Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সিন্ধুপারের পাখি || Prafulla Roy » Page 4

সিন্ধুপারের পাখি || Prafulla Roy

সিসোন্ট্রোস বে’র এক কোণে আটলান্টা পয়েন্টের মাথায় আট শ’ কুঠুরির সেলুলার জেল। ওটা পুরুষদের কয়েকখানা। সিসোস্ট্রেস উপসাগর যেখানে ঘোড়ার খুরের আকারে বেঁকে সমুদ্রে মিশেছে, সেই সাউথ পয়েন্টের মাথায় কয়েদিনীদের গারখানা, অর্থাৎ সাউথ পয়েন্ট জেল। আন্দামানের পুরুষ কয়েদিরা সাউথ পয়েন্ট জেলটাকে বলে, ‘রেণ্ডিবারিক’ জেল। কেউ কেউ বলে ‘সিক্সান’।

আন্দামানে আসার পর কয়েকটা দিন পার হয়ে গেল।

সাউথ পয়েন্ট কয়েদখানার এক কিনারে মাঝারি একটি টিলার মাথায় বসে ছিল সোনিয়া। উপসাগরের নীল জলে বিরাট বিরাট ঢেউগুলি কেমন উথালপাতাল হয়ে অদ্ভুত আক্রোশে দ্বীপের দিকে ছুটে আসছে, তাই দেখছিল একদৃষ্টে। চোখের পাতা পড়ছিল না তার।

এখন বিকেল। আকাশের এ-মাথায় ও-মাথায় দু-চার টুকরো হানাদার মেঘ কোন দিকে যে দিশাহীন পাড়ি জমিয়েছে, কে বলবে। সিন্ধুশকুনগুলো ছোট ডানায় বিরাট আকাশ মাপতে মাপতে দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে চলেছে।

সোনিয়া দরিয়ার দিকে তাকিয়ে ছিল আর ভাবছিল। আন্দামানে আসার পর মাত্র কয়েকটা দিন পার হয়েছে। এরপর একটা একটা করে কত দিন যাবে, দিনের পর দিন পেরিয়ে একটু একটু করে তার উমর (বয়স) বাড়বে। একদিন সে বুড়ি হয়ে যাবে। জিন্দেগি কালাপানির এই দ্বীপেই ফৌত হয়ে যাবে। ভাবতে ভাবতে তার বুক তোলপাড় করে বড় বড় শ্বাস পড়ছিল।

একসময় দরিয়ায় রোদের তেজ মরে আসে। সামনের রদ্বীপটা আবছা দেখায়।

সোনিয়া ভাবছিল। অনেক, অনেকদিন পর সাউথ পয়েন্ট কয়েদখানার এই টিলাটায় বসে সেই মরদটার কথা মনে পড়ছে। মরদটার নামও হুবহু মনে আছে। রামদেও তিওয়ারী। আদমিটার চেহারা নমুনাও অবকি মনে পড়ে। ছোট ছোট গোল চোখ, মাংসল গর্দান, শক্ত চোয়াল, মজবুত চওড়া বুক গলায় পেতলের মস্ত তাবিজ, কানে চাকার মতো দুই মাকড়ি। আদমিটা বিশ-বিশটা ভঁইস চরাত, লোটা লোটা সিদ্ধি ঘুটত, ঢকঢক করে সেগুলো গিলত, পড়ে পড়ে ভোঁসভোঁস ঘুমতো। মেজাজটা বেয়াড়া হয়ে গেলে সারা রাত্রি বদখত কর্কশ গলায় গাইত–

সৈয়া গ্যয়া ধনিয়াকা সাথ,
হাম ক্যা করু,
হাম ক্যা করু—

বহুত বড় শহর পাটনা থেকে গানটা শিখে এসেছিল রামদেও তিওয়ারী।

তামাম রাত চিল্লাচিল্লি করে হয়রান হয়ে ভোরের দিকে রশির খাঁটিয়ায় টান টান শুয়ে পড়ত মরদটা। সঙ্গে সঙ্গে নাক ডেকে উঠত।

আদমিটা কথা বলত কম। শুধু গোল গোল চোখ দুটোতে হিংস্র, ভীষণ দৃষ্টি ফুটিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকত। তার নজর হাড্ডি মাংস কুঁড়ে কুঁড়ে সোনিয়ার দিলের গোপন কারসাজিটা যেন খুঁজে বেড়াত। ভয়ে বুকের খুন জমে আসত সোনিয়ার। সেই চোখের হিংস্রতা সহ্য করার মতো শক্তি তার বুকে ছিল না।

মাঝে মাঝে রামদেও তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে অদ্ভুতভারে হেসে উঠত। হাসির রকম দেখে সোনিয়ার অন্তরাত্মা কেঁপে যেত।

রামদেও তিওয়ারীর কথা ভাবতে ভাবতে আর একটা আদমির কথা মনে পড়ে। সে ব্রিজলাল। দুটো মরদের ভাবনায় মন যত কাবু হয় সোনিয়ার, চোখের ঈষৎ কপিশ তারা দুটো ততই ঝিকঝিক করে জ্বলে। সোনিয়ার চোখ গত দুবছরে একবার ছাড়া আর ভেজে নি। তার চোখে কেউ আঁশ দেখে নি।

চোখের সামনে থেকে আন্দামানের দরিয়া, দূরের রদ্বীপ, আরো দূরের হ্যাভলকদ্বীপ, আটলান্টা পয়েন্টের মাথায় সেলুলার জেল–সব যেন মুছে গিয়েছে। জ্বালা-ধরা, পোড় খাওয়া, খাক-হওয়া কঁকা দিলটার মধ্যে অদ্ভুত এক ককানি পাক খেয়ে খেয়ে ভেঙে পড়ছে। তবু আঁখ ফেটে আঁশু বেরুচ্ছে না। অদম্য, আকণ্ঠ, অসহ্য এক যন্ত্রণা বুকটা ফাটিয়ে চুরমার করে দিচ্ছে। সোনিয়া ভাবল, একটু যদি কাঁদতেও পারত, দিল তার জুড়তো। এর আগে মুল্লুকের কয়েদখানায় দুবছর ছিল সোনিয়া। কোনোদিন তো রামদেওয়ের কথা ভেবে মন এমন বেসামাল হয়নি। বিপুল দরিয়া পেরিয়েদ্বীপান্তরে এসে মন এমন বিগড়োয় কেন? যে মানুষের কথা মুল্লুকে থাকতে একবারও ভাবেনি, তার ভাবনা কালা পানি পার হয়ে এত দূর এসে তার বুকের ভেতরটা এমন তোলপাড় করে কেন? নিজের কাছেই এ-সব প্রশ্নের জবাব মেলে না।

দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকে সোনিয়া। রামদেও তিওয়ারীর মনে এমন বদ মতলব ছিল, তা কি সে জানত? বেতমিজটা তার হাতে জান দিয়ে তার পাপেরই সাজা এমন করে দিচ্ছে! আধফোঁটা স্বরে সোনিয়া বলে, বেদরদি শয়তান, মরেও আমার জিন্দেগি একটু একটু করে খতম করে মজা লুটছে।

উপসাগরের বিরাট বিরাট ঢেউগুলি আকারে আরো বড় হতে থাকে। দরিয়ার গর্জন বাড়ে, আক্রোশ বাড়ে।দ্বীপের পাথুরে দেওয়ালে সমুদ্রের অবিরাম, উদ্দাম মাথা কোটাকুটি চলে।

আকাশের কোথাও এখন আর সূর্যটাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

এ সোনিয়া–

পেছন থেকে কে যেন ডাকল। সোনিয়া মুখ ফিরিয়েই চমকে উঠল। টিণ্ডালান রামপিয়ারী দাঁড়িয়ে আছে। আবছা আলোতে রামপিয়ারীকে দেখে চমকে ওঠারই কথা। বাঁ দিকের কান আর চোয়ালের খানিকটা অংশ পুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কেউ কেটে নিয়েছে। কান পর্যন্ত দাঁতগুলো বেরিয়ে আছে। পুরনো আমলের কয়েদিনীরা জানে, হাল আমলের কয়েদিনীরাও শুনেছে, দিল্লির ওদিকে কোথায় যেন রামপিয়ারীর ভারী ডাকাতের দল ছিল। কোন এক শহরে রাহাজানি করতে গিয়ে বাঁ কান আর চোয়ালের খানিকটা খোয়াতে হয়েছে। যে-বাড়িতে লুটপাট করতে হানা দিয়েছিল তাদের দারোয়ান ধারাল দায়ের কোপে কান আর চোয়ালের মাংস কেটে নিয়েছিল। মাংস শুকিয়ে তুবড়ে তুবড়ে ঝুলছে। চোখের পাতাও কেটে নিয়েছিল। তাই চোখদুটো খোলা, পাতাও পড়ে না। এ গল্প সোনিয়াও শুনেছে।

শেষ বেলার আবছা আলোতে রামপিয়ারীকে দেখে সোনিয়া চমকেই ওঠেনি, ভীষণ ভয়ও পেয়ে যায়।

রামপিয়ারী বাজখাই গলায় আবার ডাকল, এ সোনিয়া—

হাঁ–

তাঁতের কাজ হয়ে গেছে?

হাঁ–

রামপিয়ারী খেঁকিয়ে উঠল, সচ বলছিস?

জরুর।

টিণ্ডালান রামপিয়ারীর দাপটে রেণ্ডিবারিক কয়েদখানার কয়েদিনীরা সদাই তটস্থ। কোন কয়েদিনী তাঁত বুনল না, কোন কয়েদিনী কুর্তা সেলাই করল না, কে কোপরার জন্য নারকেল কাটল না, কার কাজে গাফিলতি হয়েছে–সব, সব কিছু পাতাহীন চোখে ঠিক ঠিক দেখে ফেলে রামপিয়ারী। তারপর কেমন করে কঁকিবাজ কয়েদিনীদের চুলের মুঠি উপড়ে ফেলতে হয়, চট পরিয়ে রেখে তাদের তিন রোজ খানা বন্ধ করে দিতে হয়, ধারাল নখে চামড়া উপড়ে নিতে হয়, সে-সব অমোঘ কায়দা তার জানা।

রামপিয়ারীকে দেখে সোনিয়ার বুকে কাঁপুনি ধরেছিল। সেই কাঁপুনি বেড়েই চলেছে।

খানিকটা সময় কাটে।

সোনিয়া দরিয়ার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। আর পাতাহীন লম্বাটে চোখে একদৃষ্টে তাকে দেখতে থাকে রামপিয়ারী।

এবার বড় নরম গলায় রামপিয়ারী ডাকল, সোনিয়া—

হাঁ–

তুই বহোত খুবসুরতী, বহোত বহোত সুন্দর।

সোনিয়ার পাশে ঘন হয়ে বসল রামপিয়ারী। বাঁ হাতটা দিয়ে তার চিকন সুঠাম মাজা পেঁচিয়ে ধরল। পাতাহীন চোখে তারা দুটো ঝিকঝিক করছে। সোনিয়ার মাজায় রামপিয়ারীর হাতটা আরো চেপে বসছে। কানের কাছে মুখ ঠেকিয়ে খুব আস্তে, গাঢ় স্বরে রামপিয়ারী বলল, তুর উমর (বয়স) কত?

উপসাগর কুঁড়ে সামুদ্রিক বাতাস সাঁই সাঁই ছুটে আসে। নারকেল বনে এলোপাতাড়ি আছাড় খায়।

অস্পষ্ট আলোতে রামপিয়ারীর চোখের দিকে তাকিয়ে অজানা, দুর্বোধ্য এক ত্রাসে বুকের ভেতরটা শিরশির করে সোনিয়ার।

রামপিয়ারী কালো কালো দাঁতগুলো মেলে নিঃশব্দে হাসে। তার চোখের তারায় কী যেন ঘন হতে থাকে। মোলায়েম স্বারে সে বলে, কি রে সোনিয়া, বাতচিত করছিস না কেন? উমর কত তোর?

ভয়ে ভয়ে সোনিয়া বলে, তেইশ সাল—

তুই বতোত খুবসুরতী।

কথাটা আগেও একবার বলেছে রামপিয়ারী।

সোনিয়া জবাব দেয় না। আড়ষ্ট হয়ে বসে থাকে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ।

হঠাৎ রামপিয়ারী সোনিয়ার মাজা থেকে হাতের পাঁচ খুলে ফেলে। বলে, আমার দিকে তাকা সোনিয়া–বলতে বলতে একটা বেশরম কাজ করে ফেলে রামপিয়ারী। বুকের কুর্তাটা ঢিলা করে খুলে ফেলে। তারপর হি হি করে টেনে টেনে খুব একচোট হাসে। বলে, দ্যাখ, দ্যাখ–দিল ভরে দ্যাখ–

চোখের পাতা নড়ছে না সোনিয়ার। তাজ্জব হয়ে সে রামপিয়ারীর বুক দেখছে। বিরাট, মাংসল রামপিয়ারীর বুক একেবারে শুকনো। ছোট ছোট টিলা স্তনে আর স্তনের ওপরের চওড়া সমতল অংশে রাশি রাশি উল্কি আঁকা রয়েছে।

উল্কিগুলি দেখতে দেখতে সোনিয়া শিউরে উঠল। মানুষ-মানুষীর জৈব প্রবৃত্তির, আদিম কামের বীভৎস সব চিত্র রামপিয়ারীর বুকময় ছড়িয়ে আছে।

যে সোনিয়া কোতল করে সারা জীবনের দীপান্তরী সাজা নিয়ে কালাপানি আসতে ডরায়নি, এই মুহূর্তে অপরিসীম আতঙ্কে সে চোখ বুজে ফেলল।

একটু পর চোখ মেলে সোনিয়া দেখল, এক জোড়া পাতাহীন চোখ তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। চোখাচোখি হতেই ঠিক আগের মতো টেনে টেনে হাসল রামপিয়ারী। লোলুপ গলায় বলল, দেখলি?

সোনিয়া জবাব দিল না।

রামপিয়ারী বলল, দুনিয়ার সব সুখ, সব মজার ছবি আমার বুকে আঁকিয়ে রেখেছি।

সোনিয়া এবারও কিছু বলল না।

রামপিয়ারী ফের শুরু করল, আমার বুকে এই ছবি কেন আঁকিয়ে রেখেছি, জানিস?

না। সোনিয়া মাথা নাড়ে।

একটুক্ষণ কী ভাবে রামপিয়ারী, সে-ই জানে। উত্তর দিতে গিয়ে হঠাৎ সে মত বদলায়, আজ থাক, আরেক দিন বলব।

ওদিকে হালকা, কালচে একটা পর্দার মতো অন্ধকার নেমেছে। একটু একটু করে সেই পর্দাটা গাঢ় হয়ে সমস্ত দরিয়াটাকে ঢেকে ফেলল। এখন উপসাগর, রদ্বীপ, কিছুই দেখা যায় না।

রামপিয়ারী বা সোনিয়া, কেউ কথা বলছিল না। একসময় বুকের ওপর কুর্তাটা তুলতে তুলতে রামপিয়ারীই শুরু করল, তোকে আমি বড় পেয়ার করি সোনিয়া। পয়লা যেদিন তুই এই রেণ্ডিবারিক-এ এলি সেদিন তোকে দেখেই আমার দিল মজেছে। একটা কথা সবসময় মনে রাখিস, আওরতে আওরতে যে পেয়ার, সে পেয়ার বড় খাঁটি চিজ।

সোনিয়া হাঁ না, কিছুই বলে না।

অন্ধকারের চেহারা দেখে হঠাৎ হুঁশ ফেরে রামপিয়ারীর। ঝট করে কুর্তাটা বুকে চড়িয়েই তাড়া লাগায়, ওঠ, ওঠ সোনিয়া। কয়েদানী গোনার সময় হয়েছে।

দুজনে উঠে পড়ে।

সকাল বিকেল দুবার কয়েদিনী গোনার নিয়ম। কয়েদিনী গুনতির পর খানাপিনার পালা। সপ্তাহে দু’দিন কয়েদিনীদের মাছ মেলে। আজ মাছের দিন।

লোহার বর্তন নিয়ে কয়েদিনীরা কাতার দিয়ে বসেছে। টিণ্ডালান, পেটি অফিসারনী আর জমাদারনীরা বড় বড় হাতায় করে থালায় থালায় ভাত দিয়ে চলেছে।

টিণ্ডালান রামপিয়ারী সোনিয়ার কাছাকাছি এসে শরীরটা বাঁকিয়ে ঝুঁকে পড়ল। তার থালায় তিন টুকরো মাছ দিয়ে ফিসফিস করে বলল, মনে রখিস সোনিয়া, আমি তোকে কত পেয়ার করি। এক টুকরোর জায়গায় তিন টুকরো মাছ দিলাম।

রামপিয়ারী পাশের কয়েদিনীর দিকে এগিয়ে গেল।

রামপিয়ারীর পেছন পেছন আসছিল পেটি অফিসারনী। নাম এতোয়ারী। সেও খানা দিচ্ছিল।

সোনিয়ার থালায় দু’হাতা ভাত দিয়ে ফিসফিসিয়ে এতোয়ারী বলল, হোঁশিয়ার সোনিয়া।

হকচকিয়ে সোনিয়া বলল, কেন?

খাটো খাটো করে ছাঁটা চুল, থ্যাবড়া নাক, চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে আসছে, দুগালের মাঝামাঝি পর্যন্ত মস্ত হাঁ–এই হল পাঠান পেটি অফিসারনী এতোয়ারীর চেহারা।

চারদিকে একবার ভাল করে দেখে নিল এতোয়ারী। রামপিয়ারী অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। এভোয়ারী বলল, ওই টিণ্ডালানকে সাবধান। ও শালী বহুত হারামী। সব কয়েদি জানে, উ আওরত আওরত না।

তবে কী? বিস্ময়ে চোখের তারা দুটো ছিটকে বেরিয়ে আসবে যেন সোনিয়ার।

পাশের কয়েদিনীরা চিল্লাচিল্লি শুরু করল।

জলদি খানা লাও—

খানা লাও, বহোত ভুখ—

এতোয়ারী অস্থির গলায় বলল, রাতে তোকে সব বলব সোনিয়া।

কয়েদিনীদের লোহার থালায় ভাত দিতে দিতে এতোয়ারী সামনের দিকে এগিয়ে গেল।

এখন অনেক রাত।

একটা কম্বল বিছিয়ে, অন্য একটা কম্বল মুড়ি দিয়ে পড়ে রয়েছে সোনিয়া। লাইন দিয়ে কয়েদিনীরা ঘুমোচ্ছে।

আচমকা পাঁজরে নখের খোঁচা খেয়ে লাফিয়ে উঠল সোনিয়া। দেখল, এতোয়ারীর মস্ত গোলাকার মুখটা তার ওপর ঝুঁকে রয়েছে।

চাপা, ভয়ানক গলায় এতোয়ারী বলল, চুপ। বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থাকে সোনিয়া। একটু পর ধাতস্থ হয়ে বলল, কী মতলব অফসরনী?

তোর সঙ্গে কথা আছে, বলেছিলাম না?

সোনিয়া একদৃষ্টে এভোয়ারীর দিকে তাকিয়ে রইল।

চারপাশে কয়েদিনীরা গভীর ঘুমে ডুবে আছে। একেবারে শেষ মাথায় শুয়েছে হাবিজা। সবার নাকের ডাক ছাপিয়ে তার নাক থেকে বিকট আওয়াজ বেরুচ্ছে।

আলো নিভে গিয়েছিল অনেকক্ষণ আগেই। এই ব্যারাকে কয়েদিনীদের কেউ জেগে নেই। ঘন অন্ধকারে পেটি অফিসারনী এভোয়ারীর কাছে বসে থাকতে থাকতে সোনিয়ার বুকের রক্ত( ঠাণ্ডা হয়ে আসে।

অশান্ত উপসাগর গর্জায়, পাথরের দেওয়ালে অবিরাম আছাড় খায়। নারকেলবনে বাতাস মেতে ওঠে। দরিয়া আর বাতাসের গর্জন, ঘন অন্ধকার, কয়েদিনীদের নাকের ডাক–সব মিলিয়ে সোনিয়ার বুকে বিচিত্র এক আতঙ্ক ঘনিয়ে তোলে।

হঠাৎ ফিসফিস করে এতোয়ারী বলে, তুই যেদিন আন্দামানে এলি, সেদিন একটা মরদ তোর জন্যে কত খুন দিয়েছে, জানিস?

কোন মরদ?

চান্নু সিং। গলার স্বরটাকে এবার বড় নরম করে ফেলে এতোয়ারী, মরদটা বহোত আচ্ছা। তামাম আন্দামান ছুঁড়ে চান্নুর মতো দুসরা মরদ পাবি না সোনিয়া। তোর জন্যে চান্নুর জান খতম হতে যাচ্ছিল।

সোনিয়ার গায়ে গা ঠেকিয়ে ঘন হয়ে বসে এতোয়ারী। অন্ধকারেই তার মুখের চেহারা। দেখতে চেষ্টা করে।

আশ্চর্য! এবার হাসে সোনিয়া। ঠিক আসে না, যে ঠোঁট বিদ্রুপে বেঁকে গিয়েছে সেই ঠোঁটে হাসিটাকে টিপে টিপে মারে। একটু আগের ভয়ডর আর নেই।

ঝাপসা অন্ধকারে সোনিয়ার হাসিটা ঠিকমতো দেখতে পায় না এতোয়ারী। সে বলে, মঙ্গলবার মঙ্গলবার এখানে শাদির প্যারিড (প্যারেড) হয়। মরদানা কয়েদিরা আসে, জেনানা কয়েদিদের সঙ্গে বাতচিত করে। দুতরফ রাজিবাজি হয়ে গেলে শাদি হয়ে যায়।

আমি শুনেছি।

শুনেছিস! কার কাছে?

চান্নু সিং বলেছে।

এতোয়ারী চমকে উঠল, চান্নু সিংকে তুই চিনিস!

জরুর। যে মরদ আমার জন্যে এত খুন দিল, তাকে চিনব না! দুর্বোধ্য শব্দ করে হেসে ওঠে সোনিয়া। বলে, চান্নু বলেছে, শাদির প্যারিডের সময় সে আসবে। মাথায় লাল সাফা (পাগড়ি) থাকবে, হাতে লোহার বালা।

এতোয়ারী উৎসাহিত হয়ে ওঠে, তামাম জিন্দেগির সাজা নিয়ে কালাপানি এসেছিস সোনিয়া। সারা জীবন এই দ্বীপে কাটাতে হবে। তুই খুবসুরতী লেড়কী, একটা শাদি করে না ফেললে তোর জিন্দেগি বরবাদ হয়ে যাবে।

সোনিয়া কিছু বলে না। অন্ধকারে তার ঠোঁটের সেই হাসিটা আরো দুর্বোধ্য হয়।

এতোয়ারী আবার বলে, শাদি না করলে কোনোদিন এই কয়েদখানা থেকে তোকে বেরুতে দেবে না।

কেন?

এইদ্বীপে আওরত খুব কম। মরদানা কয়েদিগুলো আওরতের জন্যে পাগলা কুত্তা হয়ে আছে। জেনানা পেলে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে। একে তুই জেনানা,তার ওপর খুবসুরতী। তুই বেরুলে উপায় আছে। আমি বলছি, তুই শাদি কর সোনিয়া।

দিল যে শাদি করতে চায় না।

দিলের মার্জি তুই কি বুঝিস রে ছুকরি? তোর বয়েসে দিল বহোত দিল্লাগী করে।

একটু থামে এতোয়ারী। টেনে টেনে দম নেয়। তারপর বলে, শাদি কর সোনিয়া, ওই চান্নু সিংকেই শাদি কর। আদমিটার ইমান আছে, দিল আছে, আবার রুপেয়াও আছে। চাল্লুকে শাদি করলে তোর সুখ হবে। নয়া নয়া কাপড়া পাবি, গয়না পাবি।

কিছুক্ষণ কী যেন ভাবে এতয়ারী। পরে ফিস ফিস করে বলে, তুই নয়া এসেছিস সোনিয়া। ছে মাহিনা এখানে না কাটালে সিরকার (সরকার) তাকে শাদি করতে দেবে না। ছে মাহিনায় তোর কাছে টিণ্ডালান পেটি অফিসারনীরা দুসরা কয়েদির সঙ্গে শাদির কথা বলবে। লেকিন তুই চান্নুর কথা ইয়াদ রাখিস। তোকে আমি পেয়ার করি, তাই চান্নুর মতো ভাল আদমির সঙ্গে তোর শাদির কথা বলছি।

চান্নুর সঙ্গে তোমার জান-পয়চান আছে পেটি অফিসারনী?

জরুর।

কেমন করে জান-পয়চান হল?

এবার এতোয়ারীর গলা বড় করুণ শোনায়, চান্নুর সাথ আমার শাদি হয়েছিল। ছে রোজ একসাথ ঘর করেছিলাম। লেকিন আমার কসুরেই সেই ঘর তুড়ল। শাদি খারিজ হয়ে গেল। আর কোনোদিনই রেণ্ডিবারিক কয়েদখানা থেকে আমি বেরুতে পারব না। এতোয়ারীর গলার স্বর ভারী এবং বিমর্ষ শোনায়।

এরপর কেউ আর কথা বলে না। একটু আগে অন্ধকার, উপসাগরের গর্জন, বিশাল আকাশের অসংখ্য মিটি মিটি তারা, সামুদ্রিক বাতাস, এতোয়ারী–সব মিলিয়ে সোনিয়ার বুকে বিচিত্র এক ভয় ঘনিয়ে তুলেছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে এতোয়ারীর বিষণ্ণ কণ্ঠস্বর শুনতে শুনতে সেই ভয়টা অদ্ভুত এক করুণার রূপ নিয়েছে।

নিজের অজান্তে একটা হাত বাড়িয়ে এতোয়ারীর হাতে রাখল সোনিয়া। সেই স্পর্শে প্রাণের উত্তাপ পেল এতোয়ারী।

সেই রাত্রে ফাই মঙ বর্মীর দোকানে খুদার নামে বিশ কসম খেয়ে চান্নু সিংকে কথা দিয়েছিল জাজিরুদ্দিন। চান্নু যদি কলমা পরে ইসলামি হয়, তা হলে সোনিয়ার সঙ্গে তার শাদির সব ইন্তেজাম করবে সে নিজে। চান্নু এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিল।

কথা হয়ে গেলে এবারডিন বাজার থেকে সরাসরি সেলুলার জেলে চলে এসেছিল পীরজাদা মৌলানা জাজিরুদ্দিন হাজী।

দুবছর আন্দামানের জঙ্গলে জঙ্গলে কোথায় যে পালিয়ে বেড়িয়েছে জাজিরুদ্দিন, কে বলবে। পুলিশ, টিণ্ডাল, পেটি অফিসার তামামদ্বীপ ছুঁড়েও কেউ তার পাত্তা পায়নি। এত কাল বাদে ভাগোয়া কয়েদি আপনা থেকেই ধরা দিয়েছে।

আন্দামানে ভাগোয়া কয়েদির সাজা বড় মারাত্মক।

কিন্তু নিজের থেকে ধরা দেওয়ার জন্যই হোক, বা অন্য যে কোনো কারণেই হোক জাজিরুদ্দিনের সাজাটা তেমন ভয়ঙ্কর কিছু হল না।

পয়লা সাত দিন খাড়া ডাণ্ডাবেড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল তাকে। তারপর দুরোজ টিকটিকিতে চড়িয়ে দুই পাঠান জোয়ান তিরিশ ঘা করে বেত মেরেছে। তিন রোজ পুরা খানা বন্ধ ছিল।

বারোটা দিন কুঠুরিতে আটক ছিল জাজিরুদ্দিন। কারো সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হয়নি তাকে। বাতচিত দূরে থাক, সিপাই আর জমাদার ছাড়া একটা কয়েদির মুখ পর্যন্ত দেখেনি সে।

আজ পয়লা ছুটি পেয়েছে জাজিরুদ্দিন।

এখন দুপুর।

ওপরে বিশাল আকাশ, নিচে বিপুল দরিয়া। আকাশে কোথাও এক টুকরো মেঘের চিহ্ন নেই। দুপুরের রোদে আন্দামানের আকাশ জ্বলে, দরিয়া জ্বলে। আকাশ আর সমুদ্র যেখানে একাকার হয়ে মিশেছে, সেখানকার রং বোঝা যায় না। অস্পষ্ট, দুজ্ঞেয় এক রহস্যের মতো। মনে হয়।

পাথরের দেওয়ালে উপসাগর ক্রমাগত আছাড় খায়। সব বাধা চুরমার করে দরিয়া নিজেকে আরো ছড়িয়ে দিতে চায়। সমুদ্রকে পাথরের দেওয়ালে বশ মানানো কি সোজা কথা!

কয়েদিদের দুপুরের খানাপিনা হয়ে গিয়েছে। এখন তাদের আরাম-বিশ্রামের সময়।

সাত নম্বর ব্লকের ওয়ার্কশপের সামনে ছোট ছোট দলে জোট পাকিয়ে বসেছে কয়েদিরা। এলোমেলো গল্প করছে। নয়া নয়া কয়েদিরা পরস্পরের সঙ্গে দোস্তি মহবৃতি করছে। কেউ কেউ ঘাসের ওপর চিত হয়ে শুয়ে পড়েছে। কেউ কেউ কুর্তা খুলে শীতের রোদে পিঠ সেঁকছে। জনকতক মনোযোগ দিয়ে লম্বা চুলে বিনুনি পাকাচ্ছে। কয়েকজন পাঠান চোখা দাড়ি তোয়াজ করছে।

ফাঁসি-কুঠুরির ওপাশ থেকে জাজিরুদ্দিন এসে পড়ল।

তার চাচাছোলা মাথায়, থুতনির পরিপাটি দাড়িতে, দীর্ঘ খাড়া চেহারায়, লাল-লাল একজোড়া চোখে কেমন এক ধরনের আদিম হিংস্রতা রয়েছে। নয়া কয়েদিরা তটস্থ হয়ে উঠল।

দু’পাটি দাঁতে ঝিলিক হেনে জাজিরুদ্দিন হাসে। তারপর বাজখাই গলায় হেঁকে ওঠে, এ শালে লোগ–

তটস্থ কয়েদিরা নড়েচড়ে বসল।

জাজিরুদ্দিন আবার চিল্লায়, তোরা আমাকে চিনিস?

কেউ জবাব দিল না। হতবাক হয়ে জাজিরুদ্দিনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

জাজিরুদ্দিন বলে, আমার নাম পীরজাদা মৌলানা জাজিরুদ্দিন হাজী। সাত সাত বার আমি হজে গেছি। কথাটা ইয়াদ রাখিস।

সাত রোজ খাড়া ডাণ্ডাবেড়িতে ঝুলে, তিন রোজ বিনা খানায় আর দুরোজ টিকটিকিতে বেত খেয়ে, একটু কাহিল হয়ে পড়েছিল জাজিরুদ্দিন। তবু গলার তেজ তার অটুটই রয়েছে।

জাজিরুদ্দিন এবার জানায়, দো সাল আগে আমি কালাপানি এসেছিলাম। এই কয়েদখানার কয়েক রোজ থেকে জঙ্গলে ভেগেছিলাম। আবার এসেছি।

ভাগোয়া কয়েদি! নয়া কয়েদিদের গলা ফেড়ে ভয় আতঙ্ক আর বিস্ময়-ভরা অদ্ভুত আওয়াজ বার হয়।

সাত নম্বর ব্লকের সামনে ঘাসের ছোট্ট ময়দান ও কয়েদিদের জটলাটাকে ভয়ানকভাবে চমকে দিয়ে খেঁকিয়ে খেঁকিয়ে হাসে জাজিরুদ্দিন। দু’পাটি এবড়ো খেবড়ো দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। একটা দস্তুর জানোয়ারের মতো তাকে দেখায়।

জাজিরুদ্দিন ঘেঁকাতে ঘেঁকাতেই বলে, ভাগোয়া কয়েদি। জরুর আমি ভাগোয়া কয়েদি। আমার কলিজায় কত হিম্মত, বুঝে দ্যাখ শালে লোগ। এত এত সিপাহী, এত এত টিণ্ডাল, পেটি অফসার, জমাদার। লেকেন কোনো শালে আমাকে আটক রাখতে পারল না। কোনো শালে আমাকে রুখে দিতে পারবে না।

বঙ্গোপসাগরের এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপে মেইনল্যান্ডের যে-সব কয়েদি সারা জীবনের সাজা খাটতে আসে, এমনিতেই তারা হত্যাকারী, লুটেরা, ডাকু। যারা ভাগোয়া কয়েদি, তারা আরো ভয়াবহ। সভ্য দুনিয়ার কানুন ভেঙে কয়েদিরা আন্দামান আসে। আন্দামানের কানুন ভেঙে যারা পালায়, তারা যে কত মারাত্মক তা এইদ্বীপের বাসিন্দারা ভাল করেই জানে। সাধারণদ্বীপান্তরের কয়েদিরা এই সব ভাগোয়া কয়েদিদের ভীষণ ডরায়। তাদের ধারণায়, আন্দামানের কানুন ভাঙার সাহস যার খুনে আছে, তার মতো বড় মরদ আর কে? তার মতো হিম্মতদার আদমী দুনিয়ার কোথায় মিলবে? ভাগোয়া কয়েদি সম্বন্ধে সাধারণ কয়েদির মনে ভয় বিস্ময় এবং সম্ভ্রম-ভরা এক বিচিত্র মোহ ঘনিয়ে থাকে।

অবাক হয়ে নয়া কয়েদিরা জাজিরুদ্দিনকে দেখছে। কেউ টু শব্দটি করে না।

জাজিরুদ্দিন সদর্পে চেঁচায়, দিন দুনিয়ায় আমাকে আটক রাখার তাগদ কোনো মানুষের নেই।

একপাশে চুপচাপ বসে রঙ্গ দেখছিল লখাই। এবার সে বলল, বেফায়দা কি চিল্লাচিল্লি লাগিয়েছ!

চোখ দুটো কুঁচকে ছোট হয়ে এল জাজিরুদ্দিনের। পোড়া তামার মতো মুখের চামড়া। সেই চামড়ায় আড়াআড়ি অনেকগুলো হিংস্র রেখা ফুটে বেরুল। দু’পাটি খিঁচানো দাঁতে হত্যা ঝিলিক দিল যেন।

কথায় বাধা পড়ায় জাজিরুদ্দিন গর্জে উঠল, কৌন, কৌন রে উল্লুকা বাচ্চে—

আমি রে শালে জানবরকা বাচ্চে–লখাই রুখে দাঁড়াল।

প্রতিপক্ষকে একবার দেখল জাজিরুদ্দিন। তারপর কী মনে করে ঈষৎ নরম স্বরে বলে, কী বলছিস?

বলছি, খুব তো চিল্লাচ্ছ, তোমাকে কেউ আটক রাখতে পারবে না! তা হলে কয়েদখানায় আটক রয়েছ, কী করে?

লখাইর অজ্ঞতায় করুণার ভঙ্গিতে হাসে জাজিরুনিন। বলে, আ বে মুরুখ, আমি নিজে এসে তো ধরা দিলাম। নইলে আমাকে আটক করে, কার সাধ্যি।

ধরা দিলে কেন?

একবার চোখদুটো আসমানের দিকে তুলে জাজিরুদ্দিন বলে, ওই আসমানে দিন দুনিয়ার যে মালেক রয়েছে, তার মর্জিতেই ধরা দিলাম।

দিন দুনিয়ার মালেকের এমন মর্জি হল কেন? শুনেছি, ভাগোয়া কয়েদি একবার ধরা পড়লে পুলিপোলাও বহুৎ চলে। বলে লখাই মিটিমিটি হাসে।

কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে লখাইর হাসির রকমটা বুঝবার চেষ্টা করে জাজিরুদ্দিন। তারপর হুমকে ওঠে, খবরদার বেয়াদপ–

জাজিরুদ্দিনের চাঁছাছোলা মাথায়, চোখা দাড়িতে, গলার আওয়াজে এমন কিছু ছিল, লখাই চমকে উঠল। আর কিছু বলল না সে। মিটিমিটি বদ হাসিটাও থেমে গেল।

তবু জাজিরুদ্দিনর লাল লাল চোখ দুটো আগুনের গোলার মতো জ্বলছে। পোড়া তামাটে রঙের মুখটায় অজস্র আঁকিবুকি ফুটে রয়েছে।

হঠাৎ কী হল, জাজিরুদ্দিন নরম গলায় বলল, শোন মুরুখ, তুই নয়া এসেছিস, তাই জানিস না। তবে আন্দামানের সবাই জানে, আমার মর্জি হলে যখন খুশি কয়েদখানা থেকে চলে যেতে পারি। লেকিন খুদার ইচ্ছা তা নয়।

লখাইকে এবার উদ্গ্রীব দেখায়। সে বলে, খুদার কী ইচ্ছা?

সে পরে বলব।

অনেকটা সময় কেটে যায়।

একটু আগেও মেঘ ছিল না। এখন পশ্চিম আকাশে পাটকিলে রঙের মৌসুমি মেঘ হানা দিতে শুরু করেছে। নিচে দরিয়ার গর্জন বাড়ছে। অনেক উঁচুতে কতকগুলি বিন্দু ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ওগুলি গাংচিল। বাতাসের সমুদ্রে ভেসে ভেসে দিশাহীন তারা কোন দিকে যে চলেছে, কে জানে।

জাজিরুদ্দিন ফের শুরু করল, তোর নাম কী?

লখাই।

কৌন দেশকা মূর্তি?

বাংলাদেশ।

হিন্দু না মুছলমান?

হিন্দু।

বাংলা কিতাব পড়তে পারিস?

পারি। হঠাৎ ডান দিকে ঘুরে জাজিরুদ্দিন হাঁকল, ফয়জর আলি—

জি–

ওয়ার্কশপের পেছন থেকে বেঁটেখাটো গোলগাল এক কয়েদি ছুটে এল। তার গলায় D মার্কা টিকিট ঝুলছে। D টিকিট হল সন্দেহজনক চরিত্রের কয়েদির মার্কা। কাঠের টিকিটে কোন ধারার আসামী, কবে কয়েদ হয়েছে, সব খোদাই করা আছে। একেবারে নিচে একটা L অক্ষর। অর্থাৎ তামাম জীবন সাজা খাটার কয়েদি।

জাজিরুদ্দিন বলল, কিতাব এনেছিস?

ডান এবং বাঁ, দু’দিকেই মাথা হেলিয়ে খুব একচোট ঝকায় ফয়জর আলি। তারপর বলল, হাঁ, এই নাও।

বগলের তলা থেকে খানকতক চটি চটি কিতাব বার করে জাজিরুদ্দিনের হাতে দিল ফয়জর। সেগুলো থেকে খান দুই বেছে লখাইর দিকে বাড়িয়ে দিল জাজিরুদ্দিন। বলল, পড় দেখি, কী লেখা আছে–

লখাই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বই দুটোর নাম পড়ল। একটার নাম : শিবের সঙ্গে মুহম্মদের লড়াই, আর একটার নাম : আলির সাথে হনুমানের যুদ্ধ।

ঠিক হ্যায়। এই কিতাব দুটো আগে পড়। পরে অন্য কিতাব দেব।

কী আছে এর মধ্যে?

পড়লেই বুঝবি। জাজিরুদ্দিন রহস্যময় হাসে। তারপর বলে, পরশু হল রবিবার, ছুটির দিন। আমাকে সেদিন কিতাব দুটোর কিত্সা বলতে হবে। ইয়াদ রাখিস। বলতে বলতে সামনের দিকে এগিয়ে যায় সে। যেতে যেতে একটা কয়েদির দিকে হাত বাড়িয়ে হাঁকে, নাম কী তোর?

সা মিঙ।

মুলুক কঁহা?

বর্মা, মৌলমিন।

ফায়া তোদের দেওতা?

হাঁ।

একে একে সকলের সঙ্গে জান পয়চান হয় জাজিরুদ্দিনের। কেউ পাঞ্জাবী, কেউ বর্মী, কেউ কারেন, কেউ মোপলা, কেউ বাঙালি। কেউ হিন্দু, কেউ খ্রিস্টান, কেউ বৌদ্ধ, কেউ শিখ, কেউ জৈন।

যারা পড়তে পারে, তাদের সকলকেই কিতাব দেয় জাজিরুদ্দিন। যারা পড়তে পারে, তাদের আশ্বাস দেয়, কিতাবের কিস্সা রবিবার সে নিজেই তাদের শোনাবে।

বিচিত্র সব কিতাব। হিন্দি উর্দু বাংলা বর্মী, সব ভাষারই বই বিলোয় জাজিরুদ্দিন। কোনোটা মুহম্মদের সঙ্গে শিবের লড়াই, আমার কোনটা মুহম্মদের সঙ্গে ফায়া কি নানকের যুদ্ধ।

কিতাব বিলোবার পালা শেষ হওয়ার আগেই পেটি অফিসাররা ঝাঁক বেঁধে এসে পড়ে। তাড়া লাগায়, এ শালে লোগ, খুব যে আরাম ফুর্তি লাগিয়েছিস! কাজে যা আভি। আড়াই পাউণ্ড নারকেলের ছোবড়ার তার না পেলে পাছার হাড্ডি ঢিলা করে দেব।

কয়েদিরা যে যার কাজে ছোটে।

পেছন থেকে জাজিরুদ্দিন চিল্লায়, ইয়াদ রাখিস, ছুটির রোজ সবাই আমরা মিলব। কিতাবের কি জিজ্ঞেস করব।

দিন যায়।

উপসাগর আর সামুদ্রিক বাতাসের গর্জন শুনে, দরিয়া দেখে, নারকেল গাছে গাছে ছয়লাপ টিলা দেখে, মাউন্ট হ্যারিয়েট, রস দ্বীপ, সিন্ধুশকুন আর রেণ্ডিবারিক কয়েদখানা দেখে দেখে বিশটা দিন কাটিয়ে দিল লখাই।

এই বিশ দিনে লখাই একটা সার সত্য বুঝেছে। একটি একটি দিন গেঁথে এই দ্বীপে সপ্তাহ যায়, সপ্তাহের পর মাস আসে, মাসে মাসে বছর ঘোরে। বছরের পর বছর কাটিয়ে একদিন কয়েদির তামাম জীবন শেষ হয়ে যায়। সেই জীবনের জন্য কেউ এতটুকু আপশোশ পর্যন্ত করে না।

এই বিশ দিনেই মনটা কেমন যেন নিরাসক্ত হয়ে গিয়েছে লখাইর। উগ্র নেশা আর কামাতুর নারীমাংস ছাড়া একটি দণ্ড যার চলত না, আন্দামান এসে সেই লখাইর নারী আর নেশার আসক্তিটা যেন তিলে তিলে ঝিমিয়ে আসছে। মেইনল্যান্ডে থাকতে দু’টি মাত্র স্কুল মনোধর্ম তার মধ্যে প্রকট ছিল। একটি কাম, অপরটি লালসা। আদিম প্রবৃত্তিগুলির একান্ত বশীভূত ছিল লখাই। অসংযত, ভীষণ প্রবৃত্তিগুলির তাড়নায় কি ইচ্ছায় সে চলত, ফিরত। দুর্বল মুহূর্তে মনের মধ্যে যদি কোনো সদিচ্ছাও জন্মত, সে ইচ্ছা তার নিজের ওপর ক্রিয়া করতে পারত না।

চরসে, গুলিতে, গেজিয়ে-ওঠা তাড়িতে আর নারীদেহে ছিল লখাইর জীবনের সমস্ত চরিতার্থতা।

আশ্চর্য, আন্দামানে এসে কাম আর লালসার মতো উগ্র, স্থূল প্রবৃত্তিগুলোর পাশে একটি সূক্ষ্ম অনুভূতি জন্মেছে লখাইর মনে। সেটি হল বেদনাবোধ। আর এই বেদনার বোধটাই মাত্র বিশটা দিনে তাকে বিকল করে ফেলেছে। এই বোধটাই তাকে ভাবতে শিখিয়েছে। হৃদয়হীন লখাই আজকাল ভাবে।

কয়েদখানার ঘড়িতে পাঁচটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে মেপে আড়াই পাউণ্ড নারকেল ছোবড়ার তার পেটি অফিসারের হাতে তুলে দিয়েছে লখাই। তারপর কখন যে নিজের সেলের সামনে বারান্দাটায় এসে দাঁড়িয়েছে, হুঁশ নেই।

বিকেল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাণ্ডারা থেকে ভাজি আর চাপাটি দিয়ে গিয়েছিল।

দুপুর থেকেই মনের গতিক আজ সুবিধার নয় লখাইর। কেমন যেন উদাস লাগছে নিজেকে। বিকেলের খানা সে আনতে যায়নি। পেটি অফিসারের কী করুণা হয়েছিল, সে ই দিয়ে গিয়েছে। নারকেল ছোবড়ার আড়াই পাউণ্ড তার পেটি অফিসারকে ঠিক ঠিক বুঝিয়ে দেওয়ার পর সেই যে নিজের সেলের সামনে এসে লখাই দাঁড়িয়েছে, তারপর কখন যে দরিয়ার রোদ মরে গিয়েছে, কখন যে সিন্ধুশকুনরাদ্বীপের আশ্রয়ে ফিরে গিয়েছে, আর কখন যে একটু একটু করে আবছা অন্ধকার নামতে শুরু করেছে, খেয়াল নেই।

লখাই ভাবছিল। বিবিবাজারের মোতি ঢুলানি তার সমস্ত মন এখনো যেন আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

এক বছর, দুবছর নয়, মোতি ঢুলানির সঙ্গে তার সাত বছরের পাকা সম্পর্ক।

নাম তার মোতি। রূপের দেমাকে মাজা ঢুলিয়ে ঢুলিয়ে পথ চলত মোতি। সেই থেকে বিবি বাজারের রসিক সুজনদের মুখে মুখে নাম উঠল, মোতি ঢুলানি। সেই নাম দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই নামের টানেই একদিন বিবিবাজারে এসে উঠেছিল লখাই।

মোতি মাজায় ঠমক দিয়ে রাস্তায় হেঁটে যেত। বিবিবাজারের সেরা কামিনী সে। রূপসী বটে একখানা! মাজা কালো শরীর। সেই শরীর থেকে বিদ্যুৎ খেলে যেত। সুপুষ্ট নিটোল দেহে, বাটির মতো দুই বুকে এবং বিশাল মাংসল পাছায় কোমর দোলাবার সময় ঢেউ খেলে যেত। দেখতে দেখতে লোকের চোখে ধাঁধা লাগত। মোতির চোখে ধার, কালো শরীরে ধার, জিভে ধার। এমন মেয়েমানুষ ভূ-ভারতে মেলে না।

ডাকাতের দল ছিল লখাইর। যখন খুশি রাহাজানি করে বেড়াত। সেই দল ছেড়ে বিবিবাজারের কামিনীপাড়ায় এসে উঠল লখাই। সরাসরি মোতির ঘরেই উঠল।

পাকা কথা হল মোতির সঙ্গে। যত টাকা, শখ বিলাসের যত উপকরণ, যত শাড়ি গয়না, সব যোগাবে লখাই। কিন্তু অন্য পুরুষে অন্য নাগরে মন দেওয়া চলবে না। মোতি দুরাত ভেবে রাজি হয়ে গিয়েছিল।

পুরো সাতটি বছর মোতির সঙ্গে বিবিবাজারের কামিনীপাড়ায় ঘর করল লখাই। একদিক থেকে দেখতে গেলে মোতির সঙ্গে তার সম্পর্কটা হল রসের সম্পর্ক, নাগরালির সম্পর্ক। যে মাংসাশী পুরুষ নারীমাংস কেনে আর যে কামিনী নিজের মাংস বেচে, তাদের মধ্যেকার সম্পর্ক। কিন্তু এই সম্পর্ক ছাপিয়ে আর একটা অদৃশ্য সঙ্গোপন বন্ধন গড়ে উঠেছিল। লখাই তা স্পষ্ট বুঝত। সাত বছর একটা মেয়েমানুষের সঙ্গে ঘর করে ডাকাত এবং খুনি লখাইর মনটা অনেক নরম হয়ে গিয়েছিল। লখাই বুঝত, তার আর মোতির মধ্যে দেহ কেনাবেচার দোকানদারি বাতিল হয়ে একটা মধুর, সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। নরম আবশে ভরে থাকত তার মন।

প্রথম প্রথম টের পায়নি লখাই। যখন পেল? সে কথা অনেক পরের।

যে নারীর বিবিবাজারের কামিনীপাড়ায় বাস, যার কিনা মাজা সারাক্ষণ দোলে, সারাক্ষণ যার দেহে বিদ্যুৎ, যার রক্তে রক্তে নাগরালির বীজ, এক পুরুষে কেমন করে তার মন বসবে? হৃদয় মজবে?

ভাবতে ভাবতে লখাইর চোখে জ্বালা ধরল। শিরাস্নায়ুর মধ্য দিয়ে অদ্ভুত এক উত্তেজনা দাপাদাপি করতে লাগল।

লিখাই ভাই–হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন ডাকল।

চমকে ওঠে লখাই। ঘুরে দেখল, আবছা অন্ধকারে তোরাব আলি দাঁড়িয়ে রয়েছে।

অনেকটা ধাতস্থ হয়ে লখাই বলল, কি রে তোরাব?

লখাই ভাই, জান লবেজান হয়ে গেল। জরুর খতম হয়ে যাব। তোরাব আলি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

জোয়ান মরদের কান্না লখাই সইতে পারে না। কিন্তু আন্দামানের কয়েদখানায় আসার পর থেকেই তার মনে হয়েছে, এখানে না কাঁদাটাই বেমানান। তোরাবকে কিছুই বলল না লখাই। একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

তোরাব আলি এবার বলে, লখাই ভাই, সারা জীবনের সাজা নিয়ে কালা পানি এসেছি। কোনো দিন আর দেশে ফিরতে পারব না!

অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ গলায় লখাই বলে, না–

তোরাব আলির ফোঁপানি বাড়তেই থাকে। সে বলে, আর কোনোদিন বিবির মুখ দেখতে পাব না। বিবির পেটে যে বাচ্চাটা রয়েছে, সে সারা জীবন তার বাপজানের মুখ দেখবে না।

লখাই সাড়া দেয় না। অন্ধকার আকাশে রাশি রাশি তারার হরফে কী দুজ্ঞেয় ভাষ্য লেখা রয়েছে, বুঝিবা তা পড়তে চেষ্টা করে।

তোরাব আলি বলে, কালাপানি এসে কষ্ট আরো বেড়েছে লখাই ভাই।

দেশের কয়েদখানায় থাকলেই তো পারতি। নিজেই কালাপানি আসার খাতায় নাম লেখালি। এখন কেঁদে কী করবি? লখাইর গলাটা বড় নরম শোনায়। তার কথাগুলোর মধ্যে কোথায় যেন একটু সান্ত্বনার আভাস রয়েছে।

সাধে কি কালাপানির খাতায় নাম লিখিয়েছি! প্রশ্রয় পেয়ে তোরাব আলি বলতে থাকে, ভেবেছিলুম দেশ থেকে অনেক দূরে কালাপানি গেলে দিল জুড়োবে। বিবি বাচ্চার ভাবনা তেমন থাকবে না। কিন্তু খুদাতালার মর্জি অন্যরকম লখাই ভাই। ভাবিয়ে ভাবিয়েই আমার জান খতম করে দেবে। আমি আর পারি না। তামাম রাত দুচোখে ঘুম আসে না। এর থেকে মরতে পারলেও জান জুড়তো। তোরাব একেবারেই ভেঙে পড়ে।

কতকগুলি ক্ষেত্রে মেইনল্যান্ডের কয়েদখানা থেকে কয়েদিকে আন্দামান চালান করতে গেলে তাদের মত নিতে হয়। সে-সব ক্ষেত্রে কালাপানি আসা না-আসা কয়েদির সম্পূর্ণ ইচ্ছাধীন। অবশ্য জেল কর্তৃপক্ষ কালাপানির কয়েদখানা, সেখানকার খানাপিনা, আরাম, সুখসুবিধা সম্বন্ধে মজাদার এবং লোভনীয় নানা কথা শোনায়। অর্থাৎ সেলুলার জেলে খাটুনি কম, খানাপিনা ভালো, ফুর্তিফার্তা খুশিমতো–এমনি সব রূপকথা শুনতে শুনতে কয়েদির মন মজে যায়। কালাপানির খাতায় তারা নাম লেখায়।

নিজের ইচ্ছায় আন্দামান এসেছে তোরাব আলি। কালাপানির ব্যাপারে তার গরজটা ছিল সবচেয়ে বেশি।

সেই তোরাবই দ্বীপান্তরে এসে সব চেয়ে বেশি ভেঙে পড়েছে। দিবারাত্রি সে খুদাতাল্লার কাছে কাঁদে। তার মুখে খানা রোচে না, চোখে ঘুম আসে না। এক দুঃসহ যন্ত্রণায় দিল মুচড়ে মুচড়ে খুন ঝরে।

ধরা ধরা, বিমর্ষ গলায় তোরাব আলি ডাকে, লখাই ভাই–

কী বলছিস?

বিবি বাচ্চাকে ফেলে দরিয়া পেরিয়ে এতদূর এলাম। তবু তাদের ভাবনা গেল না। দরিয়া পেরিয়ে আমার সঙ্গে তাদের ভাবনাটাও এল। আর পারি না লখাই ভাই।

কী আর করবি, বরাতে যা আছে তা হবেই। নিজেকে সামাল দে তোরাব।

তোরাবের ফোঁপানি আরো বাড়ে। লখাইর একটা হাত বুকের মধ্যে চেপে ধরে বলে, গলায় একদিন ঠিক রশি দেব লখাই ভাই।

লখাই জবাব দেয় না, আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।

নারকেল বনে সামুদ্রিক বাতাস মাথা কোটে। পাথুরে দেওয়ালে লবণ দরিয়া উথালপাতাল হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দরিয়া আর বাতাসের গর্জন স্নায়ুতে স্নায়ুতে কেমন যেন ঝিম ঝিম ক্রিয়া করে।

তোরাব আলি বলে, চোদ্দ বছর এই দ্বীপে আটক থাকতে হবে। তার মধ্যে মোটে বিশটা দিন কাটল। আরো কতদিন বাকি। আমি পাগল হয়ে যাব লখাই ভাই। আমার বিবি বাচ্চা–হাঃ। বুকের ওপর চাপড়ের পর চাপড় মারতে থাকে তোরাব।

এই বিশ দিনেই কি তোরাব আলি উন্মাদ হয়ে গেল! তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে ভালো করে দেখে লখাই। তারপর হাত দুটো ধরে ফেলে। ঈষৎ বিরক্ত স্বরে বলে, কী করছিস তোরাব?

ঠিকই করছি লখাই ভাই। বুকটা আমার ছিঁড়ে যাবে, দিলটা ফেটে যাবে। আমি জান দেব।

চোখ দুটো টকটকে লাল, মাথার চুল খাড়া খাড়া, রুক্ষ কর্কশ বুনো মুখভঙ্গি। তোরাব আলির সারা দেহে পাগলামির লক্ষণ ফুটে উঠছে।

অনেকটা সময় কাটে।

হঠাৎ তোরাব আলি বলে, লখাই ভাই, আমার মাথায় একটা মতলব এসেছে। আজকাল আমাকে সড়ক বানানোর ফাইলে কাজ দিয়েছে। রোজ কয়েদখানার বাইরে যাই। ভাবছি দরিয়া সাঁতরে দেশে পাড়ি দেব।

লখাই জবাব দিল না।

লম্বা লম্বা পায়ে কখন যে তোরাব আলি চলে যায়, হুশ থাকে না লখাইর। তারপর কতখানি সময় পেরিয়ে যায়, সে হিসাবই বা কে রাখে।

অন্ধকার আরো ঘন হয়েছে। এতক্ষণদ্বীপ আর দরিয়া আবছা দেখাচ্ছিল। এখন রাত্রির অতল অন্ধকারে সব কিছু অবলুপ্ত।

লখাই একটু আগে মোতির কথা ভাবছিল। সে চিন্তাটা মাথা থেকে মুছে গিয়েছে। তার মনটা এখন একেবারে ফঁকা।

এ লখাই দাদা–পাশ থেকে আবার কে যেন ডেকে ওঠে।

ঘুরে লখাই দেখল, ভিখন আহীর দাঁড়িয়ে রয়েছে। অন্ধকারে পোড়া, বীভৎস মুখে হেসে উঠল ভিখন। এমন যে দুর্দান্ত লখাই, মুহূর্তের জন্য সে-ও শিউরে ওঠে।

ভিখন আবার বলল, তুই যাই বলিস লখাই দাদা, কালাপানি আমার মনে ধরেছে। এ জায়গা বহুৎ আচ্ছা। থোড়া তকলিফ করলে সব কুছ মেলে। আওরত মেলে, নেশা মেলে। একটু দম নিয়ে বলে, এই নে–

কী?

চারদিকে চনমন করে তাকিয়ে ভিখন চাপা গলায় বলল, কী আবার? তোর নেশার চীজ–আফিং।

কাগজের একটা মোড়ক লখাইর হাতে খুঁজতে খুঁজতে বলল, রোজ তোর খানা থেকে আমাকে ভাগ দিস। নিমকহারামি আমি করি না লখাই দাদা–

লখাই বলল, রোজ তুই আমার নেশা কোত্থেকে জোটাস?

আ রে দাদা, রুপেয়া–দুই আঙুলে টাকা বাজাবার ভঙ্গি করে ভিখন বলে, তোকে তো বলেছি দাদা, রুপে থাকলে আন্দামানের কয়েদখানায় পেয়ার ভি মেলে।

পোড়া, কদাকার মুখে অদ্ভুত আত্মতৃপ্তির হাসি ফোটে ভিখনের। আবার সে বলে, রুপেয়ার তাগদে কী না হয়! এই দ্যাখ, তোরা নারকেল ছোবড়া ছিলেকুটে তার বার করিস, সড়ক বানিয়ে জান বরবাদ করিস, আর আমি? নারকেলের কোপরা কাটি। আমার কাজে তখলিফ নেই, মেহনত নেই।

হতবাক হয়ে ভিখনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে লখাই।

তারপর কিছুক্ষণ একথা সে কথায় কাটে দুজনের।

হঠাৎ কী মনে পড়ে যায় ভিখনের। লখাইর কানে মুখটা গুঁজে দিয়ে খুশির গলায় বলে, লখাই দাদা, মেজাজটা আজ বড় খোশ রয়েছে।

কেন?

আট আনা পয়সা খসিয়ে একটা মজাদার খবর এনেছি। ভিখন আহীর একটি মাত্র চোখে মিটি মিটি তাকায়। কিন্তু খবরটা কিছুতেই ভাঙে না।

লখাই বিরক্ত হয়ে চেঁচায়, জলদি বল। নইলে অ্যায়সা কেতকা হাঁকাব—

নিরাপদ দূরত্বে সরে দাঁড়ায় ভিখন। কদাকার মুখ বাঁকিয়ে চুরিয়ে শব্দ করে হাসে। বলে, বহুৎ আচ্ছা খবর, শুনলে তুই দাদা কাপড় খুলে পাগলা বনে নাচবি।

বল শালে–লখাই রুখে ওঠে।

ভিখন বলে, বলছি বলছি, থোড়া সবুর দাদা। বহুৎ মজাদার খবর, শুনলে দিলের ধড়কানি বেড়ে যাবে। হেঁ হেঁ দাদা–আওরত কয়েদানী সোনিয়ার খবর–

সোনিয়া? কোন সোনিয়া?

হায় হায় দাদা, তুই ক্যায়সা বেকুফ মরদানা। কৌন সোনিয়া! সোনিয়া তো একটাই জানতাম, তোর দিলজ্বালানেবালী লেড়কী। দাদা, পুরা একরাত জাহাজের খোলে তার সঙ্গে কাটালি। এখন পুছছিস, কৌন সোনিয়া! কপট দুঃখে কপাল থাপড়ায় ভিখন।

এবার আগ্রহে চোখ দুটো ঝকমক করে লখাইর। পায়ে পায়ে ভিখনের পাশে এসে ঘন হয়ে দাঁড়ায় সে। তোষামোদের সুরে বলে, তুই আমার দোস্ত। বল না সোনিয়ার কী খবর পেয়েছিস।

হেঁ হেঁ দাদা–দুটো খবর আছে। একটা বহুৎ খারাপ।

কেমন খারাপ?

আমার কোন খতা (দোষ নেই। শুনলাম, চান্নু সিং সোনিয়াকে শাদি করবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।

চোখের তারা দুটো ধক করে জ্বলে ওঠে লখাইর। খাড়া চোয়াল কঠিন হয়। সে গর্জে ওঠে, চান্নু সিং শালেটা আবার কে?

পুরানা কয়েদি।

শালের জান নেব।

ভিখন জবাব দিল না। একমাত্র চোখটা দিয়ে চেয়ে চেয়ে বুঝল, চান্নু সিংকে এই মুহূর্তে পেলে নির্ঘাত খতম করে ফেলবে লখাই।

হঠাৎ ভিখনের চওড়া গর্দানটা দুই থাবায় ঠেসে ধরে লখাই চেঁচিয়ে ওঠে, এই হারামী, একটা খবর তো দিলি, আর একটা খবর কী?

ভয়ে ভয়ে ভিখন বলে, সোনিয়ার বুখার হয়েছে। রোজ রোজ সে রস জাজিরার (দ্বীপের) সিকমেনডেরায় (হাসপাতালে) যাচ্ছে। আমি যা বলি, মন দিয়ে শোন লখাই দাদা

কী বলবি হারামীকা বাচ্চে?

দাদা, আমার কী দোষ! চান্নু শালে সোনিয়াকে শাদি করতে চায়, আমি তা চাই না। ঝুটমুট আমাকে গালি দিচ্ছিস। ভিখন আহীরের পোড়া বীভৎস মুখটা কাচুমাচু দেখায়। করুণ স্বরে সে বলে, আমি তোর সাচ্চা দোস্ত লখাই ভেইয়া। খানার বখরা যেমন তুই দিস, আমিও নেশার চীজ জুটিয়ে দিই। তুই দাদা গুস্সা করবি না।

লখাইর রাগ পড়ে না। চান্নু সিংয়ের কথা শুনবার সঙ্গে সঙ্গে শিরাস্নায়ু বারুদের মতো দপ করে জ্বলে উঠেছে। রাগ এবং উত্তেজনা রক্তের মধ্যে টগবগ করে ফুটছে।

ভিখনের কদাকার মূর্তিটার দিকে চেয়ে চেয়ে লখাই আরো খেপে ওঠে, কী বলবি শালে বল–

তোকে একটু ভাল বুদ্ধি দিতে চাই।

লখাই জবাব দেয় না। একদৃষ্টে তাকিয়ে ভিখনের ভাবগতিক লক্ষ করে।

লখাইর কাছাকাছি ঘনিষ্ঠ হয়ে আসে ভিখন। কানের মধ্যে মুখটা ঢুকিয়ে সে বলে, দাদা, তোকেও রস জাজিবার সিকমেনডেরায় (হাসপাতালে) যেতে হবে। সোনিয়ার সঙ্গে বাতচিত করবি, সিধা শাদির কথা বলবি।

কথা তো বলব, কিন্তুক সাত সাল এখানে না থাকলে তো শাদির টিকিট মিলবে না। সরকারি টিকিট না মিললে শাদি হবে কেমন করে?

আরে ভেইয়া, তুই বড় বুদ্বু! সাত সাল বাদেই শাদি করবি। লেকিন তার আগে দুলহানকে শিখিয়ে পড়িয়ে তার দিল মেজাজ খোশ রেখে রাজিবাজি করিয়ে রাখবি তো। নইলে খুবসুরতী সোনিয়া তোর মুঠা থেকে ছুটা হয়ে যাবে। হেঁ—হেঁ—দাদা। খিক খিক করে হাসতে থাকে ভিখন।

এবার অনেকটা নরম হয় লখাই। বলে, সিকমেনডেরায় (হাসপাতালে) যাব কেমন করে? আমার তো ব্যারাম নেই!

হেই ভেইয়া, তুই যতখানি গোঁয়ার, সেইরকম যদি বুদ্ধি থাকত, তা হলে দিন দুনিয়ার মালেক বনতে পারতি। একমাত্র চোখটা কুঁচকে শব্দ করে করে তিন বার তুড়ি বাজায় ভিখন। তারপর বলে, ভেইয়া, তোর বুখার বানাতে হবে।

বুখার বানাবো কেমন করে?

আমি বানিয়ে দেব। গলাটা এবার ফিসফিস শোনায় ভিখনের, পিনিক টানলে তো তোর বুকের তড়পনা বাড়ে?

হাঁ।

পেটের বুখার হয়?

হাঁ।

কাল তোকে পিনিক এনে দেব।

খুশিতে দুই চোখ চকচক করে লখাইর। পাঁজাকোলে করে ভিখনকে তুলে ধরে চিল্লায়, তুই আমার আসল দোস্ত, আর সব ঝুটা।

কপট ভয়ে ভিখন চেঁচায়, ছোড় দে, ছোড় দে, গিরলে আমার শির ফাটবে। মর যায়েগা, মর যায়েগা–

ভিখনকে নামিয়ে তার পোড়া কদাকার মুখে গোটা বিশেক চুমু খায় লখাই।

আজ ছুটির দিন।

ছোবড়া ছিলা কোটার কাজ নেই, ঘানি টানার কাজ নেই, সড়ক বানানোর কাজ নেই। রম্বাস ঘেঁচা, দড়ি পাকানো, কোপরা শুকানো, সব ঝামেলা থেকে আজ রেহাই। সপ্তাহে এই একটা দিন সব ব্যাপারে মকুব।

কালাপানির কয়েদখানায় এই দিনটা ফুর্তিতে আরামে হল্লায় আলস্যে কেটে যায় কায়েদিদের। আন্দামানের অন্য দিনগুলো টিমেতেতালা, মন্থর, ক্লান্তিকর। কিছুতেই যেন ফুরোতে চায় না। কিন্তু এই দিনটার স্বাদই আলাদা। কালোয়াতী গানের জলদ তানের মতো যেমন দিনটা আসে, আবার ফুরিয়েও যায় তেমনি দ্রুত লয়ে।

একমাত্র D টিকিট মার্কা কয়েদি ছাড়া আর কারো কাজ নেই এই দিনটায়। কয়েদখানার ইমারতগুলি এই দিন তারা ঝাড়ে-পোঁছে, ঘাস-আগাছা সাফ করে।

অন্য কয়েদিদের কাজের মধ্যে দুই–খানাপিনা আর ঘুম। খানাপিনাটাও এই দিন। জোর। মাছ মেলে, একটু মিঠাই অর্থাৎ গুড়ও মেলে। কাঞ্জিপানি অন্য দিন থাকে নোনা এবং কালচে, এই দিন তার স্বাদ ও বর্ণ বদলে যায়। ছুটির দিনে তার রং লালচে, স্বাদ মিঠা।

খানাপিনা আর ঘুম বাদ দিয়েও কিছু কাজ থাকে। চুলদাড়ি বড় হলে হাজমের কাছে। কামিয়ে আসা, আর কাপড়া কুর্তা বর্তন সাফ করা। তারপর তামাম দিন ফুর্তিফার্তা গান হল্লা, অশ্লীল রসের গল্পগুজব, গুলতানি।

সপ্তাহের এই দিনটা আর সব দিনের থেকে একেবারেই আলাদা। অন্য দিনগুলির সঙ্গে এর আসমান জমিন ফারাক।

একটু আগেই কয়েদি গুনতি হয়ে গিয়েছে। তারপর কাঞ্জিপানিও দেওয়া হয়েছে।

কাঞ্জিপানি খেয়ে, বর্তন ধুয়ে, কয়েদিরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে এখন গুলতানি পাকাতে শুরু করেছে।

খানিক আগেই রোদ উঠে গিয়েছিল। উপসাগরের নীল জলে রক্তাভা ছড়িয়ে পড়েছে। উপসাগরের পর কালো, কুটিল, দুজ্ঞেয় সমুদ্র। সেই সমুদ্র থেকে ফেনায়িত, উন্মাদ ঢেউ ছুটে আসে উপসাগরে, উপসাগর থেকে আছড়ে পড়ে দ্বীপে। কঠিন, অনড়দ্বীপের মৃত্তিকা চুরমার করে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায়।

সেলুলার জেলের সেন্ট্রাল টাওয়ারের মাথায় একটা সাগরপাখি দুই ডানা মেলে শীতের রোদের তাপ নিচ্ছিল, আরামে দুই চোখ বোজা।

এদিকে সেদিকে ছোট ছোট জটলাগুলি রকমারি কিত্সায় এবং খিস্তিখেউড়ে গুলজার হয়ে রয়েছে।

এক কয়েদি বলল, মুন্সিজির কাছে শুনলাম, দশ রোজ বাদে জাহাজ আসছে। এবার আসবে মাদ্রাজ থেকে। চার শ’ কয়েদি আসছে। মোপালা পাঠান আর পাঞ্জাবী কয়েদি।

পাশের কয়েদিটি প্রথম কয়েদির গা ঘেঁষে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে। আগ্রহে তার চোখ দুটো ঝকমক করে। একটা চোখ কুঁচকে, আর একটা চোখ ইঙ্গিতময় করে ফিসফিস গলায় বলে, মুন্সিজি আর কী বললে?

আর কী বলবে?

খালি মরদানা কয়েদিই আসবে, আওরত কয়েদি আসবে না?

না রে বুদ্ধ, নসিব বড় খারাপ। এবার আর আওরত কয়েদি আসছে না আন্দামানে।

তালুতে জিভ ঠেকিয়ে চুকচুক শব্দ করে দ্বিতীয় কয়েদি। বলে, বহুত আপশোশের বাত। সিরকার (সরকার) শালে বেদরদি, আহাম্মক। যত মরদানা তত জেনানা না পাঠালে কালাপানির জিন্দেগী বেচাল হয়ে যাবে। সব কয়েদির ভাগে একটা করে আওরত না পড়লে খুনখারাপি বেধে যাবে। একটু থেমে বলে, কত দিন আওরত দেখি না। আর দুচার সাল না দেখলে, মেয়েমানুষের চেহারাই ভুলে যাব।

সরকারের আহাম্মকি এবং নির্দয় মনোভাবের জন্য তার আক্ষেপের অন্ত থাকে না।

ঠিক তার পাশেই অন্য ধরনের আলাপ চলছিল।

চাঁছা-মাথা এক কয়েদি হাত আর পা নেড়ে নেড়ে বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলছে, তোরা নেশার ব্যাপারে নালায়েক। নেশার তোরা বুঝিস কী?

সমস্ত জটলাটা মাথা ঝাঁকিয়ে জানাল, নেশার ব্যাপারে সত্যি সত্যিই তারা আনাড়ি, কিছুই বোঝে না।

চাঁছা-মাথা দেমাকে যেন ফুলে উঠল। রোমশ, মাংসল বুকে গোটা দশেক চাপড় মেরে বলল, আমি, বুঝলি শালেরা, বাজি ধরে একবার শরাব খেয়েছিলাম।

কেমন, কেমন?

শরাবের কথায় সবাই উৎসাহিত হয়ে ওঠে।

সগৌরবে সকলের মুখের ওপর দিয়ে নজরটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে গেল চাঁছা-মাথা। বলল, ফয়জাবাদে এক দারুর দোকানে দারু খাচ্ছিলাম। এক এংরাজ তোক সেখানে এল। সাহেব বড়ে দিলদরিয়া। দারু খেতে খেতে ইয়ার বনে গেলাম দুজনে। জানিস তো, শরাবের দোস্তি বড়ে পাক্কা দোস্তি–

সকলে সমস্বরে সায় দেয়, হাঁ হাঁ, জরুর—

সাহেবের সঙ্গে দোস্তি হল। সাহেব বিলাইতের কিস্সা শোনাল, আমি মুলুকের কিত্সা শুনালাম। কথায় কথায় সাহেব বলল, সারা দুনিয়া আমি ঘুরেছি, বহুত বড়ে বড়ে নেশাড়ি দেখেছি। কালা আদমীরা নেশা করতে জানে না। দুবোতল টানলে চার রোজ খাঁটিয়া থেকে উঠতে পারে না। আমি কালা আদমী। কথাটা শুনে ইজ্জতে বড় লাগল।

তারপর কী হল?

চারপাশ থেকে কয়েদিরা ঘন হয়ে এল।

হুঁ-হুঁ–দুই হাঁটুর মাথায় আঙুল দিয়ে তাল ঠোকে চাঁছা-মাথা কয়েদি। গর্দান ফুলিয়ে বলে, বললাম, সাহেব বাজি ধর–তুমি কিনা বড়ে এংরাজবালা শাবি আর আমি কিতনা বড়ে ফয়জাবাদী শরাবী, যাচাই হয়ে যাক। সাহেব বলল, অলরাইট। বাজি কী হবে? শরাব খেতে খেতে যার আঁখ আগে লাল হয়ে যাবে, সে নাঙ্গা (উলঙ্গ) হয়ে কাপড়া-কুর্তা মাথায় বেঁধে ঘরে যাবে।

বহুত আচ্ছা, বহুত আচ্ছা–

এক কয়েদি বলল, তুই তো সাধুর দলে ছিলি। বিন্ধ্যাচল পাহাড়ের নিচে তোদের আস্তানা ছিল। তুই কেমন করে ফয়জাবাদী শরাবী হলি?

আ বে শালে, আমি সাধুবাবা, তামাম দুনিয়া ছুঁড়ে বেড়াই। যখন যেখানে থাকি তখন সেটাই আমার মুল্লুক। সাধুর দল নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে সেবার ফয়জাবাদে গিয়েছিলাম। ফয়জাবাদই তখন আমার মুল্লুক।

বহুত আচ্ছা, বহুত আচ্ছা–কয়েদিরা শোরগোল বাধিয়ে দেয়।

শোন শালেরা, আগে সব শুনে নে। চিল্লাস না। পেটি অফসার এলে হাড্ডি চুর চুর করে দেবে। চাঁছা-মাথা বিপুল উদ্যমে বলতে থাকে, তারপর শরাব গেলা শুরু হল। দারু খেতে অন্য যারা দোকানে এসেছিল, মজা দেখার জন্যে আমাদের ঘিরে ধরল। শরাব গেলার লড়াই বাধল সাদা আদমী আর কালা আদমীতে। এক বোতল গেল, দুবোতল গেল, তিসরা বোতলে সাহেব বেসামাল হয়ে পড়ল। নেশার আরামে আঁখ বুজে এসেছিল। চারপাশের লোকজনের চিল্লনিতে তাকালাম, সাহেবের আঁখ টকটকে লাল। সাহেব দেখল, আমার আঁখ বিলকুল সফেদ–

তারপর কী হল?

কয়েদিরা আবার হল্লা বাধায়।

চাঁছা-মাথা বলে, কী আবার হবে? কুর্তা প্যান্ট মাথায় বেঁধে সাহেব সেই রাতেই ফয়জাবাদ ছেড়ে কোথায় গেল, রামজি মালুম।

চাঁছা-মাথাকে ঘিরে চেঁচিয়ে গলা ফাটিয়ে কয়েদিরা তার গল্পের তারিফ করে।

চাঁছা-মাথা বিমর্ষ গলায় বলে, এংরাজবালাকে শরাবে কাবু করলাম। লেকিন কালাপানি এসে এক বুঁদ দারু পড়ছে না গলায়। চারপাশে দরিয়ায় এত পানি, আমার তিয়াসই খালি মিটছে না।

আর একপাশে অন্য এক কয়েদি বলল, দুনিয়া বানানেবালার আর একটু মেহেরবানি থাকলে খুনখারাপি কিছুই থাকত না। দুনিয়ায় আওরত বড় কম। যদি আরো মেয়েমানুষ পয়দা হত! মেয়েমানুষ নিয়েই এখানে যত গণ্ডগোল, বুঝলি মুরুখ–বলে বিজ্ঞের মতো হো হো করে হাসে। যেন এমন কিছু সে আবিষ্কার করে ফেলেছে, আগে যা কারো নজরে পড়েনি।

মনটা আজ সজুত নেই লখাইর। কয়েদিরা হরেক রকমের কিত্সায় মশগুল হয়ে রয়েছে। লখাই তাদের পাশ দিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কখনো বা সেন্ট্রাল টাওয়ারের চুড়োয় সাগরপাখিটার দিকে তাকিয়ে থাকে।

D টিকিট মার্কা কয়েদিরা গারখানার ঘাস এবং আগাছা নির্মূল করছে। কেউ কেউ বা ইমারত ধুয়ে সাফ করছে। অন্যমনস্ক, লক্ষ্যহীন লখাই মাঝে মাঝে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। আবার কয়েদখানার এ-প্রান্ত ও-প্রান্ত একা-একাই হাঁটে। আন্দামানে এসে একটা অদৃশ্য নতুন মন পেয়েছিল লখাই। যে মন ভাবে, যে মন ভাবতে ভাবতে বিরাট শরীরের শিরা স্নায়ু এবং বোধগুলিকে বিকল করে দেয়। আশ্চর্য, সেই মনটা এখন একেবারেই ফঁকা।

কয়েদিদের জটলায় গিয়ে যে বসবে তেমন ইচ্ছাও করে না লখাইর। সেই এক পুরনো কেচ্ছা–আওরত, নেশা, খিস্তিখেউড়। কালাপানির কয়েদখানায় নারী এবং নেশা মেলে না। কিন্তু আওরত এবং শরাবের কল্পনায় বিভোর কয়েদিদের কথায় এবং চিন্তায় কুৎসিত অশ্লীল রস গেঁজে ওঠে। নারীসঙ্গহীন, নিরুৎসব বন্দিজীবনে নারী আর নেশার বীভৎস কেচ্ছা তারিয়ে তারিয়ে বলেই যেন সুখ পায় তারা। সেলুলার জেলের আদিকাল থেকে এই সব কেচ্ছার ঢালা স্রোত বয়ে চলেছে। যতকাল এর অস্তিত্ব থাকবে, এই স্রোতও বইতে থাকবে। এক মুহূর্তও থামবে না।

লখাইর কী যে হয়েছে। কিছুই ভাল লাগে না। নারী নেশা, এই পৃথিবীর কোনো কিছুতেই তার বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই।

রোদের রং বদলে যাচ্ছে। দরিয়ার রোদ-তীক্ষ্ণ, ধারাল, জ্বালাময়। সেলুলার জেলের বিরাট বিরাট ইমারত ছাপিয়ে সেই রোদ কয়েদিদের জটলাগুলির ওপর এসে পড়েছে। এখন কত বেলা, কে জানে!

হঠাৎ যেন মাটি খুঁড়ে উঠে এল মানুষটা।

ম্যায় আ গ্যয়া–আজ সেই ছুটির দিন। ইয়াদ আছে শালেদের?

কয়েদিদের জমজমাট আসর চমকে উঠল। সবাই দেখল, ওয়ার্কশপের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে দীর্ঘ এক মূর্তি। পীরজাদা মৌলানা জাজিরুদ্দিন হাজী।

জাজিরুদ্দিন চিল্লায়, কি রে শালে লোগ, সেদিন যে কিতাবগুলো দিয়েছিলাম, পড়েছিস?

সকলে সমস্বরে সায় দেয়, জরুর।

কেমন লাগল?

বহুত আচ্ছা।

জাজিরুদ্দিন এবার গম্ভীর হয়ে বয়েৎ আওড়ে বলে তোরা সব ইসলামি বনে যা। মুছলমান হলে আল্লার দুআয় কোনো ঝামেলা থাকবে না, দুখ থাকবে না, বহুত সুখ হবে।

হাঁটতে হাঁটতে ফাঁসির কয়েদিদের যে তিনটে সেলে রাখা হয়, সেদিকে চলে গিয়েছিল লখাই। জাজিরুদ্দিনের গলার আওয়াজ পেয়ে গুটি গুটি ওয়ার্কশপের সামনে এসে দাঁড়ায়।

লখাইকে দেখে জাজিরুদ্দিন ডাকে, এই লখাই, এদিকে আয়–

লখাই দেখল, জাজিরুদ্দিনের দু’পাশে তোরাব আলি আর ভিখন আহীর ঘুর ঘুর করছে।

কাছাকাছি আসতেই লখাইর একটা হাত ধরল জাজিরুদ্দিন। দু’পাটি দাঁতে ঝিলিক হেনে হাসল। হাসির সঙ্গে সঙ্গে ঘন দাড়ি যেন পেখম মেলল।

জাজিরুদ্দিন বলে, কিতাব পড়েছিস লখাই?

কোন কিতাব?

শিবকা সাথ মুহম্মদের লড়াই, আলিকা সাথ হনুমানকা যুদ্ধ, আর সোনাভান বিবিকো কিত্সা। তিন কিতাবই মজাদার।

পড়েছি। আচ্ছা নেহী।

আচ্ছা নেহী। চোখ দুটো ধক করে জ্বলে ওঠে জাজিরুদ্দিনের। হাতের থাবায় এবং দাঁতে হত্যা যেন ঝিলিক মারে। জাজিরুদ্দিন গর্জায়, তোকে খতম ফেলব কুত্তাকা বাচ্চা–

এক ঝটকায় জাজিরুদ্দিনের থাবা থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নেয় লখাই। বলে, তোর মতো জানলেনেবালা আমি অনেক দেখেছি রে জানবর। শালা, বড় মরদ এসেছে! কুনো কালে শিবের সঙ্গে লড়ে কেউ পারে, না পারে হনুমানের সঙ্গে? শিব আর হনুমান কত বড়

জোয়ান, তুই বুঝবি কি রে নালায়েক বুদ্বু। অ্যায়সা কেতকা হাঁকাবো!

জাজিরুদ্দিন কিছুই বলল না। একদৃষ্টে লখাইর দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখজোড়া একটু একটু করে ভয়ানক হয়ে উঠতে লাগল। মনে হল, এই মুহূর্তে সে লখাইর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, তাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকবরো করে ফেলবে।

জাজিরুদ্দিনের চোখে চোখ রেখে সন্তর্পণে দু’পা পিছু হটল লখাই। বলল, জানিস শালে, শিব দক্ষযজ্ঞ পণ্ড করেছিল, হনুমান গন্ধমাদন মাথায় তুলেছিল। শিব আর হনুমান কত বড় মরদ, তুই শালে পাঠানবালা কী বুঝবি!

জাজিরুদ্দিনের মতো দুর্দান্ত ভাগোয়া কয়েদিকে পরোয়া করে না যে লখাই, তার সম্বন্ধে বিস্ময়ে ভয়ে তাজ্জব বনে গিয়েছে নয়া কয়েদিরা। কেউ এতটুকু শব্দ পর্যন্ত করছে না।

এমন সময় এক কাণ্ড ঘটে গেল। কয়েদিদের জটলায় একজোড়া গোলাকার চোখ ধকধক করছিল। নির্মম চোখ দুটো থেকে হিংস্রতা ঠিকরে পড়ছিল। চোখজোড়া সেই চাঁছা-মাথা কয়েদির। নাম তার বিরসা। আশ্চর্য! একটু আগেই তরিবত করে রসিয়ে রসিয়ে সে শরাবের কেচ্ছা শোনাচ্ছিল।

আচমকা লাফিয়ে উঠে পড়ল বিরসা। হুঙ্কার ছাড়ল, মারো শালে জাজিরুদ্দিনকো। মার ডালো। হিন্দুনোগদের ধরে ধরে ইসলামি বানাবার মতলব করছে!

বিরসার বাঁ চোখের নিচে গভীর ক্ষতচিহ্ন। ফলে সারাক্ষণই চোখটা ভয়ঙ্কর ভঙ্গিতে কুঁচকে থাকে।

বিরসা ধাঁ করে ছুটে এল। জাজিরুদ্দিনের গলাটা দুই থাবায় আঁকড়ে ধরল। তার ভাঙা ভাঙা, ধারাল নখগুলি জাজিরুদ্দিনের মাংসল গর্দানে গেঁথে যেতে লাগল।

গলনালীর মধ্য দিয়ে পিষ্ট, কুণ্ডলিত, অস্ফুট একটা গোঙানি বেরিয়ে এল জাজিরুদ্দিনের। চোখদুটো ঠিকরে বেরিয়ে পড়ার উপক্রম হল।

সাঙ্ঘাতিক কিছু একটা ঘটে যেতে পারত। কিন্তু তার আগেই বিরসা আর জাজিরুদ্দিনের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল ভিখন আহীর। বিরসার খাড়া চোয়ালে প্রচণ্ড এক ঘুষি বসিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে জাজিরুদ্দিনের গর্দান থেকে বিরসার থাবাটা খসে পড়ল।

একটু ধাতস্থ হয়ে বিরসার দিকে তাকাল জাজিরুদ্দিন। দৃষ্টিটা কুটিল, ভীষণ, জিঘাংসু হয়ে উঠেছে। উত্তেজনায় দাঁতে দাঁত ঘষার শব্দ হচ্ছে। মজবুত, কঠিন শরীরটা থরথর কাঁপছে। এই মুহূর্তে তার প্রতিশোধ চাই। নিষ্ঠুর, মারাত্মক প্রতিশোধ।

এক পা দু পা করে বিরসার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল জাজিরুদ্দিন। বিরসার নখের খোঁচায় গর্দান থেকে খুন ঝরছে, চামড়া ছিঁড়ে জ্বালা করছে। সেদিকে এতটুকু লক্ষ্য নেই তার।

বিরসা নামে কয়েদিটির একটা বিচিত্র অতীত আছে।

বিশ রোজ আগে লখাইদের সঙ্গে এলফিনস্টোন জাহাজে সে আন্দামান এসেছিল। এই বিশটা দিনের আগে আছে তার দীর্ঘ চল্লিশ বছরের একটা জীবন।

বিরসা যখন হিংস্র হয়ে ওঠে তখন সমস্ত মুখে বাঁ চোখের গভীর ক্ষতচিহ্নটি ছাড়া আর কোনো রেখা পড়ে না। সেই নিরেখ কঠিন মুখে কোথায় যেন চল্লিশ বছরের সাজ্ঞাতিক ইতিহাসটা ফুটে বার হয়।

জন্ম তার কোথায়, নাসিকে না জব্বলপুরে, আজ আর মনে নেই বিরসার। সেটা তার জিন্দেগীর বিস্মৃত, অবলুপ্ত অধ্যায়।

জীবনের প্রথম যে-অংশটা মনে পড়ে, তখন বিরসার বয়স সাত আট বছর।

ইলাহাবাদে, প্রয়াগের চারপাশে, গাঁওয়ে গাঁওয়ে, শহরে শহরে, কখনো বা ঘন জঙ্গলে ভান্তুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াত বিরসা।

ভান্তুরা উত্তর প্রদেশের এক বিচিত্র জাতের মানুষ। এরা রাজপুতদের বংশধর। এদের রক্তে আদিপুরুষের বীরত্ব আছে, শৌর্য আছে। কিন্তু ঘরবাড়ি এবং মাটি হারিয়ে ভান্তুরা এখন যাযাবর। শহরে শহরে, গাঁওয়ে গাঁওয়ে কয়েকদিনের জন্য তারা তাবু ফেলে। অল্প সময়ের বসবাসের সাক্ষ্য হিসাবে পোড়া উনুন, হাঁড়ি, দুএক টুকরো চাপাটি রেখে আবার নতুন আশ্রয়ের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে।

খুনখারাপি, রাহাজানি, লুটপাট ভান্তুদের পেশা।

এই ভাস্তুদের সঙ্গে ঘুরত বিরসা। যাযাবর ভান্তুরা যেখানে যেখানে তাবু ফেলত, সেখানে সেখানে সে-ও আশ্রয় পেত। নিজের বাপ-মার খবর জানে না বিরসা। এত বড় আশমানের নিচে, এত বড় দুনিয়ায় কোন কোন মানুষটার সঙ্গে যে তার রক্তের সম্বন্ধ তা তার অজানা। শুধু মনে আছে, ভান্তুদের সঙ্গে তার দুচার টুকরো চাপাটি আর মাথা গোঁজার সামান্য আশ্রয় ছাড়া আর কোনো সম্পর্ক নেই। কেমন করে এ-সব খবর জানল, তা-ও জানে না বিরসা। কেমন করে ভান্তুদের দলে জুটেছিল, তা-ও আজ মনে নেই।

ভান্তুদের দল থেকে আর্য সমাজী সাধুদের পাল্লায় গিয়ে পড়েছিল বিরসা।

সেবার লখনউ শহরের কাছে তাবু ফেলেছে ভান্তুরা। একটু দূরে টিলার মাথায় একদল সাধুও আস্তানা গেড়েছে। গাঁজা পুড়ছে, ঘিউ চাপাটি বানানো হচ্ছে, আর মাঝে মাঝে হল্লা উঠছে, হর হর, ব্যোম ব্যোম–

কী কারণে যেন সেবার তিন রোজ ভান্তুদের তাবুতে খানা জোটেনি বিরসার। দুচোখে অন্ধকার দেখতে দেখতে সাধুদের আস্তানায় এসেছিল সে।

সাধুরা ঘিউ চাপাটি দিল, সীতাফল ভাজি দিল। এমন চাপাটি আর ভাজি কোনো কালে খায়নি বিরসা।

দুরোজ সাধুরা টিলার মাথায় ছিল। এই সময়টা মুহূর্তের জন্যও তাদের সঙ্গ ছাড়েনি বিরসা, ভান্তুদের তাঁবুর দিকেও যায়নি। জন্ম থেকে এই আট দশ বছর বয়স পর্যন্ত একটা দিনও তার ভরপেট খানা জুটেছে কি না, বিরসা মনে করতে পারে না।

দুরোজ বাদেই সাধুরা লোটা কম্বল, তল্পিতল্পা গুটিয়ে রওনা হল। তারা হাঁটা-পথে বিন্ধ্যাচল যাবে।

সাধুরা জিজ্ঞেস করল যাওগে বেটা?

বিরসা সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় কাত করল।

সাধন মার্গের লোভে নয়, শুধু মাত্র চাপাটি ভাজির টানে ভাস্তুদের ছেড়ে আট দশ বছরের বিরসা সাধুদের সঙ্গ নিল। নিজের অজান্তেই এক জীবন থেকে আর এক জীবনে জুটে গেল। লখনউ থেকে বিন্ধ্যাচল। এক পথ থেকে আর এক পথ।

হাঁটা পথে বিন্ধ্যাচল পৌঁছতে কতদিন লেগেছিল, আজ আর মনে নেই বিরসার। শুধু মনে পড়ে, বিরাট পাহাড়ের নিচে তারা আস্তানা গাড়ল। যথারীতি তিনখানা ইট সাজিয়ে চাপাটি সেঁকে ঘিউ মাখানো শুরু হল। গাঁজা পুড়তে লাগল। বোটকা, কটু ধোঁয়ায় বিন্ধ্যাচলের পাহাড়তলির শ্বাস বন্ধ হয়ে এল যেন।

এর মধ্যেই একদিন বিরসার দীক্ষা হয়ে গেল। বড় সাধুবাবাই কানমন্ত্র দিলেন।

কিসের একটা যোগ যেন ছিল সেদিন। সাধুদের আস্তানার পাশেই ছোট পাহাড়ী নদী। সকাল থেকে দলে দলে মানুষের ভিড় লেগেছে।

সূর্য ওঠার আগে মহালগ্নে নদী থেকে একটা ডুব দিয়ে এল বিরসা। চেলা বাবারা তার সারা গায়ে ভস্ম মাখিয়ে দিল। তিন টুকরো হলুদে ছোপানো নয়া কাপড় আনা হল। এক টুকরোয় কৌপীন হল, এক টুকরো হল উত্তরীয়, এক টুকরো দিয়ে চোখ বাঁধা হল।

তারপর বিরসার জিভ ছুঁড়ে লোহার শলা ঢোকান হল। রীতি অনুযায়ী একমাস মৌনীবাবা সেজে থাকতে হবে তাকে।

বড় সাধুবাবা কাপড় বাঁধা কানে ফুঁ দিয়ে মন্ত্র পড়লেন। চেলা বাবারা চেঁচিয়ে উঠল, হর হর, ব্যোম ব্যোম–

বিরসা বালক সাধু হয়ে গেল।

এরপর একে একে দিন যায়, মাস যায়, বছর ঘোরে। বিরসা জোয়ান হল। আঠা মাখিয়ে চুলে জটা বানানো হল। গোঁফ দাড়ি বেরুল তার। একসময় একটা দুটো করে সেই দাড়িগোঁফে পাকও ধরতে লাগল।

বিন্ধ্যাচলের সেই অংশটা নির্জন। নির্জন হলেও লোকালয় থেকে খুব দূরে নয়। পাহাড়ী নদীটার ওপারে ছড়ানো ছিটানো কয়েকটা গাঁও। তাছাড়া অড়হরের খেত। গাঁও-ক্ষেতিবাড়ি পেরুলে একটা শহরও নাকি আছে। সেখানে বড় বড় শেঠেদের গদি।

ক্রমে ক্রমে বিরসা জেনেছে, বিন্ধ্যাচলের এই পাহাড় যেমন আস্তানা দিয়েছে, তেমনি সাধুদের খানা জোগাচ্ছে শহরের সেই বড় বড় শেঠেরা। শেঠেদের পাঠানো আটা ঘিউ মরিচ লবণ দিয়ে এতগুলো সাধু জীবাত্মা বাঁচিয়ে মহাত্মা বনে পরমাত্মার ধ্যান করে।

এমনি করেই দিন চলত। কিন্তু পাহাড়তলিতে আর একদল সাধু এল। নতুন সাধুরা উদাসী সম্প্রদায়ের।

শুধু গাঁজা পোড়ানো চাপাটি আর সেঁকাই নয়, বিরসাদের দলের অন্য কাজও ছিল। হিন্দু ধর্ম থেকে ভ্রষ্ট হয়ে যারা অন্য ধর্মের পাল্লায় পড়েছে, তাদের আবার হিন্দু বানানোই ছিল আর্য সমাজীদের কাজ। এর জন্য প্রায়শ্চিত্ত, যাগযজ্ঞ লেগেই ছিল বিন্ধ্যাচলের পাহাড়তলিতে।

সেটা ছিল শুক্লপক্ষের রাত।

চেলাবাবারা কোত্থেকে যেন দুটো মানুষকে ধরে এনে বড় সাধুবাবার সামনে হাজির করল। লোক দুটো আগে হিন্দুই ছিল, অভাবে খ্রিস্টান হয়েছে।

যথারীতি যাগযজ্ঞ প্রায়শ্চিত্তের পর শুদ্ধ করিয়ে তাদের আবার হিন্দু বানাবার কাজ চলছিল, এমন সময় উদাসী সম্প্রদায়ের সাধুরা বাধা দিল।

উদাসীদের বড় সাধুবাবা গর্জে উঠল, এ হবে না, খ্রিস্টানের হিন্দু হবার অধিকার নেই।

আর্য সমাজী সাধুবাবার বাজখাঁই স্বরে তেজ এতটুকু কম নয়, জরুর হবে। হিন্দু ধরম ছেড়ে অনেকে ভিন ধরম নিয়েছে। তাদের ফের যদি হিন্দু না বানাই, একদিন এই জগৎসে হিন্দু ধরম লোপ পেয়ে যাবে।

লোপ পাক, তবু খ্রিস্টান আর হিন্দু হবে না।

হবেই।

এর পরেই উদাসী বাবাদের সঙ্গে আর্য সমাজীদের লড়াই বেধে যায়। বিন্ধ্যাচলের পাহাড়তলিতে পরমাত্মার সন্ধানী দুই দল নিরাসক্ত যোগী ত্রিশূল, লোটা এবং ডাণ্ডা হাতে পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়াল।

অনেকের মাথা ফাটল। কলিজা কুঁড়ে ত্রিশূলের ফলা ও-পিঠে বেরিয়ে গেল। খুন ছুটল। সাধুদের চিৎকারে আর্তনাদে এবং রক্তে বিন্ধ্যাচলের পাহাড়তলি আদিম রণভূমি হয়ে উঠল।

পরদিন এল পুলিশ। দুই দলের অনেকেই জখম বা খুন হয়েছে। বাকি যারা জিন্দা ছিল, তাদের ধরে সদরে চালান দেওয়া হল। বিরসাও সেই চালানী দলে ছিল। সদরে বিচার হল। তামাম জিন্দেগীর সাজা নিয়ে কালাপানি পেরিয়ে আন্দামান এল সে।

এই হল বিরসার অতীত ইতিহাস।……

এক পা এক পা করে হিংস্র ভঙ্গিতে এগুচ্ছে জাজিরুদ্দিন। যে-কোনো মুহূর্তে সে বিরসার ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।

বিরসাও তিন কদম পিছু হটে সতর্ক হয়ে রয়েছে। দাঁতে দাঁত ঘষে সে গর্জাচ্ছে, শালে, জিন্দেগীভর ভিন ধরমের আদমী ধরে ধরে হিন্দু বানালাম। আর হারামী, আমার আঁখের সামনে তুই হিন্দুলোগদের ইসলামি বানাবি! জান তুড়ে দেব।

দুই পা জোড়া করে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তাক করছিল জাজিরুদ্দিন। পেছন থেকে তার কোমরটা জাপটে ধরল ভিখন আহীর।

জাজিরুদ্দিন খেঁকিয়ে উঠল, এ কুত্তীকা বাচ্চা—

জি—

আমার কোমর পাকড়ালি কেন? ওই শালের জান না নিলে আমার খুন ঠাণ্ডা হবে না।

সামনে থেকে বিরসা টিপ্পনী কাটল, তোর মাফিক জানলেনেবালা আমি বহুত দেখেছি রে জাজিরুদ্দিন। আয় না, কে কার জান নেয় দেখি। বিরসার গোলাকার চোখজোড়া স্থির হয়ে জ্বলতে লাগল।

কী হত বলা যায় না, জটলার মাঝখান থেকে এক কয়েদি উঠে দাঁড়াল। চেহারা দেখে বুঝবার জো নেই, আদমীটা মালাবার না বালুচিস্থান, মারাঠা না আসাম, কোন মুল্লুকের। বুঝবার জো নেই, আদমীটা হিন্দু না বৌদ্ধ, খ্রিস্টান না মুসলমান।

দুটো লম্বা লম্বা হাত দু’দিকে বাড়িয়ে কয়েদিটা চেঁচায়, ঠার যা–।

তার স্বরে এমন কিছু রয়েছে যাতে এগিয়ে আসতে আসতে জাজিরুদ্দিন থমকে গেল। চারপাশের কয়েদিরা চমকে ওঠে।

আজব কয়েদিটা বলে, শোন সবাই, আমি একটা কথা বলি।

কী কথা? চারপাশ থেকে অন্য কয়েদিরা ঘন হয়ে এল।

বিরসা আর জাজিরুদ্দিন লড়াই করছে। জাজিরুদ্দিনের মতলব, ও সবাইকে ধরে ধরে ইসলামি বানায়। আর বিরসার মতলব, ও কাউকে ইসলামি হতে দেবে না। দুজনেরই মতলব আচ্ছা। লেকিন একটা কথা–চোখ দুটো চারপাশে চরকির মতো ঘুরিয়ে আনল আজব কয়েদি। বলতে লাগল, কথাটা হল, আসছে ছুটির রোজ বিরসা আর জাজিরুদ্দিনের লড়াই হবে। লড়াইর সময় কয়েদখানার সব কয়েদি সাক্ষী থাকবে। জাজিরুদ্দিন হারলে তাকে হিন্দু বনতে হবে। আর বিরসা হারলে তাকে ইসলামি বনতে হবে। রাজিবাজি?

বিরসা বলল, রাজিবাজি।

জাজিরুদ্দিন বলল, রাজিবাজি।

চারপাশের কয়েদিরা হল্লা করে উঠল, রাজিবাজি।

একধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখল লখাই, সব শুনল। একটু পর চোখে পড়ল, ওয়ার্কশপের গা ঘেঁষে ভাণ্ডারার দিকে যাচ্ছে জাজিরুদ্দিন। তার পাশাপাশি ঘনিষ্ঠ ভঙ্গিতে চলেছে ভিখন আহীর ও তোরাব আলি।

এখন কত রাত, কে বলবে।

আকাশে খণ্ড খণ্ড মৌসুমি মেঘ। মেঘের সঙ্গে যুঝে যুঝে যেটুকু চাঁদের আলো আসছে, তাতে বঙ্গোপসাগরের এইদ্বীপের কিছুই স্পষ্ট নয়। আকাশ, মেঘ আর ক্ষয়িত চাঁদের দিকে তাকিয়ে রাতের বয়স আন্দাজ করা মুশকিল।

সেলুলার কয়েদখানাটাকে অতিকায় জানোয়ারের কঙ্কালের মতো দেখাচ্ছে।

রাত বাড়ে, রাত গাঢ় হয়। ব্লকে ব্লকে কয়েদিদের কোনো শব্দ পাওয়া যায় না। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু নিদ নেই ওয়ার্ডারদের চোখে। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরে তারা চৌকি দিচ্ছে। সেলে সেলে উঁকি মেরে পরখ করছে, কোনো কয়েদির মাথায় বদ মতলব ঘুরছে কিনা। কারো দিলে শিকলি কাটার শখ জেগেছে কিনা।

সপ্তাহের একমাত্র ছুটির দিনটা ফুরিয়ে গেল। দিনটা এসেছিল মন্থর গতিতে, চলে গেল কালোয়াতী গানের দ্রুত একটা রেলার মতো।

বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে শীত এবার বেশ জাঁকিয়েই পড়েছে। একটা কম্বল পেতে, আর একটা কম্বলে আগাপাশতলা মুড়ি দিয়েছে লখাই।

অনেকক্ষণ শুয়েছে সে, কিন্তু ঘুম আসছে না। কম্বলের শক্ত রোঁয়াগুলো গায়ে বিধছে। অনেকক্ষণ ছটফট করল লখাই, এপাশ ওপাশ করল। তবু ঘুম আসে না। কপালের দু’পাশে দুটো রগ সমানে লাফায়।

আজ দরিয়া বুঝি উন্মাদ হয়ে উঠেছে। বিরাট বিরাট হালফা (ঢেউ) উঠছে। গজরাতে গজরাতে সমুদ্র পাথুরে দেওয়ালে অবিরাম আছাড় খায়। নারকেল বনে খ্যাপা বাতাসের তাণ্ডব বাড়তেই থাকে।

হঠাৎ মনে পড়ল, রোজ রোজ সোনিয়া যাচ্ছে রস দ্বীপের সিকমেনডেরায় (হাসপাতালে)। ভিখন আহীর খবরটা জুটিয়ে এনেছিল। মনে পড়ল, শক্ত রকমের ব্যারাম বাধাতে না পারলে রস দ্বীপের সিকমেনডেরায় যাওয়ার কোনো সুযোগই মিলবে না। সেলুলার কয়েদখানার ডাক্তার সাহেবরাই দাওয়াই দিয়ে রোগ সারিয়ে দেবে।

রোগ বাধাবার বন্দোবস্তও করেছে ভিখন আহীরই। দু’দিন ধরে সমানে পিনিক জুগিয়ে যাচ্ছে। আজও বিকেলে খানিকটা পিনিক দিয়ে গিয়েছিল। পিনিক লখাইর ধাতে সয় না। এই বস্তুটা বেশি পরিমাণে ফুকলে লখাইর পেট ফোলে, মুখের মধ্যে ঘা হয়, ভীষণ শ্বাস কষ্ট শুরু হয়।

কম্বলটা গুটিয়ে একপাশে ছুঁড়ে ফেলল লখাই। ভাবল, সোনিয়ার সঙ্গে দেখা করতেই হবে। পুরো একটা রাত ঝড়ের দরিয়ায় যে সাথী হয়েছিল, তাকে এত সহজে ভোলা যায় না। শক্ত রকমের একটা রোগ বাধাতেই হবে তাকে।

ভাবার সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু হল। যে কম্বলটা পাতা রয়েছে, সেটার ভঁজে পিনিক আর তামাকপাতা লুকিয়ে রেখেছিল লখাই। পিনিকটা তামাকপাতার ঠোঙায় পুরে সেলের গরাদের কাছে এসে দাঁড়াল। ভেতর থেকে যতদূর দেখা যায়, নজর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল। না, ওয়ার্ডারকে দেখা যাচ্ছে না।

এবার ধীরে সুস্থে কম্বলটার ওপর এসে বসল লখাই। তরিবত করে তামাকপাতায় পিনিক পুরে আগুন ধরাল। তারপর জুতসই এক টান দিল। টানের সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, মাথার খুলিটা চড়াৎ করে চার ফাঁক হয়ে গেল। দুচোখে শীতের অন্ধকার রাত্রিটা আরো অন্ধকার হয়ে গেল। গলার মধ্য দিয়ে অসহ্য, তীব্র ধোঁয়ার স্রোত কুণ্ডলী পাকাতে পাকাতে নিচের দিকে নামতে লাগল। মুহূর্তে সমস্ত শরীরটাকে বিকল করে দিল।

দম প্রায় বন্ধ হয়ে আসছিল। এই অবস্থায় পিনিকে আবার টান মারল লখাই। আবার, বার বার। একসময় আচ্ছন্নের মতো ঢলে পড়ল। কিছুই সে দেখতে পাচ্ছে না। প্রাণান্তকর নেশা তাকে গ্রাস করল যেন।

কতক্ষণ পর জ্ঞান ফিরল, খেয়াল নেই লখাইর। ততক্ষণে মৌসুমি মেঘগুলি পশ্চিম আকাশে অনেক দূর পাড়ি দিয়েছে। মরা মরা, বিবর্ণ আলো এখন উজ্জ্বল হয়েছে।

লখাইর মনে হল, খুলি ফাটিয়ে মগজটা ধোঁয়া হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। অসহ্য এক যন্ত্রণায় জিভ, চোয়াল আর গলা অসাড় হয়ে গিয়েছে। বুকের মধ্যে সেই তীব্র, ঝাঁঝালো ধোঁয়া পাক খাচ্ছে।

বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে এত বাতাস, তবু লখাইর মনে হল, শ্বাস নেবার মতো পর্যাপ্ত নয়।

কিছুক্ষণ বাদে চোখ মেলে লখাই দেখল, গরাদের কাছে একটা মুখ ঝুঁকে রয়েছে। মুখটা গরাদের ফাঁক দিয়ে অনেকটা ঢুকে পড়েছে। ওয়ার্ডার মোহর গাজী।

মোহর ডাকল, লখাই, এ লখাই—

লখাই জড়ানো গলায় জবাব দিল, হাঁ–

জোরে জোরে শ্বাস টেনে সেলের বাতাসে কিসের যেন গন্ধ পায় মোহর গাজী। ফের ডাকে, লখাই ভেইয়া–

জি—

ইধর আয়।

টলতে টলতে দেওয়াল ধরে ধরে গরাদের সামনে আসে লখাই, মোহর গাজীর মুখোমুখি দাঁড়ায়।

মোহর গাজী বলল, কতক্ষণ ডাকছি, শালে শুনতে পাচ্ছিস না?

ঘুম এসেছিল। হারামী, ঘুম এসেছিল!

চোখ দুটো ধক করে জ্বলে উঠল ওয়ার্ডার মোহর গাজীর। স্বরটাকে ঝুপ করে খাদে নামিয়ে ফেলল সে, আমার নাককে তুই ধোঁকা দিবি!

অনেকক্ষণ জ্বলন্ত চোখে, একদৃষ্টে লখাইর চোখের দিকে তাকিয়ে রইল মোহর। তারপর আস্তে আস্তে বলতে লাগল, খুদা আমাকে আর কিছু দেয় নি লখাই, লেকিন নাকটা ঠিক দিয়েছে। এই শালে নাক ঠিক বলে দিতে পারে, কোথায় কী হচ্ছে। কোথায় লাশ পচল, কোথায় খুন গিরল, কোথায় কে দারু গিলল। এই নাকের বহুৎ তাগদ।

গরাদের ফাঁক দিয়ে এবার দু হাত ঢুকিয়ে লখাইর গলাটা চেপে ধরে মোহর গাজী। বলে, বল শালে, একটু আগে পিনিক যুঁকছিলি না? ওয়ার্ডের ও-মাথা থেকে ঠিক টের পেয়ে গেলাম।

রীতিমতো ভয় পেয়েছে লখাই। করুণ, কাতর স্বরে বলল, হাঁ ওয়ার্ডারজি।

জানিস নালায়েক বুদ্বু, জেলার সাহিব টের পেলে বাপের শাদি, নানার নিকাহ্ একসাথ দেখিয়ে দেবে।

লখাই জবাব দিল না। শঙ্কিত, ভয়াতুর দৃষ্টিতে ওয়ার্ডারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

হারামী তুই বঙ্গালি, হামিভি বঙ্গালি, তাই ছেড়ে দিলুম। দুসরা কয়েদি হলে জান তুড়ে দিতাম। মনে রাখিস, অ্যায়সা বে-আইনি কাম কয়েদখানায় কভী করবি না। মনে থাকবে?

প্রশ্রয় পেয়ে লখাই বলে, নিঘাত মনে থাকবে।

এবার গরাদের ফাঁক থেকে মুখটা বার করে এদিক সেদিক ভাল করে দেখে নিল মোহর গাজী। নিঃসন্দেহ হয়ে ফিসফিস গলায় বলল, আর পিনিক আছে, না খুঁকে মেরে দিয়েছিস?

আছে ওয়ার্ডার দাদা, টানবে?

হাঁ বুদ্ধ, জলদি আন।

আধপোড়া পিনিকে আগুন ধরিয়ে আবার গরাদের সামনে এল লখাই। মোহরের দুই ঠোঁটে গুঁজে দিয়ে বলল, টান, কষে টান মার।

জুত করে পর পর গোটাকতক টান দিল মোহর। মুখ বুজে পিনিকের ধোঁয়া প্রাণান্তকর প্রয়াসে চেপে চেপে গলনালীর মধ্য দিয়ে নিচের দিকে নামাতে লাগল। চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসার উপক্রম হল। পিনিক জীর্ণ করে দুই নাকের মধ্য দিয়ে দুটো পাণ্ডুর ধোঁয়ার রেখা বার করে দিল মোহর। মুখে তৃপ্তির ছাপ পড়ল তার। বলল, আঃ, এমন পিনিক বহুৎ দিন যুঁকি নি।

পিনিকের নেশায় মাথাটা অল্প অল্প টলছে মোহরের। আবছা চাঁদের আলোতেও বোঝা যায়, চোখ দুটো টকটকে লাল। জড়ানো জড়ানো, গাঢ় স্বরে মোহর আবার বলল, পিনিকের ধোঁয়া মগজে ঢুকলে তার কথাটা মনে পড়ে যায় রে লখাই। এতদিনেও যে তাকে ভুলতে পারলাম না!

আগ্রহে গরাদের কাছে আরো ঘন হয়ে আসে লখাই। বলে, কার কথা বলছ ওয়ার্ডার দাদা?

দাঁড়া একটু। কয়েদিগুলোকে দেখে আসি। কোন শালার মাথায় কী মতলব ঘুরছে খুদাও জানে না।

সেলে সেলে উঁকি মেরে একবার ঘুরে এল মোহর গাজী। এখন সে একেবারে অন্য মানুষ। মোহর বলল, একটা গান শুনবি লখাই?

লখাই অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। পিনিক টেনে ওয়ার্ডারের হল কী!

লখাইর জবাব শোনার বিন্দুমাত্র গরজ নেই মোহরের। দুনিয়ার কোনোদিকে তার ভ্রূক্ষেপ নেই। গুনগুন করে সে গান ধরল :

মন রে আর ধর্য মানে না,
দিল রে আর ধর্য মানে না।
চাঁটিগাঁ ছাড়াইল মোরে পরীজান সোনা।
পরীজান রাস্তা দিয়া যায়,
ফির ফির তার শাড়ির আঞ্চল (আঁচল) বাতাসে উড়ায়।
তার চক্ষের বিজলি মনে করে দেয়ালা।

একটু থামে মোহর গাজী।

লখাই বলে, তারপর?

মোহর আবার গায়।

পরীজানের শাড়ির জবর উম,
বুকত জড়াইলে বুক জুড়ায়, চোখত আসে ঘুম।
আর ঠোঁটের কথা হুলে (শুনলে) পরান মূরছনা।
পরীজানের মাথায় কালা চুল।
য্যান মেঘের পিছে হাজার চেরাগ করে জুল জুল।
তার চোখ ডাকে ইশারায়, হাত করে মানা।
তার হাতত বাজু, পায়ত জোড়া মল।
আর বুকত দরদ, মুখত (মুখে) করে ছল।
ও আমার পরীজান সোনা–আ-আ-আ–

একসময় গান থামল। কিন্তু তার রেশ অন্ধকার রাত্রির সেলুলার জেলের দেওয়ালে দেওয়ালে হাহাকারের মতো মাথা কুটে মরতে লাগল।

কেউ কথা বলছে না। লখাইও না, মোহরও না। নিস্তব্ধ কয়েদখানা আরো নিঝুম হয়ে গিয়েছে। দূর থেকে বঙ্গোপসাগরের গর্জন আর নারকেল বনে বাতাসের মাতামাতি ছাড়া এইদ্বীপে আর কোনো শব্দ নেই। কায়েদখানার স্তব্ধতা আর দরিয়ার গর্জন মোহর গাজীর গানের সেই হাহাকারটাকে গভীর স্পর্শময় করে তুলেছে। সেটা যেন গরাদের এধারে ওধারে দুটো মানুষকে চারপাশ থেকে একটু একটু করে ঘিরে ধরছে।

লখাই-ই প্রথম কথা বলল, ওয়ার্ডার দাদা–

হাঁ–

তন্ময় হয়ে কী যেন ভাবছিল মোহর গাজী। লখাইর ডাকে ধড়মড় করে উঠল, হাঁ, কী বলছিস রে লখাই?

তুমি সেদিন বলেছিলে, বাংলা বুলি ভুলে গেছ। পাঠান পাঞ্জাবী টিণ্ডালরা পিটিয়ে পিটিয়ে বাংলা বুলি ভুলিয়ে দিয়েছে। তবে কেমন করে বাংলা গীত গাইলে?

খুব তাজ্জব বনে গিয়েছিস লখাই, তাই না রে? বিচিত্র গলায় মোহর গাজী বলল, সব ভুলে গেছি লখাই, বুলি ভুলেছি, গাঁও-মুলুক, বাপ-মা, সবার কথা ভুলেছি। লেকিন এই গানটা ভুলিনি।

কেন?

গানে পরীজান বিবির কথা আছে যে।

পরীজান বিবি কে?

হঠাৎ খেঁকিয়ে উঠল মোহর, পরীজানকে দিয়ে তোর দরকার কী? শালে নালায়েক, হারামী। বলেই চুপ করে গেল।

লখাই এই অদ্ভুত, রহস্যময় মানুষটার কূল-কিনারা পায় না। হতবাক হয়ে সে মোহরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মোহরের সঙ্গে রোজ রাতেই দেখা হয়, বাতচিত হয়, দু চারটে দিলের কথাও হয়। কিন্তু এই মোহরকে সে চেনে না। এই মোহর, যার দৃষ্টি উদভ্রান্ত, যার চোখের সামনে এখন এই দুনিয়ার কিছুই নেই, কোনো এক পরীজান বিবির ধ্যানে যে মগ্ন হয়ে আছে।

অনেকক্ষণ পর ঘোর ঘোর ভাবটা কাটল মোহরের। বুকটা চৌচির করে দীর্ঘশ্বাস পড়ল। ধরা গলায় সে বলল, দিলটা যেন কেমন করে উঠল, বুঝলি লখাই। পিনিকের ধোঁয়া মগজে ঢুকলে বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। পুরানা জামানার কথা মনে পড়ে। ছোড় শালে ও বাত।

সব ঝেড়েঝড়ে মুক্ত হয়ে গর্দান সিধা করে দাঁড়ায় মোহর গাজী।

কেমন একটা জেদ চেপে গেল লখাইর। মোহরের দুটো হাত চেপে ধরে বলল, না না, কিছুতেই ছাড়ব না ওয়ার্ডার দাদা। তোমার মনে জ্বালা রয়েছে। পরীজান বিবির কথা বল। বলতেই হবে।

লখাই হাত থেকে নিজের হাত দুটো ছাড়াবার চেষ্টা করল না মোহর। হঠাৎ মনস্থির করে ভেজা ভেজা কেমন এক আবেগের স্বরে বলল, ঠিক হ্যায়, সব কথা তোকে বলব লখাই, দিলের মধ্যে বড় জ্বালা। বুকের মধ্যে পন্দ্র সালের কথা জমে রয়েছে। লেকিন আজ না। আর একদিন শুনিস।

একটু থামল মোহর। লখাই দেখল, মোহরের চোখজোড়া চিকচিক করছে।

গাঢ়, অদ্ভুত স্বরে মোহর আবার শুরু করল, পরীজানের কথা ভাবার জন্যে কী কী আমি পিনিক যুঁকি। লেকিন তুই কার জন্যে যুঁকিস? মুলুকে দিলজ্বালানেবালী কাউকে রেখে এসেছিস নাকি?

আমি ফুঁকি সোনিয়ার জন্যে।

সোনিয়া কৌন?

আমার দিলজ্বালানেবালী এক কয়েদানী। একসাথ, এক জাহাজে আমরা কালাপানি এসেছি। লখাই বলল, তোমাকে দাদা বলেছি। বিশ্বাস করে একটা কথা বলব?

বল।

বিশ্বাস নষ্ট করবে না তো?

না, খুদা কসম।

ওয়ার্ডার দাদা, সোনিয়াকে আমার চাই। রোজ রোজ সোনিয়া রস দ্বীপের সিকমেনডেরায় (হাসপাতালে) যায়। আমিও যাব। পুরা একটা রাত ঝড়ের দরিয়ায় তার সঙ্গে কাটিয়েছি। তাকে আমার চাই ওয়ার্ডার দাদা। সোনিয়াকে সিধা শাদির কথা বলব।

এবার মোহর গাজীকে খুব চিন্তিত দেখায়। বলে, সবই তো সমঝ গিয়া। লেকিন তুই রসদ্বীপের সিকমেনডেরায় যাবি কেমন করে? ভারী বুখার না হলে কয়েদিলোগ সেখানে যেতে পারে না।

লখাই মিটিমিটি হাসে। বলে, ভারী বুখার আমার হবে।

মোহর গাজী খেঁকিয়ে উঠল, তামাশা ছোড় শালে। ভারী বুখার হবে কেমন করে? সব অ্যায়সা অ্যায়সা?

পিনিক আমার সয় না ওয়ার্ডার দাদা। ভারী বুখারের জন্যে পিনিক যুঁকছি। দু চার রোজ বাদে দেখবে চিতায় ওঠার হাল হয়েছে।

বিস্ময়ে তাজ্জব বনে যায় মোহর। কিছুক্ষণ তার মুখ দিয়ে একটি শব্দও বেরোয় না। তারপরেই সে সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল, শাবাশ লখাই, শাবাশ। আমি বলছি, উপরবালা তোকে মেহেরবানি করবেই। সোনিয়াকে তুই পাবি, জরুর পাবি।

গরাদের দু’পাশে দুটো মানুষ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইল। লখাই ওয়ার্ডার মোহর গাজীর দিলের তাপ অনুভব করে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress