সিন্ধুপারের পাখি (Sindhuparer Pakhi) : 05
পরের দিন সকালেই পিনিকের ক্রিয়া শুরু হল।
মাথার শক্ত খোলের ভেতর তরল মগজটা যেন টগবগ করছে। শিরায় শিরায় রক্ত ফুটছে। যে কোনো মুহূর্তে চামড়া ছিঁড়ে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে পড়বে। মুখটা অস্বাভাবিক ফুলে উঠেছে। হাঁ করতে, ঢোক দিলতে ভীষণ যন্ত্রণা হয়। চোখ দুটো টকটকে লাল, পেটটা ফুলে উঠেছে। শরীরে তাণ্ডব চলছে যেন।
সকাল হয়েছে অনেক আগেই।
এক ঝাঁক সিন্ধুশকুন রোদে সাঁতার কাটতে কাটতে সেলুলার জেলের মাথা টপকে উপসাগরের দিকে চলেছে। চেয়ে চেয়ে যতক্ষণ না পাখিগুলো দৃষ্টির সীমা ছাড়িয়ে যায়, লখাই দেখল।
শরীর বিকল হয়েছে, কাজে আর মন বসে না।
সকালে কাঞ্জিপানি এনেছিল, খেতে ইচ্ছা হয় নি। খানাপিনার গরজটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে যেন। কুঠুরির মধ্যে লোহার বর্তনে সেই অপূর্ব স্বাদগন্ধের থকথকে কাঞ্জি পড়ে রয়েছে।
কাঞ্জিপানি নেওয়ার পর পেটি অফিসার নসিমূল গণির কাছ থেকে বস্তা ভরে ছোবড়া এনেছিল লখাই।
ছোবড়া, মুগুর চারপাশে ছত্রাকার পড়ে রয়েছে। ছিলেকুটে সন্ধের মধ্যে আড়াই পাউণ্ড তার বার করতে হবে। না হলে পেটি অফিসার হাড্ডি-মাংস আলাদা করে ফেলবে। তবু কাজে উৎসাহ পেল না লখাই। চনমনে চোখে এদিক সেদিক তাকাতে লাগল। বেজুত শরীর ছোবড়া ছিলতে চায় না।
ছটা সেলের পর লোহার মজবুত গেট। তার ওপার থেকে তীক্ষ্ণ একটা স্বর ভেসে এল, লখাই দাদা, এ লখাই দাদা–
ঘাড় ঘুরিয়ে লখাই তাজ্জব বনে গেল। পাকার ছোবড়ার মধ্যে বসে রয়েছে। ভিখন আহীর। তার পোড়া, বীভৎস মুখটা বড় কাচুমাচু দেখাচ্ছে। পেটি অফিসার নসিমুল গণির কৃপায় ছোবড়া ছিলাকোটার হাত থেকে রেহাই পেয়েছিল ভিখন। এই কদিন সে কোপরার জন্য নারকেল কেটেছে। ভিখনের মতো তাকতদার কয়েদির পক্ষে নারকেল কাটা মোটামুটি সহজ কাজ। লখাই ভেবে পায় না, আবার কেন ভিখনকে ছোবড়া ছিলতে হচ্ছে!
লখাই বলে, কি রে ভিখন, ফের যে ছোবড়া ছিলতে এলি!
প্রথমে ভিখন জবাব দেয় না।
লখাই এবার বলে, পেটি অফসারের সঙ্গে এত পেয়ার, এত দোস্তি মহবৃতি–সব ছুটে গেল!
পোড়া কপালে চামড়া আর মাংস ঝামার মতো হয়ে রয়েছে ভিখনের। হাত দিয়ে কপালটা দেখিয়ে সে বলে, সব নসিব রে দাদা, সব নসিব। বহুত বদ নসিব বলতে বলতে কপাল চাপড়ায় ভিখন।
লখাই বলে, কেমন করে নসিবটা তোর মন্দ হল রে ভিখন? তুই না বলতিস রুপেয়া থাকলে আন্দামানের কয়েদখানায় পেয়ার মেলে, মহৎ মেলে, নসিব কেনা যায়।
সাচ্চা কথাই বলতাম রে লখাই দাদা।
তবে এমন হল কেন?
গেটের ফোকর গলে চট করে এদিকে চলে এল ভিখন আহীর। বীভৎস মুখটা লখাইর মুখের ওপর ঝুঁকিয়ে তার একটা হাত নিজের গলার কাছে এনে ভিখন বলল, গলাটা টিপে টিপে দ্যাখ–
বুঝতে না পেরে লখাই বলল, কী দেখব?
আরে ভেইয়া, তুই অ্যায়সা নালায়েক! ভিখন আহীর পোড়া কপাল চাপড়ায়। বলে, দাদা রে তুই জানিস না, আমার গলার মধ্যে একটা চোরা থলি আছে।
হাঁ হাঁ, জানি।
কলকাত্তা থেকে আসার সময় থলিটায় রুপেয়া, সোনার একটা হার, দুটো দামি পাথর এনেছিলাম। পেটি অফসার শালাকে রিসোয়াত (ঘুষ) দিয়ে ছোবড়া পেটা মকুব করেছিলাম, কোরা কাটার কাজ পেয়েছিলাম। লেকিন নসিবটা আমার বড় নিমকহারাম। আমি পয়দা হলাম বলে যে নসিব পয়দা হতে পারল, সেই শালে আমার একটু আরামের বন্দোবস্ত করল না।
বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থাকে লখাই।
পেটি অফসার শালে আমার গলার থলিটার কথা টের পেয়ে গেল। কাল সন্ধের সময় ডাণ্ডা মেরে মেরে আমার হাড্ডি চুরচুর করলে। তারপর গলার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে হারটা আর বাকি রুপেয়া কেড়ে নিলে। শালে, কুত্তীকা বাচ্চে–
ভিখন আহীরের কদর্য মুখে একমাত্র চোখটা ধকধক করতে লাগল। কথা বলতে বলতেই কুর্তা খুলে পিঠটা দেখাল ভিখন। ডাণ্ডার বাড়িতে চামড়া মাংস থেঁতলে রক্ত জমে রয়েছে।
ভিখন এবার বলল, পেটি অফসারের জান-জমানা খতম করে দেব, তবে আমার নাম ভিখন আহীর।
লখাই কিছু বলে না। ভিখনের জন্য তার কষ্টই হয়।
ভিখন বলতেই থাকে, কাল সোনার হার রুপেয়া, সব বাগালো। আর আজই ছোবড়া ছিলতে দিয়েছে। ছোবড়া ভেজাবার জন্যে একটু পানি ভি দিল না। অন্য রোজ দুডাক্বা কাঞ্জিপানি দিত। আজ দিয়েছে এক ডাক্বা। লখাই দাদা, ভুখ তাতে মরল না। এবার ভুখাই খতম হয়ে যাব। ভিখনের মুখ চোখ করুণ হয়ে উঠল।
হঠাৎ লখাই বলে, কাঞ্জিপানি খাবি ভিখন?
কাঞ্জিপানি! কিধর? ভিখনের একমাত্র চোখটা চকচক করে, লোলুপ হয়ে ওঠে।
আমার কুঠরিতে আছে। বর্তনে। সকালে ভুখ ছিল না, তাই রেখে দিয়েছি।
লখাইর কথা শেষ হওয়ার আগেই দৌড়ে তার কুঠুরি থেকে কাঞ্জিপানির বর্তনটা নিয়ে আসে ভিখন, নিমেষে থকথকে খাদ্যটুকু চেটেপুটে সাফ করে ফেলে।
একমাত্র চোখটায় কৃতজ্ঞতা ফোটে ভিখনের। সে বলে, কাঞ্জিটা খেয়ে জান বাঁচল। তুই দাদা আর জম্মে আমার বাপ ছিলি।
অনেকটা সময় কাটে। শীতের রোদের তাপ বাড়ে, উপসাগরের গর্জন বাড়ে, নারকেল বনে বাতাসের মাতামাতি বাড়ে।
আচমকা লখাই ডাকে, আচ্ছা ভিখন—
হাঁ হাঁ ভেইয়া–ভিখন ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে। কী বলছিস?
এখনো তুই বলবি, রুপেয়ায় পৈয়ার মহবৃৎ কেনা যায়!
জরুর। ও বাত বিলকুল খাঁটি। রুপেয় থাকলে সব মেলে, না থাকলে কুছু মেলে না। যত রোজ জিন্দা আছি, এ বাত নড়চড় হবে না।
লখাই জবাব দেয় না।
ভিখন উঠে পড়ে। গেটের ফোকর পর্যন্ত গিয়ে হঠাৎ ফিরে আসে। মুখটা লখাইর কানে গুঁজে ফিসফিস করে বলে, কাল যে পিনিক দিয়েছিলাম, কুঁকেছিলি?
লখাই ঘাড় কাত করে জানায়–ফুঁকেছে।
ভিখন বলে, ইয়াদ রাখিস, রোজ রোজ সোনিয়া রসদ্বীপের সিকমেনডেরায় যাচ্ছে। তোকে শক্ত বুখার বাধাতে হবে। মনে রাখিস চান্নু সিং সোনিয়াকে শাদি করার জন্যে পাগলা কুত্তার মতো ঘুরছে।
সব মনে আছে। দুরোজের মধ্যে শক্ত ব্যারাম হবেই। আজ আবার পিনিক দিয়ে যাস।
আচ্ছা।
গেটের ফোকরের দিকে যেতে যেতে ভিখন নীরস স্বরে বলল, এখন যাই রে লখাই দাদা, পেটি অফসার হারামী ছোবড়া ছিলতে না দেখলে টিকটিকিতে (বেত মারার স্ট্যাণ্ডে) চাপাবে। শালে–দাঁতে দাঁত ঘষতে ঘষতে গরাদের ওপাশে চলে গেল ভিখন।
একদৃষ্টে তাকিয়ে তাকিয়ে লখাই দেখল।
বেলা চড়ার সঙ্গে সঙ্গে পিনিকের উপসর্গগুলো মারাত্মক হয়ে উঠল। মাথার রগ ছিঁড়ে যাচ্ছে, মুখের ভেতর অসংখ্য ফোস্কা পড়েছে যেন। শরীরটাকে আর খাড়া রাখতে পারছে।
লখাই। এখন দুপুর। সকাল থেকে এ পর্যন্ত একটা ছোবড়াও ছিলে নি লখাই। ছিলতে পারে নি।
একুট পর খানাপিনার সময় হল।
দুদ্দাড় করে সিঁড়ি কাঁপিয়ে কয়েদিরা নিচে ছুটছে। টলতে টলতে লোহার বর্তন হাতে সকলের সঙ্গে লখাইও নেমে এল এবং খানা নেওয়ার জন্য কানুন মাফিক ফাইল দিয়ে বসল।
চাপাটি ডাল ভাজি আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়া করল লখাই। খাওয়ার গরজ নেই, ইচ্ছাও নেই।
এ-পাশে লাইন দিয়ে বসেছে হিন্দু কয়েদিরা, ও-পাশে মুসলমান কয়েদিরা।
খাবার নাড়তে নাড়তেই হঠাৎ লখাইর চোখে পড়ল, মুসলমান কয়েদিদের ফাইলে জাজিরুদ্দিনের গা ঘেঁষে বসেছে ভিখন আহীর। তরিবত করে মুসলমান ভাণ্ডারার খানা খাচ্ছে।
লখাই তাজ্জব বনে গেল।
খানাদানার পর বর্তন ধুয়ে যখন ওপরে যাচ্ছে ভিখন, লখাই চিৎকার করে ডাকল, এই ভিখন, এদিকে আয়–
তরতর করে নিচে নেমে এল ভিখন আহীর। পোড়া মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, ডাকছিস লখাই ভেইয়া–
হারামী, তুই যে জাত দিলি! মুসলমান ভাণ্ডারার খানা খেলি যে!
বিচিত্র স্বর ফুটল ভিখনের গলায়, কয়েদির আবার জাত কি রে ভেইয়া! ও বাত ছোড়। যদি জাতই বলিস, জাত দেবই বা না কেন? হিন্দু ভাণ্ডারা যে খানা দেয় তাতে পেট ভরে না। জাজিরুদ্দিন বলেছিল, ইসলামী বলে ডবল খানা মিলবে। বলতে বলতে মুখ চোখ করুণ হয়ে উঠল ভিখনের, পেটি অফসার সোনা রুপেয় সব কেড়ে নিয়েছে। রুপেয় না থাকলে জেয়াদা খানাও মেলে না। তাই ভেইয়া, সিফ পেটকো বাস্তে, স্রিফ ভুখের জন্যে আমি ইসলামী বনলাম, জাত দিলাম। গলাটা ধরে গেল ভিখনের।
লখাই দেখল, শুধুমাত্র পেটের ভুখের জন্য আন্দামানের এই নিদারুণ কয়েদখানায় মুসলমান হল ভিখন, জাত হারাল।
জীবনের সীমানা বাড়ছে। মানুষের পৃথিবী বাড়ছে। কিন্তু জীবনের সীমানা কি মানুষের পৃথিবী তো একদিনে বাড়ে না।
প্রথমেই তো জন্ম। সেই জন্ম–আকাশ বাতাস, সমগ্র জৈব জগৎ, সমস্ত অস্তিত্বকে তোলপাড় করে যার গোড়াপত্তন। জন্মের পর স্থিতি–প্রতিকূল বিমুখ পরিবেশের সঙ্গে ক্রমাগত লড়াই করে যাকে টিকে থাকতে হয়। স্থিতির পর অজস্র সংগ্রামের মূল্যে বিস্তার। কিন্তু সে অনেক পরের কথা।
পৃথিবী এবং মানুষের জন্ম স্থিতি ও বিস্তার কি সহজ কথা!
বঙ্গোপসাগরের অগাধ অতল থেকে কবে যে আন্দামান দ্বীপমালা মাথা তুলেছিল, বন্দা। নওয়াজ খান জানেন না। আন্দামানের জন্ম তিনি দেখেন নি, কিন্তু এখানকার উপনিবেশ তৈরি হতে দেখেছেন।
সেই উপনিবেশ এখন বড় হয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে।
আঠার শ’ আটান্ন সালের চৌঠা মার্চ ডক্টর জে. পি. ওয়াকার সেই যে দু শ’ কয়েদি নিয়ে আন্দামান এসেছিলেন, নওয়াজ খান সে দলে ছিলেন।
সেদিন দক্ষিণ আন্দামান ছিল এক নিদারুণ, আদিম পৃথিবী।
এখানকার ছায়াগভীর অরণ্যে কিং কোব্রারা বিশাল ফণা দুলিয়ে ঘুরে বেড়াত। বিষাক্ত কানখাজুরার পাল শিকারের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরত, তাদের একটি মাত্র কামড়ে নিশ্চিত মৃত্যু। নিবিড় জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে কালো কালো, হিংস্র মুখ দেখা দিয়েই চকিতে মিলিয়ে যেত। খর্বকায় উলঙ্গ জারোয়াদের হাতে তীর ঝকমক করত। উপসাগরে হাঙর আর। অক্টোপাস হানা দিত। উপকূল বেয়ে অতিকায় কচ্ছপের পাল উঠে আসত এই দ্বীপে। উপসাগর প্রায় সারাক্ষণ মেতে থাকত। আকাশের স্তূপাকার মেঘ ফেঁড়ে কড় কড় শব্দে যখন বাজ পড়ত, দুর্বার বেগে সমুদ্র যখন উপকূলের দিকে ছুটে আসত, যখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামত, তখন সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপ দুস্তর কালের ব্যবধান ঘুচিয়ে মুহূর্তে প্রাগৈতিহাসিক হয়ে উঠত।
সে-সব দিনেদ্বীপের ভেজা, ছায়াচ্ছন্ন মাটিতে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য কিং কোব্রার সঙ্গে, কচ্ছপের সঙ্গে, কানখাজুরা বা জারোয়াদের সঙ্গে, হাঙর আর অক্টোপাসের নিরন্তর লড়াই। এই দ্বীপের জীবজগৎ ক্রমাগত লড়াই করে আন্দামানের বর্বর মহিমা বাঁচিয়ে রাখত।
আঠারো শ’ আটান্ন সাল, আর এটা উনিশ শ’ এগার। মাঝখানে তিপান্ন বছরে কিং কোব্রা আর জারোয়া, কানখাজুরা আর হিংস্র সরীসৃপদের সেই ছায়াশীতল ভয়ঙ্কর অরণ্যকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে, জংলী অসভ্য আদিবাসীদের উৎখাত করে শহর পোর্ট ব্লেয়ারের জন্ম হল।
মানুষের বর্বরতা এবং হিংস্রতার কাছে প্রাচীন অরণ্য হার মানল। দক্ষিণ আন্দামানে উপনিবেশ গড়ে উঠতে লাগল।
তিপান্নটা বছর ফুসফুসে বঙ্গোপসাগরের নোনা বাতাস টেনে টেনে, আর আন্দামান অরণ্যের বিনাশ দেখে দেখে একটা অদ্ভুত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন বন্দা নওয়াজ খান। তার মনে হয়, সকল সৃষ্টির মূলেই রয়েছে বর্বরতা। বর্বরতা দিয়ে যার শুরু, শেষও তার বর্বরতার মধ্যেই কিনা, কে বলবে। আন্দামান উপনিবেশের ভবিষ্যৎ ভেবে মাঝে মাঝে শিউরে ওঠেন
আন্দামানের এই কলোনি জঙ্গল নির্মূল হয়ে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। জীবনের সীমানা বাড়ছে, মানুষের পৃথিবী অরণ্য নিশ্চিহ্ন করে নিজের দখল কায়েম করে চলেছে।
তিপান্ন বছরের উপনিবেশ শৈশব পেরিয়ে এখন যৌবনে পা দিয়েছে।
এতগুলো বছর এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপে কাটিয়ে নিজস্ব একটা তত্ত্বে পৌঁছেছেন নওয়াজ খান। সভ্যই বল, অসভ্যই বল, সৎ অসৎ, পাপীতাপী, আসক্ত নিরাসক্ত, খুনী কি প্রেমী–সর্ব কালের সকল মানুষের মধ্যে এক একটা আন্দামান উপনিবেশ রয়েছে।
কী বিচিত্র, কী নিদারুণ এই দ্বীপ!
এই দ্বীপের আত্মাকে খুঁজতে খুঁজতে নওয়াজ খানের মনে হয়েছে, আদিম পৃথিবীই একমাত্র সত্য। হাজার হাজার বছর ধরে আদিমতার ওপর স্তরে স্তরে সভ্যতার যে প্রলেপ পড়েছে, ধারাল নখে তাকে ছিঁড়ে, সভ্যতার সব মলাট ফেঁড়ে ফেঁড়ে যে বস্তুটি মিলবে, সেটি হল বর্বরতা।
আশ্চর্য, সেই বর্বরতাকে বিনাশ করার জন্যই আন্দামান উপনিবেশের জন্ম। নওয়াজ খানের মনে হয়, এই উপনিবেশের প্রয়োজনই ছিল না। তবু এর সৃষ্টি হয়েছে।
জীবনের সীমানা বাড়ছে।
নওয়াজ খানের ভাবনার ওপর দিয়ে পৃথিবী বিস্তৃত হচ্ছে।
বন্দা নওয়াজ খান স্যালিয়ালির পথ ধরে চৌলদারির দিকে যাচ্ছিলেন। ভাঙা ভাঙা পাথরের সড়কটা চড়াই বেয়ে ওপরে উঠেছে। সন্তর্পণে পা ফেলে ফেলে হাঁটছিলেন নওয়াজ খান। দু’পাশে হাওয়াই বুটির জঙ্গল। ঈষৎ লালচে দু চারটে ফুল ফুটে রয়েছে।
বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে শীত ফুরিয়ে আসতে শুরু করেছে। কয়েক দিনের মধ্যেই বসন্ত এসে পড়বে। এখানকার নোনা মাটিতে বসন্ত সমারোহ করে আসে না। হাওয়াই বুটির জঙ্গলে, রেন-ট্রিগুলোর মাথায় কিছু কিছু ফুল ফুটিয়েই বসন্তের সমস্ত উদ্যম শেষ হয়ে যায়। ষষ্ঠ ঋতুর নিশানা সেই ফুলগুলি একদিন ঝরে পড়ে বুঝিয়ে দিয়ে যায়,দ্বীপের মাটি থেকে বসন্ত উধাও হয়েছে।
শীতের শেষে সেই বসন্তই আসতে শুরু করেছে।
হাওয়াই বুটির জঙ্গল থেকে বুনো গন্ধ উঠে আসছে। দু’পাশের নরম, ছায়াচ্ছন্ন মাটির ঘ্রাণ নিতে নিতে নওয়াজ খান চৌলদারি পেরিয়ে, গোলঘর পেছনে রেখে, সিধা পাহাড়গাঁও গারাচারামার পথ ধরেছেন। দু’দিকের জঙ্গল আরো ঘন হচ্ছে। মাটির গন্ধ, জঙ্গলের গন্ধ, বুনো ফুলের গন্ধ মিশে একটা উগ্র মিশ্রিত গন্ধ নাকটাকে অবশ করে দিচ্ছে যেন।
তিপ্পান্ন বছর এইদ্বীপে কাটিয়েছেন নওয়াজ খান। তিপ্পান্ন বছরে তিপ্পান্নটা বসন্ত এসেছে এই দ্বীপে। বসন্তের চেহারা তার পরিচিত, বসন্তের গন্ধ তার কতকালের চেনা। তবু প্রতিবারই এই ঋতুতে ভেজা মাটি, বুনো ফুল, আর জঙ্গলের গন্ধ অনাস্বাদিত মনে হয় নওয়াজ খানের, অননুভূত রোমাঞ্চ জাগায়। পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপের সব কিছুই সৃষ্টিছাড়া।
নোনা মাটিতে বসন্ত যেমন দুচারটে ফুলও ফোঁটায়, তেমনি দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে এক টুকরো কালো মেঘকেও টেনে আনে। মৌসুমি বাতাসের তাড়নায় মেঘের টুকরোগুলো ফুলে ফেঁপে পাকার হয়ে নিমেষে আকাশটাকে ছেয়ে ফেলে। সমুদ্রের তলা থেকে একটা গম্ভীর গুরগুর গর্জন ঠেলে বেরিয়ে পড়ে। পাহাড়ের মতো খাড়া হয়ে কালো কুটিল জল দুর্জয় বেগে দ্বীপের দিকে ছুটে আসে। চারপাশের সমুদ্র এই দ্বীপ ভেঙে গুঁড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়।
বছরের শেষ ঋতুটি ভয়ঙ্কর হয়ে এই বর্বর দ্বীপের মর্যাদা পুরোপুরি বজায় রাখে।
বন্দা নওয়াজ খান পাথুরে সড়ক ভাঙছিলেন। প্রতিদিন পোর্ট ব্লেয়ারের বন্দি উপনিবেশে একবার টহল দিয়ে বেড়ানো তার অভ্যাস। অনেক বছরের পাকা অভ্যাসটা এখন একটা নিয়মে দাঁড়িয়ে গিয়েছে।
সড়কের দু’পাশে বনতুলসির ঝাড়, সুপারি বাগিচা, নারকেল বাগিচা। ফাঁকে ফাঁকে বরগত দিদু আর পপিতা গাছ। মাঝে মাঝে জঙ্গল সাফ করে কুঠি বাড়ি উঠেছে, আবাদের জন্য ক্ষেতিবাড়ি তৈরি হয়েছে।
পথে দুচার জনের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।
আদাব খান সাহেব—
আদাব—
তবিয়ত আচ্ছা?
আচ্ছা।
আজ আমাদের গাঁও-এ আসবেন তো?
না। আজ গারাচারামা গাঁও-এ যাব। ডি-কুনহার কুঠিতে দাওয়াত (নিমন্ত্রণ) আছে।
লোকগুলো চলে যায়।
অলক্ষ্যে নৈর্ঋত আকাশে এক খণ্ড সোনামুখি মেঘ দেখা দিয়েছে।
এখন কত বেলা, কে জানে। বাতাসে শীতের আমেজ একটু একটু মিশে রয়েছে। আবার রোদের তেজও মারাত্মক। চড়া রোদ আর হিমাক্ত বাতাস মিশে সর্বাঙ্গে সুখের স্পর্শ দিয়ে যাচ্ছে।
নতুন উপনিবেশের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গারাচারামা গাঁও-য়ে ডি-কুনহার কুঠিবাড়িতে পৌঁছে গেলেন নওয়াজ খান।
কুঠিবাড়ির সামনের দিকে ছোট্ট একখণ্ড বাগিচা। নারঙ্গি, গোঁড়া লেবু, মুসম্বি দ্বীপের নোনা মাটিতে বহু আয়াসে কিছু কিছু মরশুমি ফল ফলানো হয়েছে।
ডি-কুনহার কুঠিবাড়ি অনেকটা বর্মী প্যাগোডার মতো। টিনের নকশা-কাটা চাল, খোদাই কাঠের দেওয়াল, নিচে কাঠের পাটাতন। কুঠিবাড়ির সর্বাঙ্গে সুন্দর একটি রুচির ছাপ রয়েছে।
বন্দা নওয়াজ খান ডাকলেন, ডি-কুনহা—
কৌন? কুঠিবাড়ি থেকে গম্ভীর স্বর ভেসে এল।
আমি নওয়াজ–
আমি ভাবলাম কে না কে। সঙ্গে সঙ্গে দরজায় পুরো ছফিট দীর্ঘ একটা লোক দেখা দিল। লালচে কোঁকড়ানো চুল, নীল চোখ। নতুন পয়সার মতো উজ্জ্বল তামাটে রঙে কিছুটা মোঙ্গলীয় খাদ মিশে আছে। খাড়া, কঠিন দু’টি চোয়াল। বাজপাখির ঠোঁটের মতো ধারাল নাক। এই হল ডি-কুনহা। টান টান চামড়া সর্বাঙ্গে জড়িয়ে নিজের আদত বয়স লুকিয়ে রেখেছে লোকটা। চেহারা দেখে ডি-কুনহার বয়স বুঝবার জো নেই।
পরনে সিল্কের লুঙ্গি আর ফিনফিনে কলিদার পাঞ্জাবি। ডি-কুনহা দরজার ওপর থেকে নিচে নেমে এল। বলল, আসুন, আসুন খান সাহেব—
কী বিচিত্র এই দ্বীপ! আর কী বিচিত্র এই ডি-কুনহা!
সপ্তদশ শতাব্দীতে নাবী বাংলায় পর্তুগিজ আর হার্মাদ লুটেরারা যে তাণ্ডব শুরু করেছিল, ইতিহাসে তার বিস্তর সাক্ষ্য আছে। সেদিনের বিবর্ণ ইতিহাসের পৃষ্ঠাগুলি রক্তে হত্যায় ধর্ষণে আর অমানুষিক অত্যাচারে কলঙ্কিত। পর্তুগালের রুক্ষ উপকূল থেকে ঝকে ঝকে জলদস্যুর জাহাজ বাংলাদেশের সম্পদ লুট করতে আসত। সপ্তদশ শতাব্দীর পুর্তগিজ জাহাজগুলির একটুকরো কাঠও আজ মিলবে না। একজন জলদস্যুর একখণ্ড হাড়ও নিম্ন বাংলার কোথাও নেই।
সুশ্যাম বাংলাদেশের অদ্ভুত এক কুহক আছে। এর নিরুত্তাপ জালবায়ুতে বিচিত্র মোহ আছে। হামাদ বোম্বেটেরা নিজেদের অজান্তে বাংলার কোমল পলিমাটিতে আটকে গেল। বৈঠা আর চলল না, পাল আর উঠল না। কালে কালে, স্তরে স্তরে পলিমাটি এসে জাহাজগুলিকে গ্রাস করে ফেলল, ফিরবার পথ বন্ধ হয়ে গেল তাদের।
সেই যে বিদেশি জলদুস্যরা বাংলায় এসেছিল, তারপর তিনটে শতাব্দী পার হতে চলল। এই তিন শ’ বছরে বাংলাদেশ তাদের সব উদ্দামতা জুড়িয়ে দিল। যে-হাতে তারা শাণিত তলোয়ার আর কামান বাগিয়ে ধরত, সেই হাতে হাল লাঙল ধরল। তিন শ’ বছর আগে তাদের ধমনীতে যে বিশুদ্ধ পর্তুগিজ রক্ত বইত, সে রক্ত আর বিশুদ্ধ রইল না। আরাকানী, মগ আর নোয়াখালি চট্টগ্রামের দেশি রক্তের খাদ মিশে আদিপুরুষের গৌরব ম্লান করে দিল, তাদের সমস্ত অতীতকে ভুলিয়ে দিল। কিছু কিছু বিকৃত নাম, মাতা মেরি, গলায় ক্ৰশ, যেশাস–সামান্য কয়েকটি উপকরণের মধ্যে পোর্তুগালের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ পলকা একটি সুতোয় ঝুলতে লাগল।
বাংলাদেশ সেই নিদারুণ অত্যাচারের চরম প্রতিশোধ এমন নির্মমভাবেই নিয়েছে।
এদেরই একজন ডি-কুনহা।
ডি-কুনহার যে অতীত, তাতে পুরোপুরি জাত সে হারায় নি। কিছু বর্মী রক্ত ছাড়া তার ধমনীতে মোটামুটি পোর্তুগিজ রক্তই বইছে। তবে অনেক কাল নাবী বাংলার বাতাসের সঙ্গে ফুসফুসের সম্পর্ক রাখতে হয়েছে। কাজেই তিন শ’ বছর আগের মতো ফুসফুসটা তেমন পোক্ত নয়, রীতিমতো তাতে নোনা ধরেছে। তবু বাংলাদেশের জলবায়ুর তাড়না থেকে নিজেকে সন্তর্পণে বাঁচিয়ে রাখতে বিন্দুমাত্র কসুর করে নি ডি-কুনহা। এত সত্ত্বেও পোশাকে
আশাকে রুচিতে চেহারায় বাংলাদেশ আর বর্মার প্রভাব ঠেকিয়ে রাখতে পার নি।
নারীঘটিত গোটা সাতেক জঘন্য অপরাধে সারা জীবনের দ্বীপান্তরী সাজা নিয়ে আন্দামানে এসেছিল ডি-কুনহা। বছর খানেক হল সাজার মেয়াদ ফুরিয়েছে। বড় করিতকর্মা লোক সে। এক বছরের মধ্যেই প্রচুর টাকা করেছে। গারাচারামা গাঁও আর পোর্ট ব্লেয়ারের এবারডিনে দুটো কুঠিবাড়ি বানিয়েছে। জঙ্গলে অনেক জমি বন্দোবস্ত নিয়েছে। এত টাকা কিভাবে তার হল, সে এক দুয়ে রহস্য।
আন্দামানে আসার আগে আকিয়াবে সুপারির ব্যবসা ছিল ডি-কুনহার। এখানে তার সিপির ব্যবসা। সিপি হল সামুদ্রিক শঙ্খ-কড়ি-শামুক। সমুদ্র থেকে এগুলিকে তুলে বিদেশের বন্দরে চালান দেয় সে।
অন্য কয়েদিরা বলে সিপির ব্যবসা করে এত পয়সা কামানো যায় না। তবু কোত্থেকে তার টাকা আসে, তা এক দুর্বোধ্য ধাঁধা হয়েই রয়েছে।
ডি-কুনহার চরিত্রটি বিচিত্র। নারীঘটিত সাত-সাতটা জঘন্য অপরাধের দায়ে আন্দামানে এসেছিল সে। অথচ আন্দামানে কোনোদিন তাকে কেউ নারীসঙ্গ করতে দেখে নি। আওরত কয়েদি নিয়ে জাহাজ যখন এই দ্বীপের উপকূলে নোঙর ফেলে, অন্য কয়েদিরা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, রেণ্ডিবারিক কয়েদখানার চারপাশে হন্যে হয়ে ঘোরে। তা ছাড়া, এই উপনিবেশে বর্মী যুবতী জোটানো তেমন দুরূহ ব্যাপার নয়। নারীমাংস এই দ্বীপে যেমন দুর্লভ, তেমন আবার সহজলভ্যও।
কিন্তু কোনোদিন ডি-কুনহাকে আওরতের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে কেউ দেখে নি। গারাচারামার কুঠিবাড়িতে নিঃসঙ্গ দিন কাটায় ডি-কুনহা।
ইতিমধ্যে কাঠের কুরসিতে জাঁকিয়ে বসেছেন নওয়াজ খান।
ডি-কুনহা বলল, খান সাহেবের খুব তকলিফ হল।
না না, তকলিফ আর কি। এ তো অভ্যাসই হয়ে গেছে। রোজ একবার পেনাল কলোনিটা ঘুরে ঘুরে না দেখলে ভালো লাগে না। এই দ্বীপের সঙ্গে কতদিনের সম্পর্ক, কয়েদিদের কতকাল ধরে দেখছি–বন্দা নওয়াজ খান বড় একটা শ্বাস ফেললেন।
একটু চুপচাপ।
তারপর নওয়াজ খান আবার বললেন, কী ব্যাপার, মা-পোয়েকে আনলে না?
না। বাজপাখির ঠোঁটের মতো ডি-কুনহার যে নাকটা উদ্যত হয়ে ছিল, সেটা ফুলে উঠল। নীল চোখদুটো ঈষৎ কুঁকড়ে গেল। চাপা, কঠিন স্বরে আবার সে বলল, না।
নওয়াজ খান বলতে লাগলেন, সাজার মেয়াদ ফুরিয়েছে, কুঠিবাড়ি বানিয়েছ, এবার মুল্লুক থেকে মা-পোয়েকে নিয়ে এস।
এই দ্বীপের কেউ জানে না, কিন্তু বন্দা নওয়াজ খান অনেক প্রশ্ন-ট্রশ্ন করে খোঁজ নিয়েছেন, আন্দামানে আসার আগে আকিয়াবে একটা শাদি করে এসেছে ডি-কুনহা। বিবির নাম মা-পোয়ে। বর্মী। গুটি তিনেক ছেলেপিলেও রয়েছে।
মা-পোয়ের প্রসঙ্গে এবার আর কিছু বলে না ডি-কুনহা।
নওয়াজ খান ফের বললেন, কি, কথা বলছ না কেন?
কী বলব?
তুমি একবার মেইনল্যাণ্ডে যাও।
মেইনল্যাণ্ডে গিয়ে কী করব?
বিবি আর বাচ্চাগুলোকে নিয়ে এস।
বিবি আর বাচ্চাগুলো কোথায় রয়েছে, কী করে বলব? বিশ বছর তাদের কোনো পাত্তা নেই। তাদের ঠিকানা জানি না। দুনিয়া থেকে তারা লোপাট হয়ে গেছে কি না, কে জানে।
অনেক বার আকিয়াব গিয়ে মা-পোয়েকে আনবার কথা বলেছেন নওয়াজ খান। প্রতিবার একই জবাব দিয়েছে ডি-কুনহা।
মা পোয়েকে এই দ্বীপে নিয়ে আসার পেছনে নওয়াজ খানের কোনো মতলব রয়েছে কিনা, কে বলবে। বঙ্গোপসাগরের এই বর্বর দ্বীপে উপনিবেশ যখন গড়েই উঠল, তখন তা মানুষে ভরে উঠুক। হয়তো বা এই ইচ্ছাই নওয়াজ খানের মনে। শুধু মা-পোয়ে কেন, এই দ্বীপের যত কয়েদি-সকলকেই তিনি মুলুক থেকে বিবি বাচ্চা আনার পরামর্শ দেন।
নওয়াজ খান বললেন, তবু একবার মেইনল্যাণ্ডে যাও, বিবি বাচ্চার খোঁজ কর।
দেখি–
গলায় কালো কারে একটা ছোট ক্রস ঝুলছে। ক্রসটা লুফতে লুফতে ডি-কুনহা বলল, অনেক বেলা হয়েছে খান সাহেব, এবার খানা দিক?
হাঁ–
সেই সকালে পোর্ট ব্লেয়ার থেকে বেরিয়েছেন নওয়াজ খান। সূর্য এখন দ্বীপের মাথায় এসে উঠেছে। শীতের অরণ্য জ্বলছে। বাগিচা থেকে লেবু ফুলের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে। মাঝে মাঝে দমকা বাতাস এসে নারঙ্গি গাছের মাথা দুলিয়ে যাচ্ছে।
এই জঙ্গলেও মোগলাই খানার বন্দোবস্ত করেছে ডি-কুনহা। বাদক পাখির কাবাব, হরিণের গোস্তের কোর্মা, পোলাও। খানার অনুপান হিসেবে বিশেষ পিনার ব্যবস্থাও রয়েছে।
বর্মী চাকর টেবিলে খান সাজিয়ে দিল।
হরিণের হাড় চিবুতে চিবুতে ডি-কুনহা নরম স্বরে বলল, খান সাহেব, আমার একটা আর্জি আছে–
আমার কাছে?
হাঁ–
বল।
বলছিলাম, কমিশনার সাহেব আপনাকে খুব খাতির করেন। কয়েদিরা বলে, তাঁর সঙ্গে আপনার বহুৎ দোস্তি মহব্বতি–
নওয়াজ খান মৃদু হাসলেন। বললেন, থোড়া জান-পয়চান আছে।
এরপর দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ।
খেতে খেতেই ডি-কুনহা নওয়াজ খানের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। মুখচোখের ভাবগতিক লক্ষ করে। তারপর সুযোগ বুঝে বলে, খান সাহেব, দিনকতক আগে আমরা উত্তর আন্দামান গিয়েছিলাম। সেই পোর্ট কর্নওয়ালিস–
হাঁ–নির্বিকার মুখে ডি-কুনহার দিকে তাকিয়ে কোর্মায় কামড় দিলেন নওয়াজ খান।
একটু অপেক্ষা করল ডি-কুনহা। তারপর বলল, উত্তর আন্দামানের দরিয়ায় অনেক সিপি দেখে এসেছি। আপনি যদি কমিশনার সাহেবকে বলে ওই জায়গাটা ইজারার বন্দোবস্ত করে দেন, আমার বড় উপকার হয়।
কিছুক্ষণ কী ভাবলেন নওয়াজ খান। পরে বললেন, কমিশনার সাহেবকে বলতে পারি, লেকিন তোমার একটা কাজ করতে হবে।
কী?
মেইনল্যাণ্ড থেকে মা-পোয়েকে খুঁজে আনতে হবে।
হাঁ হাঁ, জরুর–হঠাৎ মা-পোয়ের ব্যাপারে বড় উৎসাহী হয়ে ওঠে ডি-কুনহা, আমার শাদিকরা বিবি, আর আপনি যখন বলছেন, তাকে নিয়ে আসব নিশ্চয়ই।
খানাপিনা চুকতে ঢুকতে এই দ্বীপে বিকেল নামে। ডি-কুনহার নারঙ্গি গাছগুলোর মাথা টপকে ঝাঁকে ঝাঁকে বাদক পাখিরা কোনদিকে যে উড়ে যায়! বাতাসের একটানা তাণ্ডব চলতেই থাকে।
বিকেল থেকেই অস্থির হয়ে উঠল ডি-কুনহা। বাগিচার ফাঁক দিয়ে সড়কের যে-অংশটা দূরে চলে গেছে, বার বার সেদিকে তাকাতে লাগল। যে-কোনো মুহূর্তে তারা এসে পড়বে। এদিকে নওয়াজ খান উঠবার কোনো লক্ষণই দেখাচ্ছেন না। মনে মনে যেশাসের নামে একটা শপথ নিয়ে ডি-কুনহা ভাবল, আজ নওয়াজ খানকে দাওয়াত না করলেই ভালো। হত।
শেষ পর্যন্ত ডি-কুনহার উদ্বগ বিশ গুণ বাড়িয়ে, প্রাণটাকে ওষ্ঠাগত করে সন্ধের একটু আগেই তারা এসে পড়ল। সরাসরি সেই কামরাতেই ঢুকল।
কুরসির বাজুতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন নাওয়াজ খান। বয়স হয়েছে। খানাপিনার পর আজকাল তন্দ্রা আসে, চোখ দুটো আপনা থেকেই ভারী হয়ে ওঠে। তখন আর ঘুমটাকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না।
সর্বনাশ যা ঘটবার ঘটে গেল, সেই মুহূর্তেই নওয়াজ খান কুরসির বাজু থেকে মাথা তুললেন।
ডি-কুনহার ইশারায় লোকদুটো বেরিয়ে যাচ্ছিল। নওয়াজ খান বললেন, ও–ও– কে? ফাই মঙ বর্মী না! এবারডিন বাজারে দোকান আছে?
ফাই মঙ ঘুর দাঁড়াল। চাপা, কুতকুতে চোখজোড়ার একটা নিষ্ঠুর ছায়া পড়ে চকিতে মিলিয়ে গেল। সামান্য হাসল ফাই মঙ। সোনা-বাঁধানো একটা দাঁত একবার দেখা দিয়েই অদৃশ্য হল। মৃদু, কঠিন স্বরে ফাই মঙ বর্মী বলল, হাঁ জি, আমি ফাই মঙ, এবারডিন বাজারে আমার দোকান আছে।
অন্য লোকটা, যার নাম জন, এতক্ষণে দরজার সামনে থেকে সরে গিয়েছে কিন্তু একবার দেখেই তাকেও চিনে ফেলেছেন নওয়াজ খান। এই দ্বীপের প্রতিটি কয়েদিকেই চেনেন তিনি। সকলের গাঁও মুল্লুক, সাজার মেয়াদ, কে দণ্ডবিধির কোন ধারার আসামী, কার মেয়াদ ফুরোতে কতদিন বাকি, সব, সব নওয়াজ খানের কণ্ঠস্থ। এইদ্বীপের সঙ্গে কি তার দু দশ দিনের সম্পর্ক!
ডি-কুনহার কুঠিবাড়িতে কোনোদিন ভাগোয়া কয়েদি জনকে দেখবেন, এমন অনুমান কস্মিনকালেও করেন নি নওয়াজ খান। অদ্ভুত উত্তেজনায় বুকের ভেতরটা ধকধক করছে। পরিষ্কার তার মনে আছে, দু বছর আগে মালয় থেকে জন এই দ্বীপে সোজা খাটতে এসেছিল। দু’মাস সাত রোজ জেলে থাকার পর সে ফেরার হয়ে যায়।
সেলুলার জেলের নথিপত্রে উল্লেখ আছে, আজ উনিশ শ’ সালের বারই অক্টোবর। যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের আসামী মালয়ী খ্রিস্টান জন আজ পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ফেরার হয়। দণ্ডবিধির তিন শ’ দুই ও তিন শ’ সাতষট্টি ধারার যাবতীয় সাজা তার উপর প্রযুক্ত ছিল।
জন অতি ভয়ানক প্রকৃতির আসামী। এ যাবত সে সজ্ঞানে স্থির মস্তিষ্কে তিনটি হত্যা করেছে। জন সেলুলার জেলের বিশ নম্বর কয়েদি।
জন ফেরার হওয়ার কিছুদিন পর পাহাড়গাঁওতে দুটো খুন হয়েছিল। খুনের পদ্ধতি বিচার করে সেলুলার জেলের কর্তৃপক্ষ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন, এ জনেরই কাজ।
পাহাড়গাঁও-এর খুনের পর সরকার থেকে ঘোষণাপত্র বেরোয়, জীবিত বা মৃত, যে কোনো অবস্থায় জনকে ধরে দিতে পারলে এক হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।
দুবছরেও জনকে ধরা যায় নি। গোটা দক্ষিণ আন্দামান ছুঁড়েও তার পাত্তা মেলে নি।
নওয়াজ খান অস্থির হয়ে উঠলেন। উদ্বগ এবং আতঙ্কের ছাপ পড়ল তার মুখে।
একদৃষ্টে, নির্মম চোখে নওয়াজ খানের দিকে তাকিয়ে রয়েছে ডি-কুনহা। তার ভাবান্তর লক্ষ করছে।
অনেকটা সময় কাটল। এর মধ্যে দরজার পাশ থেকে ফাই মঙ কর্মী আর জন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।
বাইরে অরণ্যের মাথায় রোদ মরে আসতে শুরু করেছে। লেবু বাগিচার ফাঁক দিয়ে যে-সড়কটা অস্পষ্ট হয়ে ছিল, সেটা এখন একেবারেই নিশ্চিহ্ন। জঙ্গল ফুঁড়ে ঠাণ্ডা বাতাস উঠে আসছে।
হঠাৎ নওয়াজ খান বললেন, ওই লোকটা কে?
কঠিন, নির্মম স্বরে ডি-কুনহা বলল, আবদাল্লা–আমার নোকর।
আরো খানিকটা পর উঠে পড়লেন নওয়াজ খান। বিদায় জানিয়ে সড়কে এসে নামলেন। মেজাজটা একেবারেই খারাপ হয়ে গিয়েছে।
ভাগোয়া কয়েদি জনকে এক নজরেই পরিষ্কার চিনে ফেলেছেন নওয়াজ খান। তবু ডি কুনদা মিথ্যা নাম বলল কেন?
ডি-কুনহার সাজার মেয়াদ ফুরিয়েছে। আইনের চোখে সে এখন অপরাধমুক্ত, স্বাভাবিক, স্বচ্ছন্দ মানুষ। তবে ভাগোয়া কয়েদি জনের সঙ্গে তার কি সম্পর্ক?
চলতে চলতে নওয়াজ খানের মনে হয়, ডি-কুনহার সঙ্গে জনের কোথায় যেন একটা নিগূঢ় যোগাযোগ রয়েছে। যোগাযোগটা আদপেই নির্দোষ নয়–ভীষণ এবং সাঙ্ঘাতিক।
এত বছর এই দ্বীপে কয়েদ খেটেও শোধরাল না ডি-কুনহা।
লখাইর কুঠুরির ডান পাশের কুঠুরিটা পরাপের। বাঁ পাশের কুঠুরিটা এতদিন খালি পড়েই ছিল। দিন তিনেক আগে মাঝ রাতের দিকে এক কয়েদিকে সেখানে পোরা হয়েছে। লোকটা বর্মী। ওয়ার্ডার মোহর গাজীর কাছে নাম জেনে নিয়েছে লখাইলা ডিন।
অন্য কয়েদিদের সকালে বাইরে বার করে দেওয়া হয়। কিন্তু পুরো তিনটে দিন লা ভিনকে তালা বন্ধ করে রাখা হয়েছে। পেটি অফিসার সকালে এক বর্তন কাঞ্জি, দুপুরে এক ডাক্বা ভাত এবং বিকেলে খান তিনেক শুকনো রুটি–সেলুলার জেলের বরাদ্দ খানা সেলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে তার কর্তব্য চুকিয়ে ফেলে।
তিন দিনের খানা জমে গরাদের মুখে পাকার হয়ে রয়েছে। বাসি কাঞ্জি থেকে অল্প সিকার গন্ধ ছুটছে। রুটিগুলিতে ছাতা পড়তে শুরু করেছে।
আশ্চর্য! লা ডিন খাদ্যবস্তুর দিকে একবার ফিরেও তাকায় না। বাইরের বারান্দায় নারকেল ছোবড়ার ঝুরা খসিয়ে সরু মিহি তার বার করতে করতে লখাই লক্ষ করেছে, তিন দিনে এধারে মুহূর্তের জন্যও মুখ ফেরায় নি লা ডিন। কুঠুরির পেছনের দেওয়ালে বাইরের আলো আর বাতাসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য যে ছোট্ট ফোকরটা রয়েছে, সেদিকে তাকিয়ে মেরুদণ্ড খাড়া রেখে সারা দিন বসে থাকে লোকটা। রাতের কথা অবশ্য লখাই বলতে পারবে না। তবে তার মনে হয়, সারারাত লা ডিন ওই একই অবস্থায় বসে বসে কাটিয়ে দেয়।
বাইরে কয়েদিদের এত হল্লা, এত চিৎকার, টিণ্ডাল পেটি অফিসারদের খিস্তিখেউড়, ছোবড়া পেটার দুপদাপ আওয়াজ, যাঁতা পেষার ঘড় ঘড় শব্দকোনো কিছুই লা ডিনকে টলাতে পারে না।
প্রথম দিন ভিখন আহীর গরাদের কাছ থেকে খান দুই রুটি সরিয়েছিল, তবু ভ্রূক্ষেপ নেই। মোপলা বকরুদ্দিন গরাদের ফাঁকে মুখ ঢুকিয়ে কুত্তার ডাক ডেকে তামাশা করেছে, তবু বিকার নেই।
নিজের চারপাশে অটলতার একটা কঠিন খোলস এঁটে দিবারাত্রি স্থির বসে থাকে লা ডিন। কুত্তার ডাক, তামাশা, হল্লা, সব কিছু সেই খোলসে ঘা খেয়ে ফিরে যায়।
বারান্দায় যাঁতা ঘোরাতে ঘোরাতে, কি ছোবড়া পিটতে পিটতে কয়েদিরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে। এমন তাজ্জবের আদমী নাকি তারা সারা জিন্দেগীতে আদৌ দেখে নি। কথা বলে না, হল্লা বাধায় না, খিস্তি করে না, অন্তত বুক চাপড়ে কাঁদে না–এমন কয়েদির কথা সেলুলার জেলের নথিতে নেই।
চার দিনের মাথায় পেটি অফিসার নসিমুল গণি সেলের গরাদ খুলল। মোলায়েম স্বরে ডাকল, লা ডিনজি–
নিঃশব্দে মুখ ঘোরায় লা ডিন।
নসিমুল আবার বলল, আপকো খানা–
আন্দামানের কয়েদি শায়েস্তা করার জন্য উপরবালা যাকে মুখে খিস্তি, হাতে ডাণ্ডা দিয়ে দুনিয়ায় পাঠিয়েছে, সেই নসিমুল গণির স্বরটা এত মিঠা হতে শুনে পয়লা পয়লা কয়েদিরা তাজ্জব বনে গিয়েছিল।
ভিখন আহীর পাশের কয়েদির কানে মুখ খুঁজল, নয়া কয়েদি বড়ে মরদ রে। দেখছিস, পেটি অফসার শালা কেমন খাতির করে কথা বলছে!
অন্য কয়েদিরা অবাক হয়ে দেখল, নাসিমুল গণি নয়া কয়েদির জন্য সকালের নাস্তা এনেছে, এবং সে নাস্তা কালচে কটুস্বাদ কাঞ্জিপানি না, টাটকা কিছু ফল আর কলের রুটি। নসিমুল সমানে সাধছে, আপকো খানা নিন লা ডিনজি।
খানার নমুনা দেখে চারপাশের কয়েদিদের চোখগুলো লোভে ছুরির ফলার মতো ঝকমক করতে লাগল।
লা ডিন বলল, আগে গোসল করব।
আসুন।
পেটি অফিসার নিচে থেকে লা ডিনকে স্নান করিয়ে আনল। তারপর ফল এবং রুটির সঙ্গে তাকে সেলের মধ্যে পুরে গরাদে তালা আটল। তারও পর পাথুরে সিঁড়ি কাঁপিয়ে কয়েদি শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যেই বুঝি বা অন্য ব্লকের দিকে উধাও হল।
আশ্চর্য, এবার আর পেছনের সেই ফোকরটার দিকে চোখ রেখে স্থির হয়ে বসল না লা ডিন। একখানা কম্বল চার ভাঁজ করে গরাদের সামনে পাতল। সেটার ওপর বসে প্রসন্ন
দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকাল।
এদিকে পিনিকের দাপটে মাথা খাড়া রাখতে পারছে না লখাই। শিরায় শিরায় রক্ত টগবগ করে ফুটছে। মাথার শক্ত খোলা ফাটিয়ে ফুটন্ত মগজ বুঝিবা এই মুহূর্তে বেরিয়ে পড়বে। অসহ্য এক যন্ত্রণা সমস্ত শরীরে চরকির মতো ঘুরছে। চোখ দুটো টকটকে লাল, শিরাগুলো সাপের মতো ফুলে উঠেছে।
তবু নসিমুল গণির হাত থেকে রেহাই নেই। যথারীতি নারকেল ছোবড়া আর মুগুর দিয়ে লখাইকে বসিয়ে দিয়েছে। বিকেলে আড়াই পাউণ্ড তার চাই-ই চাই।
হাত আর চলে না লখাইর। শরীর টলে পড়ছে। লখাইর মনে হল, ডাক ছেড়ে কেঁদে ওঠে। কিন্তু কাদার শক্তিটুকুও তার মধ্যে আর অবশিষ্ট নেই।
হঠাৎ কে যেন বলে, এই যে শোন—
পেছনে ঘুরে লখাই দেখল, হাতের ইশারায় লা ডিন ডাকছে, এদিকে এস।
লা ডিনের ডাকে কী ছিল, টলতে টলতে তার কুঠুরির সামনে উঠে এল লখাই। বলল, আমাকে?
হাঁ–বোসো।
গরাদের এপাশে বসে পড়ল লখাই।
তোমার বুখার হয়েছে?
লা ডিনের গলার স্বরে এমন একটা সহানুভূতির কোমল স্পর্শ রয়েছে যা মুহূর্তে লখাইর সমস্ত মনটাকে অভিভূত করে ফেলল।
এই নিদারুণ দ্বীপ, এই নির্মম সেলুলার জেল। পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন এই সৃষ্টিছাড়া কয়েদখানায় দয়া নেই, মায়া নেই, বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই। চিরকাল এখানে পেটি
অফিসারের হাতে পীড়নের ডাণ্ডাটি উদ্যত হয়েই থাকে।
তিনটে দিন পিনিকের নেশায় আচ্ছন্নের মতো কাটছে লখাইর। দুচার টুকরো রুটি আর দুচার আঁজলা জলে প্রাণটা কোনোক্রমে টিকিয়ে রেখেছে সে। কেউ একবার জিজ্ঞেসও করে নি, কী হয়েছে লখাইর। কারো জন্য এতটুকু সমবেদনা না জানানো এখানকার দস্তুর। সেলুলার জেলের মতোই এখানকার কয়েদিদের মনগুলি নিষ্ঠুর, অনুভূতিশূন্য। এখানে মমতার বাষ্পমাত্র নেই। কালাপানির দরিয়ায় মনের সবটুকু সুকুমার অনুভূতি ডুবিয়ে দিয়ে দুর্দান্ত কয়েদিরা এই দ্বীপে সাজা খাটতে আসে।
এমন যে হৃদয়হীন লখাই, লা ডিনের সহানুভূতির তাপে তার মধ্যেকার সেই স্নেহলোভী স্পর্শাতুর প্রাণটা কতকাল পর যেন আকুল হয়ে উঠল।
মা-বাপের কথা আদৌ মনে করতে পারে না লখাই। স্নেহ কি মমতার স্বাদ প্রথম যার কাছে পেয়েছিল, সে হল বিবিবাজারের মোতি। লখাইর পরিষ্কার মনে পড়ে, সারা জীবনে মোতি ছাড়া কেউ কোনোদিন তাকে আদর কি প্রশ্রয় দেয় নি। এত বড় পৃথিবীতে মোতি ছাড়া আর কেউ তার দুঃখের পরিমাপ কষতে বসে নি। কেউ যদি দুচার ফোঁটা জল তার কল্যাণে ফেলে থাকে, সে মোতিই। অনেক, অনেক দিন পর দ্বীপান্তরী কয়েদি লখাইর বুকটা মোতির জন্য হু-হু–করে উঠল।
লা ডিন আবার বলল, তোমার বুখার হয়েছে?
হাঁ।
লখাইর গলার স্বর আপনা থেকেই জড়িয়ে এল।
লা ডিন বলল, তোমার ছোবড়াগুলো আর মুগুরটা আমাকে দাও, আমি তার বার করে দিচ্ছি।
চমকে লা ডিনের মুখের দিকে তাকায় লখাই। লা ডিন মৃদু মৃদু হাসছে। সে হাসিতে বঙ্গোপসাগরের এই বিবেকহীন, বর্বর দ্বীপের এক দুর্লভ পরিচয় ফুটে বেরিয়েছে।
লা ডিন বলল, কই, নিয়ে এস।
পেটি অফসার খিস্তি করবে, ডাণ্ডা হাঁকাবে—
সে আমি বুঝব, তুমি ছোবড়া-মুগুর দাও–
ছোবড়া-মুগুর এগিয়ে দেওয়ার কথা ভুলে যায় লখাই। বার বার তার মনে হতে লাগল, বিবিবাজারের মোতির সঙ্গে বর্মা মুলুকের লা ডিনের কোথায় যেন একটা নিবিড় মিল রয়েছে। সাজিয়ে গুছিয়ে ভাবার শিক্ষা কোনোকালে পায় নি লখাই। তার অস্থির, উন্মুখ মনে ছাড়া ছাড়া ভাবে যে ভাবনাটা চলছে তা গুজিয়ে নিলে বুঝি এমনই দাঁড়ায়। বঙ্গে পিসাগরের দুস্তর ব্যবধান ঘুচিয়ে বিবিবাজারের মোতি আর বর্মী লা ডিন যে কেমন করে একাকার হয়ে যায়, সমস্ত বিচারবুদ্ধি দিয়ে সেটুকু কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না লখাই।
একসময় মুগুর আর ছোবড়া লা ডিনের সেলে ঢুকিয়ে দিল লখাই।
লা ডিন বলল, তোমার বুখার, তুমি শুয়ে আরাম কর। যাও, আপন কুঠুরিতে যাও।
না।
গরাদের ওপর মাথাটা রেখে নির্জীবের মতো পড়ে রইল লখাই।
এইদ্বীপে শীতের আয়ু ফুরিয়ে আসছে। সকালের দিকে সমুদ্র ছুঁড়ে যে হিমাক্ত জলো বাতাস উঠে আসে, বেলা চড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই বাতাস থেকে হিম আর জলীয় ভাবটা মুছে যায়। তীক্ষ্ণ, প্রখর রোদে সিসোস্ট্রেস উপসাগরটা জ্বলতে থাকে। টিলাগুলি নারকেল গাছে ছয়লাপ, ঝড় এসে সেখানে অবিরাম মাথা কোটে। ভোরের সিন্ধুসারসগুলোকে এখন আর দেখা যায় না। একদ্বীপ থেকে তারা অন্য দ্বীপে উধাও হয়ে যায়।
শীতশেষের এই দিনটিতে সেলুলার জেলের মাথায় ধারাল রোদ এসে পড়েছে। বেলা চড়ছে।
দীর্ঘ বারান্দায় কয়েদিরা নারকেলের ছোবড়া ছিলছিল, কেউ যাঁতায় গম পিষছিল। তুখোড় হারামী যারা, তাদের রম্বাস হেঁচতে দেওয়া হয়েছে। হাতের কাজ গুটিয়ে রেখে তাজ্জব হয়ে তারা লা ডিনের কাজ দেখছিল। সবাই ভাবছিল, নয়া কয়েদিটা বড় আজব আদমী বটে! পরের জন্য যে কয়েদি ছোবড়া ছিলে দেয়, তার মতো অদ্ভুত এবং মুরুখ প্রাণী এই দ্বীপে আর একটাও আছে কিনা, তারা ভেবে উঠতে পারছিল না।
নসিমুল গণি ফল আর রুটি দিয়ে গিয়েছে। দুচার টুকরো রুটি ছাড়া কিছুই খায় নি লা ডিন।
হঠাৎ লা ডিন গরাদের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে ভিখন আহীরকে ডাকল, এদিকে এস ভেইয়া–
গুটি গুটি পায়ে লা ডিনের সেলের কাছে এসে কোমর বাঁকিয়ে দাঁড়াল ভিখন আহীর। বলল, আমাকে কুছু বলছ?
হাঁ–
বর্মী লা ডিন অল্প হাসল। বলল, তোমার নাম কী?
ভিখন আহীর।
হঠাৎ ভিখনের মুখচোখের ভাব করুণ হয়ে উঠল। লখাইর দিকে একটা মাত্র চোখে একবার তাকিয়ে ফিসফিস করে সে বলল, এতকাল ভিখন আহীরই ছিলাম। দুরোজ হল স্রেফ পেটের ভুখের জন্য আমি ইসলামী বনেছি। জাত দিয়েছি। এখন আমার নাম শরীয়তুল্লা। তুমি আমাকে ভিখন বলেই ডেকো।
লা ডিন বলল, তোমার বড় ভুখ, না?
হাঁ, ভুখটা আমার বড় দুশমন।
এক রোজ তুমি এই গরাদের কাছ থেকে দুটো রুটি নিয়েছিলে ভিখন?
ভিখন হতবাক তাকিয়ে রইল। পুরো তিনটে দিন লা ডিন পেছনের ফোকরটার দিকে তাকিয়ে বসে ছিল। সামনের গরাদের কাছ থেকে দুটো রুটি ভিখন হাতসাফাই করে সরিয়েছিল। তা টের পেয়েছে লোকটা।
ভিখন ভাবে, লা ডিন কি ভেলকি জানে? তার কদাকার পোড়া মুখটা হাঁ হয়ে রইল। সেই হায়ের মধ্যে দিয়ে আধফোঁটা একটা শব্দ বেরুল শুধু।
লা ডিন বলল, তোমার বড় ভুখ, এই নাও রুটি আর ফল। খা লেও। একটু থেমে আবার শুরু করে, রোজ তোমাকে আমার খানা থেকে রুটি দেব।
সচ?
হ হাঁ, সচ—
রুটি এবং ফল নিয়ে ভিখন চলে গেল।
ভিখন চলে যেতেই মোপলা কয়েদি বকরুদ্দিনকে ডাকল লা ডিন। বলল, তুমি বড় তামাশাবালা। কুত্তার ডাক ঠিক ঠিক ডাকতে পার। বিল্লির ডাক ডাকতে পার?
বকরুদ্দিন অবাক হয়ে গেল। যে কয়েদি তিন দিনে একবারও পেছন ফেরে নি, সে কেমন করে সব টের পায়!
লা ডিন আবার বলল, তামাশা আমার খুব ভাল লাগে। তুমি যত পার আমার কুঠুরির সামনে কুত্তার ডাক ডেকো। এখন যাও, পেটি অফিসার এসে পড়বে।
বকরুদ্দিন একটা কথা বলারও সুযোগ পায় না। যেমন এসেছিল, ঠিক তেমনি ফিরে যায়।
এরপর আর কাউকে ডাকে না লা ডিন। লখাইর ছোবড়াগুলো ছিলে কুটে তার বার করতে থাকে।
গরাদের ওপর মাথা রেখে আচ্ছন্নের মতো পড়ে ছিল লখাই। পিনিকের ক্রিয়া চরম পর্যায়ে উঠেছে। মাথা আর খাড়া রাখা যাচ্ছে না। প্রচণ্ড নেশার মধ্যে লখাই ভাবল, যে মানুষ পরের ছোবড়া ছিলে দেয়, নিজের ফল রুটি নির্বিবাদে বিলিয়ে দেয়, সে মানুষের মনে কী আছে, কে জানে। তার মনে হল, নিজের চারপাশে বিচিত্র এক আবরণ এঁটে লা ডিন ভেতরের অনেকখানি রহস্য ঢেকে রেখেছে। সেই রহস্যটা যে কী, এই মুহূর্তে, পিনিকের এই প্রবল নেশার ঘোরের মধ্যে সঠিক বুঝি উঠতে পারছে না লখাই।
ভাবতে ভাবতে গরাদের ওপর টলে পড়ল সে। সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।
মেইনল্যাণ্ডের কয়েদখানায় যেমন মেট, কালা পাগড়ি, সেলুলার জেলে তেমনি টিণ্ডাল, পেটি অফিসার, কয়েদি জমাদার।
দক্ষিণ আন্দামানের আটালান্টা পয়েন্টের মাথায় যেমন পুরুষ কয়েদিদের সেলুলার জেল, সাউথ পয়েন্টের মাথায় তেমনই কয়েদিনীদের জন্য রেণ্ডিবারিক জেল বা সিক্সান। সেলুলার জেলে যেমন টিণ্ডাল, পেটি অফিসার, রেণ্ডিবারিক জেলে তেমনই টিণ্ডালান, পেটি অফিসারনী।
লিঙ্গগত সামান্য তফাৎটুকু ছাড়া টিণ্ডাল কি টিণ্ডালান, পেটি অফিসার কি পেটি অফিসারনী আদতে একই বস্তু। ডাণ্ডা মেরে, কিল চড় হাঁকিয়ে কয়েদির জান পয়মাল করার জন্যই এদের জন্ম। ক্রুরতা, নিষ্ঠুরতা, অমানুষিক অত্যাচার করার ঝোঁক দুনিয়ার এই সব জঘন্য ওঁচা কদর্য বস্তু দিয়ে এরা তৈরি। এদের সৃষ্টিকর্তা কালাপানির জেলে কয়েদি ঠেঙাবার জন্য একই ধাতুতে একই ছাঁচে এদের মনগুলোকে ঢালাই করে দুনিয়ায় পাঠিয়েছে।
জেলাররা কয়েদিদের ভেতর থেকেই টিণ্ডাল, পেটি অফিসার বাছাই করে নেয়। একমাত্র সেরা কয়েদি অর্থাৎ সেরা দুশমনদেরই টিণ্ডাল, পেটি অফিসার হওয়ার যোগ্যতা থাকে। কালাপানির কয়েদখানার রীতিনীতি বড়ই অদ্ভুত।
টিণ্ডাল, পেটি অফিসারদের এখানে মাসিক তলব (মাইনে) মেলে। মাস গেলে পেটি অফিসাররা পায় বার আনা, টিণ্ডালরা পাঁচ সিকা। এ ছাড়া খানা এবং পোশাক তো আছেই। সাধারণ কয়েদির তুলনায় খাবার দাবার অনেক উঁচু দরের। কুর্তা ইজেরের ওপর আড়াআড়ি রঙদার চওড়া ফিতে মেলে, মাথায় সাফা (পাগড়ি) মেলে, পেতলের চাপরাশ মেলে।
কয়েক গণ্ডা পয়সার জন্য এই সব টিণ্ডাল, পেটি অফিসাররা না পারে হেন কাজ নেই। পিটিয়ে পিটিয়ে কয়েদিকে সিধা রাখতে এদের জুড়ি নেই।
বকরুদ্দিন কয়েদখানার খানা সম্বন্ধে খারাপ কথা বলেছে, তাকে হাঁকাও চার ডাণ্ডা। গোবিনাদের মনে জেলের শিকলি কাটার বাসনা উঁকি মেরেছে, টিকটিকিতে (বেত মারার স্ট্যাণ্ড) চাপিয়ে তার পাছার ছাল উপড়ে নাও। মঙ ফো জেলার সাহেবের বিল্লী গোঁফ নিয়ে তামাশা করেছে, তিনদিন ডাণ্ডা বেড়িতে ঝুলিয়ে বুঝিয়ে দাও দুনিয়ার হাল হকিকত কেমন।
পেটি অফিসার, টিণ্ডালদের শাসনে অতি মসৃণ নিয়মে কালাপানির কয়েদখানায় জীবন দিনের পর দিন এগিয়ে চলে। মাত্র কয়েক গণ্ডা পয়সার জন্য কয়েদিদের সমস্ত অসন্তোষকে শায়েস্তা করে বশংবদ টিণ্ডাল, পেটি অফিসাররা দ্বীপান্তরের রীতিনীতি নিরঙ্কুশ এবং অব্যাহত রাখে। শিকারি কুত্তার মতো এদের আনুগত্য। নিমকহারামী এদের ধাতে নেই।
যতগুলি গুণ থাকলে টিণ্ডালান কি পেটি অফিসারনী হওয়া যায়, তার চেয়ে কিছু বেশিই আছে হাবিজার।
প্রায় চার হাত লম্বা, মাথার আধাআধি পর্যন্ত টাক, তারপর খাপচা খাপচা তামাটে চুল, গোল নোংরা দুটো চোখ, শাড়িটা জানু পর্যন্ত, লম্বা লাউয়ের মতো দুটো স্তন, অস্বাভাবিক দীর্ঘ দুই হাত–এই হল পাঠান জেনানা হাবিজার চেহারা নমুনা।
রেণ্ডিবারিক জেলে আসার পর দু’ দশ রোজ চুপচাপ রইল হাবিজা। প্রথম প্রথম সব কয়েদিই চুপচাপ থাকে। কোনো ঝামেলা বাধায় না।
পুরো চারটে দিন লাগে বঙ্গোপসাগরের কালাপানি পাড়ি দিয়ে আন্দামান পৌঁছতে। কয়েদি যত শয়তান আর বজ্জাতই হোক, চার দিন নিরবচ্ছিন্ন দরিয়া দেখতে দেখতে তার অন্তরাত্মা ছম ছম করে ওঠে। সত্যমিথ্যা আজগুবি, নানা কথা শুনে শুনে আন্দামানের কয়েদখানা সম্বন্ধে আগে থেকেই কয়েদির মনে ভয় জমে থাকে। চারটে দিন বঙ্গে পিসাগরের সাঙ্তিক চেহারা দেখে সেই ভয়টা হাজার গুণ বাড়ে। আন্দামান পৌঁছে সেই ভয়ের প্রতিক্রিয়ায় কিছুদিন কয়েদিগুলো যেন বোবা মেরে থাকে। মেইনল্যাণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে প্রথম প্রথম চুপচাপ থাক ছাড়া উপায়ই বা কি।
হাবিজাও দিনকয়েক গণ্ডগোল করল না। এই নতুন জায়গা, অচেনা কয়েদখানা, অপরিচিত সব কয়েদিনী–সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। এখানকার হালচাল, জমানা, কেতা, সমস্ত কিছু বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করল।
এমন করেই দশটা রোজ পার করে দিল হাবিজা। তারপর একটু একটু করে অন্য কয়েদিনীদের নিজের মহিমা বোঝাতে শুরু করল।
একদিন কয়েদিনীরা কাতার দিয়ে খেতে বসেছিল। টিণ্ডালান আর পেটি অফিসারনীরা খানা দিচ্ছিল।
হাবিজার ঠিক পাশেই বসেছিল প্রেমা। গোলগাল, বেঁটে আকৃতির মাংসল এক কয়েদিনী। প্রেমার বর্তনে খানা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাবিজা ছোঁ মারল।
চেরা, তীক্ষ্ণ গলায় প্রেমা চেঁচিয়ে উঠল, শালী খানা লে লিয়া, হামারা জান লে লিয়া–
তৎক্ষণাৎ দুই থাবায় প্রেমার খানা আত্মসাৎ করে ফেলে হাবিজা। বেঁটে বেঁটে হাত বাড়িয়ে হাবিজার মুখ থেকে চাপাটি টাপাটি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে আর সমানে চিল্লাচ্ছে প্রেমা, শালী হারামী, ঢেঙী খচরী, আমার খানা গিলে ফেলল।
অস্বাভাবিক লম্বা একটা হাতে প্রেমাকে অনেকটা দূরে ঠেলে সরিয়ে রেখেছে হাবিজা। প্রেমার বেঁটে হাত তার মুখ পর্যন্ত পৌঁছয় না।
অনেকটা খাদ্য একসঙ্গে মুখে পুরে ফেলেছিল হাবিজা। সেগুলো গিলতে গিলতে চোখদুটো ঠেলে বেরিয়ে পড়েছিল। অচর্বিত খাদ্যের পিণ্ড কি সহজে গেলা যায়? গলনালী দিয়ে প্রবল শক্তিতে সেগুলোকে পাকস্থলীর দিকে পাঠাতে পাঠাতে জানটা বেরিয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে হাবিজার। গলার শিরাগুলো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ফুলে উঠেছে।
প্রেমা যখন দেখল খানা ফেরত পাওয়ার আর ভরসা নেই, তখন মারমুখী হয়ে উঠল। লোহার বর্তনটা তুলে হাবিজার মাথা বরাবর ছুঁড়ে মারল। একান্ত অবলীলায় এক হাতে বর্তনটা লুফে নিল হাবিজা।
প্রেমা সমানে চিল্লাচ্ছে, কাঁদছে আর খিস্তি করছে, কুত্তীর বাচ্চা, খচরীর বাচ্চার জান নেব। পেট ফাঁসিয়ে আমার খানা বার করব।
প্রেমা ফুঁসছিল। দুই চোখ থেকে আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে তার। খিস্তির তোড়ে সে হাবিজার চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার করে ফেলছে, আর বেঁটে বেঁটে দুই হাতে সমানে কিল-চড় হাঁকিয়ে যাচ্ছে।
এতক্ষণ মুখ এবং একটা হাত আটকে ছিল। অন্য হাতে প্রেমার আক্রমণ ঠেকিয়ে যাচ্ছিল হাবিজা। খানা গিলে এবার সুবিধা হল। মুখ এবং দুই হাত কাজে লাগানো গেল। প্রেমার দিক থেকে যে পরিমাণ খিস্তি আসছে, হাবিজার মুখ থেকে তার বিশগুণ ফেরত যেতে লাগল। হাতে লোহার কাঙনা (বালা) ছিল। সেটা দিয়ে প্রেমার চোয়াল বরাবর প্রচণ্ড এক ঘা বসিয়ে দেয় হাবিজা। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে। পাক খেয়ে ঘুরে পড়ে প্রেমা। গোঙাতে থাকে, এ পেটি অফিসারনী, এ টিণ্ডালান, আমাকে মেরে ফেলল, মেরে ফেলল।
পেটি অফিসারনী এবং টিণ্ডালানরা ছুটে এসেছিল। হাবিজাও উঠে দাঁড়িয়েছে, তার চোখজোড়া ধিকি ধিকি জ্বলছিল।
এক দিকে হাবিজা একা, অপর দিকে রেণ্ডিবারিক কয়েদখানার সমস্ত টিণ্ডালান আর পেটি অফিসারনী। প্রথমে দুই পক্ষের মধ্যে কিছুটা অশ্রাব্য খিস্তির আদান-প্রদান হয়ে যায়।
পেটি অফিসারনীরা হাবিজার ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার তাল করছিল। হঠাৎ তাদের চোখে পড়ে, কাঠের একটা বড় টুকরো বাগিয়ে হিংস্র চোখে তাকিয়ে রয়েছে হাবিজা। এগুতে এগুতে পেটি অফিসারনীরা থমকে যায়। ভাবে, হাবিজাকে ছিঁড়ে ফালা ফালা করে ফেলে। ভাবলই শুধু, কিন্তু কাজটা আদপেই এত সহজ নয়। চার হাত লম্বা তাদের এই নতুন প্রত্মিঙ্গিনী বড়ই মারাত্মক।
মারামারিটা আর হল না। কিন্তু দুই তরফে আর এক প্রস্থ অশ্লীল গালাগালির দেয়া-নেয়া হয়ে গেল।
বিকেলে কয়েদিনীদের কাজকর্ম চুকে যাওয়ার পর হাবিজাকে ধরল সোনিয়া। বলল, তোর সাথ আমার বাতচিত আছে।
কী বাত?
চল বলছি।
দুজনে একটা টিলার মাথায় নারকেল গাছের ছায়ায় এসে বসল।
হাবিজার সঙ্গে সোনিয়ার অনেক কালের জান পয়চান। মেইনল্যান্ডের কয়েদখানায় পাক্কা দুটো বছর তারা একসঙ্গে কাটিয়েছে। একই সঙ্গে তারা কালাপানি এসেছে। দুজনেই দুজনের জিন্দেগীর তাবত খবর রাখে, স্বভাবের কথা জানে, সুখ-দুঃখের হদিস রাখে। অনেকদিন কয়েদখানায় একসঙ্গে কাটিয়ে পাঠান হাবিজা আর বিহারী সোনিয়ার মধ্যে একটা বিচিত্র বন্ধন গড়ে উঠেছে। কয়েদখানার সঙ্গিনীদের মধ্যে যে মহবৃতি, তার রীতিই আলাদা।
সোনিয়া বলল, প্রেমার খানা নিলি কেন?
উদাসীন মুখে হাবিজা বলল, এমনি।
এমনি না, আসল কথাটা বল। তুই তো বেশি খাস না।
হাবিজা এবারও এড়িয়ে গেল। বলল, ইচ্ছে হল, তাই নিলাম।
না। কিছুক্ষণ একদৃষ্টে হাবিজার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সোনিয়া। তার অজস্র রেখায় বোঝাই লম্বাটা মুখটা থেকে গূঢ় কোনো কারসাজি বার করার চেষ্টা করল। তারপর বলল, তোর সাথ তো আমার দু দশ রোজের জানাশোনা না, তোকে আমি চিনি। বল, কেন প্রেমার খানা নিলি?
চুপচাপ কী যেন ভাবতে লাগল হাবিজা।
এখন বিকেল। সমুদ্র ছুঁড়ে হিমেল বাতাস উঠে আসছে। সেই বাতাস সোনিয়া আর হাবিজার মুখে ক্রমাগত ঘা মেরে চলেছে। নরম রোদে অন্যমনস্ক হাবিজার কদাকার মুখ বড় রহস্যময় ঠেকে।
সোনিয়া বলল, কি রে, কথা বলছিস না কেন?
এক-একটা সময় মানুষকে যেন জাদু করে। যে-পাঠান আওরত হাবিজা খেঁকিয়ে ছাড়া কথা বলে না, এখন তার স্বরটা আশ্চর্য নরম শোনায়, বুঝলি সোনিয়া, আমি পেটি অফিসারনী বনতে চাই।
পেটি অফিসারনী বনবি, সে তো ভাল কথা। লেকিন প্রেমার খানা নিলি কেন? কাঙনা (বালা) দিয়ে ওর শির ছেঁচলি কেন?
হাবিজা হাসল। বলল, দ্যাখ ছোঁকরি, তোর বয়েস কম, মাথায় এক ছটাক বুদ্ধিও নেই। থোড়া বুদ্ধি থাকলে বুঝতি, অ্যায়সা অ্যায়সা পেটি অফিসারনী হওয়া যায় না। দস্তুরমতো এলেম দেখাতে হয়। পিটিয়ে পিটিয়ে কয়েদিনীর জান চৌপট করতে না পারলে কি পেটি অফিসারনী হওয়া যায়?
প্রেমার চোয়াল ফাটিয়ে বুঝি এলেম দেখালি?
হাবিজা হাসতে লাগল।
সোনিয়া ফের বলল, টিণ্ডালান, পেটি অফিসারনীরা তোর ওপর খেপে আছে। তোর জান নেবে বলছে। তুই ওদের কাছে মাফি মেঙে নে।
তাচ্ছিল্যে কালো ঠোঁট দুটো বেঁকে গেল হাবিজার। ভেংচে ভেংচে বলতে লাগল, কুত্তীদের বাত ছোড়। আমার জান নেবে! বহুত দেখেছি অমন। তুই তো জানিস, জোড়া খুন করে কালাপানি এসেছি। জান দেবার আগে দু দশটা জান জরুর নেব, হাঁ। কথাটা ইয়াদ রাখিস সোনিয়া। বলতে বলতে হাবিজা উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
এরপর খানিকটা সময় নীরবে কাটে। রোদের রং মরে আসে।
হঠাৎ সোনিয়া বলে, পেটি অফিসারনী হয়ে কী হবে?
তলব (মাইনে) মিলবে, পয়সা পাব।
কয়েদখানায় পয়সা দিয়ে কী করবি? খরচা তো আর করতে পারবি না।
এক মুহূর্ত কী চিন্তা করে হাবিজা। তারপর বলে, সোনিয়া, তোকে আমার কথা সব বলেছি। একটু থেমে, আবার শুরু করে, মনে আছে কি, মুল্লুকে আমার আদমীটা রয়েছে। একটা পা তার কাটা, জিন্দেগীটা তার বেকার হয়ে গেছে। ভিখ মেঙে সে খায়।
বলতে বলতে গলা ধরে আসে হাবিজার। কুৎসিত মুখটা বড় করুণ দেখায়। আশ্চর্য! হাবিজা কাঁদে না। চোখ তার কোনোকালেই ভেজে না, চিরদিন শুকনোই থাকে।
এ-সব কথা সোনিয়া আগেই শুনেছে।
হাবিজার আদমীর নাম বকাউল্লা। কুঁচকি পর্যন্ত বকাউল্লার একটা পা কাটা! আদমীটার শরীরে অফুরন্ত শক্তি, কিন্তু সেই শক্তি প্রয়োগ করার উপায় নেই। একটা পা বাতিল হয়ে যাওয়ার পর তার জীবন বরবাদ হয়ে গিয়েছে। ভিখ মাঙা ছাড়া তার গতি কি?
যতদিন কয়েদখানার বাইরে ছিল, বকাউল্লার খানা, আশ্রয়–সমস্তই জুগিয়েছে হাবিজা। কিন্তু এখন যে আদমীটার কী অবস্থা, কে জানে। আন্দামানে আসার আগে খবর পেয়েছিল, বকাউল্লা লাহোর শহরে ভিখ মেঙে পেট চালাচ্ছে।
হাবিজার চার হাত লম্বা বেটপ দেহটা কাঁপিয়ে বড় রকমের একটা শ্বাস পড়ল। আস্তে আস্তে সে বলল, আদমীটা যে কী করছে, খুদা জানে।
সোনিয়া কিছু বলল না।
হাবিজা বলল, বেঁচে আছে না মরে গিয়েছে, কে বলবে। কত রোজ যে আদমীটার খবর পাই না!
কুৎসিত হাবিজাকে এই মুহূর্তে তত খারাপ দেখায় না। অদ্ভুত এক কষ্টে তার চোখ দুটো ফেটে যেন রক্ত ছুটবে। কথা বলতে বলতে বার বার তার গলা ধরে আসে।
সোনিয়া সান্ত্বনা দেয়, মরবে কেন, বেঁচেই আছে।
বঙ্গোপসাগরের এইদ্বীপ কী বিচিত্র! মেইনল্যান্ডের কয়েদখানায় মাঝে মাঝে বকাউল্লার কথাই বলত হাবিজা। সে-কথায় মমতার তাপ ছিল না। কিন্তু কালাপানির এই কয়েদখানার সেই আদমীটার জন্যই তার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে পড়তে চায়। বিরাট দেহের মধ্যে লুকননা হাবিজার নারী হৃদয় অসহ্য বেদনায় টনটন কয়ে ওঠে।
এই দ্বীপ কয়েদিকে হৃদয়হীন বানায়। আবার বুঝি কখনো কখনো কয়েদির দিলে মমতারও জন্ম দেয়।
হাবিজা বলল, পেটি অফিসারনী আমার বনতেই হবে। তলব (মাইনে) যা পাব, আদমীটাকে পাঠিয়ে দেব। কত কষ্ট যে করছে আদমীটা! একটা পা নেই–
শুনতে শুনতে বুকের ভেতরটা হু-হু–করে ওঠে সোনিয়ার। কেন জানি সেই মরদটার কথা তার মনে পড়ে যায়। সেই রামদেও তিওয়ারী–যাকে পুরোপুরি ভুলে যাওয়ার জন্য জেদ ধরে সে আন্দামানে এসেছে। আশ্চর্য! সেই মানুষটার কথাই এই মুহূর্তে চোখের সামনে ফুটে ওঠে। নাঃ, রামদেও তিওয়ারীর ভাবনা থেকে কোনোদিন নিস্তার মিলবে না। মরদটা সোনিয়ার হাতে মরেছে, আবার তারই কথা ভাবিয়ে ভাবিয়ে সোনিয়াকে একটু একটু করে মারবে। বেদরদি শয়তান!
হাবিজা এবার বলল, চোদ্দ বছরের সাজা খাটতে কালাপানি এসেছি। এই কটা রোজ পার হলেই মুল্লুকে ফিরব। আদমীটাকে নিয়ে আবার ঘর করব।
সোনিয়ার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। চোদ্দ বছর পর তারও সাজার মেয়াদ শেষ হবে। হাবিজার ভবিষ্যৎ আছে, দিলে ভবিষ্যতের স্বপ্ন আছে। সাজা ফুরোলে হাবিজা বকাউল্লাকে নিয়ে নতুন করে সংসার পাতবে। কিন্তু সোনিয়ার কী আছে? তার অতীত এক দুর্বহ যন্ত্রণা, বর্তমান অসহ্য এক জ্বালা, আর ভবিষ্যৎ তো অফুরন্ত অন্ধকার। এত বড় দুনিয়ায় হাবিজার মতো তার এমন একটা মানুষ নেই, যার কথা ভেবে ভেবে চোদ্দটা বছর নিমেষে পার করে দেওয়া যায়। মেয়াদ ফুরোলে যাকে নিয়ে সে নতুন করে জীবনের স্বাদ পেতে পারত, তাকে তো নিজের হাতেই শেষ করে এসেছে সোনিয়া। চোদ্দ বছরের ওপারে হাত বাড়িয়ে ধরবার মতো কিছুই নেই তার। তখন সব কিছুই ধু ধু, শূন্য, দুঃসহ।
বুক ফালা ফালা করে, গলা ফাটিয়ে, আকণ্ঠ এক চিৎকার কুণ্ডলী পাকাতে পাকাতে উঠে আসতে চাইছে। আন্দামানের এই নিদারুণ কয়েদখানায় ভবিষ্যৎ জীবনের চেহারাটা আন্দাজ করে শিউরে উঠল সোনিয়া।