Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সিন্ধুপারের পাখি || Prafulla Roy » Page 10

সিন্ধুপারের পাখি || Prafulla Roy

এইমাত্র মুন্সিজির মুখে সঠিক খবরটা পেলেন নওয়াজ খান।

পাঁচ বছর আগুপিছু কালাপানি পেরিয়ে তারা এই দ্বীপে এসেছিলেন। সেই সুবাদে : মুন্সিজির সঙ্গে নওয়াজ খানের অনেক কালের পরিচয়।

এই দ্বীপের অন্য কয়েদিদের মতো মুন্সিজিও নওয়াজ খানকে খাতির করে। শুধু খাতিরই নয়, এখানে যা দুর্লভ, সেই ভালবাসাও আছে দুজনের মধ্যে। দেখা হলেই একে অন্যের কুশল জিজ্ঞেস করে, দিল মর্জি হাল হকিকতের খবর নেয়। অনেক কাল এক সঙ্গে একই দ্বীপের মাটিতে কাটিয়ে, ফুসফুসে একই নোনা বাতাস টেনে টেনে নিজেদের মধ্যে নিবিড় বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন নওয়াজ খান আর মুন্সিজি।

খাঁটি জাতের মানুষ মুন্সিজি। খানিকটা লেখাপড়াও শিখেছে। দু চার বছর হাই স্কুলেও না কি পড়েছে।

ঝোঁকের মাথায় সাঙ্ঘাতিক একটা অপরাধ করে এই দ্বীপে কয়েদ খাটতে এসেছিল মুন্সিজি। অপরাধের জন্য অনুতাপের অন্ত নেই তার। মুখ বুজে পুরো দশটা বছর কয়েদ খেটে প্রায়শ্চিত্ত করেছে। পাপের যে-বোধটা মনের ওপর ভারী একটা পাথরের মতো চেপে ছিল, সারা দিন নিজেকে অকথ্য নির্যাতন করে সেটাকে নামিয়ে দেবার চেষ্টা করেছে। দেওয়ালে কপাল ঠুকেছে, নিজের হাত কামড়েছে, একরকম নিজেকে পীড়ন করেই অপরাধের বোধটাকে হালকা করতে চেয়েছে মুন্সিজি।

পেটি অফিসার যখন ডাণ্ডা হাঁকিয়েছে, টিকটিকিতে চাপিয়ে বেত মেরে যখন তার পাছার মাংস ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে, বিস্বাদ কাঞ্জিপানি যখন গলা দিয়ে আর নামতে চায়নি, পাথর ভাঙতে ভাঙতে যখন হাত দুটো খসে পড়ার উপক্রম হয়েছে, তখনো গলা দিয়ে একটা শব্দ বার করেনি মুন্সিজি। মুখ বুজেই থেকেছে। মুন্সিজির মনে হয়েছে, এগুলো তার প্রাপ্য।

দশ বছর কয়েদ খেটে আর নিজেকে নির্যাতন করে এখন খানিকটা শান্ত হয়েছে মুন্সিজি। তবু মাঝে মাঝে সেই পাপবোধটা কোথায় যেন বিধতে থাকে। আর তখনই অস্থির হয়ে ওঠে সে।

বড় খাঁটি জাতের লোক মুন্সিজি। তা না হলে তার মতো একটা সাধারণ কয়েদির সঙ্গে নওয়াজ খানের মতো অসাধারণ মানুষের বন্ধুত্ব হয় কেমন করে?

প্রায় নওয়াজ খানের মতোই বয়স হবে মুন্সিজির। মাথার চুলগুলো বকের পাখার মতো সাদা। এত বয়স হয়েছে, তবু মেরুদণ্ডটি খাড়া, মজবুত। চওড়া কবজি, চোখের নজর ধারাল।

শাদি করে নি মুন্সিজি। শাদি করার ইচ্ছাও নেই।

মুন্সিজি সেলুলার জেলের রেকর্ড কিপার। কোন কয়েদি কখন বাইরে যায়, কোন ফাইলে কত কয়েদি থাকে, রোজ কত মণ কোপরা কাটা হল, কটা বেতের কুরসি বানানো হল, কোন কয়েদি কদিন ডাণ্ডা বেড়ির সাজা পেয়েছে, কোন কয়েদি কঘা বেত খেল–এ-সবের রেকর্ড রাখতে হয় তাকে। রেকর্ড রাখাই তার কাজ, তার নৌকরি। এ-জন্য মাসে মাসে সাত টাকা তলব পায় মুন্সিজি।

দুবরাজের ছুটি নিয়ে মচ্ছি লাইনে গিয়েছিল মুন্সিজি। সেখান থেকে তাকে খুঁজে বার করেছেন নওয়াজ খান। এখন সিসোস্ট্রেস উপসাগরের পাড়ে একটা নারকেল বাগিচায় বসে আছে দুজনে।

চারদিকে মুখ ঘুরিয়ে যতদূর দেখা যায়, দেখে নিল মুন্সিজি। না, আশেপাশে কেউ নেই। অনেকটা দূরে একদল কয়েদি উপসাগরের বাঁধ মেরামত করছে।

নিঃসন্দেহ হয়ে মুন্সিজি বলল, খবরটা সাচ্চা।

নওয়াজ খান বললেন, ছোকরাদের বাহাদুর বলতে হবে। আমরা যা পারি নি, ওরা তা করে ফেলল। বাহাদুর না হলে এমনটা পারে? কী বল মুন্সিজি?

হাঁ হাঁ। ও তো ঠিক বাত।

তুমি ঠিক জানো, মেইনল্যাণ্ডে (ইণ্ডিয়া) ইংরাজদের সাথ লড়াই হয়েছে?

সেই রকমই তো শুনেছি।

কী শুনেছ? নওয়াজ খান মুন্সিজির দিকে ঝুঁকে পড়লেন। উত্তেজনায় তার চোখজোড়া চক চক করছে। হাতের মুঠি দুটো পাকিয়ে যাচ্ছে।

মুন্সিজি বলল, লড়াইটা হয়েছে বাংলা মুলুকে। বেশি দিন নাকি ইংরাজকে আর ইণ্ডিয়ায় থাকতে হবে না।

বল কী!

তাই তো মালুম হচ্ছে। লড়াইতে অনেক ইংরাজ বিলকুল খতম হয়ে গিয়েছে। অবস্থা খুব খারাপ খান সাহেব।

এত দূরে আন্দামানে বসে কী করে বুঝলে?

চিফ কমিশনার, ডেপটি কমিশনার, জেলার আর সুপারিনটেনডেন্ট সাহেব ঘন ঘন মুলাকাত করছে। কী একটা পরামর্শ যেন চলছে।

নওয়াজ খান উগ্রীব হয়ে উঠলেন, কী পরামর্শ, কিছু শুনেছ?

না খান সাহেব। তবে আন্দাজ করছি।

সতর্ক চোখে চারদিক আরো একবার দেখে নেয় মুন্সিজি। তারপর ফিশফিশ করে বলতে থাকে, বাংলা মুলুকে ইংরাজদের সাথ যে-লড়াই হয়েছে, মনে হয়, সে-ব্যাপার নিয়ে কমিশনার সাহেবরা খুব ঝামেলায় পড়েছে।

হুঁ।

কিছুক্ষণ চুপচাপ।

হঠাৎ নওয়াজ খান বললেন, তোমার কি মনে হয় মুন্সিজি, বাংলা মুলুকে ইংরেজদের সাথ যে–লড়াইটা হয়েছে সেটা ভারী লড়াই?

হাঁ, জরুর। মুন্সিজি বলতে লাগল, ভারী লড়াই যদি না হবে, তা হলে জাহাজ ভরে কয়েদি আসছে কেন?

সামনের দিকে তাকালেন নওয়াজ খান। সিসোস্ট্রেস উপসাগরের মাথায় এক ঝাক সাগরপাখি অহেতুক উড়ে বেড়াচ্ছে। তেজী রোদের টানে নীল জল বাষ্প হয়ে উড়ে যাচ্ছে। যতদূর তাকানো যায়, মনে হয়, সাদা কুয়াশা জমেছে। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, কুয়াশা নয়,–বাষ্প।

কী যেন ভাবছিলেন নওয়াজ খান। নিজের মধ্যে তলিয়ে গিয়েছিলেন বুঝিবা অনেকক্ষণ পর আস্তে আস্তে বলতে লাগলেন, আচ্ছা মুন্সিজি, এবার জাহাজ তো বাংলা মুলুক থেকেই আসছে?

হাঁ।

কবে আসছে?

বিশ পঁচিশ রোজের ভেতর।

একসময় উঠে পড়লেন নওয়াজ খান। সিসোস্ট্রেস উপসাগরের পাড় দিয়ে যে সড়কটা আটলান্টা পয়েন্টে বাঁক ঘুরে ফিনিক্স বের দিকে চলে গিয়েছে, সেদিকে এগিয়ে গেলেন।

ভোর হতে না-হতেই ডিলানিপুরের কুঠি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন বন্দা নওয়াজ খান। আন্দামানের বাতাসে যে গুজবটা উড়ছিল, সেটার সত্যমিথ্যা যাচাই করার জন্য মচ্ছি লাইনে গিয়ে মুন্সিজিকে খুঁজে বার করেছেন। খাঁটি খবর নিয়ে এখন কুঠিতে ফিরছেন।

এখন দুপুর। হাঁটতে হাঁটতে ফিনিক্স উপসাগরের কাছাকাছি এসে পড়েছেন নওয়াজ খান।

উপসাগরটা জ্বলছে। অনেক দূরে লবণ-মেশা বিপুল দরিয়াটা জ্বলছে। উপসাগরের মাথায় বিরাট এক টুকরো নীল আকাশ জ্বলছে।

।উপসারের পাড় দিয়ে সড়ক। চলতে চলতে একবার থমকে পড়লেন নওয়াজ খান। সাদা ভুরুর ওপর হাত রেখে আকাশের দিকে তাকালেন। বুঝিবা বেলা কতটা হয়েছে, আন্দাজ করতে চাইলেন। তারপরই আবার হাঁটতে শুরু করলেন।

আকাশ জ্বলছে, সমুদ্র জ্বলছে। শুধু কি আকাশ আর সমুদ্র, নওয়াজ খানের মনে হল, শিথিল কোঁচকানো চামড়ার তলায় অনেক, অনেক কাল পরে রক্তও জ্বলতে শুরু করেছে। ঠিক জ্বলছে না, ফুটছে। টগবগ করে ফুটছে।

বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডটা সত্তর না আশি বছর ধরে সমানে টিক টিক করে বাজছে। সেটার অস্তিত্ব একরকম ভুলেই গিয়েছিলেন নওয়াজ খান। কতকাল পর যেন হৃৎপিণ্ডটা আবার উন্মাদ বেগে লাফাতে শুরু করেছে। সরু সরু শিরা বেয়ে মন্থর, হিম হিম রক্ত তির তির করে বইত। সেই রক্তই হঠাৎ প্রবল উচ্ছ্বাসে ধমনীতে ঘা মারছে। অদ্ভুত এক উত্তেজনায় কুঁদ হয়ে রয়েছেন তিনি।

নওয়াজ খান ভাবছিলেন, ছন্নছাড়া কতকগুলো ভাবনা তার মাথায় ভর করেছে। একটু আগে মুন্সিজি যে-খবরটা দিয়েছে, সেটার সঙ্গে এই ভাবনাগুলোর আশ্চর্য যোগ আছে।

তিপ্পান্ন বছর আগে একদিন বুকের মধ্যে সিপাহী বিদ্রোহের আগুন নিয়ে এই দ্বীপে এসেছিলেন। বুকের সেই আগুনটাকে শুধু নিজের মধ্যেই ধরে রাখতে চান নি নওয়াজ খান, অন্য সবার ভেতরেও ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু সেই আগুন কাদের দিয়ে যাবেন তিনি? এইদ্বীপে প্রতি মাসে যারা কয়েদ খাটতে আসে, তারা কি মানুষ! তারা ঠগ-লুটেরা-খুনি, ইন্দ্রিয় আর আদিম প্রবৃত্তির ক্রীতদাস একদল বিচিত্র জীব। নওয়াজ খানের মনে হয়, মানুষের আকৃতির মধ্যে কতকগুলি কুৎসিৎ বর্বর প্রতি মাসে জাহাজ ভরে এখানে আসে। ওরা সিপাহী বিদ্রোহের মহিমা বোঝে না, দেশের আজাদীর জন্য এদের মাথাব্যথা নেই। কিছু নেশার চীজ আর নারীমাংস পেলেই এরা খুশি, তৃপ্ত। জীবনে এগুলোই তাদের চূড়ান্ত চাওয়া। এর চেয়ে বেশি দাবি তাদের নেই। নারী-নেশা, অশ্লীল গুলতানি, খিস্তি-খেউড়–এ-সবের মধ্যেই তাদের যা কিছু মাহাত্ম। এর বাইরে তারা কিছুই বোঝে না, বুঝতেও চায় না।

প্রথম প্রথম খেপে উঠতেন নওয়াজ খান। গালাগাল করতেন, শালারা শরাব আর আওরত ছাড়া কিছুই বুঝিস না!

নওয়াজ খানের গালি তারা গায়ে মাখত না। বরং আমোদই লাগত তাদের। খ্যা খ্যা করে হেসে বলত, ঠিক ধরেছেন খান সাহেব, দুনিয়ায় ও দুটো চীজ ছাড়া কুছু নেই।

অনেক বছর এইদ্বীপে থেকে, অনেক দেখে, অনেক ঠেকে এখন অনেক কিছু শিখেছেন নওয়াজ খান। এই মানুষগুলোর ওপর খেপে উঠে কোনো লাভই হবে না। উপরন্তু এরা নাগালের বাইরে বলে যাবে।

এই মানুষগুলোর দেশ-কাল সম্বন্ধে কোনো ধারণাই নেই। কতকগুলি উৎকট জৈবিক সুখ ছাড়া এরা আর কিছুই ভাবতে পারে না।

নেশা আর নারী ছাড়া জীবনে অন্য মাহাত্ম্যও যে আছে, হাজার চেষ্টা করেও এ-কথা বোঝাতে পারেন নি নওয়াজ খান। এই দ্বীপে এমন একটি মানুষ তার চোখে পড়ে নি, যার মধ্যে সিপাহী বিদ্রোহের সেই আগুন তিনি রেখে যেতে পারেন।

সূর্যটা সরাসরি মাথার ওপর উঠে এসেছে। উপসাগর এখন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু কোনো দিকে খেয়াল নেই নওয়াজ খানের। আগের ভাবনাগুলোর খেই ধরে তিনি ভেবেই চলেছেন। তেমন মানুষ কি তিনি একেবারেই পাননি, যার মধ্যে সিপাহী যুদ্ধের সেই আগুন দিয়ে যেতে পারেন, যে তার জ্বালাটা বুঝতে চায়? প্রশ্নটা যেন নিজেকেই করলেন নওয়াজ খান। জবাবটাও নিজের কাছ থেকেই পেলেন।

সেটা আঠার শ’ পঁচাশি কি ছিয়াশি সাল। সঠিক তারিখ মনে নেই।

এই দ্বীপে থেকেই তিনি খবরটা পেয়েছিলেন। বর্মা মুলুকের মান্দালয়ে নাকি ইংরেজদের সঙ্গে বর্মীদের লড়াই হয়েছে। খবরটা এনেছিল একটা বর্মী শেল ডাইভার। মোটর বোট ভরসা করে লোকটা বিপুল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আন্দামানে আসত। আন্দামানের দরিয়া থেকে নানা ধরনের শঙ্খ কড়ি-শামুক–যাদের নাম টার্বো-ট্রোকাসনটিলাস, তুলে নিয়ে রেঙ্গুনে বিক্রি করত। এটাই ছিল তার জীবিকা।

শেল ডাইভারটাই খবর দিয়েছিল, আজাদীর জন্য রাজা থিবো ইংরেজদের সঙ্গে লড়াই করেছেন। লড়াইতে থিবো হেরে গিয়েছেন। থিবোর যুদ্ধের আসামীদের নাকি আন্দামানে চালান দেওয়া হবে। সত্যিসত্যিই একদিন আন্দামানে খবর এল, থিবোর যুদ্ধের বন্দিরা আসছে।

সেই দিনগুলো অদ্ভুত এক উত্তেজনায় কাটছিল। নওয়াজ খান ভেবেছিলেন, বর্মা থেকে যুদ্ধ বন্দিরা এলেই কাজে নেমে পড়বেন। আঠার শ’ সাতান্নর যে-আগুন নিয়ে তিনি আন্দামান এসেছিলেন, সেই আগুন আত্মপ্রকাশের একটা পথ চায়। সেই পথই বুঝি এবার পাওয়া যাবে। ভেবেছিলেন, সিপাহী বিদ্রোহের মতোই একটা বিদ্রোহ করবেন এই দ্বীপে। তার বিশ্বাস ছিল, থিবোর যুদ্ধের বন্দিরা তার পাশে এসে দাঁড়াবে। যারা ভারতবর্ষকে স্বাধীন করতে চায়, আর যারা বর্মা মুলুককে মুক্ত করতে চায়, তাদের উদ্দেশ্য এক, তাদের শত্রুও এক, সে-শত্রু ইংরেজ। নওয়াজ খানের মনে হয়েছিল, (এখনো মনে হয়) দেশের আজাদীর জন্য বর্মা এবং ভারতবর্ষকে এক হতে হবে। বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে সেই একতার ছোটখাট একটা ভূমিকা তৈরি করে দিয়ে যাবেন তিনি।

রোজই আশায় উদ্বগে সিসোস্ট্রেস উপসাগরের পাড়ে আসতেন নওয়াজ খান। রোজই ভাবতেন, থিবোর যুদ্ধের বন্দি নিয়ে আজই জাহাজ আসবে। কিন্তু জাহাজ আর আসে না। শেষ পর্যন্ত যেদিন জাহাজ এল, সেই দিনই দুজন জমাদার আর দুজন পুলিশ তাকে ভাইপার দ্বীপের কয়েদখানায় নিয়ে গেল।

ভাইপারের কয়েদখানায় পুরো দশটা বছর কাটিয়েছেন নওয়াজ খান। তার ইচ্ছা ছিল, সিপাহী বিদ্রোহের আগুনের সঙ্গে থিবোর যুদ্ধের আগুন তিনি মেলাবেন। কিন্তু ইচ্ছাটা ইচ্ছাই রয়ে গেল। কোনোদিন পূরণ আর করতে পারলেন না।

দশ বছর পর ভাইপারে কাটিয়ে পোর্ট ব্লেয়ার এসে শুনলেন, থিবোর যুদ্ধের আসামীদের কেউ কেউ দরিয়ায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বন্দিত্বের জ্বালা জুড়িয়েছে। কেউ কেউ ফরেস্টের কাজে গিয়ে জারোয়াদের তীরে প্রাণ দিয়েছে। কেউ কেউ বুকের আগুন নিবিয়ে চাউঙে গিয়ে ফুঙ্গি হওয়ার তোড়জোড় করছে। (নওয়াজ খান দেখেছেন, এর কয়েক বছর পর পুরাদস্তুর এক ফুঙ্গি হয়ে বসেছে লা ডিন।)

অবুঝ এক কষ্টে বোবা হয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

ভাবতে ভাবতে এগুচ্ছিলেন নওয়াজ খান। একসময় উপসাগরের পাড় থেকে বাঁ দিকে একটা টিলার ওপর উঠতে লাগলেন। হঠাৎ একজনের কথা মনে পড়ল তাঁর। সে সুন্দর খান। যে-আগুন তাঁর বুকে সেই আঠার শ’ সাতান্ন থেকে জ্বলছে, সেই আগুনেরই একটা ঝলক তিনি সুন্দর খানের মধ্যে দেখেছিলেন।

একটু চমকে উঠলেন নওয়াজ খান। এই মুহূর্তে তিনি সুন্দর খানের কথা ভাবতে চান না। আস্তে আস্তে মন থেকে তার ভাবনাটাকে সরিয়ে দিলেন নওয়াজ খান।

টিলার মাথায় উঠে পড়েছেন নওয়াজ খান। এর পরেই উতরাই বেয়ে তাঁকে নিচে নামতে হবে। এখান থেকে তার ডিলানিপুরের কুঠিটা দেখা যাচ্ছে। একবার পেছন দিকে মুখটা ঘোরালেন নওয়াজ। উপসাগরটা জ্বলছে। বেশিক্ষণ উপসাগরের দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না। চোখ দুটো ঝলসে যেতে থাকে।

শিরায় শিরায় রক্ত ফুটছে। মাথার মধ্যে আন্দামানের পেনাল কলোনির জন্মকাল থেকে আজ পর্যন্ত অসংখ্য ঘটনা ভিড় জমাচ্ছে। চারপাশে আঁ আঁ করছে রোদ। নিজেকে আর খাড়া রাখতে পারছেন না নওয়াজ খান। মাথাটা ঘুরছে। সত্তর পচাত্তর বছরের এই দুর্বল, অশক্ত দেহ এতখানি উত্তেজনা, এতখানি ধকল সহ্য করতে পারছে না।

টলতে টলতে নিচের দিকে নামতে লাগলেন নওয়াজ খান। নামতে নামতে তার মনে হল, অনেক বয়স হয়েছে। সামান্য উত্তেজনাতেই আজকাল বড় কাবু হয়ে পড়েন। মনে হল, বেশি দিন তিনি আর বাঁচবেন না। কিন্তু যে কটা দিন এই দুনিয়ায় আছেন, তার মধ্যে জীবনের শেষ কাজটা যেমন করে হোক, করে যাবেন। আঠার শ’ সাতান্নর যে-আগুন নিয়ে তিনি আন্দামান এসেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই কি তা নিবে যাবে? অনেক, অনেক দিন পর আবার একটা সুযোগ এসেছে। তার জীবনে এটাই সম্ভবত শেষ সুযোগ। থিবোর যুদ্ধের বন্দিদের নিয়ে তিনি যা পারেন নি, এবার তা পারবেন। তাকে পারতেই হবে।

এইমাত্র মুন্সিজির কাছ থেকে খবর নিয়ে এসেছেন, বাংলা মুলুকে ইংরাজদের সঙ্গে আজাদীর জন্য তুমুল লড়াই হয়েছে। সেই লড়াইতে বন্দি হয়ে একদল কয়েদি আন্দামানে আসছে। বিশ পঁচিশ দিনের মধ্যেই তারা এসে পড়বে।

এই কদিনের মধ্যেই নওয়াজ খান তাঁর কাজ শেষ করে ফেলবেন। এই বয়সে, এই দুর্বল অশক্ত দেহে কতখানি কাজ করাই বা সম্ভব? তিনি শুধু ভূমিকা করে দিয়ে যাবেন। তার ওপর দাঁড়িয়ে নতুন কালের বন্দিরা যাতে প্রেরণা পায় তার ব্যবস্থা করে দেবেন। ভারতের প্রথম স্বাধীনতা-সংগ্রামের সৈনিক হিসাবে নওয়াজ খানের অনেক দায়িত্ব। সে-দায়িত্ব তাঁকে পালন করতেই হবে।

তিপ্পান্ন বছর বুকের ভেতর যে আগুন বয়ে বেড়াচ্ছেন, বার বার তা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন নওয়াজ খান। কিন্তু প্রতিবার ব্যর্থ হয়েছেন।

এবার তাকে সফল হতেই হবে।

এই পৃথিবীতে কিছু মানুষ শুধু তোষামোদ করতেই জন্মায়। মাউ খে হচ্ছে সেই জাতের মানুষ। চাটুকারিতার মাহাত্ম্য সে পুরোপুরি বোঝে। তার মতে এই দুনিয়ায় এমন কেউ নেই, কৈতববাদে যে কাবু হয় না।

দুনিয়ায় এসে এই শিক্ষাটাই সবচেয়ে বেশি করে পেয়েছে মাউ খে। কারোর কাছ থেকে কিছু বাগাতে চাও? কোনো মতলব হাসিল করতে চাও? তবে স্রেফ তোষামোদ করে যাও। একদিন না এক দিন বাজি মাত করতে পারবেই।

তোষামুদির যে কী মহিমা, সাত দিনের মধ্যেই চান্নু সিংকে বুঝিয়ে দিল মাউ খে।

চাটুকারিতার সবরকম কলাকৌশল মাউ খের আয়ত্তে। এমন জবরদস্ত যে পিয়ারীলাল, নিয়ম কানুনের বাইরে যে এক কদমও হাঁটে না, তাকে পর্যন্ত টলিয়ে ফেলেছে মাউ খে।

তিন দিন ধরে ঠিক এই সময়টায় চান্নু সিং আর মাউ খে সাউথ পয়েন্ট কয়েদখানার পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে।

এখন দুপুর। সূর্যটা সোজা মাথার ওপর পৌঁছে গিয়েছে।

কয়েদখানার গা ঘেঁষে একটা নারকেল বাগিচা। সারাদিনের মধ্যে নারকেল গাছের ছায়াগুলো ঠিক এই সময়ে সব চেয়ে ছোট হয়ে যায়। সামনে সিসোস্ট্রেস উপসাগর। বিরাট বিরাট ঢেউগুলো খাড়া হয়ে দুর্জয় বেগে দ্বীপের দিকে ধাওয়া করে আসে। নারকেলের পাতায় পাতায় ঝড়ো বাতাস সাঁই সাঁই করে বেজে যায়।

বাঁ হাতের কনুই দিয়ে চান্নু সিংয়ের পাঁজরে বেশ জোরেই একটা ঠেলা মারল মাউ খে। ডাকল, এ চান্নু–

হাঁ।

তোকে আগেই বলেছিলাম–

হাঁ। কোনো দিকে হুঁশ নেই চান্নু সিংয়ের। একদৃষ্টে সাউথ পয়েন্ট কয়েদখানার ফটকটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে। মাউ খের কথার জবাবে মাঝে মাঝে হুঁ হাঁ করে যাচ্ছে।

মাউ খে সমানে বকর বকর করছে, তোকে আগেই বলেছিলাম, তোষামুদিতে আসমান দুনিয়া টলে যায়।

হাঁ। অন্যমনস্কভাবে চান্নু সিং সায় দিল।

চান্নু সিংয়ের জবাবের জন্য বিশেষ মাথাব্যথা নেই মাউ খের। নিজের মনেই সে বকে যায়, আর এ তো পিয়ারীলাল। শালে বড় কানুনের বন্দা এসেছে! সাত রোজ তোষামুদি করে কুত্তাটাকে কবজা করেছি।

হাঁ।

আরে ছোঃ, এমন কানুনের বন্দা আমি বহুত দেখেছি। বুঝলি চান্নু, কাম হাসিলের জন্যে লোকের পায়ে ধরবি, ভাই বলবি, বাপ বলবি। তাতেও যদি না হয়, স্রেফ জিজাজি বলবি। হ্বিক–হ্বি–হ্বিক–হিক্কার মতো অদ্ভুত শব্দ করে খুব এক চোট হাসে মাউ খে। হাসির দাপটে তার কুতকুতে চোখ দুটো বুজে যায়।

হাসির তোড় কিছুটা কমলে চান্নু সিংয়ের দিকে তাকাল মাউ খে। সে যে এত হাসল, তবু খেয়াল নেই চান্নুর। একদৃষ্টে কয়েদখানার দিকে তাকিয়েই রয়েছে সে।

মাউ খে ডাকল, চান্নু–

হাঁ–হাঁ–চান্দু ধড়মড় করে উঠল, কী বলছিস শালে?

কী ভাবছিস?

ভাবছি পিয়ারীলাল তো এখনো বেরুচ্ছে না।

পিয়ারীলাল সাউথ পয়েন্ট কয়েদখানার কয়েদিনীদের তাঁত বুনতে শেখায়। সকালে কয়েদখানায় ঢোকে, দুপুরে সূর্যটা যখন মাথার ওপর উঠে আসে, ঠিক তখন খানাপিনার

জন্য বেরিয়ে পড়ে। তিন দিন ধরে ঠিক এই সময়টায় পিয়ারীলালকে ধরছে চান্নু সিং।

সমানে তোয়াজ করে, তোষামোদ করে, বাপ-ভাই-জিজাজি–যখন যা মুখে এসেছে, তা-ই ডেকে পিয়ারীলালকে কাবু করে ফেলেছে মাউ খে। ব্যবস্থা হয়েছে, রোজ দুপুরে কয়েদখানা থেকে বেরিয়ে সোনিয়ার খবর দেবে পিয়ারীলাল। ব্যবস্থা অনুযায়ী চান্নু সিংরা আজ তিন দিন ধরে কয়েদখানার পাশের নারকেল বাগিচাটায় এসে দাঁড়াচ্ছে।

চান্নু সিং উত্তেজিত হয়ে উঠল, নাঃ, পিয়ারী শালে একটা কুত্তা। হারামীটা এখনো তো বেরুচ্ছে না! কী হল, বল দিকি?

ফায়া (বুদ্ধ) মালুম। বড় নির্বিকার দেখায় মাউ খে’কে।

শালের জান তুড়ব। চান্নু সিং দাঁতে দাঁত ঘষে আর মাটিতে পা ঠোকে।

চান্নু সিংয়ের উত্তেজনার কারণ আছে।

কাল এবং পরশু মাউ খে’কে সঙ্গে নিয়ে এখানে এসেছিল চান্নু সিং। পিয়ারীলাল সোনিয়ার যে–খবর এনেছিল, তাতে আদৌ খুশি হয় নি সে। সোনিয়া সেই যে রামপিয়ারীর হাতে জখম হয়েছিল, তারপর থেকে মাথাটা না কি বিগড়ে যাচ্ছে। তার মতিগতি বুঝবার উপায় নেই। কখনো বলছে শাদি করবে, কখনো বলছে কয়েদখানা ছেড়ে কোথাও যাবে না। সোনিয়া যে ঠিক কী চায়, হাজার চেষ্টা করেও বুঝে উঠতে পারে নি পিয়ারীলাল। চান্নু সিংকে সে বলেছে, জোয়ানী ছোঁকরির দিল বড়ে ঝামেলার ব্যাপার। এই বলে শাদি করব, এই বলে করব না। মালুম হচ্ছে, সোনিয়ার শির বিলকুল খারাপ হয়ে গিয়েছে।

কোথাও যাবার উপায় নেহয়েছিল, তারপদী খুশি হয় না

এই খবরটা পাওয়ার পর থেকেই চান্নু সিংয়েরই শির খারাপ হতে বসেছে। উত্তেজনা এবং অস্থিরতা একটু একটু করে বেড়েই চলেছে।

সূর্যটা এখন পশ্চিম দিকে হেলতে শুরু করেছে। নারকেল গাছের ছায়াগুলো আবার একটু একটু করে বড় হচ্ছে।

শেষ পর্যন্ত দেখা মিলল। কয়েদখানার ফটক পেরিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে এদিকেই এগিয়ে আসছে পিয়ারীলাল।

একরকম দৌড়েই পিয়ারীলালের সামনে এসে পড়ল চান্নু সিং। তার পিছু পিছু এল মাউ খে।

পিয়ারীলাল দাঁত বার করে হাসল। বলল, কি রে শালেরা, আজও এসেছিস?

মাউ খে বলল, হাঁ, বড়ে ভাই।

হঠাৎ মুখটাকে কাঁচুমাচু করে ফেলল মাউ খে। তারপর বলল, আপনি তো সবই বোঝেন বড়ে ভাই। সোনিয়ার জন্যে চান্নুর দিলটা–

কথাটা আর শেষ করে না মাউ খে। না করলেও, সে যা বলতে চায়, সেটা বুঝে ফেলে পিয়ারীলাল।

বিরাট চেহারার চান্নু সিং এক পাশে দাঁড়িয়ে সমানে দু’হাত কচলাচ্ছে। এবার সে বলল, আপনাকে তো সবই বলেছি পিয়ারীলালজি। অ্যাদ্দিনে সোনিয়ার সাথ আমার শাদিটা হয়ে যেত। লেকিন রামপিয়ারী কুত্তীটার জন্যে হল না।

এক পাশে চান্নু সিং, আর এক পাশে মাউ খে, মাঝখানে পিয়ারীলাল। একসময় তিনজনে সিসোস্ট্রেস উপসাগরের পাড় ধরে এবারডিন বাজারের দিকে চলতে শুরু করল।

পিয়ারীলাল ডাকল, এ চান্নু—

হাঁ, জি–

দুকদম পিছিয়ে পড়েছিল চান্নু সিং। দৌড়ে পিয়ারীলালের পাশে এসে পড়ল। বলল, কী বলছেন জি?

তোর নসিবটা বড় ভাল।

কেমন, কেমন? চান্নু সিং পিয়ারীলালের দিকে ঝুঁকে পড়ল।

আরে মুরুখ, সোনিয়া আজ আপনা থেকেই শাদির কথা বলল।

সচ?

সচ। পিয়ারীলাল বলতে লাগল, সোনিয়া তোকে একটা কাম করতে বলেছে। কামটা জলদি জলদি করতে হবে।

কী কাম জি?

আজই ডিপটি (ডেপুটি কমিশনারের অফিসে গিয়ে শাদির ব্যবস্থা করে ফেলবি। যত তাড়াতাড়ি পারিস সোনিয়াকে কয়েদখানা থেকে নিয়ে আসবি। বুঝেছিস?

হাঁ, জি—

একটা আচ্ছা খবর দিলাম। দিলমর্জি খুশ হল তো?

হাঁ, জি–

পাশ থেকে মাউ খে হল্লা করে উঠল, পিয়ারীলালজি, আপনি আমাদের সাচ্চা দোস্ত। আপনার মাফিক দিলবালা বড়ে ভাই তামাম জিন্দেগীতে আর দেখি নি। বলেই পিয়ারীলালের পেছন দিয়ে ঘুরে চান্নু সিংয়ের কাছে এল মাউ খে। তার একটা হাত ধরে টান মারল। বলল, আমার সাথ চল চান্নু–

তাজ্জব হয়ে চান্নু, কোথায় যাব?

মাউ খে খেঁকিয়ে উঠল, নালায়েক, বুদ্ধু কাঁহাকা! যাবি ডিপটি কমিশার সাহিবের অফিসে। শাদির ব্যবস্থা করতে হবে না?

চান্নু সিং আর কিছু বলল না। বরাবর যা করে আসছে, তার ব্যতিক্রম ঘটল না। মনে মনে মাউ খের খাসা বুদ্ধিটার তারিফ করতে লাগল।

বেশ কিছুদিন হল তুষণাবাদের এই ‘বীটে’ এসেছে লখাই। ফরেস্ট গার্ড আবর খানের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে জঙ্গলের চেহারা অনেকখানি দেখে ফেলেছে। প্যাডক, ধূপ, মার্বেল উড, টমপিঙ, পেমা, দিদু, জারুল–নানা জাতের গাছ আর লতাও চিনেছে। কিন্তু জঙ্গলের চেহারা দেখা আর তার স্বরূপ বোঝা এক নয়। আন্দামানের জঙ্গলের যে কী মহিমা, আজ খানিকটা টের পেল লখাই।

গত দুটো দিন অঝোরে বৃষ্টি ঝরেছে। মুহূর্তের জন্য সে বৃষ্টি থামে নি।

দক্ষিণ পশ্চিম কোণ থেকে টুকরো টুকরো মৌসুমি মেঘ এইদ্বীপের ওপর দিয়ে ভাসতে ভাসতে ভারতবর্ষের মেইনল্যাণ্ডের দিকে চলে যায়। হঠাৎ কী খেয়াল হল, আন্দামানের আকাশে মেঘগুলো জমাট বাঁধতে লাগল। বঙ্গোপসাগর থেকে সূর্যের তাপে যে জলকণাগুলি মেঘ হয়ে ভারতবর্ষের দিকে রওনা হয়েছিল, প্রকৃতির কোনো এক গুঢ় কারসাজিতে শেষ পর্যন্ত তারা গন্তব্যে পৌঁছাত পারল না। আন্দামানের আকাশে দু’দিন আটকে থেকে অবিশ্রাম বৃষ্টি ঝরাল।

বৃষ্টির জন্য দু’দিন কেউ ঝুপড়ি থেকে বেরুতে পারে নি। কাজকর্ম সব বন্ধ ছিল। এই দু’দিন ‘ফেলিং’ হয় নি।

একটানা বৃষ্টির পর প্রকৃতির হঠকারিতা অনেকটা কমে এসেছে। মেঘ কেটে যেতে শুরু করেছে। আজ সকাল থেকেই বৃষ্টিটা ধরেছে। মেঘভাঙা খানিকটা ঘোলাটে রোদও দেখা দিয়েছে।

কুলি-জবাবদার-ফরেস্ট গার্ড-পুলিশ জমাদার–যে যার ঝুপড়িতে দু’দিন আটকে ছিল। দুর্ভোগ থেকে রেহাই পেয়ে হল্লা করতে করতে তারা বেরিয়ে পড়ল।

খানিকটা পরেই ‘ফেলিং’-এর জন্য তৈরি হয়ে নিল সকলে।

কুড়াল করাত-গাঁইতি সমেত একদল কুলি নিয়ে লখাই ছুটল।

প্রায় মাসখানেক কাবার হতে চলল, তুষণাবাদের এই ‘বীটে’ এসেছে লখাই। এর মধ্যে বিরাট একটা পেমা গাছ কাটা আর দুটো হাওয়াই বুটির জঙ্গল সাফ করা ছাড়া ‘ফেলিং’ এর কাজ বিশেষ এগোয় নি।

আজকের কাজ হল ছোট ছোট জারুল গাছের একটা ঝোঁপ সাফ করা। এই ঝোঁপটার পরেই বিরাট বিরাট কটা গর্জন গাছ আকাশের দিকে খাড়া মাথা তুলে রয়েছে।

দু’দিন বৃষ্টির জলে ধুয়ে ধুয়ে গাছের পাতাগুলির মসৃণতা বেড়েছে। মেঘভাঙা ঘোলাটে রোদে জঙ্গলের মাথাটা চক চক করছে।

লেখাইরা জারুল গাছের ঝোঁপটার কাছে এসে পড়ল।

এমনিতেই জঙ্গলের মাটি স্যাঁতসেঁতে, পিছল। নীলাভ শ্যাওলার পুরু একটি স্তর তার ওপর আটকে আছে। দু’দিনের অবিরাম বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে সেই মাটি থক থক করছে। পা ফেললেই হাঁটু পর্যন্ত ঢুকে যায়।

এক পাশে দাঁড়িয়ে জবাবদারি করতে লাগল লখাই, মারো জোয়ান, মারো কোপ–জোরসে মরদ মারো কোপ।

হেঁই–হেঁই—হেঁইও–

বেঁটে জারুল গাছগুলির গায়ে কুড়ালের কোপ পড়তে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে গাছের মাথা থেকে থোকায় থোকায় জোঁক ঝরতে শুরু করে। কুলিদের গায়ের ওপর পড়ে চামড়া ফুটো করে তারা রক্ত চুষতে থাকে। এক একবার টেনে টেনে জোঁক ছাড়ার কুলিরা। আবার গাছে কোপ মারে।

লখাইর হাতে একটা বর্মী দা বাগিয়ে ধরা। দাটা দিয়ে গা থেকে জোঁক চেঁছে ফেলছে। আর মাঝে মাঝে চিৎকার করে উঠছে, মারো জোয়ান–

কত জোঁক আর চেঁছে ফেলবে লখাই? যেগুলি অলক্ষ্যে থেকে যাচ্ছে, রক্ত চুষে চুষে কচি তেলাকুচের মতো ফুলে আপনা থেকেই খসে পড়ছে।

শুধু কি জোঁক, দু’দিনের বৃষ্টিতে এই জঙ্গলের সমস্ত গর্ত বুজে গিয়েছে। গর্তই যাদের আশ্রয়, সেই লক্ষ লক্ষ পোকা-মাকড়সরীসৃপ বৃষ্টির দাপটে বেরিয়ে পড়েছে। বৃষ্টির ওপর যে-আক্রোশ তারা মেটাতে পারে নি, প্রাণভরে মানুষের ওপর মিটিয়ে নিচ্ছে।

বাড়িয়া পোকা, গাঁধী পোকা সমানে কামড়াচ্ছে। মাকড়সরীসৃপ বেয়ে বেয়ে গায়ে উঠছে। এদের উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে লখাই।

থকথকে কাদার ভেতর হাঁটু পর্যন্ত গাড়া। এই অবস্থায় জোঁক আর পোকা মাকড়ের অসহ্য কামড় সয়ে সয়ে জবাবদারি করছে লখাই, মারো কোপ–

হঠাৎ জঙ্গলের মাথা থেকে কুচকুচে কালো রঙের একটা কিং কোব্রা লাফিয়ে পড়ল লখাইর সামনে। সম্ভবত বৃষ্টির সময় গাছের মাথায় উঠেছিল সাপটা। মাটিতে পড়েই লেজের ওপর ভর দিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে ওঠে। চওড়া ফণাটা দুলতে থাকে। পাতাহীন ক্রুর চোখ দুটো ঝিক ঝিক করছে। সাপটা হিস হিস করে গর্জাচ্ছে।

মুহূর্তের জন্য বুকের রক্ত হিম হয়ে গিয়েছিল। তারপরেই নিজেকে সামলে নিল লখাই। এক পা পিছু হটে বর্মী দাটা দিয়ে একটা কোপ বসিয়ে দিল। কিং কোব্রার ধড় থেকে ফণাটা ছিটকে গিয়ে পড়ল দশ-পনেরো হাত দূরে।

সাপ দেখে কুলিরা ‘বীটে’র দিকে দৌড়তে শুরু করেছিল। তাদের ফিরিয়ে আনল লখাই। আবার জবাবদারি শুরু করল, মারো জোয়ান–

ধীরে ধীরে মেঘ পুরোটাই কেটে গেল আকাশ থেকে। দু’দিন পর ঝকঝকে, ধারাল রোদ দেখা দিয়েছে। মেঘভাঙা রোদের তেজ বড় সাঙ্ঘাতিক।

এর মধ্যেই কুলিরা কয়েকটা জারুল গাছ কেটে ফেলেছে।

লখাইর কোনো দিকে খেয়াল ছিল না। কুলিদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সে জবাবদারি করে যাচ্ছিল। হঠাৎ হাঁটুর ঠিক ওপরে ঊরুর ঝাছটায় কেমন যেন জ্বালা জ্বালা করে উঠল। চমকে নিচের দিকে তাকিয়ে লখাই দেখতে পেল, হাতখানেক লম্বা একটা কানখাজুরা (চেলা জাতীয় সরীসৃপ) সামনের ঝোঁপটার দিকে পালিয়ে যাচ্ছে।

মুহূর্তের মধ্যে সেই জ্বালাটা সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। তীব্র যন্ত্রণায় মনে হল, দম বন্ধ হয়ে যাবে।

চিৎকার করে উঠল লখাই, মরে গেলাম, মরে গেলাম–থকথকে কাদার ওপর টলে পড়ল সে।

কুলিরা ধরাধরি করে ঝুপড়িতে নিয়ে এল লখাইকে। কানখাজুরার বিষ শরীরের সমস্ত শিরায় শিরায় ছুটে বেড়াচ্ছে। আচ্ছন্নের মতো বিকেল পর্যন্ত পড়ে রইল সে।

জোঁক-পোকা-মাকড় উৎখাত করে, কানখাজুরা আর কিং কোব্রার মুখ থেকে মাটি ছিনিয়ে নিতে হচ্ছে। অরণ্য কি সহজে মাটির দখল ছাড়তে চায়? কিন্তু মানুষের প্রয়োজনের সময়ে তাকে মাথা নোয়াতেই হয়। এমন করেই আন্দমানের বসতি বাড়ে। বুঝিবা মানুষের পৃথিবীর পেছনে এই একই ইতিহাস।

বিকেলের দিকে আন্দামান জঙ্গলের আর একটা স্বরূপ দেখল লখাই।

এখন এই ঝুপড়িতে কেউ নেই। কুলি-জবাবদাররা ‘ফেলিং’-এর কাজে বেরিয়ে গিয়েছে।

মাচানের ওপর বেহুঁশের মতো পড়ে রয়েছে লখাই। কানখাজুরার বিষের তীব্রতা অনেকটা কমে এসেছে।

ঘোর ঘোর চোখ মেলে একবার তাকাবার চেষ্টা করল লখাই। কিন্তু কিছুই পরিষ্কার দেখতে পেল না। সব কিছুই কেমন যেন আবছা, ঘোলাটে। এই ঝুপড়ি, ঝুপড়ির ভেতরের মাচান, বেড়ায় গোঁজা একটা বর্মী দা, বোঁচকা কুঁচকি–কোনো কিছুই সঠিক আকার নিয়ে তার চোখের সামনে ফুটে উঠছে না।

কিছুক্ষণ আগেই প্রচণ্ড যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে ছিল লখাই। মাচানের ওপর ছটফট করছিল, গোঙাচ্ছিল, কাতরাচ্ছিল। থেকে থেকে শরীরটা বেঁকে দুমড়ে যাচ্ছিল। হাতে-পায়ে খিচ ধরছিল। চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে পড়ছিল। আগের সেই তীব্রতা না থাকলেও অন্য একটা উপসর্গ দেখা দিয়েছে।

শরীরটা যেন বিশ মণ ভারী হয়ে গিয়েছে। সেখানে কোনো বোধ নেই, সাড় নেই, কোনো অনুভূতিই কাজ করছে না। যদি একটা কোপও বসিয়ে দেওয়া যায়, তা হলেও হয়তো লখাই টের পাবে না।

মাথায় ভেতরটা ফাঁপা, শূন্য। ভয়ানক কাহিল লাগছে। তবু লখাই ভাবতে চেষ্টা করল, অনেক দিন আগে আরো একবার কবে যেন ঠিক এইরকম একটা অবস্থা হয়েছিল তার। কোথায়? কতদিন আগে? এই মুহূর্তে দুর্বল, অনুভূতিহীন দেহে ভেবে উঠতে পারল না লখাই।

এখন একটা কথাই ভাবতে পারছে সে, ভাবতে অবশ্য ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে। এই ঝুপড়িতে তাকে একা ফেলে রেখে কুলি-জবাবদাররা ‘ফেলিং’-এর কাজে চলে গিয়েছে। এই নিদারুণ জঙ্গলে এমন একটা মানুষ নেই, ‘ফেলিং’-এর কাজ স্থগিত রেখে যে তার পাশে অন্তত কিছুক্ষণের জন্যও এসে বসবে। তার মনে হল, এই সৃষ্টিছাড়া জঙ্গলে সে বড় একা। তার কেউ নেই।

হয়তো সে মরে যাবে। সেজন্য কারোর এতটুকু মাথাব্যথা নেই। যদি তার মৃত্যু হয় বড় জোর দুই ঠ্যাং ধরে তাকে কোনো একটা খাদে ফেলে দেবে কুলিরা।

হৃদয়হীন এই বর্বর জঙ্গলের আসল চেহারাটা যেন লখাইর চোখের সামনে ভেসে উঠল।

যতই ভাবছিল ততই আক্রোশ বাড়ছিল। আক্রোশটা একসময় অহেতুক একটা অভিমানের রূপ নিল। কিন্তু আন্দামানের এই জঙ্গলে কার ওপর অভিমান করবে লখাই? তার গলার কাছে অদ্ভুত এক কান্না পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে। একবার মনে হল, চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। কিন্তু এই দুর্বল শরীরে কাঁদবার শক্তিটুকু পর্যন্ত নেই।

তখনও দক্ষিণ আন্দামানের জঙ্গলে স্নান, বিষণ্ণ একটু রোদ আটকে ছিল। সে রোদের তাপ নেই, তেজ নেই।

হঠাৎ বুশ পুলিস ক্যাম্পে বিশ টিকারায় ঘা পড়ল। ডিম-ডিম-ডিম—

কুলি জবাবদাররা জঙ্গলের দিক থেকে চিৎকার করে উঠল, জারোয়া–জারোয়া–

লখাই যেদিন তুষণাবাদের এই ‘বীটে’ আসে, তার পরদিন রাত্রে জারোয়ারা হানা দিয়েছিল। বুশ পুলিশরা একটা জারোয়াকে ধরেও ফেলেছিল। আবর খানের সঙ্গে বুশ পুলিশ ক্যাম্পে গিয়ে জারোয়াটাকে দেখে এসেছিল লখাই।

আন্দামানের জঙ্গলে জারোয়া ধরা একটা বিরাট ঘটনা। এমনিতে জারোয়াদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা যায় না। তাদের কাছে ঘেঁষার উপায়ও নেই। এই আদিম মানুষগুলো কোনোক্রমেই সভ্য মানুষের সংস্পর্শে আসতে রাজি নয়। সভ্যতার আলো যেখানে পৌঁছায় না, সেই গভীর জঙ্গলের মধ্যে তারা নিজেদের লুকিয়ে রাখে।

আদিম মানুষগুলির একজন ধরা পড়েছে। কোনোরকমে জারোয়াটাকে একবার পোর্ট ব্লেয়ার পাঠাতে পারলে মোটা বকশিশ মিলবে। কিন্তু পোর্ট ব্লেয়ার পাঠাবার আগেই জারোয়াটা পালিয়ে গিয়েছিল।

বুশ পুলিশরা দু’দিন জারোয়াটাকে বেঁধেছেদে পাহারা দিয়ে রাখতে পেরেছিল। তিন দিনের মাথায় কোন ফাঁকে যে সেটা জঙ্গলে উধাও হয়েছে, কেউ টের পায় নি।

তারপর থেকে বেশ কিছুদিন জারোয়াদের উৎপাত বন্ধ ছিল। আজ তারা আবার হানা দিল।

বুশ পুলিশ ক্যাম্পে টিকারার শব্দটা জোরালো হয়ে উঠেছে। ডিম-ডিম-ডিম—

টিকারার এই আওয়াজে চারপাশ থেকে অদ্ভুত এক ভয় ঘনিয়ে আসে। জঙ্গলের অন্তরাত্মা ছম ছম করতে থাকে। মনে হয়, এই জঙ্গল বর্তমান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কয়েক হাজার বছর পেছনে ফিরে গিয়েছে। যেখানে হয়তো দিবারাত্রি বিরাট বিরাট নাকারা পিটিয়ে দুই দল উলঙ্গ যূথমানব পরস্পরের সঙ্গে তুমুল লড়াইতে মেতে থাকত। টিকারার শব্দের সঙ্গে যুথমানবদের সেই কল্পিত নাকারার আওয়াজের যেন অদ্ভুত মিল আছে।

টিকারার শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কুলি-জবাবদাররা চিল্লাচ্ছে, জারোয়াজারোয়া

কাল কানখাজুরায় কেটেছিল লখাইকে। এখনও বিষটা পুরোপুরি নামে নি। রক্তের মধ্যে তার ক্রিয়া চলছে। ঊরুটা অস্বাভাবিক ফুলে রয়েছে। মাথা ঝিম ঝিম করছে।

ধরাধরি করে কুলিরা কাল মাচানের ওপর রেখে গিয়েছিল। সেই থেকে আর নামে নি লখাই, কিছুই খায় নি। কানখাজুরার বিষে কাল দুপুর থেকে এখন পর্যন্ত আচ্ছন্নের মতো পড়ে রয়েছে।

কুলিরা ভয়ার্ত গলায় চেঁচাচ্ছে, জাবোয়া–জারোয়া—

ঝুপড়ির ঝাঁপটা খোলা পড়ে আছে। সেই ফাঁক দিয়ে লখাই দেখতে পেল, অনেকগুলো বেঁটে বেঁটে উলঙ্গ মানুষ তীরধনুক হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

বুকের ভেতরটা শিউরে উঠল। মেরুদণ্ড বেয়ে খাড়া ঝিলিক ছুটে গেল। এই মুহূর্তে কী করবে, ঠিক বুঝে উঠতে পারল না লখাই।

লখাই শুনেছে, জারোয়াদের নজরে পড়লে বাঁচার কোনো উপায়ই থাকে না। বিষমাখা তীর দিয়ে তারা গেঁথে রেখে যায়। এই মুহূর্তে মুখোমুখি মৃত্যুকে দেখে সে বুঝতে পারল, বাঁচবার ইচ্ছাটা তার কত প্রবল।

কালো কালো আদিম মানুষগুলোর যত আক্রোশ এই বীটটার ওপর।

বেতপাতার চাল, বাঁশের বেড়া, মাচান, পাটাতন–ঝুপড়িগুলোর ভেতর ঢুকে যা দেখছে, সবই ভেঙেচুরে তছনছ করে ফেলছে তারা।

এই ‘বীটে’র মানুষগুলো জঙ্গল সাফ করে তাদের পৃথিবীকে সঙ্কীর্ণ করে ফেলছে। খুব সম্ভব এই কারণেই ফরেস্টের এই বীটটার ওপর খেপে উঠেছে জারোয়ারা।

এই বীটটার ওপর কেন যে জারোয়াদের এত আক্রোশ, এখন সে-কথা একেবারেই ভাবছে না লখাই। তার বুকের মধ্যে হৎপিণ্ডটা হাজার গুণ জোরে লাফাচ্ছে। কানখাজুরার বিষে শরীরটা এমনিতেই কাহিল হয়ে রয়েছে। নড়াচড়ার শক্তিটুকু সেভাবে ফিরে পায় নি। মাচান থেকে সে একবার উঠবার চেষ্টা করল, খানিকটা উঠলও। কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার টলে পড়ল।

আচমকা ঝাপের ফাঁকে দুটো কালো মুখ দেখা দিয়েই পরক্ষণে অদৃশ্য হল। হঠাৎই কেন জানি লখাইর মনে হল, তাকে বাঁচতে হবে। বাঁচবার এই অদম্য ইচ্ছা তার মধ্যে খানিকটা অস্বাভাবিক শক্তি ফিরিয়ে আনল।

মাচান থেকে টলতে টলতে কত কষ্টে লখাই যে নিচে নামল, একমাত্র সে-ই জানে। নেমেই গুঁড়ি মেরে মাচানটার তলায় ঢুকল। এটুকু ধকলেই জিভ বেরিয়ে পড়েছে। টেনে টেনে প্রাণপণে হাঁপাতে লাগল সে। কিছুক্ষণ হাঁপাবার পর চোখ বুজে মড়ার মতো পড়ে রইল।

জঙ্গলের দিকে থেকে কুলিদের হইচই ভেসে আসছে, জারোয়া-জারোয়া—

টিকারাগুলো এখন বিশগুণ জোরে বাজছে। ডিম-ডিম-ডিম–

একবারই মাত্র ঝাপের ফাঁকে দুটো কালো মুখ দেখা দিয়েছিল। তারপর আর তাদের দেখা যায় নি। লখাইর ঝুপড়ির দিকে দ্বিতীয় বার ওরা উঁকি দেয় নি।

আচমকা কোনো একটা ঝুপড়ি থেকে প্রাণফাটা চিৎকার উঠল, আ-আ-আ-মরে গেলাম–মরে গেলাম–

দক্ষিণ আন্দামানের এই অরণ্য শিউরে উঠল।

মাচানের তলাটা অন্ধকার। সেখানে মড়ার মতো পড়ে আছে লখাই। অদ্ভুত এক ভয় তাকে একটু একটু করে ঘিরে ফেলছে। ঘোর ঘোর চেতনার মধ্যে হঠাৎ সে বন্দুকের আওয়াজ শুনতে পেল। বুম্‌-ম্‌-ম্‌–

সম্ভবত বুশ পুলিশরা বন্দুকে ফাঁকা আওয়াজ করছে। শব্দটা মিলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে দুপ দাপ করে কারা যেন জঙ্গলের দিকে ছুটে পালাল।

এই পর্যন্ত মনে আছে লখাইর। তারপরেই সে ফের বেহুঁশ হয়ে পড়েছিল।

কখন যে কুলিরা ‘বীটে’ ফিরে এসেছে এবং মাচানের তলা থেকে তাকে টেনে বার করে ওপরে শুইয়ে দিয়েছে, আর কখন যে পুরো একটা রাত কাবার হয়ে গিয়েছে, লখাই টের পায় নি।

এখন সকাল।

আবর খান ডাকাডাকি শুরু করে দিল, এ লখাই–লখাই হো–

হাঁ। লখাইর হুঁশ ফিরে এসেছিল। সে আস্তে সাড়া দেয়।

কাল তো জারোয়ার ডরে বেহুশ হয়ে ছিলি। এখন কেমন লাগছে?

ভাল।

আজ সকালে অনেকখানি সুস্থ বোধ করছে লখাই। কানখাজুরার বিষের ক্রিয়া বোধ হয় আর নেই। তবে ফোলা ঊরুটা পুরোপুরি স্বাভাবিক হয় নি। টাটানিটাও অল্প অল্প আছে।

তবু বেশ লাগছে। লখাইর মনে হল, আজ মাচান ছেড়ে সে বাইরে বেরুতে পারবে। প্রায় দুটো দিন এই মাচানে আটকে আছে সে।

আবর খান ফের ডাকল, এ লখাই—

হাঁ–

ওঠ ওঠ, অনেক বেলা হয়েছে। জারোয়ারা কাল কী করে গেছে, দেখবি চল।

এবার মাথার ওপর থেকে কম্বল সরিয়ে আস্তে আস্তে উঠে বসল লখাই। বলল, কী করেছে জাবোয়ারা?

আমার সাথ চল। নিজের আঁখেই সব কুছ দেখবি।

আবর খানের কাঁধে ভর দিয়ে মাচান থেকে নিচে নামল লখাই। ফোলা পাটা টেনে টেনে বাইরে বেরিয়ে এল।

ঝুপড়িগুলোর সামনে খানিকটা সমতল ঘাসের জমি। সেখানে কুলি-জবাবদাররা গোল হয়ে কিছু একটা ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

কুলিদের ঠেলে গুঁতিয়ে, জটলাটা ভেঙে লখাইকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল আবর খান।

সামনের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল লখাই।

আউটরাম ঘাট থেকে আন্দামানে আসার সময় এলফিলস্টোন জাহাজে মঙ চোকে বারকয়েক দেখেছে লখাই। কিন্তু সেলুলার জেলে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তার পাত্তা মেলে নি। যেদিন লখাই তুষণাবাদের এই ‘বীটে’ আসে, তার পরদিন বিকেলে মঙ চোকে শেষ বারের মতো দেখেছিল। পরে তার কথা একবারেই ভুলে গিয়েছিল। কুলি খাটানো, জবাবদারি, উজাগর সিং, আবর খান, এই জঙ্গল, মিমি খিন–নানা ব্যাপারে ডুবে ছিল সে।

ঘাসের জমিটায় পড়ে রয়েছে মঙ চো। তার সমস্ত দেহে অনেকগুলো তীরের ফলা গেঁথে রয়েছে। একটা তীর চোখে ঢুকেছে। চোখটা ফেটে খানিকটা হলদে চর্বি-মেশানো রক্ত বেরিয়ে এসেছে। বীভৎস দেখাচ্ছে তাকে।

এমন যে সাঙ্তিক লখাই, কোনো কিছুতেই যার ভয়ডর নেই, সব রকম ভীষণতা এবং বীভৎসতায় যে অভ্যস্ত, সে পর্যন্ত আতঙ্কে চোখে বুজে ফেলল।

চোখ বুজে মঙ চোর সেই কথাগুলোই ভাবছিল লখাই। সে তাকে এখান থেকে পালিয়ে যেতে বলেছিল।

এ-এক নিদারুণ জঙ্গল। এই জঙ্গল ব্যারাম দিয়ে মানুষ মারে। ব্যাধিতেও যদি মৃত্যু না ঘটে, তা হলে বুঝি জারোয়া দিয়েই তাকে খতম করবে। আন্দামান অরণ্যের মোটামুটি একটা স্বরূপ বুঝতে পারল লখাই।

ভিখন আহীরের হিসাবটা জলের মতো সহজ। তাতে কোনো মারপ্যাঁচ নেই। হাত পেতে কিছু নিলে তার বদলে যে কিছু দিতে হয়, অন্তত দেওয়া উচিত, এটা সে বোঝে। শুধু বোঝে না, মেনেও চলে।

ভিখনের খিদে বড় মারাত্মক ধরনের। কেউ যদি তাকে একখানা রোটি দেয়, সে তাকে কিছু মিঠে কথা শোনাবে। কেউ যদি দুখানা রোটি দেয়, তোষামুদি করে সে তাকে খুশি করবে। কেউ যদি তাকে তিনখানা রোটি দেয়, সে তার হয়ে হুইল ঘানি টেনে দেবে, কিংবা সড়কের পাথর ভাঙবে। কেউ যদি চারখানা রোটি দেয়, সে তাকে ধরম দিয়ে বসবে। কেউ যদি পুরো খানা দেয়, ভিখন বোধ হয় তাকে জানটাই দিয়ে দিতে পারে। মোট কথা, কারোর কাছ থেকে কিছু নিলে, তার বদলে সে কিছু দেবেই। এটা তার কাছে একটা সোজা নিয়ম। জীবনে এই একটা মাত্র নিয়ম, যা কোনোদিন ভাঙে নি ভিখন। কিন্তু সেই নিয়মটাই এবার বুঝি ভাঙতে হচ্ছে।

কদিন ধরে মহা মুশকিলে পড়েছে ভিখন। ভেবে ভেবে কিছুতেই ঠিক করে উঠতে পারে না, কী তার করা উচিত।

রোজ রোজ লা ডিনের খানা থেকে ভাগ বসাচ্ছে ভিখন। অথচ তার বদলে কিছুই দিতে পারছে না। রম্বাস ঘেঁচা, ঘানি টানা, নারকেল ছোবড়ার তার বার করা কি সড়ক বানানোকয়েদখানার কোনো কাজই করতে হয় না লা ডিনকে। যদি লা ডিন এ-সব করত, তা হলে তার হাত থেকে কাজ ছিনিয়ে নিয়ে করে দিত ভিখন।

কত তোষামুদি করেছে ভিখন। কিন্তু লা ডিন হচ্ছে সেই জাতের মানুষ, চাটুকারিতায় যাকে খুশি করা যায় না। কাপড়-কুর্তা হলুদ রঙে ছুপিয়ে ফুঙ্গি হয়ে ধরম দিতে চেয়েছিল ভিখন। কিন্তু তাতেও রাজি হয় নি লা ডিন।

নিজের খানা থেকে ভাগ দিয়ে তার বদলে কিছুই নেয় না, এমন আশ্চর্য মানুষ সারা জিন্দেগীতে এই প্রথম দেখল ভিখন আহীর। রোজ রোজ লা ডিনের খানায় ভাগ বসাচ্ছে, অথচ তাকে কিছুই দিতে পারছে না, বিবেকে কোথায় যেন বাধছে তার।

লা ডিনকে পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারে না ভিখন। পারে না বলেই বোধহয় এই দুয়ে মানুষটা সম্বন্ধে হাজার চিন্তা তার মাথায় সর্বক্ষণ চেপে থাকে।

লা ডিন যেন জাদু করেছে। তার আকর্ষণ ঠেকানো ভিখনের পক্ষে দুঃসাধ্য ব্যাপার। ফুরসত পেলেই ঘুরে ঘুরে সে লা ডিনের কুঠুরিটার সামনে এসে দাঁড়ায়।

এখন দুপুর।

অন্য অন্য দিন এই সময়টায় সেলুলার জেলের মাথায় আকাশের নীল টুকরোটা ঝকঝক করতে থাকে। আজ কিন্তু আকাশ আর নীল নেই, পেটানো তামার পাতের মতো রং ধরেছে সেখানে। খুব সম্ভব বিকেলের দিকে ঝড় উঠবে।

আজকাল হার্দুর ওদিকে সড়ক বানাবার কাজ পেয়েছে ভিখন। সকাল থেকে সড়ক বানিয়ে এই মাত্র সেলুলার জেলে ফিরে এল সে। কোনোক্রমে নাকেমুখে ভাত-ভাজি-ডাল গুঁজে খানাপিনা চুকিয়ে ফেলল। তারপর গুটি গুটি পায়ে লা ডিনের কুঠুরির সামনে এসে বসল।

রোজ একই মতলব নিয়ে ঠিক এই সময়টা লা ডিনের কাছে এসে বসে ভিখন আহীর।

ভিখন আসার আগেই আরো অনেকে এসে পড়েছে। মোপলা বকরুদ্দিন এসেছে, জাজিরুদ্দিনের সাকরেদ ফয়জর আলি এসেছে, জন তিনেক বর্মী কয়েদি এসেছে। আরো কয়েকজন এসেছে, যাদের মুখ চেনে ভিখন, কিন্তু নাম জানে না।

সুমাত্রা-জাভা-শ্যাম-কম্বোডিয়া–জীবনে কত জায়গায় ঘুরেছে লা ডিন। কত মানুষ দেখেছে। রসিয়ে রসিয়ে সেই সব মানুষ আর জায়গার কত বিচিত্র কিস্স্সাই না শোনায় সে। দুনিয়ার কত বিচিত্র খবরই না সে রাখে! কিস্সার টানেই খানাপিনার পর কয়েদিরা লা ডিনের কুঠুরির সামনে ভিড় জমায়।

একবার মুখ তুলল লা ডিন। সঙ্গে সঙ্গে ভিখনের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল।

লা ডিন বলল, তুমি এসে গেছ ভিখন, ভালই হয়েছে।

ভিখন জবাব দিল না। জটলার মধ্যে চুপচাপ বসে রইল।

বড় গম্ভীর দেখাচ্ছে আজ লা ডিনকে। অন্য অন্য দিনের হাসিখুশি, মিশুক মানুষটিকে আজ একেবারেই চেনা যাচ্ছে না। মুখটা থমথম করছে তার।

মোপলা বকরুদ্দিন বলল, লা ডিনজি, কাল যে কিস্সাটা বলবেন বলেছিলেন, সেটা বলুন।

কোন কিস্‌সা?

সেই যে যখন আপনি জাভাতে ছিলেন, তখন কেমন করে লাগুন (লেগুন) থেকে অক্টোপাস মারতেন, সেটা।

বকরুদ্দিন আগের দিনের গল্পের খেই ধরিয়ে দেয়।

জাজিরুদ্দিনের সাকরেদ ফয়জর আলি বলে, না লা ডিনজি, আপনি সেদিন যে মুক্তোর চাষের কথা বলেছিলেন, তার কথাই বলুন। কয়েদ-খাটা শেষ হলে আমি মুক্তোর চাষ করব। ফিকির টিকিরগুলো বাতলে দিন লা ডিনজি।

আর এক কয়েদি বলে, না না লা ডিনজি, আপনি মালয়ের রবার বাগানের কিস্সাটা বলুন। সেই যে কুলিরা–

কয়েদিরা চিল্লাচিল্লি বাধিয়ে দেয়।

কোনো দিকে নজর নেই লা ডিনের। আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে। সেখানে কতকগুলো দুর্বোধ্য হরফে কোনো লেখা যেন পড়তে চেষ্টা করেছে। হঠাৎ মুখটা নিচে নামাল লা ডিন। আস্তে আস্তে বলল, তোমাদের আজ একটা নয়া কিস্সা বলব।

কী? কী? কী? কয়েদিদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। সকলেই গরাদ ধরে লা ডিনের মুখোমুখি বসতে চায়। একসময় হইচই থামে। সুবিধামতো জায়গা দখল করে লা ডিনের গল্প শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে বসে থাকে তারা।

লা ডিন বলে, পঁচিশ সাল আগে আমি এই দ্বীপে এসেছিলাম।

কয়েদিরা সঙ্গে সঙ্গে বলে, হাঁ হাঁ, ও-কথা তো আমরা শুনেছি।

বারো সাল কয়েদ খাটার পর আমার সাজার মেয়াদ শেষ হয়েছিল।

হাঁ হাঁ, তা-ও তো আমরা জানি।

লা ডিন বলল, আমি এখানে কী-জন্যে সাজা খাটতে এসেছিলাম, তা তো তোমাদের বলেছি।

হাঁ হাঁ জি, বর্মা মুলুকে ইংরাজদের সাথ আজাদীর লড়াই করেছিলেন। সেই কসুরে কালাপানির সাজা নিয়ে এখানে এসেছিলেন।

অনেকক্ষণ আর কিছু বলল না লা ডিন। আকাশটার দিকে ফের তাকায় সে। কী যে ভাবতে থাকে, সে-ই জানে। একসময় আস্তে আস্তে বলতে লাগল, কাল রাত্তিরে আমি একটা খবর পেয়েছি।

কী খবর? কয়েদিরা গরাদের ওপর ঝুঁকে পড়ল।

লা ডিনের গলাটা খাদে ঢুকে গেল, বিশ রোজের মাথায় এবার জাহাজ আসছে। বাংলা মুলুকে ইংরেজদের সাথ একটা ভারী লড়াই হয়েছে। জাহাজ ভরে সেই লড়াইয়ের কয়েদিরা আসছে।

শ্রোতারা এবার আর কিছু বলে না। তাদের মুখগুলো একবার দেখে নেয় লা ডিন। তারপর ধীরে শুরু করে, আমার একটা মতলব আছে। তোমাদের সে-কথা বলতে চাই।

বল।

সেটা বলার আগে আর ওকটা কথা বলি।

কী কথা? ইংরাজ বড় দুশমন, এটা তো মানো?

আরে বাপ রে বাপ! এ আপনি কী বলছেন লা ডিনজি!

ঠিকই বলছি।

এ কথা জেলার সাহেবের কানে গেলে জান চৌপট করে দেবে।

লা ডিন সামান্য হাসল। তার ছোট ছোট চোখজোড়া জ্বলছে। ভেতরে কোথায় যেন খানিকটা গনগনে আগুন আছে লোকটার। মুখেচোখে তার তাপ ফুটে বেরিয়েছে। খুব আস্তে লা ডিন বলল, আমি চাই কথাটা জেলার সাহেবের কানে যাক।

বকরুদ্দিন বলল, আপনি এংরাজবালাকে চেনেন নি লা ডিনজি। এংরাজবালার মতো। বড়ে মরদ দুনিয়ায় নেই। তারা দরিয়ার মধ্যে কয়েদখানা বানিয়ে সাজা খাটায়, কয়েদিকে ফাঁসির রশিতে লটকায়, বেয়াদবি কি হারামীগিরি করলে পিটিয়ে জান তুড়ে দেয়।

অন্য অন্য কয়েদিরা সঙ্গে সঙ্গে সায় দেয়, ও তো ঠিক কথা।

হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠল লা ডিন। বলল, তুমি বড় খাসা কথা বলেছ বকরুদ্দিন, এংরাজবালাকে আমি চিনি না, তুমি চেন! একটু থেমে আবার শুরু করে, কদ্দিন তুমি কয়েদ খাটছ?

দেড় দু’মাস।

আমি পঁচিশ সাল এই দ্বীপে আছি। এখানে আসার আগে এংরাজবালার সাথ লড়াই করে এসেছিলাম। আমি এংরাজবালাকে চিনি না, তুমি চেন! একটু যেন উত্তেজিত হয়ে উঠল লা ডিন।

বকরুদ্দিন বলল, আপনার মতলবটা কী লা ডিনজি?

এংরাজবালাদের সাথ লড়াই করা।

লড়াই! বকরুদ্দিনের গলায় অস্ফুট, ভয়ার্ত একটা শব্দ ফুটল।

বলে কী লা ডিন! কয়েদিরা নিজেদের কানগুলোকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। অনেকক্ষণ হাঁ করে লা ডিনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল তারা। তাদের চেহারা দেখলে মনে হয়, এমন তাজ্জবের কথা সারা জীবনে আর কখনও শোনে নি।

দেওয়ালের গা ঘেঁষে একটা লোক দাঁড়িয়ে ছিল। লা ডিন জানে না, যেদিন তাকে সেলুলার জেলে আটক করা হয়েছে, সেদিন থেকেই লোকটা ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে। সে কী বলে, কী করে, সব লক্ষ্য রাখে।

পা টিপে টিপে লোকটা সিঁড়ির দিকে ছুটল। সিঁড়ি বেয়ে নেমে সোজা জেলার সাহেবের অফিসে গিয়ে ঢুকল।

বকরুদ্দিন আবার বলল, এংরাজবালাদের সাথ লড়াই করতে চান লা ডিনজি? সচ্‌?

সচ্‌।

কয়েদিগুলো একদৃষ্টে তাকিয়ে লা ডিনকে দেখতে লাগল। তামাশা করছে না তো লোকটা? কিন্তু না, তামাশার কোনো লক্ষণই নেই তার মুখে।

লা ডিন বলতে লাগল, ইণ্ডিয়া আর বর্মা মুলুকের ওপর এংরাজবালারা বহুত জুলুম করেছে। আজাদীর জন্যে ইণ্ডিয়াতে সিপাহী লড়াই হয়েছে, বর্মা মুলুকে থিবোর লড়াই হয়েছে। এবার বাংলা মুলুকে লড়াই হল।

একটু চুপ করল লা ডিন। তার মুখের চেহারা আজকের আকাশটার মতোই থমথম করছে। লা ডিন আবার শুরু করল, বিলাত থেকে এদেশে এসে অনেক জুলুম করেছে এংরাজ। আমাদের আজাদী কেড়ে নিয়েছে। আজাদী ফিরে চাইলে গুলি করে মেরেছে। কালাপানি পার করে এখানে পাঠিয়ে কয়েদ খাঁটিয়েছে। লেকিন আর তাদের জুলুম সইব না।

বকরুদ্দিন বলল, আপনার মতলব কী?

এই কয়েখানায় এংরাজবালাদের সাথ আমি লড়াই করব। তোমরা আমার সাথে থাকবে।

ইংরেজ সম্বন্ধে সাধারণ কয়েদির মধ্যে অদ্ভুত এক সংস্কার আছে। যে-ইংরেজ বিলাইত থেকে বড় বড় দরিয়া পাড়ি দিয়ে এই মুলুকে এসে পৌঁছেছে, যারা ইচ্ছা করলে সবাইকে ধরে ধরে ফাঁসির দড়িতে লটকাতে পারে, দুনিয়ার যে কোনো মানুষকে দিয়ে ঘানি টানাতে পারে, তাদের সঙ্গে লড়াই করা আর যাই হোক, বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

কয়েদিগুলো কিছুক্ষণ হতবাক লা ডিনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। অন্য অন্য দিনের হাসিখুশি, নির্বিরোধ লা ডিন আজ একেবারেই বদলে গিয়েছে। কয়েদিরা এই লা ডিনকে চেনে না। একবার তারা ভাবল, লা ডিনের মাথা বুঝি খারাপই হয়ে গিয়েছে। তা না হলে বঙ্গোপসাগরের এই নিদারুণ দ্বীপে ইংরেজের সঙ্গে লড়াই করার মতো একটা অসম্ভব ও সাঙ্তিক কথা সে কেমন করে বলতে পারে!

হঠাৎ কয়েদিগুলো জটলা ভেঙে উঠে পড়ল। চিল্লাতে চিল্লাতে যে যেদিকে পারল পালিয়ে বাঁচল, মর যায়েগা, মর যায়েগাজরুর মর যায়েগা। লা ডিনজির মতলব বড় খারাপ। এংরাজবালা সবাইকে জানে মেরে ফেলবে।

লা ডিনের চোখের সামনে দিয়ে একে একে সবাই সরে পড়ল। গরাদের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে একজনকেও ধরে রাখতে পারল না সে।

লা ডিন জানত, একটা কয়েদিও তার পাশে এসে দাঁড়াবে না। এইদ্বীপে পঁচিশটা বছর কাটিয়ে দিল। এই পঁচিশ বছরে এখানে কয়েক হাজার কয়েদি এসেছে। কয়েদির চরিত্র তার চেয়ে আর বেশি কে বোঝে!

এই মানুষগুলো খুন করতে ডরায় না, রাহাজানি দুশমনি করে ফাঁসির দাড়িতে ঝুলতে পেছ-পা হয় না। অথচ তাদের যত ভয় ইংরেজকে।

লা ডিন বিড় বিড় করে বকতে লাগল, সবাই পালিয়ে গেল। তার গলায় কেমন যেন হতাশা এবং আক্ষেপ ফুটল।

না জি, এই তো আমি আছি। ডান দিকের দেওয়াল ঘেঁষে চুপচাপ বসে ছিল ভিখন আহীর। পাছা ঘষটাতে ঘষটাতে এবার সে লা ডিনের মুখোমুখি এসে বসল। ফিশফিশ করে বলল, সবাই চলে গিয়েছে, লেকিন আমি যাই নি।

ভিখন–তুমি! চোখ দুটো চকচক করে উঠল লা ডিনের।

হাঁ লা ডিনজি। কেউ না থাকলেও আমি আপনার সাথ থাকব। বলে একটু থামল ভিখন। কী যেন ভাবল। তারপর ফের বলে, কবে লড়াই হবে জি?

লড়াই! হঠাৎ যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল লা ডিন।

কবে, কেমন করে এই কয়েদখানায় ইংরেজদের সঙ্গে লড়াই শুরু হবে, সে কথা তো একবারও ভেবে দেখে নি লা ডিন। কাল রাতে পাকা খবর পেয়েছে সে, কয়েক দিনের মধ্য বাংলা মুলুক থেকে আজাদী লড়াইর কয়েদিরা এই দ্বীপে আসছে। সেই থেকে অদ্ভুত এক উদ্দীপনা তার ওপর ভর করে বসেছে।

লা ডিন হচ্ছে সেই জাতের মানুষ, ভাবাবেগে যে চালিত হয়। উত্তেজনা কি ঝোঁকের বশে সে হঠাৎ কিছু করে ফেলতে পারে।

থিবোর যুদ্ধের জ্বালা বুকের মধ্যে পুরে এই দ্বীপে এসেছিলে লা ডিন। এখানে প্রথম বারো বছর সাজা খেটেছে সে। পরের বারো তেরো বছর ধরে সে ফুঙ্গি। এই সন্ন্যাস জীবনের নিরাসক্তিও থিবোর যুদ্ধের সেই জ্বালাটাকে জুড়িয়ে দিতে পারে নি।

উত্তেজনাটা আস্তে আস্তে কমে আসতে লাগল। এখন লা ডিনের মনে হচ্ছে, প্রবল ঝোঁকের মাথায় হঠাৎ কিছু করে ফেলা উচিত হবে না। পরিকল্পনা নেই, প্রস্তুতি নেই, এমন অবস্থায় কয়েদিদের খেপিয়ে দিলে হঠকারিতাই করা হবে, লাভ কিছু দাঁড়াবে না। তা ছাড়া, এই কয়েদিগুলোর মনই তৈরি নেই। ইংরেজ সম্বন্ধে এদের সংস্কার না ঘোচাতে পারলে এদের দিয়ে কোনো কাজই হবে না।

কাল অনেকটা রাত পর্যন্ত ঘুমোতে পারেনি লা ডিন। জেগে জেগে অদ্ভুত এক লড়াইয়ের কথা ভেবেছে। এই লড়াই সম্বন্ধে এখনও ধারণাটা তার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। তবে এটুকু সে বুঝেছে, এতে গুলি-বন্দুক লাগে না। খুনখারাপি, রক্তপাত–এর মধ্যে কিছুই নেই। কিন্তু এর জন্য যে অটুট মনোবল প্রয়োজন, কয়েদিদের মধ্যে তার ছিটেফোঁটাও নেই।

হঠাৎ লা ডিনের মনে হল, যেমন করেই হোক কয়েদিদের মনগুলোকে তৈরি করে দিতে হবে। দেশ-কাল এবং ইংরেজ সম্বন্ধে ধারণা বদলে দিতে হবে। মানসিকভাবে প্রস্তুত করে দিলেই চলবে না, অনবরত তাদের প্রেরণাও দিয়ে যেতে হবে। তা না হলে লড়াইয়ের নাম শুনলেই তারা পালিয়ে যাবে।

প্রবল উদ্দীপনায় লড়াইয়ের কথাটা বলে ফেলেছে। নাঃ, বারো তেরো বছর ফুঙ্গি জীবন কাটিয়েও উত্তেজনা দমাতে পারল না লা ডিন। এজন্য এখন তার বড় অনুতাপ হচ্ছে। গরাদের ওপাশ থেকে ভিখন ডাকল, লা ডিনজি–

হাঁ–

কবে লড়াই শুরু হবে?

তোমাকে পরে বলব ভিখন। বিকেলে কাম থেকে ফিরে একবার এস। তোমার সাথ কথা আছে। তোমাকে আমার খুব দরকার।

কাজে যাবার সময় হয়েছে। ভিখন উঠে পড়ল।

কয়েদখানার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে ভিখনের মন খুশিতে ভরে গেল। লা ডিন তাকে কাজের পর আসতে বলেছে। তাকে লা ডিনের খুব দরকার।

হাত পেতে কিছু নিলে তার বদলে কিছু দেওয়াটা ভিখনের দস্তুর। লা ডিন তার খানা থেকে ভিখনকে ভাগ দিয়ে থাকে। তার বদলে কিছুই নেয়নি লা ডিন। ধরম না, জান না, তোষামুদিও না। ভিখন আহীরের মনে হল, এতদিনে খাবারের বদলে লা ডিনকে সে কিছু দিতে পারবে।

শেষ বেলায় ঝড় উঠল।

তামার পাতের মতো আকাশটা ফেড়ে কড় কড় শব্দে বাজ গর্জায়। গুর গুর করে মেঘ ডাকে। সমুদ্র তোলপাড় করে বিরাট বিরাট হালফা ওঠে।

ঝড়ের মুখে দৌড়তে দৌড়তে ভিখন আহীরেরা সেলুলার জেলে ফিরে এসেছে।

রাতের বরাদ্দ রোটি-ভাজি নিয়ে ওপরে এসে চমকে উঠল ভিখন। লা ডিন তার সেল এ নেই।

কুঠুরিটার ভেতর পাতি পাতি করে খুঁজল ভিখন। তারপর গরাদ ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

একটু পর মোপলা বকরুদ্দিন, D টিকিট পাওয়া ফয়জর আলি এবং অন্য কয়েদিরা এসে পড়ল। সবাইকে জিজ্ঞেস করল ভিখন। কিন্তু লা ডিন যে কোথায় গিয়েছে, কেউ বলতে পারল না।

লা ডিনের খাবার থেকে প্রায় প্রতিদিনই ভাগ নিয়েছে সে, কিন্তু তার বদলে কিছুই দিতে পারল না। এই ভেবেই মনটা ভারি খারাপ হয়ে গেল ভিখনের।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress