সাহেব বিবি গোলাম (Saheb Bibi Golam) : 04
সকাল বেলা ব্রজরাখালের ডাকেই ঘুম ভাঙলো। কিন্তু ব্ৰজরাখাল ততক্ষণে স্নান করে তৈরি। বললে—ওঠো হে বড়কুটুম— এত দেরি করলে চলবে না, এখানে ঘড়ি ধরে সব কাজ হয়—এ কলকাতা—তোমার গিয়ে ফতেপুর নয়—
কত রাত্রে যে ব্রজরাখাল শুলো, কখন ঘুমোলো আর কখনই বা উঠলে কে জানে। ভূতনাথ উঠে দেখলে ব্রজরাখাল ততক্ষণে রান্না ঘরে গিয়ে রান্নায় ব্যস্ত। সকাল বেলা বাড়িটার চারদিকে চেয়ে দেখলে এক পলক। দক্ষিণ দিকে জানালা দিয়ে দেখা যায় মস্ত বড় বাগান। মাঝখানে একটা পুকুর।
ব্ৰজরাখাল এল হঠাৎ। বললে—এটা খেয়ে নাও দিকিনি বড়কুটুম–
এক কাসি ফ্যানে-ভাত। ব্রজরাখাল বললে–খেয়ে দেখো খাঁটি ঘি দিয়েছি—তোমাদের ফতেপুরের ঘিয়ের চেয়ে ভালো–
ব্ৰজরাখালের ব্যবহারে ভূতনাথ অবাক হয়ে গেল। কোথাকার কে নন্দজ্যাঠা-তার মেয়ে রাধ—সেও তো আর বেঁচে নেইকী-ই বা সম্পর্ক—অথচ এমন করে আপন করে নিতে পারে পরকে! ভূতনাথ বললে—তুমি খাবে না?
—আমার ভাত ওদিকে তৈরি—এখনি ন’টার ঘণ্টা পড়বে— আমিও আপিসে বেরুবোহাঁটতে হাঁটতে আপিসে দশটার মধ্যে পৌঁছে যাবো ঠিক—তারপর ফিরতে যার নাম সেই খানিক পরেই খাওয়া দাওয়া সেরে তৈরি হয়ে পড়লো ব্রজরাখাল। সেই ধুতির কোঁচাটা কোমরে গুজে আলপাকার কোটটা চড়ালে গায়ে। তারপর যাবার আগে বললে—এইটে রাখো তত বড়কুটুম—এই পুরিয়াটা–
—কী এটা—ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে।
—হোমিওপ্যাথিক ওষধর পুরিয়া, যদি কেউ এসে ওষুধ চায়— বলে–মাস্টারবাবু কোন ওষুধ রেখে গিয়েছে—ত দেবে এইটে। আমি বলেছি কিনা বংশীকে যে, আমার সম্বন্ধীর কাছে রেখে যাবে–
ভূতনাথের বিস্মিত দৃষ্টির দিকে চেয়ে ব্ৰজরাখাল হো হো করে হেসে উঠলো। বললে—চেয়ে দেখছে কি—ডাক্তারিও জানি তোমার বোনকেই শুধু যা বাঁচাতে পারলাম না—আমার রুগীদের মধ্যে ওই একজনই যা মরে গিয়েছে—নইলে এ পাড়ায় আমার খুব নাম-ডাক হে—বলে হন্ হন্ করে বেরিয়ে গেল। আবার ফিরে এল খানিক পরে। বললে—একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি—যদি রাস্তায় বেরোও তত বেশি দূর যেও না—নতুন মানুষ হারিয়ে যাবে —আর একটা কথা, তুমি ভেবো না, তোমার চাকরিরও
একটা চেষ্টা করছি—তবে বাজার বড় খারাপ কি না—
ব্ৰজরাখাল চলে গেল। এ যেন একেবারে অন্য মানুষ। কখন সে ভাত রাঁধলে নিজের হাতে, কখন খেলে—আবার আপিসেও চলে গেল—ন’টার ঘণ্টা পড়বার সঙ্গে সঙ্গে। কাজের মানুষ বটে! ঘর ছেড়ে আর একবার বাইরে এসে দাঁড়ালো ভূতনাথ। কত বড় বাড়ি। এখানে দাঁড়ালে বাড়ির বাইরে আর কিছু দেখা যায় না। বড়বাড়িটার ভেতরে যে কোনও মানুষ বাস করে বাইরে থেকে তা। বোঝবার উপায় নেই। শুধু বাইরেই যা তোড়-জোড়-নড়া-চড়া হাঁক-ডাক। চারদিকে চেয়ে চেয়ে দেখতেই বেলা বেড়ে গেল। আস্তে আস্তে রান্না বাড়ির দিকে গেল। পাশেই সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি দিয়ে নেবে স্নান করবার জায়গা। নতুন জলে স্নান করা উচিত নয়। মুখ হাত পা ধুয়ে ওপরে রান্নাঘরে ঢুকলো। খাবার ঢেকে রেখেছে ব্রজরাখাল। এক হাতে অনেক রান্না করেছে বটে। ডাল, ঝোল, ভাত।
সবে থালা বাটি গেলাশ সাজিয়ে বসেছে খেতে—এমন সময় দরজার পাশে কে যেন উঁকি দিলে।
—কে? ভূতনাথ দরজার দিকে মুখ করে জিজ্ঞেস করলে। লোকটা কিন্তু সামনে এল না। আড়াল থেকে বললে—আপনি খান আজ্ঞে-আমি আসবো’খন পরে—
লোকটা সত্যি সত্যিই পরে এল। ভূতনাথ ততক্ষণে খাওয়া-দাওয়া সেরে বাসন কোসন মেজে রান্নাঘর ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে ফেলেছে।
এসে বললে—আপনি মাস্টার বাবুর শালা
রোগ ক্ষয়-ক্ষয় চেহারা। তেল-চকচকে তেড়ি কাটা মাথা। আধ-ময়লা ধুতিটা কোঁচা করে কোমরে গোঁজা। বললে—আমি বংশী
ভূতনাথ ওষুধের পুরিয়াটা দিয়ে জিজ্ঞেস করলে—অসুখ কার
-আজ্ঞে চিন্তার
–চিন্তা কে?
—ছোটমা’র ঝি—
–কী অসুখ?
–ম্যালেরিয়া-ডাক্তারবাবু তো বলেন ম্যালেরিয়া—দেশে গিয়ে অসুক বাধিয়ে এনেছে, আমার বোন হয় সে, এই ছোট বেলা থেকে কলকাতায় আছে কিনা, দেশে-গাঁয়ের জল আর সহ্য হয় না পেটে, আমার বিয়েতে সেবার গেল দেশে, বললুম অতো করে পুকুর ঘাটে জল ঘাঁটিসনে চিন্তা, তা কি শুনবে—ছোটমা’র আদর পেয়ে পেয়ে কথার বড় অবাধ্য হয়ে উঠেছে আজ্ঞে—এখন আমার ভোগান্তি—ছোটমা’র ভোগান্তি-মাস্টারবাবুর ভোগান্তি –এখন এক গেলাশ জল খেতে গেলে ছোটমা’কে নিজে গড়িয়ে খেতে হয়–
তারপর চলে যেতে গিয়ে থামলো বংশী—ছোটমা বলে বটে যে বংশী তোর নিজের মায়ের পেটের বোন, তুই বউবাজারের শশী ডাক্তারকে দেখা। আমি বলি—থাক। মাস্টারবাবু কি ছোট ডাক্তারবড়বাড়ির সমস্ত লোক ভালো হয়ে যাচ্ছে ওর ওষুদ খেয়ে—তা আজ্ঞে ছোটমা’র দেখুন কি জ্বলা, এই সাবু আনন। মিছরি আনো—ফলফুলুরি আনোহান্ আনো ত্যান্ আনোতা খরচার বেলায় তো সেই ছোটমা।
বংশী গলা নিচু করলো এবার। বললে—এ-বাড়ির সবার যে আজ্ঞে হিংসে আমাদের দুজনের ওপর কেউ তো ভালো চোকে দেখে না কি না—
ভুতনাথ জিজ্ঞেস–সের হিংসে—হিংসে কেন–
—ওই যে মধুসূদনকে দেখছেন—
–কে মধুসূদন? ভূতনাথ মধুসূদন কেন কাউকেই এখনও দেখেনি।
বংশী বললে-তোষাখানায় একদিন যাবেন—ওই মধুসূদনই তোষাখানার সর্দার কিনা—আমাদের পাশের গায়ে বাড়ি হুজুরবললে বিশ্বেস করবেন না, আমার আপন পিসীর সম্পর্কে ভাসুর হয় আজ্ঞে——আর তার এই কাণ্ড-বুঝুন—
—কী কাণ্ড–
—সে অনেক কথা হুজুর—অনেক কথা বলে বসলে বংশী। ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে গলা আরো নিচু করলো।
বংশীর অনেক অভিযোগ। এত বড় বাড়ি—কত পুরুষ আগে থেকে বংশপরম্পরায় কত দাস-দাসী, কত লোকজন আসা-যাওয়া করেছে। কত বংশের ভরণ-পোষণ জীবিকা নির্বাহ নির্ভর করেছে এই চৌধুরী পরিবারের দান-ধ্যান ধর্মানুষ্ঠানের সূত্রে। গ্রাম-কে-গ্রাম ঝেটিয়ে এসেছে চাকরির চেষ্টায় এখানে। উঠেছে এসে এই চৌধুরী বাড়িতে। ওই মধুসূদন এখন তোষাখানার সর্দার। ওর কোন্ পূর্ব পুরুষ কবে কী সূত্রে এসে আশ্রয় পেয়েছিল কর্তাদের আমলে। তারপর সংসারের আয়তন বেড়েছে, আয়োজন বেড়েছে, আয় বেড়েছে, ধনে জনে প্রতিষ্ঠায় প্রতিপত্তিতে চৌধুরী বংশের প্রসার বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছিয়েছে। আর সঙ্গে সঙ্গে আত্মীয়, স্বজন, পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, পারিষদ, মোসাহেব, দাস দাসী—তাদের প্রয়োজনও বৃদ্ধি পেয়েছে। কোন্ সুদূর বালেশ্বর, কটক, বারিপদা জেলা থেকে মধুসূদনের পূর্ব পুরুষের আত্মীয় পরিজন-গ্রামবাসীরা এসে জুটেছিল এখানে। এসে ভার নিয়েছিল এক একটা কাজের। ভিস্তিখানা, তোষাখানা, রান্নাবাড়ি, কাছারিবাড়ি, বৈঠকখানা সেরেস্তা অলঙ্কৃত করেছে। পূজোয়, পার্বণে, উৎসবে, আনন্দে যোগ দিয়েছে পরিবারের একজনের মতো। দেশে গিয়েছে, বিবাহ করেছে—আবার ফিরেও এসেছে, দেশে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে মাসে মাসে। এ-সংসারে তাদের প্রয়োজন যেমন অপরিহার্য, এ-সংসারও তেমনি তাদের জীবিকার পক্ষে অনিবার্য। এ-পরিবারের কেউ-ই পর নয়। সাধারণ পর্ব উপলক্ষে, দোল-দুর্গোৎসবে তারা নতুন কাপড় পেয়েছে, পার্বণী পেয়েছে। শুধু তারা কেন, একটা কুকুর-বেড়ালেরও ন্যায্য অধিকার আছে এ-বাড়ির ওপর। এখানে কেউ অনাত্মীয় নয় সবাই আপন—সবাই অনস্বীকার্য!
কিন্তু সেদিন বদলে গিয়েছে। বংশী গলা নিচু করে বলে কিন্তু সেদিন বদলে গিয়েছে হুজুর—এখন এক-একজন চাকরি পাবে আর মধুসূদনকে পাঁচ টাকা করে বা দিতে হবে—আর চাকরি যতদিন না হবে, ততদিন বছরে তাদের কাছে এক টাকা করে বাব আদায় করবে—এই যে আমার বিয়ে হলো না—ওকে দিতে হলো ওর দস্তুরী—বিয়ের দস্তুরী আজ্ঞে দশ টাকা—এই ধরুন যদি আমার সঙ্গে যদুর মার ঝগড়া হয় আর ও যদি মিটিয়ে দেয়—ওর আদায় হবে চার আনা, আমি দেবো দু’ আনা, আর যদুর মা দেবে দু’ আনা—আমার যদি ছেলে হয় আজ্ঞে তো ওকে দিতে হবে সোয়া শ’ পান আর পৌনে পাঁচ গণ্ডা সুপুরী-—এই হলো নেয়ম—তা এত বড় পিশে আজ্ঞে ওই মধুসূদন—আমার যদ্দিন চাকরি হয়নি, তদ্দিন এক টাকা করে আমার মাইনে হবার পর থেকে কেটে নিয়েছে। তা মাস্টারবাবুর কাছে শুনেছি আপনি এখানে থাকবেন এখন—চাকরি করবেন এখানে—অনেক সব দুঃখের কথা বলবো আপনাকে—আমি পুরুষ মানুষ, আমার জন্যে ভাবিনে আজ্ঞে নিজে গতরে খেটে দেনা-পত্তর শশাধ করে দেবো একদিন—কিন্তু ওই চিন্তার জন্যেই তো ভাবনা।
ভূতনাথ বললে—কেন?
–আজ্ঞে গরীবের ঘরে জন্মেছে, না খাটলে চলবে কেন, কে তোকে বসে বসে খাওয়াবে—সোয়ামী থাকলে সেও খাটিয়ে নিত, শুধু শুধু খেতে দিত না, তা সোয়ামীকে খেয়েছে, এখন ছোটমা-ই তো ভরসা—তা ছোটমা-ই বা ক’দিক দেখবে।
ভূতনাথ বললে—তোমার ছোটমা বুঝি চিন্তাকে খুব ভালোবাসেন।
—ভালোবাসলে হবে কি শালাবাবু, তার যে নিজেরই শতেক জ্বালা।
–কিসের জ্বালা।
—সে সব অনেক কথা, পরে বলবো আপনাকে—তা ছোটমা ভালোবাসে বলেই তো মধুসূদন দেখতে পারে না আমাদের। শুধু মধুসূদন কেন, মধুসূদনের দলের কেউ দেখতে পারে না, ও গিরিই বলুন, সিন্ধুই বলুন, সদুই বলুন, রাঙাঠাকমাই বলুন—কেউ না, এমন কি বেণীও নয়।
—বেণী কে? ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে।
—আজ্ঞে বেণী হলো মেজবাবুর চাকর—অথচ দেখুন সবাই এক জেলার লোক আমরা—বেণী তো আমার গায়ের লোকই বটে।
আশ্চর্য। ভূতনাথও আশ্চর্য হয়ে গেল।
–রাঙাঠাকমাকে আপনি দেখেন নি আজ্ঞে।
—কে রাঙাঠাকমা?
—ভাড়ারে থাকে, ভাড়ার দেখে শোনে, ওই মধুসূদনের সম্পর্কে রাঙাঠাকমা হয় বলে—এ-বাড়ির আমরাও সবাই রাঙাঠাকমা বলি
—তা সেই রাঙাঠাকমাকে গিয়ে কাল বললাম আজ্ঞে—পোটাক সাবু দাও আর মিছরি আধপো-। শুনে নানান কথা—কে খাবে, কেন খাবে, হান্ ত্যা। আমি বললাম—ছোটমা’র হুকুম। তখন বলে ছোট বোমা নিজের ঝিকে দিয়ে বলে পাঠালে না, তোকে দিয়ে কেন বললে রে বংশী। আমি বললাম-চিন্তার যে অসুখ, সে কি নড়তে পারে। তখন বললে–ছোট বৌমাকে গিয়ে বলগে—একটা চিরকুট নিখে দিক—আমি গিয়ে বললাম সব ছোটমাকে। ছোটমা বললে–কাজ নেই বংশী—–পয়সা নিয়ে দোকান থেকে কিনে আনগে, ঝঞ্চাট চুকে যাক। বলে টাকা দিলে আমাকে।—অথচ দেখুন আজ্ঞে–বংশী আবার বলতে লাগলো–অথচ দেখুন, এই যে গিরি, মেজমা’র পেয়ারের ঝি, তার একাদশীতে ফল, পুণ্যিমেতে পাকা ফলার—সব যোগান দেবে রাঙাঠাকমা। ছোটমা ভালো মানুষ, তা সংসারে ভালো মানুষ হওয়াও খারাপ শালাবাবু।
বংশীর কথার হয় তো শেষ নেই। কিন্তু যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও এবার উঠলো সে। বললে—যাই আবার—ছোটবাবু হয় তো ঘুম থেকে উঠবে এখনি—উঠে যদি ওপরে যায় তো মুশকিল।
ভূতনাথ অবাক হয়ে গেল। বললে—এখন? এই বারোটার সময়?
বংশী বললে—তা ছোটবাবুর এক-একদিন ঘুম থেকে উঠতে দুপুর দুটোও বেজে যায়—তারপর তখন উঠে ভাত খাবেন সেই বিকেল পাঁচটায়। তারপর হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে বললে—যাই আমি, অনেকক্ষণ বসলাম, আজকে বিকেল বেলা আবার বার-বাড়িতে রাক্ষস দেখতে যাবে—যাবেন নাকি দেখতে? ডাকবো’খন আপনাকে—
রাক্ষস? ভূতনাথ যেন ভুল শুনেছে!
—আজ্ঞে হ্যাঁ, নর-রাক্ষস আর কি-একটা জ্যান্ত পাঠা খাবে। কালকে সরকারবাবু নিজে হাতীবাগানের বাজার থেকে কিনে এনেছে—ওই যে দেখুন না, জানালা দিয়ে পুকুরের পাড়ে খোটায় বাঁধা রয়েছে, চরে চরে ঘাস খাচ্ছে—ত কচি বেশ, এখনও শিং গজায় নি-কালো রং–
ভূতনাথের বিস্ময় বিস্ফারিত চোখের দিকে চেয়ে বংশী বললেএ আপনার গিয়ে সব মেজকত্তার সখ, ভারি সৌখীন মানুষ আপনার এই মেজকত্তা—সেদিন সুখচর থেকে একজন লোক এসে বাজি রেখে দশ সের রসগোল্লা খেয়ে গেল—বাজি ছিল খেতে পারলে মেজকা নগদ পাঁচ টাকা দেবে—ভৈরববাবুও খেতে বসেছিলতিন সের খেয়েই হেঁচকি তুলতে লাগলোতা সে নগদ পাঁচটা টাকাও নিলে, দশ সের রসগোল্লাও খেলে, আবার মেজকত্তা খুশি হয়ে একটা গরদের উড়ুনি দিলেন তাকে।
একলা ঘরে ঘুরে ঘুরে ভূতনাথের সময় আর কাটে না। একবার মনে হলো—রাস্তায় বেরোয়। কিন্তু অচেনা জায়গা, কোথায় গিয়ে শেষে চিনে চিনে বাড়ি ফিরতে পারবে না। আসুক ব্ৰজরাখাল। প্রথম দিন তার সঙ্গে বেরুতে হবে।
জানালা দিয়ে আবার চেয়ে দেখলে দক্ষিণ দিকে। পুকুরের পাড়ে বাঁধা রয়েছে ছাগলটা। আপন মনে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘাস খেয়ে চলেছে। বাগানে একজন মালী গাছের গোড়াগুলো খুড়ে দিচ্ছে। কোণের মেথরপাড়ার ছেলেমেয়েরা খেলা করছে রাস্তার ওপর। আর তারপর বুঝি ধোপাদের ঘর। দড়িতে সার সার অসংখ্য শাড়ি কাপড় জামা শুকোচ্ছে।
ঘরের দেয়ালের তাকে হঠাৎ ভূতনাথের নজর পড়লো—পুরনো কাগজপত্রের জঞ্জালের মধ্যে ঢাকা পড়ে আছে এক জোড়া বাঁয়া তবলা। কার জিনিস কে জানে। ব্রজরাখালের এ দিকেও সখ আছে নাকি! সর্বাঙ্গে ধুলো মাখা। বোধ হয় বহুদিন কেউ হাত দেয়নি। মনে পড়লো ভূতনাথের—সেই ফতেপুরের বারোয়ারিতলার যাত্রাদলের কথা। একদিন এই নিয়ে কত মাথাই না ঘামিয়েছে। সাত মাত্রার যৎ, আবার আট মাত্রার যৎ! বিলম্বিত লয়ের কাওয়ালি আর একতালা। দুন, চৌদুন, তেহাই। রসিক মাস্টার বলেছিল—ড়ুগি তবলায় খাসা হাত তত ছোকরার।
কেমন যেন ইচ্ছে হলো ভূতনাথের তবলা বাজাতে। কিন্তু ভয় হলে যদি কেউ আপত্তি করে। কোথায় পরের বাড়িতে থাকা। ব্ৰজরাখালের নিজের বাড়ি তো আর নয়। তবলাটায় হাত বুলিয়ে সামনের তর্জনীটা দিয়ে দুই একটা টোকা মেরে আবার রেখে দিলে। ঘাটগুলো বাধা নেই। কেমন যেন মরা আওয়াজ বেরুলো। সামনের রাস্তা দিয়ে ফেরিওয়ালার ডাক কানে আসে–বাসন চাই—পেতল কাঁসার বাসন—
কাঁসি ঘণ্টা বাজিয়ে কাঁসার বাসন বেচতে চলেছে। সামনের আস্তাবল বাড়ির কার্নিসের ওপর একটা চিল চুপ করে বসে ছিল, এবার হঠাৎ অকারণে চিঃ হিঃ ইঃ শব্দ করে তীর বেগে উড়ে পালালো। আর একজন ফেরিওয়ালা কী একটা অদ্ভুত চিৎকার করতে করতে চলেছে। প্রথমটা কিছু বোঝা যায় না। অনেকক্ষণ। শোনার পর বোঝা গেল। বলছে—কুয়োর—ঘটি তো-লা-আ–আ–
ভূতনাথের আজও মনে আছে সে কলকাতার সেই প্রথম দিনের দুপুরটা যেমন রোমাঞ্চময় লেগেছিল, জীবনে আর কোনও দিন তেমন লাগেনি। সেই তার স্বপ্নে দেখা কলকাতার সঙ্গে চোখের সামনের কলকাতাকে মিলিয়ে নিতে চেষ্টা করেছিল সে। শুধু বাড়ি—আর বাড়ি। এত বড় বড় বাড়ি। মল্লিকদের তারাপদ’র দেখা কলকাতার সঙ্গে কি তা মিলেছে? পিসীমা যদি বেঁচে থাকতো তো ভয়ে হয় তো তার ঘুমই হতো না। তার ভূতনাথ এত বড় কলকাতায় কোথায় হয় তো হারিয়ে যাবে, হয় তো গাড়ি চাপা পড়বে—সেই ভয়।
বিকেল হতে তো অনেক দেরি আছে। ভূতনাথ ঘরের দরজায় তালা লাগিয়ে আস্তে আস্তে রাস্তায় বেরুলো।
ব্রিজ সিং বন্দুক নিয়ে পাহারা দিচ্ছিলো গেট-এ। কিছু বললে না।
খোয়ার রাস্তা। এবড়ো খেবড়ো। বনমালী সরকার লেন-এ তখনও পিচ বাঁধানো হয় নি। দুপুরের নির্জন রাস্তা। রাস্তা পেরিয়ে মমাড়ের মাথায় আসতেই মনে পড়লো সেই নরহরির কথা। বুড়ো অশথ গাছটার তলায় চেয়ে দেখলে ভূতনাথ। কেউ নেই কোথাও। দেব-দেবীর সব সাজানো পড়ে আছে। ফুল বেলপাতা শুকিয়ে আমসি হয়ে গিয়েছে। নৈবিদ্যির চাল দু’একটা ছড়ানো এদিক ওদিক। কিন্তু নরহরি নেই। এবার হঠাৎ যেন ভক্তি ভরে ভূতনাথ —কোন্ দেবতাকে লক্ষ্য করে কে জানে-প্রণাম করলে। বেদীর কাছে গিয়ে দুই হাত জোড় করে প্রণাম করলে। ফতেপুরের বারোয়ারিতলার মণ্ডলচণ্ডীর কাছে যেমন প্রণাম করে কামনা করতে ভূতনাথ, তেমনি মনে মনে প্রার্থনা করলে—মঙ্গল করে মা, মঙ্গল করো। ভূতনাথের আর কোনও প্রার্থনা মনে এল না। কার মঙ্গল, কী মঙ্গল, সে প্রশ্ন নয়। সমস্ত মঙ্গল হোক। তার নিজের মঙ্গল, ব্রজরাখালের মঙ্গল—তারপদ, ভূষণ কাকা—ননী, রাধার আত্মার মঙ্গল। বিশ্ব সংসারে সকলের মঙ্গল। ওই বংশী, ওর বোন চিন্তা, ওর ছোটমা, ছোটবাবু, মধুসূদন সকলের মঙ্গল।
বড় রাস্তার ওপর যেতে ভয় করলো ভূতনাথের। টগবগ করে সেই কালকের মতো ট্রাম গাড়ি চলেছে। ঘোড়ার গাড়িওয়ালা ঘোড়াকে ছিপটি মারতে মারতে চলেছে হু হু করে। মুখে এক অদ্ভুত শব্দ করছে—উ-উ-উ-উ আবার কেউ বলছেটি-টি-টি-টি–
একটু ও-পাশে একটা বাড়িতে ঢং-ঢং করে ঘণ্টা বাজলো। ছেলেদের স্কুল। ভূতনাথ পড়লে। বেঙ্গল সেমিনারি। স্কুলের সামনে গোটাকতক কাবুলিওয়ালা অদ্ভুত ভেলভেটের কুর্তা আর ঢিলে-ঢালা সাদা পাঞ্জাবী পরে বসে আছে। বসে বসে ফল বেচছে। একটা কাপড়ের ওপর আঙুর—বেদানাবাদাম—ছড়ানো।
গঞ্জের স্কুলের কথা মনে পড়লো। সে ছিল প্রকাণ্ড খড়ের আটচালা ঘর। এমন দোতলা পাকা দালান নয়। সামনের দিকে এগিয়ে গেল ভূতনাথ। তাদের ফাস্ট ক্লাশে সংস্কৃত বই ছিল হিতোপদেশ। পড়াতেন শরৎ পণ্ডিত। লম্বা করে নস্যি নিতেন। সর্বদাই বোয়াল মাছের মতো লাল-লাল গোল চোখ। টিকিতে ফুল বাঁধা থাকতো তার। ভূতনাথ ভারি ভয় করতে তাকে। ধাতুরূপ মুখস্ত বলতে না পারলে মাথায় গাট্টা মারতে মারতে ঢিপ করে কিল বসিয়ে দিতেন পিঠে! রাগ হলে চিৎকার করে বলতেন—এই গর্ধভ—
শরৎ পণ্ডিতের অস্ত্র ছিল শুধু হাতের গাঁট্টা।
অঙ্কের মাস্টার হরনাথবাবুর অস্ত্র ছিল খাকের কলম। দুই আঙুলের মধ্যে খাকের কলমটি দিয়ে জোরে এমন টিপে ধরতেন যে মনে হতো বুঝি বিছে কামড়িয়েছে।
আর হেডমাস্টার অবনীবাবুর বেত। দারোয়ান সত্যনারায়ণ ছিল বেতের ভাড়ারি। বড়, মাঝারি, ছোট, নানা মাপের বেত সাজানো থাকতো লম্বা লম্বা বাঁশের নলের মধ্যে। চিৎকার করে অবনীবাবু ডাকতেন—আমার কেন্–
কেন মানে বেত।
অবনীবাবু বাঙলা ভাষায় বেত বলতেন না। শাস্তির গুরুত্ব বোঝাবার জন্যে বোধ হয় ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করতেন। অর্থাৎ যেন বেতের আঘাত কম, আর কেন-এর আঘাত প্রচণ্ড। সত্যনারায়ণ সব বেত গুলো এনে হাজির করতে হেডমাস্টারের সামনে।
অপরাধীর অপরাধের তারতম্য হিসেবে বেতের আকারেরও তারতম্য হতো। অর্থাৎ পরীক্ষার খাতায় বই থেকে নকল করলে বড় বেত। পেছনের বেঞ্চে বসে ব্যাঙের ডাকের নকল করলে মাঝারি বেত। আর সত্যনারায়ণের কাছ থেকে ধারে জিভে-গজা খেয়ে ধার শোধ না করলে-ছোট বেত।
পঞ্চাননের ভাগ্যে তিন রকম বেতই জুটতত।
সেই পঞ্চানন! ভূতনাথের এতদিন পরে আবার পঞ্চাননকে মনে পড়লো। একদিন হঠাৎ পুলিশে ধরে নিয়ে গেল সেই পঞ্চাননকে। ম্যাজিস্ট্রেটের বাগান থেকে ফুল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল। বিচারে জেল হয়ে গেল পঞ্চাননের তিন মাস। তারপর জেল থেকে বেরিয়ে পঞ্চানন আর গ্রামে আসেনি। কোথায় যে উধাও হয়ে গেল কেউ জানতে পারলে না।
স্কুলের সামনে যেতেই কেমন একটা হৈ-চৈ গণ্ডগোল শোনা গেল। ওদিক থেকে ছেলেরা চিৎকার করছে—আর এদিক থেকে কাবুলিওয়ালারও চিৎকার করে। কী বিকট ভাষা এদের। গোটাকতক শব্দ কেবল—কিছু মানে বোঝা যায় না। ওদিক থেকে ঢিল ছুড়তে লাগলো ছেলেরা—আর এরা কিছু না পেয়ে বড় বড় বেদানা ছুড়তে লাগলো ছেলেদের লক্ষ্য করে।
রাস্তাময় বেদানা ডালিম আঙুর নাশপাতির ছড়াছড়ি। ভিড় জমে গেল চারিদিকে। চার পাঁচটা কাবুলিওয়ালা যেন পাগলের মতো ক্ষিপ্ত হয়ে ছুটোছুটি করতে লাগলো। হাতের লম্বা লাঠিগুলো নিয়ে ঘোরাতে লাগলো। দমাদম জানালা-দরজা বন্ধ হয়ে গেল বেঙ্গল সেমিনারির। স্কুলের নাম লেখা সাইন বোর্ডখানা। টেনে নামিয়ে ভেঙে দিলে।
ভুতনাথের কেমন অবাক লাগলো—কেন হঠাৎ এই মারামারি। অথচ একটু আগেও তো কোনো কিছু ছিলো না। ছেলেরা ফল কিনছিল ওদের কাছে।
-কী হলো মশাই–কী হলো।
যে যা পারলে দুটো চারটে বেদানা কুড়িয়ে পকেটে পুরলে।
একজন বললে—ছেলেদেরই দোষ।
-কেন?
–ওরা ওদের বেইমান বলেছে।
–বেইমান! বেইমান বলা এত বড় অপরাধ! হট্টগোলের মধ্যে থেকে ভূতনাথ বেরিয়ে এল। কয়েকটা লাল চামড়ার সাহেব পুলিশ ততক্ষণ এসে পড়েছে। ভয়ে যে যেদিকে পারলে দৌড় দিলে। এখনি হয় তো লাঠি মারবে। ওরা ভয়ানক মারে। গোরাদের ক্ষমতা কি কম। এসেই চার পাঁচটা কাবুলিওয়ালাকে ধরে ফেললে। তারপর দমাদম লাথি মারতে লাগলো স্কুলের বন্ধ দরজার ওপর। রাস্তার গাড়ি ঘোড়া ট্রাম লোক-চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। হৈ হৈ কাণ্ড!
আবার বনমালী সরকার লেন-এর মধ্যে ঢুকে পড়লো ভূতনাথ। বুকটা তখনও তার দূর দূর করে কাঁপছে। বেইমান! কথাটার মানে কী!
মনে আছে বহুদিন আগে পঞ্চানন একবার হেডমাস্টার অবনী বাবুর কাছে খুব মার খেয়েছিল। দুই হাতের পাতায় তখনও লাল দাগ আছে। রাস্তায় এসে বলেছিল—এই বইগুলো একটু ধর তো—বোধ হয় জ্বর আসছে।
পঞ্চাননের কপালে হাত দিয়ে ভূতনাথ চমকে উঠেছিল। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে যেন। জ্বরের ঝোঁকে সেই রাস্তার মধ্যেই শুয়ে পড়েছিল পঞ্চানন।
মনে আছে সেই জ্বরের ঘোরেই পঞ্চানন বলেছিল—শালা হেডমাস্টারটা বেইমান।
ভূতনাথ সেদিন মানে বোঝেনি পঞ্চাননের কথাটার। বেঙ্গল সেমিনারির ছেলেদের বেইমান বলায় কাবুলিওয়ালাদের রাগের কারণটাও ভূতনাথ বুঝতে পারেনি সেদিন। কিন্তু মানে বুঝতে পেরেছিল অনেকদিন পরে, যেদিন ছোটবৌঠান বলেছিল—ভূতনাথ তুই এত বড় বেইমান–
হেডমাস্টারের বেইমানি বোঝবার বয়েস তখন হয়নি ভূতনাথের। কাবুলিওয়ালাদের বেইমানির অর্থও খুঁজে পাওয়া যায়নি সেদিন। কিন্তু ভূতনাথ যে কেমন করে বেইমান হলো সে প্রশ্ন…কিন্তু ছোটবৌঠান তো তখন অপ্রকৃতিস্থ। তাকে অবশ্য ক্ষমা করেছিল ভূতনাথ। ছোটবৌঠানকে চিনেছিল বলেই তো ভূতনাথ পরে। তাকে ক্ষমা করতে পেরেছিল।