মূল সভাপতি একজন
দুজনকেই দেখেছি। যশোমতী পাঠককে সম্মেলনের প্রতি দিনই। শঙ্কর সারাভাইকে একদিন। কিন্তু সেই একটা দিনের চিন্তা অজ্ঞাত অনেকগুলো দিনের মধ্যে প্রসারিত হতে চেয়েছে।
মূল সভাপতি একজন। শাখা সভাপতি এবং প্রধান অতিথির সংখ্যা অনেক। কিন্তু সভানেত্রীও একজন। যশোমতী পাঠক। অবশ্য সেটা স্থানীয় সম্পাদকের উদাত্ত ঘোষণায় জানা গেছে। সভানেত্রীর নীরব উপস্থিতি ছাড়া আর কোনো কাজ আছে বলেই মনে হয়নি আমার। বক্তৃতা করা দূরে থাক সভাপরিষদদের সঙ্গে উঁচু ডায়াসে গিয়েও বসেনি। সামনের সারির শ্রোতাদের এক পাশে একটা নির্দিষ্ট আসনে প্রত্যহ চুপচাপ বসে থাকতে দেখা গেছে তাকে। ত্রিপুরারি তার হয়ে সুপারিশ করেছে, বলেছে কর্মী যে যত প্রবল তার দুই ঠোঁট ততো বেশি সেলাই করা, বুঝলে? ওই মহিলা একদিন না এলে এমন জম-জমাট সভা-ঘর নীরস লাগত সকলের। এসে যখন ঢোকে, কেমন লাগে বল তো?
শেষের উক্তিতে আতিশয্য ছিল না। এই বিশাল হল-ঘরে মহিলার পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে এখানকার কর্মকর্তাদের চোখে-মুখে এক ধরনের নীরব অথচ উৎফুল্ল তৎপরতা লক্ষ্য করেছি। আর সমবেত স্থানীয় ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলাদের সসম্ভ্রমে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেও দেখেছি। অভ্যস্ত সহজ সৌজন্যে এই শ্রদ্ধা গ্রহণ করে হাসিমুখে সহজোড়া চোখের ওপর দিয়ে এগিয়ে এসে সে মঞ্চের সামনের আসনটি গ্রহণ করেছে। সেই আসনও তার জন্য নির্দিষ্ট ছিল না। প্রথম দিন স্থানীয় উদ্যোক্তারা শশব্যন্তে তাকে মঞ্চের আসনে নিয়ে বসাতে চেয়েছিল। হাসিমুখে মহিলা শুধু একবার হাত নেড়ে দিয়ে সামনের আসনটিতে বসে পড়েছিল। তারপর রোজই সেই আসনে বসছে।
লক্ষ্য শুধু আমি নয়, সকল অতিথিবর্গই করেছে।
ত্রিপুরারি চল্লিশ বছর বয়েস বলেছিল মহিলার। আর তারপর পনেরোটা বছর হেঁটে নিতে বলেছিল তার থেকে। অতিশয়োক্তি করেনি। ….আর তার চেহারা প্রসঙ্গে আমার কৌতূহলের জবাবে বলেছিল, সামনে এসে দাঁড়ালে হিসেব-পত্র ভুল হবার মতো। সেই কাঠখোট্টা উপমা শুনে রূপসী বোঝা গিয়েছিল। সুখের ঘরে এই রূপের বাসা অভাবনীয় কিছু নয়। অর্থও রূপ বাড়ায়। সেই রূপ কিছুটা দেখা আছে। সেই রূপের থেকে চিত্ত বিচ্ছিন্ন করা কঠিন ব্যাপার। কিন্তু আমার চোখে সব থেকে বেশি লোভনীয় যেটুকু মনে হয়েছে, সেটা মহিলার ঐশ্বর্যের ছটাও নয়, রূপের ছটাও নয়। সেটা রমণী-মুখের প্রায়-নিরাসক্ত কৌতুক-মাধুর্য। শুধু সেইটুকু লক্ষ্য করে দেখলে অ-শিল্পীরও শিল্পী হতে সাধ হতে পারে। সারাক্ষণ সেই কৌতুক যেন নিঃশব্দে একটু হাসি হয়ে চোখের পাতায় আর ঠোঁটের ফাঁকে টলমল করছে।
ত্রিপুরারির মুখে এত কথা শোনা না থাকলে আমি এভাবে দেখতুম কিনা জানি না। সমস্তক্ষণের মধ্যে কতবার চোখদুটো ওই মুখের দিকে ধাওয়া করেছে, পাশে বসেও চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট ত্রিপুরারি ঘোষ তা খেয়াল করেনি। খেয়াল করলে আমার লজ্জার কারণ হতে পারত। কারণ অভিযোগটা সকলরবে সে তার গৃহিণীর কাছে পেশ করত।
আলাপ ঠিক নয়, তবে প্রথম দিনের অধিবেশনেই পরিচয় হয়েছিল মহিলার সঙ্গে। উদ্যোক্তাদের মারফত নিতান্ত আনুষ্ঠানিক পরিচয়। মহিলা উঠে দাঁড়িয়ে দু’হাত জোড় করে অভিবাদন গ্রহণ করেছে এবং জানিয়েছে। অন্যদের বেলায় এটুকুতেই শেষ হয়েছে, আমাকে শুধু বলেছে, আপনার কথা ঘোষবাবুর মুখে শুনেছি।
বলা বাহুল্য, আমি খুব কৃতার্থ বোধ করিনি। ত্রিপুরারিকে ঘোষবাবু না বলে মিস্টার ঘোষ বললে কানে একটু অন্যরকম লাগত কিনা বলতে পারি না। অস্বস্তিকর অনুভূতিটা গোপন করা সহজ হচ্ছিল না খুব। ত্রিপুরারি আমার বন্ধু। আর ঘোষবাবু এর বেতনভুক। কর্মচারী। তুলনা দিতে হলে কুবের-নন্দিনীর দ্বাররক্ষী উপমাটাই মনে আসে। বন্ধুকে ভালোবাসি, কিন্তু ঘোষবাবুর মতো অনুগ্রহভাজন হতে চাই না।
অবশ্য এটা নিতান্ত ব্যক্তিগত একটা বেখাপ্পা অনুভূতির ব্যাপার। বিশ্লেষণ করতে বললে অনেক রকম ব্যাখ্যা করে নিজের দুর্বলতা চাপা দেওয়া যেতে পারে। সে চেষ্টা করব না। সেই মুহূর্তে আমি মহিলার ঘোষবাবুর কথা ভাবিনি, নিজের কথাই ভেবেছি। আমার আসন শ্রোতাদের সঙ্গে। কিন্তু ওই ডায়াসের ওপরেও হতে পারত। কর্মকর্তাদের অনেক টানা-হেঁচড়া সত্ত্বেও কোনো শাখার ভার নিতে আমি রাজি হইনি। এখানে আসার সেটাই শর্ত ছিল–শ্রোতা হব, বক্তা নয়। সেজন্যে অবশ্য খেদ নেই এখনো, কিন্তু তবু মানুষের নিভৃতের কারিকুরি বড় বিচিত্র। মহিলার মুখে ঘোষবাবু, শুনেই কেমন মনে হল, আমার আসনটা আর একটু উঁচুতে, অর্থাৎ, ওই ডায়াসের ওপরে হলে মন্দ হত না।
তৃতীয় অধিবেশন-শেষে বিকেলের দিকে শঙ্কর সারাভাইয়ের দর্শন মিলল। ইতিমধ্যে ভদ্রলোকটির সম্বন্ধে কৌতূহল আরো একটু বেড়েছে। কেন, সেটা পরের প্রসঙ্গ। হলঘরে পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে অনেককে ঘড় ফেরাতে দেখে বোঝা গেল গণ্যমান্য কেউ এলো। ত্রিপুরারি আমার পাজরে একটা খোঁচা দিয়ে বলল, শঙ্কর সারাভাই!
মাথা ঝাঁকিয়ে হাসিমুখে অনেকের অভিবাদনের জবাব দিতে দিতে এগিয়ে এলো। সৌম্যদর্শন লম্বা-চাওড়া মূর্তি। গায়ের রং কালোর দিক ঘেঁষা। মাথার ঝাকড়া চুলের দু’দিকে পাক ধরেছে। কপালের চামড়ায় গোটা দুই ভাঁজ পড়ে আছে। সেটা বয়সের নয়, প্রাজ্ঞ গাম্ভীর্যের নিদর্শন। অবশ্য, ত্রিপুরারির হিসেব ধরে ভদ্রলোকের বয়েস ঠিক পঁয়তাল্লিশ মনে হয় না, আরো কিছু বেশি মনে হয়। পরনে ঢোলা পাজামা, গায়ে লম্বা ঝুলের গরদের পাঞ্জাবি।
সব মিলিয়ে এক জোরালো পুরুষের মূর্তিই বটে।
কিন্তু এই মূর্তি পর্যবেক্ষণে আমি বেশি সময় অপচয় করিনি। আমার দু-চোখ ধাওয়া করেছে ও-পাশের দু’সারি আগের রমণীর মুখের দিকে। এই একজনের আবির্ভাবে সঙ্গে সঙ্গে ওই মুখের রং বদল দেখব এমন আশা অবশ্য করিনি। তবু, ত্রিপুরারির সকল বচন সত্য হলে দৃষ্টি আপনা থেকেই ওদিকে ছুটবে। না, ব্যতিক্রম কিছু চোখে পড়েনি। কৌতুক-মাধুর্য মেশা মুখখানা আরো একটু নির্লিপ্ত মনে হয়েছে শুধু। কে এলো না এলে সে সম্বন্ধে সচেতন নয় যেন। ….তবে এও নিজের কল্পনা হতে পারে।
ভদ্রলোকের অর্থাৎ শঙ্কর সারাভাইয়ের আজই সভার এই শেষ মাথায় হাজিরা দেবার পিছনে অন্য কোনো আকর্ষণ আছে কিনা, সে কথা পরে মনে হয়েছে। পরে, অর্থাৎ ঘন্টাখানেক পরে। আজই এই একজনের শুভাগমন হতে পারে সে-কথা ত্রিপুরারিও বলেনি, অর্থাৎ, তারও জানা ছিল না। হালকাগোছের সাহিত্য-প্রোগ্রাম ছিল সেদিন। তারপর গানের আসর। নিছক অনুমান কিনা জানি না, মনে হল এই গানের আসরই তাকে টেনেছে।
এই অনুষ্ঠানে প্রথমেই যে নামটি ঘোষণা করা হল, সেই নাম যশোমতীর। ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় অভ্যাগতদের বিপুল করতালি। এ-রকম অভ্যর্থনা গানের খাতিরে কি গায়িকার খাতিরে পাশে ত্রিপুরারি থাকলে জিজ্ঞাসা করতাম হয়তো। কিন্তু ত্রিপুরারি পাশে নেই, শঙ্কর সারাভাইকে দেখেই সেই যে ‘আসছি’ বলে উঠে গেছে, এখনো ফেরেনি। এই পরিতোষণও চাকরির দায়ে কিনা জানা নেই।
মহিলা আসন ছেড়ে উঠল। জোরালো আলোয় মুখখানা আরো মিষ্টি, আরো একটু হাসি-হাসি দেখাচ্ছে। তাকে আপ্যায়ন করে নেবার জন্য দু’জন ভলান্টিয়ার দৌড়ে এলো। ঈষৎ মন্থর পায়ে যশোমতী ডায়াসে উঠে গেল। মানুষের মাথায় ঠাসা বিশাল হল ঘরটার মেজাজই বদলে গেছে যেন। অনেক সজাগ, অনেক সজীব। নিজের অগোচরে এবারে আমার দুচোখ শঙ্কর সারাভাইকে খুজছে। কিন্তু ভদ্রলোক যে কোন্ দিকের কোন্ সারিতে বসেছে ঠিক্ ঠাওর করা গেল না।
গান হল। শ্রোতাদের সরব সনির্বন্ধ অনুরোধে পর পর তিনটে পান।
একটা ঘণ্টা কোথা দিয়ে কেটে গেল টের পাইনি। আসরে বসে গান অজস্র শুনেছি। সেদিক থেকে একেবারে মোহিত হবার মতো কিছু শুনলাম, এমন বলব না। বিশেষ করে পাঁচ-মিশালি শ্রোতার আসরের গান খুব গভীর পর্যায়ের না হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু ক’দিন ধরে সাহিত্যের নানা ধারার ক্লান্তিকর জটিলতা বিস্তারের পর হঠাৎ যেন কানে ভারী মিষ্টি একটা স্পর্শ এসে লাগল। তাই, শুধু ভালো লাগল বলে অবিচারই করা হবে।
এত ভালো লাগবে আশা করিনি। কান পেতে শোনার মতই মিষ্টি পরিপুষ্ট কণ্ঠস্বর। সহজ, স্বচ্ছন্দ।
গানের সঙ্গে শিল্পীর একটা বিশেষ যোগ আছেই। অন্তত, আমার মত অ-গায়কদের সেই রকমই মনে হয়। সেই যোগটা শিল্পীর চেহারার কি পরিবেশন-মাধুর্যের–ঠিক জানিনে। প্রসঙ্গত কোনো এক বিখ্যাত মহিলা-শিল্পীর গানের আসরে উপস্থিত থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম একবার মনে পড়ে। গান শুনেছিলাম। সেই গানের তুলনা নেই, তা হয়তো সত্যি। কিন্তু তবু কেন যেন মন ভরেনি। তার কারণ সম্ভবত আগাগোড়া বেশির ভাগ চোখ বুজে শুনতে হয়েছিল বলে। না, সেই মহিলাও রূপসী না হোক একেবারে কুরূপা নয়। তা ছাড়া, গানের আসরে শিল্পীর যে রূপ সেটা আর এক বস্তু, জানি। তবু চোখের প্রসন্নতার বার বার ব্যাঘাত ঘটেছিল তার কারণ, শিল্পীর সঙ্গীত-তরঙ্গের প্রতিটি ঢেউ অস্থির অভিব্যক্তির আকারে শ্রোতার নিবিষ্টতা চঞ্চল করে তুলছিল। পুরুষ শিল্পীদের বেলায় এই ব্যাপারটা ততো বিসদৃশ ঠেকে না যত মেয়েদের বেলায় ঠেকে।
কিন্তু এখানে চোখ-কান-মন ভরে ওঠার মত সবকুটুই গান। কোনো আবেগের মুখে স্থির শিল্পী হয়তো কখনো একটু দুলে উঠল, কোনো হালকা রসাবেদনের মুখে হয়তো মৃদু মৃদু হাসতে লাগল, কোনো দ্রুত বিন্যাসের মুখে তবলচির আসুরিক আহ্বানে সাড়া দিয়ে গানের মধ্যেই ফিক করে হেসে উঠল কখনো। এই আসরে শোনার থেকেও সঙ্গীতের এক মূর্তিমতী রূপ সুসম্পূর্ণ।
গান শেষ। আবার অনুরোধের সুযোগ না দিয়ে মহিলা সোজ। উঠে পড়ল। প্রস্থানের ভঙ্গী দ্রুততর। এবারে দ্বিগুণ হাত-তালি। আবার আমি নীরবে সারাভাইকে খুজলাম একপ্রস্থ। চোখে পড়ার আগে পিঠে খোঁচা।
ত্রিপুরারির উদ্ভাসিত মুখ।–কেমন শুনলে?
কৃতিত্বটা যেন তারই।
জবাব দেবার অবকাশ পেলাম না। অনেকের সঙ্গে সঙ্গে ত্রিপুরারিরও সামনের দিকে দৃষ্টি ঘুরেছে। আগের মতই পরিচিতদের উদ্দেশে হাত তুলে নমস্কার জানাতে জানাতে হাসিমুখে ডায়াসের লাগোয়া সারি থেকে এদিকে আসছে শঙ্কর সারাভাই। বলা বাহুল্য, এই আসা এবং এই নমস্কার বিদায়সূচক।
যশোমতী পাঠক তার পূর্বাসনে। তার পাশ দিয়েই শঙ্কর সারাভাই এগিয়ে এলো। দেখলাম, সে একনজর তাকালো মহিলার দিকে। কিন্তু মহিলার দৃষ্টি সামনের ডায়াসের দিকেই। সেখানে মন্ত্র-সঙ্গীত, অর্থাৎ সেতার-বাদনের তোড়জোড় চলেছে। রমণীর হৃদয় যন্ত্ৰ গোটাগুটি নির্লিপ্ত।
–সার।
ত্রিপুরারি তখনো পাশে দাঁড়িয়েই ছিল। তার বিনয়-বিগলিত আহ্বানে আমার রমণীর রীতি দেখার একাগ্রতায় ছেদ পড়ল। ঠিক পথ আগলে নয়, একটু পথ ছেড়ে দিয়েই কাজের উদ্দেশে ত্রিপুরারির এই সসম্ভম আহ্বান।
মিলিয়নেয়ার মিল-ওনার শঙ্কর সারাভাই দাঁড়িয়ে গেল। ব্যস্ত-সমস্ত ত্রিপুরারি এবারে শশব্যস্তে আমার হাত ধরে এক টান। তার পরেই গড়গড় করে আমার পরিচয় দিয়ে গেল। সেই পরিচয় শুনলে যে-কোন লেখক ওকে প্রচার-সচিবের পদে বহাল করার ইচ্ছেটা মনে মনে অন্তত পোষণ করবে। সারাভাইয়ের সঙ্গে ত্রিপুরারি কথা বলল হিন্দীতে। এরই ফাঁকে আমি যে ওর ছেলেবেলার একাত্ম বন্ধু–সেই সমাচারও অব্যক্ত থাকল না। আর অবশেষে লেডি অর্থাৎ যশোমতী পাঠকের সনির্বন্ধ অনুরোধ এবং একান্ত আগ্রহে আমার এখানে পদার্পণ–এটুকুর মধ্যে সেই অতিশয়োক্তিও অনুক্ত রইল না।
ত্রিপুরারির বেপরোয়া প্রশংসা বচনে অস্বস্তি বোধ করছিলাম। আমার একটা হাত ভদ্রলোকের পুষ্ট দুই হাতের থাবার মধ্যে চালান হয়ে গেল এবং গোটা দুই ঝাঁকুনি পড়ল।
–সো গ্ল্যাড টু মিট ইউ।
আমার পাল্টা বিনয়োক্তি। কিন্তু ভদ্রলেকের তুলনায় সেটা অনেক ক্ষীণ। হিন্দীর সঙ্গে ইংরেজি মিশিয়ে শঙ্কর সারাভাই তড়বড় করে বলে উঠল, কত দূর থেকে কষ্ট করে এসেছেন, উই আর রিয়েলি সস হ্যাপি। আপনারা গুণী লোক, কিন্তু বড় আফসোেস এই গুণের খবর আমি কিছুই রাখি না। রাখেন যিনি তিনি ওই যে–উনিই আপনাদের রিয়েল অ্যাডমায়ারার!
আঙুল দিয়ে অদূরবর্তিনী মহিলা, অর্থাৎ সশোমতকে দেখিয়ে দিল। ত্রিপুরারিকে জিজ্ঞাসা করল লেডির সঙ্গে আমার এক আধ দিন সাহিত্য-চৰ্চা হয়েছে কিনা। হয়নি শুনে একদিন নিয়ে যেতে পরামর্শ দিল, তারপর শুভেচ্ছা জানিয়ে হাসিমুখে প্রস্থান করল।
মনের আনন্দে ত্রিপুরারি কি বলে যাচ্ছে কানে ঢোকেনি। আমার দৃষ্টি এই সামনের দিকে দু’সারি আগের আসনের দিকে। একটানা এতক্ষণ গানের পর মহিলার বসার শ্রান্ত ভঙ্গিটুকুও মিষ্টি। গান শেষ হতেই বিশিষ্ট ব্যক্তিটি যে প্রস্থান করল সে সম্বন্ধেও তেমন সচেতন মনে হল না। ত্রিপুরারি বকেই চলেছে। আমার অভিলাষ নিজের কাছেই প্রায় অগোচর তখনও।
যন্ত্রসঙ্গীতের কদর কণ্ঠসঙ্গীতের তুলনায় কম-বেশি সর্বত্রই এক রকম। শুধু শঙ্কর সারাভাই নয়, অনুষ্ঠানের তোড়জোড় শেষ হবার আগেই অনেকে উঠে দাঁড়িয়েছে, অনেকে চলে যাচ্ছে। যশোমতীর পাশের আসনে বসে ছিল এক স্থানীয় বৃদ্ধা। কে জানি না। সেও উঠল এবং দরজার দিকে পা বাড়াল। আর সঙ্গে সঙ্গে দম ফুরানে। যন্ত্রের মত ত্রিপুরারির মুখের কথা অসমাপ্ত থেকে গেল। কারণ, আমি আর তখন পাশের চেয়ারে নেই।
কেন উঠলাম, বলা নেই কওয়া নেই প্রস্তুতি নেই–কেন সামনে এসে দাঁড়ালাম, কেন অভিনন্দন জানানোর লোভ সংবরণ করা গেল না, তার সঠিক বিশ্লেষণে অক্ষম। এই গান শোনার পর সামনে আসতে বা অভিনন্দন জানাতে মনে মনে হয়তো অনেকেই চেয়েছে। কিন্তু মনে মনে চাওয়া আর সরাসরি উঠে আসার মধ্যে তফাত আছে। শিল্পী যদি বয়েসকালের কোনো রমণী হয় ( যদিও এ-ক্ষেত্রে বছরে হিসেং ধরে বয়েসকালের বলা চলে না।) সাধারণত একটু বাড়তি প্রশংসা তার প্রাপ্যর মধ্যেই গণ্য। সেই রমণী যদি সুরূপা হয়, প্রশংসা তাহলে স্বতির আকার নিয়ে থাকে। আর সেই গুণবত সুরূপা রমণী যদি অফুরন্ত বিত্তের অধিকারিণী হয়, তাহলে তার আকর্ষণ বোধকরি এমনিই দুরতিক্রম্য। এমন কেন হয় আমার জানা নেই।
মহিলা ঈষৎ সচকিত। কিছু একটা তন্ময়তায় ছেদ পড়ল যেন। সোজা হয়ে বসে তাকালো।
সবিনয়ে বললাম, আপনার গান শোনার পর মনে হচ্ছে এখানে আসা সার্থক হল।
যশোমতী পাঠক বিব্রত মুখে হাসল একটু। অস্ফুট সৌজন্যে বলল, ধন্যবাদ….
কিন্তু ভিতরে ভিতরে আমি কি-রকম ধাক্কা খেলাম একটু। এরকম সাদা-মাটা প্রায় নির্লিপ্ত ভব্যতার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। আমার স্পষ্টই মনে হল, তিন দিন আগের সেই এক মিনিটের পরিচয় মহিলা ভুলে গেছে। অস্বাভাবিক কিছু নয়, কারণ দর্শক বা শ্রোতার আসনের অভ্যাগত আমি। তাছাড়া, আরও কতজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছে সেদিন। সকলকে মনে করে না রাখতেও পারে। কিন্তু তা হলেও ত্রিপুরারির এত আগ্রহ করে আমাকে এখানে টেনে আনার সঙ্গে সুদর্শনার এই মাপা সৌজন্য ঠিক যেন মিলছে না। ত্রিপুরারি লিখেছিল, লেডি আমাকে প্রত্যহ তাগিদ দিচ্ছে তুমি আসছ কি না….। ফলে এ রকম ভুল আমার বিবেচনায় অন্তত খুব বাঞ্ছিত নয়। তাছাড়া ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বাঙালী দেখেও, আর আসা সার্থক হয়েছে শুনেও খেয়াল হবার কথা।
আমি কি আশা করেছিলাম? ওইটুকুই আশা করেছিলাম হয়ত। আশা করেছিলাম আর পাঁচজনের থেকে আমার এই প্রশংসার একটু মূল্য বেশি হবে, মহিলা খুশি হবে। আর হয়তো আশা করেছিলাম, পাশের শূন্য আসনটি দেখিয়ে আমাকে বসতে বলবে। তার বদলে আধা-ভাঙা আসরের যন্ত্রসঙ্গীত যে বেশি মনোযোগের বিষয় হবে, ভাবিনি।
অতএব আমি কি করলাম, পাঠক সহজেই অনুমান করে নিতে পারেন। পাঁচ-সাত-দশ সেকেণ্ড বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। সেটুকুই দীর্ঘ এবং অশোভন মনে হতে বোকার মতো হাসলাম একটু। তারপর আবার নমস্কার জানিয়ে পিছনে ফিরে ত্রিপুরারির পাশে এসে বসলাম। তারপর মনে মনে নিজের উদ্দেশে কটক্তি করতে থাকলাম। মর্যাদা-বোধ আহত হলে কখনো কখনো সেটা ঠুনকো বস্তুর মতই ভেঙে পড়তে চায়।
কিন্তু ত্রিপুরারির সবুর সয় না, ফিরে আসা মাত্র সাগ্রহে চড়াও হল আমার ওপর।–তুমি হঠাৎ উঠে কি বলে এলে?
রাগটা অকারণে ত্রিপুরারির ওপরেই ঝাড়তে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু নিজের দোষে বোকা বনেছি, ওর দোষ কি। বললাম, গানের প্রশংসা করে এলাম।
খুশি হল খুব? কি বলল?
-ধন্যবাদ দিল।
নিজেকে সান্ত্বনা দেবার দায়ে এদিক-ওদিক চেয়ে দেখছি–বাংলা সাহিত্যের অধিবেশন বলে আমার মতো ধুতি-পাঞ্জাবির সংখ্যাই বেশি, অতএব মহিলার চিনতে না পারাটা আশ্চর্য কিছু নয়। কিন্তু অনুভূতি সব সময় যুক্তি ধরে চলে না। ভিতরে ভিতরে অস্বস্তিজনক কিছু একটা বিধছেই। কেবলই মনে হচ্ছে মস্ত ধনী কন্যাকে গায়ে পড়ে প্রশংসা করতে যাওয়ার মতো হয়েছে ব্যাপারটা।
ত্রিপুরারি তার লেডির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠার খোরাক পেয়েছে যেন। বাজনা শোনাটা ওর কাছে বিলাপ শোনার মতো। সাগ্রহে ঘুরে বসে বলল, শুধু গান? ও-দিকে এম-এ পাস, জানো? আজ না হয় এখানে মেয়েদের মধ্যে বি-এ এম.-এ’র ছড়াছড়ি–বিশ বছর আগে তো হাতে গোণা যেত। তাছাড়া, আরো অনেক রকমের গুণ আছে মহিলার, বক্তৃতা করে চমৎকার। কিছুদিন থেকে যাও যদি তোমাকে শোনাব। তারপর এখানকার লেডিস ক্লাবের সে-ই ফাউণ্ডার-প্রেসিডেন্ট-বিশ বছর আগে তারই চেষ্টায় হয়েছিল। গোড়ায় অনেকে আপত্তি করেছিল, এখন লেডিস ক্লাব জম-জমাট। আর এবারে তো পুরুষদেরও টেক্কা দিয়ে একেবার চেম্বারের প্রেসিডেন্টই হয়ে বসেছে।
আমি বাজনায় মন দিয়েছি। দিই না দিই বাজনা শোনায় গুরুগম্ভীর নিবিষ্টতা আনতে চেষ্টা করেছি। মনে মনে নিজেকে যে প্রত্যাখ্যাত গোছের ভেবে আহত, এত গুণের ফিরিস্তি তার কানে আরো পীড়াদায়ক। অন্তত তখনকার মতো। জিজ্ঞাসা করলাম, এ-রকম শিক্ষিতা হয়েও তোমাকে ঘোষবাবু বলে কেন?
ত্রিপুরারি জবাব দিল, এখানে সকলেই ওই রকম বলে।
.
পরদিন সুন্দর একটি ছাপা কার্ড পেশ করল ত্রিপুরারি। আমন্ত্রণ লিপি, সোনা-রঙের ছাপার নিচে সোনালী অক্ষরে যশোমতী পাঠকের নাম। পাঁচ দিনের অধিবেশন-শেষে প্রবাসী অতিথিবর্গের সম্মানার্থে পার্টি। শ্ৰীমতী পাঠক তার বাড়িতে ব্যক্তিগত ভাবে এই পার্টি দিচ্ছে। স্থানীয় প্রধান বা প্রধানার তরফ থেকে এ-ধরনের পার্টির ব্যবস্থা নতুন কিছু নয়।
এও যে আর একটা বাড়তি অবজ্ঞার মতো লেগেছে সেটা ত্রিপুরারিকে বুঝতে দেবার ইচ্ছে ছিল না। আমন্ত্রণ-লিপি দেখে নিয়ে খুব সাদাসিদেভাবে জিজ্ঞাসা করলাম, তা কত্রীর হয়ে তুমিই নেমন্তন্ন করে বেড়াচ্ছ বুঝি?
একটা সুবিধে, আয়-ব্যয় জমা-খরচের জটিলতায় ত্রিপুরারির যত মাথা খোলে, এসব সামাজিক ব্যাপারে ততো নয়। এই প্রশ্নের ফলে ওর মনে এতটুকু ছায়াপাত হোক, সেটা চাইনি তার ভিন্ন কারণ। আমার মেজাজের আঁচ পেলে সেটা ওর পক্ষে বিড়ম্বনার ব্যাপার হবে। হয়তোবোঝতে বসবে আমিই ভুল করেছি। তাই কিছু খেয়াল না করার মতো করেই জিজ্ঞাসা করেছিলাম-ত্রিপুরারি খেয়াল করলও না।
জবাব দিল, বাড়ির গায়ের গেস্ট কোয়ার্টার্সের সব সাহিত্যিকদের নিজেই বলেছে, আর এদিককার দু-দশজন যাদের বলা হচ্ছে, তাদের ভার আমার ওপর। চিঠি নিয়ে এখন ক’ জায়গায় ছোটাছুটি করতে হবে, ঠিক নেই।
যাক, নিশ্চিন্ত। মনের তলায় শুধু একটা অস্বস্তি, আমার কোনো আচরণে ত্রিপুরারি না আঘাত পায়। যার জন্যে ছোটাছুটি করে তার আনন্দ, তার সঙ্গে ওর রুটির যোগ, চাকরির যোগ, ভবিষ্যতের যোগ। আমার আচরণে ও এদিক থেকে কিছুমাত্র সচেতন হলে আমার লজ্জার সীমা থাকবে না। মহিলার গেস্ট কোয়ার্টার্সে আমি থাকিনি ত্রিপুরারির অন্তরঙ্গতার টানাপোড়েনে পড়ে। কিন্তু আমি যে এখানকার দু-দশজনের একজন নই, আমিও যে বহিরাগত অতিথি –সেটা ত্রিপুরারির মনে না থাকুক, ওই মহিলার মনে না থাকাটাও ঠিক বরদাস্ত হবার কথা নয়। গত দিনের ব্যবহারের পর এই নিজে নিমন্ত্রণ না করাটা শুধু কর্মচারীর বন্ধু বলে, এছাড়া এই অবজ্ঞার আর কোন কারণই মনে আসেনি আমার।
অতএব শরীরটা সেই দিনই আমার খারাপ হল একটু। কত্রীর বাড়ির নেমন্তন্ন দুদিন পরে, তাই ত্রিপুরারির কিছু আঁচ করা সম্ভব হল না। পরদিন স্ব-ঘটিত শরীর-খারাপের মাত্রা আরো একটু বাড়াতে হল। ত্রিপুরারিকে জানালাম, মাথা ভার, গা ম্যাজ ম্যাজ করছে অতএব সাহিত্য-সম্মেলনের সেটা শেষ দিন হলেও যাই কি করে ত্রিপুরারি নিজেই ডাক্তারী করল, ডায়েটিংয়ের ব্যবস্থা করে দিল, মাথা ধরার বড়ি রেখে গেল। ওকে তো বেরুতেই হবে, মাথার ওপর অনেক দায়। খাওয়ার ওপর যেমন অত্যাচার চলেছে ক’দিন ধরে ডায়েটিংয়ে আমার আপত্তি নেই। মাথা ধরার ওষুধ অবশ্য কাজে লাগানো গেল না। মাথা কিছু খাটাতে হচ্ছে, তাই মাথা একটু আধটু ধরা বিচিত্র ছিল না। কিন্তু না ধরলে কি আর করা যাবে।
আর তার পরদিন অর্থাৎ পার্টির দিন তো শরীর একটু বেশিই খারাপ। বেশি কি? পেটে গেলযোগ? কোনো ভদ্রমহিলার কাছে, বিশেষ করে যশোমতী পাঠকের মতো মহিলার কাছে রিপোর্ট করার মতো ভদ্রগোছের অসুখ নয় ওটা। ওদিকে দশবার করে গায়ে হাত দিয়ে দেখছে ত্রিপুরারি। জ্বরও বলতে পারি না। তাহলে বাকি থাকল বুকের দিকটা। ত্রিপুরারি জানল বুকে একটু-আধটু ব্যথা, যা নাকি আমার মাঝে-সাজে হয়, আর একটানা চব্বিশটা ঘণ্টা বিশ্রাম নিলেই আবার বিনা ঝামেলায় আপনা থেকেই দিবি সেরে যায়।
….ওষুধ!
ত্রিপুরারির ব্যস্ততা ঘন হবার আগেই তাড়াতাড়ি বলতে হল, ও একটু-আধটু ওষুধ আমার সঙ্গেই থাকে, ঘাবড়াবার মতো কিছু নয়। বলছি তো। তুমি আর দেরি কোরো না, পালাও এখন।
না ঘাবড়ালেও ত্রিপুরারির মন যে খারাপ হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পাটিতে আমার যাওয়া সম্ভব হল না বলে ঘুরে ফিরে বহুবার খেদ প্রকাশ করেছে। তার আগে মুহুর্মুহু বুকের খবর নিয়েছে। গাড়ি করে আধঘণ্টার জন্যে ঘুরে আসা যায় কিনা সেই প্রস্তাব অনেকবার করেছে। সঙ্গে ডাক্তার থাকলে যাওয়া চলে কিনা জিজ্ঞাসা করেছে– শেষে ওর বউয়ের কাছে চাপা ধমক খেয়ে হাল ছেড়েছে। মনিবদের এ-ধরনের অনুষ্ঠানে ওদের ব্যস্ত থাকতেই হয়, অতএব শেষ পর্যন্ত একাই যেতে হল তাকে।
বিকেলে নিশ্চিন্ত মনে বাগানে ঘোরাঘুরি করছিলাম। ত্রিপুরারি গৃহিণী এমনিতেই মিতভাষিণী, তার ওপর এই দ্বিতীয়বার মাত্র সাক্ষাৎ। মহিলা অতিথিপরায়ণ, কিন্তু তার সঙ্গে আড্ডা জমানো শক্ত। বহুবার শরীরের খবর নেওয়ায় অস্বস্তি বোধ করছিলাম। বিকেলের দিকে বেশ ভালো আছি এবং বাগানে একটু বেড়ালে আরো ভালো লাগবে শুনে সে নিশ্চিন্ত মনে ঘরের কাজে মন দিয়েছে। আর, একটু বাদেই পার্টি প্রসঙ্গ বা নিজের অসুস্থতার প্রসঙ্গ আমার মন থেকে সরে গেছে।
বাড়ির দরজায় গাড়ি দাঁড়াল একটা।
গাড়ি থেকে একজন স্থানীয় অপরিচিত লোক নামল। তার হাতে ছোট ব্যাগ আর স্টেথোস্কোপ। আমাকে দেখে থমকে দাঁড়াল, তারপর এগিয়ে এলো। আমি হতভম্ব। তাকে দেখা মাত্র মনে হল আমিই তার শিকার।
এগিয়ে এসে ভদ্রলোক ইংরেজিতে পরিচয় জিজ্ঞাসা করল, অর্থাৎ আমিই ওমুক কিনা। বোকার মতো ঘাড় নাড়তে চিকিৎসকের চোখে একটু নিরীক্ষণ করে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে আপনার? বুকে হঠাৎ কি-রকম ব্যথা বোধ করছেন শুনলাম? মিস পাঠক টেলিফোন করে এক্ষুনি আপনাকে একবার দেখে যেতে বললেন….
এ রকম বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হবে কে ভেবেছিল? বাংলা দেশের বাসিন্দা, চিকিৎসককে এত অবাঞ্ছিত আর বোধহয় কখনো মনে হয়নি। ওদিকে গাড়ির আওয়াজ পেয়ে দরজার কাছে ত্রিপুরারির স্ত্রী এসে দাঁড়িয়েছে। অতিথি এবং স্বামীর অন্তরঙ্গ অসুস্থ বন্ধুর প্রতি তারও কর্তব্যবোধ কিছু আছে। পরিস্থিতিগুণে আমি অসহায়।
মিথ্যার সতেরো জ্বালা। কি সব বলে গেছি বা বলতে চেষ্টা করেছি সঠিক মনে নেই। মোট কথা, ডাক্তারকে বোঝাতে হয়েছে শরীর সামান্য খারাপ হয়েছিল বটে কিন্তু এখন সুস্থই বোধ করছি। এখানে এসেই একটু অনিয়ম করা হয়েছে, একটু বেশি ছোটাছুটি করা হয়ে গেছে, খাওয়া-দাওয়ারও বেশি চাপ গেছে–দু’দিন একটানা বিশ্রাম নিয়ে এখন ভালই লাগছে। শুধু ভাল না, এখন আর কোনো গোলযোগের লেশ মাত্র নেই। ওঁদের এভাবে বিব্রত করার দরুন লজ্জিত, তাকে ধন্যবাদ, মিস পাঠককে ধন্যবাদ, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
কিন্তু শুধু ধন্যবাদ পকেটে পুরে ভদ্রলোক বিদায় নিল না কারণ, সে আমার অথবা আমার অসুখের তাগিদে আসেনি। এসে যার নির্দেশে ফিরে গিয়ে তাকে রিপোর্ট করতে হবে। অগত্যা বাগানের বেঞ্চে বসেই শরীরটাকে দু’পাঁচ মিনিটের জন্য অন্তত তার হেপাজতে ছেড়ে দিতে হল। ত্রিপুরারি-গৃহিণীও পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়াল। গুরুগম্ভার পর্যবেক্ষণ পর্ব শেষ করে প্যাড বার করে খসখস করে একটা প্রেসকৃপশন লিখে ডাক্তার বলল, এটা খেলে কালকের মধ্যেই আরোগ্য হয়ে যাবেন।
ডাক্তার বিদায় নিতে ত্রিপুরারি-গৃহিণীর মুখোমুখি হবার পালা। সাদা-মাটা মহিলা মৃদু মন্তব্য করল, খানিক আগেও যা ছিলেন তা থেকে তো অনেক ভালো মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ, এক্ষুণি ওই ওষুধ-টষুধ আনার দরকার নেই….।
চোখের আড়ালে বা অধর কোণে কৌতুকের আভাস দেখলাম কি? একটু চুপ করে থেকে ত্রিপুরারি-গৃহিণী বলল, কিছু হয়ইনি বোধ হয়….। চলে গেল। আমার সন্দেহ হল কেমন, যতটা সাদাসিধে একে ভেবেছিলাম ততোটা যেন নয়।
.
আরো কিছু বাকি ছিল।
সন্ধ্যায় আর পরদিন সকালে সতীর্থরা অনেকেই আমাকে দেখে যাওয়া কর্তব্য বোধ করল। কিন্তু তাদের সহৃদয়তায় মুগ্ধ বলেই প্রায় নির্বাক আমি। বুঝলাম, কত্রীর আমন্ত্রণ রক্ষা করতে না পারার মত অসুখটা মোটেই খুব ছোট করে প্রচার করেনি ত্রিপুরারি। পার্টির সাহিত্যিক বন্ধুরা সকলেই জেনেছে আমি বেখাপ্পা রকমের অসুখে পড়ে গেছি। অতএব দলে দলে তারা এসেছে, দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেছে, আর উপদেশ দিয়ে গেছে।
এ-ধরনের সাহিত্য-অধিবেশনে অভ্যাগতদের আসার পিছনে যেমন উৎসাহ, যাবার বেলাতেও তেমনি তাড়া। এলো, অধিবেশনের ফাঁকে ফাঁকে অনুষ্ঠাতাদের রুটিনমাফিক ব্যবস্থা অনুযায়ী হুড়মাড় করে দেখার যা আছে দেখা হয়ে গেল–অধিবেশন শেষ তো অমনি ফেরার তাগিদ। কটা দিন জীবনটাকে তাড়াহুড়োর মধ্যে রাখার বৈচিত্র্য থেকে কেউ বঞ্চিত হতে চায় না। কেউ স্বস্থানে প্রত্যাগমন করবে, কউ বা তেমনি দ্রুত তালে কাছাকাছির আরও দু’একটা নতুন জায়গা হয়ে ফিরবে। কাজেই আমার কাছে সতীর্থদের অবস্থান বা আমার শরীরের জন্য তাদের উদ্বেগ দীর্ঘস্থায়ী হল না–এই যা রক্ষা।
যাই হোক, ঝাঁকে ঝাঁকে এসে সতীর্থদের এই শশব্যস্ত কর্তব্যের পালাও শেষ হল একসময়। হাঁপ ফেলে এরপর ত্রিপুরারিকে নিয়ে পড়লাম আমি। পাছে ওর কোনরকম সন্দেহ হয় এজন্যে সেটাই নিরাপদ মনে হল। ওর স্ত্রীর সেই কথা ক’টা কানের পর্দায় অস্বস্তির কারণ হয়ে আছে এখনো। বললাম, বেশ করে ঢাক পিটিয়ে সকলের কাছে প্রায় এখন তখন অবস্থা আমার বলে এসেছ মনে হচ্ছে?
আমতা-আমতা করে ত্রিপুরারি জবাব দিল,না মানে, অসুখ শুনে মিস পাঠক একটু ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে।
গম্ভীর মুখে বললাম, বড়লোকের ব্যস্ততার ধকল সামলানোও মুশকিল-ব্যস্ততার চোটে একেবারে ডাক্তার এসে হাজির হয়েছিল।
–হ্যাঁ, অসুখ শুনে পাঁচবার করে জিজ্ঞাসা করল কি অসুখ তারপর উঠে গিয়ে নিজেই ডাক্তারকে ফোন করে দিলে।
মুখের গাম্ভীর্য এবারে নিরাপদে একটু তরল করা যেতে পারে মনে হল।–সেজন্যেই তো বলছি, পার্টিতে যেতে না পারার কৈফিয়ৎ দেবার দায়ে তুমি আমাকে প্রায় শেষ করেই এনেছ।
ত্রিপুরারি লজ্জা পেল।–কি যে বলল! গেলে না দেখে ভদ্রমহিলা দুঃখ করতে লাগল। শুনলে এক্ষুণি তোমায় গিয়ে দেখা করতে ইচ্ছে করত। এর পর ত্রিপুরারি উল্টো দোষারোপ করল।–সাধে লোকে বলে বাঙালী বাবু, বাংলাদেশে থেকে থেকে তোমর যা হয়েছ। এখানে ওটুকু শরীর খারাপ আমরা কেয়ারই করি না–আর দু’দিনের মধ্যে তুমি বাড়ি থেকেই নড়লে না, পার্টিতেও গেলে না–জিজ্ঞাসা করলে তেমন কিছু হয়নি বলি কি করে? ভদ্রমহিলা যদি ভেবে বসে ইচ্ছে করেই কাটান দিলে!
আর বেশি ঘাঁটানো যুক্তিযুক্ত নয় মনে হতে সরব হাসির গর্ভে আলোচনার বিলুপ্তি ঘটাতে হল। কিন্তু হাসিটা স্বতঃস্ফূর্ত নয় এখনো, ওর বউ এরপর আবার কিছু মগজে না ঢোকালে বাঁচি।