হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর সেই প্রশ্নটাই আবার করে, তোর জন্য আর কী দেব?
ভেবে বল না–
অনেকক্ষণ চোখ পিট পিট করে চিন্তা করে চান্নু সিং। কিন্তু কিছুই ঠিক করে উঠতে পারে না। সোনিয়ার মতো আওরতকে খুশি করার কৌশল তার মাথায় আসে না।
ভাবতে ভাবতে মাথাটা গরম হয়ে ওঠে চান্নু সিং-এর। শেষ পর্যন্ত চিন্তা করা ছেড়ে দিয়ে কাতর স্বরে বলে, তুই বল না, কী দেব?
জান দিতে পার মরদ?
ওয়া গুরুজি কি ফতে! চান্নু সিং চেঁচিয়ে উঠল, জান দিলে তোকে পাব কেমন করে?
সোনিয়া জবাব দিল না। তার যা চিরকালের স্বভাব, ঠোঁটের ফাঁকে হাসি টিপে টিপে মারতে লাগল।
এবার উত্তেজিত হয়ে উঠল চান্নু সিং। চড়া গলায় সে বলল, তোর কথা আমি বুঝি না। আমার সিধা কথাটার সাফ জবাব দে।
বল—
আমাকে শাদি করবি তো? রাজিবাজি?
রাজিবাজি হতে পারি, লেকিন তার আগে আমার একটা কথার জবাব দাও। সরাসরি চান্নু সিং-এর মুখের দিকে তাকাল সোনিয়া। বলল, শাদি তো করতে চাও। পুরা দিলটা দিতে পারবে তো মরদ?
চান্নু সিং-এর বিরক্ত মুখে ভ্রুকুটি ফুটল। চাপা, তীব্র স্বরে সে বলল, দিল কেমন করে দেব? এ কি কাপড়া গয়না যে হাতে করে দেব। তোর কথা আমি বুঝি না।
এবার ব্যাপারটা সহজ করে দেয় সোনিয়া, আমাকে পেয়ার করবে তো মরদ? আমার জন্যে তোমার দিলে মহবৃত আছে?
খুশিতে চান্নু সিং-এর গোঁফদাড়ি-ভরা বিরাট মুখটা আলো হয়ে যায়। জড়ানো জড়ানো কেমন যেন আবেগের স্বর ফোটে তার গলায়, জরুর পেয়ার করব। যেদিন পয়লা তোকে দেখেছি, সেদিন থেকেই পেয়ার করতে লেগেছি।
সচ?
জরুর সচ, গুরুজি কসম।
হঠাৎ সোনিয়া বলে বসে, তা হলে তোমাকেই শাদি করব মরদ। আমি রাজিবাজি।
চান্নু সিং সোল্লাসে চিল্লায়, রাজিবাজি?
হাঁ।
টিণ্ডালনটা শকুনের মতো ধারাল চোখে নজর রাখছিল। যেই শুনল দুপক্ষই রাজিবাজি, অমনি টেনে টেনে চেঁচাল, এ মরদ, এ জেনানা–এবার দূরে গিয়ে দিলের কথা বল। হাল হকিকত জেনে নে। যা, উধারে গিয়ে বস।
সবুজ ময়দানটা নারকেল গাছে গাছে ছয়লাপ।
এক-একটা নারকেল গাছের নিচে এক-এক জোড়া নারী এবং পুরুষ বসে রয়েছে। কালাপানির এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বাকি জীবনের জন্য তারা পরস্পরের সাথী বেছে নিচ্ছে।
দূরের একটা নারকেল গাছের তলায় গিয়ে বসল চান্নু সিং আর সোনিয়া।
জেলার, সুপারিন্টেনডেন্ট, পুলিশ-হাবিলদার-জমাদার, টিণ্ডালান, পেটি অফিসারনীরা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য রাখছে জুটিগুলোর ওপর। ভব্যতার সীমা পেরিয়ে বেচাল হওয়ার উপায় নেই কারোর।
চান্নু সিং বলল, হাবরাডিন (এবারডিন) বাজারে একটা চা-খানা খুলেছি। রোজ দুটাকা লাভ হয়। গারাচারামা গাঁও-এ সিরকার (সরকার) থেকে ঝুপড়ি তুলেছে। একটা ঝুপড়ি ভাড়া নিয়েছি। সেখানে আমরা থাকব।
হাঁ।
নয়া নয়া শাড়ি আর গয়না কিনেছি তোর জন্যে।
হাঁ।
যেদিন সিরকার তোকে নিয়ে যাবার পারমিশ (পারমিশন) দেবে সেদিন শাড়ি-গয়না নিয়ে আসব।
হাঁ।
আমার তিন শ’ রুপেয়া আছে, সাতটা দামি পাথর আছে। সব তোকে দেব।
আচ্ছা।
খুশি তো?
খুশি।
শেষ শীতের এই দিনটা বড় ভাল লাগছে সোনিয়ার। বিকট চেহারার চান্নু সিংকে ভাল লাগছে। তীব্র, ধারাল রোদ এসে পড়েছে মুখে। শিরায় শিরায় রক্ত ঝাঝা করছে। নেশার ঘোরের মতো মনে হচ্ছে সমস্ত কিছু। এই রোদ, চান্নু সিং, এই ম্যারেজ প্যারেড–সব মিলিয়ে কালাপানির এই তাজ্জব দুনিয়াটাকে হঠাৎ বড় ভালবেসে ফেলল সোনিয়া।
আরো খানিকটা পর দুজনে উঠে পড়ল।
মেম জেলার এবং সাহেব জেলার দুজনের নাম লিখে নিলেন।
নিয়ম অনুযায়ী ম্যারেজ প্যারেডে দাঁড়াবার আগে সোনিয়া এবং চান্নু সিং-এর ডাক্তারি পরীক্ষা হয়ে গিয়েছিল।
জেলাররা বললেন, এক সপ্তাহ বাদ সোনিয়াকে নিতে আসবে চান্নু সিং। সোনিয়াকে নিয়ে সিধা এখান থেকে ডেপুটি কমিশনারের অফিসে যাবে। সেখানে রেজিস্ট্রি করিয়ে এক সপ্তাহ এক সাথ থেকে রসদ্বীপে চিফ কমিশনারের অফিসে যেতে হবে। সেখানে ফাইনাল রেজিস্ট্রি হবে। এই এক সপ্তাহের মধ্যে যদি বনিবনা না হয়, তবে এ-শাদি ভেঙে যাবে।
ইয়াদ থাকবে? জেলাররা বাঁধা গত আউড়ে যায়।
চান্নু সিং এবং সোনিয়া, দুজনেই ঘাড় কাত করে জানাল, হাঁ, ইয়াদ থাকবে।
জেলাররা বললেন, এবারে টিপছাপ দাও।
দুখানা ছাপানো দরখাস্তে সোনিয়া এবং চান্নু সিং টিপছাপ দিল।
হঠাৎ চমকে উঠল সোনিয়া। সাপের হিস হিসের মতো একটা শব্দ আসছে। শব্দটা সোনিয়ার অত্যন্ত চেনা।
ঘুরে দাঁড়াল সোনিয়া। দেখল, তাঁতঘরের পেছন থেকে একজোড়া পাতাহীন চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে চোখ নিষ্ঠুর, সাঙ্ঘাতিক।
সোনিয়া শিউরে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে মুখটা সরিয়ে অন্য দিকে তাকায়। এবার দৃষ্টিটা অন্য একজনের ওপর গিয়ে পড়ল। সে এতোয়ারী।
একটা নারকেল গাছ দু’হাতে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে এভোয়ারী। ঘাড় ভেঙে ঝুলে পড়েছে। অস্বাভাবিক নির্জীব ভঙ্গিতে শরীরটা ঝুঁকে আছে তার।
একদৃষ্টে চান্নু সিংকে দেখছে এতোয়ারী। চোখের তারা দুটো চক চক করছে তার।
দৃশ্যটা দেখতে দেখতে সোনিয়ার বুকের মধ্যে নরম নারী হৃদয়টি মোচড় দিয়ে উঠল।
একটু পর পুলিশ-জমাদার-হাবিলদার, সেলুলার জেলের সাহেব জেলার, জেল সুপারিন্টেনডেন্ট এবং পুরুষ কয়েদিরা সাউথ পয়েন্ট কয়েদখানার বাইরে বেরিয়ে গেল।
বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে আজকের মতো স্বয়ম্বর সভা শেষ হল।
ফাঁসির আসামীদের জন্য পাশাপাশি তিনটে সেল।
তারই একটার গরাদ ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে জাজিরুদ্দিন। আকাশে কী দেখছে সে-ই জানে।
এই দ্বীপে বসন্ত এসে গিয়েছে। অন্য সব বছরের মতো এবারও উত্তর-পশ্চিম দিগন্ত পার হয়ে ঝাঁকে ঝাকে ধূসর রঙের মেঘ আন্দামানের আকাশে হানা দিতে শুরু করেছে। মৌসুমি মেঘ এক দিক থেকে আর এক দিকে পাড়ি জমায়। সাগরপাখিরাও পাড়ি জমিয়েছে। খণ্ড খণ্ড মেঘগুলোকে তারা বুঝি মনে করেছে অচেনা কোনো পাখির ঝাঁক। মেঘেদের নাগাল পাওয়ার জন্য পাখিরা অনেক, অনেক উঁচুতে উঠে যাচ্ছে।
জাজিরুদ্দিন আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু তার দৃষ্টির সামনে যেন আকাশ, সাগরপাখি কি মৌসুমি মেঘ ছিল না। সে ভাবছিল। কাল ভোরে তার ফাঁসি হবে। এখন দুপুর। আর মাত্র কয়েকটা ঘণ্টা সে এই দুনিয়ার আলো দেখবে, ফুসফুসে এই দুনিয়ার বাতাস টানবে। এই পৃথিবীর সঙ্গে তার চল্লিশ না পঁয়তাল্লিশ বছরের সম্পর্ক, ঠিক মনে পড়ছে না। আর মাত্র কয়েকটা ঘণ্টার মধ্যে এতদিনের পুরনো সম্পর্কটা চুকিয়ে ফেলতে হবে। এর জন্য বিন্দুমাত্র আপশোশ নেই জাজিরুদ্দিনের। একটা দীর্ঘশ্বাসও তার পড়ছে না, মন এতটুকু বিকল হচ্ছে না।
অদ্ভুত এক উত্তেজনায় সমস্ত মনটা ভরে রয়েছে জাজিরুদ্দিনের। বিরসা তার ধরম নিতে চেয়েছিল। তার প্রতিফলও সে পেয়েছে। কাল ফাঁসি হবে। এর জন্য লেশমাত্র দুঃখ নেই জাজিরুদ্দিনের, কিন্তু দুঃখ হচ্ছে অন্য কারণে। ফাঁসির সেলের মধ্যে দাঁড়িয়ে এই প্রথম তার মনে হল, বিরসাকে না মারলেই হত। নিজের নিজের ধরম নিয়ে তাদের বেঁচে থাকা হয়তো একেবারেই অসম্ভব ছিল না।
আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে জাজিরুদ্দিন ভাবছিল। জান সে দেবে, কিন্তু ধরম দেবে না। ধরম দেওয়ার মতো গুণাহ্ আর নেই।
বঙ্গোপসাগরের এই কয়েদখানায় ধর্মের মর্যাদা রাখার জন্য ফাঁসির দড়িতে ঝোলা, ধরম দেওয়ার চেয়ে অনেক বেশি কাম্য।
সূর্যটা এখন সরাসরি সেলুলার জেলের মাথায় এসে উঠেছে। খা খা করছে রোদ।
আকাশের দিকে আর তাকানো যায় না।
চোখ নামিয়ে সাত নম্বর ব্লকের ওয়ার্কশপের দিকে তাকাল জাজিরুদ্দিন। দেখল, ওয়ার্কশপের গা ঘেঁষে গেটের দিকে চলেছে লখাই।
জাজিরুদ্দিন ডাকল, এ লখাই–
লখাই থমকে দাঁড়াল। চারদিকে চনমন করে তাকাল। সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না, কোন দিক থেকে ডাকটা আসছে।
জাজিরুদ্দিন এবার খেঁকিয়ে উঠল, এ শালে কুত্তা, এই দিকে দ্যাখ–এই যে আমি–ফাঁসি কুঠরির ভেতর। আয়-আয়–
গুটি গুটি পায়ে জাজিরুদ্দিনের সেলের সামনে এসে দাঁড়াল লখাই।
জাজিরুদ্দিন অল্প অল্প হাসছিল। বিরসাকে খুন করার পর সেই যে পুলিশ-জমাদাররা তাকে জেলার সাহেবের অফিসে ঢুকিয়েছিল, তারপর থেকে সেলুলার জেলে আর তাকে দেখা যায় নি। একদৃষ্টে জাজিরুদ্দিনকে লক্ষ করছে লখাই।
জাজিরুদ্দিন সমানে হাসছে আর বলছে, এ শালে, নালায়েক বুদ্ধ কঁহাকা, ফাঁসির কুঠরিতে আমাকে দেখে তাজ্জব বনে গিয়েছিস, না?
লখাই জবাব দিল না।
আরে বুদ্বু, কাল আমার ফাঁসি। সেই যে বিরসা কুত্তাটাকে খতম করেছিলাম–কথাটা পুরো না করে খ্যাখ্যা করে হাসতে লাগল জাজিরুদ্দিন। হাসির দাপট কমলে ফের শুরু করল, দ্যাখ লখাই, বিরসার নসিবে ছিল, আমার হাতে কোতল হবে। যা নসিবে আছে, তা
তো হবেই। হঠাৎ তার গলাটা অস্বাভাবিক ভারী শোনায়। চোখের তারা দুটো চক চক করে। আকাশের দিকে তাকিয়ে কী যেন খুঁজতে থাকে।
জাজিরুদ্দিন যেন জাদু করেছে লখাইকে। হতবাক দাঁড়িয়ে থাকে সে। জাজিরুদ্দিনের মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে কিছু একটা বুঝতে চেষ্টা করে।
এবার গাঢ়, ভাঙা ভাঙা স্বরে জাজিরুদ্দিন বলে, কাল আমার ফাঁসি হবে, সে জন্যে আপশোশ নেই। দিলে আমার বহুত সুখ, বহুত ফুর্তি। বুঝলি লখাই, কালাপানির এই কয়েদখানায় আমি আমার ধরমের মান রাখতে পেরেছি।
লখাই যে সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সে-হুঁশ নেই জাজিরুদ্দিনের। লখাই যেন উপলক্ষ মাত্র। আসলে কথাগুলো সে নিজেকেই বলছে, নিজেকেই শোনাচ্ছে। বিরসাকে কোতল করার পেছনে নির্ভরযোগ্য যুক্তি খাড়া করে যাচাই করে নিচ্ছে।
জান থাকতে আমি ধরম দেব না। বলে একটু থামে জাজিরুদ্দিন। সেলের গরাদের দিকে তাকিয়ে লখাইকে আস্তে আস্তে বলে, বুঝলি লখাই, যত রোজ বাঁচবি, ধরম দিবি না। ধরমের চেয়ে বড় চীজ এই দুনিয়ায় কিছু নেই। কথাটা ইয়াদ রাখিস।
অবাক হয়ে লখাই ভবে, এই জাজিরুদ্দিনই একদিন হঠাৎ কোত্থেকে এসে সেলুলার জেলের কয়েদিদের ধরে ধরে ধরম নিতে চেয়েছিল।
ওদিকে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে জাজিরুদ্দিন। গরাদের ফাঁক দিয়ে এদিকে সেদিকে নজর ফেলে কাকে যেন খুঁজছে।
লখাই বলল, কাকে খুঁজছিস?
পেটি অফসার শালে এখনো তো হাজমকে (নাপিতকে) নিয়ে এল না। দেখছিস, দাড়ির রোঁয়াগুলো কেমন বেড়েছে। গালে ফুটছে। বলতে বলতে হঠাৎ জাজিরুদ্দিন খেপে উঠল, শালে এলে অ্যায়সা লাথ হাঁকাব, বাপের নাম ভুলে যাবে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ।
তারপর লখাই বলল, আমি যাই। জবাবদার দাঁড়িয়ে আছে।
গরাদের ফাঁক দিয়ে হাত বার করে লখাইর ঘাড়টা ধরে ফেলল জাজিরুদ্দিন। খেঁকিয়ে উঠল, শালে কুত্তা, কোথায় যাচ্ছিস?
বাঃ, বেশ কথা বলছিস! কাজে যাব না? ‘ফিনিক্স বে’তে সড়ক বানাতে হবে।
যাবি যাবি, জিন্দেগীভর কাম তো আছেই। লেকিন আমাকে কি আর পাবি রে শালে! গলার স্বরটা কেমন যেন শোনায় জাজিরুদ্দিনের, কাল সকালেই তো দুনিয়া থেকে খসে পড়ব।
এমন যে সাঙ্ঘাতিক জাজিরুদ্দিন, এই মুহূর্তে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে লখাইর। অদ্ভুত এক বেদনাবোধ তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।
নিজের অজান্তে কখন যেন পরিবর্তন শুরু হয়েছিল। পুরনো মনটা, পুরনো ধারণাগুলি আশ্চর্যভাবে বদলে যাচ্ছে লখাইর। তা না হলে তার বিবেকহীন, বর্বর মনে সহানুভূতি জন্মায় কেমন করে? এক কালে আদিম, অর্ধপশুগঠন মানুষের মতো মন ছিল লখাইর। সেই মনে একটু একটু করে নরম অনুভূতি জন্ম নিচ্ছে। সে যেন স্পর্শাতুর এবং অনুভূতিপ্রবণ হয়ে উঠেছে। না হলে জাজিরুদ্দিনের জন্য বুকের ভেতরটা মোচড় খেয়ে ওঠে কেন?
ফাঁসির আসামীদের সেল তিনটের পাশে মস্ত এক রেন-ট্রি। ছোট ছোট, গোল গোল পাতার মধ্য দিয়ে চিকরি-কাটা রোদ এসে পড়েছে। সেলুলার জেলের মাথায় বিরাট আকাশের নীল টুকরোটা জ্বলছে। আকাশের নীলে আটকে-থাকা এক ঝাঁক পাখি ঝলসে যাচ্ছে যেন। ওয়ার্কশপের টিনের চালটা ঝকঝক করছে।
প্রথমে আকাশ দেখল জাজিরুদ্দিন, পাখি দেখল। তারপর তার দৃষ্টিটা রেন-ট্রি, চিকরি কাটা রোদ, ওয়ার্কশপের টিনের চালের ওপর দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে লখাইর মুখের ওপর এসে পড়ল।
হঠাৎ যেন কথাটা মনে পড়ল জাজিরুদ্দিনের। সামান্য উত্তেজিত দেখাল তাকে। বলল, যে যে কাজ করার জন্যে দুনিয়ায় এসেছিলাম, সব শেষ করেছি। যাকে যে-কথা দিয়েছি, সব রেখেছি। লেকিন–
লেকিন কী? তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় লখাই।
লেকিন একটা কথা রাখতে পারলাম না লখাই। জাজিরুদ্দিনের গলায় আক্ষেপ ফোটে।
কী কথা?
চান্নু সিংকে জবান দিয়েছিলাম, তার সাথ সোনিয়ার শাদির ব্যবস্থা করব। চান্নু শালাও বলেছিল, সোনিয়ার সাথ তার শাদির ব্যবস্থা করলে আমি যা চাই, তা-ই দেবে। লেকিন কথাটা রাখতে পারলাম না।
সোনিয়ার সঙ্গে চান্নু সিংয়ের শাদির কথা শুনে লখাই চমকে উঠল। কিন্তু সে কিছু বলবার আগেই জাজিরুদ্দিন আবার শুরু করল, কাল সকালে দুনিয়া থেকে আমার ঠিকানা হারিয়ে যাবে! একটা সাচ্চা দোস্তের কাজ করবি লখাই?
পলকহীন লখাইর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল জাজিরুদ্দিন। দৃষ্টিটা যেন কেমন হয়ে উঠেছে। অদ্ভুত গাঢ় স্বরে সে বলল, কাল আমার ফাঁসি, সময়ও আর নেই। খুদার নামে তিন কসম খেয়ে আমাকে কথা দে লখাই।
কী কথা?
চান্নুর সাথ তুই সোনিয়ার শাদির বন্দোবস্ত করে দিবি।
লখাইর দু-হাত চেপে ধরল জাজিরুদ্দিন। বলতে লাগল, কথা দিয়ে কথা রাখতে না পারলে ফাঁসিতে লটকেও আমার সুখ হবে না। বল দোস্ত, আমার কথা রাখবি?
এমন যে জবরদস্ত লখাই–খুনখারাপি, রাহাজানি, মেয়েমানুষ চুরি, নারী-মাংসের ব্যবসা চালানো, ধর্ষণ–কোনো কিছুতেই যে পিছু হটে না, এই মুহূর্তে সে জাজিরুদ্দিনের সামান্য প্রশ্নের জবাবটা দিতে পারল না।
দুই হাত ধরে ঝকানি দিল জাজিরুদ্দিন, বল দোস্ত, বল শালে—
এবারও উত্তর নেই লখাই-এর।
খানাপিনার পর আরামের জন্য কয়েদিরা যে ঘণ্টাখানেক সময় পায় তা কাবার হয়ে এসেছে। ফাঁসির আসামীদের পাহারা দেয় যে সিপাইটা, সে যেন কোথায় গিয়েছিল, এইমাত্র এসে পড়ল। লখাইকে দেখে সে তাড়া লাগায়, এ কুত্তা, ভাগ–
ওয়ার্কশপের ওপাশ থেকে পেটি অফিসার জবাবদাররা হইচই শুরু করে দিয়েছে, এ শালে লখাই–কামে যাবি না?
জাজিরুদ্দিনের হাত থেকে নিজের হাত দুটো ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়তে দৌড়তে ওয়ার্কশপের দিকে পালিয়ে গেল লখাই। পেছন দিকে একবারও মুখ ফেরাল না।
দাঁতে দাঁত ঘষে জাজিরুদ্দিন গর্জে উঠল, হারামীকা বাচ্চে—
তখনো দক্ষিণ আন্দামানের আকাশে বিকেলের নিস্তেজ রোদ ছিল। সাগরপাখিরা ক্লান্ত ডানায় বাতাস মাপছিল। উপসাগরের বিরাট বিরাট ঢেউগুলির মুখে শাসানি ছিল। আটলান্টা পয়েন্টের নারকেল গাছগুলির পাতা ঝিলমিল করছিল। ফিনিক্স বের জল কেটে কেটে উড়ুক্কু মাছগুলি রুপোর তীরের মতো দিগ্বিদিকে উড়ছিল। মাউন্ট হ্যারিয়েটের মাথায় অরণ্যের চেহারাটা দুর্বোধ্য হতে শুরু করেছিল। পানিঘাটে লর্ড মেয়োর কবরের সেই সাদা ক্ৰশটা দেখা যাচ্ছিল কি যাচ্ছিল না।
এমন সময় সেলুলার জেলে ফিরে এল লখাইরা।
আজকের মতো ফিনিক্স উপসাগরের পাড়ে সড়ক বানাবার কাজ শেষ হয়েছে।
ওয়ার্কশপের পাশ ঘেঁষে যেতে যেতে লখাইর চোখে পড়ল, সেলের গরাদ ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে জাজিরুদ্দিন। রোদের তেজ কেমন করে আস্তে আস্তে মরে আসছে, কেমন করে তার জীবনের শেষ দিনটা একটু একটু করে নিবে যাচ্ছে, বুঝিবা তাই দেখছিল।
কাল রাত কাবার হওয়ার আগেই ফাঁসি হয়ে যাবে জাজিরুদ্দিনের। শেষ দিনের মতো ছোট্ট কুঠুরি থেকে বিরাট আকাশ আর দুনিয়াটাকে যতখানি দেখে নেওয়া যায়, সাধ মিটিয়ে দেখছিল জাজিরুদ্দিন। কাল পৃথিবী থেকে মুছে যাবে সে। আন্দামানের এই আকাশ, উপসাগর, সিন্ধুশকুন, এই নিদারুণ সেলুলার জেল–সব, সবই পড়ে থাকবে। কত কালের পুরনো এই দুনিয়া, এই ভয়ানক বঙ্গোপসাগর, সারি সারি অসংখ্য দ্বীপ–সমস্ত কিছুই থাকবে। ঘুরে ঘুরে অব্যর্থ নিয়মে আজকের এই বিকেলটির মতো কত বিকেল আসবে। আজকের মতোই সিন্ধুসারসগুলো বাতাস মাপতে মাপতে কোথায় চলে যাবে। আজকের মতোই রোজ রোজ দিনের রং ফিকে করে দিতে দিতে রোদ মরে যেতে থাকবে। উপসাগরে এমনই হালফা উঠবে, নারকেল গাছে গাছে ছয়লাপ টিলাগুলির মাথায় এমন করেই উন্মাদ বাতাস ক্রমাগত ঘা মারবে।
হয়তো শেষ দিনের মতো দুনিয়ার সব রং দেখে নিচ্ছে জাজিরুদ্দিন, সব শব্দ শুনছে, সব গন্ধ শুঁকছে, ফুসফুস ভরে যতখানি পারছে বাতাস টানছে।
ওয়ার্কশপের গা ঘেঁয়ে এগুতে এগুতে দাঁড়িয়ে পড়েছিল লখাই। হঠাৎ জাজিরুদ্দিনের নজর এসে পড়ল তার ওপর। হাতের ইশারায় তাকে ডাকল সে।
দুপুরে জাজিরুদ্দিনের হাত থেকে নিজেকে ছিনিয়ে নিয়ে একরকম পালিয়েই গিয়েছিল লখাই। এখন কিন্তু গুটি গুটি তার কুঠুরিটার সামনে এসে দাঁড়াল। যে-মানুষটার কাল ফাঁসি, বুঝিবা তার জন্য মায়া হয়ে থাকবে লখাইর মনে।
লখাই দেখল, দাড়িগোঁফ কামিয়ে পরিষ্কার হয়ে রয়েছে জাজিরুদ্দিন। চিকন এক জোড়া গোঁফ, সূক্ষ্ম নূর। চাঁছা গাল চকচক করছে। মাথায় পরিপাটি টেরি বাগানো।
জাজিরুদ্দিন হাসল। বলল, ডর নেই লখাই। দোস্তের কাজ আর করতে বলব না তোকে। চান্নু সিং-এর সাথ সোনিয়ার শাদির ব্যবস্থা তোর করতে হবে না।
লখাই অবাক হয়ে যায়।
জাজিরুদ্দিন দাড়িগোঁফ চেঁছেছুলে মুখটাকেই সাফ করেনি, রেশমি লুঙ্গি পরেছে, কালিদার পাঞ্জাবি পরেছে, মাথায় লাল টকটকে একটা শৌখিন ফেজ চড়িয়েছে।
সেলুলার জেলের কর্তৃপক্ষের মনে কিঞ্চিৎ করুণাই হয়ে থাকবে। কয়েদখানার ভেতরে কয়েদিদের জন্য নির্দিষ্ট ধারিওলা ইজের এবং কামিজ ছাড়া অন্যরকম কাপড়-কুর্তার ব্যবহার বে-আইনি। কিন্তু যে কয়েদি কাল সকাল হওয়ার আগেই ফাঁসির দড়িতে ঝুলবে, তার জন্য খুব সম্ভব নিয়ম-কানুন সামান্য শিথিল করা যায়।
কালিদার পাঞ্জাবি, রেশমি লুঙ্গি আর লাল টকটকে ফেজে জীবনের শেষ শখটা মিটিয়ে নিচ্ছে জাজিরুদ্দিন।
একদৃষ্টে তাকিয়েই আছে লখাই।
জাজিরুদ্দিন বলল, কী দেখছিস শালে?
লখাই জবাব দিল না।
জাজিরুদ্দিন বলতে লাগল, তুই ভাবছিস, কালই তো লোপাট হয়ে যাব। তাহলে কটা ঘণ্টার জন্য এমন সাজগোজ করলাম কেন?
হাঁ-–
আধফোঁটা একটা শব্দ করল লখাই।
কাল দিন-দুনিয়ার মালেকের দরবারে গিয়ে জবাবদিহি করতে হবে। দুনিয়ায় এসে কী করলাম, তার হিসেব দিতে হবে। বুঝলি লখাই–টেনে টেনে দম নেয় জাজিরুদ্দিন। পরক্ষণে আবার শুরু করে, কয়েদখানার এই কাপড় কুর্তা পরে, দাড়িগোঁফ-ওলা এই বদখত চেহারা নিয়ে উপরবালার কাছে হাজির হওয়া যায় না। তাই সাফা লুঙ্গি কামিজ ফেজ পরলাম। বলে খ্যাখ্যা করে হেসে ওঠে জাজিরুদ্দিন।
তারপর খানিকক্ষণ চুপচাপ।
জাজিরুদ্দিনই ফের স্তব্ধতা ভাঙে, এ লখাই, এতক্ষণ আসমানের দিকে চেয়ে চেয়ে কী ভাবছিলাম বল দিকি?
কী জানি?
বুঝলি বুদ্ধ নালায়েক, ভাবছিলাম, জিন্দেগীটা মস্ত এক তামাশা, বঢ়িয়া এক দিল্লেগী। আজ তোর সাথ কথা বলছি, কাল আর আমাকে দেখবি না। বলতে বলতে হঠাৎ হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল জাজিরুদ্দিন।
আন্দামানের আকাশ থেকে রোদ মুছে যাচ্ছে দ্রুত। যে বিষণ্ণ, নিস্তেজ আলোটুকু সেন্ট্রাল টাওয়ারের মাথায় আটকে ছিল, তা-ও আর নেই।
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লখাই আর জাজিরুদ্দিন। দুজোড়া চোখ স্থির হয়ে পরস্পরের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে।
বিকেলের খানা আনে নি লখাই। মনটা তার ভাল নেই।
কাল সকাল হওয়ার আগেই জাজিরুদ্দিন ফাঁসির দড়িতে ঝুলবে। যতবার কথাটা ভেবেছে, ততবারই লখাইর মনটা অস্থির হয়ে উঠেছে। জাজিরুদ্দিনের ভাবনাটা কিছুতেই সরিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। চিন্তাটা তাকে পাকে পাকে পেঁচিয়ে ধরেছে। তীব্র যন্ত্রণার মতো সেটা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
সারা রাত একটা মুহূর্তও ঘুমোতে পারল না লখাই।
বঙ্গোপসাগরের হিম হিম বাতাস, রোঁয়াওলা ভারী কম্বলের উষ্ণ আরাম, টানা ঘুমের পক্ষে এত আয়োজন থাকা সত্ত্বেও লখাইর চোখে ঘুম এল না। বিছানায় ছটফট করে কাটাল সে। অন্য অন্য দিন ওয়ার্ডার মোহর গাজীর সঙ্গে অনেকটা রাত পর্যন্ত কথাবার্তা বলে লখাই, গল্প করে, নানা খবর নেয়। কিন্তু আজ আর কথা বলতে ইচ্ছা হয় না। জাজিরুদ্দিনের ভাবনাটা মাথার মধ্যে একটা চোখা ফলার মতো ক্রমাগত বিধছে।
শেষ রাত্রির দিকে লখাইর চোখের পাতা জুড়ে এসেছিল।
আটলান্টা পয়েন্টের মাথায় বিরাট সেলুলার জেলটা এখন নিস্তব্ধ। একটানা, অগাধ ঘুমের নিচে সেটা তলিয়ে রয়েছে।
অন্ধকার আর কুয়াশা ছুঁড়ে দিনের প্রথম রোদ এখনো বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে এসে পৌঁছতে অনেক দেরি। কয়েদখানাটা একটা আবছা দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
আচমকা শেষ রাত্রির সেলুলার জেল এবং কুয়াশা আর অন্ধকারের তলায় এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপটাকে ভীষণভাবে ভয় পাইয়ে দিয়ে জাজিরুদ্দিনের চিৎকার ভেসে আসে, আল্লা-আ-আ–আমি এক খুদাবন্দ—
ধড়মড় করে উঠে বসল লখাই। তারপর দৌড়ে গরাদের সামনে এসে দাঁড়াল।
এরপর আর কোনো শব্দ শোনা গেল না।
জাজিরুদ্দিনের ফাঁসি হয়ে গেল।
এ-এক নিদারুণ দ্বীপ।
লড়াই করে এখানে নিজের ধর্মকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। এখানে ধর্মের জন্য চাকুর ফলায় জান দেয় বিরসা। ধর্মের জন্যই এখানে জাজিরুদ্দিন ফাঁসির দড়িতে ঝোলে।
চাকুর ফলায় এবং ফাঁসির দড়িতে এই বর্বর দ্বীপের মহিমা অব্যাহত থাকে। সভ্যতা থেকে, পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপ ধর্মের মর্যাদা এমন করেই অক্ষুণ্ণ রাখে। এই দ্বীপে এটাই একান্ত স্বাভাবিক এবং সঙ্গত।