Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সাহেব বিবি গোলাম || Bimal Mitra » Page 23

সাহেব বিবি গোলাম || Bimal Mitra

শহর তখন নিঝুম। কিন্তু বড়বাড়ি তখনও সরগরম। ছুটুক–বাবুর আসরে বুঝি অনেকদিন পরে আবার গানের আসর বসেছে। আজকাল সব দিন আসর বসে না। আস্তাবলের ভেতর অনেক গাড়ি-ঘোড়ার মধ্যে ছোটবাবুর ঘোড়া দুটোও আজ পা ঠুকছে। শুধু মেজবাবু নিত্যকার মতো বাইরে গিয়েছেন মোসায়েবদের নিয়ে। তোষাখানায় চাকরদের তাস-পাশা-দাবার আড়ার শব্দ। খাজাঞ্চীখানার দরজায় একটা পাঁচসেরি ওজনের ভারী তালা ঝুলছে। ইব্রাহিমের ঘরের কোণে রেড়ির তেলের বাতিটা থেকে এক ফালি তেরছা আলো এসে পড়েছে শানবাঁধানো উঠোনের ওপর। বড়বাড়িতে সব ঘরে ইলেকটিক আলো জ্বলে আজকাল। তবু রেড়ির তেলের বাতিটা তুলে নেবার কথা কারো মনে আসেনি। বদরিকাবাবুর ঘর থেকে জানালার ফুটো দিয়ে ক্ষীণ আলো দেখা যায়। আর দেখা যায় এখান থেকে একেবারে বারান্দার ধারে ব্রজরাখালের ঘরখানা অন্ধকার নিস্তব্ধ নির্জীব। জীবনে ওই একটিমাত্র মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ-পরিচয়ে এসেছে ভূতনাথ। এই কলকাতা শহরে যে-লোকটা শিরদাঁড়া সোজা করে হাঁটতে জানে। আর সেই লোকটাই আজ হারিয়ে গিয়েছে।

পাশ দিয়ে শ্যামসুন্দর যাচ্ছিলো। ভূতনাথকে দেখেই থামলো। ডাকলে—শালাবাবু।

–আমাকে ডাকছিস?

—আপনার একটা চিঠি।

—কোথায় চিঠি?

—মধুসূদনকাকার কাছে আছে, আপনাকে দেবে।

–কা’র চিঠি, ডাকপিওন দিয়ে গেল?

—তা জানিনে—বলে শ্যামসুন্দর নিজের কাজে চলে গেল।

ভূতনাথ একবার দাঁড়ালো। কা’র চিঠি হতে পারে। নিশ্চয়ই ব্ৰজরাখালের। কদিন থেকেই আশা করছিল চিঠির। অন্তত একটা খবর তো দেবে! তেমন মানুষ তো ব্রজরাখাল নয়। কাজের লোক বটে। কিন্তু ব্ৰজরাখাল নেই, আর তার পরিচয়সুবোদেই থাকা এ-বাড়িতে। ব্রজরাখালের অনুপস্থিতিতে কতদিন আর এখানে থাকা যায়। লোকেই বা কী বলবে। আজকাল—সেই চোট লাগার পর এ-বাড়িতে পাল্কি করে আসার পর থেকে ভাত-তরকারি আসে তার রান্নাবাড়ি থেকে। কিন্তু তারও তো একটা সীমা আছে। খাজাঞ্চীখানার খাতায় বিধু সরকার প্রত্যেকটি জিনিষের হিসেব রাখে। একদিন দেখতে পেলে হয়তো বলবে—কে তুমি? কোন্ তরফের লোক? নাম কি তোমার? কোন্ খাতায় তোমার নাম? রান্নাবাড়ি না বারবাড়ি না দেউড়ি না তোষাখানা না…

বিধু সরকারের হিসেবের বাড়তি লোক সে। হিসেবের বাইরে এখন সে। এতদিন সে যে ধরেনি কেন, এইটেই আশ্চর্য!

যারই চিঠি হোক সে পরে দেখলেই হবে। এখন আর সময় নেই। ভূতনাথ অন্ধকার পেরিয়ে সেই দক্ষিণের চোরকুইরির বারান্দা দিয়ে আবার গিয়ে হাজির হলো মুখোমুখি। ভেতরে যথারীতি রোজকার মতো আলো জ্বলছে। ছোটবৌঠান বালিশে মুখ গুজে শুয়ে ছিল। বেড়া খোঁপাটা এলিয়ে পড়েছে। ঘাড়ের ওপর বিছে হারটা ইলেকটি ক আলোয় চিক চিক করছে। ওদিকে যশোদাদুলালের সামনে দু’চারটে ধূপকাঠি জ্বলে জ্বলে নিঃশেষ হবার মত। আলমারির ভেতরের সেই পুতুলটা যেন কটাক্ষ করলো আবার। চিন্তাকে আশে পাশে কোথাও দেখা গেল না। ভূতনাথ দরজার চৌকাঠের ওপর দাঁড়িয়ে ডাকলো—বৌঠান?

এক নিমেষে চমকে-ওঠা হরিণীর মতন ঘাড় বেঁকিয়ে দেখেই উঠে পড়লো ছোটবৌঠান। তারপর কাপড়টা গুছিয়ে বললে— কে, ভূতনাথ? এনেছো? তারপর সামনে এসে বললে-দাও।

ভূতনাথ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

ছোটবৌঠান আবার বললে—কই, দাও দেখি।

ভূতনাথ এবার স্পষ্ট করে জবাব দিলে—আনিনি।

—আনননি? কেন? দোকান খোলা পেলে না?

–দোকান পর্যন্ত যাইনি।

—কেন? পটেশ্বরী বৌঠানের আর বিস্ময়ের সীমা নেই।

ভূতনাথ বললে—আমি আনতে পারবো না বৌঠান, এই তোমার টাকা ফেরৎ নাও-ও-বিষ আমি আনতে পারবো না।

বৌঠান এবার শক্ত হয়ে দাঁড়ালো। তাকালো ভালো করে ভূতনাথের মুখের দিকে। বললে—তুমি আনতে পারবে না তাহলে?

ভূতনাথ বললে–তুমি আমাকে আনতে বোলো না বৌঠান।

-কেন ভূতনাথ, কী হলো হঠাৎ তোমার?

ছোটবৌঠান এবার ভূতনাথেব দুটো হাত ধরে বললে—আচ্ছা পাগল যা হোক, কেউ কিছু বলেছে নাকি শুনি?

ভূতনাথ কেমন যেন নরম হয়ে এল। মনে হলো, এক্ষুণি সে বুঝি কেঁদে ফেলবে। বললে—কেন তুমি খেতে যাবে ওই ছাই-পাশ-ও বুঝি কোনো মানুষ খায়? লক্ষ্মীছাড়ারাই কেবল ওই সব খায় যে।

ছোটবৌঠান বললে–কেন, এ-বাড়ির ছোটকর্তা তত খায়— কেউ না খেলে ওদের দোকান চলে কী করে?

–যে-খায় সে-খায়, কিন্তু তুমি খেতে পাবে না, তোমাকে আমি খেতে দেবো না–কিছুতেই। ওগুলো খেয়ে তুমি বাঁচবে না।

ছোটবৌঠান এবার খিল খিল করে হেসে উঠলো। বললে–মরাই আমার ভালো ভূতনাথ, স্বামী যার দিকে ফিরে দেখে না, তার বেঁচে থেকে লাভ কী! তবু একবার দেখি না আমার ফেরাতে পারি কি না। মহাভারতে পড়েছি, সেকালের সতীরা কত কী করেছে—কলাবতী, মাদ্রী, লোপামুদ্রা, তাদের মতো হতে চাইছি না, কিন্তু স্বামীর কথা একবার শুনেই দেখি না! ও-খেলে তো কেউ মরে না।

ভূতনাথ হঠাৎ বললে—মরতে তোমার বড় সাধ, না বৌঠান?

ছোটবৌঠান বললে—না ভাই, বরং ঠিক তার উল্টো, আমার মতো এমন করে কেউ বাঁচতে চায় না সংসারে, তবে স্বামীর জন্যে মরতেও আমার আপত্তি নেই কিন্তু এই না-বাচা, না-মরা অবস্থা আমি আর সহ্য করতে পারছি না ভূতনাথ।

—কিন্তু এতেও যদি ছোটকর্তার মতিগতি না ফেরে, তখন?… তখন কী করবে বৌঠান?

ছোটবৌঠান বললে—তখন তোমার ভয় নেই ভূতনাথ–তোমায় দোষ দেবে না তা বলে—কাউকেই দোষী করবো না, আমার কপালেরই দোষ বলে মানবব…কিন্তু সে কথা থাক, আমার জন্যে তোমার এত মাথাব্যথা করতে হবে না। এ-বাড়িতে একটা ঘোড়ার জন্যেও ভাববার লোক আছে, কিন্তু বউ বড় সস্তা, বউ মরলে বউ আসবে, কিন্তু ঘোড়া মরলে ঘোড়া কিনতে পয়সা লাগে যে।

–তবে একটা কথা দাও বোঠান, মদ তুমি বেশি খাবে না।

—তা কি হয়, ছোটকর্তা যত খেতে বলবে তত খাবো, আমি যে কথা দিয়েছি, যা বলবে ছোটকর্তা, সব করবো।

ভূতনাথ খানিক থেমে বললে কিন্তু ছি, এমন কথা কেন দিতে গেলে তুমি?

ছোটবৌঠান হেসে উঠলো। গলা নিচু করে বললে তুমি আমায় খুব ভালোবাসো, না ভূতনাথ!

লজ্জায় ভূতনাথের কান দুটো বেগুনি হয়ে উঠলো। ঝা ঝা করে উঠলো মাথাটা এক নিমেষে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ দুটো নামিয়ে নিলে। খানিকক্ষণের মধ্যে মাথা তুলতে পারলো না সে।

ছোটবৌঠান কিন্তু অপ্রস্তুত হয়নি একটুও। বললে—পরস্ত্রীকে ভালোবাসা পাপ-তা জানো তো।

ভূতনাথ একবার প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলো।

ছোটবৌঠান আবার বললে—তা যদি সত্যিই ভালোবাসে। আমাকে—তত ওটা নিয়ে এসো। যদি নিয়ে আসতে পারে আজ রাত্রে তো বুঝবো সত্যিই ভূতনাথ আমাকে ভালোবাসে।

এ-কথার পর ভূতনাথ আর একমুহূর্তও দাঁড়ায়নি সেখানে।

সেদিন বংশীকে নিয়ে সেই রাত্রেই শেষ পর্যন্ত মদ কিনে নিয়ে এসেছিল ভূতনাথ। যে-হাতে একদিন ‘মোহিনী-সিঁদুর এনে দিয়েছিল বৌঠানের হাতে, সেই হাতেই এনে দিয়েছিল মদের বোতল। আজ অবশ্য অনুতাপ হয় সেজন্য। এত বছর পরে অবশ্য অনুতাপের কোনো অর্থ হয় না। কিন্তু সেদিন সে তা না দিলে বড়বাড়ির ইতিহাস হয় তো অন্য রকম হতো। কিন্তু তা হোক, ছোটবাবু তো ফিরেছিল। ফিরেছিল তার মতিগতি! এতদিন পরে সেইটেই শুধু ভূতনাথের সান্ত্বনা!

তোষাখানার সর্দার মধুসূদন বললে—এই নিন শালাবাবু আপনার চিঠি—কাল থেকে পড়ে আছে।

চিঠি খুলে কিন্তু অবাক হয়ে গিয়েছিল ভূতনাথ। চিঠি লিখেছেন সুবিনয়বাবু। মোহিনী-সিঁদুরের মালিক। আলোটার তলায় এসে অত রাত্রেই পড়ে দেখলে।

সুবিনয়বাবু লিখেছেন–

ব্ৰহ্ম কৃপাহি কেবলম্‌–

সুচরিতে,

শুভানুধ্যায় বিজ্ঞাপনঞ্চ বিধায়–

পরে ভূতনাথবাবু, প্রেমময় ঈশ্বরের কৃপায় তুমি এতদিনে নিশ্চয় আরোগ্য লাভ করিয়াছ। তুমি যথাসত্বর আমার সহিত একবার দেখা করিবে। বিশেষ প্রয়োজন বিধায় পত্র লিখিলাম। আমার বড় দুঃসময় যাইতেছে। আমি পাপী, অপদার্থ, আমি অনুতাপ অনলে নিরন্তর দগ্ধ হইতেছি। তুমি আসিলে কথঞ্চিত শান্তি পাইব। ইতি সত্যং জ্ঞানমনন্তং–

নিবেদক,

শ্ৰী……

অত রাতে আর ‘মোহিনী-সিঁদুরে’র আপিসে যাবার উপায় নেই তখন। কিন্তু রাতটা যেন একরকম জেগেই কাটালো ভূতনাথ। হঠাৎ আধো ঘুমের মধ্যে যেন তন্দ্রা ছুটে যায়। যেন সে বিছানায় শুয়ে নেই। যেন সে ছোটবৌঠানের ঘরে গিয়েছে। পাশাপাশি বসে আছে তারা। চিন্তাকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে বোঠান। অনেক গল্প করছে দুজনে। বৌঠান বলছে—“তুমি আমাকে অত ভালোবাসো কেন ভূতনাথ’। বৌঠানের শাদা চোখের ভেতর দুটো কালো কুচকুচে তারা। তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। ঠোট দুটো একটা আর একটাকে দাত দিয়ে কামড়ায়। ঠিক দু’ কানের নিচে ঘাড়ের দিকের কয়েকটা চুল উড়ে এসে সামনে পড়েছে। বৌঠান তেমনিভাবে চেয়ে বললে—“আমি যদি মদ খাই—তাতে তোমার কি এসে যায়—আমি তোমার কে বলো না যে, আমায় তুমি বারণ করছে। অসম্পূর্ণ কথার সব টুকরো। ঘুমের ঘোরের মধ্যেই যেন স্পষ্ট দেখতে পেলে ছোটবৌঠানকে। হঠাৎ বৌঠান বোতলটা কাত করে ঢালতে গেল।

ভূতনাথ খপ করে বৌঠানের চুড়িসুদ্ধ হাতটা ধরে ফেলেছে।–তুমি আবার খাচ্ছে বৌঠান?

বৌঠান একবার কঠিন দৃষ্টি দিয়ে তাকালো ভূতনাথের দিকে। বললে—হাত ছেড়ে দাও বলছি!

—এই তো খেলে, আবার খাচ্ছো কেন?

ছোটবৌঠান সে-কথার জবাব না দিয়ে বললে—তুমি এবার যাও ভূতনাথ—তুমি এবার যাও—অনেক রাত হয়ে গেল।

—আগে বলো, আর খাবে না।

ছোটবৌঠান বললে—একটু অভ্যেস করে নিই। একটু একটু অভ্যেস না করলে যে হেরে যাবো ছোটকর্তার কাছে—কিন্তু বডেড়া ঝাঁঝ ভূতনাথ।

ভূতনাথ দেখলে—বৌঠান গেলাশটা নিয়ে অতি সঙ্কোচে যেন একবার জিভে ছোঁয়ালো। ছোঁয়াতেই গেলাশটা সরিয়ে নিলে। মুখটা কেমন বিকৃত হয়ে উঠলো। বড় ঝাঝ বুঝি। তারপর আর একবার ছোঁয়ালে জিভে। এবার সবটা। তারপর সমস্ত শরীরটা যেন কেমন শিউরে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে একটা পান মুখে পুরে দিলে। দরদর করে ঘাম ঝরছে সারা শরীরে। লাল হয়ে উঠলো। সারা মুখখানা। একটা আবেগ ছড়িয়ে পড়লো সর্বাঙ্গে।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে কেমন লাগছে এখন?

ছোটবৌঠানের চোখ দুটো স্তিমিত হয়ে এল। শুধু একবার বললে—বড় জ্বালা করছে—আর একটু বরফ-জল দাও তো ভূতনাথ।

ভূতনাথ জল গড়িয়ে দিলে গেলাশে।

জল খেয়ে বৌঠান বললে—আমার ঠাকুরমা’র যিনি মা ছিলেন ভূতনাথ, শুনেছি, তিনি সহমরণে গিয়েছিলেন, মহা ঘটা হয়েছিল সে-সময়ে, তিনি নাকি হাসতে হাঁসতে চিতায় উঠেছিলেন, তার হাতে-পায়ে দড়ি বাঁধতে হয়নি, দেশের লোক ধন্য ধন্য করেছিল—আর আমিও আজ সহমরণে যাচ্ছি ভূতনাথ—দেখো আমি মরলেও ধন্য ধন্য পড়ে যাবে।

হঠাৎ ভূতনাথ হাত দিয়ে ছোটবৌঠানের মুখ চাপা দিয়ে দিলে–মরা ছাড়া তোমার কথা নেই মুখে।

কিন্তু সেই মুহূর্তেই কী যে কাণ্ড ঘটে গেল। ছোটবৌঠান নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে এক চড় বসিয়ে দিলে। কোমল হাতের চড়! কিন্তু চড়টা ভূতনাথের গালের ওপর ফেটে চৌচির হয়ে গেল।

চিৎকার করে উঠলো বৌঠান-যাও, বেরিয়ে যাও—এখনি আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যাও।

এক মুহূর্তের মধ্যে ঘটনা-বিপর্যয়ে যেন স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছে ভূতনাথ। হঠাৎ মনে হলো যেন ছোটকর্তার জুতোর আওয়াজ কানে এল। আর দাঁড়ানো যায় না। ভূতনাথ ভয় পেয়ে গিয়েছে। এখনি ছোটকর্তা এসে ঘরে ঢুকবে। ভূতনাথ পেছন ফিরে এক নিমেষে চোরের মতো নিঃশব্দে সবার অলক্ষ্যে পালিয়ে এসেছে। শুধু মনে হলো তার এই ভয় পাওয়া দেখে যেন হেসে উঠলো বোঠান। প্রচণ্ড হাসি। সে-হাসি আর থামতে চায় না। পাগলের মতো, মাতালের মতো বৌঠান ঘর ফাটিয়ে হাসছে!

আর তারপরেই আচমকা ঘুমটা ভেঙে গেল ভূতনাথের। প্রথমটা যেন ঠিক বোঝা গেল না। তারপর জ্ঞান হলে বোঝ গেল, ভূতনাথ তার ছোট চোরকুঠুরিতেই শুয়ে আছে। আর তারপরেই খেয়াল হলো—কে যেন দুমদাম শব্দ করে দরজা ঠেলছে অনেকক্ষণ ধরে। ধড়ফড় করে লাফিয়ে উঠে দরজা খুলতেই দেখা গেল বংশীকে। বংশী একা নয়। সঙ্গে একজন চীনেম্যান, আর একজন নুরওয়ালা লোক। মনে হয় মুসলমান।

বংশী বললে—কী ঘুম আপনার শালাবাবু-কত বেলা হয়ে গেল, কতক্ষণ ধরে দরজা ঠেলছি!

ভূতনাথ যেন একটু লজ্জায় পড়লো। চারদিকে বেশ কড়া রোদ উঠে গিয়েছে। ছোটঘর বলে বিশেষ কিছু বোঝা যায়নি।

বংশী তখন চীনেম্যানকে বললে—হাঁ করে দেখছো কি সাহেব এই পায়ের মাপ নিয়ে নাও।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—কী ব্যাপার আবার?

—আপনার পায়ের মাপ নিতে হবে, ছোটমা’র হুকুম—ছুটুকবাবুর বিয়েতে বাড়িসুদ্ধ লোকের পায়ের মাপ নিতে হচ্ছে যে।

চীনেম্যান পায়ের মাপ নেবার পর বংশী পাশের লোকটিকে বললে—খলিফা সাহেব, এবার তুমি এগিয়ে এসো, দেরি করে না বাপু আবার, একটা কামিজ আর একটা কোট—আমার ওদিকে আবার অনেক কাজ পড়ে রয়েছে। ছোটবাবু আবার আজ বাড়িতে রয়েছে।

মাপ নেওয়া হলো। চীনে মুচি আর ওস্তাগর চলে গেল।

ভূতনাথ ডাকলে–ও বংশী, শোন ইদিকে?

বংশী এল। বড় শশব্যস্ত।

—কী ব্যাপার বল তো? আমার এ-সব কেন?

—আজ্ঞে, এই যে রেওয়াজ, বাড়িসুদ্ধ সবার হচ্ছে আর আপনার হবে না? ভৈরববাবু, মতিবাবু, তারকবাবু, ওঁয়ারা সব এ-বাড়ির কে বলুন না, ওঁদেরও হলো, আর শুধু ওঁদেরই নাকি? ওঁদের ছেলে নাতি সবাই সক্কাল বেলা এসে গায়ের পায়ের মাপ দিয়ে গেল যে—তাই তো ছোটমা বলে পাঠালে

—ছোটমা নিজে বলেছে?

—তা ছোটমা নিজে বলবে না তো কি মেজমা বলেছে। মেজম’র বয়ে গিয়েছে।

কেমন যেন অবাক লাগলো ভূতনাথের। এ ক’দিন এখানে থাকতেই খারাপ লাগছিলো তার। যেন অনধিকার প্রবেশ করেছে সে এ-বাড়িতে। কোন্ দিন খাজাঞ্চীখানার বিধু সরকার না…

ভূতনাথ বললে—অথচ আমি ভাবছিলাম কোন্ দিন সরকার মশাই হয় তো কী বলে বসবে আবার, ভাবছিলাম ব্ৰজরাখাল নেই, আমি এখানে আছি, অন্নধ্বংস করছি—

বংশী বললে—সে-কথাও হয়ে গিয়েছে।

–হয়েছে নাকি সে-কথা?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। হয়েছে বৈকি! মেজমা’র ছেলেরা এখন মামার বাড়ি গিয়েছে, পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে, তাই ছুটি—তারা ফিরে এলে আপনিই পড়াতে শুরু করে দেবেন।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—আচ্ছা, সে ছেলেদের কই একদিনও তো দেখতে পেলাম না থাকে কোথায়?

–তারা আজ্ঞে, বেশির ভাগই তো মামার বাড়িতে থাকে, লেখাপড়া যা হয়, তা খুব জানি, গাড়ি করে স্কুলে যেতে দেখেন নি, তা আপনি তো ভোর বেলাই আপিসে চলে যান, আর আসেন সন্ধ্যেবেলা—দেখবেন কখন? সন্ধ্যেবেলা তারা বাড়ির ভেতর নিজেদের ঝি-এর কাছে থাকে—তা বিধু সরকারকে আপনার অত ভয় কি?

তারপর শশব্যস্ত হয়ে বললে—আমি এখন যাই শালাবাবুছোটবাবু বাড়িতে আছে আজ।

-তাই নাকি? ছোটকর্তা কোন্ ঘরে শুয়েছিল কাল রাতে?

—কেন, ছোটমা’র ঘরে। রাত্রে গিয়ে ছোটবাবুকে আমি ছোটমা’র ঘরে পৌঁছে দিলাম আজ্ঞে—যা-ই বলুন আপনার ‘মোহিনী-সিঁদুরে’র ফল আছে বলতে হবে কিন্তুক।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress