সাহেব বিবি গোলাম (Saheb Bibi Golam) : 01 – পূর্বাভাস
ওদিকে বউবাজার স্ট্রীট আর এদিকে সেন্ট্রাল এভিনিউ। মাঝখানের সর্পিল গলিটা এতদিন দুটো বড় রাস্তার যোগসূত্র : হিসেবে কাজ চালিয়ে এসেছিল। কিন্তু আর বুঝি চললো না। বনমালী সরকার লেন বুঝি এবার বাতিল হয়ে গেল রাতারাতি। এতদিনকার গলি। ওই গলিরই পশ্চিমদিকে তখন বনমালী সরকারের পূর্বপুরুষ রাজত্ব করে গিয়েছিলেন সূতানুটী আর গগাবিন্দপুরের সময় থেকে। কথায় ছিল, “উমিচাঁদের দাড়ি আর বনমালী সরকারের বাড়ি”। দুটোরই বোধহয় ছিল সমান জাঁকজমক আর বাহার। সে-যুগে সদগোপ বনমালী সরকার ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর কাছ থেকে পাটনায় দেওয়ানী পেয়েছিলেন। আর কলকাতায় পেয়েছিলেন কোম্পানীর অধীনে ব্যবসা করবার অধিকার। সে-সব অনেক যুগ আগের কথা। সেকালের কুমোরটুলীতে তিনি লাটসাহেবের অনুকরণে এক বাড়ি করেন। তার দেখাদেখি সেকালের আর এক বড়লোক মথুর সেন বাড়ি করেন নিমতলায়। কিন্তু বনমালী সরকারের বাড়ির কাছে সে-বাড়ির তুলনাই হতো না যেন। তারপর কোথায় গেল সেই কুমোরটুলীর বাড়ি–কোথায় গেল বনমালী সরকার নিজে আর কোথায় গেল মথুর সেন! সত্যিই তো ভাবলে অবাক হতে হয়। কোথায় গেল সেই আরমানী বণিকরা, যারা করতে সূতা আর নুটীর ব্যবসা! আর কোথায় গেল জব চার্নকের উত্তরাধিকারী ইংরেজরা—যারা কালিকট থেকে পর্তুগীজদের ভয়ে পালিয়ে এসে সূতানুটীতে আশ্রয় নিলে—আর পরে কালিকটের অনুকরণে সূতানুটীর নামকরণ করলে ক্যালকাটা। আজ শুধু কোম্পানীর সেরেস্তার কাগজপত্রে পুরনো নথিপত্র ঘেঁটে সূতানুটীকে খুঁজে বার করতে হয়। তবু যে বনমালী সরকার ওই এদোপড়া গলির মধ্যে এতদিন দম আটকে বেঁচেছিলেন তা কেবল কলকাতা কর্পোরেশনের গাফিলতির কল্যাণে। এবার তাও গেল। এবার গোবিন্দরাম, উমিচাঁদ, হুজরি মল, নকু ধর, জগৎ শেঠ আর মথর সেনের সঙ্গে বনমালী সরকারও একেবারে ইতিহাসের পাতায় তলিয়ে গেল। আধখানা আগেই গিয়েছিল সেন্ট্রাল এভিনিউ তৈরি হবার সময়ে, এবার বাকি আধখানাও শেষ।
ভার পড়েছে ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্টের ওপর। গলির মুখে ছিল হিন্দুস্থানী ভুজাওয়ালাদের মেটে টিনের দোতলা। হোলির এক মাস আগে থেকে খচম খম শব্দে খঞ্জনী বাজিয়ে “রামা হো” গান চলতো। তারপর সোজা পুব মুখো চলে যাও। খানিকদূর গিয়ে বাঁয়ে বেঁকে আবার ডাইনে বেঁকতে হবে। সদ্গোপ বনমালী সরকারের প্যাঁচোয়া বুদ্ধির মতো, তার নামের গলিটাও বড় পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে মিশেছে গিয়ে বউবাজার স্ট্রীটে। গলিটাতে ঢুকে হঠাৎ মনে হবে বুঝি সামনের বাড়ির দেয়ালটা পর্যন্ত ওর দৈর্ঘ্য। কিন্তু বুকে সাহস নিয়ে এগিয়ে গেলে অনেক মজা মিলবে। নিচু নিচু বাড়িগুলোর রাস্তার ধারের ঘরগুলোতে জম্-জমাট দোকান-পত্তর। বাঁকের মুখে বেণী স্বর্ণকারের সোনা রূপোর দোকান। তারপর পাশের একতলা বাড়ির রোয়াকের ওপর “ইণ্ডিয়া টেলারিং হল”। কিছুদূর গিয়ে বাঁ হাতি তিন রঙা ন্যাশন্যাল ফ্ল্যাগ আঁকা সাইনবোর্ড। প্রভাস বাবুর “পবিত্র খদ্দর ভাণ্ডার”। তারপরেও আছে গুরুপদ দে’র “স্বদেশী বাজার”। যখন স্বদেশী জিনিস কিনতে খদ্দেরের ভিড় হয় তার জেরটা গিয়ে ঠেকে পাশের বাড়ির সবুজ সঙ্ঘের দরজা পর্যন্ত। এক একদিন “সবুজ সঙ্ঘ” হঠাৎ মুখর হয়ে ওঠে আলোতে আর জাঁকজমকে। একটা উপলক্ষ্য তাদের হলেই হলো। সেদিন পাড়ার লোকের ঘুমোবার কথা নয়। সকাল থেকে সন্ধ্যে অবধি “সবুজ সঙ্ঘের জয় ঘোষণা ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনও ঘটনা ঘটে না। লোকে আপিসে যায় না, বাজার করে না, ঘুমোয় না, খায় না—শুধু সবুজ সঙ্ঘ আর সবুজ সঙ্ঘ। কিন্তু তারপরেই আছে জ্যোতিষার্ণব শ্রীমৎ অনন্ত ভট্টাচার্যের “শ্রীশ্রীমহাকালী আশ্রম” যেখানে এই কলিকালের ভেজালের যুগেও একটি খাঁটি নবগ্রহ কবচ মাত্র ১৩টাকা ১০আনায় পাওয়া যায়—ডাকমাশুল স্বতন্ত্র। সত্য ত্রেতা দ্বাপর—বর্তমান, ভূত ভবিষ্যৎ—ত্রিকালদর্শী রাজজ্যোতিষীর প্রস্তুত বশীকরণ, বগলামুখী আর ধনদা কবচের প্রচার ইংলণ্ড, আমেরিকা, আফ্রিকা, চীন, জাপান, মালয়, সিঙ্গাপুরের মতো দূর-দূর দেশে। বনমালী সরকার লেন-এর “শ্রীশ্রীমহাকালী আশ্রম’-এর আরো গুণাবলী সাইনবোর্ডে লাল, নীল আর হলদে কালিতে সবিস্তারে লেখা আছে। তারপরের টিনের বাড়িটার সামনের চালার নিচে বাঞ্ছার তেলেভাজার দোকান। আশে পাশের চার পাঁচটা পাড়ায় বাঞ্ছার তেলেভাজার নাম আছে। তিন পুরুষের দোকান। বাঞ্ছা এখন নেই। বাঞ্ছার ছেলে অধর। অধরের ছেলে অক্রর এখন দোকানে বসে। অক্রর কারিগর ভালো। বেসনটাকে মাটির গামলায় রেখে বাঁ হাতে একটু সোডা নিয়ে বেসনটা এমন ফেটিয়ে নেয় যে, কড়ার গরম তেলে ফেলে দিলে প্রকাণ্ড ফোস্কার মতো নিটোল হয়ে ফুলে ফুলে ওঠে বেগুনিগুলো। হাতকাটা কেলো এসে সকাল থেকে বসে থাকে। তখন ঝাঁপ খোলেনি অক্রর। শীতকালের সকালবেলা চারদিকে গোল হয়ে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে খদ্দেররা—আর অক্রর ঝাঁঝরি খুন্তিটা দিয়ে বেগুনিগুলো ভেজে ভেজে তেলে চুবড়িতে। সময় সময় চুবড়িতে তোলবারও অবসর দেয় না কেউ। জিভ পুড়ে ফোস্কা পড়বার অবস্থা। তেমনি চলে দুপুর বারোটা পর্যন্ত। এমনি করে আরো হরেক রকমের দোকান বাঁদিকে রেখে বনমালী সরকার লেন এঁকে বেঁকে ঘুরে ফিরে গিয়ে পড়েছে বউবাজার স্ত্রীটে। দোকানপত্তর যা কিছু সব বাঁদিকে কিন্তু অত বড় গলিটার ডানদিকটায় প্রায় সমস্তটা জুড়ে কেবল একখানা বাড়ি। নিচু নিচু ছোট ছোট পায়রার খোপের মতন ঘরগুলো। ভাড়াটের চাপাচাপিতে কালনেমির লঙ্কা ভাগের মতন আর তিল ধরবার জায়গা নেই ওতে। লোকে বলতো “বড়বাড়ি”। তা এদিককার মধ্যে সে-যুগে ও-পাড়ায় অত বড় বাড়ি আর ছিল কই! বালির পলেস্তারার ওপর রঙ চড়িয়ে চড়িয়ে যতদিন চালানো গিয়েছিল ততদিন চলেছে। তারপর রাস্তার দিকের চারপাঁচখানা ঘর নিয়ে কংগ্রেসের “ন্যাশন্যাল স্কুল” হয়েছিল ইদানীং। আর একটা ঘরে তঁত বসেছিল অনেক আগে থাকতে। সমস্ত দিন ঘণ্টায় ঘণ্টায় পেটাঘড়িতে ঢং ঢং আওয়াজ হতো। টিফিনের সময় লেবেনচুওয়ালা আর জিভে-গজার ফেরিওয়ালারা ঠুন ঠু বাজনা বাজিয়ে ছেলেদের আকর্ষণ করতো। কোনও দিন হয়তো এক ভাড়াটের ছোট বৈঠকখানার মধ্যে সন্ধ্যেবেলা গানের আসর বসে। তানপুরার একটানা শব্দের সঙ্গে বাঁয়া তবলায় কাহারবা তালের রেলা চলেছে। পিয়া আওয়াত নেহি’র সঙ্গে মিঠে তবলার তেহাই পাড়া মাত করে দেয়। কোনও কোনদিন ‘মিঞা কি মল্লারের সঙ্গে মিষ্টি হাতের মধ্যমানের ঠেকায় আকৃষ্ট হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ে রসিক লোকেরা। জানালা দিয়ে উঁকি মারে। এককালের মালিকরাই আজ ঘটনাক্রমে অবস্থার ফেরে ভাড়াটে হয়ে পড়েছে। তবু বড়বাড়ির ভেতরে ঢুকতে কারো সাহস হয় না। ছোট ফ্রকপরা একটা মেয়ে হয়তো টপ করে এক দৌড়ে অক্র রের দোকান থেকে এক ঠোঙা তেলেভাজা কিনে আবার ঢুকে পড়ে কোঠরের মধ্যে। দোতলার ওপর থেকে হঠাৎ তরকারীর খোসা ঝুপ করে পুষ্পবৃষ্টির মতো পড়ে হয়তো কোনও লোকের মাথায়। লোকটা ওপর দিকে বেকুবের মত চোখ তুলে চায়, কিন্তু কে কোথায়! এ-বাড়ির রান্নাঘর থেকে আসে কুচো চিংড়ি আর পেয়াজের ঠাট্টা আর হয়তো পাশের রান্নাঘর থেকেই আসছে মাংস গরম-মশলার বিজয়ঘোষণা। একটা দরজার সামনে এসে থামলো ট্যাক্সি মেয়েরা যাবে সিনেমায়। আবার হয়তো তখনই পাশের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে একটা থার্ড ক্লাশ ঘঘাড়ার গাড়ি মেয়েরা যাবে হাসপাতালের প্রসূতি-সদনে। জন্ম-মৃত্য-সঙ্গমের লীলাবিলাস কবে ষাট-সত্তর-আশী-একশ’ বছর আগে এ-পাড়ার বাড়িগুলোতে প্রথম শুরু হয়েছিল আভিজাত্যের খরস্রোতে, আজ এই ক’টি বছরের মধ্যে তা যেন বইতে শুরু করেছে নিতান্ত মধ্যবিত্ত খাতে।
হোক মধ্যবিত্ত! না থাক সেই সেকালের জুড়ি, চৌঘুড়ি, ল্যাণ্ডো, ল্যাণ্ডোলেট, ফিটন আর ব্রুহাম। নাই বা রইল ঘেরাটোপ দেওয়া পাল্কি, তসর-কাপড়-পর ঝি, কিম্বা সোনালি-রূপালি কোমরবন্ধ পর দরোয়ান, সরকার, হরকরা, চোদার, হুকাবরদার, আর খানসামা। নাই বা চড়লাম চল্লিশ দাড়ের ময়ুরপঙ্খী। ছিল চিংড়ি মাছ, পেঁয়াজ, পুইশাক, মাথার ওপর একটা ছাদ আর সূতিকা-রুগী বউ। এবার তাও যে গেল। এবারে দাঁড়াব কোথায়?
নোটিশ দিয়েছে ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট যথাসময়ে।
জোর আলোচনা চলে বাঞ্ছার তেলেভাজার দোকানে। “ইণ্ডিয়া টেলারিং হল-এ”। গুরুপদ দে’র “স্বদেশী বাজারে”র সামনে, প্রভাস বাবুর “পবিত্র খদ্দর ভাণ্ডারে”র ভেতরে বাইরে। আর ‘সবুজ সঙ্ঘের আড্ডায়। আরো আলোচনা চলে ত্রিকালদর্শী শ্রীমৎ অনন্তহরি ভট্টাচার্যের “শ্রীশ্রীমহাকালী আশ্রমে”। জ্যোতিষার্ণব বলেন—আগামী মাসে কর্কট রাশিতে রাহুর প্রবেশ—বড় সমস্যার ব্যাপার—দেশের কপালে রাজ-রোষ— অনেক আলোচনা চলে বড়বাড়িতে। এর থেকে ভূমিকম্প ছিল ভালো। ছিল ভালো ১৭৩৮ সনের মতো আশ্বিনে ঝড়। যেবার চল্লিশ ফুট জল উঠেছিল গঙ্গাতে। তাও কি একবার! বড়বাড়িতে যারা বুড়ো, তারা জানে সে-সব দিনের কথা। তোমরা তখন জন্মাওনি ভাই। আর আমিই কি জন্মিয়েছি, না জন্মেছে আমার ঠাকুর্দা। এ কি আজকের দেশ? কত শতাব্দী আগেকার কথা। গঙ্গা তো তখন পদ্মায় গিয়ে মেশেনি। নদীয়া আর ত্রিবেণী হয়ে সাগরে গিয়ে মিশতে। ওই যে দেখছো চেতলার পাশ দিয়ে এক ফালি সরু নদৰ্মা, ওইটেই ছিল যে আদিগঙ্গা, ওকেই বলতে লোকে বুড়িগঙ্গা। তারপর যেদিন কুশী এসে মিশলো গঙ্গার সঙ্গে, স্রোত গেল সরে। ভগীরথের সেই গঙ্গাকে তোমরা বলে হুগলী নদী আর আমরা বলি ভাগীরথী। তখন হুগলীর নামই বা কে শুনেছে, আর কলকাতার নামই বা শুনেছে কে! প্লিনি সাহেবের আমল থেকে লোকে তত শুধু সপ্তগ্রামের পাশের নদীকেই বলতে দেবী সুরেশ্বরী গঙ্গে! তারপর উত্থান আর পতনের অমোঘ নিয়মে যেদিন সাতগাঁ’র পতন হলো, উঠলো হুগলী, সেদিন পর্তুগীজদের কল্যাণে ভাগীরথী নাম হলো গিয়ে হুগলী নদী।
গল্প বলতে বলতে বুড়োরা হাঁপায়। বলে—পড়োনি হুতোম প্যাঁচার নক্সায়—
“আজব শহর কলকাতা
রাঁড়ি বাড়ি জুড়ি গাড়ি মিছে কথার কি কেতা।
হেতা ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে বলিহারী ঐক্যতা,
যত বক-বিড়ালী ব্ৰহ্মজ্ঞানী, বদমাইসির ফাঁদ পাতা—”
চূড়ামণি চৌধুরী আলীপুরের উকীল। বলেন—আরে কিপলিং সাহেবই তো লিখে গিয়েছে—
Thus from the midday halt of Charnock
Grew a city……
Chance-directed chance-erected laid and
Built
On the silt
Palace, byre, hovel, poverty and pride
Side by side……
বড়বাড়ির নতুন মালিকরা সেই সব দিনের কাহিনী জানে না। গড়গড়ায় তামাক খেতে নাকি ওয়ারেন হেস্টিংস আমাদের মতন। বড় বড় লোকদের নেমন্তন্নর চিঠিতে লেখা থাকতো ‘মহাশয় অনুগ্রহ করে আপনার হুকাবরদারকে ছাড়া আর কোনও চাকর সঙ্গে আনবার প্রয়োজন নেই।‘ আর সেই জব চার্নক। বৈঠকখানার মস্ত বড় বটগাছটার নিচে বসে হুঁকো খেতে, আড্ডা জমাতো, এবং সন্ধ্যে হলেই চোর-ডাকাতের ভয়ে চলে যেতে বারাকপুরে। বিয়েই করে ফেললে এক বামুনের মেয়েকে। ডিহি কলকাতায়, গোবিন্দপুর আর সূতানুটীতে বাস করবার জন্যে নেমতন্ন করে বসলো সকলকে। একদিন এল পর্তুগীজরা। এখন তাদের দেখতে পাবে মুরগীহাটাতে। আধা-ইংরেজ, আধা-পর্তুগীজ। নাম দিয়েছিল ফিরিঙ্গী। ওরাই ছিল ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর প্রথম যুগের কেরানী। তারাই শেষে হলো ইংরেজদের চাপরাশী, খানসামা আর ওদের মেয়েরা হলো মেমসাহেবদের আয়া। আর এল আরমানীরা। তাদের কেউ কেউ খোরাসান, কান্দাহার, আর কাবুল হয়ে দিল্লী এসেছিল। কেউ এসেছিল গুজরাট, সুরাট, বেনারস, বেহার হয়ে। তারপর চু চুড়াতে থাকলে কতকাল। শেষে এল কলকাতায়। ওদের সঙ্গে এল গ্রীক, এল ইহুদীরা, এল হিন্দু-মুসলমান—সবাই।
এমনি করে প্রতিষ্ঠা হলো কলকাতার। সে-সব ১৬৯০ সালের কথা।
পাঠান আর মোগল আমল দেখতে দেখতে মিলিয়ে গেল। লোকে একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখলে ইন্দ্রপ্রস্থ আর দিল্লী কোথায় তলিয়ে গিয়েছে। তার বদলে এখানে এই সুন্দরবনের জলো হাওয়ার মাটিতে গজিয়ে উঠেছে আর এক আরব্য উপন্যাস। ভেল্কি বাজি যেন। কলকাতার একটি কথায় রাজ্য ওঠে, রাজ্য পড়ে। জীবনে উন্নতি করতে গেলে এখানে আসতে হয়। রোগে ভুগতে গেলে এখানে আসতে হয়। পাপে ড়ুবতে গেলে এখানে আসতে হয়। মহারাজা হতে চাইলে এখানে আসতে হয়। ভিখিরী হতে চাইলে এখানে আসতে হয়। তাই এলেন রায় রায়ান রাজবল্লভ বাহাদুর সূতানুটীতে। মহারাজ নন্দকুমারের ছেলে রায় রায়ান রাজা গুরুদাস এলেন। এলেন দেওয়ান রামচরণ, দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ। এলেন ওয়ারেন হেস্টিংস-এর দেওয়ান কান্তবাবু, এলেন হুইলারের দেওয়ান দর্পনারায়ণ ঠাকুর, এলেন কলকাতার দেওয়ান গোবিন্দরাম মিত্র, উমিচাঁদ—আর এলেন বনমালী সরকার।
এই যার নামের রাস্তায় বসে তোমাদের গল্প বলছি—
চূড়ামণি চৌধুরীর মক্কেল হয় না। কালো কোটটার ওপর অনেক কালি পড়েছে। সময়ের আর বয়েসের। হাতে কালি লেগে গেলেই কালো কোটে মুছে ফেলেন। বাইরে থেকে বেমালুম। কোর্টে যান। আর পুরনো পূর্বপুরুষের পোকায় কাটা বইগুলো ঘাঁটেন। তোমরা তো মহা-আরামে আছো ভাই। খাচ্ছ, দাচ্ছ, সিনেমায় যাচ্ছ। সেকালে সাহস ছিল কারো মাথা উচু করে চৌরঙ্গীর রাস্তায় হাঁটবার? বুটের ঠোক্কর খেয়ে বেঁচে যদি যাও তো বাপের ভাগ্যি। সেকালে দেখেছি সাহেব যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। হাত বেতের ছড়ি। দু’পাশের নেটিভদের মারতে মারতে চলেছে। যেন সব ছাগল, গরু, ভেড়া। আর গোরা দেখলে আমরা তো সাতাশ হাত দূরে পালিয়ে গিয়েছি। ওদের তো আর বিচার নেই। নেটিভরা আর মানুষ নয় তা বলে। রেলের থার্ড ক্লাশে পাইখানা ছিল না ভাই। নাগপুর থেকে আসানসোল এসেছি—পেট টিপে ধরে। কিছু খাইনি—জল পর্যন্ত নয়—পাছে…
তা হোক, তবু ইপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের নোটিশ দিতে বাধা নেই। বড়বাড়ির ছোট ছোট মালিকরা নোটিশ নিয়ে সই দিলেন।
নোটিশের পেছন পেছন এল চেন, কম্পাস, শাবল, ছেনি, হাতুড়ি, কোদাল, গাঁইতি, ডিনামাইট—লোকলস্কর, কুলিকাবারি। আর এল ভূতনাথ। ওভারসিয়ার ভূতনাথ। ভূতনাথ চক্রবর্তী। নিবাস—নদীয়া। গ্রাম—ফতেপুর, পোস্ট আপিস—গাজনা।
দুপুরবেলা ধুলোর পাহাড় ওড়ে। টিনের চালাগুলো ভাঙতে সময় লাগবার কথা নয়। এদিকে ভুজাওয়ালাদের টিনের দোতলা বাড়িটা থেকে শুরু করে সবুজ সঙ্ঘের ঘরটা পর্যন্ত ভাঙা হয়ে গিয়েছে। শীতকাল। দল বেঁধে কুলির দল লম্বা দড়ির শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে সুর করে চিৎকার করে—
—সামাল জোয়ান—
—হেঁইও—
—সাবাস জোয়ান—
—হেঁইও—
–পুরী গরম—
—হেঁইও—
গরম পুরী ওরা খায় না কিন্তু। দুপুরবেলায় এক ঘণ্টা খাবার সময়। সেই সময় ছাতু কাঁচালঙ্কা আর ভেলী গুড় পেটের ভেতর পোরে। বউবাজার স্ত্রীটের ট্রামের ঘড় ঘড় শব্দ এখানে ক্ষীণ হয়ে আসে—আর এদিকে সেন্ট্রাল এভিনিউতে তখন দুপুরের ক্লান্তি নেমেছে। মাঝখানে “শ্রীশ্রীমহাকালী আশ্রম”-এর অশথ গাছটার তলায় একটু গড়িয়ে নেয় ওরা। বনমালী সরকার লেন-এর সর্পিল গতি সরল হয়ে গিয়েছে। ভাঙা বাড়ির সমতল ভূমিতে দাঁড়িয়ে বেহারী কুলিরা জানতেও পারে না—কোন্ শাবলের আঘাতে জীবনের কোন্ পর্দায় কোন্ সুর মূৰ্ছিত হয়ে উঠলো। এক একটা ইট নয় তো যেন এক একটা কঙ্কাল। ইতিহাসের এক একটা পাতা ভাঙা ইটের সঙ্গে গুড়িয়ে ধুলো হয়ে যায়—আর তারপর উত্তরে হাওয়ায় আকাশে উঠে আকাশ লাল করে দেয়।
চূড়ামণি চৌধুরী কোর্ট ফেরৎ বাড়ি যেতে যেতে তখন ফিরে চেয়ে দেখেন। মনে হয় আকাশটা যেন লাল হয়ে গিয়েছে। আশে পাশে ট্রামে লোক বসে আছে—মুখে কিছু বলেন না। বাড়িতে এসে ইতিহাসটা খুলে কসেন। কোথায়, কবে সিরাজদ্দৌলা শহর পুড়িয়ে ছারখার করে দিলে। আবার দেখতে দেখতে নতুন করে গড়ে উঠলো কলকাতা। পোড়া কলকাতা যেন আবার আজ পুড়ছে—নতুন করে গড়ে ওঠবার জন্যে। ভালোই হলো। বহু বিষ জমে উঠেছিল ওখানে। খোলা হাওয়া ঢুকতে না ঘরগুলোতে। পুরুষানুক্রমে বড়বাড়ির অবস্থা যা দাঁড়িয়েছিল, তাতে সরিকের সঙ্গে সরিকের আর পাশাপাশি বাস করা চলতো না। বড়কর্তাদের সে আমলের একটা রূপোর বাসন নিয়ে মামলা হয়ে গেল সেদিন। তবু আজকালকার ছেলেরা সে-সব দিন তো দেখে নি। চূড়ামণি চৌধুরীও তখন খুব ছোট। মেজ-কাকীমার পুতুলের বিয়েতে মুক্তোর গয়না এসেছিল ফ্রান্স থেকে। আর মেজকর্তার পায়রা নিয়ে মোকর্দমা লাগলে ঠঠনের দত্তদের সঙ্গে। সে কী মামলা। সে মামলা চললো তিন বছর ধরে। কজ্জনবাঈ সেকালের অত বড় বাঈজী। গান গাইতে এসেছিল দোলের দিন। ধর্মদাসবাবু ড়ুগি-তবলা বাজিয়েছিলেন। বড়দের দোলের উৎসবে ছোটদের ঢোকবার অধিকার ছিল না তখন। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছিলেন দপ্তরখানার ভেতর দরজার ফাঁক দিয়ে। সে কী নাচ। সেই কজ্জনবাঈ-ই এসেছিল আর একবার দশ বছর পরে। তখন সে চেহারা আর নেই। মেজ-কাকীর কাছ থেকে ভিক্ষে চেয়ে নিয়ে গেল। অনেক বলা-কওয়াতে একটা গান গাইলে। সে গানটা সে দশ বছর আগে একবার গেয়েছিল।
বাজু বন্ধ্ খুলু খুলু যায়—
ভৈরবী সুরের মোচড়গুলো বড় মিঠে লেগেছিল সেদিন। বুড়ীর গলায় যেন তখনও যাদু মেশানো। ঠুংরীতে ওস্তাদ ছিল কজ্জনবাঈ। আজকালকার ছেলেরা শোনে নি সে গান।
কোর্টে আসা-যাওয়ার পথে ট্রামের জানালা দিয়ে বাড়িখানা আর একবার দেখেন। এদিককার সব ভাঙা হয়ে গিয়েছে। বড়বাড়িটা এখনও ছোঁয়নি ওরা। এদিকটা শেষ করে ধরবে ওদিকটা।
চূড়ামণি চৌধুরীর মনে হয় যেন এখনও কিছু বাকি আছে। চোখ বুজলেই যেন দেখতে পান সব। পাল্কি এসে দাঁড়ালো দেউড়িতে। মেজ-কাকীমার পেয়ারের ঝি গিরি এসে দাঁড়িয়েছে তসরের থান পরে। সদর গেটে ঘণ্টা বাজিয়ে দিলে ব্রিজ সিং। হটো সব, হটো সব। পাল্কি বেরুচ্ছে। বড় ছোট সব যোগে মেজ-কাকীমার গঙ্গাস্নান চাই। তারপরেই মনে হয় ভালোই হয়েছে। সেই বড়বাড়িতে একটা চাকরও রইল না তোষাখানাতে। মধুসূদন ছিল বড়কর্তার খাস চাকর। চাকরদের সর্দার। সে-ও একদিন দেশে গেল পূজার সময়, আর ফিরলো না।
যখন চোখ খোলেন চূড়ামণি চৌধুরী, তখন ট্রাম হাতীবাগানের কাছ দিয়ে হু হু করে চলেছে। পাতলা হয়ে গিয়েছে ভিড়। কালো কোটের পকেটে দুটো হাত ঢুকিয়ে চুপ করে বসে থাকেন আর ভাবেন, বাড়িতে গিয়েই কটন সাহেবের হিস্ট্রিটা পড়তে হবে। আর বাস্টীডের বইটা। সার ফিলিপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে ম্যাডাম। গ্র্যাণ্ডের প্রণয়কাহিণী। কী রাজত্বই করেই গিয়েছে বেটার। সাত সমুদ্র থেকে জব চার্নক আর ছ’ জন সহকারী আর সঙ্গে মাত্র তিরিশ জন সৈন্য। আকবর বাদশা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেন নি এত বড় সাম্রাজ্যের কথা।
বেহারী মজুররা পেতলের থালা ধুয়ে মুছে আবার ইট ভাঙতে শুরু করে। দুম-দাম করে পড়ে ইট। চুন-সুরকীর গুড়ো আকাশে উড়ে চলে। চোখ-মুখ ধুলোয় ধুলো হয়ে যায়। তবু ঠিকাদারের লোক হুঁশিয়ার নজর রাখে। কাজে কেউ ফাকি দেবে না। সায়েব কোম্পানী শহর বানিয়েছে, রাস্তা বানিয়েছে। বড় বড় তালাও কেটেছে। জলের কল বসিয়েছে। মাথায় বিজলী বাতি আর পাখা দিয়েছে। সব দিয়েছে সায়েব কোম্পানী। বনমালী সরকারের গলি ভেঙে দেশের কোনও ভালো করবে নিশ্চয়ই সায়েবরা।
—সেলাম হুজুর—বলে সরে দাঁড়ালো বৈজু।
—সেলাম হুজুর—গাইতি থামিয়ে দুখমোচনও সেলাম জানায়।
দু’পাশে পদে পদে সেলাম নিতে নিতে চলতে লাগলো ভূতনাথ। ভূতনাথ চক্রবর্তী। একবারে সোজা এসে দাঁড়ালো বড়বাড়ির সামনের সদর গেটে।
কুলির সর্দার চরিত্র মণ্ডল সামনে এসে নিচু হয়ে সেলাম করলে।
এতক্ষণে ভূতনাথও মাথা নোয়াল। বললে—দাগ শেষ করেছে। চরিত্র?
চরিত্র মণ্ডল মাথা নাড়লে—আজ বড় দাগ দিতে হবে হুজুর, কাল আরো চল্লিশজন কুলি লাগাচ্ছি, এদিকটা তত দিলাম শেষ করে, সন্ধ্যে নাগাদ সব সমান করে তবে কুলিরা ছুটি পাবে হুজুর।
ভূতনাথ চারিদিকটা চেয়ে দেখলে একবার। অনেকদিন আগেই সব বিলুপ্তপ্রায় হতে চলেছিল। এবার যেটুকু আছে, তা-ও নিঃশেষ করে দিতে হবে। কোথায় বুঝি কোন্ অভিশাপ কবে এ-বংশের রক্তের মধ্যে প্রবেশ করেছিল শনির মতো নিঃশব্দে, আজ তা নিশ্চিহ্ন হলো।
চরিত্র মণ্ডল আবার কথা বললে—কাল তা হলে ওই দাগটা ধরবো তো হুজুর?
একদিন এই বাড়ির আশ্রয়ে এসেই নিজকে ধন্য মনে করেছিল ভূতনাথ। সারা কলকাতায় সেদিন এই বাড়ি আর এই বাড়িরই আর একজন মানুষকে কেবল নিজের বলে মনে হয়েছিল। অথচ ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস!
চরিত্র মণ্ডল আবার বললে—কাল তা হলে কোথায় হাত লাগাবো হুজুর?
হঠাৎ ভূতনাথ বললে-না না, মদ টদ আমি খাইনে—-বলেই চমকে উঠছে। চরিত্র মণ্ডলও কম চমকায় নি। ওভারসিয়ার বাবুর দিকে হঠাৎ ভালো করে তাকিয়ে দেখলে সে।
কিন্তু এক নিমেষে নিজেকে সামলে নিয়েছে ভূতনাথ। এরই মধ্যে কি তার ভীমরতি ধরলো নাকি। সামলে নিয়ে ভূতনাথ বললে—কী বলছিলে যেন চরিত্র?
—আজ্ঞে দাগের কথা বলছিলাম, বলছিলাম এদিকটা তো শেষ করে দিলাম, কাল কোত্থেকে শুরু করবো তাহলে হুজুর?
ঈশ্বরের কী অভিপ্রায় কে জানে! যদি সেই অভিপ্রায়ই, হয়, তো সে বড় নিষ্ঠুর কিন্তু। একদা নিজের নিশ্চিন্ত আশ্রয়স্থলকে নিজের হাতেই আবার একদিন তাঙবার আদেশ দিতে হবে, কে জানতে! একদিন এই বড়বাড়িতে প্রবেশ করবার অনুমতির অভাবে এইখানে এই রাস্তার ওপর হাঁ করে পাঁচ ছ’ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। ব্রিজ সিং ওইখানে লোহার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। ডান হাতে সঙ্গীন উচু করা বন্দুক। আর বুকের ওপর মালার মতন বন্দুকের গুলীভরা বেল্ট। সেদিন এমন সাহস ছিল না যে, ওইখানে ব্রিজ সিং-এর সামনে দিয়ে ভেতরে যায় ভূতনাথ।
কোথায় সে গেট! কোথায়ই বা সে ব্রিজ সিং! ব্রিজ সিং ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে চেঁচাতে—হুঁশিয়ার হুঁশিয়ার—হো-
ছোটবাবুর ল্যাণ্ডোলেট যখন ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে রাস্তায় বেরুতোতখন সাড়া পড়ে যেতো এ-পাড়ায় ও-পাড়ায়। কড়ির মতো সাঈ জুড়ি ঘোড়া টগবগ্ করতে করতে গেট পেরিয়ে ছুটে আসতো রাস্তায়। আর রাস্তায় চলতে চলতে লোকেরা অবাক হয়ে চেয়ে দেখতে ঘোড়া দুটোকে।
গাড়িটা যখন অনেক দূরে চলে গিয়েছে, তখন ব্রিজ সিং আবার সেই আগেকার মতো কাঠের পুতুল সেজে সঙ্গীন খাড়া করে দাঁড়িয়ে থেমে থাকতো।
সে-সব অনেক দিনের কথা। তারপর কত শীত কত বসন্ত এল। কত পরিবর্তন হলো কলকাতার। কত ভাঙা কত গড়া। ভূতনাথের সব মনে পড়ে।
এখনও দাঁড়ালে যেন দেখা যাবে ব্ৰজরাখাল রোজকার মতন আপিস থেকে বাড়ি ফিরছে। সেই গলাবন্ধ আলপাকার কোট। সামনে ধুতির কোঁচাটা উল্টে পেট-কোমরে গোঁজা। মুখে গালের ভেতর পান গোঁজা। হাতে পানের বোঁটায় চুন। রোগা লম্বা শক্তসামর্থ্য মানুষটি।
ব্ৰজরাখাল বলতোনা না, এটা কাজ ভালো করোনি ভূতনাথ, আমরা হলাম গিয়ে গোলাম—ওদের গোলাম—আর বাবুরা হলো সায়েব-সায়েব বিবির সঙ্গে কি গোলামদের মেলে-কাজটা ভালো করোনি বড়কুটুম।
চরিত্র মণ্ডল সামনে এল আবার। বললে—তা হলে আজ আমরা আসি হুজুর।
তার মানে! ওভারসিয়ার ভূতনাথ চোখ ফিরিয়ে দেখলে চারদিকে। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। শীতকালের বেলা দেখতে দেখতে যায়। বললে—তা হলে ওই কথাই রইল, এই দাগেই হাত দেবে কাল সক্কাল বেলা।
চরিত্র মণ্ডল সেলাম করে চলে গেল। সঙ্গে দু’চারজন যারা অবশিষ্ট ছিল সবাই সেন্ট্রাল এভিনিউ-এর দিকে পা বাড়ালো। একটা কুকুর হঠাৎ কোথা থেকে ভূতনাথের পায়ের কাছে এসে ল্যাজ নাড়াতে লাগলো। ধুলোয় ধুলো সারা গা। সমস্ত দুপুর বোধহয় বসে বসে রোদ পুইয়েছে। এবার হয়তো ইটের স্কুপের মধ্যে আশ্রয় নেবে রাতটুকুর জন্যে। কেমন যেন মায়া হলো ভূতনাথের। যারা মালিক, যারা ভাড়াটে, তারা কবে নোটিশ পেয়ে কোথায় চলে গিয়েছে। কিন্তু কুকুরটা বোধহয় কাস্তুভিটের মায়া ছাড়তে পারছে না। ও-পাড়ায় গিয়ে, ওই হিদারাম বড়য্যের গলিটা পর্যন্ত গেলেই চপকাটলেটের এটো টুকরো খেয়ে আসতে পারে। বউবাজারের পাটার দোকানের ফুটপাথে গিয়ে দাঁড়ালেও দু’চারটে টেংরি মেলে। তবে কীসের মায়া ওর? বাস্তুভিটের? কুকুর একটা, তার আবার বাস্তুভিটে, তার আবার মায়া!!
–দূর, দূর, দূর হ—ভূতনাথ কুকুরটার দিকে একটা লাথি ছুঁড়লে।
মেজকর্তার অত সখের পায়রা সব। তা-ই রইল না একটা। এক-একটা পায়রা ময়ুরের মতন পেখম তুলে আছে তো তুলেই আছে। হাতে করে ধরলেও পেখম উঁচু করে ছড়িয়ে থাকতো।
কী সব বাহার পায়রার। তাই বলে একটা রইল না।
—দূর, দূর, দূর হ–
ক্রমে অল্প অল্প অন্ধকার হয়ে এল। দূরে বউবাজারের ট্রাম লাইন-এর ঘড় ঘড় আওয়াজ আরো কর্কশ হয়ে আসে। রাস্তায় রাস্তায় আলো দেখা যায়। বনমালী সরকার লেন-এ আর আলো জ্বলবে না এবার থেকে। লোক চলবে না। ইতিহাস থেকে বনমালী সরকার বিলুপ্ত হয়ে যাবে শেষ পর্যন্ত।
বনমালী সরকারের সঙ্গে এই বড়বাড়ির ইতিহাসও তো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কথাটা ভাবতেই ভূতনাথ কেমন যেন অবশ হয়ে এল। তারপর একবার আশে পাশে ছেয়ে নিয়ে টুপ করে ঢুকে পড়লো সদর দরজা দিয়ে। কেউ কোথাও নেই, কে আর দেখতে আসছে তাকে। কিন্তু দেখতে পেলে হয়তো তাকে পাগলই ভাববে। ভূতনাথ পাশের ঘড়িঘরটার নিচে সাইকেলটা হেলান দিয়ে রেখে সোজা চলতে লাগলো।
মনে আছে তখন এই ঘড়িঘরের ঘণ্টার ওপর নির্ভর করেই সমস্ত বাড়িখানা চলতো।
সকাল ছ’টায় বাজতো একটা ঘণ্টা। ব্রজরাখাল উঠতো তারও আগে। তারই মধ্যে তখন তার মুখ ধোওয়া, প্রাতঃকৃত্য সমস্ত শেষ হয়েছে। পাথর বাটিতে ভিজোনো খানিকটা ছোল আর আদা-নুন নিয়ে কচ কচ করে চিবোচ্ছে।—ওঠো হে বড়কুটুম, ওঠো, ওঠো-ব্রজরাখাল ঘন ঘন তাগাদা দেয়।
আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে উঠে বসতে দু’চার মিনিট দেরিই লাগে ভূতনাথের। তখনও একতলার আস্তাবল থেকে ঘোড়া ডলাই-মলাই-এর শব্দ আসে। ছপছপছপ-ছ—হিস্স্-হিস্স্–ক্লপ-ক্লপ! ও-ধারে দরোয়ান ব্রিজ সিং আর নাথু সিং-এর ঘরে তখন হু হু করে ডনবৈঠকের আওয়াজ হচ্ছে। সিমেন্টের দাগরাজি করা সামনের উঠোনের ওপর দাসু জমাদারের খ্যাংরা ঝাটার খর-খর শব্দ আসছে। বোঝা যায় সকাল হলো। আর চোখ বুজে থাকা যায় না। ভূতনাথ দেউড়ি পেরিয়ে আরো সামনে এগিয়ে গেল।
বাঁদিকের এই ঘরটার ওপরে থাকতো ইব্রাহিম। ইব্রাহিমের গালপাট্টা দাড়ির কথা এখনও মনে পড়ে ভূতনাথের। একটা কাঠের চিরুণী নিয়ে ছাদের নিচু বারান্দাটায় বসে ইয়াসিন সহিস ইব্রাহিমের লম্বা বাবড়ি চুল আঁচড়ে চলেছে তো আঁচড়েই চলেছে। কিছুতেই আর ইব্রাহিমের মনঃপুত হয় না। ইব্রাহিম কাঠের কেদারাটায় বসে এক মনে বাঁ হাতের কাঠের আশিতে মাথা কাত করে নিজের চুলের বাহারই দেখছে। কোনও দিকে হৃক্ষেপ নেই—তারপর হঠাৎ এক সময় ফট করে উঠে দাঁড়াতে। অর্থাৎ চুলটা বাগানো তার পছন্দ হয়েছে। এবার সে নিজের হাতে চিরুণী নিয়ে বাগাবে পাঠানী দাড়িটা।…এমনি করে চলতে সকাল সাতটা পর্যন্ত।
ভূতনাথ আরো এগিয়ে চললো পায়ে পায়ে ইতিহাসের সিংহদ্বার যেন আস্তে আস্তে খুলছে ওভারসিয়ার ভূতনাথের চোখের সামনে। সন্ধ্যে হয়ে এল। কিন্তু চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর-একশ’–দেড়শ’ বছর পেছনে যেন ভূতনাথ চলে গিয়েছে। কালের নাটমঞ্চ যেন ক্রমশঃ ঘুরতে লাগলো। অষ্টাদশ শতাব্দীর মুর্শিদকুলী খাঁ’র কানুনগোর শেষ বংশধর বদরিকাবাবু যেন সামনের একতলার বৈষ্ঠকখানা-ঘরের শেতলপাটি ঢাকা নিচু তক্তপোশটার ওপর হঠাৎ উঠে বসেছেন।
সাধারণত সমস্ত দিন ওইভাবে ওই তক্তপোশটার ওপরই চিত হয়ে পায়ের ওপর পা দিয়ে শুয়ে থাকেন বদরিকাবাবু। তাঁর ভয়ে ও-ঘর কেউ মাড়ায় না। তবু কাউকে দেখতে পেলেই হলো। ডাকেন। কাছে বসান। টাকে একটা ছোট্ট ঘড়ি। বলেন— বাড়ি কোথায় হে ছোকরা?
–বাপের নাম কী?
–গাঁ? কোন জেলা?
—বামুন কায়েত ক’ ঘর?
–বিঘে প্রতি ধান হয় কত?
—দুধ ক’ সের করে পাও?
এমনি অবান্তর অসংখ্য প্রশ্ন। ব্যতিব্যস্ত করে ছাড়েন সবাইকে। গ্রীষ্মকালে খালি গা। একটা চাদর কাঁধে। আর শীতকালে একটা তুলোর জামা। প্রথমটা কেউ সন্দেহ করে না। সরল সাধাসিধে মানুষ। তারপর যখন শুরু করেন গল্প—সে-গল্প আর শেষ হতে চাইবে না। মুর্শিদকুলি খাঁ থেকে শুরু করে লর্ড ক্লাইভ হালসীবাগান, কাশিমবাজার আর…ফিলিপ ফ্রান্সিস, ওয়ারেন হেস্টিংস…নন্দকুমার—
সব শুনতে গেলে আর ধৈর্য থাকে না কারো। তারপর যখন রাত ন’টা বাজে, তোপ পড়ে কেল্লায়, তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বসেন বদরিকাবাবু। হাই তোলেন লম্বা একটা। তারপর দুটি আঙুলে তুড়ি দিয়ে একবার চিৎকার করে ওঠেন—ব্যোম্ কালী কলকাত্তাওয়ালী। তারপর টাকঘড়িটা বার করে মিলিয়ে নেন সময়টা।
বাঁ ধারে বদরিকাবাবুর বৈঠকখানাআর ডানদিকে খাজাঞ্চীখানা। খাজাঞ্চীখানা মানে বিধু সরকারের ঘর। সামনে একটা ঢালু কাঠের বাক্স নিয়ে বসে থাকে বিধু সরকার। চশমাটা ঝুলছে নাকের ওপর। মাদুরের ওপর উবু হয়ে বসে চাবি দিয়ে খোলন বাক্সটা। ভারি নিষ্ঠা বিধু সরকারের ওই ক্যাশবাক্সটি আর ওই চাবির গোছাটির ওপর। প্রতিদিন ঠনঠনে কালীবাড়ির ফুল আর তেল সিঁদুর আসে তার জন্যে। বিধু সরকার নিজের হাতে চাবির ফুটোটার তলায় ত্রিশূল এঁকে দেয় একটা। আর একটা ত্রিশূল আঁকে পশ্চিমের দেয়ালে আঁটা লোহার সিন্দুকটার চাবির ফুটোর নিচে।
সামনে বরফওয়ালা মেঝের ওপর ঠায় বসে আছে পাওনা টাকার তাগাদায়। সেদিকে বিধু সরকারের নজর দেবার কথা নয়।
ত্রিশূল আঁকার পর বিধু সরকার ক্যাশবাক্সটি খুলবে। খুলে ফুলটি রাখবে তলায়। তারপর বার করবে ছোট একটি ধুনুচি। বিধু সরকারের নিজস্ব ধুনুচি। একটি ছোট কোটো থেকে বেরুবে ধুনো, বেরুবে কাঠ কয়লা আর একটি দেশলাই। দেশলাইটি জ্বালিয়ে আগুন ধরাবে ধুনোয়। তারপর ঘন ঘন পাখার হাওয়া। করতে করতে যখন গল্ গল্ করে ধোঁয়া বেরুবে, ধোঁয়ায় চোখ নাক মুখ অন্ধকার হয়ে আসবে বিধু সরকারের, তখন সেই মজার কাণ্ডটি করে বসবে। আগুন সমেত ধুনুচিটি বাক্সর মধ্যে বসিয়ে বাক্সর ডালাটি ঝপাং করে বন্ধ করে দেবে। নিচু হয়ে বাক্সে মাথা ঠেকিয়ে অনেকক্ষণ ধরে নমস্কার করবে বিধু সরকার। তারপর মাথা তুলে। বাক্স খুলে ধুনুচি বার করে আবার ডালা বন্ধ করবে। তখন কাজ আরম্ভ করার পালা। সামনের দিকে চেয়ে বলবে-এবার বলো তোমার কথা।
বিধু সরকারের মতো খাজাঞ্চীর কাজে এমন নিষ্ঠা ভূতনাথ আর কারও দেখেনি।
দু’পাশে দুটি ঘর, মধ্যেখান দিয়ে বারবাড়িতে ঢোকবার রাস্তা। রাস্তার ওপাশেই বারমহলের উঠোন। উঠোনের দক্ষিণমুখে পূজোর দালান। সেই পূজোর দালানটা এখনও যেন তেমনি আছে। আশে পাশের আর সবই গিয়েছে বদলে। শ্বেতপাথরের সিঁড়ির টালিগুলো সবই প্রায় ভাঙা। বোধহয় এখনও পূজোট। চলছিল। ওটা বন্ধ হয়নি।
একবার নবমী পূজোর দিন একটা কাণ্ড হয়েছিল। শোনা গল্প। এই বাড়িতে এখানেই ঘটেছিল।
পূজো টুজো সব শেষ হয়ে গিয়েছে। প্রাসাদ বিতরণ হচ্ছে। রাঙাঠাকমা তসরের কাপড় পরে পুরুমশাই-এর জন্যে নৈবেদ্যর থালাগুলো সাজিয়ে গুণে গুণে তুলছে। ওধারে উঠোনে রান্নাবাড়িতে, গোলাবাড়িতে, আস্তাবলবাড়িতে যে-যেখানে ছিল সবাই ছুটে এসেছে। প্রসাদ পাবে। ভেতরে অন্দরমহলের জন্যে বারকোষ ভর্তি প্রসাদ গেল ঠিকে লোকদের মাথায় মাথায়।
ওদিকে ভিস্তিখান, তোশাখানা, বাবুর্চিখানা, নহবৎখানা, দপ্তরখানা, গাড়িখানা, কাছারিখানা সমস্ত জায়গায় যারা কাজের জন্যে আসতে পারেনি, আটকে গিয়েছে তাদের কাছেও পাঠিয়ে দেওয়া হলো।
দরদালান, দেউড়ি, নাচঘর, স্কুলঘর, সব জায়গায় সবাই প্রসাদ খাচ্ছে। হঠাৎ এদিকে এক কাণ্ড হলো।
–খাবো না আমি–
–-কেন খাবিনে—
–পূজো হয়নি—
—সে কি–কে তুই—
–আমি হাবু—
–কোথাকার হাবু? কাদের হাবু? বাড়ি কোথায় তোর?
আশে পাশে ভিড় জমে গেল। সবাই জিজ্ঞেস করে—কী হলো? কে ও? কাদের ছেলে? কিন্তু চেহারা দেখেই তো চিনতে পারা উচিত। পাগলই বটে! পাগলা হাবু। বাপের জন্মে কেউ মনে করতে পারলে না যে দেখেছে ওকে কোথাও। আধময়লা কাপড়, খালি গা, এক পা ধুলো, চুল একমাথা। উদাস দৃষ্টি! খেলো না তো বয়ে গেল। সেধো না ওকে। কলাপাতা আসন পেতে রূপোর গেলাস দিয়ে আসুন বসুন করতে হবে নাকি! দাও তাড়িয়ে। হাঁকিয়ে দাও দূর করে।
মেজকর্তা খবর পেয়ে ছুটে এলেন। মেজকর্তা শুধু নামে–আসলে কিন্তু মেজকর্তাই মালিক। সারা গায়ে গরদের উড়নি, পরনে গরদের থান। কপালে চন্দনের ফোটা। ভারিক্কী মানুষ। নিখুত করে দাড়ি কামানো—শুধু তীক্ষ একজোড়া গোঁফ মুখের দু’পাশে সোজা ছুঁচলো হয়ে বেরিয়ে রয়েছে। গায়ে আতরের গন্ধ কিন্তু আতরের গন্ধকে ছাপিয়েও আর একটা তীব্র গন্ধ আসছে গা থেকে। যারা অভিজ্ঞ তারা জানে ওটা ভারি দামী গন্ধ। দামী আতরের গন্ধের চেয়েও আরো দামী। মেজকর্তাকে দেখে সবাই সরে দাঁড়ালো। এসে বললেন—কই দেখি–
দেখবার মতো চেহারা নয় তার। ভয় নেই। ও নেই। মেজকর্তাকে দেখে নমস্কার করাও নেই। শুধু একদিকে আপন মনে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।
একবার জিজ্ঞেস করলেন-প্ৰসাদ খাবিনে কেন?
—আজ্ঞে পূজো হয় নি—
—পূজো হয়নি মানে—
–পিতিমের পাণ পিতিষ্ঠে হয়নি—
মেজকর্তা হাসলেন না। কিন্তু হাসলেন রূপলাল ভট্টাচার্য। পাশে তিনিও এসে দাঁড়িয়েছিলেন। পায়ে খড়ম। পরনে কোসার থান। গায়ে নামাবলী। মাথার লম্বা শিখায় গাঁদা ফুল। বললেন—পাগলের কথায় কান দেবার প্রয়োজন নেই বাবাজী-তুমি এসো।
কিন্তু মেজকর্তা সহজে ছাড়বার পাত্র নন। বললেন-না ঠাকুরমশাই, আমার বাড়িতে বসে অতিথি নবমীর দিন অভুক্ত থাকবে—এটা ঠিক নয়।
রূপলাল ঠাকুর কেমন যেন চিন্তিত হলেন। জিজ্ঞেস করলেনপ্রতিমার প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়নি তুই বুঝলি কিসে?
পাগলা হাবু বললে–মা তো নৈবিদ্যি খায়নি।
রূপলাল ঠাকুর এবার বিরক্ত হলেন।
আশে পাশের ভিড়ের মধ্যে যেন একটা কৌতুক সঞ্চার হয়েছে!
রূপলাল ঠাকুর এবার জিজ্ঞেস করলেন-প্রাণ প্রতিষ্ঠা তা হলে কীসে হবে?
—আমি পিতিষ্ঠে করবো!
–বামুনের ছেলে তুই?
—আজ্ঞে মায়ের কাছে আবার বামুন শুদ্দুর কী—মা যে জগদম্বা জগজ্জননী।
পাগলা হাবুর কথায় যেন সবাই এবার চমকে গেল। নেহাৎ বাজে কথা নয় তো। মেজকর্তা কেমন যেন মজা পাচ্ছেন মনে হলো। তিনি যেন অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশি মৌজে আছেন। আজ কেমন যেন মিষ্টি মিষ্টি হাসি হাসছেন।—তা কর তুই প্রাণ প্রতিষ্ঠা—বলছে যখন, তখন করুক ও।
রূপলাল ঠাকুর প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বৃথা। মেজকর্তার ওপর কথা বলা চলে না।
ততক্ষণ খবর ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। বারমহল ঝেটিয়ে এসে জুটেছে পূজোর দালানে। কেউ বলে ছদ্মবেশী সাধু বটে। পাগলাটার সঙ্গে কথা বলবার লোভ হচ্ছে। রান্নাবাড়ি থেকে ঠাকুররা এসেছে রান্না ফেলে। শুধু মেজকর্তার ভয়ে কেউ বেশি এগোতে সাহস পায় না। দাসু মেথর আজ ছেলেমেয়ে নাতি নাতনি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক কোণে। নিজে পরেছে চীনা-সিল্কের গলাবন্ধ কোট—আর বউ ছেলে-মেয়েদেরও গায়ে নতুন জামা-কাপড়-শাড়ি।
পাগলা হাবুকে নিয়ে যাওয়া হলে পূজোমণ্ডপে। পূজোর দালানের ভেতর।–কর প্রাণ প্রতিষ্ঠে-কর তুই।
—কলার বাশ্না দাও—
—কলার বাশ্না কী হবে—
—আগে দাওই না, দেখোই না, কী করি–
এল গাদা গাদা কলার বাশ্না দক্ষিণের বাগান থেকে। মেজকর্তার হুকুম। দেখাই যাক না মজা। পূজোর বাড়িতে মজা করতে আর মজা দেখতেই তো আসা। ভিড় করে সবাই দাঁড়ালো শ্বেত মার্বেল পাথরের সিঁড়ির ওপর। ঝুঁকে দেখছে সামনে পাগলা হাবুর দিকে।
পাগলা হাবু কিন্তু নির্বিকার। ধারালো কাটারি দিয়ে কলার বাশ্নাগুলো ছোট ছোট করে কাটলে। তারপর এক কাণ্ড! সেই এক-একটা বাশ্না নেয় আর কী মন্ত্র পড়ে, আর জোরে জোরে ছুঁড়ে মারে প্রতিমার গায়ে, মুখে, পায়ে, সর্বাঙ্গে।
রূপলাল ঠাকুর বাধা দিতে যাচ্ছিলো হাঁ হাঁ করে। কিন্তু মেজকর্তার দিকে চেয়ে আর সাহস হলো না। মেজকর্তা তখন এক দৃষ্টে পাগলা হাবুর দিকে চেয়ে মিষ্টি মিষ্টি হাসছেন।
পাগলা ততক্ষণ মেরেই চলেছে। সে কী জোর তার গায়ে। হঠাৎ সবাই অবাক হয়ে দেখলে দুর্গা প্রতিমার শরীর দিয়ে আঘাতের চোটে রক্ত ঝরছে। এক-একটা বাশ্না ছুঁড়ে মারে পাগলা, আর ঠাকুরের গায়ে গিয়ে সেটা লাগতেই রক্ত ঝরে পড়ে সেখান থেকে। সমস্ত লোক হতভম্ব।
শেষে এক সময় পাগলা থামলো। মেজকর্তার দিকে চেয়ে বললে—হয়েছে, এবার মায়ের পাণ পিতিষ্ঠে হয়েছে, এবার পেসাদ খাবো, দাও।
সে কী ভিড়। তবু সেই ভিড়ের মধ্যেই প্রসাদ আনতে পাঠানো হলো। দেখতে দেখতে খবর রটে গিয়েছে এ-বাড়ি ও-বাড়ি, এ-পাড়া, সে-পাড়া। হাটখোলার দত্তবাড়ি, পোস্তার রাজবাড়ি, ঠনঠনের দত্তবাড়ি, শোভাবাজারের রাজবাড়ি, জোড়াসাঁকোর ঠাকুর-বাড়ি, মল্লিকবাড়ি, সব জায়গা থেকে লোকের পর লোক আসতে লাগলো।
এদিকে ভেতরবাড়ি থেকে প্রসাদ আনানো হয়েছে। ভালো করে বসিয়ে প্ৰসাদ খাওয়ানো হবে, মেজকর্তার হুকুম।
কিন্তু পাগলা হাবু উধাও।
খোঁজ খোঁজ-কোথায় গেল। দশজন লোক দশদিক খুঁজতে গেল। কোথাও নেই সে। পাগলা হাবু সেই যে গেল আর কেউ দেখেনি তাকে কোনদিন।
তখনও লোকের পর লোক আসছে। সবাই দেখতে চায় পাগলা হাবুকে। প্রতিমার শরীরে তখনও রক্ত লেগে আছে। টাটকা রক্ত। সেই ভিড়, সেই লোকারণ্য চললে সমস্ত দিন, সমস্ত রাত ধরে—
পুরনো বড়বাড়ির ধ্বংসস্তুপের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে ভূতনাথ অতীতের আবর্তে ড়ুবে গিয়েছিল যেন। হঠাৎ এক সময় বংশী এসে ডাকতেই ভূতনাথের চটকা ভাঙলো।
—শালাবাবু—
–আমাকে ডাকছিস বংশী–ভূতনাথ ফিরে তাকালো।
—ছোটমা আপনাকে একবার ডাকছে যে—
আজ আর সে-বয়েস নেই ভূতনাথের। এখন অনেক বয়েস হয়েছে। কিন্তু তবু এই নির্জন শ্মশানপুরীতে দাঁড়িয়ে সেদিনকার ছোটবৌঠানের ডাক যেন অমান্য করতে পারলো না সে। আজ সে-বাড়ি আর সে-রকস নেই। পার্টিশনের ওপর পার্টিশন হয়ে হয়ে অতীতের স্মৃতিসৌধের সিং-দরজা, প্রায় বন্ধ হবার যোগাড়। তবু ছোটবৌঠানের ডাক শুনে কেমন করে ভূতনাথই বা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে।
-তুই চল বংশী, আমি এখুনি আসছি—ভূতনাথ উঠলো। বারমহল পেরিয়ে অন্দর মহল। অন্দর মহলে ঢুকতেই যেন সেই গিরির সঙ্গে হঠাৎ মুখোমুখি দেখা। গিরি মেজগিন্নীর পান সাজতে এসেছে। পান নিতে এসে ঝগড়া বাধিয়েছে সদুর সঙ্গে। সদু হলো সৌদামিনী।
সৌদামিনীর গলা খুব। বলে—আ ভগমান, কপাল পুড়েছে বলেই তো পরের বাড়িতে গতর খাটাতে এইচি
—গতরের খোটা দিমনি সদু, তোর গতরে পোকা পড়বে— সেই পোকাশুদ্ধ গতর আবার নিমতলার ঘাটে মুদ্দোফরাসরা পুড়োবে একদিন, দেখিস তখন–
—হালা গিরি-গতরের খোটা আমি দিলুম না তুই দিলি—যারা গতরখাকী তারাই জন্ম জন্ম গতরের খোঁটা দিক—
—কী, এত বড় আস্পদ্দা—আমাকে গতরখাকী বলিস—বলচি গিয়ে মেজমা’র কাছে—বলে দুম দুম্ করে কাঠের সিঁড়ির ওপর উঠতে গিয়ে সামনে ভূতনাথকে দেখেই যেন থমকে দাঁড়ালো গিরি তারপর জিভ কেটে এক গলা ঘোমটা দিয়ে একপাশে সরে দাঁড়িয়ে রাস্তা করে দিলে।
সেই নির্জন সিঁড়ি। সেই নিরিবিলি অন্দর মহল। কোথায় গেল সেই যদুর মা। সিঁড়ির ওপাশে রান্নাবাড়ির লাগোয়া ছোট্ট ঘরখানাতে বসে কেবল বাটনা বেটেই চলেছে। হলুদ আর ধনে বাটনার জল গড়িয়ে পড়ছে রোয়াক বেয়ে নর্দমার ভেতর। কখন সূর্য ড়ুবতো, কখন উঠতো, কখন বসন্ত আসতো, শীত আসতে আবার চলেও যেতো, খোঁজও রাখতে না বুড়ী। যখন কাজ নেই, দুপুরবেলা, তখন হয়তো ডাল বাছতে বসেছে। সোনামুগের ডাল, খেসারি, মসুর, ছোলা-আরো কতরকমের ডাল সব। কখনও কথা ছিল না মুখে। শুধু জানতে কাজ। কাজের ফুটো দিয়ে কোন ফাঁকে কখন তার জীবনটুকু নিঃশেষ হয়ে ঝরে পড়ে গিয়েছে—কেউ খবর রাখেনি। সিঁড়ি দিয়ে ভূতনাথ উঠতে যাবে, হঠাৎ আবার পেছনে ডাক—
—শালাবাবু—ও শালাবাবু–
ভূতনাথ পেছন ফিরে তাকালো। শশী ডাকছে।—শিগগির আসুন–
-কেন?
—ছুটুকবাবু ডাকছে—গোঁসাইজী আসেনি—আসর আরম্ভ হচ্ছে না–
ছুটুকবাবুর আসরে তবলচী বুঝি অনুপস্থিত। ছুটুকবাবু বসবে তানপুরা নিয়ে। ওদিকে কান ধীরু ইমনের খেয়াল ধরেছে আর গোঁসাইজী তবলা। সমের মাথায় এসে সে কী হা-হা-হা-হ্যাঁ চিৎকার। ঘর বুঝি ফেটে যায়। অনেক রাত পর্যন্ত চলবে আসর। এক-একদিন মাংস হবে। মুরগীর ঝোল আর পরটা। আর পর্দার আড়ালে এক-একবার এক-একজন উঠে যাবে আর মুখ মুছতে মুছতে ফিরে আসবে।
ছুটুকবাবুর মলমলের পাঞ্জাবি তখন ঘামে ভিজে গিয়েছে। কপালে দর দর করে ঘাম ঝরছে। গলার সরু সোনার চেনটা চি চিক্ করছে ইলেকটিক আলোয়। তালে তালে মাথা দুলবে ছুটুকবাবুর। বলবে কুছ পরোয়া নেই—শালাবাবু, তুমি এবার থেকে তবলার ভারটা নাওগোঁসাই-এর বড় গ্যাদা হয়েছে—শশী কাল গোঁসাই এলে তুই জুতো মেরে তাড়াবি-বুঝলি—এবার দেখাচ্ছি গোঁসাই-এর গ্যাদা।
কিন্তু ব্ৰজরাখালের কথাটা ভূতনাথের আবার মনে পড়ে ওদের সঙ্গে অত দহরম-মহরম কেন ভূতনাথ, বাবুরা হলো সায়েবের জাত, আর আমরা হলুম ওদের গোলাম—গোলামদের সঙ্গে কি সায়েব-বিবির মেলে খুব সাবধান ভূতনাথ খুব..
ভূতনাথ শেষ পর্যন্ত বললে—ছুটুকবাবুকে গিয়ে বল শশী ছোটমা আমাকে ডেকেছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলো ভূতনাথ। দোতলায় উঠে লম্বা বারান্দা। ডানদিকে রেলিং ঘেরা। চক্-মিলানো মহল। চারদিকে ঘের রেলিং—রেলিং-এর ওপর ঝুকলে নিচে একতলার চৌবাচ্চা আর উঠোন দেখা যায়। রান্নাবাড়ি থেকে রান্না করে সেজখুড়ী একতলার রান্নার ভাঁড়ারে ভাত ডাল তরকারী এনে সাজিয়ে রাখে। এখানে দাঁড়ালে আরো দেখা যায় যদুর মা শিল নোড়া নিয়ে দিনের পর দিন হলুদ বেটেই চলেছে। আর তার পাশের জানালা দিয়ে দেখা যায় আনাজঘরের এক টুকরো মেঝে— সেইখানে হয়তো সৌদামিনী ঝি তারকেশ্বরের বিরাট একটা বঁটি পেতে আলু বেগুন কুমড়ো কুটছে। চারদিকে কাঁচা আনাজের পাহাড় আর তার মধ্যে সদু একলা বঁটি নিয়ে ব্যস্ত। কিম্বা হয়তো পান সাজছে—খিলি তৈরি করছে—কিম্বা বিকেল বেলা প্রদীপের সুলতে পাকাতে বসেছে—জানালার ওই ধারটিতে ছিল সদুর বসবার জায়গা। হাতে কাজ চলছে আর মুখও চলছে তার। কার সঙ্গে যে কথা বলছে কে জানে। যেন আপন মনেই বকে চলে—আ মরণ, চোক গেল তো তিভূবন গেল-ভোলার বাপ তাই বলতো– ফুলবউ, চোক কান থাকতে থাকতে তিভুবন চিনে নাও–তা সে ভোলার বাপও নেই, ভোলাও নেই—আমি মরতে পরের ভিটেয় পিদিম জ্বলছি—আর আমার সোয়ামীর ভিটে আজ অন্ধকার ঘুরঘুটি।
যদুর মা’র কানে যায় সব। কিন্তু সে কারো সাতেও নেই পাঁচেও নেই। কিন্তু হঠাৎ গিরির কানে যেতেই বলে-কার সঙ্গে বক্ বক্ করছিস লা সদু—এবার হঠাৎ চুপ হয়ে যায় সৌদামিনী।
ভূতনাথ রেলিং ধরে ধরে এগুতে লাগলো। ভাঙা রেলিং-এর ফাঁকগুলো যেন উপপাসী জন্তুর মতো হাঁ করে আছে। এর পর ডাইনে বেঁকে, বাঁদিকে ঘুরে-এ-গলি সে-গলি পার হয়ে উত্তরদিকে। তিনচারটে ধাপ উঠে পড়বে বউদের মহল। আকাশ-সমান উচু কাঠের ঝিলিমিলি দিয়ে ঢাকা। আর তার সামনে দক্ষিণমুখখা সার-সার বউদের ঘর। ছোটবৌঠানের ঘর একেবারে শেষে। ডানদিকে প্রথমেই বড় বউ-এর ঘর। তিনি বিধবা। কোথা থেকে যে এ-বাড়ির সব বউরা এসেছিল! মেম-সায়েবদের মতো গায়ের রং। ফরসা দুধে-আলতার ছোপ। বড় বউ-এর বয়েস হয়েছে, তবু চেহারায় বয়েস ধরবার উপায় নেই। পরনে সাদা ধবধবে থান।
ভূতনাথকে দেখে সিন্ধু সরে দাঁড়ালো। বড় বউ-এর ঝি সিন্ধু।
ভেতর থেকে গলার আওয়াজ এল—ওখানে কে রে সিন্ধু।
ভূতনাথ শুনতে পেলে সিন্ধু বলছে—মাস্টারবাবুর শালা।
তারপরেই মেজগিন্নীর ঘর। পর্দাটা ভোলা। ভূতনাথের নজরে পড়লো এক পলক। মেজগিন্নী মেঝের ওপর বসে তাকিয়া হেলান দিয়ে গিরির সঙ্গে বাঘ-বন্দী খেলছেন। চোখ সরিয়ে নিয়ে ভূতনাথ একেবারে শেষ ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
পায়ের আওয়াজ পেতেই কে দরজা খুলে দিলে যেন। কত বছর আগের ঘটনা। তবু অতীতের মায়াঞ্জন যেন আজো চোখে লেগে আছে স্পষ্ট। ভূতনাথ যেন আজ স্মৃতির পাখীর পিঠে চড়ে বর্তমানের লোকালয় ছেড়ে অতীতের অরণ্যে ফিরে গিয়েছে।
ছোটবৌঠান দরজা খুলে ডাকলে—কে ভূতনাথ-আয়।
হঠাৎ দুটো হাত ধরে ফেলেছে পটেশ্বরী বৌঠান।একটা কাজ তোকে করতে হবে ভাই—বলে ছোটবৌঠান তার কালো কালো চোখ দুটো তুলে সোজা তাকালো ভূতনাথের মুখের ওপর।—সেইজন্যেই তোকে ডাকা।
–কী কাজ-বলো না–
—এই নে টাকা—বলে ভূতনাথের হাতের মুঠোর মধ্যে গুজে দিলো টাকাটা।
—কী আনবে এতে? ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে।
—মদ—গলাটা নিচু করে ছোটবৌঠান বললে।
সত্যি চমকে উঠেছে ভূতনাথ। মদ? কানে ঠিক শুনেছে তো সে।
-হ্যাঁ মদ—
—এতো রাত্তিরে—
–হ্যাঁ যেখান থেকে পারিস যেমন করে পারিস—খুব ভালো মদ, খুব দামী। কিন্তু এততেও যেন স্বস্তি পেলে না ছোটবৌঠান। হঠাৎ কান থেকে হীরের কানফুলটা খুলে ভূতনাথের মুঠোর মধ্যে পুরে দিলে ছোটবৌঠান জোর করে। বললেও টাকাতে যদি না কুলোয় তো এটাও রেখে দে ভাই—
–এ কী করলে, এ কী করলে তুমি বৌঠান—চিৎকার করে উঠলে ভূতনাথ। চিৎকার শুনে পাশের ঘর থেকে ছুটে এসেছে গিরি, মেজগিন্নী, সিন্ধু আর বড় বউ। কী হলো? কী হলো রে ছোট বউ?
হঠাৎ যেন নিজের চিৎকারে নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছে ভূতনাথ। ছোটবৌঠান নয়, ভূতনাথই লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো যেন। বুড়ো বয়েসে এ কি করলে সে। কেউ তো কোথাও। নেই। সে তো আজ একলাই দাঁড়িয়ে আছে ভাঙা বাড়িটার মাথায়। সে তো ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের ওভারসিয়ার ভূতনাথ : ভূতনাথ চক্রবর্তী। নিবাস—নদীয়া, গ্রাম—ফতেপুর, পোস্টাপিস—গাজনা। কোনও ভুল নেই। হীরের কানফুল আর টাকাটা আর একবার দেখবার জন্যে হাতের মুঠো খুলতেই ভূতনাথের নজরে পড়লোকই কিছু তো নেই, শুধু সাইকেলের চাবিটা রয়েছে মুঠোর মধ্যে। হঠাৎ কেমন যেন ভয় হতে লাগলো ভূতনাথের। এ অভিশপ্ত বাড়ি। ভালোই হয়েছে এর ধ্বংস হচ্ছে। এই এত উঁচু থেকে লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে হলো তার। কেউ কোথাও নেই। বিষাক্ত বাড়ির আবহাওয়া ছেড়ে সে যতো শিল্পীর বেরিয়ে যেতে পারে ততই মঙ্গল। কালই চরিত্র মণ্ডল এখানে এসে গাঁইতি বসাবে। বনমালী সরকার লেন-এর স্মৃতির সঙ্গে চৌধুরী পরিবারের ইতিহাসও বিলুপ্ত হয়ে যাবে একেবারে। তাই যাক। তাই যাক। তাই ভালো।
অন্দরমহল, রান্নাবাড়ি, বারবাড়ি, বৈঠকখানা, দপ্তরখানা, দেউড়ি সব পেরিয়ে ভূতনাথ একেবারে সাইকেলটা নিয়ে উঠতে যাবে—এমন সময় কাপড় ধরে কে যেন টানলে—ভয়ার্ত একটা চিৎকার করতে যাচ্ছিলো ভূতনাথ। কিন্তু ভালো করে চেয়ে দেখতেই একটা লাথি ছুড়লো—দূর–দূর হবেরো—সেই কুকুরটা! অনেকদিন আগে আর এক দিন এমনি করে এ-বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় যে বাধা দিয়েছিল সে ছোটবৌঠান। আর আজ বাধা দিলে এই কুকুরটা।
সাইকেল চড়ে অন্ধকার বনমালী সরকার লেন দিয়ে চলতে চলতে ভূতনাথের মনে হলো অর সমস্ত অতীতটা যেন ওই কুকুরের মতো তাকে আজ কেবল পেছু টান দিতে চেষ্টা। করছে। ওই কুকুরটার মতোই তার অতীত কালো, বিকলাঙ্গ, মৃতপ্রায় আর অস্পষ্ট।
ভূতনাথের সাইকেলের চাকার ঘূর্ণায়িত তরঙ্গে ক্রমে ক্রমে উদ্বেলিত হতে লাগলো তার বিস্মৃত প্রায় কাহিনী-মুখর অতীত।