সিন্ধুপারের পাখি (Sindhuparer Pakhi) : 06
দু পাঁচ দিনের মধ্যেই বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে বসন্ত এসে পড়বে। তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। দক্ষিণ পশ্চিম কোণ থেকে হানাদার মেঘ আন্দামানের আকাশে ছুটে আসতে শুরু করেছে। উপসাগর ছুঁড়ে একটা গোঁ-গোঁ গম্ভীর গর্জন ঠেলে বেরিয়ে পড়তে চায়। দরিয়া থেকে বিরাট বিরাট হালফা পাহাড়ের মতো ফুলে ফুলে, ফুঁসে ফুঁসে, দুর্জয় বেগেদ্বীপের দিকে ধাওয়া করে আসে। কালো কালো, পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের তলা দিয়ে আঁকে ঝকে সিন্ধুশকুন উত্তর দিকে পাড়ি জমিয়েছে। শীত আসার আগে বাতাসে হাজার হাজার মাইল ভাসতে ভাসতে সুদূর অজানা কোনো দিগন্ত থেকে এই পাখিরা পূর্ব-ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে ডিম পাড়তে এসেছিল। শীত ফুরিয়ে আসছে, আবার তারা ফিরে চলেছে।
আকাশ-জোড়া বিরাট একটা মৃদঙ্গে ঘা পড়ছে যেন। গুরু গুরু শব্দটা সমুদ্রের গর্জনের সঙ্গে মিশে এই সৃষ্টিছাড়া দ্বীপে একটা ভীষণ সর্বনাশকে ডেকে আনছে।
বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে বসন্তর মাহাত্মই আলাদা।
পশ্চিমা ভিখনটা পিনিকের সঙ্গে কী মিশিয়ে দিয়েছিল, সেই জানে। কিন্তু তার ক্রিয়া হয়েছে সাঙ্ঘাতিক। লখাই বেজায় কাহিল হয়ে পড়েছে।
লা ডিনের কুঠুরির গরাদে সেই যে টলে পড়েছিল লখাই, আজ আর উঠে বসার সমার্থ পর্যন্ত নেই। টলে পড়ার পর কখন যে ভিখন আহীর আর মোপলা বকরুদ্দিন তাকে ধরাধরি করে তার কুঠুরিতে রেখে গিয়েছে, খেয়াল করতে পারে না। কাল দুপুর থেকে বাকি দিনটা আর পুরো একটা রাত বেহুঁশ অবস্থায় কেটেছে। বিকেলে পেটি অফিসার নারকেল ছোবড়ার তার নিতে এসেছিল। লা ডিনই তার বুঝিয়ে দিয়েছে। রাতে ওয়ার্ডার মোহর গাজী বরকতক ডাকাডাকি করে জবাব না পেয়ে কিছুক্ষণ খিস্তি করে ফিরে গিয়েছে। কিছুই টের পায় নি লখাই।
সেলুলার কয়েদখানায় এইমাত্র সকাল হল।
আর মাথা খাড়া করতে পারছেনা লখাই। আচ্ছন্ন, অস্থির দৃষ্টিতে এধারে ওধারে তাকায় সে। চারপাশ থেকে কুঠুরির চারটে দেওয়াল যেন একটু একটু করে চেপে বসেছে, ছাদটা নেমে আসছে। পেছনের দেওয়ালে সেই ছোট ফোকরটা অনেক খুঁজেও বার করতে পারল না লখাই। বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে অফুরন্ত, পর্যাপ্ত বাতাস। তবু লখাইর মনে হল, শ্বাসনালীটা কেউ যেন শক্ত মুঠো চেপে ধরেছে। হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে নোনা বাতাসের যোগাযোগ রাখতে প্রাণটা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। বুক হাপরের মতো ওঠানামা করছে তার।
এই মুহূর্তে আকাশের কালো কালো জমাট মেঘ ফেড়ে রোদের দীর্ঘ কটি রেখা এসে পড়েছে সেলুলার জেলের মাথায়।
পেটি অফিসার নসিমুল গণি গরাদের ফাঁকে নাক ঢোকাল। যথারীতি শখানেক অশ্রাব্য খিস্তি আউড়ে ডাকল, এ লখাই, শালে আন্দামানের জনাব বনে গেলি যে! নালায়েক হারমীকা বাচ্চা, কাম কাজ নেই? সিরকারের বড় মেহমান এসেছে! খানা গিলবে আর ঘুমোবে, ও-সব আরাম কালাপানির কয়েদখানায় চলবে না। ওঠ শালে। সকাল হয়েছে, মালুম পাচ্ছিস না বুঝি! অ্যায়সা ডাণ্ডা হাঁকাবো! তোকে আজ ছোবড়া ছিলতে দেব না। সিধা হুইল ঘানিতে চাপাব।
সারা গায়ে কম্বল জড়িয়ে পড়ে ছিল লখাই। পেটি অফিসারের আওয়াজ পেয়ে ঘোর ঘোর, রক্তাভ চোখে গরাদের দিকে তাকাল। তাকালই শুধু, আবছা একটা মানুষের কাঠামো ছাড়া কিছুই নজরে পড়ল না। পরক্ষণে নিজের অজান্তে তার চোখ বুজে গেল।
চাবি ঘুরিয়ে গরাদের তালা খুলল নসিমুল গণি। খেকাতে কোতে কুঠুরির মধ্যে ঢুকে বলল, শালে, খুব যে দিল্লাগি করছিস! একবার আঁখ মেলছিস আবার বুজছিস! পিটিয়ে পিটিয়ে আজ তোর জান চৌপট করে ফেলব।
পেটি অফিসারের এত শাসানিতেও লখাই উঠবার লক্ষণ দেখায় না। নড়াচড়ার শক্তি সে হারিয়ে ফেলেছে।
চোখ থেকে আগুন ঠিকরে বেরুল। নাকের ভেতর দিয়ে যে কালো কালো রোঁয়াগুলো বেরিয়ে পড়েছে সেগুলো নড়তে লাগল। গলার ভেতর থেকে একটা উত্তেজিত গর গর শব্দ বেরিয়ে আসছে। পেটি অফিসার দুই হাতে লখাইর গর্দানটা আঁকড়ে ধরল, তারপরেই চমকে উঠল। লখাইর গা থেকে অসহ্য উত্তাপ তার হাতের তালুটা যেন পুড়িয়ে দিল।
লখাইর গর্দান ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকে পেটি অফিসার। চোখদুটো কুঁচকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে কী যেন লক্ষ করে। তারপর ডাকে, আঁই হারামী–
লখাই জবাব দিল না।
দুই থাবায় লখাইকে প্রচণ্ড ঝাঁকানি মেরে পেটি অফিসার গর্জে উঠল, আঁই লখাই, কুত্তীকা বাচ্চা, জেগে জেগে ঘুমোচ্ছিস!
কোমরের খাঁজ থেকে তেল-পাকানো বেতের মোটা ডাণ্ডাটা টেনে বার করল পেটি অফিসার। লখাইর কাঁধে একটা গুঁতো মেরে বলল, ওঠ শালে–
আন্দামান মানেই সেলুলার জেল। আর সেলুলার জেল মানেই পেটি অফিসার। পেটি অফিসার মানেই পাঠান। পাঠান মানেই মুখে খিস্তি, হাতে ডাণ্ডা এক দুশমন মূর্তি।
বঙ্গোপসাগরের এই বর্বর দ্বীপের হৃদয় কোনোকালে ছিল কিনা, ইতিহাসে তার নজির নেই। যদি থেকেও থাকে, নসিমুল গণির মতো পেটি অফিসারেরা অর্ধ শতাব্দী ধরে তাকে তিল তিল করে হত্যা করেছে। হৃদয়হীন এই দ্বীপ পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আপন মহিমায় বিরাজ করছে।
পেটি অফিসার লখাইর গর্দান ধরে খাড়া বসিয়ে দিল। লখাই টলে পড়ছিল, মুণ্ডুটা ধরে টানতে টানতে তাকে কুঠুরির বাইরে আনল নসিমুল। সমানে চিল্লাতে লাগল, শালেকে আজ হুইল ঘানিতে জুড়ে দেব। খানা কি এমনি এমনি আসে! সিরকার কি কালাপানিতে আরামখানা বসিয়েছে! সসুরকা কোঠি পেয়েছ হারামী! বলে একটু থামে। গলার শিরাগুলো উত্তেজনায় কাছির মতো ফুলে ওঠে নসিমুলের। ফের চিল্লায়, হুইল ঘানিতে জুড়ে দিলে বুঝবি খানা কোত্থেকে আসে! বুঝবি দরিয়ায় কত পানি! তারপর এক দমে লাচাড়ির মতো গুটিকতক গালি আউড়ে যায়।
পাশের কুঠুরি থেকে লা ডিন সমস্ত লক্ষ করেছিল। সে ডাকল, এ পেটি অফিসার—
হাঁ জি–
ইধর এস।
নাসিমুল লা ডিনের কুঠুরির সামনে এসে দাঁড়ায়।
লা ডিন বলল, কেন লখাইকে তখলিফ দিচ্ছ। ওর বুখার হয়েছে।
পেটি অফিসার যেন তাজ্জব বনে গেল। সেলুলার জেলের কয়েদিদের যে রোগ হয়, বা হওয়া উচিত, এ তার ধারণার বাইরে। কিছুক্ষণ অবাক তাকিয়ে থাকে সে, তারপর প্রবল বেগে মাথা ঝাঁকায়, না না লা ডিনজি, লখাই শালে বহুৎ হারামজাদা, বুখারের নাম করে কাজে ফাঁকি মারতে চায়। দুই ডাণ্ডা হাঁকালে সিধা হয়ে যাবে কুত্তাটা।
না।
কঠিন, গম্ভীর স্বরে লা ডিন বলতে লাগল, ওর বুখার হয়েছে। ওকে সিকমেনডেরায় নিয়ে যাও। আভী যাও।
লা ডিনের স্বরে এমন কিছু ছিল, পেটি অফিসারের মতো দুর্দান্ত পাঠানও আর কিছু বলতে পারল না। গুটি গুটি পায়ে লখাইর সামনে এসে দাঁড়াল।
চারপাশের গরাদের ফাঁকে ফাঁকে কয়েদিদের মুখ দেখা দিয়েছে। অবাক হয়ে আজব কয়েদি লা ডিন আর পেটি অফিসারের কাণ্ড দেখছে তারা।
মুখের চেহারাটা কদর্য করে গজ গজ করছে পেটি অফিসার। কয়েদিরা আন্দাজ করল, নাসিমুল গালি দিচ্ছে। কিন্তু তার একটি বর্ণও বোঝা যাচ্ছে না।
লখাই বেহুঁশ পড়ে রয়েছে। পেটি অফিসারের ইচ্ছা ছিল, আজ থেকেই লখাইকে ঘানিতে চাপায়। কালাপানির কয়েদখানা কি চীজ, মালুম পাইয়ে দেয়। কিন্তু এমন একটা সদিচ্ছাকে আপাতত বাগ মানিয়ে রাখতে হল। খুদার দুনিয়ার বাইরে বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপের স্বরূপ আর লখাইকে জানানো গেল না। যত আপোশ হল, তার বিশ গুণ হল আক্রোশ। ভাবল দুদশ রোজের মধ্যেই কালাপানির মহিমা সে লখাইকে টের পাইয়ে দেবে।
পেটি অফিসার খেঁকিয়ে উঠল, চল শালে, সিকমেনডেরায় যাবি। বলেই দুই পা ধরে টানতে টানতে লখাইকে সিঁড়ির মুখে নিয়ে এল। তারপর সামনের কুঠুরিটা খুলে অন্য একটা কয়েদিকে বার করল। তার ঘাড়ে লখাইকে চাপিয়ে বলল, নিচে চল।
পাথুরে সিঁড়ি কাঁপাতে কাঁপাতে পেটি অফিসার নিচে নামতে লাগল।
লখাইর সেলের ঠিক পাশেই পরাঞ্জপের সেল। কুর্তা প্যান্ট মাথায় বাঁধা। উলঙ্গ পরাঞ্জপে লম্বা কদমে সেলের মধ্যে ঘুরছে। ঘুরছে আর হাসছে। হাসছে আর বিড় বিড় করে বকছে, লখাই শালের খুব এলেম। বিশ পচাশ রোজ কালাপানির কয়েদখানায় কাটিয়ে বুদ্ধি খুলে গিয়েছে। বুখারের নাম করে কাজে ফাঁকি মারছে। শালে আমার পাক্কা দোস্ত বনতে পারবে। বকতে বকতে গলা ফাটিয়ে হা হা করে হেসে উঠল পরাঞ্জপে।
সেলুলার জেলের মধ্যে কয়েদিদের জন্য একটা ছোট হাসপাতাল রয়েছে। লখাইকে নিয়ে প্রথমে সেখানে এল পেটি অফিসার।
নেটিভ ডাক্তার বুক পেট টিপে লখাইকে অনেকক্ষণ পরীক্ষা করল। বলল, রোগটা বেশ শক্তই বাধিয়ে বসেছে। এখানে হবে না, রস দ্বীপের ডাক্তারখানায় যেতে হবে। সুপারিনটেনডেন্ট সাহেবের পারমিশন করিয়ে রাখব। বিকেলে এটাকে নিয়ে রস-এ যাবে।
ডাক্তার অন্য রুগী দেখতে গেল। পেটি অফিসার ছুটল চার নম্বর ব্লকের দিকে। এখনো কয়েদিদের সেলের তালাই ভোলা হয়নি।
আর হাসপাতালের বারান্দায় বেহুশ পড়ে রইল লখাই। জ্বরের অসহ্য তাপে তার চামড়া পুড়ে যাচ্ছে।
এরপর গোটা দিনটা হাসাপাতালে বারান্দায় কাটল লখাইর। এক কণা খাদ্য কি এক বিন্দু দাওয়াই জুটল না। কেউ খোঁজও নিল না তার।
আন্দামানের এই নিদারুণ কয়েদখানা কয়েদির জীবন সম্বন্ধে একেবারেই নির্বিকার, উদাসীন।
বিকেলের দিকে জ্বরের প্রকোপ কমল, বেহুশ অবস্থাটা কাটল। বারান্দার মোটা একটা থামে ঠেসান দিয়ে বসল লখাই। অসহ্য যন্ত্রণায় ঘাড় থেকে মাথাটা যেন খসে পড়বে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পেটি অফিসার নসিমুল গণি, পুলিশের একজন জমাদার এবং জন দুই সিপাই এসে পড়ল। ডাক্তারের কাছ থেকে জেল সুপারিনটেনডেন্টের পারমিশন মিলল। তক্ষুনি লখাইকে নিয়ে সকলে এবারডিন জেটিতে রওনা হল।
সেলুলার জেলের বাইরে এসে পড়ল সকলে।
কতদিন এই দ্বীপের কয়েদখানায় কাটাল, এই মুহূর্তে লখাই ঠিক করে উঠতে পারছে । জ্বরের দাপটে স্নায়ুগুলো এখন শিথিল, স্মৃতিটা বড় দুর্বল। একবার মনে হল, সেলুলার জেলে সে বিশ দিন আটক রয়েছে। আবার মনে হল, পুরো চল্লিশ দিনের এক সেকেন্ড কম নয়। হিসেবটা কিছুতেই মেলাতে পারে না লখাই।
দুই সিপাইর কাঁধে হাতের ভর রেখে টলতে টলতে এবারডিন জেটিতে এসে পড়ল লখাই। উতরাই বেয়ে নামতে নামতে হৃৎপিণ্ডটা যেন ফেটে পড়ছিল। তবু খুব ভালো লাগছে লখাইর। এই কটা দিন সেলুলার জেলের মাথায় এক টুকরো আকাশ, সারি সারি কুঠুরি, ওয়ার্কশপ, পেটি অফিসার, টিণ্ডাল আর ওয়ার্ডার দেখে দেখে চোখের সাড় ছিল না যেন।
সামনে নীল জলের উপসাগর, দূরে অগাধ, অসীম সমুদ্র। অনেক দূরে ধোঁয়ার পাহাড়ের মতো হ্যাভলক দ্বীপটা চোখে পড়ে কি পড়ে না। সকালে কালো কালো, পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ আন্দামানের আকাশ ঘিরে ফেলেছিল। এখন সেই মেঘ উড়ে উড়ে আকাশ আর সমুদ্র যেখানে এক হয়ে মিশেছে, তার ওপারে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।
বিকেলের নরম রোদে উপসাগরের মৃদু ঢেউগুলি ঝিকমিক করে। উড়ুক্কু মাছেরা উপসাগরময় উড়ে বেড়ায়।
দেখতে দেখতে চোখ দুটো যেন জুড়িয়ে গেল লখাইর। এই উপসাগর, বিকেলের । নরম রোদ, উড়ুক্কু মাছের ফিনফিনে রুপোলি ডানা, সব মিলেমিশে লখাইর সমস্ত যন্ত্রণা, পিনিকের ব্যারাম অনেকখানি কমিয়ে দিল।
একটু পরেই লঙ ফেরি এসে পড়ল এবারডিন জেটিতে। সিপাইরা ধরে ধরে মোটর বোটে তুলল লখাইকে।
উপসাগরটা পাড়ি দিতে মিনিট দশেকের বেশি লাগল না। রসদ্বীপের জেটিতে নেমেই চমকে উঠল লখাই।
জেটির এক কিনারে গুটিকতক মেয়েমানুষ দলা পাকিয়ে বসে আছে। তাদের ঘিরে রয়েছে জনাকয়েক পুলিশ, একজন জমাদার আর তিন জন টিণ্ডালান। মেয়েমানুষগুলোর মধ্যে সোনিয়াকেও দেখা যাচ্ছে।
দেখামাত্রই চিনতে পারল লখাই। ঝড়ের দরিয়ায় পুরো একটি রাত যে নারীর সান্নিধ্যে কাটানো যায়, যার নরম হাতের ডলায় বুকের যন্ত্রণা উবে যায়, তাকে কি এত সহজে ভোলা যায়!
কদিন ধরেই রসদ্বীপের হাসপাতালে আসছে সোনিয়া। পেটে অসহ্য যন্ত্রণা। মাংসের একটা ডেলা সমস্ত তলপেটটা জুড়ে চাকা বেঁধে আছে। ডেলাটা যখন ওঠানামা করে, পেটের ভেতরটা তোলপাড় করে একটা যন্ত্রণার ঢেউ দেহময় ছোটাছুটি শুরু করে দেয়। তখন মনে হয়, নিচের দিকটা শরীর থেকে ছিঁড়ে পড়বে। দাঁতে দাঁত চেপেও কষ্টের বেগ সামলাতে পারে না সোনিয়া। মাঝে মাঝেই বেহুশ হয়ে পড়ে।
রেণ্ডিবারিক জেলের হাসপাতালে কদিন সুই (ইঞ্জেকশান) নিয়েছে সোনিয়া। কিন্তু যন্ত্রণার কোনো আসান্যুই হয়নি। সেটা বেড়েই চলেছে। মাংসের ডেলাটা ক্রমাগত ফুলছে। এ এক দুরারোগ্য স্ত্রী ব্যাধি।
রেণ্ডিবারিক জেলের ডাক্তারই রসদ্বীপের হাসপাতালে পাঠিয়েছে সোনিয়াকে। কদিন ধরে টিণ্ডালান, পেটি অফিসারনীদের পাহারায় রোজ রস-এ আসছে সে।
পশ্চিমা ভিখনটা তো মিথ্যা স্তোক দেয়নি। সত্যিই সোনিয়া রসদ্বীপে এসেছে!
লখাই ভাবল, সোনিয়ার সঙ্গে একটু দেখা করা আর দুচারটে কথা বলার জন্য সে পিনিক ফুকেছে, তাতেই তার ওই রোগ। কটা দিন অসহ্য যন্ত্রণায় একেবারে কাবু হয়ে। রয়েছে সে।
সোনিয়াকে দেখতে দেখতে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। হৃৎপিণ্ডটা হাজার গুণ জোরে লাফালাফি করতে লাগল। অদ্ভুত এক উত্তেজনায় কাহিল শরীরটা কাঁপছে।
মোটর বোট দেখে সোনিয়ারা উঠে পড়েছিল। সাউথ পয়েন্ট কয়েদখানা থেকে দুপুরে তারা রসদ্বীপে এসেছিল, এখন ফিরে যাচ্ছে।
দুই সিপাইর কাঁধে ভর দিয়ে সামনের দিকে এগুতে এগুতে লখাই ডাকল, সোনিয়া–
প্রথমে শুনতে পায়নি সোনিয়া। ঘাড় গুঁজে অন্য কয়েদানীদের সঙ্গে মোটর বোটটার দিকে হাঁটছিল।
ক্ষীণ, কাতর স্বরে আবার ডাকল লখাই, আঁই সোনিয়া—
চমকে সোনিয়া মাথা তুলল। এক লহমায় সে লখাইকে চিনে ফেলেছে। চলতে চলতে থমকে গেল সে। অস্ফুট গলায় বলল, এ মরদ–তুই!
লখাইকে নিয়ে যে জমাদার এসেছে, সে খেঁকিয়ে উঠল, শালে উল্লু, আওরতের সাথ মুলাকাত মহবৃত করতে রস-এ এসেছিস! পিটিয়ে জান পয়মাল করে দেব।
সে সিপাই দুটোর কাঁধে ভর রেখে লখাই এগুচ্ছিল, তাদের দিকে তাকিয়ে জমাদার হুমকে উঠল, হারামীটাকে জলদি নিয়ে চল।
সিপাইরা লখাইকে টানতে টানতে সামনের দিকে বিশ কদম এগিয়ে গেল।
টিণ্ডালান রামপিয়ারী সোনিয়াকে নিয়ে এসেছিল। পাতাহীন চোখে একদৃষ্টে সোনিয়ার রকম সকম দেখছিল আর ফুঁসছিল। দাঁতে দাঁতে ঘষে সে হ্যাঁচকা টান মারল। এবং সেই টানে সোনিয়াকে মোটর বোটে এনে তুলল।
সোনিয়া এবং লখাইর মধ্যে এখন অনেকটা দূরত্ব।
অতি কষ্টে দুর্বল ঘাড়টা ঘুরিয়ে সোনিয়াকে খুঁজছে লখাই। সিপাইরা সুযোগ দিল না। আরেক টানে লখাইকে নিয়ে সড়কের বাঁক ঘুরে ওপরে উঠে গেল। সোনিয়াকে আর দেখা গেল না।
মোটর বোটে গলাটা অস্বাভাবিক লম্বা করে চনমনে চোখে লখাইকে খুঁজছিল সোনিয়া। টিণ্ডালান রামপিয়ারী তার মাথাটা ধরে উলটো দিকে ঘুরিয়ে দিল।
একটু পর মোটর বোট ছেড়ে দিল।
হাসপাতালের দিকে যেতে যেতে লখাইর মনে হল, পিনিকের ব্যারামের এত আয়োজন নেহাতই ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে।
সড়কের ওপর একটুকরো ছোট পাথর পড়ে ছিল। প্রচণ্ড আক্রোশে শরীরের সমস্ত শক্তি পায়ে এনে সেটাকে এক লাথি হাঁকায় লখাই। পাটা ফেটে রক্ত ঝরতে লাগল। পাথরের টুকরোটা সড়ক পেরিয়ে ওধারে উড়ে গেল।
জমাদারটা লখাইর কাছে এগিয়ে এল। ঘনিষ্ঠ স্বরে বলল, কি বে, আওরতটাকে চিনিস নাকি?
লখাই জবাব দিল না।
কী জানি কেন, হঠাৎ দ্বীপান্তরের কয়েদি দুর্দান্ত লখাই হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে।
লং ফেরিটা উপসাগর ছুঁড়ে সাউথ পয়েন্ট কয়েদখানার দিকে ছুটছে।
এখন বিকেল।
বেজায় ফুর্তিতে উড়ুক্কু মাছগুলি মোটর বোটের চারপাশে ফিনফিনে রুপোলি ডানায় উড়ছে। নীল জলে পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো সাদা ফেনায় ভরিয়ে দিয়ে মোটর বোট ছুটে চলেছে।
সোনিয়ার চোখ দুটো জ্বলছে। একদৃষ্টে ফেনার দিকে তাকিয়ে কী যেন সে খোঁজে। তার মনের অতলে কী আছে, কে বলবে।
গোল গোল, পাতাহীন চোখে সোনিয়ার দিকে চেয়ে রয়েছে টিণ্ডালান রামপিয়ারী। সোনিয়ার গা ঘেঁষে সে বসেছে।
এতক্ষণ একটা কথাও কেউ বলেনি।
মোটর বোটটা সিসোস্ট্রেস উপসাগরের আধাআধি পেরিয়ে এসেছিল। রামপিয়ারী সোনিয়ার গলায় আস্তে একটা খোঁচা মারল। চাপা, তীব্র স্বরে ডাকল, এ সোনিয়া–এই–
সোনিয়া অন্যমনস্কর মতো বসে আছে। মোটর বোটের ঘা খেয়ে উপসাগরের নীল জলে যে ফেনারা জন্ম নিচ্ছে, একদৃষ্টে সেদিকেই তাকিয়ে থাকে সে।
সোনিয়ার চুলের মুঠি ধরে ঝকানি দিল রামপিয়ারী। বলল, শালীর হুঁশ নেই। ডাকছি, কানে যাচ্ছে না! আওরত বহুত খচরী।
মুখ ফেরায় সোনিয়া। দেখে, স্থির দৃষ্টিতে রামপিয়ারী তার দিকে চেয়ে রয়েছে। তার চোখদুটো মাছের আঁশের মতো চক চক করছে।
সোনিয়া বলল, কী মতলব তোমার?
অল্প হাসে রামপিয়ারী। কালো কালো ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে গোটাকয়েক ভাঙা দাঁত দেখা দেয়। আগের মতোই চাপা স্বরে সে বলল, ওই হারামীটা কে?
কোন হারামী?
কোন হারামী! শালী বুঝতে পারছিস না?
না। সোনিয়ার গলাটা কঠিন শোনায়।
কিছুক্ষণ চুপ করে কিছু ভাবে রামপিয়ারী। সোনিয়ার মনের গতিক বুঝবার চেষ্টা করে। কোন দিক দিয়ে এগুলে সোনিয়ার মুখ থেকে সঠিক জবাবটা বেরুবে, বুঝে উঠতে পারছে না। রসদ্বীপের জেটিতে সেই কয়েদিটাকে দেখার পর থেকে স্বস্তি নেই রামপিয়ারীর। কিছু একটা আন্দাজ করে নিয়েছে সে। তার মনে হয়েছে, কয়েদিটার সঙ্গে সোনিয়ার জান-পয়চান আছে। সেই পরিচয় কত কালের এবং কতটা গভীর, ঠিক করে উঠতে পারছে না রামপিয়ারী। কয়েদিটার সঙ্গে সোনিয়ার যে কী সম্পর্ক, তা না বোঝা পর্যন্ত সে উতলা হয়েই থাকবে।
সোনিয়ার মন বোঝা কি সহজ কথা! একেক সময় রামপিয়ারীর মনে হয়, সোনিয়া বড়ই দুজ্ঞেয়। আন্দামানের দরিয়ার চেয়েও সেটা অথৈ, পারকূলহীন।
বিচিত্র নারী এই রামপিয়ারী। তার মনের গতিও বিচিত্র। তার মন কোন সর্পিল খাত বেয়ে চলে, নিজেই কি সে বোঝে!
এই মুহূর্তে অদ্ভুত এক ঈর্ষায় রামপিয়ারীর বুকের ভেতরটা পুড়ে পুড়ে খাক হতে লাগল।
মোটর বোটটা সাউথ পয়েন্ট কয়েদখানার কাছাকাছি এসে পড়েছে।
গলার স্বর এবার অনেকটা খাদে নামিয়ে ফেলল রামপিয়ারী। আস্তে আস্তে ডাকল, এ সোনিয়া–এই শালী–
ইতিমধ্যে চোখ দুটো উপসাগরের দিকে নিয়ে গিয়েছিল সোনিয়া। সেদিকে তাকিয়ে থেকেই সে বলল, হাঁ–কী বলছ টিণ্ডালান?
মুখটা এই দিকে ফেরা।
মুখ দিয়ে তো শুনব না, কান দিয়ে শুনব। তুমি বল, কান আমার খাড়া আছে।
থুতনিটা ধরে সোনিয়ার মুখ নিজের দিকে ঘুরিয়ে দেয় রামপিয়ারী। একটু হাসে। গালে টোকা দিয়ে খানিকটা আদরও করে। গোল পাতাহীন চোখে কী যেন ফুটে বেরোয় রামপিয়ারীর। দেখতে দেখতে শিউরে ওঠে সোনিয়া। সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে নেয়।
ফিস ফিস করে রামপিয়ারী বলল, তোকে কত পেয়ার করি সোনিয়া, তুই কি বুঝিস না? আমার ওপর তোর মন নেই। আমার জন্যে তোর দিলে একটুও মহত্ত্বৎ নেই।
সোনিয়া জবাব দেয় না।
রামপিয়ারী আবার বলে, তোকে এত পেয়ার করি, দিলের সব কথা বলি, লেকিন তুই আমাকে একটা কথাও বলিস না।
কী বলব? সোনিয়ার গলা আবছা শোনায়।
ওই আদমীটা কে? রস-এর জেটিতে যে তোকে ডাকল, ওর সঙ্গে তোর কত কালের জান-পয়চান আছে?
অদ্ভুত এক জেদ পেয়ে বসে সোনিয়াকে। সে উলটে প্রশ্ন করল, কোন আদমীটা?
এ তামাশাবালি ছোঁকরি, আমার সাথ দিল্লাগী করবি না। সচ বল।
সোনিয়া চুপ করে গেল।
সাউথ পয়েন্টে বাঁক ঘুরে নীল উপসাগর দূরে কালো দরিয়ায় গিয়ে মিশেছে। বাঁকের মাথায় লম্বা জেটি, উপসাগর ছুঁড়ে জেটিটা অনেকটা নেমে এসেছে। এটা সাউথ পয়েন্ট জেটি।
লঙ ফেরি সাউথ পয়েন্ট জেটিতে ভিড়ল। একে একে কয়েদিনীরা নেমে রেণ্ডিবারিক জেলে ঢুকে পড়ল।
রাতে খানাপিনার পর কম্বল গায়ে জড়িয়ে কেয়েদিনীরা টান টান শুয়ে পড়েছে।
উপসাগর থেকে হিম বাতাস উঠে আসছে। কয়েদিনীরা মতলব করেছে, একটানা আরামের ঘুমে রাতটা কাবার করে দেবে।
এমন একটা ইচ্ছা সোনিয়ারও ছিল। কম্বলের নিচে হাত-পা-মাথা একাকার করে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে সে।
আজ বিকেলে আকস্মিকভাবে ঝড়ের দরিয়ার সেই সাথীটার সঙ্গে রস দ্বীপের জেটিতে দেখা হয়েছিল। অসুস্থই বুঝি হয়েছে লখাই। আন্দামানে আসার সময় জাহাজের খোলে তাকে দেখেছিল, আজ আবার দেখা হল। আদমীটা ভীষণ কাহিল হয়ে পড়েছে। সিপাই দুটোর কাঁধে ভর দিয়ে বোধ হয় হাসপাতালে যাচ্ছিল। কী বোখার হয়েছে লখাইর?
হঠাৎ ভাবনাটা পুরোপুরি ভিন্ন একটা খাতে বইতে লাগল। ঝড়ের সমুদ্রে এলফিনস্টোন জাহাজের খোলে লখাইর সঙ্গে যখন দেখা হয়, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লখাই তার গাঁও-মুলুকের খোঁজ নিয়েছিল। গাঁও-এ তার স্বজন-পরিজন কে কে আছে, সকলের খবর নিয়েছিল। কী অপরাধে তার সাজা হয়েছে, দ্বীপান্তরের সাজার মেয়াদ কতদিন, কিছুই বাদ দেয়নি।
উন্মাদ দরিয়ায় যেখানে জীবন এবং মৃত্যুর মাঝে সীমারেখাটা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, যেখানে কালাপানি অন্ধ আক্রোশে এলফিনস্টোন জাহাজটাকে এলোপাতাড়ি আছাড় মেরে টুকরো টুকরো করে ফেলতে চাইছিল, সেখানে কয়েক ঘণ্টা লখাইর সঙ্গে কাটিয়েছে সোনিয়া। সেই কয়েকটা ঘণ্টার মধ্যেই লখাইর দিলের তাপ পেয়েছে।
জাহাজে লখাই বলেছিল, আন্দামানের কয়েদখানায় তারা পাশাপাশি কুঠুরিতে থাকবে। এখানে নেমে সোনিয়া শুনেছিল, পুরুষ এবং জেনানা কয়েদিদের ভিন্ন ভিন্ন জেলখানা। পেটি অফিসারনী এতোয়ারী অনেক দূরে, আটলান্টা পয়েন্টের মাথায় অনেকগুলো লাল বাড়ি দেখিয়ে বলেছে–সেলুলার জেল। ওটাই পুরুষ কয়েদিদের আস্তানা। সোনিয়া আন্দাজ করে নিয়েছিল, লখাই সেলুলার জেলেই আছে।
লখাইর ইচ্ছা ছিল, পাশাপাশি কুঠুরিতে তারা থাকে। কিন্তু এই দ্বীপের মর্জি অন্য। আলাদা আলাদা কয়েদখানায় লম্বা লম্বা পাঁচিলের আড়ালে তাদের আটক রাখা হয়েছে। সাউথ পয়েন্ট কয়েদখানায় ডাক্তার আর যে বুড়ো কয়েদি তাতের কাজ শেখাতে আসে, দুজন ছাড়া পুরুষের ঢোকার হুকুম নেই, উপায়ও নেই। (অবশ্য মঙ্গলবার মঙ্গলবার শাদির প্যারেডের সময় সেলফ সাপোটার্স টিকিট পাওয়া পুরুষ কয়েদিরা সেখানে আসে)।
লখাইর পাশাপাশি থাকতে পারল না, এ-জন্য খুব একটা আপশোশ নেই সোনিয়ার। তবু রস দ্বীপের জেটিতে দরিয়ার সাথীটার সঙ্গে যখন আকস্মিকভাবে দেখাই হয়ে গিয়েছিল, তখন দুচারটে কথা বলার ইচ্ছা হয়েছিল। কিন্তু টিণ্ডালান রামপিয়ারী তার কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। টেনে হিঁচড়ে তাকে মোটর বোটে তুলেছিল।
সেই থেকে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে আছে। বঙ্গোপসাগরের ঠাণ্ডা আরামদায়ক বাতাসও অনেকটা রাত্রি পর্যন্ত তার চোখে ঘুম আনতে পারল না।
এখন কত রাত, কে বলবে।
নারকেল বনে বাতাসের তাণ্ডব, পাথুরে দেওয়ালে দেওয়ালে উপসাগরের অবিরাম গর্জন ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। কয়েদিনীরা কম্বলের নিচে একটা উষ্ণ আরামের ঘুমে তালিয়ে আছে।
রাত্রি যখন গম্ভীর হয়, উপসাগর থেকে ভাঙা ভাঙা পাথর বেয়ে বিরাট বিরাট সব কচ্ছপ উঠে আসে। তীর ঘেঁষে অজানা জলচর জীবেরা অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ করতে থাকে। কোত্থেকে এক ঝাঁক নিশাচর সিন্ধুশকুন এসে এই দ্বীপে নামে।
এখন মানুষের সাড়া পাওয়া যায় না। রাত্রি যত গম্ভীর হয়, কুয়াশা আর অন্ধকার যত গাঢ় হতে থাকে, এইদ্বীপের চেহারা একেবারে বদলে যায়। সারাদিন যার খোঁজ মেলে না, সেই আদিম সত্তাটা এখন আত্মপ্রকাশ করে। মুহূর্তে এই দ্বীপ স্থানকালের ব্যবধান ঘুচিয়ে প্রাগৈতিহাসিক হয়ে ওঠে।
গভীর রাত্রিতে এই দ্বীপটার আর একটা পরিচয় পেল সোনিয়া।
কম্বলের নিচে উষ্ণ আরামে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে, হুঁশ ছিল না। কানের মধ্যে মুখ গুঁজে কে যেন চাপা গলায় ডাকল, এ সোনিয়া—সোনিয়া–
কম্বল গুটিয়ে লাফিয়ে উঠল সোনিয়া, কৌন–কৌন?
চুপ।
গলায় আওয়াজেই সোনিয়া চিনতে পারল, টিণ্ডালান রামপিয়ারী। বিচিত্র এক ভয়ে রক্তের মধ্যে শির শির করে কী যেন ছুটে গেল। হৃৎপিণ্ডটা বিশ গুণ জোরে লাফাতে শুরু করল।
কাঁপা গলায় সোনিয়া বলল, কী মতলব টিণ্ডালান?
রামপিয়ারী জবাব দিল না। তার গরম নিশ্বাস সোনিয়ার মুখের ওপর পড়তে লাগল। সেই উত্তপ্ত বাতাসে রামপিয়ারীর জবাবটা রয়েছে।
সোনিয়ার মুখ যেন পুড়ে যাচ্ছে। ভয়, অস্বস্তি এবং আতঙ্কমেশা বিচিত্র এক অবস্থার মধ্যে সময় কাটতে লাগল। সোনিয়া আবার বলল, আমারে কাছে কী দরকার টিণ্ডালান?
টেন টেনে অনেকক্ষণ হাসল রামপিয়ারী। তারপর আচমকা হাসিটা থামিয়ে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে সোনিয়ার মুখটা খুঁজে বার করল। তাকে নিজের কাছে টেনে এনে তার মুখে একদমে গোটা বিশেক চুমু খেল। কফ-জড়ানো থকথকে লালা সোনিয়ার মুখে লেপটে যায়।
পুরনো কথাটাই আবার বলল রামপিয়ারী, তোকে কত পেয়ার করি সোনিয়া, লেকিন আমার ওপর তোর দিল নেই।
সোনিয়া আধফোঁটা, কাতর একটা শব্দ করল। কী যে বলল, কিছুই বোঝা গেল না। রামপিয়ারী আরো ঘন হয়ে বসে। একটা হাত বাড়িয়ে সোনিয়ার চিকন কোমরটা সাপের মতো পেচিয়ে ধরে। ধীরে ধীরে হাতের পাঁচটা কঠিন হতে থাকে।
অন্ধকারে রামপিয়ারীর মুখ দেখা যায় না। তবু কেন জানি সোনিয়ার মনে হয়, তার পাতাহীন চোখ দুটো ধিকি ধিকি জ্বলছে।
রামপিয়ারী ডাকল, এ সোনিয়া—
কাঁপা, ক্ষীণ গলায় সোনিয়া শুধু বলতে পারল, হাঁ—
রসদ্বীপে যে শালে তোকে ডাকছিল, ও কে?
বিকেলে সোনিয়া জেদ ধরেছিল, রামপিয়ারীর কাছে লখাইর কথা বলবে না। তখন ছিল দিনের আলো। এখন রাত গম্ভীর হয়েছে। দ্বীপের চেহারা বদলে গিয়েছে। এখন আশেপাশে কেউ জেগে নেই। গাঢ় অন্ধকারে বঙ্গোপসাগরের এই সৃষ্টিছাড়া বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হাজার হাজার বছর পেরিয়ে আদিম বর্বর যুগে ফিরে গেছে।
এই গভীর রাতের চরিত্রই আলাদা।
রামপিয়ারী ফের বলল, এ সোনিয়া, জবাব দিচ্ছিস না কেন? ওই হারামীটা কে? নিজের অজান্তেই সোনিয়ার মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ল, ও লখাই, মরদানা কয়েদি। একসাথ এক জাহাজে আমরা আন্দামান এসেছি। জাহাজে ওর সাথ জান-পয়জান। হয়েছিল।
খানিকটা সময় কেটে যায়। দুজনেই এখন চুপ।
শীতশেষের বাতাস আরো উন্মাদ হয়ে উঠেছে। অন্ধ আক্রোশে উপসাগরটা দ্বীপের দিকে ছুটে আসছে। দুর্জয় আঘাতে এই স্থবির দ্বীপটাকে চুরমার করে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইছে।
অজগরের মতো রামপিয়ারী হাত সোনিয়ার কোমরটা এমন জাপটে ধরেছে যেন হাড়গোড় ভেঙে যাবে। নাক থেকে গরম বাতাস ছুটে এসে মুখটাকে যেন ঝলসে দিচ্ছে। যদিও দেখা যায় না, তবু টের পাওয়া যায়, পাতাহীন চোখ দুটো আরো ধক ধক করছে রামপিয়ারীর।
ফিস ফিস করে রহস্যময় গলায় রামপিয়ারী বলল, তকে সেদিন একটা কথা বলেছিলাম–
সোনিয়ার জবাব শুনবার জন্য একটু চুপ করল রামপিয়ারী। কিন্তু না, কিছুই বলল না সে। অন্ধকারে রামপিয়ারী বুঝতে পারল না, সোনিয়া কথা বলার সামর্থ্যটুকু পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে। যে নারী কোতল করে দ্বীপান্তরী সাজা নিয়ে কালাপানি আসতে ডরায়নি, রামপিয়ারীর কাছে বসে থাকতে থাকতে তার চোখের সামনে এই অন্ধকার রাত্রিটা আরো অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। সোনিয়ার মনে হল, বুকের ধুকধুকুনি বোধহয় বন্ধ হয়ে যাবে।
রামপিয়ারী বলতে লাগল, এক রোজ তোকে বলেছিলাম, মরদের সঙ্গে মহবৃতি করবি না। মরদের মহত্ত্বতে বড় ভেজাল, মরদরা আসল দুশমন। আওরতে আওরতে যে মহবৃতি, সেটা হল খাঁটি চীজ, আসলী পেয়ার। কথাটা জিন্দেগীভর মনে রাখিস।
কোমর থেকে হাতের পাঁচটা খুলে এবার সোনিয়ার গলা জড়িয়ে ধরল রামপিয়ারী। গাঢ় গলায় বলতে লাগল, লখাই শালের সাথ আর দেখা করবি না।
সোনিয়া জবাব দেয় না। রামপিয়ারীর দুই হাতের মধ্যে তার দেহটা থর থর কাপে। রামপিয়ারী সোনিয়ার জবাবের তোয়াক্কা রাখে না। একনাগাড়ে বলে যায়, তোকে সোনার কাঙনা দেব, চাঁদির মল দেব। আচ্ছা আচ্ছা খানা দেব। কয়েদখানার বাইরে থেকে তোর জন্যে মিঠাই আনিয়ে দেব। জানিস তো, আমি টিণ্ডালান, পাঁচ সিকি তলব পাই। অনেক রুপে জমিয়েছি, সব তোকে দিয়ে দেব।
বলতে বলতে টেনে টেনে দম নেয় রামপিয়ারী। এক হাতে সোনিয়ার থুতনিটা ধরে প্রবলভাবে নেড়ে নেড়ে খানিকটা আদর করে। তারপর আবার শুরু করে, তোকে সেদিন বুকের কুর্তা খুলে দেখিয়েছিলাম, ইয়াদ আছে?
সোনিয়া শিউরে উঠল। মনে পড়ল, রামপিয়ারীর বুকময় রাশি রাশি উলকি। মানুষ মানুষীর আদিম কামকলা এবং জৈব ক্রিয়াকলাপের ছবি বুকের চামড়ায় ছুঁচ ফুটিয়ে আঁকিয়ে রেখেছে রামপিয়ারী।
অন্ধকারে শব্দ করে হাসে রামপিয়ারী। বলে, দুনিয়ার সব সুখের তসবির আমার বুকে ধরে রেখেছি সোনিয়া। তাই না রে শালী? বলেই দু’হাতে সোনিয়াকে ফের টানতে লাগল। তার কুর্তার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে নিজের বুকের ওপর তাকে ফেলল রামপিয়ারী। সোনিয়ার বুকের দুপিণ্ড নরম মাংস রামপিয়ারীর বুকে থেতলে একাকার হয়ে মিশে যায়। রামপিয়ারীর ধারাল নখগুলো সোনিয়ার পিঠে গেঁথে গিয়েছে। চামড়া ফেঁসে খুন ঝরছে।
ছটফট করতে লাগল সোনিয়া। হাত-পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। শেষ পর্যন্ত ছটফটানি থেমে যায়। রামপিয়ারীর বুকে এলিয়ে পড়ে সে।
রামপিয়ারীর ঠাসানি, ডলানি এবং জাপটানির মধ্যে বুকটা ফেটে যাবার উপক্রম হচ্ছে সোনিয়ার। মনে হল, নরম সুন্দর শরীরটা কদাকার একটা পিণ্ডের মতো দলা পাকিয়ে যাচ্ছে।
খানিক পর সোনিয়াকে ছেড়ে দিল রামপিয়ারী। একটা কথাও আর বলল না। উঠে টলতে টলতে অন্ধকারে কোন দিকে যেন অদৃশ্য হয়ে গেল সে।
নির্জীবের মতো অনেকক্ষণ বসে থাকে সোনিয়া। বার বার পেটি অফিসারনী এতোয়ারীর কথা মনে পড়তে লাগল তার। রামপিয়ারীটা আওরত না, শালী মরদের বাপ।
বাকি রাতটা আর ঘুমোতে পারল না সোনিয়া।
‘রস’দ্বীপ থেকে ফিরে এসে দিনকতক সেলুলার জেলের হাসপাতালে কাটিয়ে দিল লখাই। পিনিকের নেশার ব্যারামটা তাকে খুবই কাবু করে ফেলেছিল। সাত আট দিন। ঠিকমতো দাওয়াই এবং ভাল খানা পেটে পড়তেই আবার চাঙ্গা হয়ে উঠল সে। হাসপাতাল থেকে আজই তাকে রিলিজ দেওয়া হবে। কিছুক্ষণের মধ্যে পেটি অফিসার নসিমুল গণি তাকে নিতে আসবে।
এখনো অন্ধকার আর কিছুটা কুয়াশা রয়েছে। কালো আকাশটা উপুড় হয়ে সেলুলার জেলটাকে ঢেকে রেখেছে। কয়েদখানাটাকে পরিষ্কার দেখা যায় না। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ইমারতগুলো নির্দিষ্ট চেহারা নিয়ে এখনো স্পষ্ট হয়ে ওঠে নি। সাত নম্বর ব্লকের ওয়ার্কশপটা একটা বিশাল কালো ভালুকের মতো ওত পেতে রয়েছে যেন।
আরো কতক্ষণ পর যে সকাল হবে, বোঝা যাচ্ছে না।
লোহার খাঁটিয়াটার ওপর উঠে বসল লখাই।
মনোধর্মের দিক থেকে লখাই অত্যন্ত স্থূল। বিরাট দেহে মনটা তার শ্লথ গতিতে ক্রিয়া করে। বাইরের জগতে যে-সব ঘটনা ঘটে, সেগুলো তার মনে অতি সামান্যই প্রভাব রাখতে পারে। মনস্তত্ত্বের বিচারে লখাইর মন অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। বর্বর যুগের মানুষের মন যেমন অমার্জিত, ভাবনা চিন্তার খুব একটা ধার ধারে না, লখাইর মনও অনেকটা তেমনি। সে-মন সহজে বিহ্বল বা কাতর বা উদ্বিগ্ন হয় না। সেখানে অনুভূতি জাগাতে হলে প্রবল শক্তি প্রয়োগ করতে হয়।
সেলুলার জেলে আসার আগে এটাই ছিল লখাইর মনের চেহারা।
আশ্চর্য! আজকাল লখাইর মন সাড়া দেয়। তুচ্ছ, নগণ্য যে-কোনো ঘটনা তার মধ্যে আলোড়ন তোলে। হঠাৎ-জাগা মনটা তার ভাবে। ভাবতে ভাবতে তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।
পিনিকের নেশা দিয়ে যে-ব্যারামটা বাধিয়েছিল তা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে গেল। সোনিয়ার সঙ্গে একটা কথাও বলতে পারল না লখাই। কটা দিন ধরে অদ্ভুত এক শূন্যতায় মনটা ভরে রয়েছে। লখাই রোগে যতটা না কাহিল হয়েছে, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি হয়েছে হতাশায়।
অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে সোনিয়ার কথাই ভাবছিল লখাই, অস্ফুট এক গোঙানির শব্দে চমকে উঠল।
সারি সারি লোহার খাঁটিয়া। জেল হাসপাতালের এই ওয়ার্ডে রোগীরা নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছে। এদিক সেদিক তাকিয়েও ঠাহর করতে পারল না লখাই, গোঙানির শব্দটা ঠিক কোত্থেকে আসছে। কান খাড়া করে বসে রইল সে।
আওয়াজটা একটু একটু করে বাড়ছে।
হঠাৎ উঠে পড়ে লখাই। তন্ন তন্ন করে খুঁজতে খুঁজতে ওয়ার্ডের শেষ মাথায় এসে পড়ে। দরজার দিক থেকে তেরছা করে এখানে এক খাঁটিয়া পাতা। একটা রোগী খাঁটিয়া থেকে নেমে দরজার দিকে মুখ ঘুরিয়ে উবু হয়ে বসেছে আর সমানে গোঙাচ্ছে।
এদিকে অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে। বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে আর একটু পরেই সকাল হবে। আবছা আলোয় লোকটাকে চিনে ফেলল লখাই।
তার নাম কপিলপ্রসাদ। কয়েদিরা কপিলজি কপিলজি বলে ডাকে, উঠতে বসতে সেলাম ঠুকে সম্ভ্রম জানায়।
সেলুলার জেলের এই হাসপাতালেই কপিলপ্রসাদের সঙ্গে লখাইর পরিচয় হয়েছে।
জেলের নিয়ম অনুযায়ী মুসলমানের নুর, শিখের চুলদাড়ি বাদ দিয়ে হিন্দুদের দাড়িগোঁফ চেঁছে ফেলতে হয়। মুসলমানের নুর এবং শিখের চুল হিংস্র। হিন্দুর চুলদাড়ি নিরীহ। নির্বিবাদে হিন্দুরা হাজমের ক্ষুরের নিচে মাথা সঁপে দেয়।
আশ্চর্য, হিন্দু হয়েও কপিলপ্রসাদের একজোড়া সুপুষ্ট চুমরানো গোঁফ এখনো বিরাজ করছে। গোঁফ জোড়া দেখলেই বোঝা যায়, এ দুটোর পেছনে অনেক কালের অধ্যবসায় রয়েছে। কপিলপ্রসাদ গোঁফজোড়াকে কেমন করে টিকিয়ে রাখতে পেরেছে, লখাইর কাছে তা এক অসীম বিস্ময়।
কয়েদিদের কাছেই লখাই শুনেছে, বেনারস শহরে কপিলপ্রসাদের গোটা দশেক পাকা ইমারত আছে। গায়ে হাজার বিঘা ক্ষেতি আছে, প্রজা আছে। কপিলপ্রসাদ বড় জমিদার। শুধু জমি মালিকই নয়, রীতিমতো রইস আদমী।
শিকারি বেড়ালের যেমন গোঁফ, রইস আদমীর তেমনি চোখের কোল। চোখ দেখেই লখাই সেটা টের পেয়েছিল। কয়েদিদের মুখে শুনে নিঃসন্দেহ হল।
এক খুরসুরত বাঈজী নিয়ে কপিলপ্রসাদের সঙ্গে বাংলা মুলুকের আর এক রইস আদমীর রেষারেষি বাধে। শেষ পর্যন্ত তা আক্রোশে দাঁড়ায়। বেনারস শহরের এক সড়কে দুপুরবেলায় পর পর দুটো গুলি করে বাঙালি প্ৰঙ্গিীকে খতম করে দিয়েছিল কপিলপ্রসাদ। যে-নারী তার নিজস্ব তার অন্য দাবিদারেকে সে ক্ষমা করে না।
পুলিশের হাতে নিজেই ধরা দিয়েছিল কপিলপ্রসাদ। আদালতে বিচার হল। সারা জীবনের দ্বীপান্তরী সাজা নিয়ে আন্দামান এল সে।
হাতে কাজ না থাকলে অবসর সময়ে কখনো সখনো রসিয়ে রসিয়ে কপিলপ্রসাদের কিত্সটা বলে কয়েদিরা। তারপর কিত্সার নায়কের উদ্দেশে দশ সেলাম ঠুকে বলে, কপিলজি বড়ে মরদ হ্যায়—
পেছন দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে রয়েছে কপিলপ্রসাদ। কী যে করছে, ঠিক বুঝে উঠতে পারল না লখাই।
হঠাৎ লোকটার গোঙানিটা তীব্র হয়ে উঠল।
এবার লখাইর চোখে পড়ল, কপিলপ্রসাদের কণ্ঠার ঠিক ওপরেই গভীর এক ক্ষত। সারাদিন মস্ত এক ব্যাণ্ডেজ বেঁধে সেটা ঢেকে রাখা হয়। ব্যাণ্ডেজটা এখন খুলে ফেলেছে কপিলপ্রসাদ। শুধু তাই না, বাঁকানো একটা লোহার শলা ক্ষতে ঢুকিয়ে ঘুঁটে দিচ্ছে। শুকিয়ে-আসা ঘা সঙ্গে সঙ্গে রক্তাক্ত হয়ে উঠছে, ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে। ভ্যাপসা, পচা দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে সেটা থেকে।
লখাই শিউরে উঠল। কাঁপা কাঁপা স্বরে ডাকল, কপিলজি—
কৌন, কৌন রে? চমকে ঘুরে বসল কপিলপ্রসাদ।
আমি–আমি লখাই।
ও। বস ওই খাঁটিয়ার ওপর।
কপিলপ্রসাদকে অনেকটা আশ্বস্ত দেখায়। আস্তে আস্তে সে বলে, থোড়েসে সবুর কর, ভাল করে ঘাটা খুঁচিয়ে খুন ঝরিয়ে নিই।
শুকনো ক্ষতটা কাঁচা করে, রক্তারক্তি বাধিয়ে খাঁটিয়াটায় এসে বসল কপিলপ্রসাদ। চুমরানো গোঁফে চাড়া মেরে বলল, খুব তাজ্জব বনে গেছিস, না?
লখাই অবাক তাকিয়ে রইল। হাঁ, না–কিছুই বলল না।
দু-চার দিনের পরিচয়েই লখাই বুঝেছে, মেজাজ ভাল থাকলে কপিলপ্রসাদ মনের জানালা কপাট খুলে দেয়। নিজে এতবড় জমির মালিক এবং রইস আদমী, সেটা বেমালুম ভুলে যায়। তখন দুনিয়ার সব মানুষই তার ইয়ার-দোস্ত।
গলার ক্ষতটা খুঁচিয়ে রক্তারক্তি কাণ্ড বাধিয়েও মেজাজ কিন্তু খোশই আছে কপিলপ্রসাদের। সে বলল, শুখা ঘাটা খোঁচালাম কেন, তাই ভাবছিস?
হাঁ–ফস করে লখাইর মুখ থেকে বেরিয়ে এল শব্দটা।
জানিস তো আমি জমিদার।
হাঁ।
তামাম জিন্দেগী ফুর্তিফা করে কাটিয়েছি। আরাম আর খেয়ালখুশিতে, আওরত আর শরাবে ডুবে রয়েছি। একটু থামল কপিলপ্রসাদ। চোখ বুজে পুরো অতীতটা একবার যেন দেখে নিল। তারপর ফের শুরু করে, নাঃ, সেই জিন্দেগীটা আর ফিরবে না। কালাপানির কয়েদখানায় সেই সব দিন কোথায় পাব?
রীতিমতো আপশোশের সুর ফুটল কপিলপ্রসাদের গলায়। হঠাৎ সব আক্ষেপ ঝেড়েঝুড়ে মনটা সাফ করে ফেলল সে, ছোড় শালে ও বাত।
লখাই চুপচাপ আজব মানুষটার কাণ্ড দেখতে লাগল।
লখাই যে পাশে বসে রয়েছে, সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। নিজের কাছেই নিজে যেন জবানবন্দি দিতে শুরু করল কপিলপ্রসাদ, কয়েদখানার সব সইতে পারি। হুইল-ঘানি টানতে পারি, রম্বাস ঘেঁচতে পারি, নারকেলের ছোবড়া ছিলে তার বার করতে পারি, পাথর ভেঙে সড়ক বানাতে পারি। লেকিন খানা! ও তো খানা না-হারাম, দুশমন। ও-খানা আমি বরদাস্ত করতে পারি না। ও-খানা পেটে গেলে বাপের নাম ভুলে যাই। জান লবেজান হয়ে যায়। সিকমেনডেরায় আচ্ছা খানা মেলে। জেলের খানার ডরেই তো গলায় ঘা বানিয়ে এখানে এসে আছি।
কিছুক্ষণ ভারিক্কি চালে চতুর হাসে কপিলপ্রসাদ। তারপর বলে, এই ঘাটাই আমাকে বাঁচিয়েছে। না হলে কবে মরে ফৌত হয়ে যেতাম। বুঝলি লখাই, ঘাটা যখন শুকিয়ে আসে, শলা মেরে মেরে কাঁচা করে দিই।
কয়েদিদের মুখে লখাই শুনেছে, কপিলপ্রসাদ জেল হাসপাতালের স্থায়ী বাসিন্দা। এখন বুঝছে, তার গলার ক্ষতটার সঙ্গে তার মরা-বাঁচা জড়িয়ে আছে। এই ঘাটাই তাকে জেল হাসপাতালের স্থায়ী রোগী বানিয়ে রেখেছে। যত দিন সে বাঁচবে, হয়তো তাকে জেলের হাসপাতালেই কাটাতে হবে।
কপিলপ্রসাদের পাশাপাশি আর একটা কয়েদির কথা হঠাৎ মনে পড়ল লখাইর। সে পরাঞ্জপে। তার মনে হল, পরাঞ্জপের সঙ্গে কোথায় যেন কপিলপ্রসাদের একটা অদ্ভুত রকমের মিল রয়েছে।
কপিলপ্রসাদ ডাকল, এ লখাই—
হাঁ কপিলজি—
তোকে ঘায়ের কথাটা বললাম। আর কাউকে বলিস না।
মাথা ঝাঁকিয়ে লখাই জানাল, এই খবরটা তার কাছ থেকে পৃথিবীর অন্য কেউ জানতে পারবে না।
যে-জোরাল নজিরটার জোরে কপিলপ্রসাদ হাসপাতালের স্থায়ী বাসিন্দা হতে পেরেছে, সেই ক্ষতটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে কী যেন ভাবতে লাগল লখাই।
সকাল হয়ে গিয়েছে। দিনের প্রথম রোদ এসে পড়েছে সেলুলার জেলের মাথায়।
দরজার ফাঁকে পেটি অফিসার নসিমুল গণির মুখ দেখা গেল! লখাইকে নিতে এসেছে সে।
মাঝখানে আরো একটা দিন টানা ঘুমে কাবার করে দিল লখাই।
তারপরেই ব্যাপারটা শুরু হল।
পেটি অফিসার নসিমুল গণি যা ভেবে রেখেছিল, এখনো তা ভোলে নি। প্রবল তার স্মৃতিশক্তি। লখাইকে সে বুঝিয়ে ছাড়বে আন্দামানের দরিয়ায় কত পানি, বুঝিয়ে দেবে সেলুলার জেলের আসল স্বরূপখানা কী বস্তু। ব্যারামের কোনো ওজর, কোনো বায়নাক্কাই তাকে টলাতে পারল না।
পরের দিন সকালেই সড়ক বানানোর ফাইলে লখাইকে জুতে দেওয়া হল।
কাঞ্জিপানি খাওয়ার পর বর্তন ধুয়ে কয়েদিরা কাতার দিয়ে দাঁড়ায়। পেটি অফিসার নসিমুল গণি ফাইল ভাগ করে দেয়। ফাইল হল দল।
বিশটা কয়েদি, একজন জবাবদার, একজন জমাদার আর একটা পাঞ্জাবী পেটি অফিসার–মোট তেইশ জন নিয়ে একটা ফাইল। এই ফাইল-এই কাজ দেওয়া হয়েছে লখাইকে।
এর মধ্যে রোদ বেশ তেতে উঠেছে। বেলা চড়েছে অনেকটা।
পাঞ্জাবী পেটি অফিসার ফাইল নিয়ে সেলুলার জেলের বাইরে এল।
ফিনিক্স উপসাগরের কাছে আপাতত সড়ক বানাবার কাজ চলছে। পেটি অফিসার মুনিয়া সিংয়ের হেফাজতে ফাইলটা সেদিকে রওনা হল।
সেলুলার জেলের বাইরে কয়েদিদের সারি সারি ব্যারাক। এগুলির নাম বিজন, কোনো কোনোটার নাম টাপু। ডাইনে বাঁয়ে অনেকগুলি বিজন এবং টাপু রেখে লখাইদের ফাইল এবারডীন বাজারে এসে পড়ল। বাজারের গা ঘেঁষে বস্তি। বস্তির ভেতর দিয়ে চড়াই উতরাই বেয়ে পাচাননা প্যাচানো পথ সোজা ফিনিক্স উপসাগরের দিকে গিয়েছে।
বস্তি পেরিয়ে যে-সড়কটা মিলল, তার দু’পাশে রেন-ট্রি, নারকেল বন। মাঝে মাঝে বিরাট বিরাট খাদ। সেই সব খাদে হাওয়াই বুটির জঙ্গল আপনা থেকেই গজিয়ে রয়েছে। সড়কের দু’পাশ থেকে ভেজা ভেজা নোনা মাটি এবং জঙ্গলের গন্ধ উঠে আসছে। আর কয়েকদিনের মধ্যেই বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে পুরোপুরি বসন্ত এসে পড়বে। তার নিশানাস্বরূপ হাওয়াই বুটির জঙ্গলে নীল নীল ফুল ফুটতে শুরু করেছে।
আকাশটা ঝক ঝক করে। একটুকরো মেঘের চিহ্নও সেখানে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এখন এই দ্বীপের আকাশ আশ্চর্য নীল, আশ্চর্য উজ্জ্বল।
বিশটা কয়েদি পেটি অফিসারের পেছনে সমান তালে পা ফেলছে।
কিন্তু কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই লখাইর। ঘাড় গুঁজে সামনের কয়েদিটার পেছনে পেছনে চলেছে সে।
হঠাৎ পাশ থেকে চাপা, সরু গলায় কে যেন ডাকল, লখাই দাদা—
ঘাড় তুলে লখাই দেখল, তোরাব আলি।
তোরাব আলি বলল, সড়ক বানাবার ফাইলে তোকেও জুড়ে দিল।
হাঁ। ভুরু কুঁচকে জবাব দেয় লখাই।
বিড় বিড় করে তোরাব আলি বলতে লাগল, তোকেও খতম করে ফেলবে শালারা।
এরপর অনেকটা পথ চুপচাপ পাশাপাশি চলল দুজনে।
সামনের একটা বাঁক পার হয়ে তোরাব আলি ফের ডাকে, লখাই দাদা—
হাঁ—
আর পারি না, জরুর আমি মরে যাব। দু’দিন গলায় রশি দেবার চেষ্টা করলাম, দু’দিনই ওয়ার্ডার শালা টের পেয়ে রশি কেড়ে নিল। আর পারি না লখাই দাদা। তোরাব আলি আচমকা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।
আঁই হারামী, চুপ কর। লখাই খেঁকিয়ে উঠল।
অন্য দিন হলে থেমে যেত তোরাব আলি। আজ যেন সে মরিয়া হয়ে ফোঁপাতে শুরু করেছে। ফোঁপানিটা তার ক্রমশ বেড়েই চলল।
বিরক্ত, ক্রুদ্ধ চোখে তোরাব আলির দিকে তাকায় লখাই। পিনিকের ব্যারামে শরীরটা এমনিতেই তার কাহিল হয়ে রয়েছে। মনও বিশেষ সজুত নেই। তোরাব আলির একটানা কান্নায় সে খেপে উঠল, শালা, আওরতের মতো ফাঁচ ফাঁচ করবি না।
তোরাব কান্না থামায় না। যেমন চলছিল, তেমনি চলতে থাকে। বিড় বিড় করে সমানে বকে যায়, আর পারি না। আজ দিল যা চায়, করে বসব।
একটু পরেই ফাইলটা ফিনিক্স উপসাগরে এসে পড়ল।
এপারে খানিকটা সমতল জায়গায় ছোট্ট একটা মেরিন। ওপারে হ্যাঁডোর টিলায় কয়েকটা বিক্ষিপ্ত কাঠের বাড়ি। মাঝখানে নীল জলের উপসাগর ঢুকে পড়েছে। উপসাগরে এখন ঢেউ ওঠে কি ওঠে না।
মেরিন-এর পাশ দিয়ে লম্বা সড়ক বানাবার কাজ চলছিল। চারদিকে ইতস্তত ভাঙা পাথরের স্তূপ, গুটিকয়েক হাতে টানা রোড রোলার, সড়ক দূরস্ত করার দূরমুশ।
পেটি অফিসার দশ জন কয়েদি আর জবাবদারকে পাঠালো ডিলানিপুরের কোয়ারিতে। আঁকা ভরে ভরে তারা পাথর বয়ে আনবে। পাঁচ জন হাত-রোলার টানবে। চারজন দূরমুশ দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে সড়ক সমান করবে। বাকি দুজন পাথর ঢেলে ঢেলে সড়কের ওপর সাজিয়ে দেবে। পেটি অফিসার কিছুই করবে না, সামনের একটা রেন-ট্রির ছায়ায় বসে আরাম করবে, মাঝে মাঝে উঠে এসে হুকুমদারি করবে, গালি দেবে, সামান্য ছুতোয় কিল চড় হাঁকিয়ে কয়েদির হাড্ডি চুর চুর করে দেবে।
সড়ক তৈরির কাজ শুরু হল।
লখাই আর তোরাব আলি দূরমুশ দিয়ে পাথর পেটাবার কাজ পেল।
লখাই বলল, অফসার সাহেব–
কী বলছিস? পাঞ্জাবী পেটি অফিসার খেঁকিয়ে ওঠে।
আমার বুখার হয়েছিল, বড় কাহিল হয়ে পড়েছি। মেহনতের কাজ পারব না। ঘোড়া মেহেরবানি করে আমাকে দুসরা কাজ দিন।
কী কাজ? গোল গোল, হিংস্র চোখে তাকায় পেটি অফিসার।
তবিয়ত দুলা হয়ে গেছে। যদি সড়কে পাথর ঢালবার কাজটা দেন, আমি বাঁচি।
সড়ক তৈরির ব্যাপারে পাথর ঢালার কাজটাই সবচেয়ে সহজ, সবচেয়ে কম মেহনতের। এই কাজটা কয়েদিদের পছন্দসই। কিন্তু পছন্দ হলেই তো আর তা মেলে না। এ-কাজ পেতে হলে পেটি অফিসারের পেয়ারের লোক হতে হয়। কিন্তু পেটি অফিসারের পেয়ারের লোক হওয়া কি সোজা কথা! তার জন্য বহুত এলেম দরকার। নিয়ম করে রোজ পেটি অফিসারের হাত-পা ডলতে হয়, নিজের খানা থেকে ভাগ দিতে হয়, চুরিচামারি বা হাত সাফাই করে নেশার চীজ জোগাতে হয়।
সড়ক তৈরির কাজে পয়লা এসেই লখাই পাথর ঢালার কাজটা চেয়ে বসেছে। কিছুক্ষণ নিজের কান দুটোকে বিশ্বাস করতে পারল না পেটি অফিসার। রক্তাভ চোখজোড়া তার গোল্লা পাকিয়েই রইল।
লখাই আবার করুণ গলায় বলে, মেহেরবানি করে–
লখাইর কথা শেষ হওয়ার আগেই এলোপাতাড়ি কয়েকটা ঘুষি বসিয়ে দিল পেটি অফিসার। তারপর হুমকে ওঠে, পয়লা এসেই শালে পাথর ঢালতে চায়!
লখাইর গর্দানে দুই ঠাসানি এবং পাছায় দুই লাথি হাঁকিয়ে পেটি অফিসার বলতে লাগল, আগে দূরমুশ ধর হারামীর বাচ্চা। চুপচাপ সড়ক দূরস্ত কর।
লখাই বুঝল, আন্দামানের পেটি অফিসারের মনে মেহেরবানি বলে কোনো পদার্থ নেই।
চারটে কয়েদি এক তালে দূরমুশ চালাচ্ছে। ধুপধাপ, ভেতা ধাতব শব্দ উঠছে। দূরমুশের লোহায় পাথরের ঘা লেগে আগুনের ফুলকি ছোটে।
দেখতে দেখতে সূর্যটা আকাশের গা বেয়ে অনেকখানি ওপরে উঠে এল। এখন উপসাগরের লোনা জল জ্বলছে। সেদিকে তাকানো যায় না, চোখ ঝলসে যায়।
তেজী রোদে মাথার চাঁদি যেন ফেটে যাবে। শেষ শীতের এই সকালেও কয়েদিদের গা বেয়ে গল গল করে ঘাম ছুটতে থাকে। ঘামে-মাজা কালো দেহগুলি চকচক করে।
ডাইনে বাঁয়ে, কোনোদিকে না তাকিয়ে সমানে দূরমুশ চালাচ্ছে লখাই। দূরমুশের বাঁটের ঘষায় হাতের চেটো থেকে এক পর্দা চামড়া উঠে যায়। কাঁধ থেকে দুই হাত খসে পড়ার উপক্রম, তবু ভ্রূক্ষেপ নেই। বিবেকহীন, নির্দয় এই দ্বীপটার ওপর ভয়ানক খেপে গিয়ে মরিয়া হয়েই দেহের সমস্ত শক্তিতে সে পাথর ভাঙতে থাকে।
এদিকে তোরাব আলি দূরমুশ হাতে প্রায় দাঁড়িয়ে আছে। হাত তার ওঠে কি ওঠে না। দূরমুশ চলে কি চলে না। দূরমুশ চালাবে কি, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সমানে সে ফেঁপাচ্ছে। চোখ থেকে নোনা জল শুকনো গাল বেয়ে ক্রমাগত ঝরে যায়।
রেন-ট্রির ছায়ায় বসে পেটি অফিসার আরামে শরীর এলিয়ে দিয়েছে ঠিকই, তবে তীক্ষ্ণ নজরে চারদিকে লক্ষ রাখছে। কয়েদিদের কাজে সামান্য গাফিলতি দেখলেই লাফাতে লাফাতে উঠে আসছে সে। দুই-চার লাথিতে তাদের ঢিট করে ফের যথাস্থানে ফিরে যাচ্ছে।
এর মধ্যেই তোরাব আলির পিঠে গোটা বিশেক ঘুষি এবং পাছায় গোটা দশেক লাথি পড়েছে। তবু তার প্রাণে ভয় নেই। কী যে তার হয়েছে, কে বলবে। উভ্রান্ত দৃষ্টিতে সে উপসাগরটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
ফিনিক্স উপসাগরে গুটিকতক মোটর বোট, বার্জ, দুটো মাঝারি আকারের জাহাজ স্থির দাঁড়িয়ে আছে। একপাশে গোটা দশেক জেলে ডিঙি বাঁধা। তোরাব আলির নজর জেলেডিঙিগুলোর দিকে।
একসময় দূরমুশটা নামিয়ে কপাল থেকে ঘাম মুছে ফেলল লখাই। পেছন ফিরে কনুই দিয়ে তোরাব আলির পিঠে একটা গুঁতো মারল। বলল, আঁই শালা উজবুক, ওদিকে চেয়ে কী করছিস! পাথর ভাঙ। নইলে পেটি অফিসার এসে হাড়গোড় ভাঙবে।
তোরাব আলি জবাব দিল না। যেমন ফেঁপাচ্ছিল, তেমনি ফোঁপাতে লাগল।
লখাই বলল, কি রে শালা, এত কাদলে আঁখের পানি যে শেষ হয়ে যাবে।
কান্নাটা আর এক পর্দা চড়াল তোরাব আলি। ভাঙা ভাঙা, বিকৃত গলায় সে বলল, দিলে যা আছে, আজ তা করব লখাই দাদা। আর সইতে পারি না। বিবির পেটের সেই বাচ্চাটার কথা যে কিছুতেই ভুলতে পারছি না।
লখাই আর কিছু বলল না, দূরমুশটা তুলে নতুন উদ্যমে পাথর ভাঙতে লাগল।
দুপুরে লখাইরা জেলে খানাপিনা সারতে গেল। তারপর ঘণ্টাখানেক আরাম করে আবার ফিনিক্স বেতে ফিরে এল।
এখন বিকেল। সকালের সেই ঝকঝকে রোদের চিহ্নমাত্র নেই কোথাও। দিগন্তের ওপারে অদৃশ্য কোন একটা সাজঘরে কতক্ষণ ধরে যে আয়োজন চলছিল, কে বলবে। এখন দিগন্ত পেরিয়ে ভারী ভারী কালো মেঘ ছুটে আসতে লাগল। এবং মহুর্তে আন্দামানের আকাশ এবং বোদ ঢেকে ফেলল। সকালের সেই শান্ত, নিস্তরঙ্গ উপসাগরটার চেহারা নিমেষে বদলে গিয়েছে। উন্মাদ বাতাসের উৎসাহ পেয়ে বিরাট বিরাট ঢেউ দ্বীপের ওপর হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে লাগল। এক ঝাঁক সী-গাল পাখি উড়ে পালাচ্ছিল, বাতাসের ঝাঁপটায় তারা উপসাগরে আছড়ে পড়ল। কড় কড় শব্দে বাজ পড়ে। আকাশ আড়আড়ি ফেড়ে বিদ্যুৎ ঝলসে যায়। আকাশ-জোড়া বিরাট মৃদঙ্গটায় গুরু গুরু ঘা পড়তে থাকে।
আন্দামানের আকাশ আর দরিয়াকে বিশ্বাস নেই। তার প্রকৃতিকে একেবারেই ভরসা করা চলে না। কখন যে দরিয়া উথালপাতাল হয়ে উঠবে, বাতাস খেপে যাবে, আগে থেকে হদিস মেলে না।
কয়েদিরা বলে, মেয়েমানুষের মতোই আন্দামানের প্রকৃতি দুর্জ্ঞেয়।
এতক্ষণ নেপথ্যে আয়োজন চলছিল, এবার বেশ ঘটা করেই শুরু হয়ে গেল।
খানাপিনার পর আপনা থেকেই ঘুম ঘনিয়ে এসেছিল। রেন-ট্রির তলায় বসে ঢুলতে ঢুলতে বেশ আরামে চোখ বুজে গিয়েছিল পেটি অফিসারের। বাজের আওয়াজে সুখের নিদ্রা ছুটে গেল। আকাশ এবং দরিয়ার চেহারা দেখে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল সে। চিল্লাতে লাগল, হালফা, হালফা উঠেছে। দরিয়া আসমান পাগলা বনে গেছে। কয়েদিলোক আ যা, জান বাঁচাতে হলে আ যা বলেই এবারডীন বস্তির দিকে ছুটতে লাগল।
প্রাণ বাঁচাবার অন্ধ তাড়নায় পেটি অফিসারের পেছন পেছন কয়েদিরাও ছুটল।
লখাই ছুটতে যাবে, তার আগেই দুই হাতে তাকে জাপটে ধরল তোরাব আলি। প্রাণপণে নিজেকে ছড়িয়ে নেওয়াব চেষ্টা করল লখাই। এই মুহূর্তে আন্দামানের দুয়ে প্রকৃতি যখন মত্ত হয়ে উঠেছে, মাথার ওপর আকাশটা ক্রমাগত গর্জাচ্ছে, তখন কেথেকে যেন বেঁটেখাটো তোরাব আলির দেহে অসুরের শক্তি নেমে এল। দুটো হাত লোহার দুটো মোক্ষম সাঁড়াশি হয়ে তাকে পিষে ফেলতে লাগল। কিছুতেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারল না লখাই।
তোরাব আলি বলল, আমার সঙ্গে চল লখাই দাদা—
কোথায়?
উদ্ভ্রান্তের মতো কিছুক্ষণ চেয়ে চেয়ে লখাইর মুখে কী যেন দেখল তোরাব আলি। তারপর বলল, লখাই দাদা, এমন মওকা এ-জীবনে আর পাবি না। পেটি অফিসার চলে গিয়েছে। চল, আমরাও এই জাজিরা থেকে পালিয়ে যাই।
কেমন করে?
পালাবার কথায় লখাইর মনটা বিচলিত হয়ে পড়ল। সারাটা জীবন এই দ্বীপে সাজা খাটতে হবে। কোনো দিন সেই বিবিবাজার, তার পরিচিত জগৎ, যাদের সঙ্গে তার আজন্মের সম্পর্ক, সেই সব মানুষগুলির মুখ দেখতে পাবে না।
কখনো কোনো কিছু ভেবে মন খারাপ করাটা লখাইর ধাতে নেই। তেমন দুর্বল, স্পর্শাতুর মনই নয় তার। কিন্তু এই মুহূর্তটার কথাই অন্য। এই সৃষ্টিছাড়া খেপে-ওঠাদ্বীপের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তোরাব আলির কথাগুলো শুনতে শুনতে লখাইর শিরায় শিরায় বিচিত্র এক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। আন্দামানে আসার পর এই প্রথম হাজার মাইল দূরে বাংলাদেশের সেই হেমতপুর গ্রামের জন্মভূমিটার কথা মনে পড়ল লখাইর। সেখানে কে এক বুড়ি, বুঝিবা ঠাকুমাই হবে, তার আবছা মুখ চোখের সামনে ফুটে ওঠে। এই সৃষ্টিছাড়া, বিচ্ছিন্ন দ্বীপটা থেকে পালিয়ে যাওয়ার অদম্য, আকণ্ঠ এক ইচ্ছা তার বুক তোলপাড় করতে লাগল। স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেল লখাই। তোরাব আলির সঙ্গে সে পালাবে।
লখাই আবার বলল, পালাব, কিন্তু কেমন করে?
তোরাব আলি জবাব দিল না। লখাইকে জাপটে ধরে টানতে টানতে উপসাগরের কিনারে নিয়ে এল। এবার আর নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল না লখাই। ঠিকই বলেছে তোরাব, পালাবার যে-সুযোগটা অযাচিতভাবে হাতের মুঠোয় এসে পড়েছে সেটা হারালে পস্তাতে হবে।
জেলেডিঙিগুলো এক পাশে বাঁধা ছিল। পাহাড়প্রমাণ ঢেউয়ের ধাক্কায় তারা সমানে আছাড়ি-পাছাড়ি খাচ্ছে।
তোরাব আলি বলল, চল লখাই দাদা, ডিঙিতে উঠি।
লখাই চমকে ওঠে। বলে, ডিঙিতে সমুদ্র পাড়ি দিতে চাস নাকি?
তোরাব আলি বিচিত্র হাসি হাসল। বলল, এ ছাড়া গতি কি? জাহাজে চেপে কয়েদি আন্দামানে আসতে পারে। সারা জীবনের মেয়াদ না ফুরোলে ফিরবার জাহাজ কী মেলে?
লখাই মনে মনে ভাবল, তোরাব আলির কথাটা খুবই ঠিক।
কিন্ত এখন আকাশ-জোড়া বিরাট মৃদঙ্গটায় আরো জোরে জোরে ঘা পড়ছে। কড় কড় শব্দে কালো স্তূপাকার মেঘ ফেড়ে বিদ্যুৎ ঝিলিক মারে। সমস্ত প্রকৃতি তাণ্ডব ঘটাবার জন্য প্রস্তুত। সমুদ্রের দুশমন চেহারাটার দিকে তাকিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছাটা একটু একটু করে নিভে আসতে লাগল লখাইর।
তোরাব আলি লখাইর হাত ধরে টান মারল। বলল, চল–
মুহূর্তে স্থির করে ফেলল লখাই, সে পালাবে না। ডিঙিতে এত বড় বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিতে হবে! উথালপাতাল দরিয়ার মর্জিতে কোন দিকে ভেসে যাবে তার ঠিকঠিকানা নেই। ভাবতে ভাবতে লখাইর অন্তরাত্মা শিউরে উঠল। পালাবার ইচ্ছাটা বাষ্প হয়ে উবে গেল। ডিঙিতে দরিয়া পাড়ি দেওয়ার মতো পাগলামি আর নেই। নিজেকে নিয়ে এমন হঠকারিতা সে করতে পারবে না। মনে হল, ক্ষিপ্ত কালাপানির চেয়ে এই দ্বীপের আশ্রয় অনেক নিরাপদ, অনেক কাম্য। এইদ্বীপে সারা জীবন কয়েদই সে খাটবে।
তোরাব আলি এখন ভাবাভাবির বাইরে। বিবির পেটের ছানাটা ছাড়া তার সামনে এই মুহূর্তে অন্য কোনো লক্ষ্য নেই। নিজের বাঁচা-মরার কথা ভাবছে না। সমুদ্রের এই ভয়ঙ্কর মূর্তি দেখেও বুক তার কাঁপে না। ঝড়ের দরিয়া তাকে পালাবার সুযোগ করে দিয়েছে, এই খুশিতেই সে কৃতজ্ঞ। এত বড় বঙ্গোপসাগর বিবির পেটের শিশুটির কাছে একেবারেই তুচ্ছ হয়ে গিয়েছে। পালাবার ইচ্ছাটা তার অদম্য হয়ে উঠেছে।
ঢেউয়ের গর্জনের সঙ্গে বাতাসের শাসানি মিশে এই দ্বীপকে তোলপাড় করে ফেলছে। অল্প অল্প বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে।
তোরাব আলি হাত ধরে ফের টানে। বলে, আয়–
কখন যে তাকে টেনে টেনে একেবারে জলের কিনারে নিয়ে গিয়েছিল, লখাই খেয়াল করতে পারে নি। এবার চমকে উঠল সে। বিরাট বিরাট ঢেউগুলি তার পায়ের ওপর এসে আছড়ে পড়ছে।
তোরাব আলি আবার ডাকল, আয়–
না। অস্ফুট গোঙানির মতো একটা শব্দ ফুটল লখাইর গলায়। তারপরেই এক লাফে জলের কিনারা থেকে অনেকটা দূরে সরে এল সে।
আশ্চর্য, তোরাব অলি এখন আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে না। পেছন ফিরে লখাইকে আর সে টানল না, ডাকল না। সিধা উপসাগরে নেমে একটা ডিঙিতে উঠে পড়ল।
লখাই তাজ্জব বনে গিয়েছে। সে ভেবেই পায় না, এই দানোয়-পাওয়া দরিয়া, ঝড়ো বাতাস, মেঘে-ঢাকা আকাশ–এ-সবের মধ্যে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দেওয়ার মতো এতখানি দুঃসাহস কী করে হল তোরাব আলির!
ডিঙির রশি খুলে ফেলেছে তোরাব আলি। বঙ্গোপসাগরের এই নিদারুণ দ্বীপ থেকে নিজেকে ছিন্ন করে ফেলল সে।
লখাই চেঁচিয়ে উঠল, তোরা-আ-আ–ব—
বাতাসের এক ঝাঁপটায় লখাইর ডাকটা উড়ে গেল। এই মুহূর্তে, উপসাগরের জল যখন অন্ধকারে ঘন আলকাতরার মতো হয়ে গিয়েছে, চকিতের জন্য লখাইর চোখে পড়ল, বিরাট একটা ঢেউয়ের মাথায় উঠে তোরাব আলির ডিঙি দুর্জয় বেগে সমুদ্রের দিকে ছুটে চলেছে। উপসাগরের মধ্য থেকে প্রাণফাটা, বিকট চিৎকার উঠল, খুদাতাল্লা–আ-আ-আ–
একসময় তোরাব আলির ডিঙিটা আর দেখা গেল না। বিপুল বঙ্গোপসাগর নিমেষে সেটা গ্রাস করে ফেলেছে।
ফিনিক্স উপসাগরের পাড়ে আচ্ছন্নের মতো দাঁড়িয়ে রইল লখাই।
এখন দুপুর।
কয়েদিরা খানাপিনা সেরে আরাম করছে।
এইদ্বীপের দুপুরটা বড় ক্লান্ত, মন্থর। দুনিয়ার সব আলস্য এখন সেলুলার জেলের ওপর ভর করে বসেছে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সড়ক পিটিয়ে, ছোবড়া ছিলে, ঘানি ঘুরিয়ে কয়েদিদের জের বার হয়ে গিয়েছে।
খাওয়ার পর কেউ ঢুলতে থাকে। সেলুলার জেলের দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে কেউ বা এক টুকরো আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কী ভাবে, কে বলবে। কেউ আবার ঢোলেও না, আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবেও না, বারান্দায় টান টান শুয়ে চোখ বোজে।
যাদের প্রাণশক্তি অফুরন্ত, তারা খানাপিনার পর অবরে সবরে থোকায় থোকায় বসে গুলতানি করে। কিত্সা-খিস্তি-তামাশায় নরক গুলজার করতে থাকে।
জনকতক কয়েদি লা ডিনের কুঠুরির সামনে বসে রয়েছে।
কুঠুরির ভেতরে লা ডিন, কুঠুরির বাইরে মোপলা বকরুদ্দিন, ভিখন আহীর, লখাই এবং আরো জনকতক।
এই ভরদুপুরে আন্দামানের উপসাগর জ্বলছে, সেলুলার জেলের লাল লাল ইমারতগুলি জ্বলছে, দূরে মাউন্ট হ্যারিয়েট আর রসদ্বীপ জ্বলছে। দুটো সাগরপাখি সেন্ট্রাল টাওয়ারের মাথায় ঝিম মেরে বসে আছে।
লা ডিন বলছিল, যে-সাল আমি এই আন্দামানে এলাম, তখন পোর্ট ব্লেয়ার শহর এমন ছিল না। জঙ্গল থেকে জারোয়ারা এসে হানা দিত। পুলিশ আর কয়েদিদের সঙ্গে জারোয়াদের লড়াই হত। একটু থেমে আবার শুরু করে, কয়েদিরা জঙ্গল সাফ করতে লাগল, সড়ক বানাতে লাগল, কুঠিবাড়ি বানাতে লাগল, জংলী জাবোয়ারা পশ্চিম দিকের জঙ্গলে পালিয়ে গেল। শহর তৈরি হল। এই দ্বীপের যা-কিছু দেখছ, সব বানিয়েছে কয়েদিরা। এই যে সেলুলার জেলে বসে আছ, কয়েদিরাই এর জন্য ইট পুড়িয়েছে, ইট গেঁথে গেঁথে এই কয়েদখানা বানিয়েছে।
মোপলা বকরুদ্দিন বলে, কয়েদিদের বানানো কয়েদখানায় কয়েদিদেরই রাখছে। আপনা জুতিসে আপনাকেই পিটছে কুত্তারা।
সেলুলার জেল সম্বন্ধে পুরনো রসিকতাটাই করে বকরুদ্দিন। এ-রসিকতা সব কয়েদিরই জানা। তবু সকলেই হাসে, হাসতে হাসতে হল্লা বাধিয়ে দেয়।
কদিন ধরে ভিখন আহীর লা ডিনের বংশব্দ হয়ে পড়েছে। সমানে তাকে তোষামোদ করছে। খানাপিনা, ঘুম আর জেলের কাজ, এ-সব বাদ দিয়ে বাকি সময় সে লা ডিনের কাছে কাছে কাটায়। এর কারণও আছে। লা ডিন নিজের খাবার থেকে মোটা একটা অংশ ভিখন আহীরকে দিয়ে থাকে।
ভিখন হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে, এ উল্ললোগ, চিল্লাবি না। তারপর লা ডিনের দিকে ঘুরে তোষামুদির সুরে বলে, লা ডিনজি, আপনার জিন্দেগীর কথা বলুন। পয়লা থেকেই শুরু করুন।
লা ডিন তার কথা শুরু করে।
বিচিত্র মানুষ লা ডিন। এই আজব কয়েদির অতীতও আজব।
প্রথম জীবনে লক্ষ্যহীন, উদ্দেশ্যহীন হয়ে পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বন্দরে বন্দরে ঘুরে বেড়িয়েছে সে। খাঁটি ভবঘুরে বলতে যা বোঝায়, লা ডিন ছিল তা-ই। শ্যাম কম্বোডিয়া-মালয়ে, সুমাত্রা-জাভাবান্দ্বিীপে জীবনের অনেকগুলো বছর কেটে গিয়েছে তার। সেই সব জায়গায় পেটের জন্য কত পেশা, কত ফিকিরই যে করছে তার ইয়ত্তা নেই। কখনো জাহাজের মাল্লা, কখনো রবার বাগানের কুলি, কখনো মেয়ে ব্যবসার দালাল। কখনো মুক্তোর চাষ করেছে, কখনো সমুদ্র থেকে শেল তুলেছে, কখনো অক্টোপাস এবং হাঙর মেরে বেড়িয়েছে। কত রকমের যে কাজ! কিন্তু কোনো কিছুই তাকে বেঁধে রাখতে পারে নি। জন্মাবধি নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে, নানা মানুষ দেখে দেখে জীবন সম্বন্ধে লা ডিনের দৃষ্টিভঙ্গি অদ্ভুত নিরাসক্ত হয়ে গিয়েছে।
এই পরিণত বয়সে জীবনের অনেকখানি পেরিয়ে এসে লা ডিনের মনে হয়, একটা মানুষের মধ্যে কত ধরনের মানুষই না থাকে! তাদের কেউ দালাল, কেউ মাল্লা, কেউ কুলি, কেউ অক্টোপাস মেরে বেড়ায়, কেউ মুক্তোর চাষ করে। আবার কেউ–
নাঃ, ভাবনাটা ঠিকমতো সম্পূর্ণ হয় না। তার আগেই লা ডিনের মনে পড়ে, এ-সবের পেছনে আরো অনেকটা জীবন ফেলে এসেছে সে।
একটানা কিছুক্ষণ বলে যায় লা ডিন। আবার চোখ বুজে কিছুক্ষণ ভাবে। ধুধু অতীত থেকে হাতড়ে হাতড়ে স্মৃতির এক-একটা খণ্ড তুলে আনে।
সঠিক মনে নেই, সুমাত্রা না কম্বোডিয়া, কোত্থেকে সে হঠাৎ একদিন বর্মার মান্দালয় শহরে ফিরে গিয়েছিল। সেটা কোন সাল, কোন তারিখ, ভুলে গেছে। শুধু মনে পড়ে, সেই বছরই ব্রহ্মরাজ থিবোর সৈন্যদলে সে নাম লেখায়। আর তারই কয়েক বছরের মধ্যে ইংরেজদের সঙ্গে বর্মীদের তৃতীয় বার যুদ্ধ বাধে।
সেটা আঠার শ’ চুরাশি সাল।
সাম্রাজ্য বিস্তারের লালসায় ইংরেজ তখন বিবেকহীন, বেপরোয়া। এশিয়া মহাদেশের দিকে দিকে সম্পদ আর ভূমির লোভে সে তখন থাবা বাড়িয়েছে।
ধুরন্ধর ইংরেজ ফিকির খুঁজছিল। তারা এমন এক জাত, কস্মিন কালে যাদের ফিকিরের অভাব হয় না। ওজর তাদের মিলেও গেল।
ব্রহ্মরাজ থিবো ফরাসিদের সঙ্গে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছেন, বর্মা মুলুকে ব্রিটিশ বণিকেরা উৎপীড়িত হচ্ছে, এমন সব অজুহাত তুলে লর্ড ডাফরিন যুদ্ধ ঘোষণা করলেন।
ইতিহাসে এরই নাম তৃতীয় ইঈ-ব্ৰহ্ম যুদ্ধ।
কয়েক মাসের মধ্যে ইংরেজরা মান্দালয় দখল করল। রাজা থিবো সপরিবারে ভারতবর্ষে নির্বাসিত হলেন। এর বছর দুই পর আঠার শ’ ছিয়াশিতে ইংরেজরা পুরো ব্রহ্মদেশ অধিকার করে বসল।
এই সময় একটা স্মরণীয় ঘটনার কথা মনে পড়ে লা ডিনের। ব্রহ্মদেশের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রকাশ্যে এই যুদ্ধের তীব্র প্রতিবাদ করেছিল।
বর্মা মুলুকে সে এক অপূর্ব দিন। মাতৃভূমি স্বাধীন রাখার জন্য বর্মী জোয়ানরা মরণপণ যুদ্ধ করেছে। দেশপ্রেমী সৈনিকের রক্তে মান্দালয়ের মাটি পিছল হয়ে গিয়েছিল।
লা ডিনও এই লড়াইয়ে যোগ দেয়। তার গায়ে দুটো গুলি লেগেছিল। একটা কাঁধে, আর একটা উরু ভেদ করে গিয়েছিল। গুলির ক্ষত কবে শুকিয়ে গিয়েছে, কিন্তু কাঁধ এবং উরুতে দুটো গোলাকার কালো দাগ আজও ইঙ্গ-ব্রহ্ম যুদ্ধের সেই ভয়াবহ, রক্তাক্ত দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়।
কত বয়স হয়েছে লা ডিনের! দেহের বাঁধুনি ঢিলে হয়ে গিয়েছে। চামড়া শিথিল হয়ে ঝুলছে। মুখে অসংখ্য কালো কালো রেখা ফুটে বেরিয়েছে। চোখে মাছের আঁশের মতো ছানি পড়তে শুরু করেছে।
সেটা আঠার শ’ ছিয়াশি আর একটা উনিশ শ’ এগার। মধ্যে পুরো পঁচিশটা বছর। স্মৃতির ওপর পঁচিশ বছরের একটা পর্দা ঝুলছে। কত কথা ভুলে গিয়েছে লা ডিন। কত স্মৃতি আবছা, দুর্বোধ্য হয়ে গিয়েছে। কত ঘটনা নিঃশেষে মন থেকে মুছে গিয়েছে। তবু পঁচিশ বছর আগের সেই রক্তই তো শিরায় শিরায় বহমান। কিন্তু সেদিনের রক্ত ছিল খরধার, অমিত তেজে টগবগ করে ফুটত। সেই রক্তই আজ নিরুত্তাপ, নিস্তেজ, মন্থর।
লা ডিনের জীবন আজ অন্য খাতে বইছে।
থিবোর যুদ্ধে বন্দি হয়ে আন্দামান এসেছিল লা ডিন। এই দ্বীপে তার দীর্ঘ চৰ্বিশটা বছর কেটে গেল। এখানে এসে আর একটা জীবনের খোঁজ পেয়েছে সে। নিস্পৃহ, উত্তেজনাহীন, বিচিত্র সে জীবন। সে জীবন পবিত্র, স্নিগ্ধ, পরামার্থ সন্ধানী। পোর্ট ব্লেয়ারের চাউঙে গিয়ে সে ফুঙ্গি হয়েছে। বার বছর তার ফুঙ্গি জীবন চলছে।
বার বছর আগে লা ডিনের সাজার মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। এখন তার নিরাসক্ত ভিক্ষু জীবন।
আশ্চর্য! এক যুগ পর লা ডিনকে আবার কয়েদ করা হয়েছে।
জীবনে অনেক পথ পেরিয়ে এসেছে লা ডিন। তবু থিবোর যুদ্ধের কথা ভাবতে বসে ছানিময় ঘোলাটে চোখজোড়া ধক ধক করে। হাতের মুঠো পাকিয়ে আসে। দাঁতে দাঁতে ঘষা লেগে হিংস্র শব্দ হয়। মন্থর রক্তের স্রোত আচমকা প্রবল বেগে ধমনীতে ঘা মারে।
ভিখন আহীর, বকরুদ্দিন, লখাই এবং আরো দু-চারজন কয়েদি অবাক বিস্ময়ে লা ডিনের জীবনের দীর্ঘ ইতিহাস শোনে। এই দুজ্ঞেয়, আজব কয়েদি, যে প্রথম জীবনে পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বন্দরে বন্দরে ঘুরে বেড়িয়েছে, যে মুক্তোর চাষ করেছে, হাঙর অক্টোপাস মেরেছে, জাহাজের মাল্লাগিরি করেছে, রেণ্ডিবাড়ির দালালি করেছে, চুটিয়ে নেশা এবং নারীসঙ্গ করেছে, সে-ই আবার বর্মা মুলুকের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে ইংরেজের গুলি খেয়েছে, সেলুলার জেলে কয়েদ খাটতে এসে ফুঙ্গি বনেছে! পরস্পর বিরোধী কত বৃত্তি, কত কত পেশাই না ধরেছে লা ডিন! তার জীবন একটি মাত্র খাত বেয়ে চলে নি, বার বার বিচিত্র সব ধারায় বয়ে গেছে।
বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে যারা কয়েদ খাটতে আসে, তাদের জীবন মোটামুটি একটি খাত বেয়েই চলে। সে খাতটি হল জৈবিক এবং দৈহিক ক্ষুধার খাত। কামগন্ধি নারীমাংসে, চরসে-পিনিকে এবং গেজিয়ে-ওঠা মদে তাদের জীবনের সমস্ত চরিতার্থতা। নারী, নেশা আর নির্বিচার হত্যা, এ-সবের বাইরে জীবনের অন্য অর্থও যে আছে, সে-সম্বন্ধে তাদের কোনো ধারণাই নেই। এর বাইরে বিশেষ কিছুই তারা বোঝে না।
লা ডিনের জিন্দেগীর কথা যত শোনে, কয়েদিরা ততই তাজ্জব বনে যায়। সবটা যে বোঝে তা নয়। এই মানুষটা তাদের কাছে জটিল এক ধাঁধার মতো।
হঠাৎ ভিখন আহীর বলে, লা ডিনজি, বার সাল আপনি ফুঙ্গি হয়েছেন। এত দিন বাদ আপনাকে আবার কয়েদ করল কেন?
উদাস স্বরে লা ডিন বলল, ফায়া মালুম।
খানিকটা সময় কাটে।
লা ডিন এদিক সেদিক তাকিয়ে কী যেন খোঁজে। গলার স্বরটা তার খাদে নামে, সেদিন মুন্সিজির কাছে একটা কথা শুনলাম।
গরাদের ওপাশের কয়েদিগুলো কান খাড়া করে।
ভিখন বলে, কী কথা লা ডিনজি?
এবার আন্দামানে দুসরা কিসিমের কয়েদি আসছে।
দুসরা কিসিমের কয়েদি! সে আবার কী! কয়েদিদের তো একই কিসিম। কোতল, ডাকাইতি করে যে শালেলোগ আন্দামান আসে, তারা তো এক কিসিমেরই কয়েদি।
লা-ডিনের ঘোলাটে, অস্পষ্ট চোখজোড়া ধিকি ধিকি জ্বলছে। গলার স্বরটা অদ্ভুতভাবে বদলে যায়। গাঢ়, গম্ভীর গলায় লা ডিন বলে, এবার যারা আসছে, ইণ্ডিয়াকে আজাদ করার জন্যে তারা ইংরাজদের সঙ্গে লড়াই করেছে।
এতক্ষণ লা ডিনকে যেমনটা দেখা যাচ্ছিল, এখন আর সে তেমনটা নেই। আমূল বদলে গিয়েছে। গলার স্বর গম্ভীর। চাপা চাপা চোখ দুটো জ্বলছে, খাড়া চোয়াল কঠিন হয়ে উঠেছে, থ্যাবড়া নাকটা ফুলে ফুলে উঠছে।
সেলুলার জেলের সমস্ত কয়েদির মধ্যে লা ডিন এখন আশ্চর্য রকমের স্বতন্ত্র হয়ে গিয়েছে। তাকে চেনা হয়তো যায়, কিন্তু বোঝা বড় দুরূহ ব্যাপার।
বিড় বিড় করে দুর্বোধ্য স্বরে লা ডিন আবার বলে, বর্মা মুলুককে আজাদ রাখতে এক রোজ ইংরেজদের সাথ আমরাও লড়াই করেছিলাম। বলেই থেমে যায়।
কিছুক্ষণ চুপচাপ।
সেলুলার জেলের মাথায় রোদ ঝক ঝক করে। অনেক উঁচুতে বিরাট আকাশটাকে জ্বলন্ত কাঁসার পাতের মতো দেখায়। সেন্ট্রাল টাওয়ারের চোখা ডগায় সাগরপাখি দুটো আগের মতোই ঝিম মেরে বসে থাকে। উপসাগর থেকে একটানা ঢেউয়ের শাসানি ভেসে আসে।
গরাদের মোটা মোটা দুটো লোহার রড ধরে বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে লা ডিন। তার চাপা চোখদুটো আন্দামানের আকাশ পার হয়ে কোথায় কোন এক দুৰ্জ্জেয় জগতে যেন হারিয়ে গিয়েছে। তার সামনে এই সেলুলার জেল, কয়েদি, আকাশ–কিছুই নেই। সব মুছে নিরাকার হয়ে গিয়েছে।
ভারতকে স্বাধীন করতে যারা ইংরেজদের সঙ্গে লড়ে আন্দামানে কয়েদ খাটতে আসছে, তাদের কথাই ভাবছে লা ডিন। মনে পড়ল, বর্মা মুলুকের মর্যাদা রাখতে তারাও একদিন ইংরেজদের সঙ্গে যুঝেছিল। যারা ইণ্ডিয়াকে আজাদ করতে চায়, আর যারা বর্মাকে আজাদ রাখতে চেয়েছিল, তাদের মধ্যে কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম এবং আশ্চর্য রকমের মিল রয়েছে।
থিবোর যুদ্ধের পর পঁচিশ বছর পার হয়ে গিয়েছে। এতগুলো বছরে জীবনে কত ওলটপালটই না ঘটে গেল। আন্দামানে কয়েদ খাটতে এসে চাউঙে গিয়ে সে ফুঙ্গি হয়েছে। তবু পঁচিশ বছর আগে সেই আঠার শ’ ছিয়াশিতে থিবোর যুদ্ধের আগুন বুকের মধ্যে পুরে সেই যে লা ডিন আন্দামানে এসেছিল, সে আগুন এতদিন পরও নেভে নি। কালের অমোঘ প্রভাবে খানিকটা জুড়িয়ে এসেছে ঠিকই, কিন্তু শুধুমাত্র একটি ফুয়ের অপেক্ষা। পলকে থিবোর যুদ্ধের স্মৃতি অগ্নিমুখ হয়ে উঠবে। এই জাহাজের কয়েদিরা বুঝিবা তার ভেতরকার আগুন উসকে দেবার জন্যই আন্দামানে আসছে।
গরাদের ওপাশে কয়েদিরা ফিস ফিস করে বলে, ইংরাজদের সাথ লড়াই করে কয়েদ খাটতে আসছে। শালেরা বড়ে মরদ হ্যায়।
ইংরেজ সম্বন্ধে সাধারণ কয়েদির মনে অদ্ভুত এক ধারণা আছে। যে-ইংরেজ কায়েদিকে ফাঁসিতে লটকায়, দরিয়ার মধ্যে কয়েদখানা বানিয়ে সাজা খাটায়, গুলি মেরে শরীর ঝাঁঝরা করে দেয়, যাদের একটি ইঙ্গিতে পাঠান পাঞ্জাবি পেটি অফিসাররা পাছার হাড্ডি ঢিলে করে দেয়, হাড় থেকে মাংস খসিয়ে ছাড়ে, তাদের মতো বড় মরদ দুনিয়ায় আর কে আছে? সেই ইংরেজদের সঙ্গে যারা লড়াই করার তাকত রাখে, তাদের মতো হিম্মতদার তামাম দুনিয়া ছুঁড়লে বুঝি মিলবে না। সাধারণ কয়েদিদের কাছে সেই সব শক্তিমান মানুষগুলো রহস্য এবং বিস্ময়ের বস্তু। এই জাহাজেই তারা আন্দামানে আসছে।
কৌতূহলে, উত্তেজনায় কয়েদিদের চোখমুখ ঝকঝক করে।
একটু পরই পেটি অফিসাররা এসে পড়ল। তাড়িয়ে তাড়িয়ে, ডাণ্ডা হাঁকিয়ে, খিস্তিখাস্তা দিয়ে কয়েদিদের ফের কাজে পাঠিয়ে দিল তারা।
একটা মতলব ভেঁজে ভিখন আহীর লা ডিনের কাছে এসেছিল। নানা প্রসঙ্গ ওঠায় নিজের কথাটাই তার বলা হল না।
কাজে যাওয়ার আগে ভিখন বলল, সন্ধের সময় আমি আসব। আপনার সঙ্গে দু-চারটে বাতচিত আছে।
লা ডিন কিছুই বলল না, মাথাটা বাঁ দিকে কাত করল শুধু।
আন্দামানের আকাশে তখনো মরা মরা, ফ্যাকাসে আলোর ছোপ লেগে রয়েছে। সকালে যে-সূর্যটা একটা আগুনের গোলার মতো দরিয়া থেকে উঠে এসেছিল, একটু আগে অরণ্যের ওপারে সেটা টুপ করে ডুবে গিয়েছে। সাগরপাখিরা দ্বীপে ফিরে যেতে শুরু করেছে। উপসাগরের অগভীর জলে উড়ুক্কু মাছেরা বেলাশেষের বিষণ্ণ আলোটুকু মেখে দিনের শেষ খেলা খেলে নিচ্ছে।
এমন সময় ভিখন আহীর এল।
গরাদ ধরে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল লা ডিন। সেই দুপুর থেকে একই ভঙ্গিতে বসে আছে সে। তার চোখের সামনে দুপুরটা বিকেল হয়ে গেল। বিকেলটা রং বদলাতে বদলাতে সন্ধের দিকে ঢলে পড়ল। তার নড়াচড়া নেই। যেমন ছিল তেমনি বসে রইল।
ফিস ফিস করে ভিখন ডাকল, লা ডিনজি—
হাঁ–কে?
তন্ময় হয়ে কী যেন ভাবছিল লা ডিন। চমকে উঠে সামনের দিকে তাকায়।
ভিখন এবার গলার স্বল উঁচুতে তুলে বলল, আমি ভিখন।
বোসো।
গরাদের ওপাশে বসে পড়ল ভিখন আহীর।
এতক্ষণ লক্ষ করে নি। যখন করল, শিউরে উঠল লা ডিন। ভিখনের পোড়া ভুরুটা ফেটে গিয়েছে। রক্তমাখা থকথকে এক ডেলা হলদেটে চর্বি বেরিয়ে পড়েছে। পাটকিলে রঙের খানিকটা কাঁচা মাংস ভুরুটার ওপর ঢিবির মতো ফুলে ঝুলছে। পোড়া চোখটা বুজে গিয়েছে। পোড়া গালের কোঁচকানো চামড়ার ওপর গাঢ় রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। আর ফাটা ভুরু থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় তাজা রক্ত ঝরছে।
লা ডিন আঁতকে উঠল, কী হয়েছে ভিখন!
রক্তের ফোঁটাগুলো থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে গাল বেয়ে ঠোঁটের ওপর এসে পড়ছিল ভিখনের। জিভ বার করে চেটে নিল সে।
লা ডিন এবার চেঁচিয়ে ওঠে, কী হয়েছে? এত খুন কেন?
পোড়া, রক্তাক্ত, বীভৎস মুখে হ্যসল ভিখন। আস্তে আস্তে বলল, ও কুছু না লা ডিনজি। জাজিরুদ্দিন হারামীটার সাথ একটু হাতাহাতি হয়ে গেল। শালে ইটা হাঁকিয়ে আঁখ তুবড়ে দিয়েছে, খুন আর গোস্ত বার করেছে। শালের সাথ সব সম্পর্ক তুড়ে দিয়ে এলাম। শালে ঠগ, বেতমীজ, জুয়াচোর, বেজন্মা। শালের মা বাপের ঠিক নেই।
একদমে, না-থেমে শখানেক খিস্তি আউড়ে যায় ভিখন আহীর। তারপর টেনে টেনে হাঁপায়। হাঁপানির তাড়নায় বুকটা তোলপাড় হতে থাকে।
ভিখন আবার বলে, শালের মুখের ঠিক নেই। মুখ থেকে কথা তো বার হয় না, ঘোড়ার পেচ্ছাব বার হয়।
কী হয়েছে ভিখন! লা ডিন উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে।
শুনুন লা ডিনজি, ওই জাজিরুদ্দিন হারামীটার পাল্লায় পড়ে ইসলামী বনেছিলাম। হিন্দু নাম বদলে মুছলমানী নাম নিয়েছিলাম। শালে কথা দিয়েছিল, মুছলমান বনলে জেয়াদা খানা মিলবে। লেকিন–কথা শেষ না করে ভিখন আহীর থামল।
লা ডিন বলল, লেকিন কী?
দু-দশ রোজ জেয়াদা খানাই মিলেছে। কথামত নামাজ পড়েছি, পাক্কা ইসলামী বনে গেছি। বলতে বলতে কী যেন ভাবতে থাকে ভিখন।
এতক্ষণে আকাশ অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। অনেক দূরে মাউন্ট হ্যারিয়েটের চূড়াটা ঘিরে হালকা কুয়াশার একৃটা পর্দা নামতে শুরু করেছে। দূরে রসদ্বীপ, আরো দূরে নর্থ বের ত্রিকোণ মুখ, নর্থ বে পেরিয়ে হ্যাভলকদ্বীপ–সব, সব কিছু আঁকাবাঁকা কয়েকটি আঁচড়ের মতো দেখায়। অন্যমনস্ক সে-সব এক পলক দেখে নিয়ে ভিখন আহীর বলল, স্রেফ পেটের ভুখের জন্য জাত দিয়েছিলাম, ধরম দিয়েছিলাম। লেকেন শালে জাজিরুদ্দিন এ-বেলা থেকে জেয়াদা খানা বন্ধ করে দিয়েছে। চার রোটিতে আমার মতো মরদের কি পেট ভরে? আপনিই বলুন লা ডিনজি?
গরাদের ফাঁক দিয়ে দু হাত ঢুকিয়ে লা ডিনের ডান হাতটা চেপে ধরল ভিখন। তার একমাত্র চোখে করুণ দৃষ্টি ফুটে বেরিয়েছে।
অবাক হয়ে ভিখনের মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে লা ডিন। একটা কথাও বলছে না। পেটের ভুখের জন্য ধরম দেওয়ার মতো তাজ্জবের কথা সে কস্মিনকালে শোনে নি।
ভিখন আহীর আবার শুরু করল, ইসলামী বনেছিলাম, জাজিরুদ্দিন আমার জাত ধরম মেরে নাম দিয়েছিল করিমুদ্দি। আজ থেকে আমি আবার হিন্দু বনলাম। খানাই যদি না মেলে, বেফায়দা জাত মারব কেন?
লা ডিন এবারও জবাব দিল না।
মাউন্ট হ্যারিয়েটের চূড়াটা ঘিরে এতক্ষণ হালকা কুয়াশার একটা রেখা ছিল। আবছা হলেও রসদ্বীপ আর হ্যাভলক দ্বীপটাকে দেখা যাচ্ছিল। এখন আর কিছুই চোখে পড়ে না। গাঢ় অন্ধকারে আকাশ, সমুদ্র, উপসাগর এবং অরণ্য বিলীন হয়ে গিয়েছে।
গরাদের এপাশে ওপাশে দুটো কয়েদি মুখোমুখি বসে রয়েছে।
ফিস ফিস করে ভিখন আহীর ডাকল, লা ডিনজি–
হাঁ–
দুপুরে আপনাকে একটা কথা বলতে এসেছিলাম। তখন অন্য কয়েদি থাকায় বলতে পারি নি। এখন বলব?
বল!
আপনি আমাকে মেহেরবানি করবেন?
মেহেরবানি!
হাঁ হাঁ জি, রোজ আপনার খানা থেকে আমাকে ভাগ দেন। আপনি ফায়াজির (বুদ্ধের) চেলা, ফুঙ্গি। ভাবছি–বাকিটা আর পূরণ করল না ভিখন। দু’হাতে লা ডিনের ডান হাতটা জোরে আঁকড়ে ধরল।
লা ডিন বলল, কুছু বলবে ভিখন?
হাঁ জি। ভিখন আহীরের স্বরটা অদ্ভুত শোনায়। দম নিয়ে সে বলে, লা ডিনজি, আপনি খানা দিয়ে আমার জান বাঁচান, আমি আপনাক কুছু দিতে চাই।
কী দিতে চাও?
ধরম।
অনেকক্ষণ ধরে এই কথাটাই বলার উদ্যোগ করছিল ভিখন আহীর।
লা ডিন স্তম্ভিত হয়ে যায়। ধরম!
হাঁ জি, আমি ফুঙ্গি বনব।
বলতে বলতে বগলের তলা থেকে দুটো হলদে রঙের কাপড় আর কুর্তা বার করল। বলল, লা ডিনজি, ফুঙ্গিদের মতো কাপড় ছুপিয়েছি। আমি ফুঙ্গি বনব, আপনার ধরম নেব।
লা ডিন চুপচাপ বসে রইল। ভেবে ভেবে সে বুঝে উঠতে পারে না, কেমন করে ভিখন আহীর নামে এক কয়েদি স্রেফ পেটের ভুখের জন্য হিন্দু থেকে মুসলমান হয়, আবার মুসলমান থেকে বৌদ্ধ হতে চায়।
জীবনে অনেক কিছু দেখেছে লা ভিন। কিন্তু স্রেফ পেটের জন্য একটা মানুষকে বার বার ধরম পালটাবার কথা বলতে এই প্রথম শুনল।