সাহেব বিবি গোলাম (Saheb Bibi Golam) : 03
১৬৯০ সালের জব চার্নকের কলকাতা নয়। বিংশ শতাব্দীর ও শুরু হয়নি তখন। চৌধুরীদের লাইব্রেরী ঘরে সে-কলকাতার ছবি দেখেছে ভূতনাথ। করফিল্ড সাহেবের ছবির বইতে চৌরঙ্গীর সেই ছবি। ১৭৮৭ সালের চৌরঙ্গী। এর্দোপড় পুকুর চারদিকে। ছই ঢাকা গরুর গাড়ি চলেছে চৌরঙ্গী দিয়ে। লোক চলেছে উটের পিঠে চড়ে। তারই পাশাপাশি আবার সঙ্গীন উঁচু করে সৈন্যরা প্যারেড করতে করতে যাচ্ছে। এখন ভাবলে হাসি পায়।
অথচ যে-দিন ভূতনাথ শেয়ালদা স্টেশনে এসে প্রথম ট্রেন থেকে নেমেছিল—সে-শেয়ালদা’র সঙ্গে আজকের শেয়ালদা’রও কোনো মিল নেই। মনে আছে—ভূতনাথ স্টেশন থেকে বাইরে এসে বৈঠকখানা বাজারের সামনের ফুটপাথে এসে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো। ভাবতে লাগলো কোথায় কোন দিকে যাওয়া যায়। ব্ৰজরাখাল বলে দিয়েছিল-সোজা পশ্চিম দিকে যেতে। পশ্চিম দিকের রাস্তা দিয়েই চলতে লাগলো ভূতনাথ।
কিন্তু ঠিক পথেই চলেছে কিনা কে জানে। এতে লোক একসঙ্গে কখনও দেখেনি সে। ঘোড়ার গাড়ির কী বাহার। ঘোড়াগুলোর মাথার দু পাশে কানের দিকে ছোট ছোট ঝালর লাগানো। কারো কারো গলায় ঠুংঠুঙি বাজছে তালে তালে। হৈ হৈ করতে করতে ছুটেছে। একটা গাড়ি যেমন-ইচ্ছে একবার রাস্তার ডাইনে, একবার বাঁয়ে হাঁকিয়ে চলেছে। সামনে কে একজন পড়েছিল—চাবুক দিয়ে বেদম মেরে পলকের মধ্যে উধাও হয়ে গেল।
বুক কাঁপতে লাগলো ভূতনাথের। তাকেও যদি মারে কেউ। সরে এসে দাঁড়ালো রাস্তার ধারে গা ঘেঁষে।
দুটো ঘোড়ার গাড়ি টেক্কা দিতে দিতে চলেছে। ঘোড়ার লাগাম ধরে গাড়োয়ান দুটো চিৎকার করছে-উ-উ-উ-উ-
এক-একবার মনে হয় বুঝি ধাক্কা লাগলে ট্রামগাড়ির সঙ্গে। কিন্তু লাগলো না। উ-উ-উ-উ-করতে করতে গাড়োয়ান দুটো দাঁড়িয়ে উঠে চালাচ্ছে গাড়ি। কে আগে যাবে—
একদৃষ্টে ওই দিকে চেয়ে চলতে গিয়ে হঠাৎ হুড়মুড় করে পড়লো ভূতনাথ। যতো রাজ্যের জঞ্জালের পাহাড় জমে ছিল রাস্তার ওপর। একগাদা ময়লার ওপর পড়ে আবার উঠে দাঁড়ালো। সবাই দেখছে তার দিকে। ভূতনাথ মাথা নিচু করলো। সবাই হয় তত ভাবছে—নতুন কলকাতায় এসেছে। ভারি লজ্জা হলো। সকলের দৃষ্টি এড়াবার জন্যে পাশের এক গলির মধ্যে ঢুকলো সে। একটা খাবারের দোকানের সামনে গরম-গরম জিলিপী ভাজছে একটা লোক। ভূতনাথ খানিকক্ষণ দেখলে চেয়ে চেয়ে।
দোকানদার বললে—কী দেখছো গা ছেলে–?
ভূতনাথ লোকটার দিকে চেয়ে দেখলে। আদুড় গা। বড় উনুনের ওপর বিরাট একটা কড়া চাপিয়েছে। নারকোল মালার তলা দিয়ে মশলা ছাড়ছে হাতটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একিয়ে বেঁকিয়ে, আর হলদে-হলদে জিলিপীগুলো ভেসে উঠছে গরম ঘিয়ের ওপর। লোকটা আবার বললে–হাঁ করে কী দেখছে। গা ছেলে
—জিলিপী ভাজা দেখছি তোমার—বললে ভূতনাথ।
—দেখো না অমন করে জিলিপীর দিকে—যারা খাবে তাদের পেট কামড়াবে যে—সরে যাও ভাই-পয়সা আছে পকেটে?
–পয়সায় ক’টা করে—জিজ্ঞেস করলে ভূতনাথ। ক্ষিধেও পেয়েছে বেশ। খেলে হয়। এক পয়সার নিলে। চারটে করে পয়সায়। তা হোক—এ তো আর ফতেপুর নয়। কলকাতা মাগগি-গণ্ডার দেশ। বললে— আর এক পয়সার দাও তো।
খেতে খেতে ভাব হলো। ফতেপুরের পাশের গ্রাম মামারাকপুরে ভগ্নির শ্বশুর বাড়ি। লোকটা আসলে ভালো। ময়রার ছেলে। জাত-ব্যবসা ধরেছে। বললে—আমিও ভাই একদিন তোমার মতন নতুন এসেছিলুম কলকাতায়—তারপর এই ধরেছি—কে দেবে চাকরি বলো না, লেখাপড়া তো শিখিনি কিছু, তোমার মতো লেখাপড়া শিখলে দশ-বারো টাকার চাকরি একটা জুটিয়ে নিতুম ঠিক—পাঁচ টাকায় মাস চালাতুম আর পাঁচ টাকা পাঠাতুম দেশে।
পেট ভরে এক গ্লাশ জল খেলে ভূতনাথ।
লোকটা বললে—বনমালী সরকার লেন? বড়বাড়িতে যাবে— তাহলে এখান থেকে বড় রাস্তা ধরে নাক-বরাবর সোজা চলে যাও—তারপর বাঁ দিকে গিয়ে আবার ডান দিকে প্রথম যে রাস্তা পড়বে…
রাস্তার নির্দেশ পেয়ে উঠলো ভূতনাথ। বললে-তোমার নামটা।
—প্রেকাশ—আর তোমার?
—ভূতনাথ চক্রবর্তী—বামুনগাছির পঞ্চানন্দের দোর ধরে হয়েছি কিনা তাই পিসী ওই নাম রেখেছিল—পরে দেখা করবো–
সমস্ত কলকাতার মধ্যে হঠাৎ যেন একটা আশ্রয় পেয়ে গেল ভূতনাথ। ব্ৰজরাখালের ঠিকানা যদি খুঁজে না-ই পাওয়া যায় আজ, এখানে এই প্রকাশ ময়রার কাছে এসেই ওঠা যাবে। মামারাকপুরে ওর ভগ্নির বিয়ে হয়েছে—আত্মীয়ই বলা চলে। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললে ভূতনাথ। ভগবান সহায় থাকলে নরকে গিয়েও নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। কথাটা ভূষণ কাকার। সে-কথার সত্যতার প্রমাণ আজ যেন হাতে-হাতে পাওয়া গেল এই কলকাতায় এসে।
রাস্তায় চলতে-চলতে একবার মনে হলো—এখন যদি হঠাৎ ননীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। এত বড় কলকাতা শহরে খুঁজে পাওয়া অবশ্য মুশকিল। তা আজ না হোক-কাল হোক, পরশু হোক একদিন দেখা হবেই। ননীর সঙ্গে দেখা করতেই হবে।
বউবাজার স্ট্রীট দিয়ে বনমালী সরকার লেন-এ ঢুকতেই প্রকাণ্ড একটা বটগাছ। বেশ ছায়া হয়েছে চারদিকে। এইখান দিয়েই ঢুকতে হবে গলির ভেতরে।
একটা বেঁটে কালোপানা লোক গাছতলায় বসে ছিল। ডাকলে–আসো বাবু আসো–
ভূতনাথকে বাবু বলে ডাকা এই বুঝি প্রথম। মনে হলো— তার হাব-ভাব দেখে বুঝতে পেরেছে নাকি যে গ্রাম থেকে আজ নতুন এসেছে ভূতনাথ।
—তোমার বাসনা সিদ্ধ হবে বাবু, সিদ্ধ হবে–বলতে বলতে এক কাণ্ড করে বসলো লোকটা। বলা নেই কওয়া নেই, কড়ে আঙুলে সিঁদুরের ফেঁটা নিয়ে লাগিয়ে দিলে ভূতনাথের কপালে। বললে—সিদ্ধিদাতা গণেশের পায়ে কিছু প্রণামী দাও বাবু—যাত্রা শুভ হবে—মনবাঞ্ছা পূরণ হবে–
ভূতনাথ এতক্ষণে ভালো করে দেখলে। বটগাছটার তলায় অনেকখানি জায়গা জুড়ে ইটের উচু বেদী বাঁধানো। তারই ওপর নানা জানা-অজানা দেব-দেবীর মূর্তি ছড়ানো। শুধু সিদ্ধিদাতা গণেশ নয়। কালী, শিব, দুর্গা, মনসা, জগদ্ধাত্রী পুতুলের মতন মাপের সব দেবতামণ্ডলী। ফুল, বেলপাতা, সিঁদুর আর অসংখ্য
আধলা আর পয়সা ছড়ানো চার পাশে।
লোকটা আবার বলতে লাগলো—কপালে রাজটীকা আছে বাবু—অনেক পয়সা হবে—-অনেক সুখ হবে—বাবুর তিনটা বিবাহ হবে—
গড় গড় করে লোকটা অনেক সুসংবাদ শুনিয়ে গেল। হাসি পেলে ভূতনাথের। তিনটে বিয়ে। মরেছি। চাকরি-বাকরি নেই, খাওয়াবো কি। ভূতনাথ পাশ কাটিয়ে চলে আসছিল। বেলা হয়ে আসছে। স্নান নেই, খাওয়া নেই, ঘুম নেই, মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে।
—প্রণামী দাও বাবু, প্রণামী-গণেশের ফোঁটা নিলে প্রণামী দিলে না—মহাপাতক হবে—দেবতার শাপ লাগবে
বোধহয় রেগে গেল পূজারী বামুন। টাক থেকে একটা আধলা বার করে দিলে ঠাকুরের পায়ে, তারপর গড় হয়ে প্রণাম করলে বেদীতে মাথা ঠেকিয়ে। দেবতা সন্তুষ্ট হলেন কিনা কে জানে কিন্তু পূজারী বামুনের মুখ প্রসন্ন হলো।
হাতে একটা ফুল দিয়ে পূজারী বললে-বলে-নমামিহাত জোড় করে ভূতনাথও বললে—নমামি—
—সর্বসিদ্ধিদাতাঃ
–সর্বসিদ্ধিদাতাঃ
—বিনায়কং
—বিনায়কং—
আরো কী কী বলেছিল মনে নেই। লম্বা সংস্কৃত শ্লোক। ছাড়া পেয়ে ভূতনাথ গলি দিকে চলতে-চলতে বাড়ির নম্বরগুলো দেখতে লাগলো। পকেট থেকে ব্রজরাখালের চিঠিটা আর একবার বার করলে ভূতনাথ। পাঁচ নম্বর-বনমালী সরকার লেন। এক নম্বর, দু’ নম্বর করে—পাঁচ নম্বর বাড়িটা দেখেই চমকে গেল ভূতনাথ। এত বড় বাড়ি! এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত সমস্তটা ঘুরে দেখে নিলে একবার। এ-বাড়ির নম্বর যে পাঁচ, সে-সম্বন্ধে আর কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু তবু সন্দেহ হলে। এই ব্রজরাখালের বাড়ি। এখানে থাকে নাকি ব্রজরাখাল!
সামনে লোহার গেট খোলা। কিন্তু বিরাট এক যমদূতের মতো চেহারার দারোয়ান বন্দুক উচিয়ে পাহারা দিচ্ছে। বুকে মালার মতো গুলী গুলো সাজানো।
সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরে চেয়ে দেখতে ভয় হলো। বলা নেই– কওয়া নেই–অমনি ভেতরে গিয়ে ঢুকলেই হলো নাকি। বাড়িটার উল্টো দিকে অনেকগুলো বাড়ি। একটা বাড়ির সামনে ছোট এক ফালি সিমেন্ট বাঁধানো বোয়াক। বসলো সেখানে ভূতনাথ। সেই সকাল থেকে হাঁটছে। পা দুটো বুঝি ব্যথা করে না। দেয়ালে পিঠ দিয়ে হেলান দিলে একটু। বনমালী সরকার লেন খুব বড় রাস্তা নয়। ট্রাম নেই এ-রাস্তায়। তবু লোকজন চলাচল আছে খুব। আস্তে আস্তে দুপুর গড়িয়ে এল। রাস্তাটা যেন একটু নিরিবিলি হয়ে আসছে। ভূতনাথের সমস্ত শরীরটা যেন ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে এল। একবার মনে হলো ফিরে যায় সেই জিলিপীর দোকানে প্রকাশ ময়রার কাছে। একটা রাত তো থাকা যাবে তবু সেখানে। তারপর কাল তাকে সঙ্গে নিয়ে এলেই চলবে। প্রকাশ লোকটা ভালো। ভগ্নিপতির দেশের লোক শুনে জিলিপীর দাম নেয়নি।
একটা ঘড়ঘড় শব্দে ঘুম ভাঙলো ভূতনাথের। কখন সেই কঠিন রোয়াকের ওপর ঘুমিয়ে পড়েছিল মনে নেই। সামনে দিয়ে একটা গাড়ি যাচ্ছে নজরে পড়লো। ঘোড়ায় টানছে গাড়িটা। চ্যাপটা চেহারার গাড়ি। কিন্তু পেছনের একটা অসংখ্য ফুটোওয়ালা নল দিয়ে ঝিরঝির করে জল পড়ছে। ধুলোর ওপর জল ছিটিয়ে দিচ্ছে। ধুলো ওড়া বন্ধ হঝে। কিন্তু খোয়ার রাস্তার ওপর গাড়ির লোহার চাকা লাগতে কী বিকট শব্দই না হচ্ছে।
উঠলো ভূতনাথ। সেই প্রকাশের জিলিপীর দোকানেই ফিরে যেতে হবে শেষ পর্যন্ত। বামুনের ওপর ভারি ভক্তি প্রকাশের। প্রকাশ শুধু চাল আর জল দিয়ে হাঁড়ি চাপিয়ে দেবে উনুনে, আর ভাত হলে নাবিয়ে নেবে ভূতনাথ। ময়রার এটো বামুনকে খাইয়ে মহাপাতক হবে নাকি সে। যে-রাস্তা দিয়ে এসেছিল ভূতনাথ, আবার সেই রাস্তা দিয়েই চলতে হয়।
—এ কী বড়কুটুম না—
চেনা গলার আওয়াজ পেয়ে ভূতনাথ আশে-পাশে সামনে পেছনে চেয়ে দেখলে। চেনা মুখ কেউ নেই। কে তবে ডাকলে তাকে। কিন্তু সামনের গোঁফ দাড়িওয়ালা লোকটাই যে ব্ৰজরাখাল
একথা কে বলবে।
ব্ৰজরাখাল বললে—কখন এলে?
–সকাল বেলা। বললে ভূতনাথ।
-–আচ্ছা মুশকিল তো, সেই সকাল থেকে এই বিকেল পর্যন্ত রাস্তায় কাটিয়েছে। নাকি? কী কাণ্ড দেখোদিকিনি—একটা চিঠি দিতে হয় তো আসবার আগে কিছু খাওয়া-দাওয়া হয়নি বোধহয়
সারাদিন হরিমটর—কপালে কী?
ভূতনাথ কপালে হাত দিয়ে মুছতেই হাতের পাতায় সিঁদুর লেগে গেল। বললে—গণেশের ফোটা
–ওই নরহরি দিয়েছে বুঝি——দেখোদিকিনি, ঠিক টের পেয়েছে, তুমি নতুন এসেছে। গা থেকে—চলল—এখন আমার সঙ্গে যদি দেখা না হতে-টানতে টানতে নিয়ে এল ব্রজরাখাল বাড়ির ভেতর।
ব্রিজ সিং আপত্তি করলে না। ব্ৰজরাখাল ভূতনাথকে নিয়ে সোজা ভেতরে ঢুকলো। বিরাট বাড়ি। কোথায় কোন্ দিকে কে থাকে, কোথায় রান্না হয়, কে কোথায় খায়। অসংখ্য লোক ঘোরাফেরা করছে। কেন করছে কেউ বলতে পারে না।
ব্রজরাখাল সোজা চললো সামনে। আসল বড় বাড়িটা ডানদিকে রেখে, পেছনের পুব-পশ্চিম বরাবর লম্বা বাড়িটার নিচে এসে দাঁড়ালো। একতলায় সার-সার তিনটে পাল্কি। তারপর ঘোড়ার গাড়ি। তার ওপাশে কয়েকটা ঘোড়া। মুখের দু’পাশে দড়ি দিয়ে বাঁধা। ঘোড়াগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শক্ত ইটের মেঝের ওপর ঘন ঘন পা ঠুকছে। তারই পাশ দিয়ে সরু সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে ব্রজরাখালের পেছনে ভূতনাথ চললো।
ওপরে ডানদিকে সার-সার ঘর। চাকর-বাকর ঘোরা ফেরা করছে। মেঝের ওপর ময়লা বিছানা গোটানো পড়ে রয়েছে পর পর। নাথু সিং তখন নিজের ঘরে লেঙটু পরে পেতলের থালায় একতাল আটা মাখছে।
সব পার হয়ে পুবদিকের একেবারে শেষ ঘরটায় এসে দরজার তালা খুললো ব্রজরাখাল। ঘরে ঢুকে বললে—এই হলো আমার ঘর—আর এর পাশের ঘরটাও তোমায় দেখাই চলো—বলে পাশের আর একটা ঘর খুললে।–এটাও আমারই, কিন্তু আমার আর কে আছে বলো—খালিই পড়ে থাকে—যতো রাজ্যের জঞ্জাল জমে আছে–তুমিই না হয় এ-ঘরটায় থেকো
তারপর বললে— বিছানা-টিছানা তো কিছু আনননি দেখছি –তাতে কিছু অসুবিধে হবে না, কিন্তু তুমি হলে আবার বড়কুটুম কিনা, একটু খাতির-যত্ন না করলে নিন্দে হবে— কী বলো–
ব্ৰজরাখাল নিজের তোষক বিছানা পেতে দিলে ভূতনাথের জন্যে। বললে—আমার জন্যে তুমি ভেবো না, আমি সন্নিসী মানুষ—আমার ও-সব কিছু লাগে না।
সত্যিই বজ্ররাখাল সন্ন্যাসী মানুষ। আপিসের ধুতি আলপাকার কোট খুলে একটা গেরুয়া রং-এর ছোট ফতুয়া পরলে। আর গেরুয়া ধুতি-কাছা কোঁচাহীন। ভূতনাথের এতক্ষণে নজরে পড়লো—দেয়ালের গায়ে একটা মস্ত বড় সাধুর ছবি। ফুলের মালা ঝুলছে ছবির গায়ে। নিচে কুলুঙ্গীর ওপর কয়েকটা বই–অনেকটা গীতার মতন চেহারা। ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলেও কার ছবি ব্রজরাখাল?
—প্রণাম করে ওঁকে—বলে ব্রজরাখাল নিজেই আগে সভক্তি প্রণাম করলে। তারপর মাথা তুলে বললে—আমার গুরুদেবপরমহংসদেব—এখন দেহরক্ষা করেছেন
খানিক থেমে বললে–সারাদিনটাতো উপোষ-আজ রাত্রে কী খাবে বলো তো বড়কুটুম—আমি তের মাছ মাংস খাইনে—অড়র ডাল ভাতে দিয়ে দেবো’খন—আর গাওয়া ঘি আছে ব্রিজ সিং-এর দেশ থেকে আনা-সঙ্গে একটু আলুর দম করি, কী বলো–
ভূতনাথের মনে আছে সেই বিকেলবেলা ব্রজরাখাল নিজের হাতে উনুনে আগুন দিয়ে ভাত চড়িয়ে দিলে। তারপর এক ঘণ্টার মধ্যে রান্না সেরে, খাওয়া-দাওয়া করে নিয়ে বললে—এইবার শুয়ে পড়ো আরাম করে—আমি ততক্ষণ ছেলেদের পড়িয়ে আসি–
ব্ৰজরাখাল ধুতি চাদর পরে ছেলে পড়াতে গেল। ভূতনাথ নিজের বিছানায় শুয়ে আবোল-তাবোল নানা কথা ভাবতে লাগলো সেদিনকার সেই ব্ৰজরাখাল-বর-বেশী ব্ৰজরাখাল—এ হঠাৎ এমন অন্য মানুষ হয়ে গিয়েছে যেন। মাছ-মাংস খায় না। কোন সাধুর শিষ্য! কোথাকার পরমহংসদেব। কে তিনি? কেনই বা এই চাকরি করছে সে? কার জন্যে? ঘুমের মধ্যে কত রকম শব্দ কানে আসতে লাগলো। একতলায় ঘোড়াগুলো শক্ত সিমেন্টের মেঝের ওপর পা ঠুকছে। গেটের ঘড়িঘরে ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজছে। আশে পাশের ঘর থেকে চাকর-বাকরদের হাঁক-ডাক শোনা যায়। কোথা থেকে যেন কালোয়াতী গানের সুর ভেসে আসছে। ইমনকল্যাণের খেয়াল। সঙ্গে তবলা। রাত বাড়তে লাগলো। রাধার কথা মনে পড়লো। এ-সংসার তো তারই। কপালে নেই তার। হয় তো রাধা মরে গিয়েছে বলেই ব্রজরাখালের এই বৈরাগ্য।…ননীর সঙ্গে দেখা করলে হয় একবার। খুব চমকে যাবে। ননী কোন কলেজে ভর্তি হয়েছে কে জানে। প্রকাশ ময়রা জিলিপী ভাজতে জানে বটে। জিলিপী করা কি যার-তার কাজ। অমন পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে…কিন্তু গো-ব্রাহ্মণে ভক্তি আছে বটে প্রকাশের। এই বাজারে দুটো পয়সা কে ছাড়ে অমন!…অনেক রাত্রে ঘুমের মধ্যে মনে হলো যেন গেট খোলার শব্দ হলো। ঘোড়ার পায়ের টগবগ শব্দ–একটা গাড়ি যেন এসে দাঁড়ালো নিচের একতলায়। লোকজনের কথাবার্তা। চাকরদের ছুটোছুটি।
কেমন যেন ভয় করতে লাগলো ভূতনাথের। নতুন জায়গা, নতুন বিছানা। তার মধ্যে যেন কেমন একটা অসহ্য অস্বস্তিতে বিছানা ছেড়ে উঠলো। যেন গলা শুকিয়ে এসেছে। ডাকবে নাকি ব্ৰজরাখালকে। বাইরে ফুটফুটে জ্যোৎস্না। ঘরের ভেতরে চাঁদের আলো এসে পড়েছে। মনে পড়ে গেল ফতেপুরের কথা। কাল এই সময় সে ছিল ফতেপুরে আর আজ এই কলকাতায়। ফতেপুরের আকাশেও এমনি চাঁদের আলো এখন। গাঙের ধারে কুঁচগাছের ঝোপে জঙ্গলে আচমকা ছাতার পাখীর পাখা-ঝাপটানির শব্দ হচ্ছে। মাঝরাত থাকতেই হর গয়লানীর মেয়ে বিন্দী উঠেছে মল্লিকদের বাগানে আম কুড়োতে। মালোপাড়ায় বেহুলার ভাসান গানের ঢোলের আওয়াজ অস্পষ্ট ভেসে আসছে। কত দেশ কত বিচিত্র মানুষ—এক দেশের সঙ্গে আর এক দেশের মিল নেই—কিন্তু আকাশ একটা যে-আকাশ কলকাতার মাথায় —সে-আকাশ ফতেপুরের মাথাতে—সে-আকাশ সর্বত্র। এক শ’ বছর আগেও এই আকাশ ছিল—এক শ’ বছর পরেও থাকবে…
ভূষণ কাকা বলতো—তুই থাম তো ভূতে—যতে সব বিদঘুটে বিদঘুটে ভাবনা–
মল্লিকদের তারাপদ বলতো—ও বোধহয় বড় হয়ে কবি হবে কাকা—মধু কামারের মতো পালা-যাত্রার গান বাঁধবে—
কবি ভূতনাথ হয়নি। হয়েছে শেষ পর্যন্ত ওভারসিয়ার! কিন্তু সে-সব কথা যাক, সেই মাঝরাত্রে ভূতনাথ ডাকতে লাগলো–ব্ৰজরাখাল—ও ব্রজরাখাল–ও শব্দটা কিসের। উত্তর নেই। মাঝখানের দরজাটা ভেজানো ছিলো। সেটা খুলতেই ভূতনাথ অবাক হয়ে দেখলে ঘরের মাঝখানে যোগাসনে বসে আছে ব্রজরাখাল। আবছা আলো-অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা যায় না—কিন্তু মনে হলো ব্রজরাখাল যেন তন্ময় হয়ে আছে কোন দুশ্চর তপস্যায়। বাহ্যজ্ঞানশূন্য। সামনের দেয়ালে সেই সাধুর ছবিটা ঝুলছে। শিরদাঁড়া সোজা-চোখ দুটিও বোজা-শরীরে প্রাণস্পন্দনের লেশমাত্রও নেই বুঝি। ভূতনাথ আবার ডাকলে—ব্রজরাখালএবারও উত্তর নেই। ভূতনাথের মনে হলো—ব্রজরাখাল এখন যেন আর সামান্য ব্রজের রাখাল নয়, মথুরায় গিয়ে রাজা হয়ে বসেছে—রাধার নাগালের বাইরে ফতেপুরের নলজ্যাঠার এগারো বছর বয়সের সেই নগণ্য মেয়ে রাধা!