টালির ঘরের বাড়ি
পাশাপাশি দুটো টালির ঘরের বাড়ি। ঘরের মেঝে শুধু সিমেন্টের। মাটির দেয়াল। সামনে উঠোন। উঠোন পেরুলে ফ্যাক্টরি। ফ্যাক্টরি বলতে টিনের চালার বড় ঘর আর একটা। তাতে গোটা দুই পুরনো তাত, ঝরঝরে পাওয়ার মেশিন একটা, আর তেমনি কুড়িয়ে পাওয়া গোছের আনুষঙ্গিক কিছু সরঞ্জাম। অন্ধকারে ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকিয়ে নবাগতা শুধু ঘর ক’টাই দেখল।
দু ঘরের একটা ঘরে যশোমতীকে ঢুকিয়ে দিয়ে দিদিকে নিয়ে এদিকের ঘরে এলো শঙ্কর। ভাইয়ের সঙ্গে হঠাৎ এ-রকম সুশ্রী একটা মেয়েকে দেখে দিদি অবাক। তার থেকে আরো বেশি অবাক বোধহয় পাঁচ বছরের ভাগ্নেদেবরাজ ওরফে রাজু। মামাকেসে-ই আগে দেখেছে। তার সঙ্গে রমণীমুর্তি দেখে সে-ই আগে হতভম্ব হয়েছে। কিন্তু চিন্তাশক্তি তার রীতিমত চটপটে। প্রথমে যা মনে এলো তাই অবধারিত সত্যি ধরে নিল। মায়ের কাছে যেমন শোনা ছিল, অর্থাৎ মামার ঘরে একজনেরই আসতে বাকি–সে মামী। সেটাই সে ভেবে নিয়েছে তৎক্ষণাৎ। চোখ বড় বড় করে আগে যশোমতীকে দেখেছে একটু, তারপরেই ঘুরে মায়ের উদ্দেশে চিৎকার।মা! দেখো এসে–মামা মামী নিয়ে এসেছে।
মামার মেজাজ এমনিতেই সপ্তমে চড়া। ভাগ্নের এরকম উত্তেজিত এবং উল্লসিত অভ্যর্থনার জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিল না সে। চিড়বিড় করে উঠেছে সঙ্গে সঙ্গে।–দেব এক চড়ে মুণ্ডু ঘুরিয়ে, যা বেরো এখান থেকে।
মামার উগ্র মূর্তি দেখে ছেলেটা সভয়ে দুপা সরে গেল। তারপর ফ্যালফ্যাল করে অপরিচিতার দিকে চেয়ে রইল। মামার এ-রকম ক্ষেপে ওঠার মতো অন্যায়টা কি করল, বোঝার চেষ্টা। যশোমতী হতচকিতের মতো দাঁড়িয়ে গেছে। সমস্ত মুখ লাল। ফুটফুটে হতভম্ব ছেলেটাকে হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিতেও ইচ্ছে করেছে। কিন্তু ভরসা করে পারেনি।
দিদি ছেলের ডাক শুনে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে ততক্ষণে। বিধবা। যশোমতীকে দেখে তারও বিস্ময়ের সীমা-পরিসীমা নেই। শঙ্করের তাতেও বিরক্তি। জীবনে মেয়ে যেন এই প্রথম দেখল।
ভালো করে আর একবার দেখে নিয়ে বিস্ময় সামলে দিদি অনুচ্চ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, কে…?
বলছি। যশোমতীর দিকে ফিরে শঙ্কর বলল, আপনি ওই ঘরে গিয়ে বসুন–
বসতে বলার এই সুরটাও আর যাই হোক খুব সদয় আপ্যায়নের মতো নয়। দ্বিধান্বিত পায়ে যশোমতী দরজার পাশে জুতো খুলে সামনের ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়াল। ঘরে ইলেট্রিক নেই। এক কোণে একটা ছোট লণ্ঠন জ্বলছে। রাতে সাদাটে আলো দেখা অভ্যস্ত চোখ বড় বড় হয়ে উঠেছে। এই আলো ঘরের অন্ধকার দূর করলেও যশোমতীর অস্বস্তি বাড়িয়েছে।
দিদিকে নিয়ে শঙ্কর পাশের ঘরে এলো। দু ঘরের মাঝের দেয়াল আর ছাদের মধ্যে দু হাত প্রমাণ ফাঁক। অর্থাৎ, দেয়ালটা একটাই বড় ঘরের পার্টিশনের মতো। ও-ঘরের কথা এ-ঘরে স্পষ্টই শোনা গেল। যশোমতী শোনার জন্য কান পেতেছেও। আর ও-ঘরে কথা যে বলছে, সে আর কেউ শুনছে কি না-শুনছে সেই পরোয়াও করে না বোধহয়।
অল্প দু-চার কথায় দাদার বাড়ি ছেড়ে মেয়েটার চাকরির চেষ্টায় আসার ইতিবৃত্তি শেষ করল শঙ্কর। বুদ্ধি থাকলে কেউ এভাবে আসে না সেই মন্তব্যও জুড়ল। একা পথে-ঘাটে বেরোয় নি, বাসে ব্যাগ হারানোটাই তার প্রমাণ–সেই মতও ব্যক্ত করল। তারপরেই নিজের লোকসানের খেদ। দেখা হওয়ার পর থেকে শুধু খরচাই যে হয়েছে, এমন কি খবরের কাগজটাও যে খোয়া গেছে, সেই বিরক্তিও গোপন থাকল না। বলল, বাসের টিকিট কেটে দিয়েছি, ট্রেনের টিকিট কেটেছি আর জরিমানা দিয়েছি, তারপর রিকশা ভাড়া দিয়ে সমস্ত পথ হেঁটে এসেছি-বুঝলে?
দিদির বরং সন্ত্রস্ত চাপা গল কানে এলো যশোমতীর, চুপ কর, শুনতে পাবে যে! ভদ্রলোকের মেয়ে বিপদে পড়েছে, খরচা হয়েছে হয়েছে।
ফলে পুরুষকণ্ঠ আরো চড়ল, শুনতে পাবে তার কি, আমি কি মিছে কথা বলছি।
এ-ঘরে দাঁতে করে ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে আছে যশোমতী। সামনে একটা চৌকিতে বিছানা পাতা। ক্লান্ত লাগলেও বসেনি।
আরো কানে এল। দিদি বলছে, আ-হা, মুখখানা বড় সুন্দর, বেশ বড় ঘরের মেয়েই মনে হয়, ভাইটা চণ্ডাল ছাড়া আর কি। যশোমতীর মুখ লাল, বাসের ব্যাগ চোরকেই আর এক দফা ভস্ম করতে ইচ্ছে করছে তার। দিদি বলে চলেছে, রাজুর হাঁক শুনে আর দেখে আমি তত আকাশ থেকে পড়েছিলাম। বড়লোক ভাই-ভাজের কি-রকম না জানি ব্যবহার নইলে এভাবে বাড়ি থেকে বেরোয়।…. তার ওপর কত রকমের লোক আছে সংসারে, তুই না সেদিন কার কথা বলছিলি, কে এক ব্যবসাদার নিজের ভাইঝিকেসুদ্ধ টেনে এনে কারবারের চটক বাড়াচ্ছে আর বড় বড় লোকদের হাত করছে এও কি ব্যাপার কে জানে, মেয়েটি খুব ভাল না হলে এভাবে বেরিয়ে আসবে কেন? কে ভাই, কি-রকম ভাই তুই খোঁজ-টোজ করেছিলি?
দিদির গলা এবং সমস্ত বক্তব্য খুব কান খাড়া করেই শুনতে এবং বুঝে নিতে হয়েছে যশোমতীকে। শুনে ভুরু কুচকেছে, মুখও আর এক দফা লাল হয়েছে। কিন্তু তবু ওই দিদিটিকে বেশ সরলই মনে হয়েছে তার।
একটু বাদেই ছেলে-সহ দিদি এ-ঘরে এলো। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ব্যস্ত হয়ে বলল, তুমি দাঁড়িয়েই আছ এখনো, বোস বোন, বোসোতোমার কিছু ভাবনা নেই, নিজের দিদির কাছেই এসে পড়ছে ভাবো। সাগ্রহে আবার আপাদ-মস্তক দেখে নিল, তারপর মুখের দিকে চেয়ে হেসে বলল, কিন্তু দিদি হলেও গরীব দিদি, তোমার কষ্ট হবে।
সমস্ত দিনের দুশ্চিন্তার পর এই কথাগুলো যশোমতীর ভালো যেমন লাগল, লজ্জাও তেমনি পেল। দারিদ্রটা যে যশোমতীর চোখে বেশ বড় হয়ে ধাক্কা দিয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। অল্প হেসে বলল, কষ্ট হবে না।
আর একবার তার ঝকমকে গয়নাগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে দিদি বলল, হলেই বা আর কি করবে বলে? এক কাজ করো, কুয়োতলা থেকে একেবারে হাত-মুখ ধুয়ে কাপড় বদলে ঠাণ্ডা হয়ে বসে। খিদেও পেয়েছে নিশ্চয়, রাত না করে আগে খেয়ে নাও তারপর কথা হবে। আমার সঙ্গে এস–
লণ্ঠন তুলে নিয়ে থমকালো।–ও, তোমার তো ব্যাগও চুরি হয়ে গেছে, পরবেই বা কি…আমার তো সবই থান!
যশোমতী তাড়াতাড়ি বলল, এইটেই পরব’খন, আপনি ব্যস্ত হবেন না!
দিদির মনঃপুত হল না, বল, রাস্তার কাপড়, তাছাড়া এই ভাল শাড়িটা নষ্ট হবে
যশোমতী বলতে পারল না এটা তার ভালো শাড়ির মধ্যে গণ্য নয়। তবু যাহোক কিছু বলার আগেই মহিলা এক কাণ্ড করে বসল। এ-ঘরে দাঁড়িয়েই ডাক দিল, শঙ্কর! ওরে শঙ্কর, তুই যা তো, ও-বাড়ির বাচ্চর মায়ের কাছ থেকে একটা ধোয়া শাড়ি চেয়ে আন চট্– করে-হাত-মুখ ধুয়ে এসে মেয়েটা পরবে কি!
হুকুম শুনে যশোমতী তটস্থ। ফলাফল পরক্ষণেই দেখল। গম্ভীর মুখে শঙ্কর দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। যশোমতী মুখ দেখেই বুঝল দিদির ওপর চটেছে।
–সমস্ত দিন বাদে এসে এই রাতে এখন আমি আধ মাইল রাস্তা শাড়ি আনতে ছুটব?
দিদি বলল, তোর সবেতে বেশি-বেশি, সবে তো সন্ধ্যে পার হল, আর এখান থেকে এখানে আধ মাইল হয়ে গেল! যাবি আর আসবি, একটা শাড়ি না পেলে ও পরবে কি?
শঙ্কর সারাভাই সাফ জবাব দিল তোমার যা আছে তাই দাও। আমি এখন যেতে পারব না।
যশোমতী ব্যস্ত হয়ে আবারও কি বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু অবকাশ পেল না। মুখের কথা মুখে থেকে গেল, তার আগেই দিদিটি ক্রুদ্ধ। মেয়েটা বাড়িতে এলো, আর আমি তাকে থান পরতে দেব। কোনো কাণ্ডজ্ঞান আছে তোর? নিজে না যাস, বিহারীকে পাঠা, আমার নাম করে একটা ধোয়া শাড়ি চেয়ে আনে যেন।
যশোমতী সশঙ্কে তাকাল দরজার দিকে, অর্থাৎ দরজার ওধারে যে দাঁড়িয়ে আছে তার দিকে। এবারে তাকেই দু’কথা শোনাবে কিনা কে জানে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখল, রাজ্যের বিরক্তি সত্ত্বেও সে আর দ্বিরুক্তি না করে পায়ে পায়ে প্রস্থানই করল।
একটু চুপ করে থেকে বিব্রত মুখে যশোমতী বলল, আমি সেই থেকে খুব অসুবিধে করছি
দিদির সাধাসিধে কথাগুলো সত্যি মিষ্টি। বলল, অসুবিধে আবার কি! তুমিই কি কম অসুবিধেয় পড়েছ! মুখের দিকে চেয়ে থমকালো একটু, শঙ্কর কিছু বলেছে বুঝি? বকা-ঝকা করেনি তো? ওর কথায় তুমি কান দিও না, ওর ওই রকমই মেজাজ–তার ওপর নড়বড়ে ব্যবসা নিয়ে নাজেহাল হয়ে হয়ে মনটা বিগড়েই আছে। নইলে এমনিতে কারো কষ্ট দেখতে পারে না।
খাওয়া-দাওয়ার পর যশোমতী ঠাণ্ডা হয়ে সুস্থ মাথায় একটু চিন্তা করবে ভেবেছিল। ব্যাগটা চুরি গিয়ে তার ভাবনা কত যে বাড়িয়ে দিয়েছে ঠিক নেই। ওটা সঙ্গে থাকলে আর কিছু না থোক, কথায় কথায় এরকম মর্মান্তিক লজ্জাকর পরিস্থিতিতে পড়তে হত না। শঙ্কর সারাভাইয়ের দিদি ওদিকে খাবার ব্যবস্থা করতে গেছে। যশোমতীর মনে হল দেরি হচ্ছে। মুখ হাত ধোয়া হয়েছে। শাড়িও একটা হয়েছে। এখন তার রীতিমত খিদে পেয়ে গেছে। ফলে আরো খারাপ লাগছে। কিন্তু ঘড়ির দিকে চেয়ে অবাক। রাত মাত্র সাড়ে সাতটা। মনে হচ্ছিল অনেক রাত হয়েছে।
দরজার দিকে চোখ পড়তে সচকিত হল। সেখানে দাঁড়িয়ে গভীর এবং গম্ভীর মনোযোগে তাকে লক্ষ্য করছে পাঁচ বছরের ক্ষুদ্রকায় মূর্তি। রাজু। ভিতরে ঢুকতে খুব ভরসা পাচ্ছে না, কারণ এই একজনকে উপলক্ষ করেই তার কিছু অপমানের কারণ ঘটেছে। নতুন মানুষ দেখেই মায়ের উদ্দেশে ও ভাবে হাঁক দেবার ফলে মামা হঠাৎ এরকম তেড়ে মারতে আসতে পারে-কল্পনাও করেনি। মামা যে রকম মেজাজেই থাকুক না কেন তার সঙ্গে অন্তত এত খারাপ ব্যবহার কখনো করে না। অতএব কৌতূহল সত্ত্বেও সে খুব ভরসা করে অপরিচিতার কাছে এগিয়ে যেতে পারছে না। যদিও ইচ্ছে বেশ করছে, কারণ তার বিবেচনায় কাছে আসার মতোই লোভনীয় মনে হচ্ছে।
এমন এক পরিবেশে এসে পড়ে যশোমতীরও মুখ খুলতে সঙ্কোচ। কিন্তু ছেলেটা ভারী সুন্দর। দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। মুখ না খুলে হাতের ইশারায় তাকে কাছে ডাকল। কিন্তু মনস্থির করে ছেলেটা তবু কাছে এগোতে পারল না। মামা ধারে কাছেই আছে, টের পেলে এসে দু’ঘা বসিয়েই দেবে কিনা ঠিক কি।
যশোমতী উঠে এসে হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে গেল। চৌকির ওপর বসালো। নিজেও বসল।
কি দেখছিলে?
তোমাকে….
আমাকে কেন দেখছিলে?
কথায় ছেলে চটপটে বেশ। জবাব দিল, মা আমাকে বলছিল, তুমি খুব সুন্দর দেখতে।
তক্ষুনি আলাপের প্রসঙ্গ ঘোরাল যশোমতী। তোমার নাম কি।
রাজু। তোমার নাম?
যশোমতী আবার মুশকিলে পড়ল। একটু ভেবে বলল, আমার নাম মাসি।
খুব মনঃপূত হল না যেন। ভয়ে ভয়ে যেন যাচাই-ই করে নিতে গেল।মামী না?
চকিতে দরজার দিকে একবার তাকিয়ে যশোমতী মাথা নাড়ল।-না।
আর একবার তাকে দেখে নিয়ে রাজু মন্তব্য করল, মা তো বলে মামা মামী আনবে। বিহারীকাকাও বলে–
ছেলেটার মাথায় ‘মামী’ ঢুকে আছে। যশোমতী সঙ্কোচ বোধ করছে আবার। কানে লাগছেও কেমন। সকালে সেই বাসের থেকে এ পর্যন্ত ভদ্রলোক উপকার কম করল না। তার মেজাজের দিকে না চেয়ে কৃতজ্ঞ থাকাই উচিত। যশোমতী অকৃতজ্ঞ নয়। বাড়িতে কেউ তাকে এভাবে চোখ রাঙালে বা ও-রকম করে তার সঙ্গে কথা কইলে হাতে মাথাই কাটত। তার সঙ্গে এ-রকম ব্যবহার করার কথা কেউ কল্পনাই করতে পারে না। কিন্তু তবু যশোমতী তেমন রাগ করেনি লোকটার ওপর, রাগ হলেও তা চাপতে চেষ্টা করেছে, আর কৃতজ্ঞ বোধ করতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু পাঁচ বছরের শিশুর মুখেও এ-রকম অসম্ভব সম্পর্কের কথা শুনে সে অস্বস্তি বোধ করছে।….কালচারের ছিটে-ফোঁটা নেই লোকটার, সামান্য চক্ষুলজারও বালাই নেই, ব্যবসা বলতে দিন আনে দিন খায় গোছের কিছু করে হয়তো। অবস্থা অনেকেরই খারাপ হতে পারে, কিন্তু ব্যবহার যা–ইস্কুল-কলেজের মুখ দেখেছে কিনা কোনদিন সন্দেহ।
পাঁচ বছরের শিশুও ওই গোছের একটা সম্পর্ক কল্পনা করলে অস্বস্তি।
আলাপ আর জমার অবকাশ পেল না। খাবার ডাক পড়ল। দিদি নিজেই এসে ডেকে নিয়ে গেল।
সামনের বারান্দার মেঝেতে তিনটে জায়গা করা হয়েছে দুটো হারিকেন। শঙ্কর পিঁড়িতে বসে আছে। হাব-ভাব নরম একটু। সদয় মুখে ভাগ্নেকে ডাকল, আয়–
এই আলোয় আর এ-রকম মেঝেতে বসে খেতে হবে যশোমতীর সেটা তেমন খেয়াল ছিল না। বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে নেমন্তন্ন উপলক্ষে মেঝেতে বসে হয়তো দু-চারদিন খেয়েছে, কিন্তু এ-রকম আলোয় খেতে বসার অভিজ্ঞতা নেই। বারান্দার চারদিকে যতদূর চোখ যায় অন্ধকার বলেই দুটো হারিকেনের আলোও একেবারে নিষ্প্রভ ঠেকছে।
তার মুহূর্তের দ্বিধা লক্ষ্য করেই দিদি জিজ্ঞাসা করল, শঙ্করের সামনে বসে খেতে তোমার লজ্জা করবে নাকি? আর তো জায়গা নেই আমাদের, একসঙ্গে না বসলে তো দেরি হয়ে যাবে–সেই কখন খেয়ে বেরিয়েছ।
যশোমতী তাড়াতাড়ি বসে পড়ে বাঁচল। দিদি নিশ্চিন্ত মনে খাবার আনতে গেল। যশোমতী লক্ষ্য করল, ওদিকে মামা-ভাগ্নের। মধ্যে নিঃশব্দে খোঁচাখুচি লেগে গেছে। ভাগ্নের মান ভাঙাবার চেষ্টায় মামা এক-একবার তার গায়ে হাত রাখতে চেষ্টা করছে, নয়তো পিঠে একবার আঙুলের খোঁচা দিয়ে অন্য দিকে তাকাচ্ছে। আর ভাগ্নে ছোট্ট শরীরটাকে ঝাঁকিয়ে বা কুকড়ে মামার সঙ্গে অসহযোগ ঘোষণা করছে, নয়তো হাত দিয়ে আমার হাত ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে। সমস্ত দিন বাদে বাড়িতে ঢুকেই মামা তাকে রীতিমত অপমান করেছে, এখন সাধাসাধি করলেও সে এত সহজে ভাব করতে রাজি নয়।
যশোমতীর ভালো লাগছে। ভালো লাগছে কারণ, লোকটার রুক্ষ মুখে হাসির আভাস এই বোধহয় প্রথম দেখল।
দিদি খাবার নিয়ে এলো। মোটা মোটা চালের লালছে ভাত। আর তরকারীর চেহারা দেখেও ভিতরে ভিতরে আবার অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে যশোমতী। ভব্যতা জ্ঞান তার যথেষ্ঠই আছে, কিন্তু হাতে তুলে এই সব গলাধঃকরণ করবে কি করে ভেবে পাচ্ছে না।
কিন্তু খাওয়া শুরু করতেই অন্যরকম। খিদের মাথায় মনে হল অমৃত খাচ্ছে। এই চেহারার ভাত-ডাল-তরকারী এরকম উপাদেয় কি করে হয় সে ভেবেই পেল না। তবু তার খাওয়ার ধরন-ধারণ দেখে দিদিটির বোধহয় খটকা লাগার কারণ ঘটল কিছু। খানিক লক্ষ্য করে শেষে বলেই ফেলল, তোমার বোধহয় অসুবিধে হচ্ছে খুব, আমাদের এইরকমই খাওয়া-দাওয়া।
যশোমতী তাড়াতাড়ি মাথা নাড়ল। অর্থাৎ, একটুও অসুবিধে হচ্ছে না। ওদিক থেকে তার ভাইটিও মাঝে মাঝে আড়চোখে তার খাওয়া লক্ষ্য করছে। পুরুষের সঙ্গে বসে খেতে বা খাওয়া নিয়ে হৈ-চৈ করতে কোনদিন এতটুকু সঙ্কোচ বোধ করেনি যশোমতী। সঙ্কোচের অনুভূতিটা এই প্রথম।
খানিক বাদেই ভাই-বোনের কথাবার্তার মোড় একেবারে অন্যদিকে ঘুরে গেল। আর তাই শুনে যশোমতী অবাক মনে মনে। বাইরের একজনের সামনে যে প্রসঙ্গ তোলাটাও অস্বাভাবিক, সেই প্রসঙ্গ নিয়েই ভাই-বোনে বলতে গেলে কথা-কাটাকাটিই হয়ে গেল একপ্রস্থ। যশোমতীর মনে হল, দিদিটিরও মেজাজপত্র কোনো কোনো ব্যাপারে তার ভাইয়ের ওপর দিয়ে যায়। এই এক বিষয়ে অন্তত ভাই-বোনের প্রগাঢ় মিল। কে আছে কাছে বা কে শুনছে এ নিয়ে চক্ষুলজ্জার বালাই নেই। মেজাজ চড়লে ভব্যতার এই দিকটার প্রতি তারা সচেতন নয় একজনও।
কি মনে পড়তে আহাররত ভাইয়ের দিকে চেয়ে দিদি হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, হা রে, একরাশ মালপত্র নিয়ে এলি, তার ওপর দেরাজে আবার অতগুলো টাকা রাখলি দেখলাম, রায়ার তাড়ায় জিজ্ঞেস করতে মনে ছিল না। অনেকগুলো টাকাই তো মনে হল–এত টাকা হঠাৎ পেলি কোথায়?
যশোমতী লক্ষ্য করল, ভাইয়ের মুখে হঠাৎ বিরক্তির ঘন ছায়া পড়েছে। প্রসঙ্গটা অবাঞ্ছিত বোঝা গেল। মুখ তুলে একবার, তার দিকে তাকালো সে। তারপর খেতে খেতে ক্ষুদ্র জবাবে প্রশ্নের ইতি টানতে চাইল।–যোগাড় করেছি।
দিদি শঙ্কিত। যোগাড় করেছিস! গলাকাটা সুদে আবার ধার-ধোর করিসনি তো কোথাও থেকে? সেবারের কথা মনে হলে আমার এখনো গা কঁপে।
-না। বিরক্তি চাপতে না পেরে প্রচ্ছন্ন ঝাঁঝে ক্ষুদ্র জবাব দিল শঙ্কর সারাভাই।
কিন্তু দিদিটির শঙ্কা যায় না তবু। ভাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে আছে। খটকা লেগেইছে, সেই সঙ্গে কিছু বোধহয় মনেও পড়ল তার। মুখের দিকে খানিক চেয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করল, মেসোমশাইয়ের কাছ থেকে আবার টাকা আনিসনি তো?
এদিকের ধৈর্য গেল। তিক্ত বিরক্ত হয়ে শঙ্কর সারাভাই বলে উঠল, এনেছি তো, না আনলে টাকা পাব কোথায়, আমাকে ধার দেবার জন্যে কে হাত বাড়িয়ে বসে আছে?
যশোমতী খাওয়া ছেড়ে উঠে পালাতে পারলে বাঁচে। বাইরের কারো সামনে এই আলাপও যে কেউ করতে পারে তার ধারণা ছিল না। কিন্তু এরপর যা শুনল, তার চক্ষুস্থির।
দিদির মুখেও বিরক্তির ছায়া ঘন হতে লাগল। ভাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত।–ফের তুই মিথ্যে কথা বলে টাকা এনেছিস?
সঙ্গে সঙ্গে ভাই চিড়বিড় করে উঠল।–সত্যবাদী যুধিষ্ঠির হলে মেসো টাকা দেবে? নাকি টাকা ছাড়া চলবে? ওদিকে তো কাজ একরকম বন্ধ, সুতো নেই, মেশিন ভাঙা, ছাদ দিয়ে মাথার ওপর জল পড়ছে–কাপড় নানো ছেড়ে ওই তাঁতে গামছা পর্যন্ত তৈরি করা যাচ্ছে না।
দিদিটির মুখের দিকে চেয়ে ঘাবড়েই যাচ্ছে যশোমতী। হারিকেনের অল্প আলোয়ও বোঝা যায় মুখখানা তেতে উঠেছে। বলে উঠল, তা বলে তুই ভাওতা দিয়ে টাকা আনবি, একবার ওই করে শিক্ষা হয় নি? কালই আমি মাসিমার কাছে চিঠি লিখে জানিয়ে দিচ্ছি সব।
শঙ্কর বলল, তুমি না লিখলেও দু’দিন গেলেই তারা বুঝতে পারবে।
–পারুক, তরু লিখব। ছি ছি ছি ছি, লজ্জায় মাথা কাটা গেল। না হয়, ক্ষেতের শাক-ভাত খেয়ে থাকব আমরা, টাকা মাথায় চাপলে তোর হয় কি শুনি?
ভাই হুমকি দিয়ে উঠল, খেতে দেবে, না সব ফেলে উঠে চলে যাব?
সুর নরম হওয়া দূরে যাক, সঙ্গে সঙ্গে দিদিটিরও সমান উগ্রমূর্তি। –যা দেখি কেমন আস্পর্ধা তোর! আর-একবারের সেই হাতে-পায়ে ধরার কথা ভুলে গেছিস, কেমন?
যশোমতীর দুই চক্ষু বিস্ফারিত। সে যেন চোখের সামনে নাটক দেখছে কিছু। ওদিকে ক্ষুদ্র শিশুটির কোনরকম ভাববিকার নেই। সে যেন মা আর মামার এ-ধরনের বিবাদ শুনে অভ্যস্ত। নিবিষ্ট মনে খাচ্ছে এবং এক খাওয়া ছাড়া আর কিছু তার মাথায় নেই। একটু নীরবতার ফাঁক পেয়ে বলল, মা, আর একটা ভাজি দেবে?
মায়ের এইবার খেয়াল হল বোধহয়। বাইরের মেয়ে এই ঘরের কথাবার্তা শুনে কাঠ হয়ে বসে আছে। ছেলের পাতে ভাজা দিয়ে যশোমতীর দিকে ফিরল।–কি হল, তুমি হাত গুটিয়ে বসে আছ দেখি। তুমি এ-সব শুনে কিছু মনে কোনো না বাছা–গরীবের ঘরের সতেরো জ্বালা, তার ওপর ওই অবুঝ ছেলে এমন এক-একটা কাণ্ড করে বসে যে মাথা ঠিক থাকে না।
যশোমতী আড় চোখে দেখল অবুঝ ছেলে ঘাড় গোঁজ করে খাচ্ছে। দিদি জিজ্ঞাসা করল, আর কি দেব বলে
যশোমতী তাড়াতাড়ি মাথা নাড়ল, আর কিছু চাইনে।
.
রাতের শয্যা নেবার পর আর চিন্তা করা গেল না কিছু। সমস্ত দিনের ক্লান্তি আর চিন্তার ধকলে স্নায়ুগুলো সব নিস্তেজ। কোন পর্যায়ের দারিদ্র্যের সঙ্গে যে এরা যুদ্ধ করছে সেটা ভাবতে ভাবতেই চোখ বুজে এলো যশোমতীর। তার আগে মনে মনে একটা ব্যাপার অনুভব করে কেমন একটু স্বস্তিও বোধ করেছে সে। ভাইটির মেজাজ যত তিরিক্ষিই হোক, বোনের কাছে ঢিট সে। এটা তার যেমন মন্দ লাগে নি, ছল-চাতুরী করে কোন এক আত্মীয়ের কাছ থেকে টাকা আনা হয়েছে শুনে তেমনিই আবার খারাপ লেগেছে।
শেষ রাতের দিকে ঘুম ভেঙে গেল। ঘরের কোণে স্তিমিত হারিকেন জ্বলছে তখনো। বাইরে কোথায় শেয়াল ডাকছে। ছোট একটা জানলা খোলা, বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকাতে গা-টা কেমন ছমছম করে উঠল। চোখ বুজেই বিছানায় পড়ে রইল যশোমতী। সকাল হলে কি করবে সে, মেয়ে-পাঠশালায় চাকরির চেষ্টায় যাবে? তারপর? কালই চাকরি হবে সে-রকম আশা করার কোনো কারণ নেই। চাকরি না হলে কি করবে? আবার এই দারিদ্রের সংসারে ফিরে আসবে। এখান থেকে যেতে হলেও টাকা লাগবে, এক-আধখানা গয়না এখানে বিক্রি করার সুবিধে হবে কিনা কে জানে। আর এত বিড়ম্বনার পর ভাগ্য যদি তার একটু ভালই হয় অর্থাৎ, মেয়ে পাঠশালায় চাকরি যদি পেয়েই যায় তাহলেই চাকরি হলেই বা কি করবে? থাকবে কোথায়? পরক্ষণে নিজেকেই আবার চোখ রাঙাতে চেষ্টা করল যশোমতী, সমস্যা তো সর্বত্রই আছে। অত ভাবলে বাড়ি থেকে বেরোতে গেছল কেন?
ভাবতে ভাবতে আবার কখন চোখ বুজে এসেছিল। চোখ খুলে দেখে সকাল। প্রথম মনে হল বাড়ির শয্যায় শুয়েই কিছু একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে উঠল সে। চোখ মেলে তাকানোর পরেও সে স্বপ্নের রেশ কমে নি যেন। তারপরেই টের পেল স্বপ্ন নয়। কঠিন বাস্তবের মধ্যেই পড়ে আছে। বিচিত্র বাস্তব। তবু জানলার ভিতর দিয়ে দুরের আকাশ আর প্রথম ভোরের দিকে চেয়ে অদ্ভুত লাগল। প্রকৃতি যেন শুচি-স্নান করে উঠল এইমাত্র।
বিছানা ছেড়ে উঠল যশোমতী। ঘরের কোণের হারিকেনটা নিভিয়ে দিল। পরা শাড়িটা একটু গোছগাছ করে নিয়ে দরজার খিল খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল।
প্রথমেই যে বস্তুটা তার চোখে পড়ল, সেই বস্তুরই আর-একটার অর্থাৎ দ্বিতীয়টার খোঁজে এদিক-ওদিক তাকালো সে। তারপর বিড়ম্বনার ছায়া পড়ল মুখে।
স্যাণ্ডাল। তার শৌখিন স্যাণ্ডালজোড়ার দ্বিতীয় পাটি অদৃশ্য। রাত্রিতে শোবার সময়ে ঘরের ভিতরে দাঁড়িয়ে দরজা টেনে দিয়েছে, হারিকেনের স্বল্প আলোয় স্যাণ্ডালজোড়া চোখে পড়ে নি। অলক্ষ্যে সে দুটো বাইরেই থেকে গেছে। এখন তার একটা পড়ে আছে, আর একটা নেই। এদিক-ওদিক খুজল একটু। কুকুর বা শেয়ালের কাণ্ড ছাড়া আর কি!
এত সমস্যার ওপর সকালে উঠেই এই সমস্যা কার ভালো লাগে? আশায় আশায় তবু উঠোনে নেমেও নিঃশব্দে এদিক-ওদিক খানিক খোঁজাখুজি করল যশোমতী। উঠোনের বাইরেটাও একটু দেখল। তারপর হতাশ হয়ে ওই একপাটি স্যাণ্ডাল চৌকির আড়ালে এক কোণে পা মোছার ছালা দিয়ে নিরাপদে চাপা দিয়ে রাখল। যদি আর এক পাটির হদিস মেলে ভালো, নইলে যা গেছে তো গেছেই, আবার সেটা নিয়ে অপ্রস্তুত না হতে হয় সেই শঙ্কা।
পায়ে পায়ে বাইরে এলো। উঠোনের ওধারটায় বাগান। যশোমতী বাগানের দিকে এগুলো। সুন্দর তাজা আনাজের বাগান। বাগানে অনেক রকমের আনাজ হয়ে আছে। যা খায়, তা গাছে ফলে জানত, কিন্তু গাছের জিনিস দেখতে যে এত ভালো লাগে জানত না। বাগানের কেনা জিনিসের এক চেহারা, এগুলোর আর এক। ওধারে বাঁধানো পুকুর একটা। আরো ভালো লাগত পায়ে স্যাশ্যাল নেই ভূলে যশোমতী তাড়াতাড়ি সেদিকে এগুলো।
কিন্তু একটু গিয়েই থমকে দাঁড়াতে হল। এত সকালে পুকুরে কাউকে চান করতে দেখবে ভাবে নি। দাঁড়িয়ে চান নয়, মনের আনন্দে সাঁতার কাটছে আর জলে ভাসছে শঙ্কর সারাভাই। ঋজু, পরিপুষ্ট দেহ জলের ওপর যেন কখনো চঞ্চল কখনো বা শিথিল অবকাশ-বিনোদনে রত। যশোমতী যে ভব্যতার আবহাওয়ায় মানুষ, তার চলে আসা উচিত, ফিরে আসা উচিত। তাদের ঘরের পুরুষেরাও স্নানের পর গায়ে জামা না চড়িয়ে বাথরুম থেকে বেরোয় না। কিন্তু স্থান-কাল ভুলে সে দাঁড়িয়েই রইল, আর চেয়েই রইল।
সাতারের পর ঘাটের কাছে এসে নিটোল পুষ্ট দুই হাতে গাত্র মার্জনা শুরু হল। শক্ত হাতের তাড়নায় পেশীগুলো ফুলে ফুলে উঠছে। প্রথম সূর্যের আলো পড়েছে লোকটার মুখে। যশোমতী আরো অবাক, গালে মুখে কালকের সেই খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর নেই, চানের আগে এরই মধ্যে কখন দাড়ি কামানোও হয়ে গেছে। রীতিমত সুশ্রী দেখাচ্ছে ঝাকড়া চুলে ঢাকা মুখখানা।
পুরুষের মূর্তি…
পুরুষের এই মূর্তি কি যশোমতী আর দেখেছে?
রীতিমত সাড়া জাগিয়ে ক্ষুদ্রকায় রাজুর আবির্ভাব। হারানো প্রিয়জনের সন্ধান মিলেছে যেন।–মাসি, তুমি এখানে! আমি আর মা সেই থেকে তোমাকে খুঁজছি।
যশোমতীর সমস্ত মুখ পলকে রাঙা। আরো নাজেহাল অবস্থা ভাগ্নের কলকণ্ঠ শুনে অদূরে স্নান যে করছে সে ফিরে তাকাতে। যশোমতী পালাতে পারলে বাঁচে। কিন্তু বিপদের ওপরে বিপদ, লোকটা হাতের ইশারায় কাছে ডাকছে। পালাবার মুখেও বিমূঢ় মুখে দাঁড়িয়ে গেল। দু’জনের কাকে যে ডাকছে ভাগ্নেকে নাতাকেই– হঠাৎ ঠাওর করতে পারল না যশোমতী।
যে ডাকছে তার মুখে কোনরকম সঙ্কোচের চিহ্নমাত্র দেখতে পেল না। এদিকে খুশির দূত ক্ষুদ্র সঙ্গীটি ততক্ষণে তার হাত ধরে ঘাটের দিকে টেনে নিয়ে চলেছে–রাজুর যেন এই মুহূর্তে ওখানে না গেলেই নয়। বলছে, মামা এক ডুবে পুকুরটা এপার-ওপার করতে পারে, বুঝলে? দেখবে এসো–
না, ডাকছে ভাগ্নেকেই। যশোমতী সামনে এসে দাঁড়ানো সত্ত্বেও কোনরকম সঙ্কোচের লক্ষণ দেখল না, প্রশস্ত বুকের ওপর ভিজে গামছাটা পর্যন্ত ফেলল না। তার দিকে একবার তাকিয়ে ভাগ্নেকে বলল, চান করবি তো নাম–
মামাকে হঠাৎ এ-রকম উদার হতে দেখে ভাগ্নে অবাক একটু। পরক্ষণে আত্মহারা আনন্দে টেনে-হিঁচড়ে গায়ের জামাটা খুলে যশোমতীর হাতে দিয়ে তরতর করে জলে নেমে গেল। না মাথায় তেল, না গায়ে। জামা হাতে যশোমতী দাঁড়িয়ে রইল, ওদিকে ভাগ্নেকে উল্টে-পাল্টে চান করাতে লাগল শঙ্কর সারাভাই। তাদের দুজনেরই মুখে হাসি ধরে না।
একটু বাদে দিদিও হাজির।–দেখেছ কাণ্ড! এই সাত সকালে ছেলেটাকে ধরে চান করাতে লেগেছে।
তার মুখে কিন্তু অখুশির ছায়া দেখল না যশোমতী। রাতের বিরূপতা সকালে মুছে গেছে।
রাজুর ডাকে যশোমতী সচকিত।…মাসি তুমিও নেমে পড়ো না! সাঁতার জান না বুঝি? কিছু ভয় নেই, মামা জানে, ধরবে-খন।
মামার ধমক শোনা গেল, ধ্যেৎ।
মুখে আঁচল চাপা দিয়ে দিদির প্রস্থান। যশোমতীও দ্রুত অনুসরণ করে বাঁচল।
চানের পর অবশ্য সেই দুপুরের আগে আর শঙ্কর সারাভাইয়ের দেখা পেল না যশোমতী। স্কুলে দেখা করার ব্যাপারটা আজ যদি কোনরকমে কাটিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে কি একটা উপলক্ষে পর পর তিন দিন ছুটি। আজও দেখা করতে যেতে আপত্তি ছিল, কিন্তু জুতোর সমস্যা। গয়না না বেচা পর্যন্ত এক জোড়া স্যান্ডাল কেনারও উপায় নেই। তাছাড়া, বলা নেই কওয়া নেই, মুখ ফুটে এই একটা নগণ্য চাকরি চাইতে যাওয়ার যে মানসিক প্রস্তুতির। দরকার, তাও নেই। মোট কথা, লোকটার ও-রকম জেরায় পড়ার আগে প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করার কথা সে কখনো ভাবেও নি। স্কুলের চাকরি যদি কোথাও করতেই হয় তাহলে এখান থেকে চলে গিয়ে কোনো হাইস্কুলে চেষ্টা করাই সঙ্গত।
কিন্তু এখানে থাকার ব্যাপারেও তো চক্ষুলজ্জা কম নয়।
সেই লজ্জার অবসান দিদিটিই করে দিল। সকালে মুড়ি দিয়ে জলযোগ সারার পর সঙ্কোচ-বিনম্র মুখে সমস্যাটা দিদির কাছে যশোমতীই ব্যক্ত করল। বলল, এ-রকম শূন্য হাতে স্কুলে এখন সে দেখা করবে না, তার থেকে আপাতত বরং তার ফিরে যাওয়াই ভালো। কারণ, কাজের সুবিধে হলে তখন স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে সময় চাওয়াটা ঠিক হবে না। কিন্তু নানা কারণে ফেরার ইচ্ছে তার একটুও নেই, অনেক রকম ঝামেলায় পড়ার সম্ভাবনা। এখন দিদি যদি তার এক আধখানা গয়না বিক্রি করার ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যায়–তারপর সে ভেবে-চিন্তে যাহোক ঠিক করতে পারে। এসব গয়না তার দাদার দেওয়া নয়, বাবার দেওয়া আর হাতের টাকা চুরি গেছে যখন দুই-একখানা গয়না বিক্রি তো করতেই হবে, ইত্যাদি।
দিদি তার মুখের দিকে চেয়ে চুপচাপ শুনল। গায়ের গয়না লক্ষ্য করল। হাত দিয়ে হীরে-বসানন বালা দুটো নেড়েচেড়ে দেখল একটু। তারপর জিজ্ঞাসা করল, তোমার বাবা খুব বড় অবস্থার লোক ছিল বুঝি?
ছিল শুনে যশোমতীর ভিতরটা খচ করে উঠল, ঢোঁক গিলে মাথা নাড়ল।
দিদি আবার বলল, এসব গয়না একখানাও কেনার লোক নেই এখানে। বিক্রি করতে হলে ট্রেনে চেপে ফিরে আবার শহরেই যেতে হবে। কিন্তু বাবার দেওয়া জিনিস তুমি বিক্রিই বা করতে চাও কেন? যে ক’দিন দরকার এখানেই থেকে চাকরির চেষ্টা করো, অবশ্য আমাদের এই গরীবের ঘরে তোমার খুব কষ্ট হবে।
যশোমতী তাড়াতাড়ি বাধা দিল, ওকথা বার বার বললে আমাকে চলেই যেতে হবে দিদি, আমি যে অবস্থায় পড়েছি তার তুলনায় এ তো স্বর্গ।
দিদিটি মনে মনে খুশি হল। এরই মধ্যে একটা অভিলাষ তার মনে উঁকিঝুঁকি দিয়ে গেছে সেটা আর কেউ জানে না। ধীরে সুস্থে তার আগে অনেক কিছু জানার আছে, খুটিয়ে জিজ্ঞাসা করার আছে।….হয় যদি ছোঁড়ার ভাগ্য। বলল, তাহলে আর কি, তুমি নিশ্চিন্ত মনে চাকরির চেষ্টা দেখো, তারপর শঙ্করের সঙ্গে পরামর্শ করে যা-হোক একটা ব্যবস্থা করা যাবে, আর তোমার কি লাগবে তুমি আমাকে বোলো, বিহারীকে দিয়ে আনিয়ে দেব–তোমার হাতে টাকা এলে তখন শোধ করে দিও।
যশোমতী মাথা নাড়ল বটে, কিন্তু ব্যবস্থাটা মনঃপূত হল না খুব। টাকা কিছু হাতে এলে খরচ-বাবদ জোর করে দিদির হাতে কিছু গুঁজে দিতে পারত। তাহলে ওই একটা লোকের কাছে অন্তত সম্মান বাঁচে। আত্মীয়ের কাছ থেকে যেভাবে ধাপ্পা দিয়ে টাকা সংগ্রহ করেছে শুনলো গত রাত্রিতে, তাতে ভাগ বসাবার রুচিও নেই ইচ্ছেও নেই। যার কাছে টাকার এত দাম, কোনো একসময় তাকে দিয়েই গয়না বিক্রির ব্যবস্থা করা যেতে পারবে ভেবে তখনকার মতো এ নিয়ে আর কথা বাড়ালো না যশোমতী।
মুখ কাঁচুমাচু করে পরের সমস্যার সম্মুখীন হল সে। বলল, কিন্তু আজই স্কুলে দেখা করতে যাব? ….শরীরটা তেমন ভালো লাগছে না।
-তাহলে যেও না, আজই ছুটতে হবে তোমাকে কে বলেছে? স্কুলের লোকের সঙ্গে শঙ্করের আলাপও আছে, সে-ই না হয় তোমাকে নিয়ে যাবে’খন।
কিন্তু না গেলে শঙ্করবাবু যদি রাগ করেন?
ওর রাগের কথা ছেড়ে দাও, ওর রাগ আর রাজুর রাগ একরকমই।
বসে দিদিটির সঙ্গে গল্পে গল্পে আরো কিছু খবর জানা গেল এরপর। ফলে যশোমতীর আশা বাড়ল, কিছু সঙ্কোচও দূর হল। যেমন, মেয়েদের প্রাইমারী স্কুলটাকে হাইস্কুল করার চেষ্টা হচ্ছে। হয়ে যাবে হয়তো শিগগীরই। অনেকে এ-জন্যে উঠেপড়ে লেগেছে। আর ছোটখাট গানের স্কুলও আছে এখানে একটা-সেটাকে বড় করে তোলার খুব তোড়জোড় চলছে, কারণ, এই দেশে তো গানের ভক্ত বলতে গেলে সবাই। কে একজন নাকি মোটা টাকা দেবার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। দিদির অবশ্য ও-সব গান খুব ভালো লাগে না, দুই-একটা ঠাকুর-দেবতার গান শুনলে বরং কান জুড়োয়।
যশোমতী ভালো করে বুঝে নিয়েছে, এই দিদিটিকে হাত করতে পারলে তার অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে। অতএব সেই চেষ্টাই সর্বাগ্রগণ্য মনে হল তার। তক্ষুনি সবিনয়ে প্রস্তাব করল, আমি কিছু কিছু জানি দিদি, ঠাকুরের নাম করব একটু?
দিদি তাকালো আর সানন্দে মাথা নাড়ল। গলা না ছেড়েই একখানা ভজন গাইল যশোমতী। দরদ দিয়েই গাইল। গান শেষ হতে দিদি হাঁ, ক্ষুদ্র রাজু হ্যাঁ–আর অদূরে দাঁড়িয়ে বিহারী চাকরও মুগ্ধ। দিদি তো পারলে জড়িয়েই ধরে তাকে, বলল, আ-হা, এমন গুণের মেয়েকে কিনা চাকরির জন্যে ঘর ছেড়ে বেরুতে হয়েছে তোমার দাদা মানুষ না কি!
গোবেচারী মুখ করে বসে রইল যশোমতী। দিদিটির মন দখলের ব্যাপারে আর একটা বড় ধাপ উত্তীর্ণ হওয়া গেল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। অতঃপর দিদির গল্প শোনায় মন দিল সে। এই জমি-জমা আর ঘরের মালিক দিদি নিজে। তার জমিতে ওই ফ্যাক্টরির ঘরটা শুধু শঙ্করের তোলা। এই সবই দিদির স্বামীর ছিল। জমি যা আছে তাই থেকে বছরের ধান এসে যায়, আর বাগানের তরি-তরকারী তো আছেই। কাজেই খাওয়ার ভাবনা তাদের খুব নেই।
শুনে মস্ত একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল যশোমতী। এক অপ্রিয় প্রসঙ্গও মনে পড়েছে তক্ষুনি। মনে হয়েছে আত্মীয়ের কাছ থেকে লোকটার ধাপ্পা দিয়ে টাকা আনার কারণ তাহলে নিছক অনটনের দরুন নয়। আসলে স্বভাব আর টাকার লোভ। সকালে চানের ঘাটে যে দৃশ্য মিষ্টি অনুভূতির মতো মনে লেগে ছিল, তার ওপর বিরূপ ছায়া পড়-পড় হল একটা।
নিজের গল্প থেকে ক্রমে ভাইয়ের অর্থাৎ শঙ্কর সারাভাইয়ের প্রসঙ্গের দিকে ঘুরল দিদি। আর সেই বিরূপ ছায়াটা নিজের অগোচরেই সরে যেতে লাগল যশোমতীর মন থেকে। দিদির কথার সারমর্ম, ওই ভাইকে নিয়েই হয়েছে তার জ্বালা। এক দিদি ভিন্ন তাকে সামলাতে পারে এমন কেউ নেই। বি. এসসি, ভালো পাস করেছে, ভালো মাথা–ইচ্ছে করলেই একটা ভালো চাকরি করে সুখে থাকতে পারত, মেসো তো কতবার চাকরি নিয়ে সাধাসাধি করেছে– কোন্ এক মস্ত কাপড়ের কলে বড় চাকরি করে মেসোতা ছেলে গোলামী করবে না কারো। আর যে মেজাজ, চাকরি করবে কি করে। নিজের নড়বড়ে ব্যবসা নিয়ে মেতে আছে, তিনদিন চলে তো চারদিন সব বন্ধ থাকে। একটু ভালো অর্ডার হাতে এলেই কি করে টাকা যোগাড় করবে সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ে। মূলধন না থাকলে অর্ডার পেলেই তো আর সাপ্লাই করা যায় না। তখন আর ভালো-মন্দ জ্ঞান থাকে না। ব্যবসা করে বড় হবে দিন-রাত খালি এই স্বপ্ন দেখে। বাবার আমলে উড়নচণ্ডী ছেলে ছিল, কিন্তু ব্যবসা শুরু করার পর থেকে একটা পয়সাকে সোনার চোখে দেখে।
দিদি যে মুখ করেই বলুক, ভাইয়ের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর এই চেষ্টাটাকে খুব ছোট করে দেখে বলে মনে হল না। বলা বাহুল্য, যশোমতীর ভালো লেগেছে, সবটুকুই কান পেতে শুনেছে। গত রাত্রিতেও লোকটার শিক্ষা-দীক্ষা আছে কিনা সে সম্বন্ধে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল তার।
কৌতূহল দমন করতে না পেরে দুপুরে রাজুর হাত ধরে ফ্যাক্টরি দেখতে চলল সে। দুপুরে মানুষটা খেতেও আসে নি, বিহারী তার খাবার নিয়ে গেছে ওখানে। শুনেছে, কাজে মন দিলে এই রকমই নাকি হয়।
ফ্যাক্টরি বলতে টিনের শেড দেওয়া ওই জায়গাটুকুই। কাপড় বানানোর ব্যবসা শুনেই যশোমতীর আরো বেশি কৌতূহল হয়েছিল। কিন্তু ভিতরের দশা দেখে তার চক্ষুস্থির। বাবার যে বিশাল মিল দেখে সে অভ্যস্ত সেই চোখে এটা দেখে তার হেসে সারা হওয়ার কথা। যশোমতী হেসেই ফেলেছিল প্রায়। কিন্তু তারপরেই তার দুঃখই হল একটু। এমন করেও কেউ অনর্থক উদ্যম নষ্ট করে।
শঙ্কর সারাভাই একবার দেখল তাকে। কিন্তু ভালো করে তাকানোর ফুরসত নেই। সে তখন কাজে ব্যস্ত। সর্বাঙ্গ দর-দর করে ঘামছে। গায়ে হাত-কাটা গেঞ্জি, পরনে আধময়লা পা-জামা। সে একাই মালিক আর একাই প্রধান শ্রমিক। সাহায্যের জন্য আছে পুরানো সাগরেদ বিহারী।
যশোমতী দেখছে চেয়ে চেয়ে। তার বাবার কলে শ’য়ে শ’য়ে লোক খাটতে দেখেছে। কিন্তু মেহনতী মানুষের এই মূর্তি সে যেন আর দেখে নি। পাওয়ার মেশিন চলছে, ভারী ভারী সরঞ্জাম নিজেই টেনে টেনে তুলছে, পরিপুষ্ট দুই বাহুর পেশীগুলো লোহার মত উঁচিয়ে উঠছে এক-একবার।
আর নিষ্পলক চোখে পুরুষের রূপ দেখছে যশোমতী। কাজের সময় ক্ষুদ্রকায় চঞ্চল ভাগ্নেটি পর্যন্ত চুপ! এ সময় বিরক্ত করা চলবে না, মামা তাহলে রেগে যায়–সে-সম্বন্ধে যশোমতীকে সে আগেই সতর্ক করে রেখেছিল। কলের মূর্তির মতো মুখ বুজে এটাসেটা এগিয়ে দিচ্ছে বিহারী।
অনেকক্ষণ বাদে হয়তো একটু বিশ্রাম নেবার জন্যই গামছায় ঘাম মুছতে মুছতে শঙ্কর সারাভাই নিস্পৃহ মুখে যশোমতীর সামনে এসে দাঁড়াল। হাতল-ভাঙা একটা কাঠের চেয়ার দেখিয়ে বলল, বসুন। বসার মত ঘরে আর দ্বিতীয় কিছু নেই।
যশোমতী বসল না, হাসিমুখে চেয়ারটার গায়ে একটু ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। ফ্যাক্টরি প্রসঙ্গে দুটো প্রশংসার কথা বললে হয়তো খুশি হবে, কিন্তু বলার মতো কিছু মাথায় এলো না। সে-চেষ্টার আগেই ভাগ্নেটি একটা সুসমাচার জ্ঞাপন করল মামাকে। সোৎসাহে বলে উঠল, মামা, মাসি বলেছে আমাকে একটা সত্যিকারের কলের মোটরগাড়ি কিনে দেবে আর একটা সত্যিকারের তিন চাকার সাইকেল কিনে দেবে!
গেল বছর মায়ের সঙ্গে সাবরমতীর দেব-উঠি-আগিয়ারস্-এর মেলায় গিয়ে সেই বড় শহরের দোকানে এই দুটি দুর্লভ জিনিস দেখার পর দুনিয়ায় এর থেকে বেশি কাম্য জিনিস আর কিছু নেই মনে হয়েছে রাজুর। অন্তরঙ্গ আলাপের ফাঁকে সেটা বোঝামাত্র অবস্থা ভুলে যশোমতী তাকে কথা দিয়ে বসেছিল ওই দুটো জিনিসই কিনে দেবে।
কিন্তু এই পরিস্থিতিতে সমাচারটা বেখাপ্পা শোনালো। আরো বেখাপ্পা শোনালো এই জন্যে যে, ভাগ্নের আনন্দ দেখে মামাটি যে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকালো যশোমতীর দিকে, তার অর্থ, সে যেন এই হাস্যকর ব্যবসাকে বড় মিলে দাঁড় করানোর থেকেও অসম্ভব কিছু আশ্বাস দিয়েছে ওই শিশুকে। এখানে এসব কথা নিয়ে উৎসাহ বোধ করার সময় কম তার। তবু টিপ্পনীর সুরেই জিজ্ঞাসা করল, সকালে স্কুলে দেখা করতে না গিয়ে বেশ গানটান করলেন শুনলাম।
একে ভাগ্নের আনন্দ-সমাচারের জবাবে ওই চাউনি, তারপর এই উক্তি। শোনামাত্র যশোমতীর ভিতরটা চিড়বিড় করে উঠল। আবার হাসিও পেয়ে গেল পরমুহূর্তে। ভদ্রলোকের অন্য রকম ভাবা অন্যায়, কিছু নয়। তবু হালকা জবাব দেবার লোভ ছাড়া গেল না। গম্ভীর সে-ও। বলল, দিদি আমার গানের খুব প্রশংসা করছিলেন, আর ওই বিহারীরও খুব ভালো লেগেছে। আপনি তো শুনলেন না–
শঙ্করের ভালো লাগার কথা নয়, ভালো লাগলও না। মন আপাতত নানা চিন্তায় আচ্ছন্ন। মেসোর কাছ থেকে যে টাকা এনেছে তার অনেকটাই অবশিষ্ট আছে এখনো। কাজের মধ্যেও তাই সকাল থেকে নতুন চেষ্টার ছক কাটছিল মনে মনে। যা ভাবছে তা করতে হলেও এ-টাকার কম করে বিশগুণ দরকার। তার ভগ্নাংশও পাওয়ার আশা দুরাশা। তবু মাথা খাঁটিয়ে এই টাকা দিয়েই আরো টাকা আনা যায় কিনা সেই অসম্ভব চিন্তাই তার মাথায় ঘুরঘুর করছে কেবল। তাই যশোমতীর কথায় কান গেল বটে, মন গেল না।
হালকা উক্তির কোন প্রতিক্রিয়া না দেখে যশোমতী আর এক ধাপ এগলো। –স্কুলেই বা দেখা করতে যাই কি করে, কোথায় কি, আমি কিছু চিনি না জানি? সমস্ত দিনের মধ্যে আপনার তো দেখাই পাওয়া গেল না।
–তা আমি কি করব?
–দিদি বলছিলেন, আপনার চেনা-জানা আছে, যখন হয় আপনি নিয়ে যাবেন।
আমি? আমি এখন আপনাকে নিয়ে নিয়ে চাকরির জন্যে ঘুরব? আমার খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই!
-কি কাজ?
শঙ্কর সারাভাই নিজের মধ্যে ফিরে এলো এতক্ষণে। অর্থাৎ পিত্তি জ্বলার উপক্রম হল তার। গম্ভীর মুখে জবাব দিল, দিদির মাথা খারাপ হয়েছে। যা পারেন নিজে করুন গে, আমার দ্বারা আর কিছু হবে না, বুঝলেন? যথেষ্ট হয়েছে–
তার প্রতি পুরুষের এরকম নিস্পৃহতা এই বোধ করি প্রথম দেখছে যশোমতী। দিদির সঙ্গে সমস্ত সকাল গল্প করে মেজাজ কেন যেন অতিরিক্ত প্রসন্ন তার। এখনো কৌতুকই বোধ করল। ভালো মুখ করে বলল, কি যথেষ্ট হয়েছে? হবার মধ্যে তো আপনার দশ পয়সা বাসভাড়া খরচা হয়েছে আর ছ’আনা না আট আনা ট্রেনের টিকিট ভাড়া–
তিনটাকা দু আনাকে ইচ্ছে করেই ছ’ আনা আট আনায় দাঁড় করালো যশোমতী। আর হাতে-নাতে প্রত্যাশিত ফলও পেল। কক্ষ জবাব শুনল, কৃতজ্ঞতাবোধ থাকলে ওইটুকুর জন্যেই কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। আপনি মস্ত বড়লোক বুঝতে পারছি, কিন্তু আমার কাছে ওই ছ’আনা আট আনারই অনেক দাম, বুঝলেন?
দুই ঠোঁটে হাসি চেপে মুখখানা যতখানি নিরীহ করে তোলা যায় সেই চেষ্টাই করছে যশোমতী। গতকাল বাস থেকে এ পর্যন্ত তিরিশ ঘণ্টা পার হয় নি, তবু এরকম বিচিত্র যোগাযোগের ফলেই হয়তো অনেক স্বাভাবিক সঙ্কোচ অনায়াসে উত্তীর্ণ হতে পেরেছে সে। পরিবেশ গুণে আর লোকটার মেজাজের গুণেও হয়তো সহজ হওয়া আরো সহজ হয়েছে। অম্লানবদনে বলে বসল, কিন্তু সেও তো আপনার নিজের নয়, কোন আত্মীয়ের কাছ থেকে ভাওতা দিয়ে টাকা এনেছেন শুনলাম।
ব্যস, মামার এই মূর্তি দেখে ক্ষুদ্র ভাগ্নেটি পর্যন্ত মনে মনে শঙ্কিত। শঙ্কর সারাভাইয়ের গম্ভীর দৃষ্টি অদূরবর্তিনীর মুখের ওপর কেটে বসল যেন।—এরকম বলার মতো পরিচয় আপনার সঙ্গে আমার এখনো হয় নি বোধহয়।
যশোমতী ভয় পেয়েই মাথা নাড়ল যেন। বলল, না এখনো হয় নি। এখনো কথাটার ওপর সামান্য একটু জোরও পড়ল।
শঙ্কর সারাভাইয়ের মেজাজ ঠিক রাখা শক্তই হয়ে উঠছে। খুব স্পষ্ট করে যশোমতীর কর্তব্য বুঝিয়ে দিল সে।–তাহলে আপনি দয়া করে এসব কথা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না, নিজের ব্যবস্থাটা যত তাড়াতাড়ি হয় সেই চিন্তা করুন গে।
যশোমতী এবারও মাথা নাড়ল, অর্থাৎ তাই করবে। কষ্ট গাম্ভীর্যে তাকে লক্ষ্য করে ভদ্রলোক কাজের দিকে পা বাড়াবার উদ্যোগ করতেই যশোমতী আবার বাধা দিল, কিন্তু একজন বিপন্ন মহিলার সঙ্গে আপনিও তো ভালো ব্যবহার করছেন না। শঙ্করণ সারাভাইর সপ্রশ্ন চোখে চোখ রেখে গম্ভীর মুখে বলল, দিদির কাছে শুনলাম এখানে নাকি গানের স্কুলও হবে একটা আর প্রাইমারি স্কুল হাইস্কুল হয়ে যাবে–এ-সব খবর আপনি বলেন নি তো।
-হাইস্কুল হবে তাতে কি?
–হলে প্রাইমারিতে ঢুকব কেন?
জবাবে শঙ্কর সারাভাই ঠেস দিয়ে বলল, হাইস্কুলে চাকরি করতে হলে কোয়ালিফিকেশনও একটু হাই হওয়া দরকার, বুঝলেন? প্রাইমারির কোয়ালিফিকেশনে হয় না–
–কি রকম হাই হওয়া দরকার, ডক্টরেট-টক্টরেট?
বিরক্তি সত্ত্বেও কথার ধরনে কেমন খটকা লাগল শঙ্করের। এ যেন ঠিক সামান্য পড়াশুনা করা মেয়ের উক্তি নয়। ফিরে আবার দেখল একটু।–আপনি কি পাস?
–আপনার থেকে একটু বেশিই হবে–ফিলসফি অনার্স নিয়ে বি. এ. পাস করেছিলাম, এবারে এম. এ. দেবার কথা ছিল। এতে হাই স্কুলের চাকরি হবে না?
বিশ্বাস করবে কি করবে না শঙ্কর সারাভাই ভেবে পেল না কয়েক মুহূর্ত। খোঁচা খেয়েও মুখের দিকে চেয়ে রইল খানিক। সেই অবকাশে দিদির আবির্ভাব। যশোমতী সচকিত। ওদিকে মাকে দেখামাত্র রাজু মামার বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করল, মা মাসির সঙ্গে মামা ঝগড়া করছিল।
ঠোঁটের ফাঁকে হাসি এসেই গেল এবারে যশোমতীর। আর রাগতে গিয়ে শঙ্করও হেসে ফেলল। ওদিকে দিদি দুজনকেই নিরীক্ষণ করল একবার। তার কেমন একটা সন্দেহ হয়েছিল, ভাই আগে থেকেই হয়তো বা চেনে এই মেয়েকে, তাই বিপদে পড়েছে শুনে একেবারে বাড়িতে নিয়ে এসেছে। ঝগড়ার কথা শুনে সন্দেহটা আরো পাকা হল।
হেসে বলল, তোরই তো মামা, ঝগড়া করবে না? কি হয়েছে?
প্রশ্নটা যশোমতীর দিকে চেয়ে। যশোমতী হাসিমুখেই মাথা নাড়ল, কিছু হয় নি। শঙ্কর ভাগ্নের উদ্দেশে চোখ পাকালো, এই পাজী, কি ঝগড়া করেছি?
দিদি মন্তব্য করল, বলেছিস কিছু নিশ্চয়, নয়তে ও বলবে কেন? ভালো কথা, যা বলতে এলাম–তোর কাজ শেষ হয়েছে না হয় নি?
-কেন? শঙ্কর সন্দিগ্ধ।
–একবার বাজারে বেরুতে হবে না? লীলার জন্যে একজোড়া শাড়ি কিনে নিয়ে আয়, ওই একখানা শাড়িতেই চলবে নাকি, তাও ভালো শাড়ি–লোকের সঙ্গে দেখাশুনা করার জন্যেও ওটা তুলে রাখা দরকার। বাড়িতে পরার জন্য তুই একজোড়া কিনে নিয়ে আয়, তারপর তোর সময়মতো নিজে হাতে আর একজোড়া ভালো শাড়ি বানিয়ে দিস। বক্তব্য শেষ করে দিদি যশোমতীর দিকে ফিরল। ভাইয়ের প্রশংসা করতেও কার্পণ্য করল না। বলল, ইচ্ছে করলে ও নিজেই খুব ভালো শাড়ি বানাতে পারে, দেখবে’খন–
সে-ই যে লীলা নিজেরই খেয়াল ছিল না। খেয়াল হতে সঙ্কোচে আড়ষ্ট। আর দিদির কথা শোনার পর যে মুখ হল। ভদ্রলোকের, তাও দেখার মতই।
শঙ্কর সারাভাই আকাশ থেকেই পড়ল বুঝি। চিরাচরিত অনুভূতিটা সামলে নিতে সময় লাগল একটু। গম্ভীর মুখে একবার যশোমতীর দিকে তাকিয়ে দিদির মুখোমুখি হল সে। –দু’ জোড়া মানে চারটে শাড়ি লাগবে? তা কত দিনের ব্যবস্থা?
ভাইয়ের মেজাজ তেতেছে বুঝেছে, কিন্তু বক্তব্যটা কি দিদির ঠিক বোধগম্য হল না। জিজ্ঞাসা করল, কি বলছিস?
–বলছি, উনি কতদিন থাকবেন এখানে?
এ ধরনের উক্তির সঙ্গে দিদি পরিচিত। কিন্তু ইচ্ছে করেই অর্থাৎ সব জেনে-শুনেও মেয়েটাকে লজ্জা দিচ্ছে ভেবে বিরক্তও। বলল, তোর যেমন কথার ছিরি, কাজের চেষ্টায় নিয়ে এলি আর ভালো রকম চেষ্টা-চরিত্র না করেই ওই দাদার বাড়িতে ফিরে যাবে আবার! নাকি গেলে ওই দাদা এরপর আর একটুও ভালো ব্যবহার করবে ওর সঙ্গে। ব্যবস্থার কথা তোকে কিছু ভাবতে হবে না, লীলার সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে-তোকে যা বললাম, কর, টাকা আমিই দেব’খন, খরচের কথা শুনলেই তোর ভদ্রতাজ্ঞান পর্যন্ত থাকে না।
দিদি চলে গেল। শঙ্কর সারাভাই তখনো ভেবে পেল না, মাত্র একদিনের পরিচয়ের এক বিপদগ্রস্ত অজানা মেয়ে দিদির এরকম আপন হয়ে গেল কি করে। দু-চার মুহূর্ত আবার তাকে নিরীক্ষণ করে কাজের দিকে এগিয়ে গেল সে।
যশোমতী বিব্রত বোধ করছে বটে, আবার পরিস্থিতিগুণে মজাও পাচ্ছে। রাজুর হাত ধরে পায়ে পায়ে সে-ও সেদিকে এগলো। চুপচাপ দাঁড়িয়ে কাজের বহর দেখল একটু সে-যে আবার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে লক্ষ্য করেও করছে না। অতএব যশোমতী তাকে ডেকেই বলল, শুনুন, এভাবে আপনাদের ঘাড়ের ওপর বসে থাকার ইচ্ছে সত্যিই আমার নেই–যদি সরাতে চান তো আগে আমার একটা কাজের যোগাড় করে দিন। যে-ভাবে চলে এসেছি, বাড়ি ফের সত্যিই আর এখন সম্ভব নয়। আর, আপনাকে একটা কথা বলছি, ঋণ রাখার আমার অভ্যেস নেই, আপনারা যা করেছেন সেটা অবশ্য শোধ করা যাবে না কিন্তু টাকার ঋণ থাকবে না, আপনি নিশ্চিন্ত হোন।
টাকার প্রসঙ্গ উঠতে শঙ্কর উষ্ণ হয়ে উঠল, কারণ, এটা সে ঠেস বলেই ধরে নিল। কিন্তু কিছু বলতে পারল না। তার আগেই রাজুর হাত ধরে মন্থর পায়ে প্রস্থান করল যশোমতী। কাজ ফেলে শঙ্কর সারাভাই সেদিকে চেয়েই রইল। মেয়েটির কথাবার্তা হাব ভাব, আচরণ সবই অদ্ভুত লাগছে তার। ইচ্ছে থাকলেও খুব যেন অবজ্ঞা করা যায় না। এম. এ. পরীক্ষা দেবার কথা ছিল শোনার পর আরো ধাঁধায় পড়ে গেছে সে। অনার্স নিয়ে বি. এ. পাস করার পর শহর ছেড়ে চাকরির খোঁজে এ-রকম একটা জায়গায় আসবে কেন! হতে পারে দাদার কাছ থেকে দূরে থাকতে চায়, তাহলেও মেয়েদের হাইস্কুল তো অনেক জায়গাতেই আছে, তার বদলে এলো প্রাইমারি স্কুলের চাকরির চেষ্টায়।
শঙ্করের সবই দুর্বোধ্য লাগছে।
কাজে আর মন বসল না। জোরালো আলোর অভাবে ভালো করে বিকেল না হতে এখানকার আলোয় টান ধরে। বিহারীকে সব গুছিয়ে রাখতে বলে সাবান হাতে পুকুর ধারে চলে এলো। মুখ-হাত ভালো করে ধুয়ে ঘরে ফিরল। রাজুর বা তার ভুইফেঁড় মাসির কাউকে এদিকে দেখল না। জামা-কাপড় বদলে বেরিয়ে পড়ল সে। দুই একজনের সঙ্গে দেখা করে, লাভের অংশ দিয়েও যদি কিছু টাকা আনতে পারে।
সুরাহা হল না। টাকা দেবার নামেই মাথায় আকাশ ভাঙে সকলের। তবু সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরল যখন, একজোড়া শাড়ি হাতে করেই ফিরল। কিন্তু দাওয়ায় ঢোকার আগেই গান কানে এসেছে। ভক্তিমূলক গান। শঙ্কর দাঁড়িয়ে গেল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনল। ব্যবসা নিয়ে নাকানিচোবানি খাবার পর থেকে মন দিয়ে একটা আস্ত গানও কখনো শুনেছে কিনা সন্দেহ। সমস্ত দিনের পরিশ্রমের পর এই গান যেন স্নায়ু-জুড়ানো স্পর্শের মতো। এই অনুভূতিটা নতুন। দিদির অনুরোধেই আর একখানা গানও হল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শঙ্কর সেটাও শুনল।
তারপর ভিতরে এসে দাঁড়াল। ঘরের বাইরের দাওয়ায় বসে গান হচ্ছিল। শুধু দিদি আর রাজু নয়, সমঝদার শ্রোতার মতো অদূরে বিহারীও বসে গেছে।
তাকে দেখে দিদি বলল, তুই তো একবারও শুনলি না, আহা, বোনের আমার খাসা মিষ্টি গলা, আর কি দরদ! ওকে একখানা শোনাও না।
যশোমতী হাসিমুখেই অনুরোধ নাকচ করে দিল, বলল, গান সকলের ভালো লাগে না দিদি, আজ থাক্।
ওদিক থেকে বিহারী উঠে দাঁড়িয়ে মন্তব্য করল, দাদাভাই ছেলে বেলায় খুব গলা ছেড়ে গান করত, আধমাইল দূর থেকে শোনা যেত। বড় হয়ে গান ভুলেছে।
দিদি হেসে উঠল।–সত্যি, কি গানই করত, কান ঝালাপালা। কাপড় আনলি?
পুঁটলিটা দিদির হাতে দিয়ে শঙ্কর চুপচাপ ঘরে ঢুকে গেল। দিদি সেটা খুলে হারিকেনের স্বল্প আলোয় শাড়ি-জোড়া আগে পরখ করে নিল, রাগের মাথায় কি এনে হাজির করেছে সেই সংশয়। দেখে অপচ্ছন্দ হল না। শাড়ি জোড়া যশোমতীর দিকে এগিয়ে দিল।–নাও।
রাজ্যের সঙ্কোচ আবার। তবু হাত বাড়িয়ে নিতে হল শাড়ি জোড়া। না নিয়েই বা করবে কি। কিন্তু নেবার সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞাত রোমাঞ্চকর অনুভূতি কি একটা। জীবনে পাওয়ার দিকটা তার এত প্রশস্ত যে সামান্য দু’খানা আটপৌরে শাড়ি হাতে নেবার এই প্রতিক্রিয়া নিজের কাছেই বিস্ময়কর।
ঘরে বসে ভাবছে যশোমতী। কপাল-গুণে একটা ভালো জায়গাতেই সে এসে পড়েছে। কিন্তু বাড়ি-ঘর ছেড়ে এসে মাঝখান থেকে এই জায়গায় সে আঁকড়ে পড়ে থাকবে? কি করবে? চাকরি পেলেই বা থাকবে কোথায়?
-লীলা, খেতে এসো। ওদিক থেকে দিদির গলা কানে এলো।
যশোমতী আবারও খেয়াল করল না যে এখানে সে লীলা হয়ে বসেছে।….ভাবছে দুপুরের দিকে ওদিকের কোন্ বাড়ির বউ এসেছিল–যার কাছ থেকে শাড়ি ধার করা হয়েছিল। শাড়ি চেয়ে পাঠানোর ফলেই আসার কৌতূহল হয়েছিল কিনা কে জানে। যশোমতীকে দেখে অবাকই হয়েছিল বউটি, জিজ্ঞাসা করেছিল, কে। দিদি তার সামনেই চট করে পরিচয় দিয়েছিল, তাদের দূর-সম্পর্কের আত্মীয়। স্কুলে চাকরির চেষ্টায় এসেছে–
কিন্তু আত্মীয় হলেও বা চাকরির চেষ্টায় এলেও এক, শাড়ি নিয়ে কেউ এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গায় আসে কেমন করে তাই বউটির কাছে খুব স্পষ্ট হয় নি।
-লীলা, খাবে এসো।
দিদির দ্বিতীয়বারের ডাকও কানে গেছে। কিন্তু সেই-ই যে লীলা, এই ভাবনার মধ্যে পড়ে এবারেও সচেতন হল না। নিজের এলোমেলো চিন্তায় তন্ময় সে।….গত রাত্রিতে এই ঘরে একা থাকতে তার কেমন ভয়-ভয় করছিল। আজ ভাবছে দিদিকে বলে রাজুকে এ ঘরে নিয়ে আসবে কি না। তাছাড়া আর একটা কথা ভেবেও তার সঙ্কোচ হচ্ছে। ওই ভদ্রলোকের ঘর এটা, সে ঘর দখল করার ফলে ঘরের মালিককে তার ফ্যাক্টরির ঘরে বিহারীর সঙ্গে জায়গা করে নিতে হয়েছে। কিন্তু দিদির ঘরে গিয়ে ভাগাভাগি করে থাকতেও মন সায় দেয় না। কি করবে যশোমতী?
-লীলা, খাবে না? দোরগোড়ায় দিদি এসে দাঁড়িয়েছে।
ধড়মড় করে চৌকি ছেড়ে নেমে দাঁড়াল যশোমতী। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, আমাকে বলছেন?
দিদি বিস্মিত। আর যশোমতী মনে মনে অপ্রস্তুতের একশেষ। নিজের নতুন নাম নিয়ে তৃতীয়বার গণ্ডগোল। দিদি সস্নেহে বলল, কি অত আকাশ-পাতাল ভাবছ? এসে যখন পড়েছ–সব ঠিক হয়ে যাবে, খাবে এসো।
বাইরে এসে দেখল, ভদ্রলোকটিও খাওয়ার আসনে বসে নিঃশব্দে তাকে লক্ষ্য করছে। অর্থাৎ, সে যে বিলক্ষণ ভাবনা-চিন্তার মধ্যে পড়েছে ধরে নিয়েছে। নাম নিয়ে গণ্ডগোলটা মাথায় আসার কথা নয় বলেই রক্ষা।
.
আগের দিনের মতই খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল যশোমতীর। পাশে রাজু শুয়ে, তাকে ঠেলে তুলল। তারপর মুখ হাত ধুয়ে দু’জনে চলল, বাগান পেরিয়ে পুকুরঘাটের দিকে। রাত্রিতেই রাজুর কাছে শুনেছিল, মামা মোজ ওই সময়ে পুকুরে চান করে।
শুধু এটুকু দেখার জন্যেই যে আসা, সেটা স্বীকার করতে যশোমতীর নিজের কাছেই লজ্জা।
আজকের দেখাটা আরো একটু সহজ হল। চান যে করছে তার যখন ভ্রূক্ষেপ নেই, সে মাঝখান থেকে লজ্জা পেতে যায় কেন। আজও মামা-ভাগ্নের ঘটা করে চান হল। যশোমতী দেখছে, হাসছে–তার ভালো লাগছে।
কিন্তু সেদিন আর সে ফ্যাক্টরিতে গেল না ইচ্ছে করেই। মিছিমিছি ভদ্রলোকের কাজের ব্যাঘাত ঘটিয়ে লাভ কি। ফলে আবার দেখা সেই সন্ধ্যার পরে। হাব-ভাব দেখে যশোমতীর মনে হল গান শোনার ইচ্ছে। দিদি ইতিমধ্যে দুই-একবার গান গাইতে বলেছে, বিহারীও আশায় আশায় কাছেই ঘুরঘুর করছে। গান করার জন্য প্রস্তুতও ছিল বলতে গেলে। কিন্তু কি খেয়াল চাপল মাথায়, যশোমতী দিদিকে বলে বসল, আজ থাক, শরীরটা ভালো লাগছে না।
দিদি ব্যস্ত হয়ে উঠল, থাক তাহলে। কি খারাপ লাগছে, নতুন জায়গায় জ্বর-জ্বালা এলো না তো? বলে কপালে হাত ঠেকালো।–না গা তো ঠাণ্ডাই।
আর একটু পরেই দেখা গেল গম্ভীর মুখে শঙ্কর সারাভাই বেরিয়ে গেল। যশোমতীর তখনই অনুশোচনা হল একটু, গাইলে হত। কিন্তু মনে মনে কেন যেন খুশিও আবার।
পরদিন শঙ্কর সারাভাইকে চানের ঘাটে দেখা গেল বটে, কিন্তু চানের পর কারখানায় তার সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। বিহারীকেও দেখা গেল কারখানা ছেড়ে এদিকেই ঘোরাঘুরি করছে। দিদির কাছে যশোমতী শুনল, কাজ এ-রকম অনেক দিনই বন্ধ থাকে। কখনো সড়কের ছোটখাট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে যেতে হয় বলে, কখনো বা কাঁচা মালে টান পড়ে বলে। তাছাড়া, ভাতা কল বিগড়ানো তো আছেই। আজ কি জন্যে ফ্যাক্টরি বন্ধ দিদি সঠিক করে বলতে পারল না।
যতবার ফ্যাক্টরি শব্দটা শোনে অতোবারই হাসি পায় যশোমতীর। আবার দুঃখও হয়।
শঙ্কর বাইরে থেকে ফিরল সকাল সাড়ে নটা নাগাদ। রাজুকে নিয়ে যশোমতী দিদির কাছে বসে ছিল। দিদি চাল বাছছে, আর যশোমতী বই-সেট নিয়ে রাজুকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে অক্ষর পরিচয়ের চেষ্টায় লেগেছে। এরই ফাঁকে ফাঁকে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে আবার।
কাউকে উদ্দেশ্য করে নয়, শঙ্কর সারাভাই যেন বাতাসেই খবর ছুড়ল, সে জেনে এসেছে প্রাইমারি স্কুল বন্ধ থাকলেও সেখানকার কর্তাব্যক্তিটি আজ আপিসে আসছেন, অতএব এক্ষুনি তার সঙ্গে বেরুলে দেখা হতে পারে এবং চাকরির সম্বন্ধে কথাবার্তা হতে পারে।
খানিক আগেই দিদি আশ্বাস দিচ্ছিল, ঠাকুরের দয়ায় কিছু একটা ব্যবস্থা শিগগীরই হয়ে যাবে। তাই শোনামাত্র তাড়া দিল, যাও যাও, তৈরি হয়ে নাও তাহলে। ভাইয়ের দিকে ফিরল, তুই নিয়ে যাবি তো?
শঙ্কর জবাব দিল না। এই নীরবতার অর্থ অনুকূলই মনে হল যশোমতীর। নতুন উৎসাহে রাজুর বই-স্লেট রেখে তাড়াতাড়ি সে ঘরে গিয়ে ঢুকল। নিজের সেই একমাত্র শাড়ি-ব্লাউজ বদলে নিতে পাঁচ মিনিটও লাগল না। আর তারপরেই কি মনে পড়তে ধুপ করে চৌকিতে বসে পড়ল, এবং বসেই থাকল।
জুতো মাত্র এক পাটি।
তার দেরি দেখে দিদি ঘরে এলো, শঙ্করও দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। দিদি অবাক, কি হল, বসে আছ যে, যাবে না?
বিব্রত মুখে যশোমতী দরজার দিকে তাকালো একবার, তারপর বলল, স্যাণ্ডেলের আর-এক পাটি পাচ্ছি না।
সমস্যাটা যে এই মুহূর্তের নয় সেটা ফাঁস করার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু দিদি নিজেই তাড়াতাড়ি স্যাণ্ডেল খোঁজার উপক্রম করতে যশোমতীকে দ্বিধান্বিত মুখে আবার বলতে হল, পাওয়া যাবে না, প্রথম দিন স্যাণ্ডালজোড়া বাইরে ছিল, কুকুর-টুকুরে নিয়ে গেছে বোধহয় একটা–
সঙ্গে সঙ্গে বাইরের লোকটার মুখের যে পরিবর্তন দেখল, অন্যসময় হলে যশোমতী হয়তো তা উপভোগই করত। কিন্তু স্বার্থটা এখন তারই। তাই মনে হল, বিপদ যেন ষড়যন্ত্র করে একের পর এক এসে তার ওপর চড়াও হচ্ছে। এ-সময়ে এই গণ্ডগোলে পড়ার কোনো মানে হয়। ওদিকে দিদিও বিপন্ন মুখে ভাইয়ের দিকে চেয়ে আছে। অর্থাৎ কি করা যেতে পারে তাই জানতে চাইছে।
দিদির এই চাউনিটাই যেন রাগের কারণ শঙ্কর সারাভাইয়ের। সরোষে বলে উঠল, এক পা বুঝে চলার মুরোদ নেই, এ-সব মেয়ে বাড়ি থেকে বেয়োয় কেন। চাকরির চেষ্টায় বেরিয়ে আরো বিভ্রাট বাড়ানোর দরকার কি–ঘরে বসে থাকলেই তো পারে।
দিদি ঘরে না থাকলে যশোমতীরও পাল্টা রাগ হতে পারত, কিন্তু এখন অসহায় মুখটি করে দিদির দিকেই তাকালো সে। ফলে দিদি ব্যাপারটাকে সহজ করে নিতেই চেষ্টা করল, তোর যেমন কথা, রাগ করতে পারলেই হল–ওকি জানে, না গায়ে আর এসেছে কখনো ও কি করবে?
দ্বিগুণ তেতে উঠল শঙ্কর সারাভাই। গাঁয়ে কেন, শহরেও চমৎকার, পাশ থেকে ব্যাগ তুলে নিয়ে গেলেও হুশ থাকে না। তা আমিই বা কি করব, মাথায় করে জুতো নিয়ে আসতে ছুটব এখন?
–তোকে কিছু করতে হবে না। দিদি বেরিয়ে গেল, আর একটু পরেই নিজের বিবর্ণ স্যাণ্ডালজোড়া এনে হাজির করে বলল, এটা পরেই কাজ চালিয়ে এসে কোনরকমে। পায়ে হবে তো আবার…. হবে বোধহয়। ভাইকে হুকুম করল, আসার সময় ওর জন্য দেখেশুনে একজোড়া স্যাণ্ডাল কিনে নিয়ে আসিস।
গরম চোখে ভাই দিদির দিকে তাকালে একবার, তারপরে যশোমতীর দিকে। অর্থাৎ সহেরও সীমা আছে একটা। কিন্তু দৃষ্টি বিশ্লেষণের জন্য অপেক্ষা না করে যশোমতী ততক্ষণে দিদির আধ ছেঁড়া স্যাণ্ডাল পায়ে গলিয়ে দাওয়ায় নেমে এসেছে।
পাশাপাশি যাচ্ছে দু’জনে। কম করে মিনিট সাত-আট সমনোযোগে রাস্তার দু’দিক দেখতে দেখতে চলল যশোমতী। মুখে একটিও কথা নেই। আড়চোখে তারপর পাশের গম্ভীর মূর্তিটি দেখল বার কয়েক, তারপর হঠাৎ যেন রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে বলল, এমন দেশ কে জানত, মানুষ ছেড়ে কুকুরগুলোর পর্যন্ত ভদ্রতা-জ্ঞান নেই একটু, মেয়েছেলের জুতো নিয়ে পালাল!
জবাবে শঙ্কর শুধু রুষ্ট দৃষ্টি নিক্ষেপ করল একটা।
কিন্তু তর্কের ফাঁক খুঁজছে যশোমতী। দম ফেটে এখন হাসিই পাচ্ছে তার। কিন্তু হেসে ফেললে পাশের লোকের ফিরে বাড়ির দিকে হাঁটার আশঙ্কা। গম্ভীর। একটু বাদে আবার বলল, কোনো মহিলা বিপদে পড়লে এমন চেঁচামেচি করে কেউ তাও জানতুম না। সবই বরাত, অমন একশো জোড়া জুতো খোয়া গেলেও বাড়িতে কেউ একটা কথা বলতে সাহস করত না।
শেষেরটুকু বলে ফেলে নিজেই সচকিত। বিপদ ঘটেই গেল বুঝি। সারাভাই মুখ খুলল এবার, বলল, এত কদরের বাড়ি ছেড়ে আপনি এলেন কেন তাহলে? তাছাড়া আপনার জুতো কুকুরে নিয়েছে আগেই জানতেন যখন, আগে বলেন নি কেন?
প্রথম বিপজ্জনক প্রশ্নটার জবাব এড়ানোর তাগিদে কথায় ঝঝি মেশাবার ফাঁকটুকু আঁকড়ে ধরল যশোমতী।–আগে বললে কি হত, খুশিতে আটখানা হয়ে আপনি জুতো আনতে ছুটতেন?
রাগের মাথায় শঙ্কর দাঁড়িয়ে গেল। ফলে যশোমতীও। নিঃশব্দ দৃষ্টি-বিনিময়। অর্থাৎ সে কিছু বললে যশোমতীও পাল্টা জবাব দেবেই। দেবার জন্য প্রস্তুত। ঘটা করে চোখ পাকিয়ে তাই বুঝিয়ে দিল। হাল ছেড়ে শঙ্কর সারাভাই হেসে ফেলল।
যশোমতীও।
স্কুলের আপিস-ঘর। দরোয়ান বসতে দিল তাদের। জানালো, কর্তাবাবু এখনো আসেন নি, এক্ষুনি এসে পড়বেন।
দুজনে দুটো চেয়ারে বসল। শঙ্কর টেবিলের ওপর থেকে একটা কাগজ তুলে নিল। তার অনুকরণে যশোমতীও আর একটা কাগজ তুলে নিল। চাকরির তদবিরে এসেছে, এবং না পেলে সমূহ বিপদ সেটা যেন এতক্ষণ ভুলেই ছিল। কিন্তু হাতের কাগজ খুলতেই সর্বাঙ্গে যেন তড়িত-প্রবাহের ঝাঁকুনি খেল একটা।
কাগজে যশোমতীর ছবি, আর বড় বড় হরফে তাতে পঞ্চাশ হাজার টাকার পুরস্কার ঘোষণা! দ্বিতীয় দিনেই বাবা পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরস্কারের জাল ফেলেছে। কাগজটা পুরনো তারিখের।
তার এই মূর্তি দেখে ফেললে শঙ্কর সারাভাই হয়তো ঘাবড়েই যেত। কিন্তু যশোমতীর মুখ তখন হাতের কাগজের আড়ালে। এমন আড়ালে যে চেষ্টা করেও দেখার উপায় নেই।
যশোমতী কি যে করবে ভেবে পেল না। ভদ্রলোকের হাতের ওই কাগজেও আছে কিনা কিছু কে জানে। দিশেহারাই হয়ে পড়ল সে। যার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে, এ-ছবি হয়তো তার চোখে আগেই পড়েছে। মনে হওয়া মাত্র স্কুলের ভদ্রলোকের সাথে দেখা হয়ে যাওয়াটাই যেন সব থেকে বড় বিভীষিকা।
কাগজ ছেড়ে যশোমতী দাঁড়িয়ে উঠল হঠাৎ। বলল, চলুন, বাড়ি যাব–
কাগজ সরিয়ে শঙ্কর সারাভাই আকাশ থেকে পড়ল। কি বলছে তাও যেন বোধগম্য হল না। এই মুখ দেখেও অবাক। ফ্যালফ্যাল করে চেয়েই রইল সে।
যশোমতী তাড়া দিল, কথা কানে যাচ্ছে? উনি, আমি এক্ষুনি বাড়ি যাব–আমার শরীর ভয়ানক খারাপ লাগছে।
হকচকিয়ে গেল শঙ্কর সারাভাই। মুখ হঠাৎ এত লাল দেখে আর এই উগ্র কণ্ঠস্বর শুনে ঘাবড়েই গেল। বলতে চেষ্টা করল, কিন্তু খবর পাঠানো হয়েছে, ভদ্রলোকের সঙ্গে
আঃ! আমি চাকরি করব না এখানে, চলুন শিগগীর।
এক ঝলক আগুনের ঝাপটা লাগল শঙ্কর সারাভাইয়ের চোখে-মুখে। কিছু বোঝার আগেই যশোমতী হহ করে দরজা পেরিয়ে এগিয়ে গেছে অনেকটা।
বিমূঢ় বিস্ময়ে শঙ্কর অনুসরণ করল।
খানিকটা পা চালিয়ে আসার পর ধরা গেল তাকে। মুখ স্বাভাবিক নয় তখনো। শঙ্কর ভয়ই পেয়েছে। গতকালও দিদিকে শরীর ভালো না বলেছিল মনে পড়ল। জিজ্ঞাসা করল, কি হল হঠাৎ বলুন তো, কি খারাপ লাগছে?
ক্ষোভের মাথায় যশোমতী বলে উঠল, সব খারাপ, সমস্ত দুনিয়াটা খারাপ লাগছে, বুঝলেন?
শঙ্কর রাগ করবে কি, দুর্ভাবনা ছেড়ে তার বিস্ময়েরও শেষ নেই। মুখ এখনো সেই রকমই লাল প্রায়। চুপচাপ একটু লক্ষ্য করে জিজ্ঞাসা করল, হেঁটে যেতে পারবেন না রিকশা ডাকব?
যশোমতীর কেন যে রাগ কাকে বলবে? জবাব দিল, থাক, রিকশা ডাকলেই তো আপনার বাজে খরচ! পরে খাটা দিতে ছাড়বেন? আবারও এগিয়ে গেল সে।
বিস্ময়ের ঘোর কাটতে হঠাৎ একটা সন্দেহ উঁকিঝুঁকি দিল শঙ্করের মনে। সন্দেহটা মনে আসার পর এই মুখ দেখে আর চল। দেখে এখন আর খুব অসুস্থ মনে হচ্ছে না তার। বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে এসে চুপচাপ তার পাশে পাশে চলল, দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। একটু বাদে আচমকা জিজ্ঞাসা করে বসল, আপনার ডিগ্রীর সার্টিফিকেট টার্টিফিকেটগুলো কোথায়?
এই মানসিক অবস্থায় এ-রকম একটা প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না যশোমতী। থতমত খেল। মুখ ঘুরিয়ে তাকালো তার দিকে। –সার্টিফিকেট? আনিনি তো….
চট করে এও মাথায় এলো না যে বলবে, সার্টিফিকেট ও ব্যাগের সঙ্গেই চুরি গেছে। এ-রকম প্রশ্ন কেন তাও ভাবার অবকাশ পল না। নিছক সত্যি কথাটাই বলে ফেলেছে।
দৃষ্টি ঘোরালো শঙ্কর সারাভাইয়ের চাকরি কি আপনার মুখ দেখে হয়ে যাবে ভেবেছিলেন? স্কুলে চাকরির চেষ্টায় এসেছেন আর ডিগ্রীর সার্টিফিকেট সঙ্গে আনেন নি?
আবার কিছু একটা বিড়ম্বনার মধ্যে টেনে আনা হচ্ছে তাকে। যশোমতী মাথা নাড়ল শুধু। আনেনি।
একটু থেমে শঙ্কর প্রায় নির্লিপ্ত মুখেই জিজ্ঞাসা করল, আপনি সত্যিই বি, এ. পাস করেছেন?
কি! সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে উঠল। রাগে আবার সেই রকমই মুখ লাল যশোমতীর।
শঙ্কর জবাবের প্রতীক্ষা করছে, সন্দেহ যখন হয়েছে রাগ-বিরাগের ধার ধারে না।
আবার ভেবে-চিন্তে জবাব দেবার ব্যাপারে ভুল হয়ে গেল যশোমতীর। সন্দেহটা স্পষ্ট হওয়া মাত্র মাথা আরো বিগড়েছে। বলে উঠল, আপনি ওখানকার মেয়ে-কলেজে চিঠি লিখে দেখুন সত্যি কি মিথ্যে, এম. এ-ও পড়েছি কিনা য়ুনিভার্সিটিতে লিখে জেনে নিতে পারেন–
পর মুহূর্তে খেয়াল হল, সত্যিই লেখে যদি, মিথ্যেই প্রমাণ হবে। কারণ, য়ুনিভার্সিটিতে অন্তত লীলা নায়েক বলে কেউ নেই, আর সত্যিকারের লীলা নায়েক আই. এ. পাশ করার আগেই বিয়ে করে পড়াশুনার পাট চুকিয়েছে। ফলে রাগের চোটে মাথা আবার খারাপ হবার দাখিল তার।
শঙ্কর সারাভাইয়ের দৃষ্টি পার্শ্ববর্তিনীর মুখের উপর থেকে নড়ছে না।–আপনি এভাবে চলে এলেন কেন?
যোগ্য জবাব হাতড়ে না পাওয়ার ফলেও ক্রুদ্ধ যশোমতী। বি. এ. অনার্স পাশ করে প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করব কেন?
-তাহলে আপনি দেখা করতে এলেন কেন?
-এমনি। প্রথমে ভেবেছিলাম করব, পরে মনে হল করব না। জটিলতা নিজেই পাকিয়ে তুলেছে। তাই কথার সুর আপনা থেকেই নরম একটু, বলল, আপনি বরং গানের স্কুল যেটা হবে সেখানে আগে থাকতে চেষ্টা করে দেখুন।
এবারে শঙ্করের ধৈর্য শেষ।–আমার দায় পড়েছে আপনার চাকরির চেষ্টায় ঘুরতে।
হঠাৎ যশোমতীর মনে হল, লোকটাকে আরো তাতিয়ে দিতে পারলেই এ-যাত্ৰা বাঁচোয়া। নইলে সন্দেহ আরো কোন পর্যায়ে গড়াবে ঠিক নেই।
দুর্বলতার জায়গা বেছে নিয়েই ঘা দিতে চেষ্টা করল।–দায় তো পড়েইছে, নইলে আপনার টাকা শোধ হবে কি করে?
শঙ্করও ঠাস করে জবাব দিল, আর শোধ হয়েছে! পুরুষের ওপর বসে খাওয়া আর পরা ছাড়া আপনাদের আর কোনো ক্ষমতা নেই, বুঝলেন?
বুঝলাম। কিন্তু পুরুষের ক্ষমতাও তো দেখছি, খাওয়া-পরা যোগাতেই বা ক’জন পারে!
রাগে মুখ সাদা শঙ্কর সারাভাইয়ের। সে ভেবে পায় না, এ-রকম অবস্থায় পরেও একটা মেয়ে এ-ভাবে কথা বলতে পারে কি করে।
আড়চোখে এক-একবার তাকে লক্ষ্য করছে যশোমতী, আর নিশ্চিন্ত বোধ করছে। বাড়ির কাছাকাছি এসে জিজ্ঞাসা করল, দিদিকে কি বলবেন?
ঝাঁঝালো জবাব এলো, কি বলতে হবে সেটাও আপনি অনুগ্রহ করে বলে দিন।
একটু ভেবে অনুগ্রহ করেই যেন বলে দিল যশোমতী।–বলবেন চাকরি হল না।
আর যদি জিজ্ঞাসা করে, কেন হল না?
বলবেন, প্রাইমারি স্কুলের পক্ষে ওভার-কোয়ালিফায়েড–এত বিদ্যে থাকলে অত ছোট স্কুলের চাকরি হয় না।
নিজেই বিস্মিত যশোমতী, কি যে আছে অদৃষ্টে কে জানে, রাগ দুর্ভাবনা ভুলে হাসতেও পারল।
কিন্তু শঙ্করের হাসির মেজাজ নয় আপাতত। বলল, আপনার কোন্ কথাটা সত্যি আর কোষ্টা সত্যি নয়, সেটা আমার কাছে একটুও স্পষ্ট নয়।
সঙ্গে সঙ্গে আবার অসহিষ্ণু মূর্তি যশোমতীর।–কে আপনাকে অত মাথা ঘামাতে বলেছে? দিদিকে আপনার যা খুশি বলুন গে যান, আমাকে চলে যেতে হবে এখান থেকে এই পর্যন্ত–সেটা যে আপনি সব সময়ে চাইছেন তা আমার বুঝতে একটুও কষ্ট হচ্ছে না। ব্যাগটা চুরি না গেলে আপনাকে বুঝিয়ে দিতে পারতুম টাকার পোয়া আমি করি কি না।
শঙ্কর সারাভাই চুপ। তার কেবলই মনে হতে লাগল এ-রকম মেয়ে সে জীবনে দেখেনি।