Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সিন্ধুপারের পাখি || Prafulla Roy » Page 11

সিন্ধুপারের পাখি || Prafulla Roy

কয়েকটা দিন কানখাজুরার বিষে কাবু হয়ে ছিল লখাই।

আজ পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছে।

এখন জ্বালা যন্ত্রণা টাটানি, কিছুই নেই। কানখাজুরার বিষে ডান ঊরুটা সাঙ্ঘাতিক ফুলে উঠেছিল। ফোলা ভাবটা কমে সেটা স্বাভাবিক হয়েছে।

এই কটা দিন ঝুপড়ির মাচানে আচ্ছন্নের মতো পড়ে ছিল লখাই। দুনিয়ার কোনো কিছু সম্বন্ধে ভাবার মতো অবস্থাই ছিল না তার। দেহ এবং মন, দুটোই বিকল হয়ে পড়েছিল।

আজ পুরোপুরি সুস্থ হয়ে প্রথমেই কেন যে সে মিমি খিনের কথা ভাবল, কে জানে। মেয়েটার মুখ মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অস্থির হয়ে উঠল লখাই।

সেই যে উজাগর সিং তাকে মিমি খিনের খুপরিতে নিয়ে গিয়েছিল, তারপর আর পোর্ট মোয়াট যায়নি লখাই। মনে পড়েছে, মাত্র কয়েক পলকের জন্য মিমি খিনের মুখ দেখতে পেয়েছিল সে। তারপরেই দুই হাঁটুর ফাঁকে মেয়েটা ঘাড় গুঁজে দিয়েছিল।

কিন্তু যত অল্প সময়ের জন্যই দেখুক না, মিমি খিনকে ভুলতে পারেনি লখাই। তার শ্যামলা রং, নাকের সুঠাম ছাঁদ, তার কান্না, টানা টানা জলভরা দু’টি চোখ–কিছুতেই এ-সব ভুলবার নয়। এই মুখ, এই চোখ, এই নাক আগে কোথায় যেন দেখেছে লখাই।

অনেক বর্মী মেয়েই চোখে পড়েছে লখাইর, কিন্তু তাদের মুখের ভঁদের সঙ্গে মিমি খিনের মুখের ছাদ আদৌ মেলে না। এই কথাটা যত ভাবছে, মাথার ভেতরটা ততই গুলিয়ে গেছে।

বেলা বাড়ছে। দেখতে দেখতে আকাশ বেয়ে সূর্যটা অনেকখানি ওপরে এসে উঠল।

খানিক দূরে জঙ্গল ‘ফেলিং’-এর কাজ চলছে।

কিছুই ভাল লাগছিল না লখাইর। অস্থির মন নিয়ে আর যা-ই হোক, জবাবদারির কাজ চলে না। কিছুক্ষণ পর পর জবাবদারি ছেড়ে নিজের ঝুপড়িতে ফিরে আসছে। কখনও বা শিবরাম পাণ্ডের ঝুপড়িতে গিয়ে উঁকি মারছে।

তুষণাবাদের এই ‘বীটে’ যে পুলিশ জমাদারের খবরদারিতে লখাইরা থাকে, তার নাম শিবরাম পাণ্ডে। শিবরামের হুকুম ছাড়া কুলি-জবাবদার কারোর এই ‘বীট’ থেকে নড়ার উপায় নেই।

বার পাঁচেক শিবরামের ঝুপড়িতে উঁকি মেরেছে লখাই। কিন্তু গোল গোল দুটো চোখ, অস্বাভাবিক জমকালো একজোড়া গোঁফ, চাঁছা মাথার পেছনে মোটা একটি টিকি, গলার বাজখাঁই আওয়াজ, বিরাট দেহ–সব মিলিয়ে লোকটার চেহারাটা এমন সাঙ্ঘাতিক যে ভরসা করে আসল কথাটা বলতে পারেনি সে।

জঙ্গলের দিক থেকে আর একবার ঘুরে এল লখাই। সে স্থির করে ফেলেছে, যেমন করে হোক, আজ একবার পোর্ট মোয়াটে মঙ ফা’র ঝুপড়িতে যাবেই। মিমি খিন প্রবল এক আকর্ষণে তাকে ক্রমাগত টানছে।

‘বীটে’র সামনে ঘুরতে ঘুরতে কখন যে শিবরাম পাণ্ডের ঝুপড়িটার সামনে এসে পড়েছিল, হুঁশ নেই লখাইর।

হঠাৎ ভেতর থেকে কর্কশ স্বর ভেসে এল, এ শালে লখাই–

হাঁ জি–লখাই চমকে উঠল।

অন্দর আয় শালে–

গুটি গুটি পায়ে ভেতরে ঢুকল লখাই।

ঝুপড়িটার ডান দিকে মস্ত এক মাচান। তার ওপর জাঁকিয়ে বসে আছে শিবরাম পাণ্ডে। বুকের ওপর দিয়ে আড়াআড়ি এক গোছা লাল রঙের পৈতা। মোটা মোটা আঙুলে সেটা জড়াতে জড়াতে সে খেঁকিয়ে উঠল, কী মতলব তোর? সেই সকাল থকে আমার ঝুপড়ির সামনে ঘুর ঘুর করছিস?

লখাই থতমত খেয়ে গেল। ফস করে বলে ফেলল, না জি, আমার কোনো মতলব নেই।

মতলব নেই? দুই চোখে ফাঁদ পেতে কিছুক্ষণ লখাইর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল শিবরাম। তারপর মারমুখো হয়ে উঠল, উল্ল কঁহাকা। মতলব না নিয়ে কোনো শালে আমার কাছে ভেড়ে! অ্যায়সা অ্যায়সা কোনো হারামী কি আমার সাথ পেয়ার করতে আসে! বল কুত্তা, কী মতলবে এসেছিস?

লখাই নিচের পাটাতনের দিকে চোখ রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। একবার শিবরামের মুখের দিকে তাকিয়েই সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামাল। ভীরু, কাঁপা গলায় বলল, একটা দরকারে এসেছি পাণ্ডেজি।

কী দরকার?

বলতে ডর লাগছে।

ডর নেই, বল।

জমাদারজি, পুট মুটে আমার এক দোস্ত আছে। তার খুব বুখার। আপনি মেহেরবানি করে হুকুম দিলে তাকে একবার দেখে আসতে পারি।

মোটা গোঁফের সূক্ষ্ম প্রান্ত দুটো মোচড়াতে মোচড়াতে শয়তানি চালে হাসল শিবরাম। বলল, এই বাত? হুকুম মিলবে, লেকিন তার আগে দুটো কথা। তোর কোনো বদ ধান্দা নেই তো?

জি, না।

ভাগবি না?

এই জঙ্গলে কোথায় ভাগব?

ঠিক হ্যায়। এক মুহূর্ত কী যেন ভেবে নিল শিবরাম। তারপর বলল, হুকুম মিলবে, লেকিন অ্যায়সা অ্যায়সা না। হুকুমের জন্যে দাম লাগবে।

দাম!

হা রে বুদ্বু, নগদ দুটো রুপেয়া আর দুবোতল শরাব।

লখাই প্রায় চিৎকার করে উঠল, আরে বাপ রে বাপ! কোথায় পাব রুপেয়া? কোথায় পাব শরাব!

আঁই কুত্তা–লাফিয়ে মাচান থেকে নেমে পড়ল শিবরাম। লখাইর গর্দান ঠেসে ধরে চেঁচাতে লাগল, শালে, তুই মনে করেছিস, আমি টের পাইনি! ফরেস্ট অফসর উজাগর যাবার সময় তোকে তিন বোতল শরাব আর পাঁচটা রুপেয়া দিয়ে যায়নি?

হাঁ, জি।

এবার খোঃ খোঃ করে খুব একচোট হাসে শিবরাম। হঠাৎ হাসিটা থামিয়ে বলে, মনে করেছিস, এই ঝুপড়িতে থাকি বলে কিছুই টের পাই না! আরে উল্ল, এই যে আমার কান, তামাম আন্দামান ভূঁড়লে এমন লায়েক কান তুই পাবি না। এই ঝুপড়িতে থেকেই আমি বুঝি, কোন শালে কী বলছে, কী করছে।

হঠাৎ ওয়ার্ডার মোহর গাজীর কথা মনে পড়ল লখাইর। মোহরের সঙ্গে শিবরামের আশ্চর্য একটা মিল খুঁজে পায় সে। মোহরের যেমন নাক, শিবরামের তেমনি কান। দুজনের দুই ইন্দ্রিয় সাঙ্ঘাতিক তুখোড়।

অনেক দর কষাকষির পর শেষ পর্যন্ত এক বোতল শরাব আর একটা টাকাতে রফা হল। পোর্ট মোয়াটে যাবার হুকুম পেল লখাই।

আজ একটু আগে আগেই খাওয়া সেরে ফেলল লখাই।

পোর্ট মোয়াট রওনা হওয়ার আগে শিবরাম তাকে শেষ বারের মতো হুঁশিয়ার করে দিল, এখন দুপুর। সন্ধের আগে আগে ফিরে আসবি। বদ মতলব করে ভাগবি না শালে। ভাগতে তো পারবিই না, উলটে মারের চোটে জান যাবে। একটু থেমে বলল, এখানেও আর থাকতে পারবি না। আবার সেলুলার কয়েদখানায় ফেরত পাঠিয়ে দেব। পেটি অফসরেরা পিটিয়ে পিটিয়ে নানীর শাদি, বাপের শাদি সব এক সাথ দেখিয়ে দেবে।

রামজির নামে বার দশেক কসম খেয়ে লখাই বোঝাল, তার মনের কোথাও কোনোরকম অভিসন্ধি নেই। সে কিছুতেই পালাবে না। এ ব্যাপারে শিবরামজির ভাবনার কোনো কারণ নেই।

পোর্ট মোয়াটে মঙ ফা’র কুঠিতে এসে লখাই যখন পৌঁছল, বিকেল হয়ে গিয়েছে।

রোদে গলা সোনার রং ধরেছে। জঙ্গলের মাথায় এক ঝক হীরামন পাখি পাক খেয়ে খেয়ে উড়ছে।

মঙ ফা’র কুঠির ঠিক সামনেই দুটো গোলমোহর গাছ পরস্পর জড়াজড়ি করে বেড়ে উঠেছে। গোলমোহরের সোনালি পাতাগুলো বিকেলের রোদে চিকমিক করছে।

কদিন উজাগর সিংয়ের সঙ্গে রাত্তিরে এখানে এসেছে লখাই। তাই গোলমোহর গাছদুটো দেখতে পায়নি। বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে কোত্থেকে যে এই গাছ দুটো এসে পড়েছে, এখন সে-কথা ভাবার মতো মনের অবস্থা নয় লখাইর। সে উঁচু গলায় ডাকতে থাকে, মঙ ফা, এ মঙ ফা’জি–

কৌন, কৌন রে–

ঝুপড়ির ঝপ খুলে বাইরে বেরিয়ে এল মঙ ফা। লখাইকে দেখে খুশিতে তার খুদে খুদে চোখ দুটো চিক চিক করে। খুক খুক করে একটু হেসে সে বলল, আরে তুমি! এস এস ইয়ার। রোজই ভাবি আসবে, লেকিন আসো না।

আমাকে কানখাজুরায় কেটেছিল। কদিন মাচান ছেড়ে উঠতে পারিনি।

চুক চুক করে কেমন এক ধরনের শব্দ করে মঙ ফা। লখাইকে কানখাজুরায় কেটেছে। হয়তো সেজন্য দুঃখই জানায়। মঙ ফা’র মুখ দেখে বুঝবার জো নেই, তার এই দুঃখটা কতখানি খাঁটি আর কতটা কপট।

মঙ ফা ফের খাতির করে ডাকে, ওপরে এস ইয়ার।

কাঠের সিঁড়ি বেয়ে বাঁশের পাটাতনে উঠল লখাই।

হঠাৎ লখাইর কানে মুখ গুঁজে দিল মঙ ফা। ফিস ফিস করে বলল, মিমি খিনের জন্যে এসেছ তো ইয়ার?

হাঁ। নিচু গলায় বলল লখাই।

একটা রুপেয়া লাগবে জি।

কোমরের খাঁজ থেকে টাকা বার করে মঙ ফা’র হাতে দেয় লখাই। চক্ষের পলকে টাকাটা কুর্তার পকেটে ঢুকিয়ে দেয় মঙ ফা। তারপর বেশ খুশি গলায় বলে, আমার কারবার নগদা। টাকা যেমন দিয়েছ, ফুর্তির চীজও তেমনি পাবে। এস, এস ইয়ার। ঝাঁপ খুলে লখাইকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিল মঙ ফা। যাও, শেষ খুপরিতে মিমি খিন আছে।

ঝুপড়ির ভেতরটা ঝাপসা। কোনায় কোনায় কেমন এক ধরনের ধূসর অন্ধকার জড়িয়ে রয়েছে। বেড়ার গায়ে মাকড়সারা কত যে জাল বুনেছে, তার লেখাজোখা নেই।

গোসাপের চামড়ার গন্ধ, শুকনো মাছের গন্ধ, পচা মাংসের গন্ধ–সব মিলিয়ে একটা বোটকা দুর্গন্ধ মুহূর্তের মধ্যে লখাইর নাকটাকে ধাঁধিয়ে দিল।

বেড়ার গায়ে লম্বা লম্বা বর্মী দা আর বাঁকানো টাঙির ফলা ঝুলছে। বুকের ভেতরটা ছম ছম করে উঠল লখাইর।

এইরকম দুর্গন্ধ-ভরা, আধো অন্ধকার ঝুপড়িতে থাকার অভ্যাস নেই। তাই ধাতস্থ হতে বেশ কিছুক্ষণ লাগল লখাইর। তারপর আস্তে আস্তে, পা টিপে টিপে শেষ খুপরিটায় এসে পড়ল।

লখাইর দিকে পিঠ রেখে বসে রয়েছে মিমি খিন। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না।

খুপরিটার পেছন দিকে ছোট একটা ফোকর। খুব সম্ভব ফোকরের ভেতর দিয়ে বাইরের আকাশে পাখি দেখছে মিমি খিন।

চাপা গলায় লখাই ডাকল, মিমি খিন—

কে, কে? চমকে ঘুরে বসল মিমি খিন।

আমি লখাই। তোমার ইয়াদ নেই? সেই যে ফরেস্ট অফসরের সাথ তোমার এখানে এসেছিলাম।

কাঁপা, ভয়াতুর গলায় মিমি খিন বলল, কী চাই তোমার?

লখাই জবাব দিল না। অল্প একটু হাসল শুধু। চোখদুটো ধক ধক করছে তার। আর এই ধকধকানিতেই জবাবটা রয়েছে।

লখাইর মুখের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল মিমি খিন, তোমরা আমাকে মেরে ফেল, মেরে ফেল। আমি আর বাঁচতে চাই না।

দুই হাঁটুর ফাঁকে মাথাটা প্রবল বেগে ঝাঁকাতে থাকে মিমি খিন। উজাগর সিংয়ের সঙ্গে প্রথম দিন এসে লখাই যেমন দেখেছিল, তেমনি ফুলে ফুলে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল মেয়েটা।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটানা কান্নার শব্দ শুনতে থাকে লখাই। শুনতে শুনতে ভয়ানক বিরক্ত হয়ে ওঠে।

শিবরামের কাছ থেকে এখানে আসার হুকুম জোগাড় করতেই আস্ত একটি টাকা এবং এক বোতল শরাব খোয়াতে হয়েছে। তার ওপর মঙ ফা নিয়েছে আরো একটা টাকা। মোট দু’টি টাকা এবং পুরো এক বোতল শরাবের বদলে মেয়েমানুষের কান্না শুনবার মত শৌখিন মেজাজ নয় লখাইর।

সমানে কাঁদছে মিমি খিন। তার কান্না দুই কানে ক্রমাগত ঘা মারছে। বিরক্ত লখাই চোখ কুঁচকে একদৃষ্টে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে। বিরক্তিটা একটু একটু করে অদ্ভুত এক ক্রোধের রূপ নিল।

কিছু দিলে কিছু মিলবে, এটাই এই দুনিয়ার দস্তুর। অথচ লখাই শুধু দিলই। বদলে কিছুই পাচ্ছে না। লখাইর মনে হল, এই মিমি খিন যেন কারসাজি করেই কেঁদে কেঁদে একান্ত ন্যায্য এবং সঙ্গত দাবি থেকে তাকে বঞ্চিত করছে। কথাটা যতই ভাবছে, মেজাজ ততই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে।

কতক্ষণ যে মিমি খিনের কান্না শুনছে, লখাইর খেয়াল নেই। হঠাৎ আর একটা কথা মনে পড়তেই তার হুঁশ ফিরল। খুপরির পেছন দিকে যে ছোট ফোকরটা রয়েছে, তার মধ্য দিয়ে এক টুকরো আকাশ দেখা যায়। লখাই যখন এই খুপরিতে ঢোকে তখন সেই আকাশে গলা সোনার রং ছিল। এখন সেখানে বেলা শেষের বিষণ্ণ একটু আলো আটকে আছে। একটু পরেই সন্ধে নামবে। তার আয়োজন শুরু হয়ে গিয়েছে।

লখাই হচ্ছে সেই জাতের মানুষ, নারী নেশা অর্থাৎ দুনিয়ার তাবৎ ভোগের বস্তু চোখে পড়ামাত্র যে আয়ত্ত করতে চায়। আশ্চর্য, মিমি খিনের পাঁচ হাতের মধ্যে দাঁড়িয়ে বিকেলটাকে সন্ধে করে ফেলল, অথচ এখনও তাকে ছোঁয়নি পর্যন্ত।

লখাই ভাবতে চেষ্টা করল, তুষণাবাদের সেই নিদারুণ জঙ্গল কি তার মতো দুর্দান্ত খুনিয়ারাকে একেবারেই জুড়িয়ে ফেলেছে!

মিনি খিনের কান্না থামে না।

মেয়েমানুষের কান্নাকাটি লখাই খুব পছন্দ করে, কিন্তু তারা হল অন্য জাতের মেয়েমানুষ। ফুর্তির জন্য যে-মেয়েমানুষকে নিয়ে কেনাবেচা চলে, সে হবে এরেবারে আলাদা ধরনের। সে হবে ফুর্তিবালী, তামাশাবালী, কপট শরমের রঙে সে আরক্ত হবে। তার চলায়-বলায় বিজুরি চমকাবে, তার চোখে থাকবে ছুরির ধার, কোমরে লছক খেলবে।

কিন্তু এ কী ধরনের মেয়েমানুষ! পয়সার বদলে যে মেয়েমানুষ মেলে, সে যদি ফুর্তির বদলে শুধু কান্নাই শোনায়, তাকে নিয়ে কী করবে লখাই? মোট কথা, এই জাতের মেয়েমানুষকে আদৌ বুঝে উঠতে পারে না সে। এদের দুঞ্জেয় মন লখাইর নাগালের বাইরে।

এবার এক কাজ করে বসল লখাই। আস্তে আস্তে মিমি খিনের পাশে গিয়ে বসল। তার পিঠে একখানা হাত রেখে খুব নরম গলা ডাকল, মিমি খিন–

চমকে উঠল মিমি খিন। তার শরীরটা থর থর কাঁপতে লাগল। হাঁটুর ফাঁক থেকে মাথাটা তুলে ভয়ার্ত, অদ্ভুত চোখে লখাইর দিকে তাকিয়ে থাকে সে। সে-চোখে যে-দৃষ্টি ফুটে রয়েছে, তার তুলনা নেই।

এই মুহূর্তে মিমি খিনের চাউনির একটা মাত্র উপমাই মনে পড়ছে লখাইর। তার হাতে এক হাত লম্বা একটা ছোরার ফলা দেখে বিবিবাজারের মোতির চোখে যে দৃষ্টি ফুটেছিল, অবিকল সেই ভাবেই তাকিয়ে রয়েছে এই মেয়েটা।

লখাই ঘাবড়ে গেল যেন।

কিছুক্ষণ চুপচাপ।

তারপর হঠাৎ লখাই বলল, ডর লাগছে?

হাঁ।

কিসের ডর?

মিমি খিন জবাব দিল না।

লখাই আবার বলল, আমাকে ভয় পেও না।

অনেকক্ষণ লখাইর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল মিমি খিন। একদৃষ্টে কী যেন খুঁজতে লাগল। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, সত্যি তোমাকে ডর নেই?

না।

আরো কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লখাইকে দেখল মিমি খিন। হয়তো সন্দেহ কাটিয়ে উঠতে পারছে না। এই মানুষটাকে কতটা বিশ্বাস করা যায়, ভাবতে পারছে না। তবে এটুকু সে আন্দাজ করেছে, এই দ্বীপের অন্য অন্য দুশমনগুলো যারা মঙ ফা’র মারফত তার খুপরিতে ফুর্তি লুটতে আসে, তাদের সঙ্গে এই লোকটার হয়তো কিছুটা তফাত আছে।

দুশমনগুলো কোনো কথাই বলে না। তাকে ডলে পিষে কামড়ে ছিঁড়ে শেষ করে দিতে চায়। কিন্তু এই লোকটা বুঝিবা আলাদা জাতের। অন্তত নরম গলায় দু চারটে কথা সে বলেছে। তার ডর লাগে কি না জানতে চেয়েছে। অন্য শয়তানগুলো তো তাকে জানতে চায় না, বুঝতে চায় না, তার কোনো কথাই শুনতে চায় না। তারা চায় খ্যাপা কুত্তার মতো তার দেহের মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে।

মিমি খিনের দিকে তাকিয়ে অন্য কথা ভাবছিল লখাই। উজাগরের সঙ্গে প্রথম যেদিন সে এখানে এসেছিল, সেদিন কয়েক মুহূর্তের জন্য মেয়েটার মুখ দেখতে পেয়েছে। সেই থেকেই তার মাথার ভেতর অদ্ভুত এক ভাবনা তোলপাড় করে বেড়াচ্ছে। মিমি খিনের মুখের ছাঁদ একেবারেই বর্মীদের মতো নয়। তবে? মনের মধ্যে কোথায় যেন একটা সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

লখাইর মাথায় যা তোলপাড় করে বেড়াচ্ছে, হঠাৎ মুখ দিয়ে সেটা বেরিয়ে পড়ল। খুব আস্তে সে ডাকল, মিমি খিন

কী বলছ?

তোমাকে দেখতে তো বর্মীদের মতো না।

না। চমকে উঠে অস্ফুট একটা শব্দ করল মিমি খিন।

তীক্ষ্ণ গলায় এবার লখাই বলল, তুমি কি তবে বর্মী না?

না। সুঠাম নাকের ডগাটা তির তির কাঁপছে মিমি খিনের। চোয়াল কঠিন হয়ে উঠেছে, টানা দীর্ঘ চোখ দু’টি জ্বলছে।

প্রায় চিৎকার করে উঠল লখাই, তবে তুমি কী?

বাঙালি।

বাংলা দেশের কোন জেলায় তোমার ঘর?

চাটগাঁ।

এই মুহূর্তে অদ্ভুত এক উত্তেজনা যেন লখাইর ওপর ভর করে বসেছে। মিমি খিনের দুটো হাত ধরে আঁকানি দিতে দিতে সে বলল, চাটগাঁ জেলায় ঘর! তুমি বাঙালি! তাহলে তোমার নাম মিমি খিন কেন?

আমার নাম মিমি খিন না–বিন্দি।

বিন্দি!

হাঁ।

তবে তুমি মিমি খিন হলে কেমন করে?

এতক্ষণ ঘোরের মধ্যে কথা বলছিল মিমি খিন। হঠাৎ যেন ঘোরটা কেটে গেল। দুই হাতে মুখ ঢেকে প্রবল বেগে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলতে লাগল, না না, তা আমি বলতে

পারব না। মঙ ফা জানতে পারলে আমাকে কেটে ফেলবে।

ডর নেই বিন্দি, তুমি বল। মঙ ফা জানতে পারবে না।

না-না-না। সমানে মাথা ঝাঁকাতে লাগল মিমি খিন। মিমি খিন না, বিন্দি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে, মঙ ফা বড় শয়তান। ও না পারে দুনিয়ায় এমন কাজ নেই।

কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল লখাই। তারপর আস্তে আস্তে বলল, আমিও না পারি, দুনিয়ায় এমন কাজ নেই। তোমার ডর নেই বিন্দি। আমি বলছি মঙ ফা তোমার কিছুই করতে পারবে না। একটু থেমে কী যেন ভেবে নিল লখাই। তারপর বলল, তা ছাড়া, আমি তোমার দেশের লোক। বাংলা মুলুকে আমার ঘর। চৰ্বিশ পরগনা জেলা, হেতমপুর গাঁ। আমার নাম লখাই। জাতে কৈবোত (কৈবর্ত)।

সত্যি?

হ্যাঁ, সত্যি। ভগবানের নামে দিব্যি গেলে বলছি–সত্যি। আমাকে দিয়ে তোমার কোনো ক্ষেতি হবে না বিন্দি। সব কথা খুলে বল। কেমন করে মিমি খিন হলে, জানতে ইচ্ছা করছে।

বিন্দি হয়তো বুঝল, এই নিদারুণ দ্বীপে এই প্রথম এমন একটা মানুষের দেখা সে পেয়েছে, যাকে বিশ্বাস করা যায়। এই মানুষটা হয়তো তাকে বিপদে ফেলবে না। কোনো মন্দ মতলব নিয়ে খুব সম্ভব এই মানুষটা আসেনি।

প্রতি রাতে মঙ ফা যে দুশমনগুলোকে তার খুপরিতে ঢুকিয়ে দেয়, তাদের জঘন্য ক্রিয়াকলাপ এবং অকথ্য আচার-আচরণ দেখে মানুষের ওপর বিশ্বাস হারাতে বসেছিল বিন্দি। এখানে যারাই আসে তাদের সকলকেই ঘৃণা করে সে।

বিন্দি ভাবল, এইদ্বীপে আসার পর এই প্রথম সে এমন একটা মানুষের দেখা পেয়েছে, যাকে ভরসা করে নিজের দুর্বহ জীবনের কথা শোনানো যায়।

একবার নিজের দেহটার দিকে তাকাল বিন্দি। এই বহুভুক্ত শরীরের মধ্যে অনেক ব্যথা জমে রয়েছে। মঙ ফা’র এই খুপরিতে মুখ বুজে থাকতে হয় তাকে। যত দিন যায়, দেহে আর মনে যন্ত্রণা বাড়তেই থাকে। সে-যন্ত্রণার কথা কাউকে বলে যে বিন্দি একটু হালকা হবে, তার উপায় নেই। কাকে বলবে? কে তার কষ্টের কথা শুনবে? এখানে শোনাবার মতো মানুষই বা কোথায়?

বঙ্গোপসাগরের এই নিদারুণ দ্বীপে মানুষ হয়তো মেলে। ঠিক মানুষ নয়, মানুষের আকৃতির মধ্যে কতকগুলি বর্বর জন্তু এখানে ঘুরে বেড়ায়। মানুষ যদিও মেলে, মন মেলে না। দরদ, ভালবাসা তো এখানে একান্তই দুর্লভ।

মানুষ যখন ডুবতে বসে, তখন হাত বাড়িয়ে যা পায় তাই আঁকড়ে ধরে। এখানে আসার পর জীবন-জোড়া অবিশ্বাস আর সন্দেহে ডুবতে বসেছে বিন্দি। কি হাত বাড়িয়ে ধরার মতো একটা আশ্রয়ও তার নেই। মানুষ যা সম্বল কবে বাঁচে সেই আস্থা-বিশ্বাস-সমবেদনা মমতা, কিছুই নেই এই দ্বীপে।

এক-এক সময় বিন্দির মনে হয়, গলায় রশি দিয়ে সব যন্ত্রণা জুড়োয়।

এমনভাবে আর কিছুদিন চললে মরেই যেত বিন্দি। মঙ ফাই তাকে মেরে ফেলত। কিন্তু তার আগেই এসে পড়েছে লখাই।

এই প্রথম এমন একটা মানুষের দেখা পেয়েছে বিন্দি, দেখামাত্রই যে তার দেহটাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়নি। সে জানে, তার এই খুপরিতে যে-ই ঢুকুক, তার কাছ থেকেই দাম আদায় করে মঙ ফা। লখাইর কাছ থেকেও নির্ঘাত আদায় করেছে। বিন্দির দেহের দাম আদায় না করে কাউকেই এই খুপরিতে ঢুকতে দেয় না মঙ ফা।

আশ্চর্য, দাম চুকিয়ে এসেও ফুর্তিটুকু হিসেব করে উশুল করে নেয় না, বরং তার দুঃখের কথা, কষ্টের কথা সাগ্রহে জানতে চায়, এমন মানুষ এই দ্বীপে এই প্রথম দেখল বিন্দি।

লখাই আবার বলল, বল, কেমন করে মিনি খিন হলে?

গাঢ় গলায় বিন্দি বলল, সত্যিই আমার কথা শুনতে চাও?

হ্যাঁ, সত্যি। মনে হচ্ছে, তোমার অনেক দুঃখ। তাই না বিন্দি?

হ্যাঁ–

সামান্য একটু সহানুভূতির তাপে কেঁদে ফেলে বিন্দি। খানিকটা পর ধরা ধরা গলায় বলে, শোন পুরুষ, এই দ্বীপে তুমিই পয়লা মানুষ যে–বলতে বলতে থেমে যায় বিন্দি।

লখাই বলে, আমি কী?

, কিছু না। নিচের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে বিন্দি।

বিন্দির কথা কিছুটা বুঝে, কিছুটা না বুঝে বিমূঢ়ের মতো বসে থাকে লখাই।

এরপর কতটা সময় যে কেটে যায়, কে তার হিসেব রাখে।

একসময় বিন্দির জীবনের কথা শুরু হল। তার বাপের নাম সুখচাঁদ দাস।

শুঁটকি মাছের ফলাও কারবার ছিল সুখচাঁদের। কর্ণফুলির মাছ শুকিয়ে বিরাট বিরাট গাছি নৌকোয় ভরে আকিয়াবে পাড়ি জমাত সে। চার পাঁচ দিন আকিয়াবে থেকে আবার চাটগাঁয়ে ফিরে আসত।

প্রথম প্রথম শুকনো মাছের চালান নিয়ে মরশুমে একবার মাত্র খেপ মারত সুখচাঁদ। আকিয়াবে শুঁটকি মাছের খুব চল।

দু পাঁচ বছরে কারবার কেঁপে উঠল সুখচাঁদের। মরশুমে চার পাঁচটা খেপ মেরেও চাহিদা মেটাতে পারত না সে।

কর্ণফুলির মাছ নিয়ে আকিয়াবের পাইকারদের কাছে বেচে আসত সুখচাঁদ। এতে তেমন পড়তা থাকত না। পনেরো বিশ দিন থেকে খুচরো বেচতে পারলে লাভ বেশ ভালোই থাকে। অথচ বেশিদিন আকিয়াবে থাকার উপায় নেই। পিছুটান আছে। ঘর-সংসার, বউ মেয়ে, সব পড়ে থাকে চাটগাঁয়।

পৃথিবীতে এমন একদল মানুষ আছে, ঘর-সংসারে যারা আকণ্ঠ মজে থাকে। বউ-ছেলে মেয়ে ছেড়ে কোথাও গিয়ে তারা টিকতে পারে না। সংসারের মধ্যেই তাদের জীবনের যত মজা, যত খুশি, যত আনন্দ। এ-সবের বাইরে তারা বিশেষ কিছুই বোঝে না। টাকায় পয়সায় বিত্তে বৈভবে নয়, বউ-ছেলে-মেয়ে, ঘর সংসারের কাছ থেকে কতটুকু পেল, তাই দিয়েই তারা জীবনে লাভক্ষতির হিসাব কষে। সুখচাঁদ হচ্ছে অনেকটা এই জাতের মানুষ। পেটের দায়ে শুকনো মাছের চালান নিয়ে সে আকিয়াব যায় বটে, মন কিন্তু চাটগাঁয়েই পড়ে থাকে। ঘরের টান ঠেকিয়ে বেশিদিন সে আকিয়াবে থাকতে পারে না।

রোজগারের ধান্দায় ঘন ঘন আকিয়াব যেতে হয়। আবার ঘরের টানও আছে। এই দোটানায় পড়ে অস্থির হয়ে উঠত সুখচাঁদ। ভেবে ভেবে একটা উপায় বার করল সে। চাটগাঁর বাস তুলে সবাইকে নিয়ে আকিয়াবে গিয়েই থাকবে।

সুখচাঁদের দুই মেয়ে, বিন্দি আর পাখি। দুই মেয়ে আর বউ নিয়ে তার সংসার।

আকিয়াবে সংসার তুলে আনল সুখচাঁদ। ঠিক করল, কর্ণফুলির মাছ আর আনবে না, আকিয়াব নদীর মাছ শুকিয়েই ব্যবসা চালাবে।

ব্যবসা জোর চলতে লাগল।…..

আট-দশ বছর কেটে গেল আকিয়াবে। চাচগাঁর সঙ্গে যোগাযোগটা একরকম ছিন্নই হয়ে গেল। দেশের সঙ্গে শুধু কি যোগাযোগটাই ঘুচল? আকিয়াবে যে-জায়গাটায় সুখচাঁদরা থাকত, সেখানকার আচার ব্যবহারে রুচিতে পোশাকে, কথায় বার্তায় বর্মী প্রভাব অত্যন্ত প্রবল। বিন্দি পাখি বর্মী মেয়েদের মতো পোশাক পরত। শেষ পর্যন্ত এমন দাঁড়াল, খানাপিনা, আদব-কায়দা, সবই তারা বর্মীদের অনুকরণে করত।

ব্যবসার সুবাদেই মঙ ফা’র সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সুখচাঁদের আড়ত থেকে পাইকারি দরে শুঁটকি মাছ কিনে আরাকানে নিয়ে বেচত মঙ ফা। আস্তে আস্তে পরস্পরের স্বার্থের খাতিরেই সুখচাঁদের সঙ্গে মঙ ফা’র সম্পর্কটা বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল।

তখন মঙ ফা ছিল বিশ বাইশ বছরের জোয়ান। অন্য বর্মীদের মতো সে লুঙ্গি পরত না। রেঙ্গুন শহরে গিয়ে সাহেব দেখে এসেছিল। তাদের মতো প্যান্ট পরত মঙ ফা। চুলে ঢেউ খেলিয়ে টেরি কাটত। ফুরফুরে শৌখিন মেজাজের মানুষ ছিল সে।

মঙ ফাকে খুবই পছন্দ করত সুখচাঁদ। বলত, এমন কাজের ছেলে জন্মে দেখিনি। মঙ ফা’র ব্যবসার মাথাটা বড় সাফ।

আরাকান থেকে যখন মাল কিনতে আসত মঙ ফা তখন অন্য কোথাও তাকে উঠতে দিত না সুখচাঁদ। সোজা নিজের বাড়িয়ে নিয়ে তুলত। যদ্দিন খুশি, সুখচাঁদের কাছে থাকত মঙ ফা।

পাখির বয়স তখন সতেরো, বিন্দির বারো। সুখচাঁদের আর যা-ই থাক, কোনোরকম সংস্কার ছিল না। ঘরের টান থাকলেও মনটা তার ঘরের মাপের মতো ছোট ছিল না। তার কাছে জাত-বেজাতের বিচার ছিল না। মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখতেই সে ভালবাসত।

হঠাৎ এক কাণ্ডই করে বসল সুখচাঁদ। পাখির সঙ্গে মঙ ফা’র বিয়ে দিয়ে দিল। বিয়ের পর পাখিকে নিয়ে আরাকানে চলে গিয়েছিল মঙ ফা।

বিন্দির হুবহু মনে আছে, বিয়ের পর পাখিকে নিয়ে সেই যে চলে গেল মঙ ফা, তারপর মাত্র দুবার এসেছিল আকিয়াবে।

সুখচাঁদের ধারণা ছিল, মঙ ফা আরাকানেই আছে। শেষ বার আকিয়াব আসার পর বছরখানেক ঘুরতে চলল। আর এল না মঙ ফা। লোক মারফত অনেক খোঁজখবর করল সুখচাঁদ। নিজে আরাকানে গিয়ে দেখেও এল। কিন্তু মঙ ফা বা পাখি, কারোরই খোঁজ মিলল না। তারা যে কোথায় চলে গিয়েছে, কেউ তার হদিস দিতে পারল না।

প্রথম প্রথম খুব কাঁদত বিন্দির মা। বলত, আমার মেয়ে এনে দাও।

সুখচাঁদ অনেক বুঝিয়েছে, মেয়ে আসবে, নিশ্চয় আসবে। মঙ ফা হয়তো ব্যবসার ফিকিরে কোথাও গেছে। তুমি দেখো, ঠিক সে আসবে।

বিন্দির মা জবাব দিত না, বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদত।

এর পর আরো দশটা বছর পার হয়ে গেল। কিন্তু মঙ ফা’র সন্ধান পাওয়া গেল না।

মানুষ সম্বন্ধে ধারণাটা তখনও আগের মতোই অটুট ছিল সুখচাঁদের। মানুষকে সে অবিশ্বাস করতে শেখে নি। বিন্দি তখন বড়সড় হয়েছে, বিয়ের লায়েক হয়ে উঠেছে।

বিন্দির মা বলল, মেয়ের বিয়ে দাও। স্বজাতের মধ্যে ছেলে দেখ।

সুখচাঁদের ইচ্ছা কিন্তু অন্য রকম। তার ব্যবসাতে কারেনদের একটি ছেলে কাজ করত। তার নাম ফাম চা। ফাম চা যেমন সৎ তেমনি পরিশ্রমী। ছেলেটিকে হাতে ধরে শুঁটকি মাছের ব্যবসা শিখিয়েছে সুখচাঁদ।

অনেক বয়স হয়েছে সুখচাঁদের। সে চায়, ফাম চার হাতেই মাছের ব্যবসা আর বিন্দিকে তুলে দেয়।

সুখচাঁদের ইচ্ছার কথাটা শুনে খেপে উঠল বিন্দির মা, না না, পাখির বিয়ে দিয়ে খুব শিক্ষা হয়েছে। বিন্দিকে আমি অজাত কুজাতের হাতে দেব না। বর্মীর হাতে দিয়ে এক মেয়েকে তুমি মেরেছ। এই মেয়েকে ক্লিছুতেই কারেনের হাতে দেব না।

অনেক বোঝাল সুখচাঁদ। ফাম চা খুব সৎ ছেলে, তার সঙ্গে বিয়ে হলে বিন্দি সুখেই থাকবে। তা ছাড়া মঙ ফা’র কথাও তুলল সে। এমন কোনো খবর তারা পায়নি যা থেকে বোঝা যায়, মঙ ফা পাখির ক্ষতি করেছে।

সুখচাঁদ বলল, অবুঝ হবি না বউ। মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখ। মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারলেই ভগবানে বিশ্বাস রাখা যায়। এই পিথীবিতে সব মানুষই সমান।

সুখচাঁদের সঙ্গে জীবনের পঁচিশ তিরিশটা বছর কাটিয়েও সংস্কার কাটাতে পারল না বিন্দির মা। মানুষকে জাতি-গোত্র-বংশ দিয়ে মেপে মেপে দেখতেই সে ভালবাসে। তা ছাড়া, এই বর্মী এবং কারেনদের সম্বন্ধে অদ্ভুত এক ভয় আছে তার মনে। সে বলল, এক মেয়ের তোমার ইচ্ছামতো বিয়ে হয়েছে। এই মেয়ের বেলা আমার সাধটা মেটাতে দাও।

সুখচাঁদ হচ্ছে সেই মানুষ যে ঘর-সংসার, বউ-মেয়ে খুবই ভালোবাসে। কিন্তু সব চেয়ে যেটা বেশি ভালোবাসে সেটা হল তার জেদ। শেষ পর্যন্ত তার জেদটাই বজায় রইল।

দিনের পর দিন কেঁদেও সুখচাঁদকে টলাতে পারল না বিন্দির মা। ফাম চার সঙ্গে বিন্দির বিয়ে হয়ে গেল।

বিন্দিকে নিয়ে ফাম চা কোথাও গেল না, সুখচাঁদের বাড়িতেই থেকে গেল।

অসম্ভব খাটতে পারে ফাম চা। তার হাতে ব্যবসার সমস্ত ভার তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হল সুখচাঁদ। ব্যবসা হাতে পেয়ে মাস ছয়েকের মধ্যে তাকে দশ গুণ বাড়িয়ে ফেলল ফাম চা।

ফাম চা যেমন সৎ, তেমনি বাধ্য। বর্মা মুলুকের অন্য সব জাতের লোকেদের মতো সে নেশা করে না, কথায় কথায় চাকু বার করে না। বড় শান্ত ছেলেটি।

বিন্দির মায়ের মনে করেন বলে যে-দ্বিধা, যে-সন্দেহ এবং ধন্দ ছিল, ধীরে ধীরে তা কেটে গেল। আকিয়াবী যুবকটি যে তার নরম বাঙালি মনটা জুড়ে বসবে, সে-কথা কি আগেভাগে জানত বিন্দির মা?

সুখচাঁদ বলে, তোকে আগে বলিনি বউ, ফাম চা বড় ভালো ছেলে। মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখ।

বিয়ের পর ছ সাতটা মাস স্বপ্নের ঘোরে কেটে গেল বিন্দির। কিন্তু এত সুখ তার কপালে সইল না। সুখচাঁদ কি বিন্দির মায়ের কপালেও না। তিন দিনের জ্বর বিকারে ফাম চা মারা গেল।

তারপরও দুটো বছর পার হয়ে গিয়েছে।

সাড়ে বারো বছর পর হঠাৎ একদিন মঙ ফা এসে হাজির হল আকিয়াবে। বিন্দি, বিন্দির মা, সুখচাঁদ তিনজনেই তাকে ঘিরে বসল। এত কাল কোথায় ছিল? কী করছে? পাখি কোথায়? এতদিন খোঁজখবর দেয়নি কেন? তিনজনে একসঙ্গে হাজারটা প্রশ্ন করল।

জবাবে মঙ ফা যা বলল, তা এক এলাহী ব্যাপার। পোর্ট ব্লেয়ার শহরে না কি বিরাট কাপড়ের দোকান দিয়ে বসেছে। দুখানা কুঠিবাড়ি কিনেছে। ছেলেপুলে তিনটি। একটি ছেলে, দু’টি মেয়ে। এতকাল মাদ্রাজ থেকে মাল নিয়ে বেচত, এবার কলকাতায় এসেছে।

অনেকদিন ধরে শ্বশুর-শাশুড়িকে দেখার জন্য প্রাণটা আনচান করছিল। অথচ ব্যবসার ঝামেলায় কি আসার জো আছে? এবার যখন কলকাতায় আসাই হল, তখন আকিয়াবে না এসে পারল না মঙ ফা। এই সুযোগে শ্বশুর-শাশুড়িকে দেখে গেল।

বিন্দির মা বলল, পাখি কোথায়?

পোর্ট ব্লেয়ার।

পাখিকে নিয়ে এলে না কেন?

মাথাটা নামিয়ে খুব আস্তে আস্তে মঙ ফা বলেছিল, পাখির ছেলেপুলে হবে এই মাসে। এখানে আসতে জাহাজে চার দিন লাগে। যদি জাহাজে শরীর খারাপ হয়ে যায়, সাহস করে তাই আনিনি।

ভালই করেছ বাবা। বিন্দির মা বলল।

এবার এ-দিককার খবর নিল মঙ ফা। এখানকার আর খবর কী? সুখচাঁদ আর বিন্দির মায়ের বয়স হয়েছে। বুড়ো বয়সে নতুন খবরই কী-ই বা সম্ভব? এখন তো কোনোরকমে টিকে থাকা। তবে হ্যাঁ, খবর আছে বিন্দির। বড় দুঃখের খবর। বিয়ের পর পুরো সাতটা মাসও তার কপালে স্বামী-সুখ সইল না।

শুনে খুব আক্ষেপ করল মঙ ফা।

মঙ ফা আসার পর থেকেই সুখচাঁদ বিন্দির মাকে বলতে লাগল, মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখিস বউ। তুই এই মঙ কার সম্বনে কত কথা বলেছিস। দ্যাখ সে কী হয়েছে। মেয়ে তোর সুখেই আছে।

বিন্দির মা জবাব দেয় না। আস্তে আওে মাথা নাড়ে। বুঝতে চেষ্টা করে, সুখচাঁদের কথাটাই বুঝি ঠিক।

আকিয়াবে তিন দিন মাত্র রইল মঙ ফা। চারদিনের মাথায় বলল, আর থাকার উপায় নেই। ব্যবসা আছে, তা ছাড়া পাখির এই অবস্থা।

সুখচাঁদ বলল, সে তো ঠিকই।

মঙ ফা সমানে হাত কচলায়। কী একটা কথা যেন সে বলতে চায়। কিন্তু ভরসা করে বলে উঠতে পারছে না।

সুখচাঁদ মঙ ফা’র মনের কথাটা বুঝল। বলল, কিছু বলবে?

হাঁ। বলছিলাম, বিন্দির–একটু ইতস্তত করল মঙ ফা।

বল, বল।

গলাটা কেশে সাফ করে নিয়ে মঙ ফা বলল, ফাম চা মরার পর বিন্দির মনটা তো ভালো নেই।

বিষণ্ণ স্বরে সুখচাঁদ বলল, ভালো থাকে কেমন করে?

বলছিলাম মাস দুয়েকের জন্যে বিন্দিকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাই। একটা নয়া জায়গা দেখে আসবে। মনটাও ভাল হবে। পাখি তো অনেক কাল বিন্দিকে দেখেনি। বোনকে কাছে পেলে খুব খুশি হবে।

বেশ, বেশ–এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিল সুখচাঁদ।

আকিয়াব থেকে বিন্দিকে কলকাতায় নিয়ে এল মঙ ফা। সেখান থেকে চার দিন জাহাজে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আন্দামান এসেছে।

আন্দামানে আসার পর একটু একটু করে মঙ ফা’র স্বরূপ বুঝতে পারল বিন্দি।

পোর্ট ব্লেয়ারে মঙ ফা’র কাপড়ের দোকান নেই, কুঠিবাড়ি নেই। আকিয়াবে গিয়ে মঙ ক। যে বিরাট ব্যবসা এবং টাকাপয়সার গল্প ফেঁদে এসেছিল তা যে কত বড় ধাপ্পা, কত মিথ্যা, চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে গেল।

সরাসরি পোর্ট মোয়াটের এই ঝুপড়িতেই বিন্দিকে এনে তুলেছিল মঙ ফা।

ঝুপড়িতে ঢুকেই বিন্দি জিজ্ঞেস করেছিল, দিদি কোথায়?

কেমন এক ধরনের শব্দ করে হেসে উঠেছিল মঙ ফা। বলেছিল, তুই-ই তো পাখি। কী বলিস!

স্বরটা এবার কঠিন হয়ে উঠেছে বিন্দির, বল শিগগির, দিদি কোথায়?

স করে বেড়া থেকে একটা দা টেনে উঁচিয়ে ধরেছিল মঙ ফা। তার ছোট ছোট কুতকুতে চোখজোড়া ধিকি ধিকি জ্বলছিল। বিন্দির মাথার উপর দাটা খাড়া রেখে চাপা, তীব্র গলায় সে বলেছে, বাঁচতে যদি চাস, পাখির কথা মুখে আনবি না।

ক্রমশ মঙ ফা’র স্বরূপ নানা ভাবে প্রকাশ পেতে লাগল। প্রথমেই বিন্দির নামটা বদলে দিল সে। বিন্দি হল মিমি খিন। তারপর প্রতি রাত্রে একটি করে দুশমন জুটিয়ে এনে তার খুপরিতে ঢুকিয়ে দিতে লাগল মঙ ফা। বিন্দির দেহ বেচে সে পয়সা কামাতে লাগল।

ছটা মাস এই দ্বীপে কেটে গিয়েছে। এই ছ মাসে হাজার চেষ্টা করেও পাখির কোনো হদিসই পায়নি বিন্দি। তবে এটুকু সে জেনেছে, খুনের দায়ে দশ বছরের দ্বীপান্তরী সাজা হয়েছিল মঙ ফা’র। বিন্দির এক-এক সময় মনে হয়, পাখিকেই খুন করেনি তো মঙ ফা?

এই ছ মাসে বার দশেক গলায় রশি দিতে গিয়েছে বিন্দি। দশ বারই তাকে ধরে ফেলেছে মঙ ফা। এক-একবার মনে হয়েছে, এখান থেকে পালিয়ে যেদিকে দুচোখ যায়, চলে যাবে। কিন্তু এই ঝুপড়িটার চারপাশে নিবিড় জঙ্গল। জঙ্গলের ভয়ঙ্কর মূর্তি দেখে বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। এখান থেকে কোথায় যাবে সে?

রাতের পর রাত তার ঝুপড়িতে মাতাল বদমাশদের ঢুকিয়ে দেয় মঙ ফা। বিন্দির জীবনটাকে দুর্বহ, অসহ্য করে তোলে। আত্মঘাতী হয়ে যে সমস্ত যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাবে, তারও উপায় নেই। এই ঝুপড়ি থেকে মঙ ফা নড়ে না। সবসময় তাকে চোখে চোখে রাখে। বিন্দির আর বাঁচার সাধ নেই।

অনন্ত গ্লানি আর দুঃখের কথা শুনিয়ে দুই হাঁটুর ফাঁকে মাথা গোঁজে বিন্দি। আগের মতোই ফুলে ফুলে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে, কাঁদতে থাকে।

লখাই ডাকে, বিন্দি—

হঠাৎ যেন বিন্দি খেপে উঠল, কী বলছ? আমার সব কথা তো শুনলে। এবার ফুর্তি মেরে বিদেয় হও।

বিন্দির একটা হাত ধরে লখাই বলল, ফুর্তি মারার হলে তো অনেক আগেই মারতাম। তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি। তুমি বাঁচতে চাও?

হাঁটুর ফাঁক থেকে মাথা তুলল বিন্দি। বলল, হা হা, বাঁচতেই তো চাই পুরুষ। বাঁচতেই চাই। গলার স্বরটা কান্নায় ভেঙে পড়ল তার।

বিন্দির টানা টানা, দীর্ঘ চোখ দু’টি জলে ভরে উঠেছে। গাল বেয়ে চোখের জলের ধারা নেমেছে। নাকের ডগাটি তির তির কাঁপতে থাকে। দুচোখে আশা আর সংশয় মেশা বিচিত্র এক দৃষ্টি ফুটে বেরিয়েছে।

আন্দামানে আসার পর এই প্রথম বাঁচার কথা শুনল বিন্দি। তার মুখের দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল লখাইর। গাঢ় স্বরে সে বলল, হ্যাঁ, বাঁচতে তোমাকে হবে।

কিন্তু কেমন করে? অপার আগ্রহ নিয়ে লখাইর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে বিন্দি।

হঠাৎ কেঁকের মাথায় কথাটা বলে ফেলেছে লখাই। কিন্তু কিভাবে বিন্দি বাঁচতে পারে, সে-সম্বন্ধে একবারও ভেবে দেখেনি।

বিন্দি আবার বলল, কী করে বাঁচব পুরুষ? তুমি আমাকে এই নরক থেকে আকিয়াব দিয়ে আসবে? আকিয়াব না পার, যেখানে খুশি নিয়ে চল। এখানে থাকলে আমি মরে যাব। মঙ ফাই আমাকে মেরে ফেলবে।

চিৎকার করতে লাগল বিন্দি। সে কী উন্মাদ হয়ে যাবে?

লখাই জবাব দিল না। চুপচাপ বসে রইল।

কাঁদতে কাঁদতেই অনন্ত আশায় লখাইর দিকে তাকিয়ে থাকে বিন্দি। কিন্তু অনেকক্ষণ পরও যখন জবাব মিলল না তখন মুখটা বড় করুণ হয়ে উঠল। আস্তে আস্তে মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিল সে।

এবার লখাই যেন জবাবদিহি করতে লাগল, দু’মাস হল এখানে কয়েদ খাটতে এসেছি। সাজার মেয়াদ চোদ্দ বছর। মেয়াদ না ফুরোলে এইদ্বীপ থেকে তো যেতে পারব না। এ-অবস্থায় কোথায় তোমাকে নিয়ে যাব?

মুখ না ঘুরিয়েই বিন্দি বলল, ও-কথা কে শুনতে চায়? বাঁচার আশাই দেখাতে পার পুরুষ। তার উপায়টা বলতে পার না? একটু থেমে বলল, যাও তুমি, যাও। যেদিন বুঝবে, আমাকে বাঁচাতে পারবে সেদিন এস।

আশ্চর্য! এখন আর কাঁদছে না বিন্দি।

বিন্দির মুখ দেখতে পাচ্ছে না লখাই। দেখতে পেলে বুঝত, নিদারুণ হতাশা আর ক্লেশে মানুষের মুখের চেহারা কেমন হয়ে যায়।

যে নারী গত ছ মাস পৃথিবীর কাছ থেকে মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই চায়নি তাকে প্রথম বাঁচার কথা, আশার কথা শুনিয়েছিল লখাই। তারপরেই তাকে অফুরন্ত নৈরাশ্যে ডুবিয়ে দিয়েছে। বাঁচার আশা নিয়ে, স্বপ্ন দেখে, সময় কাটিয়ে দেবার মতো মনের অবস্থা নয় বিন্দির। সে বাঁচতে চায়, বাঁচার উপায় চায়। অন্য কিছু নয়।

হঠাৎ যেন হুঁশ ফিরল লখাইর।

খুপরিটার পেছন দিকে যে-ফোকর আছে, তার ভেতর দিয়ে ছোট্ট এক টুকরো আকাশ দেখা যায়। সেটা অন্ধকার হয়ে আসছে। খুব সম্ভব বাইরে সন্ধে নামার তোড়জোড় চলছে।

লখাইর খেয়াল হল, এখানে আসার আগে, শিবরাম পাণ্ডেকে বলে এসেছিল, দিন থাকতে থাকতেই তুষণাবাদ ফিরে যাবে। আজ বরাতে যে কী আছে, কে বলবে। সেটা আন্দাজ করতেও ভরসা হল না লখাইর।

বাইরের চেহারাটা ভাল করে দেখবার জন্যই ছুটে ফোকরটার সামনে চলে এল লখাই। এখনই রওনা হলে তুষণাবাদ ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে।

শিবরাম পাণ্ডে আর রাত্রি–এই দুটো মিলিয়ে একটা সম্ভাব্য দুর্ভোগের চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠল লখাই। পিটিয়ে হাড্ডি খুলে নেবে, না আবার সেলুলার জেলেই টিণ্ডাল পেটি অফিসারদের কাছে ফেরত পাঠাবে–শিবরাম পাণ্ডে যে কী ধরনের ঝামেলা পাকাবে, ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না লখাই। পারছে না বলেই নানা দুর্ভাবনা তার মাথায় চেপে বসছে।

আকাশের দিকে তাকিয়ে অন্ধকার দেখছিল লখাই, আর ভাবছিল। হঠাৎ তার মনে হল, বাইরে বেড়ার গা ঘেযে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে।

লখাই চেঁচিয়ে উঠল, কে, কে?

চট করে একটা ছায়ামূর্তি সরে গেল। অন্ধকারে তাকে ঠিক চেনা গেল না। তবু যতটুকু দেখেছে, তাতে লখাইর মনে হল, লোকটা মঙ ফাই।

ফোকরটার সামনে থেকে বিন্দির কাছে এসে দাঁড়াল লখাই। বলল, আজ যাই। সুবিধে পেলেই আবার আসব।

বিন্দি চুপচাপ বসে রইল।

পর পর পাঁচটা খুপরি পেরিয়ে বাইরে এল লখাই। দেখল, ঝুপড়িটার সামনে লণ্ঠন জ্বালিয়ে দা দিয়ে এক টুকরো বাঁশ চাচছে মঙ ফা। মুখ তুলে বলল, ইয়ার চললে?

হাঁ। মঙ ফাকে পেছনে রেখে হন হন করে এগিয়ে গেল লখাই।

মঙ ফা ডাকল, এ ইয়ার—

হাঁ।

শোন, তোমার সাথ কথা আছে।

কী কথা?

শোনই না।

মঙ ফা’র কাছে ফিরে এল লখাই। বলল, কী বলছ?

এত বেকুব কেন তুমি? দাম দিতে জানো, আদায় করে নিতে শেখ নি?

অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল লখাই।

মঙ ফা আবার বলল, তোমার মাফিক আজব মানুষ আমি দেখিনি ইয়ার। পয়সা খরচ করে তুমি স্রিফ আওরতের কিসসা শুনে চলে যাও!

মঙ ফা’র গলায় ব্যঙ্গ না ধিক্কার, ঠিক কী যে মিশে আছে, লখাই বুঝে উঠতে পারে না।

মঙ ফা এবার বলে, বেকুবের টাকা আমি রাখি না। তোমার টাকা ফেরত নিয়ে যাও।

একটু আগে যে টাকাটা আদায় করে লখাইকে বিন্দির খুপরিতে ঢুকতে দিয়েছিল, সেটা ফেরত দেয় মঙ ফা। লখাইর কানের ভেতর মুখটা ঢুকিয়ে ফিশফিশ করে বলে, ফুর্তির ব্যাপারে তুমি একেবারে নালায়েক। আর এখানে এস না ইয়ার।

কেন? প্রায় চিৎকার করে উঠল লখাই।

যে বুদ্ধ বুরবক ফুর্তির মতলবে এসে আওরতের কিস্সা শুনে চলে যায়, তার সাথ মঙ ফা কারবার করে না।

লখাইর ইচ্ছা হল, মঙ ফা’র টুটিটা ছিঁড়ে ফেলে। কিন্তু তার হাতের বাঁকানো বর্মী দাটা দেখে আপাতত এমন ইচ্ছাটাকে স্থগিত রাখতে হল।

মঙ ফা আর একটা কথাও বলল না। ঝুপড়িটার ভেতর ঢুকে ঝাঁপটা টেনে বন্ধ করে দিল।

কিছুক্ষণ ভয়ানক চোখে মঙ ফা’র ঝুপড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকে লখাই। তার চোখ দেখে মনে হল, এ-ব্যাপারের শেষ এখানেই নয়। মঙ ফা’র সঙ্গে তার আরো অনেক বোঝাপড়া আছে।

একটু পর তুষণাবাদের পথ ধরল লখাই।

জঙ্গলের মধ্য দিয়ে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে লখাই।

এতক্ষণ মাথা গরম হয়ে ছিল। কপালের দু’পাশে দুটো রগ সমানে লাফাচ্ছিল। মঙ ফা’র কথাটা ভাবতে ভাবতে মেজাজটা আর ঠিক রাখতে পারছিল না সে।

এখন জঙ্গলের মাথায় গোল একটি চঁদ দেখা দিয়েছে। ডালপালা এবং পাতার ফাঁক দিয়ে চিকরি-কাটা আলো এসে পড়েছে।

অন্য দিন এই সময়টায় দমকা বাতাস ছোটে। আজকের বাতাস কিন্তু ভারি ঢিমে চালে বইছে।

ঝিরঝিরে বাতাসে গরম মাথাটা আস্তে আস্তে জুড়িয়ে এল লখাইর।

কখন যে মন থেকে মঙ কা মুছে গিয়ে, তার বদলে বিন্দির ভাবনা জুড়ে বসেছে, তার খেয়াল ছিল না।

তুষণাবাদের দিকে যেতে যেতে আজকের অভিজ্ঞতার কথাই অনবরত ভাবছিল লখাই। বার বার বিন্দির মুখের সেই ছবিটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। মেয়েটার টানা দীর্ঘ দু’টি চোখ জলে ভরে উঠেছিল। গালের ওপর দাগ এঁকে চোখ থেকে উষ নোনা জল ঝরছিল। নাকের ডগাটি তির তির করে কঁপছিল। লখাই যখন তাকে বাঁচার কথা শুনিয়েছিল, তখন আশা আর হতাশা মেশা বিচিত্র এক দৃষ্টি ফুটেছিল তার চোখে। বিন্দির কথা যতই ভাবছে, বুকের ভেতরটা কেমন যেন ভারী হয়ে উঠছে।

জীবনে বহু নারীসঙ্গ করেছে লখাই। মেয়েমানুষ তার চোখে ভোগের বস্তু ছাড়া কিছুই নয়। মেয়েমানুষের চোখের জলের দাম তার কাছে কানাকড়িও নয়। কোনো যুবতী চোখে লাগলেই, যেমন করে পারুক, তাকে আয়ত্ত করেছে লখাই। ভোগ করেছে। এর জন্য জেল জরিমানা, খুনখারাপি, কিছুতেই সে পেছ-পা হত না। মেয়েমানুষকে ছিনিয়ে আনার পর যখন সে চিৎকার করে কেঁদেছে, চোখের জলে বুক ভাসিয়েছে, গালি দিয়েছে, অভিশাপ দিয়েছে, তখন অদ্ভুত এক আনন্দে লখাইর মনটা ভরে উঠেছে। লখাই হল জালিয়াত-ঠগ বদমাশ-খুনি। কাম-রাগ-মত্ততা-হঠকারিতা-জৈবিক সুখভোগ-স্থূল কতকগুলি প্রবৃত্তির মধ্যেই তার সমস্তটুকু জীবনবোধ ছিল। কিন্তু আজকাল সেটা বদলে যেতে শুরু করেছে। তা না হলে বিন্দির কথা ভেবে বুকটা ধক করে ওঠে কেন? পয়সা খরচ করে ফুর্তির মতলবে গিয়ে বিন্দির দুঃখের কথা শুনে মনটা এত খারাপই বা হয়ে যায় কেমন করে?

লখাই ভাবল, জীবনে অনেক মেয়েমানুষ ভোগ করেছে সে, অনেক যুবতীর সংস্পর্শে এসেছে। কিন্তু বিবিবাজারের মোতি চুলানি, আর দরিয়ার সঙ্গিনী সোনিয়া ছাড়া তার মনে আর কেউ বিশেষ দাগ কাটতে পারে নি। মোতি আর সোনিয়া তার মনে দাগই কেটেছে, কিন্তু বিন্দির মতো তার সমস্ত মনটাকে তোলপাড় করতে পারে নি। তুষণাবাদের দিকে চলতে চলতে এবং বিন্দির কথা ভাবতে ভাবতে অস্থির হয়ে উঠল লখাই। তার মনে হল, যেমন করেই হোক বিন্দিকে মঙ ফা’র হাত থেকে উদ্ধার করতে হবে। কিন্তু কেমন করে? এই মুহূর্তে তাকে বাঁচাবার মতো সঠিক একটা পথ খুঁজে পায় না লখাই। আর পায় না বলেই মাথাটা ফের গরম হয়ে ওঠে।

কতক্ষণ হেঁটেছিল, হুঁশ নেই লখাইর। হঠাৎ সামনের একটি প্যাডক গাছের ডাল থেকে কালোমতো কী একটা যেন ঝুপ করে নিচে পড়ল। চমকে তিন পা পিছিয়ে এল লখাই।

নিচে পড়েই সেই কালো বস্তুটা সিধা খাড়া হয়ে দাঁড়ায়। চিকরি কাটা আবছা চাঁদের আলোতে বোঝা গেল, মানুষের মতো একটা মূর্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে। বোঝা গেল, কিন্তু চেনা গেল না।

লখাই চিৎকার করে উঠল, কে, কে?

সামনের মানুষটা পালটা প্রশ্ন করল, তুই কে?

আমি লখাই।

আরে আও আও দোস্ত।

গলার আওয়াজেই চেনা গেল, লোকটা জগদীপ। লখাইর মতোই তুষণাবাদ বীট-এর আর এক জবাবদার। লম্বা লম্বা পা ফেলে জগদীপের কাছে এসে পড়ল লখাই। বলল, কি রে শালে, এত রাতে এখানে এসেছিলি কেন?

দিল আসতে বলল, তাই এসেছি।

গাছের মাথায় উঠেছিলি কেন?

দিল উঠতে বলল, তাই উঠেছি।

শালা, তামাশা করছিস। জগদীপের একটা হাত ধরে ঝকানি দিল লখাই। বলল, শিবরামজি জানতে পারলে জান চৌপট করে দেবে।

দিক। ভয়লেশহীন, নির্বিকার স্বরে বলল জগদীপ।

কিছুক্ষণ একদৃষ্টে জগদীপের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে লখাই। তারপর খুব নরম স্বরে ডাকে, আঁই জগদীপ–

হাঁঃ।

বল না, কী জন্যে গাছের মাথায় উঠেছিলি?

আওয়াবিল পাখির বাসার খোঁজে। (আওয়াবিল পাখির বাসা এক ধরনের মাদক দ্রব্য)। বলে একটু কী যেন ভেবে নিল জগদীপ। তারপর শুরু করল, জানিস লখাই, দু বছর এগারো মাস ধরে ডি-কুনহা সাহেবকে আমি আওয়াবিল পাখির বাসা জুটিয়ে দিচ্ছি।

ঘাড় কাত করে লখাই বলল, জানি।

কেন দিচ্ছি জানিস?

জানি। তুই-ই তো বলেছিস, ডি-কুনহা সাহেবকে তিন বছর আওয়াবিল পাখির বাসা দিতে পারলে সে তোকে ছোট একটা মোটর বোট দেবে।

হাঁ, তোর পুরা ইয়াদ আছে দেখছি। একটু দম নিয়ে জগদীপ বলে, বিশোয়াস করে এই কথাটা স্রিফ তোকেই বলেছি। আর কাউকে না।

জানি।

খানিকটা চুপচাপ।

হঠাৎ জগদীপ বলল, ডি-কুনহা সাহেবকে তিন বছর আওয়াবিল পাখির বাসা দিলে একটা মোটর বোট মিলবে। দুবছর এগারো মাস দিয়েছি। হিসাব করে বল তো, আর কদ্দিন বাকি?

এক মাস।

তা হলে এক মাস পরেই আমি মোটর বোট পাব। বিড় বিড় করে বলতে লাগল জগদীপ, আর মোটে এক মাস, স্রিফ একটা মাস।

বিমূঢ়ের মতো জগদীপের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল লখাই।

বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে কত বিচিত্র ধরনের কয়েদিই না সাজা খাটতে আসে!

লখাই আসার আগে তুষণাবাদের ‘বীটে’ একজন মাত্র জবাবদার ছিল। সে হল জগদীপ। লখাইও জবাবদার, জগদীপও জবাবদার। জবাবদারির সুবাদে দুজনের আলাপ জমে উঠল। আলাপটাই শুধু জমল না, কয়েকদিনের মধ্যেই দুজনের বন্ধুত্ব এমন পাকা হল, যাতে পরস্পরকে নিজের জীবনের এবং জান-জমানার সমস্ত কথা না শুনিয়ে পারল না।

পুরো বিশ বছরের মেয়াদে এইদ্বীপে কয়েদ খাটতে এসেছিল জগদীপ। চার বছর সাজা খাটা হয়ে গিয়েছে।

এখানে আসার আগে মেইনল্যাণ্ডে মেয়েমানুষ নিয়ে ব্যবসা করত জগদীপ। বাংলা বিহার পাঞ্জাব আসাম বেনারস ইলাহাবাদ–নানা মুল্লুক, নানা শহর ঢুঁড়ে ঢুঁড়ে মেয়েমানুষ যোগাড় করত। তারপর বোম্বাই শহরের রেণ্ডিপাড়ায় চালান দিত। এতে দারুণ মুনাফা থাকত।

কিন্তু নারীব্যবসা সংক্রান্ত একটা খুনের কারণে বছর পাঁচেক আগে ধরা পড়ে গিয়েছিল জগদীপ। খুন এবং আনুষঙ্গিক দুচারটে ছোটখাট অপরাধের দায়ে জড়ানো হয়েছিল তাকে।

এক বছর মামলা চলল। আদালতের রায় যখন বেরুল, দেখা গেল, বিশ বছরের দ্বীপান্তরী সাজা পেয়েছে জগদীপ।

জগদীপ বলেছিল, জানিস লখাই, খুনের ব্যাপারে কে আমাকে ধরিয়ে দিয়েছিল?

কে?

আমার শাদি-করা জেনানা। শালীকে বিশোয়াস করে খুনের কথাটা বলেছিলাম। দাঁতে দাঁত ঘষে জগদীপ গর্জে উঠেছিল, শালী হারামীর বাচ্চী বলত, আওরত নিয়ে ব্যবসা কোরো না, দুসরা কুছু কর। তুইই বল লখাই, আওরতের ব্যবসার মতো ব্যবসা আছে?

না।

আরে পেয়ারে, তুই দশ রোজের দোস্ত হয়ে আমার কথাটা বুঝিস, আর ওই শালী দশ বছরের শাদিকরা ঘরবালী হয়েও বুঝত না। উলটে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিলে। শালী আমার ঘরবালী না, দুশমন। বলতে বলতে কেঁদে ফেলত জগদীপ।

মাঝে মাঝে জগদীপ বলত, আমার বড় আপোশ হয় লখাই।

কেন?

বিবিটাকে কোতল করে আসতে পারলাম না। শালী আমাকে কালাপানির কয়েদ খাটালে, লেকিন তার বদলাটা নেওয়া গেল না। তবে তুই দেখিস, যেদিন এখান থেকে ছাড়া পেয়ে মেইনল্যাণ্ডে যাব, সেদিন পয়লাই কুত্তীটাকে কোতল করব। জেল-ফাঁসি যা হবার হবে।

নিজের জিন্দেগীর সব কথাই বলেছে জগদীপ। আন্দামানে আসার পরই ফরেস্টের কাজে পাঠানো হয়েছে তাকে। পাহাড়গাঁও গারচারামা মিঠাখাড়ি ব্যাম্বু ফ্লাটনানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে শেষ পর্যন্ত তুষণাবাদে এসেছে।

চার বছর এই দ্বীপে কাটিয়েও বিবির বেইমানির কথা ভুলতে পারছে না জগদীপ। যখনই সে ভাবে, শাদিকরা জেনানা তাকে বিশ্বাসঘাতকতা করে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিয়েছে, তখন আর স্থির থাকতে পারে না। নিরুপায়, অন্ধ আক্রোশে উন্মাদ হয়ে ওঠে।

বিবিকে কোতল করে শোধ না তোলা পর্যন্ত শান্তি নেই জগদীপের। প্রায়ই সে বলে, আওরতটাকে খুন করবই।

মাঝে মাঝেই তুষণাবাদের ‘বীট’ থেকে কোথায় যেন উধাও হয়ে যায় জগদীপ। সকালে গেলে ফেরে রাত্তিরে। যেদিন রাতে পালায়, ফেরে তারপর দিন সকালে। কোথায় সে যায়, কেউ বলতে পারে না।

ডাণ্ডা দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে হাড় চুরমার করে দেয় শিবরাম পাণ্ডে। চামড়া ফেটে দর দর করে খুন ঝরে। তবু স্বভাব শোধরায় না জগদীপের। হাজার পিটিয়েও জানতে পারে নি শিবরাম পাণ্ডে, কোথায় যায় জগদীপ।

একদিন জগদীপকে ধরল লখাই। বলল, তুই কোথায় যাস জগদীপ?

অল্প একটু হেসেছিল জগদীপ। সরাসরি জবাবটা এড়িয়ে একেবারে অন্য কথায় চলে গিয়েছিল, দ্যাখ লখাই, এখানে থাকতে আর ভাল লাগে না। ওই খচরী শাঁখরেলটার জন্যে জান আমার খতম হয়ে যাচ্ছে।

লখাই বুঝেছিল, জগদীপ তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ ধমকে উঠেছিল সে, এ শালে কুত্তা, তোর মতলব কী? যে-কথা জিজ্ঞেস করছি, তার জবাব দিচ্ছিস না কেন? আমাকে দোস্ত বলে মানিস আর বিশ্বাস করে কোথায় যাস, বলতে পারিস না? তবে আর তোর সাথ দোস্তি রেখে কী হবে?

দ্যাখ ভাইয়া, নিজের শাদিকরা বিবি যেদিন বিশ্বাস ভাঙলে সেদিন থেকে দুনিয়ার কাউকেই আমি বিশ্বাস করি না, তবু তোকে বলছি। তোকে দোস্ত বলে মেনেছি। এখন বিশ্বাস রাখা না-রাখা তোর ধরম। বলে একটু দম নিয়ে জগদীপ ফের বলেছিল, আমি ডি-কুনহা সাহেবের কাছে যাই।

ডি-কুনহা সাহেব কে?

বড় এলেমদার আদমী। দরিয়ার মতো বড়ে তার দিল। বুকে তার বহুত দরদ। কী যেন ভেবে নিয়ে জগদীপ আবার শুরু করেছে, বছর তিনেক আগে গারাচারামার ‘বীটে’ জবাবদারি করতাম। সেখানেই ডি-কুনহা সাহেবের সাথ জান পয়ান হয়েছিল।

তা-ই?

ডি-কুনহা সাহেবকে আমার জিন্দেগীর সব কথা বলেছি। বিবি আমাকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছে, শুনে খুব আপশোশ করেছে সে।

আর একদিন জগদীপ বলেছিল, ডি-কুনহা সাহেব আমাকে বলেছে, তিন বছর তাকে আওয়াবিল পাখির বাসা যোগাড় করে দিলে একটা মোটর বোট দেবে।

মোটর বোট দিয়ে কী করবি?

জগদীপ জবাব দেয় নি। অনেক পীড়াপীড়ি করেও মোটর বোট পাওয়ার উদ্দেশ্যটা জানতে পারে নি লখাই।

ডালপালার ফাঁকে দিয়ে চিকরিকাটা চাঁদের আলো এসে পড়েছে। মনে হয়, এক ঝাঁক রুপোলি চাঁদা মাছ চিকমিক করছে।

জগদীপ আর লখাই তুষণাবাদের দিকে এগিয়ে চলেছে।

লখাই বলল, যেদিন তোর সাথ পয়লা জান পয়চান হয়েছিল, সেদিন থেকেই মোটর বোট মোটর বোট করছিস! কিন্তু মোটর বোট দিয়ে হবেটা কী?

জগদীপের যে জবাবটা হাজার চেষ্টা করেও এর আগে পাওয়া যায় নি, আজ হঠাৎ সেটা পেয়ে গেল লখাই।

জগদীপ বলল, এখান থেকে পালাব।

পালাবি!

হাঁ হাঁ, পালাব। আওরতটাকে কোতল করে শোধ তুলতে হবে না?

অস্ফুট একটা শব্দ করল লখাই। এই মুহূর্তে অন্য এক কয়েদির কথা মনে পড়ছে। সে তোরাব আলি। বিবির কাছে ফিরে যাবার জন্য ছোট একটা জেলে ডিঙি সম্বল করে এই দ্বীপ থেকে চলে গিয়েছিল তোরাব। আশ্চর্য, জগদীপও মোটর বোট ভরসা করে বিপুল দরিয়া পাড়ি দিতে চাইছে। বিবির টানে নয়, তাকে কোতল করে শোধ তুলতে।

লখাই ভাবতে চেষ্টা করল, তোরাব আলি আর জগদীপের মধ্যে কতখানি তফাত! জগদীপ আস্তে ডাকল, এ লখাই—

বল—

তুই আমার সাথ ভাগবি?

লখাই বুঝে উঠতে পারছে না, কী জবাব দেবে। শুধু শিরায় শিরায় অদ্ভুত এক উত্তেজনায় রক্ত ঝ ঝ করতে লাগল। তোরাব আলিও একদিন তাকে পালিয়ে যাবার কথা বলেছিল। কিন্তু ঝড়ের দরিয়ার ভয়ঙ্কর মূর্তি দেখে ছোট ডিঙিতে পাড়ি জমাতে সাহস পায় নি লখাই। আজ জগদীপ তাকে পালাতে বলছে। এই মুহূর্তে সে ঠিক করে উঠতে পারল না, কী করবে।

বঙ্গোপসাগরের এইদ্বীপটাকে বড় ভালোবেসে ফেলেছেন নওয়াজ খান। এক-এক সময় তাঁর মনে হত, এই দ্বীপে যে-উপনিবেশ গড়ে উঠেছে, তার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। কতকগুলো দুর্দান্ত কয়েদিকে বিচ্ছিন্ন ভাবে রাখলেই তাদের স্বভাব শুধরে যাবে, এমন বিশ্বাস তাঁর ছিল না।

প্রয়োজন থাক আর না-ই থাক, তবু এখানে উপনিবেশ গড়ে উঠেছে। এই দ্বীপের যারা বাসিন্দা, তাদের শতকরা নিরানব্বই জনই জঘন্য প্রকৃতির মানুষ। দেশকাল সম্বন্ধে তাদের কিছুমাত্র ধারণা নেই, দেশের ভালোমন্দ নিয়ে এদের কোনো ভাবনা নেই। নেশা আর। মেয়েমানুষ পেলেই এরা খুশি। জীবনে এ-সবই এদের চূড়ান্ত চাওয়া। এর বেশি দাবি এদের নেই, এর বাইরে এরা কিছু বুঝতেও চায় না।

এই কুৎসিত মানুষগুলিকে ঘৃণা করতেন নওয়াজ খান, কিন্তু আজকাল এদের জন্য করুণা হয়। বড় বেদনা বোধ করেন তিনি।

বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে কত বছর কেটে গেল তার? কখনো কখনো ভাববার চেষ্টা করেন নওয়াজ খান। স্মৃতিটা কেমন যেন ঝাপসা হতে শুরু করেছে। তবু সেই তারিখ এবং সালটা হুবহু মনে করতে পারেন।

আঠার শ’ আটান্নর দশই মার্চ ওয়াকার সাহেবের সঙ্গে এই দ্বীপে এসে পৌঁছেছিলেন নওয়াজ খান। এটা উনিশ শ’ এগারো সাল। মাঝখানে পুরো তিপ্পান্নটা বছর কেটে গিয়েছে।

তিপ্পান্ন বছর এই দ্বীপের অন্য বাসিন্দাদের সঙ্গে ফুসফুসে একই নোনা বাতাস টানছেন নওয়াজ খান। অন্য সকলের মতো এই উপনিবেশের ভাগ্যের সঙ্গে, এর সুখ-দুঃখের সঙ্গে, নিজের ভাগ্য এবং সুখ-দুঃখ একাকার করে মিশিয়ে দিয়েছেন। তাই এই দ্বীপটার ওপর কেমন যেন মায়া পড়ে গিয়েছে।

এতগুলো বছর কাটিয়ে আজকাল নওয়াজ খানের মনে হয়, বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপ, এর উপনিবেশ, এর বাসিন্দা-সবাইকেই বড় আপন করে নিয়েছেন।

তিপ্পান্ন বছর এই দ্বীপ ছেড়ে কোথাও যান নি নওয়াজ খান। সাজার মেয়াদ ফুরোবার পরও এখানেই থেকে গিয়েছেন। আগে আগে প্রায়ই ভাবতেন, মেইনল্যাণ্ডে চলে যাবেন। কিন্তু কোনদিন যেতে পারেন নি। এইদ্বীপটাকে যেমন তিনি ভালোবেসেছেন, এইদ্বীপও বুঝি তেমনি তাকেও ভালবেসে ফেলেছে। চলে যাবার কথা ভেবেছেনই শুধু, কিন্তু এই দ্বীপ অদৃশ্য শেকলে যেন তাকে বেঁধে রেখেছে। সেটা ছিঁড়ে চলে যাওয়া সম্ভব হয় নি।

এখানে থেকেই বরাবর মেইনল্যাণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেছেন নওয়াজ খান। যতখানি সম্ভব, দেশের চলতি জীবনধারার খোঁজ রেখেছেন। আঠার শ’ সাতান্নতে সিপাহী বিদ্রোহ তো নিজের চোখেই দেখে এসেছেন। সে-বিদ্রোহে তার অসাধারণ এক ভূমিকাও ছিল।

তিনি জানেন, আঠার শ’ পঁচাশিতে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের জন্ম। সেই বছরই বর্মা মুলুকে তৃতীয় ইঙ্গ-ব্ৰহ্ম যুদ্ধ হয়ে গেল। (সেই যুদ্ধের কয়েদিদের তো আন্দামানেই দেখেছেন নওয়াজ খান)। স্বাধীনতার জন্য এই শতকের প্রথম থেকেই আবার সংগ্রাম শুরু হয়েছে। এই তো সেদিন মুন্সিজির কাছে খবর পেয়েছেন, কয়েক দিনের মধ্যেই বাংলা দেশে থেকে আজাদী লড়াইর বন্দিরা এখানে এসে পড়বে।

মুন্সিজির মুখে খবরটা পাবার পর থেকেই অস্থির হয়ে উঠেছেন নওয়াজ খান। অদ্ভুত। এক উত্তেজনা তার ওপর ভর করে বসেছে।

এই কটা দিন গারাচারামা, পাহাড়গাঁও, লম্বা লাইন, গোল ঘর, মিঠাখাড়ি, ব্যাম্বু ফ্ল্যাট, ডাণ্ডাস পয়েন্ট–এই উপনিবেশের এক মাথা থেকে আর এক মাথায় উন্মাদের মতো ছুটে বেড়াচ্ছেন।

ডিলানিপুরের কুঠি থেকে ভোর হতে না-হতেই বেরিয়ে পড়েন। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। সারাটা রাত ঘুমোতে পারেন না। ছটফট করেন। দিনরাত বিচিত্র এক ঘোরের মধ্যে কেটে যায় নওয়াজ খানের। এই দ্বীপের কথা ভাবতে ভাবতে কিছুতেই স্থির থাকতে পারেন না।

কী আছে এইদ্বীপের? মহিমা নেই, গরিমা নেই, গৌরব নেই। মেইনল্যাণ্ডের মানুষের মনে এইদ্বীপ সম্বন্ধে যা আছে, তা হল ধিক্কার, ঘৃণা, আতঙ্ক। বিপুল ভারতবর্ষের গৌরবের ইতিহাসে এর কোনো ভূমিকাই নেই।

তবু জীবনের তিপ্পান্নটা বছর কাটিয়ে এইদ্বীপটাকে বড় ভালোবেসে ফেলেছেন নওয়াজ খান। সুখে দুঃখে, আশায় নৈরাশ্যে, সব সময় এইদ্বীপের সঙ্গে সঙ্গেই আছেন তিনি। এই দ্বীপের ভাগ্যকে নিজের ভাগ্য বলেই মেনে নিয়েছেন।

নওয়াজ খান ভাবেন, বঙ্গোপসাগরের এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপ তার জঘন্য বাসিন্দাদের নিয়ে চিরদিনই কি অপমানিত, ঘৃণিত এবং ধিকৃত হয়ে পড়ে থাকবে? ভাবতে ভাবতে মাথা গরম হয়ে ওঠে। তারপর যখন মস্তিষ্কের উত্তাপ জুড়িয়ে আসে তখন মনে হয়, এই দ্বীপের প্রথম উপনিবেশের প্রথম দিকের বাসিন্দা হিসাবে তার অনেক দায়। তিনি স্থির করে ফেলেছেন, বিপুল ভারতবর্ষের ইতিহাসে আন্দামান দ্বীপের একটা গৌরবময় অধ্যায় যোগ করে দেবেন। সেই আশায়, সেই উত্তেজনায় এই উপনিবেশের এক প্রান্ত থেকে আর-এক প্রান্তে প্রতিটি মানুষের কাছে তিনি ছুটে বেড়াচ্ছেন।

এখন দুপুর। সূর্যটা সরাসরি দ্বীপের মাথায় উঠে এসেছে।

আন্দামানের আকাশে এই মরশুমে কোত্থেকে যেন ঝাঁকে ঝাঁকে পারদেশি পাখি চলে এসেছে। ছোট ছোট পাখিগুলো খুশিতে ডগমগ হয়ে পাক খেয়ে খেয়ে উড়ছে।

কোনো দিকে খেয়াল নেই নওয়াজ খানের। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চড়াই ভাঙতে ভাঙতে তুষণাবাদের দিকে চলেছেন। সারা দেহ বেয়ে দরদর করে ঘাম ছুটছে। পা আর চলতে চায় না। হাঁটু দুটো ভেঙে আসছে। অসহ্য তৃষ্ণায় বুক ফেটে চৌচির হয়ে যাবে বুঝি। এগুতে এগুতে মনে হচ্ছে, কোমরটা বুঝি খসেই যাবে।

কিন্তু নওয়াজ খানকে এগুতে হবেই। কাল সন্ধ্যায় পোর্ট মোয়াট এসেছিলেন। রাতটা সেখানে কাটিয়ে সকালে তুষণাবাদের দিকে রওনা হয়েছেন।

সূর্যটা মাথার ওপর থাকতে থাকতেই তুষণাবাদের ‘বীটে’ পৌঁছে গেলেন নওয়াজ খান।

এই উপনিবেশের একটি মানুষকেও তিনি বাদ দেবেন না। কুঠিবাড়ি-ক্ষেতিবাড়ি-টাপু বিজন-জঙ্গলের বীট–সব জায়গায় ঘুরে ঘুরে, সব মানুষের কাছেই যাবেন। ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের সৈনিক হিসাবে তাঁর অনেক দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালনের তাগিদেই কদিন ধরে আন্দামান তোলপাড় করে বেড়াচ্ছেন।

‘বীটে’ এখন খানাপিনার সময়। ‘ফেলিং’-এর কাজ আপাতত বন্ধ রেখে কুলি জবাবদার-ফরেস্ট গার্ড–সবাই ঝুপড়িতে ফিরে এসেছে।

দু চারজন নতুন কয়েদি ছাড়া এই দ্বীপের প্রায় সকলের সঙ্গেই নওয়াজ খানের জান-পয়চান। এই ‘বীটে’র যারা তাঁকে চেনে, হল্লা করতে করতে তারা ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল, খান সাহেব এসেছে, খান সাহেব এসেছে–

ঝুপড়িগুলোর সামনে খানিকটা সমতল ঘাসের জমি। জমাদার শিবরাম পাণ্ডে স্বয়ং সেখানে রশির খাঁটিয়া পেতে দিল। নওয়াজ খানকে খাতির করে বসিয়ে বলল, বসুন, বসুন খান সাহেব। অ্যাদ্দিনে আমাদের কথা মনে পড়ল!

জবাবে অল্প একটু হাসলেন নওয়াজ খান।

এক পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল লখাই। নওয়াজ খানকে সে চেনে না। তবুও সুর্মারঞ্জিত দু’টি চোখ, মাথায় জরিদার তাজ, পরনে কামদার শিলোয়ার, কলিদার কুর্তা, শুড়তোলা বাহারে নাগরা, ধবধবে ভ্র এবং চুলের এই দীর্ঘ পুরুষটিকে দেখে তার মনে সম্ভ্রম জেগেছে। নওয়াজ খান যে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি, শিবরাম পাণ্ডের খাতিরের নমুনা দেখে এটা আন্দাজ করতে কোনো অসুবিধাই হচ্ছে না লখাইর।

লখাইর ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে জগদীপ।

লখাই জিজ্ঞেস করল, এ কে?

নওয়াজ সাহেব। বড়ে খানদানি আদমী। আন্দামানের সবাই চেনে তাঁকে। কমিশার সাহিব খুব খাতির করে।

শিবরামের রশির খাঁটিয়াতে শুয়ে পড়েছিলেন নওয়াজ খান।

এখানে আসার সময় রোদে, উত্তেজনায় এবং চড়াই ভাঙার ধকলে প্রাণটা বেরিয়ে যাবার উপক্রম হয়েছিল। সত্তর পঁচাত্তর বছর বয়স হয়েছে। এমনিতেই শরীর দুর্বল। তার ওপর কয়েক দিন ধরে সমানে অনিয়ম এবং ছোটাছুটি চলছে।

খানিক জিরিয়ে সুস্থ হলেন নওয়াজ খান। তারপর কুলি-জবাবদারদের সঙ্গে রোটি ভাজি-ডাল দিয়ে খানাপিনা সারলেন।

একটু পর কুলি-জবাবদারেরা আবার ‘ফেলিং’-এর কাজে চলে গেল।

এবার শিবরাম পাণ্ডে বলল, কী ব্যাপার খানসাহিব, এত তখলিফ করে এই জঙ্গলে এলেন যে?

একটু দরকার আছে।

কী দরকার?

নওয়াজ খান জবাব দিলেন না। এক মুহূর্ত কী যেন ভেবে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ফেলিং’-এর কাজ কখন শেষ হবে?

বিকেলে। আজকাল সন্ধে হলেই জারোয়ারা ঝামেলা বাধাচ্ছে। তাই বিকেলে ‘ফেলিং’ বন্ধ করে দিই।

নওয়াজ খান এবার প্রশ্ন করলেন, এখানে একটা বুশ পুলিশের ক্যাম্প আছে না?

জি, খানসাহিব।

বিকেলে কুলিরা ফিরলে ওরা বুশ পুলিশদের ডেকে আনতে পারবে?

পারবে।

বিকেলের দিকে রোদে গলা সোনার রং ধরল।

জঙ্গলের মাথায় প্রবাসী পাখিগুলো এতক্ষণ পাক খেয়ে উড়ছিল। এখন আর তাদের পাত্তা নেই। আন্দামানের আকাশে বাতাসের খামখেয়ালে কোত্থেকে যেন পেঁজা তুলোর মতো সাদা সাদা অসংখ্য মেঘের টুকরো ভেসে এসেছে। রোদের রং বদলালেও তেজটা এখনো পুরাপুরি বজায় আছে।

বেশ খানিকটা বেলা থাকতেই কুলি-জবাবদাররা ঝুপড়িতে ফিরে এল। শিবরাম পাণ্ডে তাদের কারোকে পাঠাল না। নিজে গিয়ে বুশ পুলিশদের ডেকে আনল। সকলে ঝুপড়ির সামনে ঘাসের জমিটায় বসে পড়ল।

নওয়াজ খান বুঝে উঠতে পারছিলেন না, ঠিক কিভাবে শুরু করবেন।

শিবরাম পাণ্ডে বলল, সবাইকে তো জুটিয়ে দিলাম। এবার যা বলতে চান, বলুন–

হাঁ, বলব। কেশে গলাটা সাফ করে নিলেন নওয়াজ খান। তারপর শুরু করলেন, যে-জন্যে এসেছি সেটা বলার আগে আর একটা কথা আছে।

কুলি-জবাবদার-পুলিশরা চুপচাপ বসে রয়েছে। সকলের মুখের ওপর দিয়ে দৃষ্টিটাকে একবার ঘুরিয়ে নিয়ে গেলেন নওয়াজ খান। তারপর গাঢ়, গম্ভীর স্বরে বলতে লাগলেন, কদিন ধরে আমি তামাম আন্দামান ঘুরে বেড়াচ্ছি। গারাচারামা, পাহাড়গাঁও, হার্দু, চৌলদাই, বিগি লাইন, এবারডিন বস্তি–সব জায়গায় গিয়ে যাকে পাচ্ছি, তাকেই কথাটা বলছি।

শিবরাম পাণ্ডে সামান্য অসহিষ্ণু হয়ে উঠল, আসল কথাটা বলুন খানসাহিব।

হাঁ হাঁ বলব, হোড়া সবুর।

রশির খাঁটিয়াটার ওপর বসে ছিলেন নওয়াজ খান। এবার কুলি-জবাবদারদের মধ্যে নেমে এলেন। বললেন, তামাম মেইনল্যাণ্ড জুড়ে ইংরাজদের সাথ লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে।

সামনের লোকগুলো চমকে উঠল।

শিবরাম পাণ্ডে আঁতকে ওঠে, ইংরাজদের সাথ লড়াই! কাহে?

আজাদীর জন্যে।

বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে রইল শিবরাম পাণ্ডে।

কোনো দিকে হুঁশ নেই নওয়াজ খানের। উত্তেজিত, চড়া গলায় তিনি বলে যাচ্ছেন, মেইনল্যাণ্ডের সব লোক খেপে উঠেছে। সবাই চায়, ইংরাজ আমাদের মুলুক ছেড়ে চলে যাক।

সামনের কুলি-জবাবদাররা সাড়াশব্দ করছে না। আজাদী যে ঠিক কী বস্তু, সে-সম্বন্ধে তাদের কোনো ধারণাই নেই। আর ধারণা নেই বলেই নওয়াজ খানের কথাগুলো তাদের কাছে ধাঁধার মতো ঠেকছে। অবাক হয়ে কথাগুলো শুনছে ঠিকই, কিন্তু কিছুই তাদের মাথায় ঢুকছে না।

নওয়াজ খান বলতে লাগলেন, তোমরা সেলুলার জেল দেখেছ। ইংরাজ আন্দামানেই খালি সেলুলার জেল বানায়নি। তামাম মুলুক জুড়ে সেলুলার জেলের মতো কয়েদখানা বানিয়েছে। ভারতের সব মানুষকে কয়েদি বানিয়ে রেখেছে।

শিবরাম পাণ্ডে ফিশফিশ করে বলল, কী বলছেন খানসাহিব!

বার বার আমি এই দ্বীপের সবাইকে বোঝাবার চেষ্টা করেছি, লেকিন কেউ বোঝেনি আমার জ্বালাটা। খুদাতাল্লার নামে বলছি, দুনিয়ার সব কিছুর নামে বলছি, তোমরা আমাকে একটু বোঝো। আমার পাশে এসে দাঁড়াও। বলে একটু থামলেন নওয়াজ খান। বুক তোলপাড় করে বড় বড় শ্বাস পড়ছে। এক হাতে বুকটা চেপে তিনি ফের শুরু করলেন, আমার অনেক বয়েস হয়েছে। বেশিদিন আর বাঁচব না। মরার আগে ইংরাজদের সাথ শেষ বুঝাঁপড়াটা করে যাব। তোমরা খালি আমার পাশে এসে দাঁড়াও।

শিবরাম পাণ্ডের গলার ভেতর থেকে ভয়ার্ত একটা শব্দ বেরিয়ে এল।

নওয়াজ খান বলতে লাগলেন, ভারতের সব জায়গায়র সব মানুষ আজাদীর জন্য পাগল হয়ে উঠেছে। আমরা কি চুপচাপ বসে থাকব?

কেউ জবাব দিল না। আসলে জবাবটা তাদের জানা নেই।

নওয়াজ খান থামলেন না, এক রোজ আজাদীর জন্যে লড়াই করে এই দ্বীপে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম সিপাহী লড়াইর যে আগুন–

নওয়াজ খানের কথা শেষ হবার আগেই জঙ্গল ছুঁড়ে পোর্ট ব্লেয়ার থানার থানাদার (দারোগা) এবং জনচারেক পুলিশ এসে পড়ল।

থানাদার বলল, এই যে খান সাহেব, আপনি এখানে! এদিকে আপনার খোঁজে তামাম আন্দামান ছুঁড়ে বেড়াচ্ছি।

কেন?

আপনাকে অ্যারেস্ট করার ওয়ারেন্ট আছে। চলুন।

একবার অসহায়, হতাশ চোখে সামনের মানুষগুলোর দিকে তাকালেন নওয়াজ খান। তারপর থানাদারের দিকে ঘুরে বললেন, চলুন।

তুষণাবাদের এই ‘বীটে’ যে-কথা বলতে শুরু করেছিলেন তা আর শেষ করতে পারলেন না নওয়াজ খান।

সবাই দেখল, নওয়াজ খান নামে দীর্ঘ পুরুষটি থানাদার আর পুলিশদের সঙ্গে সামনের জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

মন ভারি খারপ হয়ে আছে লখাইর। নওয়াজ খানকে এর আগে দেখে নি সে। তার কথাগুলো ঠিকমতো বোঝে নি। তবু নওয়াজ খান সম্বন্ধে অদ্ভুত এক সম্ভ্রম জেগেছে লখাইর মনে।

জঙ্গলের মাথায় সন্ধে ঘনিয়ে আসছে।

নওয়াজ খানের কথাগুলো ভাববার চেষ্টা করছে লখাই। জমাদার শিবরাম পাশে এসে বসল।

লখাই আস্তে আস্তে বলল, আচ্ছা শিবরামজি, পুলিশ খানসাহিবকে ধরল কেন?

লখাইর পিঠে বিরাট এক থাপ্পড় কশিয়ে শিবরাম পাণ্ডে খেঁকিয়ে উঠল, মুরুখ কহিকা। আরে উল্লু, খানসাহিব যে আজাদীর জন্যে ইংরাজদের সাথ লড়াই বাধাতে চায়। সেই জন্যই তো পুলিশ ধরল।

বিড় বিড় করে লখাই বলল, আজাদী কী? আজাদী কী? খানিকটা বকর বকর করে শিবরাম পাণ্ডে চলে গেল।

লখাই ভাবতে লাগল। এতকাল তার ধারণা ছিল, খুন-খারাপি-রাহাজানি-চুরি-ছেনতাই করলে পুলিশে ধরে। কিন্তু আজ দেখল, আজাদীর জন্য ইংরাজের সঙ্গে লড়াই করার কথা বললেও পুলিশ রেহাই দেয় না।

লখাইর হঠাৎই মনে হল, খুনখারাপি ইত্যাদি জঘন্য অপরাধের বাইরেও এমন অনেক কিছু আছে, যার কারণে পুলিশের কুনজরে পড়তে হয়। কিন্তু সে জন্য বোধ হয় এতটুকু অসম্মান কি অগৌরব নেই।

পেটি অফিসার নসিমুল গণি কেন যে তোষামোদ করে জঙ্গলে পাঠিয়েছিল, এবার একটু একটু টের পেতে লাগল লখাই।

সেই যে কানখাজুরায় কেটেছিল, তারপর থেকে তার শরীরটায় আর জুত নেই। এবার একটু একটু করে আমাশা আর পালাজ্বরে ধরল। রোজই বিকেলের দিকে পালা করে জ্বরটা আসে, মাঝরাতে ঘাম ছুটিয়ে ছেড়ে যায়।

আমাশা আর পালাজ্বরে দিনকয়েকের মধ্যে লখাই বড় কাবু হয়ে পড়ল। দিনকে দিন শরীরটা শুকিয়ে যেতে লাগল।

এতদিন গ্রাহ্য করে নি শিবরাম পাণ্ডে। কিন্তু যখন দেখল, শুধু লখাই-ই নয়, ‘বীটে’র আরো জন দশেক কুলি পালাজ্বরে পড়েছে, এবং ‘ফেলিং’-এর কাজ একরকম বন্ধ হওয়ার উপক্রম, তখন কিঞ্চিৎ টনক নড়ল।

একদিন জন ছয়েক বুশ পুলিশের হেপাজতে লখাই আর দশ জন কুলিকে সেলুলার জেলের হাসপাতালে পাঠিয়ে দিল শিবরাম।

সকাল হতে না হতে তুষণাবাদ থেকে রওনা হয়েছিল লখাইরা। সেলুলার জেলে পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেল।

আজ ডাক্তারি পরীক্ষা হবে না। কাল সকালে আবার জেল হাসপাতালে আসতে হবে।

যে বুশ পুলিশরা লখাইদের সঙ্গে করে এখানে এনেছিল, জেল সুপারিনটেনডেন্ট সাহেবের সঙ্গে দেখা করে তারাই সব ব্যবস্থা করে ফেলল। আজকের রাতটার মতো সকলে ফিনিস্ক বের বিজনে থাকবে। সকালে জেল হাসপাতালে ব্যারামী কুলিদের দেখিয়ে বিকেলে তুষণাবাদে ফিরে যাবে।

ব্যবস্থা অনুযায়ী বুশ পুলিশরা লখাইদের সঙ্গে নিয়ে ফিনিক্স বে রওনা হল।

বিজন পর্যন্ত আর পৌঁছতে হল না। তার আগেই রোজ বিকেলের দিকে নিয়ম করে যে পালা জ্বরটা আসে সেটা এসে পড়ল। ধুঁকতে ধুঁকতে এগুতে লাগল লখাই।

ফিনিক্স বের বিজনে এসে ভিখন আহীরের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।

লখাইর চেহারা দেখে ভিখন প্রায় আঁতকে ওঠে, এ লখাই ভেইয়া, চেহারার এমন হাল করেছিস কেমন করে?

যে লখাই খুনিয়ারা, দুর্দান্ত, সামান্য একটু সহানুভূতির কথায় সে কেঁদে ফেলল। বলল, আমাশা আর পালাজ্বর আমাকে সাবাড়ে করে দিচ্ছে রে ভিখন। বেশিদিন বাঁচব না। নির্ঘাৎ মরে যাব।

ভিখন সান্ত্বনা দেয়, মরার কথা বলছিস কেন? ঠিকমতো দাওয়াই পড়লে রোগ সেরে যাবে।

লখাইর চেহারা দেখে আর তার মরার কথাটা শুনে খুব দুঃখ করল ভিখন, সমবেদনা জানাল। মানুষের সহানুভূতির স্বাদ যে কত মিঠে, জীবনে এই প্রথম বুঝল লখাই।

ভিখনের সঙ্গে অনেক কথা হল। আন্দামান রিলিজ পেয়ে সে ফিনিক্স বের এই বিজনে এসে আছে। আজকাল হার্দুর ব্রিকফিল্ডে সে ইট পোড়ায়। অনেক কাল লখাইকে ছেড়ে আছে, সেজন্য বড় কষ্ট হয় ভিখনের। লা ডিনের খানা থেকে রোজ রোজ ভাগ নিয়েছে, অথচ তার বদলে কিছুই দিতে পারে নি। এজন্য তার অনুতাপের শেষ নেই। এমনি অনেক কথা বলে যায় ভিখন।

সন্ধের দিকে পালাজ্বরের দাপট অনেকটা কমে এল।

ভিখন বলল, চল লখাই ভেইয়া, একটু ঘুরে আসি। তোর সাথ অনেক কথা আছে। সে-সব বিজনে বসে হবে না।

বিজন-এর জমাদারের হুকুম নিয়ে লখাইকে সঙ্গে করে বেরিয়ে পড়ল ভিখন।

লখাই বলল, কোথায় যাবি?

হাবরাডিন বাজারে রংতামাশার খেল আছে। নাচাগানা হবে। তাই দেখতে যাব।

বাজার পেছনে ফেলে ভিখন যখন সোজা এবারডিন জেটির দিকে চালতে লাগল তখন লখাই বলল, এ কোথায় যাচ্ছিস রে শালে? রংতামাশা, নাচাগানা কোথায়?

ও-সর রাত্তিরে হবে। আগে জেটিতে চল।

পাথরের জেটিটা সোজা উপসাগরে ঢুকে গিয়েছে। ভিখন আহীর আর লখাই সেখানে পাশাপাশি বসল।

জেটিটা অন্ধকার। আশেপাশে অন্য কোনো মানুষজন নেই। উন্মাদ উপসাগর পাথুরে দেওয়ালে অবিরাম মাথা কুটছে। দূরের উঁচু উঁচু টিলাগুলি নারকেল গাছে ছয়লাপ। নারকেলের পাতায় পাতায় সামুদ্রিক বাতাস সাঁই সাঁই করে বেজে যাচ্ছে।

হঠাৎ সামনের দিকে নজর পড়ল লখাইর। সিসোস্ট্রেস উপসাগরের মাঝখানে বিরাট একটা জাহাজ নোঙর ফেলে আছে। একবার দেখেই লখাই চিনতে পারল, এই জাহাজেই তারা কালাপানির এই দ্বীপে এসেছিল। সেই এলফিনস্টোন জাহাজ।

আস্তে আস্তে লখাই বলল, কবে জাহাজ এসেছে রে ভিখন?

কাল। একটু চুপ করে রইল ভিখন। তারপর ফিশফিশ করে বলতে লাগল, জানিস লখাই ভেইয়া, এই জাহাজে আজাদী লড়াইর কয়েদিরা এসেছে।

আজাদী লড়াই! লখাই চমকে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে একটি দীর্ঘ চেহারার পুরুষের কথা মনে পড়ল তার। নওয়াজ খান। বিড় বিড় করে লখাই বলল, আজাদীর লড়াই হয়ে গিয়েছে?

লখাইর কথাগুলো ভিখনের কানে গিয়েছিল। সে বলল, হাঁ, বাংলা মুলুকে আজাদীর লড়াই হয়েছে।

সত্যি?

হাঁ সচ্। রামজি কসম।

অনেকক্ষণ চুপচাপ। হঠাৎ লখাই বলল, নওয়াজ খান সাহেবকে চিনিস ভিখন?

হাঁ হাঁ, জরুর। আন্দামানবালা কে না চেনে খানসাহিবকে?

গলার স্বরটা খাদে ঢুকিয়ে ফেলল ভিখন, নওয়াজ খানের মাফিক ইতনা বড়ে মরদ আন্দামানে আর কয়েদ খাটতে আসে নি। আজাদীর জন্যে এংরাজবালাদের সাথ লড়াই করে এখানে এসেছিল। এখানে এসেও বার বার এংরাজবালাদের সাথ লড়াই বাধাতে চেয়েছে। লেকিন কয়েদি কুত্তাগুলো তার সাথ হাত মেলায় নি। এই তো এবারও লড়াইর ইন্তেজাম করেছিল খানসাহিব। বহুত খারাপ নসিব, খানসাহিবকে কমিশনার সাহিব আটক করেছে। মুন্সিজি সেদিন বলছিল, এংরাজবালা খানসাহিবকে নাকি এই দ্বীপে থাকতে দেবে না। মেইনল্যাণ্ডে ফেরত পাঠিয়ে দেবে।

নওয়াজ খানের কথা ভাবতে চেষ্টা করল লখাই। এক-একটা মানুষ আছে, যারা জীবনে একবার মাত্র দেখা দিয়েই মনের ওপর গভীর ছাপ রেখে যায়। নওয়াজ খানের সঙ্গে সেভাবে পরিচয় হয় নি লখাইর, কিন্তু একটিবার দেখে, কয়েকটা মাত্র কথা শুনে, তাকে কিছুতেই ভুলতে পারছে না সে।

এখন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়তে শুরু করেছে। এই সময়টা মাথা বড়ে ফাঁকা ফাঁকা লাগে, শরীর ভয়ানক দুর্বল হয়ে পড়ে। আশক্ত শরীরে, ফাঁকা মাথায় এই মুহূর্তে নওয়াজ খানের কথা ঠিকমতো ভাবতে পারছে না লখাই। তবু কেন জানি তার মনে হল, ইংরাজদের সঙ্গে লড়াই করে কাল যারা এই দ্বীপে কয়েদ খাটতে এসেছে, তাদের সঙ্গে নওয়াজ খানের কোথায় যেন একটা যোগ আছে।

কিছুক্ষণ বাদে সামুদ্রিক বাতাসে শীত ধরে গেল।

লখাইকে নিয়ে উঠে পড়ল ভিখন। বেশ খানিকটা রাত হয়েছে। এবারডিন বাজারের দিকে চলতে চলতে সে একেবারে ভিন্ন কথা পাড়ল, এ লখাই দাদা, একটা বড় বুরা খবর আছে।

লখাই বলল, কী খবর?

শুনলে তোর গু হবে।

আরে, বল না শালে।

তোকে এক রোজ চান্নু সিংয়ের কথা বলেছিলাম না?

চান্নু কুত্তাটা আবার কে?

পুরানা এক কয়েদি। ইয়াদ করে দ্যাখ লখাই দাদা। সেই যে-শালে সোনিয়াকে শাদি করতে চায়–মনে করতে পারছিস না?

এবার লখাইর মনে পড়ল। বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে সেলুলার জেলে আসার কয়েকদিন পরই ভিখন কোত্থেকে যেন খবরটা জুটিয়ে এনেছিল। শুনে খেপে উঠেছিল লখাই।

প্রায় দুমাসের মতো তুষণাবাদের ‘বীটে’ কাটিয়ে এসেছে লখাই। এর মধ্যে উজাগর সিং, মিমি খিন, ফরেস্ট গার্ড আবর খান, জগদীপ, মঙ ফা, জারোয়া–বিচিত্র মানুষ আর বিচিত্ৰতর ঘটনার মধ্যে ডুবে ছিল সে। আন্দামানের অরণ্য বাকি পৃথিবী থেকে তাকে। বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল।

তুষণাবাদে থাকার সময় মাঝে মাঝে সোনিয়ার কথা ভাবতে চেষ্টা করেছে লখাই। কিন্তু ভাবনাটা তেমন জমে নি।

লখাইর মনে হয়, আন্দামানের জঙ্গল বড় সাতিক। সেখানে যে ঢোকে তাকেই সে গ্রাস করে ফেলে। শুধু গ্রাসই করে না, তার মন থেকে বাইরের সমস্ত স্মৃতি মুছে ফেলে। একবার সেখানে যে যায়, নিজের ভাবনা ছাড়া অরণ্য তাকে অন্য কিছুই চিন্তা করতে দেয় না।

লখাইর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল ভিখন। বলতে শুরু করল, একেবারে পাক্কা খবর পেয়েছি লখাই দাদা।

কী খবর?

তিন রোজের মাথায় চান্নু শালের সাথ সোনিয়ার শাদি হয়ে যাবে।

অনেক, অনেকদিন পর সোনিয়ার যে-সংবাদটা পাওয়া গেল সেটা আদৌ সুখকর নয়। সে হচ্ছে সেই জাতের মানুষ, যখন যা হাতের সামনে পায় তা-ই নিয়েই মেতে ওঠে। তখন দুনিয়ার বাকি সব কিছু ভুলে যায়।

এই মুহূর্তে পালাজ্বর, আমাশা, এবারডিন বাজারে যাওয়ার এই সড়ক, এই অন্ধকার রাত্রি–পৃথিবীর সব কিছু ভুলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে লখাই, সোনিয়াকে শাদি করবে চান্নু! কক্ষনো না! শালেকে খুন করব।

ত্রস্ত স্বরে ভিখন বলল, লেকিন লখাই ভেইয়া, ডিপটি কমিশার সাহিব শাদির ব্যবস্থা যে বিলকুল পাক্কা করে দিয়েছে।

কে বলল?

রোজ রোজ রেণ্ডিবারিক কয়েদখানায় তাঁত বোনা শেখাতে যায় যে পিয়ারীলাল সে বলেছে। পোড়া, বীভৎস মুখটা কাচুমাচু করে ভিখন বলল, খবরটা একেবারে সাচ্চা।

আক্রোশে চোখ জোড়া জ্বলছে লখাইর। চোয়াল কঠিন হয়ে উঠেছে।

প্রায় দুটো মাস আন্দামানের জঙ্গল তাকে দুনিয়া থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। এর ভেতর সোনিয়ার কথা তেমন করে ভাবে নি লখাই। সোনিয়াকে একরকম বুঝি ভুলতেই বসেছিল। কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে অদ্ভুত এক উত্তেজনা আর আক্রোশের মধ্যে লখাই বুঝতে পারল, দারিয়ার সেই সঙ্গিনী তার স্মৃতির গোপন কুঠুরিতে থেকেই গেছে।

হাঁটতে হাঁটতে শেষ পর্যন্ত তারা এবারডিন বাজারে এসে পড়ল।

চীনা রেড্ডির সরাইখানার সামনে রং-তামাশার খেল চলছে। চট বিছিয়ে নাচের আসর বসানো হয়েছে। চারপাশে গুটিকতক গ্যাসের বাতি জ্বলছে।

ফিনিক্স বে, ডিলানিপুর, হার্দু, চৌলদাই–পোর্ট ব্লেয়ারের নানা বিজন আর টাপু থেকে কয়েদিরা রং-তামাশার আসরে এসে জমায়েত হয়েছে। তা ছাড়া পাহাড়গাঁও, গারাচারামা, ডাণ্ডাস পয়েন্ট অর্থাৎ পেনাল কলোনির অন্য সব বস্তি থেকেও অনেকে এসেছে।

এখন পুরোদমে নাচ চলছে।

এক হট্টাকাট্টা চেহারার কয়েদি দাড়িগোঁফ চেঁছে, মাথায় পরচুলা লাগিয়ে, চোখে মোটা রেখায় সূর্মার টান মেরে, টকটকে একটা লাল ঘাঘরা পরে নাচনেবালী সেজেছে। একটা দোপাট্টাও জুটিয়েছে। ঘোমটার আকারে সেটা মাথায় তুলে কোমরে লছক খেলাবার চেষ্টা করছে। কোমরটা কিন্তু ঘুরছে না। থলথলে মাংসল ভুঁড়িটাই দোল খাচ্ছে।

তামাশাবালী নানা ভঙ্গি করছে। কোমর দোলাচ্ছে, চোখের চাকু মারছে, আর কর্কশ বাজখাই স্বরটাকে যতটা সম্ভব মোলায়েম করে গাইছে?

আ ভো সৈয়া কা করি হ্যায় আঁইরে
চৈতো বীতর যাইছে।
পতোয়া লিখা লিখা ভেজা বিদেশোয়া
সৈঁয়া ছোড় দে নোকরিয়া–
ছোড় দে নোকরিয়া—

তালের মাথায় তামাশাবালী একই সঙ্গে কোমর আর মাথা দোলায়। শুধু কি তার কোমর আর মাথাই দুলছে, চারপাশের মানুষগুলো সমানে মাথা ঝাঁকাচ্ছে। থেকে থেকে হল্লা করে উঠছে, শাবাশ দিলজ্বালানেবালী–

শাবাশ নাচনেবালী, দিল খুশকরনেবালী—

শাবাশ জানতুড়নেবালী–

এক পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে লখাই। অন্য সময় হলে এই খেমটা নাচ থেকে, এই রং-তামাশার খেল থেকে সকলের মতো সেও মজা লুটত। কিন্তু সোনিয়ার জন্য উত্তেজনা, আক্রোশ এবং হতাশা-মেশানো বিচিত্র এক মনোভাব তাকে অস্থির করে রেখেছে। কোনো ব্যাপারেই এখন তার হুঁশ নেই, ভ্রূক্ষেপ নেই।

হঠাৎ পাশ থেকে ফিশফিশ করে ভিখন ডাকল, লখাই দাদা—

ডাকছিস কেন?

আমার কাছে আয়।

ভিখনের পাশে ঘন হয়ে এল লখাই। কী বলছিস?

মুখটা লখাইর কানে গুঁজে দিল ভিখন। গলা আরো নামিয়ে বলল, ওই দ্যাখ, ওই যে চান্নু শালে ভি এখানে এসে জুটেছে।

কোথায়? লখাই চমকে উঠল।

হাত বাড়িয়ে ভিখন দেখাল। আসরের এক কোনায় বিরাট চেহারার চান্নু সিং বসে আছে। মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে নাচ আর গানের খুব তারিফ করছে। উৎসাহে মাঝে মাঝে তামাশাবালীর সঙ্গে গলা মিলিয়ে চেঁচিয়ে উঠছে, ছোড় দে নোকরিয়া–

একদৃষ্টে কিছুক্ষণ চান্নু সিংয়ের দিকে তাকিয়ে রইল লখাই। চোখদুটো তার ধিকি ধিকি জ্বলতে লাগল। একবার মনে হল, চান্নুর ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে টুটিটা ছিঁড়ে ফেলে।

লখাই হচ্ছে, সেই জাতের মানুষ, বিচার-বিবেচনা-চিন্তা, কোনো কিছুর ধার ধারে না। উত্তেজনা এবং হঠকারিতার বশে যা প্রাণ চায় তাই করে বসে।

আশ্চর্য, লখাই শুধু ভাবলই, কিন্তু চান্নু সিংয়ের কণ্ঠনালিটা ছিঁড়ে ফেলতে পারল না। এমনকি লাফিয়ে তার ঘাড়েও পড়ল না।

লখাই জানে না, অজান্তে, অলক্ষ্যে তার নিজের স্বভাবের মধ্যে কোথায় যেন পরিবর্তন শুরু হয়েছে। পালাজ্বর, আমাশা, কানখাজুরার বিষ, আন্দামানের অরণ্য, আবর খান এবং বিন্দির কান্না একটু একটু করে তাকে জুড়িয়ে ফেলেছে।

আজকাল রাগ হয়তো হয়, উত্তেজনাও হয়, কিন্তু বেঁকের মাথায় হঠাৎ কিছু সে করে ফেলতে পারে না।

চান্নু সিং আর সোনিয়ার শাদির কথা শোনার পর থেকেই মনটা খারাপ হয়ে ছিল। চান্নুকে দেখার পর মেজাজটা ভয়ানক খিঁচড়ে গিয়েছে। এই রং-তামাশার খেল, কোমর ঢুলিয়ে দুলিয়ে নাচ, চড়া তালের গান–কিছুই ভাল লাগছে না লখাইর।

কনুই দিয়ে ভিখনের পাঁজরে আস্তে একটা গুঁতো মারল লখাই, আই কুত্তা—

কী বলছিস লখাই দাদা?

বিজনে চল।

একটু সবুর লখাই ভেইয়া, আগে খেলটা খতম হতে দে।

চল শালে, হাঁকাবো অ্যায়সা কোঁতকা—

ঠিক হ্যায়, ঠিক হ্যায়। চল–

একসময় এবারডিন বাজার পেছনে ফেলে ফিনিক্স বের দিকে হাঁটতে শুরু করল লখাই। বেজার মুখে ভিখন আহীরও সঙ্গে সঙ্গে চলতে লাগল।

ফিনিক্স বের বিজনে অনেকটা রাত পর্যন্ত ঘুমোতে পারল না লখাই।

ঠাণ্ডা বাতাসে মাথা জুড়িয়ে এসেছে। রাগ, উত্তেজনা, আক্রোশ–এখন সবই অনেকটা শান্ত।

চোখ বুজে সোনিয়ার কথা ভাবছে লখাই। দরিয়ার সেই সঙ্গিনীকে কিছুতেই ভুলতে পারছে না সে।

চান্নু সিংয়ের সঙ্গে শাদি হবে সোনিয়ার। ডেপুটি কলিশনারের আফিসে শাদির পাকা বন্দোবস্ত হয়ে গিয়েছে। ভিখন যে-খবর এনেছে, তাতে মনে হয়, এ-শাদি কিছুতেই ঠেকানো যাবে না।

নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করল লখাই। অনেক মেয়েমানুষ এসেছে তার জীবনে। ভোগ করার পরই তাদের সম্বন্ধে আর কোনো উৎসাহই থাকে নি। ছেঁড়া কানির মতো তাদের ছুঁড়ে ফেলে অন্য মেয়েমানুষের পেছনে হন্যে হয়ে ছুটে বেড়িয়েছে সে। ভোগের বাইরে নারীর অন্য কোনো প্রয়োজন কি মহিমা সে বোঝে না, স্বীকারও করে না। কিন্তু সোনিয়ার কথা একেবারেই ভিন্ন। এই মুহূর্তে সোনিয়ার কথাই ভাবছে লখাই। পরস্পর সঙ্গতি বজায় রেখে সে ভাবতে শেখে নি। এলোমেলো, ছন্নছাড়া, টুকরো টুকরো কতকগুলো ভাবনা তার মনে জটলা করছে।

দুবার মাত্র সোনিয়াকে দেখেছে লখাই। প্রথম বার এলফিনস্টোন জাহাজে, পরের বাররসদ্বীপে। প্রথম বার পুরো একটা রাত তার সঙ্গে কাটিয়েছে লখাই। তার জীবনের কথা কিছু কিছু শুনেছে। কিন্তু দ্বিতীয় বার একটা কথাও হয় নি।

সোনিয়ার মুখেই লখাই শুনেছে, কোতল করেদ্বীপান্তরী সাজা নিয়ে আন্দামানে এসেছে সে।

ঝড়ের দরিয়ায় জাহাজের হোলে প্রথম দেখা হয়েছিল। তখন অসহ্য যন্ত্রণায় বুকটা ছিঁড়ে পড়ছিল লখাইর। আস্তে আস্তে নরম হাতে বুকটা ডলে দিয়েছিল সোনিয়া। কষ্টটা জুড়িয়ে গিয়েছিল।

লখাই ভাবতে চেষ্টা করল, হাতটা যার এত নরম, দিলটা তার এত কঠিন কেন? কঠিনই তো। না হলে সোনিয়া কোতল করে কেমন করে? কোতলই যদি করে এল, তবে দুবছর পর কালাপানির জাহাজে সে কাঁদল কেন? মানুষ মনের দরদেই তো কাঁদে। যার মনে এত দরদ, সে কোতল করে কেন? নাঃ, সোনিয়ার মন বড় দুৰ্জ্জেয় বস্তু। সে-মনের নাগাল পাওয়া লখাইর সাধ্য নয়।

সোনিয়ার দেহ দখল করতে পারে নি লখাই। তার দিলেরও হদিস পায় নি। দেহ কি মন, কোনোটাই আয়ত্ত করতে পারে নি বলেই সোনিয়ার জন্য দুর্বোধ্য এক আকর্ষণ বোধ করে সে।

কিন্তু না, সোনিয়াকে কোনোদিনই পাওয়া যাবে না। চান্নুর সঙ্গে তার শাদি হয়ে যাবে।

রাগ নয়, উত্তেজনা নয়, আক্রোশ নয়, এখন বড় কষ্ট হচ্ছে লখাইর। অদ্ভুত এক ব্যথা বুকের মধ্যে পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে।

এই ব্যথার মধ্য দিয়েই জীবনে এই প্রথম একটা বিচিত্র সত্যের চেহারা দেখতে পেল লখাই। ইচ্ছা-সাধ-লালসা থাকলেও সবসময় সব নারীকে দখল করা যায় না। এই না পাওয়ার অবুঝ, আকণ্ঠ, অসহ্য ক্লেশ নিয়েই বুঝিবা সারাটা জীবন কাটাতে হবে। এই সোজা, সহজ সত্যটা বুঝে বুক তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে লখাইর।

এতকাল যে-মেয়েমানুষ চোখে লাগত তাকে ভোগদখল করতে না পারলে ভয়ানক রাগ হত তার। কিন্তু জীবনে মেয়েমানুষকে না-পাওয়ার জন্য তার কষ্ট হচ্ছে।

এই ধরনের কষ্টবোধ জীবনে এই তার প্রথম।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress