সাহেব বিবি গোলাম (Saheb Bibi Golam) : 16
সেদিন আবার।
রাত হয়েছে বেশ। সেদিনও রাত্রে যথারীতি অন্দরমহলের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে সোজা তেতলায়। আগে আগে বংশী পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পেছনে ভূতনাথ। সদুর ঘরে তখনও টিম টিম করে আলো জ্বলছে। তরকারি কোটা শেষ করে তখন জানালার ধারে বসে পান সাজছে সদু। যদুর মা অত রাতেও একমনে শিল-নোড়া নিয়ে বাটনা বেটে চলেছে। সদু পান সাজে আর বক বক করে বকে চলে—শীতের মরণ, শীতের ছিরিছাঁদ নেই, একটু তেল নেই যে পায়ে দিই মা, পা ফেটে একেবারে অক্ত বেরোচ্ছে গা, ভোলার বাপ থাকতে পায়ের কি এই দশা ছিল? মিনসে মোল আর কপাল পুড়লো আমার—মিনসে মরেচে তত হাড় জুড়িয়েছে, কিন্তু একটা মরা-হাজা ছেলে তাকেও সঙ্গে নিয়ে গেল গা মিনসে বলতো-ফুলবউ—তিভুবনে কেউ কারো নয়।
দোতলার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই বাঁ দিকে কর্তাদের শোবার ঘর। এখন অন্ধকার। বারান্দায় মাদুর পেতে বসে বেণী তখন একমনে মেজবাবুর কাপড় কোঁচাচ্ছে। তারপর দোতলা আর অন্দরমহলের তেতলার মধ্যেকার পোলটা পেরিয়ে ওধারে যেতে হবে।
বংশী বললে—এখানে একটু দাঁড়ান শালাবাবু—দেখি বড়মা এখন রাস্তায় আছে কিনা।
ভাগ্য ভালো বলতে হবে। বড়বো তখন নিজের ঘরে। বংশী ফিরে এসে বললে—আসুন।
একেবারে বরাবর ছোটমা’র ঘর। বংশী ভেতরে ঢুকে খবর দিলে। চিন্তা বেরিয়ে এল।
—যান, ভেতরে যান।
সেদিনও বৌঠানকে যেমন দেখেছিল ভূতনাথ, আজও তেমনি। তেমনিই অবিসম্বাদী রূপ। তবু অনেক না পাওয়ার প্রাচুর্য যেন অনেক পাওয়াকে ম্লান করে দিয়েছে। হয় তো বৌঠানের ইতিহাস শোনা ছিল বলেই এ-কথা মনে হলো ভূতনাথের। কিন্তু হঠাৎ দেখলে বুঝি মনে হতো ওটা তার অহঙ্কারের আত্মপ্রকাশ। অহঙ্কারের সঙ্গে মিশে আছে প্রশান্ত মনের লালিত্য। ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। সুখী কি দুঃখী—সে প্রশ্ন আর মনে আসে না। দু’চোখের শান্তগাম্ভীর্য যেন দর্শকের সমস্ত বিচার-বুদ্ধিকে শিথিল করে দেয়।
অথচ সেই মানুষ যখন কথা বলে। যাকে দেখলে শ্রদ্ধা হয়, শান্তি হয়, হয় তো খানিকটা ভয়ও হয়, তার কথা শুনলে যেন ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।
বৌঠান বসেছিল সেদিনকার মতো। একটু সরে বসে বললে–এসো ভাই।
ভূতনাথ বসে পকেট থেকে কৌটোটা বের করে দিয়ে বললে— এনেছি সেটা—কী ভাবে ব্যবহার করতে হবে সব লেখা আছে এতে।
তারপর ঠিক সেদিনকার মতোই চিন্তা আবার ঘরে ঢুকলো এক থালা খাবার নিয়ে।
ভূতনাথ বললে—আমি এত খেতে পারবো না বৌঠান।
খিদে যে পায়নি ভূতনাথের তা নয়, কিন্তু বৌঠানের সামনে বসে খেতে কেমন লজ্জা-লজ্জা করে। কিন্তু বৌঠানও ছাড়বার পাত্রী নয়। বললে—না খেলে আমি কথাই বলবো না তোমার সঙ্গে। সব খেতে হবে।
সত্যিই খেতে হলো। খাওয়ার শেষে বৌঠান বললে—একট বসো, আসছি, বলে,—উঠে পাশের ঘরে চলে গেল। এতক্ষণে নজরে পড়লো ভূতনাথের। পাশেই আর একটা ঘর। সেদিন নজরে পড়েনি। ঘরখানার চারদিকে আর একবার ভালো করে চেয়ে দেখলে ভূতনাথ। আলমারি ভর্তি পুতুলগুলো স্থির হয়ে রয়েছে কাচের ভেতরে। তাদের মধ্যে একটা বড় কাচের পুতুল যেন ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে আছে ভূতনাথের দিকে। সোনালি রূপালি পাড় বসানো শাড়ি-পর, গায়ে পুতির গয়না। হঠাৎ মনে হলো পুতুলটা যেন একবার নড়ে উঠলো। আশ্চর্য! যেন চোখের ইঙ্গিতে তাকে ডাকলে। ভূতনাথ আবার ভালো করে চেয়ে দেখলে। না, ওটা তো নিষ্প্রাণ পুতুল ছাড়া আর কিছু নয়।
বৌঠান আবার ঘরে এল। ননীর মত নরম আলতা-পরা পা দুটো ঘুরিয়ে আবার বসলো সামনে। হাতে একটা পাজি। পাঁজি খুলে পাতা উল্টে দেখে বৌঠান বললে–কাল তো একাদশী দেখছি
—দিনটাও ভালে—কালকেই এটা পরবো তা হলে।
তারপর ভূতনাথের দিকে চেয়ে বললে—ছোটকর্তার কোনো খারাপ হবে না তো এতে, ভূতনাথ? শরীর তো ওঁর ভালো নয়, জানো, মাঝে মাঝে ভোগেনও খুব, অত অত্যাচার শরীর সইকে কেন।
ভূতনাথ কী বলবে ভেবে পেলে না। খানিক পরে বললেএকদিন’পরেই দেখুন না।
-তাই ভালো।
তারপরে কী যেন ভাবতে লাগলো বৌঠান নিজের মনে। যেন চিন্তাগ্রস্ত। খানিক পরে মুখ তুলে বৌঠান বললে—আজ পর্যন্ত সজ্ঞানে মিথ্যে কথা বলিনি ভূতনাথ, কিন্তু হয় তো তাই-ই আমায় বলতে হবে। আমার যশোদাদুলাল জানে, আমি কারোর ওপর কোনো অন্যায় করিনি, কাউকে জীবনে একটুও কষ্ট দিইনি, তুমি ব্রাহ্মণ, তোমার কাছেও স্বীকার করছি। বাবার উপদেশ আমি বর্ণে বর্ণে মেনে এসেছি কিন্তু স্বামী-সেবার জন্যে তা-ও করবো আমি বলে ডাকলে—চিন্তা–
চিন্তা আসতে বৌঠান বললে-বংশীকে একবার ডেকে দে তো এখেনে।
বংশী আসতে বৌঠান বললে—ছোটবাবু আজ কখন বেরিয়েছে রে?
–আজ্ঞে সন্ধ্যে সাতটার সময়।
-আচ্ছা, কালকে দুপুরবেলা একবার আমার ঘরে নিয়ে আসতে পারবি ছোটবাবুকে? বলবি—আমার ভীষণ অসুখ, একবার যেন দেখতে আসেন। যে-কোনো রকমে একবার তোকে এ-ঘরে আনতেই হবে ছোটবাবুকে, আর চিন্তা, তুই রাঙাঠাকমাকেও বলে দিস আমার অসুখ—আমি কিছু খাবো না আজ।
বংশী বললে—ছোটবাবু যে দুপুরে ঘুমোবে।
—ঘুম থেকে ওঠার পর বলবি।
—সেই ভালো।
–আচ্ছা এবার যা।
বসে বসে ভূতনাথের কেমন অস্বস্তি লাগছিল। এই সুযোগে বললে—আমিও তা হলে এবার আসি বৌঠান।
-তুমি একটু বোসো, এত তাড়া কিসের তোমার, কোনো কাজ আছে?
ভূতনাথ বললে—না, কাজ নেই।
—তবে, লজ্জা করছে বুঝি? সেদিন মেজদিও তত বলছিলেন— ছেলেটি লাজুক বড়।
—মেজদি কে?
–এ-বাড়ির মেজগিন্নি, এই পাশের ঘরেই থাকেন। আমাকে প্রথম দিনেই জিজ্ঞেস করেছেন—কে তোর ঘরে এসেছিল রে ছোটবউ? আমি বললাম—আমার গুরুভাই। এ-বাড়ির ভেতরে এমন করে আগে আর কখনও বাইরের পুরুষমানুষ আসেনি তো, তা আজকাল এ-বাড়ির নিয়ম-কানুন তো একটু একটু করে ভাঙছে, মেজদি’র বাবাও এখন এই অন্দরমহলে আসেন—তা আমিই বা..
কথা অসমাপ্ত রেখে বৌঠান থামলো। তারপর আবার বললে-আজই তোমার সঙ্গে হয় তত শেষ দেখা ভূতনাথ, এ-বাড়িতে বউদের সঙ্গে সাধারণত কেউ কথা বলতে পায় না, আমারও আর দেখা পাবে না, কিন্তু দিদিকে মনে রেখো—আর তোমার যদি কোনো উপকার করতে পারি, দরকার হলে বংশীকে দিয়ে খবর পাঠিও—কেমন?
ভূতনাথ উঠলো। তারপর যশোদাদুলালের সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে প্রণাম করলে একবার।
বংশী এসে আবার তেমনি করে নিচে নিয়ে গেল সঙ্গে করে।
ভূতনাথের মনটা কেমন ভারাক্রান্ত হয়ে রইল অনেকক্ষণ। আর দেখা হবে না! একটা সামান্যতম উপলক্ষ্যকে আশ্রয় করে দু’দিনের সামান্য পরিচয়। কিন্তু তবু পটেশ্বরী বৌঠানের সঙ্গে যেন একটা পরম আত্মীয়তা গড়ে উঠেছিল দু’দিনেই। এতখানি স্নেহকরুণ আত্মীয়তা ভূতনাথ যেন জীবনে কখনও পায়নি আগে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সেই কথাই ভাবছিল ভূতনাথ। উঠোনের ওপর এসে দাঁড়াতেই বংশী বললে—একটা কথা ছিল আপনার সঙ্গে শালাবাবু।
-আমার সঙ্গে।
—আজ্ঞে হ্যাঁ, একটা কাজ করে দিতে হবে আপনাকে, আপনিই পারেন।
-কী কাজ, বল না।
—ছুটুকবাবুর আসরে তো আপনি তবলা বাজাতে যান, ওঁর একটা চাকরের দরকার, আমার ভাই-এর জন্যে যদি বলেন একটু
—কেন, ছুটুকবাবুর চাকরের কী হলো?
—আপনি সে-কাণ্ড জানেন না?
–কিসের কী কাণ্ড?
–শশীকে ছুটুকবাবু যে তাড়িয়ে দিয়েছে।
শশীর কথাটা মনে পড়লো এতক্ষণে। আজই তো সন্ধ্যেবেলা দেখা হয়েছিল তার সঙ্গে। বললে—শশী যে আমার কাছে পয়সা চাইছিল, আজই তার সঙ্গে দেখা হয়েছে রাস্তায়।
—তাই নাকি, ছোঁবেন না আজ্ঞে ওকে।
—কী হয়েছিল তার?
—পারা, পারা ঘা বেরিয়েছিল সারা গায়ে মুখে—এক সঙ্গে শোয়া-বসা করি, শেষকালে ছোঁয়াচ লেগে আমাদের হোক আর কি—মধুসূদন কাকাকে গিয়ে লোচন বলে দিলে। মধুসূদন কাকা বলে দিলে ছুটুকবাবুকে, সরকার মশাই খাজাঞ্চীখানার খাতা থেকে নাম কেটে দিলে ওর।
ভূতনাথ বললে–বেচারি বলছিল বড় কষ্টে পড়েছে, দেশে যাবার পয়সা নেই।
—তা তখন মনে ছিল না। আমরা পইপই করে মানা করেছি আজ্ঞে, ও-সব বাবুদের পোষায়, টাকা আছে, রোগ সারিয়ে ফেলে, ছুটুকবাবুর হয়েছিল—সেরে গেল—কিন্তু ভদ্দরলোকের বাড়িতে ও-রোগ হলে সে-চাকরকে রাখবে কেন?
বংশী একটু থেমে বললে—তা আজ্ঞে ওই জায়গায় আমার ভাইকে আপনি ঢুকিয়ে দিন না ছুটুকবাবুকে বলে।
–আচ্ছা বলবো-বলে ভূতনাথ নিজের ঘরে এল। ব্রজরাখালের ঘরের দিকে চেয়ে দেখলে একবার। এখনও আসেনি। এখন ব্রজরাখাল ব্যস্ত বড়। সেই কদমকেশর বোস। ভদ্রলোকের জরুরি কাজ ছিল ব্রজরাখালের সঙ্গে। ফুলদাসী মৃত্যু শয্যায়। কে জানে কত কাজ—কত প্রতিষ্ঠান ব্রজরাখালের। ঠাকুরের নাম প্রচার করতে হবে। স্বামী বিবেকানন্দ এসেছেন। কাজ আরো বেড়ে গিয়েছে। বেদান্ত আর অদ্বৈতবাদ প্রচার করতে হবে। মিস্টার আর মিসেস সেভিয়ারও সঙ্গে এসেছেন শিষ্য হয়ে। সাহেব মেম শিষ্য—এ-কেমন জিনিষ। কিসের আকর্ষণে এসেছে ওরা।
অন্ধকার ঘরের ভেতর বিছানায় শুয়ে রইল ভূতনাথ। হঠাৎ যেন সমস্ত বড়বাড়ি একটা গুঞ্জন শুরু করলো। মৃদু কিন্তু স্পষ্ট। ভূতনাথের মনে হলো—কবে ১৩৪৫ সালে কে ঘড়ি তৈরি করেছিল প্রথম, সেই ঘড়ির কল-কজা ধীরে ধীরে আজ বুঝি চলতে শুরু করেছে। আজ এতদিন পরে। বদরিকাবাবুর কথাই বুঝি সত্য হবে। সব লাল হয়ে যাবে। কিন্তু লাল কেন হবে? এ-বাড়ির প্রত্যেকটা ইট কি টের পেয়েছে? কবে মোগল বাদশাহদের আমলে এ-বাড়ির পূর্বপুরুষ জমিদারীর সনদ পেয়েছিল। পেয়েছিল কোতল করবার অধিকার। কবে হাজার হাজার লাঠিয়ালের আঘাতে গ্রাম-জনপদ ভীত-বিপর্যস্ত হয়ে মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, কত নারীর সৌন্দর্য-সৌজন্য-শালীনতা আর সতীত্ব নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে এ-বাড়ির পূর্বপুরুষ! এই চৌধুরী পরিবারের অত্যাচারের তরঙ্গ কত সুদূর সীমান্তে গিয়ে গ্রামবাসীদের অভিশাপকে থামিয়ে দিয়েছে! বদরিকাবাবুর কাছে সব সেদিন শুনেছে ভূতনাথ। আর শুধু কি এর! কলকাতার প্রাচীন সমস্ত বংশের ইতিহাসের পেছনে যে-মর্মান্তিক বিশ্বাসঘাতকতা আর জাতিদ্রোহিতার কলঙ্ক লুকিয়ে আছে, আজ এই রাত্রে সব যেন একসঙ্গে তারা মুখর হয়ে উঠলো। ওই যে বদরিকাবাবু শুধু নিষ্ক্রয় হয়ে বসে বসে দর্শকের ভূমিকায় অভিনয় করে যায়, ওর ব্যথা কে বুঝবে? বোঠান বুঝি কাঁদছে এখন তেতলার অন্দরমহলের একান্তে। কে ঘোচাবে তার দুঃখ? ননীলালের জন্যে কি কেউ দায়ী নয়? আর ওই সুবিনয়বাবু! তার স্ত্রী উন্মাদগ্ৰস্ত কার শাপে! শশী কেন হঠাৎ বেকার হয়ে যায়? একদিন জলাভূমির ওপর যে শহরের পত্তন হয়েছিল জব চার্নকের আমলে, সেই শহর আজ দিনে দিনে সৌধমালায় সেজে উঠেছে কি অকারণে? ছুটুকবাবুর ঘর থেকে তখনও গানের আলাপ কানে আসছে’চামেলি ফুলি চম্পা। পাশের জানালা খোল ছিল। ওধারে দক্ষিণের বাগানে বুঝি দাশু জমাদারের ছেলে বাঁশি বাজাচ্ছে। ‘বিল্বমঙ্গলের’ গানের সুর—’ওঠা নামা প্রেমের তুফানে।‘ ভূতনাথের মনে হলো—সমস্ত কলকাতা শহর যেন কাঁদছে। তার প্রথম জীবনে ভূতনাথ যে-বেজিটা পুষেছিল, সেই বেজিটা মরবার দিন ঠিক এমনি অদ্ভুত সুরেই কেঁদেছিল যেন।
কেমন অস্বস্তি লাগতে লাগলো ভূতনাথের। কিছুতেই যেন ঘুম আসছে না। হয় তো পটেশ্বরী বৌঠানের দুঃখটাই আজ তাকে বড় অভিভূত করে দিয়েছে। মনে হলো—এখন এই সময়ে প্রাণ ভরে বায়া-তবলা বাজাতে পারলে হত। তবলায় চাটি দিয়ে মনের সমস্ত দুর্ভাবনাগুলোকে হয় তো এড়াতেও পারা যেত। কিন্তু হঠাৎ একটা আচমকা শব্দে চমকে উঠেছে ভূতনাথ।
-কে?
—আমি, এখনও ঘুমোওনি বড়কুটুম?
—এত দেরি হলো? তোমাকে এক ভদ্রলোক খুজতে এসেছিলেন।
আলো জ্বললে ব্ৰজরাখাল। তারপর গায়ের জামা খুলে ফেললে। বড় ক্লান্ত দেখাচ্ছে ব্রজরাখালকে।
-আজ সারাদিন খাওয়া হয়নি, কিছু খাবার আছে বড়কুটুম?
—মুড়ি আছে, খাবে? দিচ্ছি—আমি আজ রাঁধিনি, বাইরে খেয়েছি। বলে ভূতনাথ টিনের কৌটা থেকে মুড়ি বার করে দিলে। সারা গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে ব্রজরাখাল মুখ হাত-পা ধুয়ে এল। হাত-পা গামছা দিয়ে মুছতে মুছতে বললে—সারাদিন খুব ঘোরাঘুরি গেল, শেয়ালদা’ থেকে গেলাম রিপন কলেজে, সেখান থেকে বাগবাজারে রায় বাহাদুর পশুপতি বোসের বাড়ি, তারপর সেখান থেকে স্বামিজী আর সেভিয়ারদের নিয়ে গেলাম কাশীপুরে গোপাললাল শীলের বাগানবাড়িতে। ওঃ, খুব সাজিয়েছে বাগানবাড়িটা।
—দুটি খেয়ে নিলে না কেন ওরই মধ্যে? ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে।
—সময় পেলাম না। কাল আবার সক্কালবেলাই ছুটতে হবে কাশীপুরে, সন্ধ্যেবেলা আবার যেতে হবে আলমবাজারের মঠে।
তেল-মাখা মুড়ির বাটিটা হাতে নিয়ে ব্ৰজরাখাল বললে-কে খুজতে এসেছিল বললে?
-কদমকেশর বোস নামে এক ভদ্ৰলোক।
-কেন, কিছু বলেছে?
-তোমায় বলতে বলেছে যে, মেছোবাজারের ফুলবালা দাসীর দুপুর থেকে ভেদবমি শুরু হয়েছে, একটু ওষুধ চাইছিল।
—ভেদবমি? তবে আর খাওয়া হলো না বলে উঠলো ব্ৰজরাখাল। আবার জামা গায়ে দিয়ে পায়ে জুতো গলিয়ে নিলে।
ভূতনাথ বললে—আবার চললে নাকি?
-যেতেই হবে।
–কাল সকালে গেলে চলে না?
—কাল সকালে অনেক কাজ—বলে বাইরে বেরোলো ব্রজরাখাল।
—মুড়ি ক’টা খেয়ে যাও। কিন্তু কথাটা হয় তত শুনতে পেলে না ব্ৰজরাখাল। ততক্ষণে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে সে। বাইরে শীত-শেষের রাত। ইব্রাহিমের ঘরের ছাদের কোণের টিমটিমে আলোতে অস্পষ্ট ছায়ামূর্তিটা উঠোনের উপর একবার দেখা গেল শুধু। যেন হাঁটছে না, দৌড়চ্ছে।
ভূতনাথ ঘরের দরজা বন্ধ করে আবার বিছানায় শুয়ে পড়লো। ছুটুকবাবুর ঘর থেকে তখনও গানের সুর ভেসে আসছে—’চামেলি ফুলি চম্পা, বিশ্বম্ভরের গলা। কান্তিধরের তবলার চাটি। আর ওদিকে দক্ষিণের বাগানের কোণ থেকে দাসু জমাদারের ছেলের বাঁশিতে ‘বিমঙ্গলের’ গান-‘ওঠা নামা প্রেমের তুফানে—’