পত্রিকার প্রথম পাতায় খবর
পত্রিকার প্রথম পাতায় খবর— ডাক্তারের চেম্বারে সন্ত্রাসী হামলা। হামলায় ডাক্তারের একজন অ্যাসিসটেন্ট এবং তিনজন রোগী গুরুতর আহত। ব্যাপক ভাঙচুর।
সানাউল্লাহ খবর পড়ে আনন্দ পেলেন। হামিদ স্মৃতিভ্রষ্ট হয়েও কাজকর্ম চালাতে পারছে এটা আশার কথা। তিনি খবরের কাগজ সঙ্গে নিয়েই আবু করিমের বাড়িতে উপস্থিত হলেন। পত্রিকা বন্ধুর সামনে মেলে বললেন, খবর পডেছ?
আবু করিম বললেন, পড়েছি। এই দেশে বাস করা যাবে না। ডাক্তারের চেম্বারে সন্ত্রাসী হামলা, চিন্তা করা যায়? সব ছেড়ে-ছুড়ে বনে চলে যেতে ইচ্ছা করে। তোমার করে না?
সানাউল্লাহ জবাব দিলেন না। তাঁর কাছে এখন মনে হচ্ছে সন্ত্রাসী হামলার পুরো ব্যাপারটা চেপে যাওয়াই ভালো।
ডা. আবু করিম বললেন, তোমার ব্যাপারটা কী বলো তো? সাতদিন হয়ে গেল তোমার খোঁজ নাই। এদিকে নতুন একটা প্রিপারেশন রেডি করেছি। টেস্টার
সানাউল্লাহ বললেন, প্রিপারেশনটা কী?
ভাতের আচার।
ভাতের আচার হয় না-কি?
আবু করিম বললেন, হওয়ালেই হয়। সারা পৃথিবীতে ভাত দিয়ে অনেক কিছু হয়। জাপানিরা বানায় রাইস ওয়াইন। চায়নিজরা বানায় রাইস টি। কোরিয়ানরা ভাতের সঙ্গে শুকরের চর্বি মিশিয়ে ফার্মেন্টেড করে কী যেন বানায়। নববর্ষে খায়। নামটা ভুলে গেছি।
সানাউল্লাহ বললেন, ভাতের আচারটা কীভাবে বানিয়েছ?
আবু করিম বললেন, শীলপাটায় ভাত পিষে মন্ত্রে মতো করেছি। মার্বেলের গুলির মতো গুলি বানিয়ে রোদে শুকিয়েছি। এদিকে তেতুলের রস, আস্ত অড়বড়ই, আস্ত আমলকি, আমচুর, শুকনা মরিচ, পাঁচ ফুরন দিয়ে জ্বাল দিয়ে ঘন Semisolid বস্তু তৈরি করেছি। তার ভেতর ভাতের মার্বেল ছেড়ে দিয়ে রোদে শুকিয়েছি।
সানাউল্লাহ বললেন, শুনে তো অসাধারণ লাগছে।
আবু করিম বললেন, একটা ভয় ছিল ভাতের মার্বেলের ভেতর রস ঢুকবে কি-না। রস ঢুকেছে। এক্ষুনি আনছি খেয়ে দেখো।
সানাউল্লাহ ভাতের মার্বেল আস্ত একটা মুখের ভেতর ঢুকালেন এবং কিছুক্ষণের জন্যে স্থির হয়ে গেলেন।
আবু করিম আগ্রহের সঙ্গে বললেন, কেমন বুঝছ?
সানাউল্লাহ বললেন, এতই সুস্বাদু যে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে না। মনে হচ্ছে বাকি জীবন মুখে নিয়ে বসে থাকি।
আবু করিম বললেন, এটার প্রিপারেশনই মুখে নিয়ে বসে থাকার প্রিপারেশন। আস্তে আস্তে ভাতের গোল্লা থেকে রস বের হবে।
অসাধারণ। পেটেন্ট করে ফেলা উচিত। পেটেন্ট না করলে অন্যকেউ প্রচার করে ফেলতে পারে। দেখা যাবে চ্যানেল আইয়ের রান্নার অনুষ্ঠানে কেকা ফেরদৌসি ভাতের আচারের রেসিপি দিয়ে দিচ্ছেন।
আবু করিম বললেন, তাহলে তো চিন্তার বিষয়। পেটেন্ট অফিসে খোঁজ নেয়া উচিত আচারের পেটেন্ট হয় কি-না। আন্তর্জাতিক কোনো পেটেন্ট কোম্পানির সঙ্গেও যোগাযোগ করা দরকার। কষ্ট করে একটা জিনিস বানালাম, দেখা গেল জাপানিরা বাজারে ছেড়ে দিল। নাম দিল কেও মেও। কোটি কোটি ডলারের বিজনেস হাতছাড়া হয়ে গেল।
সানাউল্লাহ বললেন, আচারের নতুন কী প্রজেক্ট হাতে নিয়েছ?
আবু করিম বললেন, নেশাখোরদের জন্যে তামাকের একটা আচার বানিয়েছি। যারা জর্দা, সিগারেট, গাঁজা এইসব খায় তাদের জন্যে। এই জিনিস বাজারে ছাড়া ঠিক হবে না। দেখা যাবে এই আচার খেয়েই সবাই নেশা করছে।
সানাউল্লাহ বললেন, আচারটা বানিয়েছ কী দিয়ে?
আবু করিম বললেন, তামাক পাতা, চা পাতা, গাঁজা গাছের পাতার সঙ্গে ভিনিগার এবং সৈন্ধব লবণের প্রিপারেশন। এর সঙ্গে সমপরিমাণ কাগজি লেবুর রস দিয়েছি। একটা আস্ত বোম্বাই মরিচ ছেড়ে দিয়েছি।
খেয়ে দেখেছ?
এক চামচ খেয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেছি। দুবোতল বানিয়েছি। একটা বোতল তুমি নিয়ে যেও। তবে না খাওয়াই ভালো। সব আবিষ্কার সমাজের জন্যে মঙ্গলজনক হয় না। যেমন ধর অ্যাটম বোমা। এই বোমা সমাজের কোনো উপকার করে নি। ধ্বংসযজ্ঞ বয়ে নিয়ে এসেছে।
তোমার এই আচারের নাম কী দিয়েছ?
বোমা-আচার।
নাম ভালো হয়েছে, তবে রবি ঠাকুরের কাছ থেকে নাম ধার নিলে ভালো হতো। বিশ্বকবির নামের সঙ্গে আচারের নাম যুক্ত থাকত।
আবু করিম বললেন, আচার নিয়ে কি তাঁর কোনো কবিতা আছে?
সানাউল্লাহ বললেন, আছে নিশ্চয়ই। এত লিখেছেন— আচার নিয়ে কিছু লিখেবন না তা হতেই পারে না। আমার অবশ্যি জানা নেই। রবীন্দ্রভক্তদের কাছ থেকে খোঁজ নিতে হবে। তবে আমসত্ত্ব নিয়ে তাঁর কবিতা যেহেতু আছে, আচার নিয়েও থাকার কথা।
আমসত্ত্ব নিয়ে কবিতা আছে? বলো কী! কী কবিতা?
আমসত্ত্ব দুধে ফেলি, তাহাতে কদলী দলি,
সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে–
হাপুস হুপুস শব্দ চারিদিক নিস্তব্ধ,
পিঁপিড়া কাঁদিয়া পাতে।
আবু করিম বললেন, পিঁপিড়া কেঁদে যাচ্ছে বিষয়টা বুঝলাম না। পিঁপিড়া কেন কাঁদবে?
সানাউল্লাহ বললেন, আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। কবিগুরু বেঁচে থাকলে জিজ্ঞেস করতাম। উনি মারা গিয়ে সাহিত্যের ক্ষতি তো করেছেনই, আরো অনেক ক্ষতি করেছেন। নতুন নাম পাওয়া যাচ্ছে না। উনি বেঁচে থাকলে মোবাইল টেলিফোনে অচারের নাম জানতে চেয়ে এসএমএস পাঠাতাম। উনি সঙ্গে সঙ্গে নাম দিয়ে দিতেন।
আবু করিম বললেন, তোমার কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথের আমসত্ত্বের কবিতাটা শোনার পর থেকে অন্য একটা আচারের আইডিয়া মাথায় ঘুরছে। বানানো ঠিক হবে কি-না বুঝতে পারছি না।
কী আইডিয়া?
পিঁপড়ার আচার।
বলো কী!
আবু করিম বিরক্ত হয়ে বললেন, বলো কী বলে চেঁচিয়ে ওঠার কিছু নেই। পিঁপড়া আমরা সব সময় খাচ্ছি। চিনির সঙ্গে খাচ্ছি। চায়ের সঙ্গে খাচ্ছি। পিঁপড়ার শরীরে একটা অ্যাসিড আছে। অ্যাসিডের নাম ফরমিক অ্যাসিড। এই অ্যাসিডের কারণে পিঁপড়ার স্বাদ হবে টক। বাইরে থেকে কিছু টক দেয়া হবে। এবং কবিগুরুর নামে এই আচারের নাম হবে–পিপিলিকা ক্রন্দন।
পিপিলিকা ক্রন্দন?
হ্যাঁ, পিপিলিকা ক্রন্দন। এবং আচারের বোতলে কবিগুরুর ছবি থাকবে। ছবির নিচে থাকবে— এই আচারের রেসিপি কবিগুরুর রচনা থেকে প্রাপ্ত।
সানাউল্লাহ বললেন, রবীন্দ্রভক্তরা রাগ করতে পারেন।
আবু করিম বিরক্ত গলায় বললেন, রবীন্দ্রনাথ কি শুধু রবীন্দ্রভক্তদের সম্পত্তি? উনি সবার সম্পত্তি। পিঁপড়ার আচারের বিষয়ে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। এই বিষয়ে আর কথা বলবে না। অন্য কোনো বিষয়ে কথা বলতে চাইলে বলো।
সানাউল্লাহ বললেন, একটা বই লেখার বিষয়ে তোমার সঙ্গে পরামর্শ ছিল।
আবু করিম অবাক হয়ে বললেন, বই লিখছ না-কি!
শুরু করে দিয়েছি, চার পৃষ্ঠার মতো লেখা হয়ে গেছে।
বিষয় কী?
সানাউল্লাহ ইতস্তত করে বললেন, ভূত-বিষয়ক একটা বই। যে চার পৃষ্ঠা লিখেছি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। পড়লেই বুঝবে। সানাউল্লাহ পাঞ্জাবির পকেট থেকে লেখা বের করলেন।
আবু করিম সঙ্গে সঙ্গেই লেখা পড়া শুরু করলেন।
দিনের শেষে ভূতের দেশে
ভূত আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার সঙ্গে ভূত যুক্ত। বাংলা ভাষায় ভূত উঠে এসেছে বাগধারায়। যেমন, ভূতের মুখে রামনাম, সর্ষের ভেতর ভূত ইত্যাদি।
দুঃখ এবং পরিতাপের বিষয় এই, ভূত বিষয়ে আমাদের সমক কোনো জ্ঞান নেই।
এই পর্যন্ত পড়েই আবু করিম বললেন, তোমার সমস্যাটা কী? তুমি কি মানসিকভাবে অসুস্থ?
সানাউল্লাহ বললেন, বুঝতে পারছি না। হতে পারে।
আবু করিম বললেন, মানসিক রোগী ছাড়া কারো পক্ষে ভূত নিয়ে গবেষণাধর্মী বই লেখা সম্ভব না। কারণ ভূত কোনো গবেষণার বিষয় না। কেউ কোনোদিন ভূত দেখে নি। তুমি নিজেও দেখ নি। বলো দেখেছ?
সানাউল্লাহ ক্ষীণ গলায় বললেন, হুঁ।
আবু করিম বললেন, হুঁ মানে! দেখেছ ভূত?
দেখেছি।
কোথায় দেখেছ? বাঁশঝাড়ে?
দুটা ভূতের বাচ্চা আমার সঙ্গে বেশ কিছুদিন ধরে বাস করছে। একজনের নাম হমডু। আরেকজনের নাম ডমরু। এরা ভাইবোন।
আবু করিম বললেন, এরা এখনো তোমার বাসায় আছে?
আছে।
আমি গেলে দেখতে পাব?
সানাউল্লাহ বললেন, রাতে গেলে দেখতে পাবে। দিনে তারা ঘুমায়। দেহধারী হয় না বলে দিনে দেখা যায় না। ওরা আবার তোমার আচারের মহাভক্ত। আমিষ আচারের বোতলটা চেটেপুটে খেয়েছে।
ভূত আচার খায়?
খায়। আরো অনেক কিছু খায়। ব্যাটারি খায়। মধু খায়। তবে সলিড় কিছু খায় না। ব্যাটারির কার্বন দণ্ডটা খায় না।
আবু করিম আবার পড়া শুরু করলেন।
মানুষ মরলেই কি ভূত হয়? না-কি ভূত সম্পূর্ণ ভিন্ন এক প্রজাতি? মানুষদের যেমন জন্ম-মৃত্যু আছে, ভূতদেরও কি আছে? তারা কি বংশবৃদ্ধি করে?
মহামতি ডারউইন প্রমাণ করেছেন— selective evolution এর মাধ্যমে মানবজাতি পৃথিবীতে এসেছে। ভূতদের ক্ষেত্রে কি এই তথ্য সত্য?
মানুষের সঙ্গে ভূতের কোন কোন ক্ষেত্রে প্রভেদ? তারা কি আহার গ্রহণ করে? মানুষ যেমন রাজনীতি বিষয়ে আসক্ত তারাও কি তাই? তাদের মধ্যেও কি বিএনপি-আওয়ামী লীগ (কথা প্রসঙ্গে বলছি) আছে?
তাদের শিক্ষা ব্যবস্থাটা কেমন? আমাদের যেমন উচ্চতর শিক্ষার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় আছে, তাদেরও কি আছে? তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কি লালদল, নীলদল, শাদাদলে বিভক্ত? তাদের ছাত্ররাজনীতির অবস্থা কী?
মানুষদের যেমন মৃত্যু আছে, ভূতদেরও কি আছে? মৃত্যুর পর তারা কোথায় যায়? বিখ্যাত লেখক পরশুরামের একটি লেখায় পড়েছি— মৃত্যুর পর ভূতরা মার্বেল হয়ে যায়। পরশুরাম সাহেবের ভালো নাম রাজশেখর বসু, তিনি চলন্তিকা নামক ডিকশনারির প্রবক্তা। শিক্ষাগত জীবনে তিনি রসায়নশাস্ত্রে M.Sc. তার মতো একজন বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব কীভাবে বলেন যে, মৃত্যুর পর ভূত মার্বেল হয়ে যায় তা আমার চিন্তার বাইরে।
যাই হোক, ভূত বিষয়ের সমস্ত প্রাপ্ত ধারণা দূর করার জন্যেই আমি লেখনি হাতে নিয়েছি। প্রথম মুদ্রণে কিছু তথ্যগত ভুল হয়তো থাকবে। দ্বিতীয় মুদ্রণে সমস্ত ভুলভ্রান্তি
দূর করা হবে।
আবু করিম খাতা বন্ধ করে বললেন, তোমার কাজের ছেলে রফিক ফিরে এসেছে বলেছিলে। সে কি আছে? না আবারো চুরি করে ভেগেছে?
সে এখনো আছে।
তাকে রাতে রান্না করতে বলবে। আজ রাতে আমি তোমার সঙ্গে ডিনার 4951
আচ্ছা।
ভালো কথা! তোমার ঐ কাজের ছেলে রফিক। সেও কি ভূত ভাইবোনকে দেখে? না-কি তুমি একাই দেখ?
রফিক ব্যাপারটা খেয়াল করছে না। হমড়ু ডমরুও চাচ্ছে না সবাই তাদের বিষয়টা জানুক। তবে তুমি যদি যাও অবশ্যই ওদের দেখবে। ওরা তোমার ভক্ত। তোমার বানানো আমিষ আচার খেয়েছে তো। তাছাড়া আমি ওদের তোমার কথা বলে রাখব।
আবু করিম বললেন, তোমার বিষয়ে আমি অত্যন্ত চিন্তিত বোধ করছি। যাই হোক, আজ রাতেই সব ফয়সালা হবে। এখন বাসায় চলে যাও। আমাকে ঠাণ্ডা মাখায় পিপীলিকা ক্রন্দন নিয়ে চিন্তা করতে দাও। গোটা পঞ্চাশেক পিঁপড়া পাওয়া গেলে সন্ধ্যার মধ্যে পিঁপড়া আচার বানিয়ে ফেলতে পারতাম। পিঁপড়া আবার দুরকম লাল পিঁপড়া। কালো পিঁপড়া। কোন পিঁপড়ায় আচার ভালো হয় তাও বুঝতে পারছি না। ভালো দুঃশ্চিন্তায় পড়েছি।
সানাউল্লাহ রাতের খাবারের ভালো আয়োজন করলেন। আবু করিমের পছন্দ খিচুড়ি, বেগুন ভাজি। সঙ্গে খাটি ঘি দুই চামচ। তিনি নিরামিশাষি। খিচুড়ি, বেগুন ভাজি এবং ঘিয়ের ব্যবস্থা করলেন। সঙ্গে ডিমের ঝোল করা হলো। আবু করিম ডিম না খেলেও ডিমের ঝোল বা গরুর মাংসের ঝোল খান।
হমড়ুর সঙ্গে অতিথি প্রসঙ্গে আলাপ করলেন। তাকেও যথেষ্ট উৎসাহী মনে হলো। শুধু ডমরু বলল, বাবা, উনার সামনে যাব না। আমার লইজ্যা করে।
সানাউল্লাহ বললেন, লইজ্যা না মা। শব্দটা হচ্ছে লজ্জা। বলো লজ্জা করে।
বঁলব নাঁ। আমি বঁলব নাঁ।
সানাউল্লাহ বললেন, তোমরা যখন ভূতদের ভাষায় কথা বলবে তখন তোমাদের মতো বলবে। মানুষের ভাষায় কথা বললে প্রমিত বাংলা উচ্চারণ করতে হবে। এবং নাকি উচ্চারণ করাই যাবে না। তোমার ভাই হমড়ুকে দেখ। সে তো নাকে কোনো কথাই বলে না।
হমডু বলল, যে বেড়াতে আসবে তাকে কী ডাকব?
সানাউল্লাহ বললেন, স্যার ডাকবে। উনি একজন বিশিষ্ট চিকিৎসক এবং আচার উদ্ভাবক। আচার জগতের মুকুটহীন সম্রাট বললেও কম বলা হয়। এখন নতুন এক আচার বানানোর চেষ্টায় আছেন। শেষ পর্যন্ত যদি বানাতে পারেন হৈচৈ পড়ে যাবে। পিঁপড়ার আচার। নাম পিপীলিকা ক্রন্দন। আমাদের দেশে এই আচার চলবে না। তবে চায়নিজরা হামলে পড়বে। টনকে টন সাপ্লাই যাবে। ভালো কথা হমডু, চায়নায় ভূত আছে?
জানি না তো।
নাক চেপা কোনো চায়নিজ ভূতকে কখনো দেখ নি?
না।
সানাউল্লাহ বললেন, তোমরা বলতে পারবে না। তোমাদের বাবা-মা অবশ্যই পারবেন। তাদের জিজ্ঞেস করতে হবে। ভূপর্যটক ভূত থাকার কথা। হিউ-এনসাং টাইপ। হমডু, জামা-জুতা পরে রেডি হয়ে থাক। আমার বন্ধু ঘরে চুামাত্র ভূতদের ভাষায় বলবে, ভূত সমাজের পক্ষ থেকে আমার সালাম গ্রহণ করুন। ভূতদের ভাষায় এটা কী হবে?
হমছু বলল, কিঁউইইই।
সানাউল্লাহ মুগ্ধ গলায় বললেন, এত বড় একটা সেনটেন্স এক শব্দে শেষ? ভেরি ইন্টারেস্টিং। আমি আপনাকে দেখে বিরক্ত হয়েছি ভূত ভাষায় এটা কী হবে?
হমডু বলল, একটা ই কম হবে। কিঁউইই।
আপনাকে দেখে রাগ লাগছে— এর ভূত ভাষা কী?
হমড়ু বলল, আরেকটা ই কমে যাবে। কিঁউই।
সানাউল্লাহ বললেন, সবগুলি ই যদি ফেলে দেই। যদি বলি, কিঁউ তার মানে?
হমড়ু বলল, এর মানে বন্ধু।
সানাউল্লাহ বললেন, অসাধারণ। আমার বন্ধু ঘরে ঢুকামাত্র আমি বলব, কিঁউ। আর তুই বলবি, কিঁউইইই। সে শুরুতেই যাবে ভড়কে।
সানাউল্লাহ বন্ধুকে ভড়কাবার সুযোগ পেলেন না। রাত দশটায় আবু করিমের ড্রাইভার এসে বলল, স্যার অসিতে পারবেন না। তিনি মহাখালী কলেরা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাঁর বমি এবং দাস্ত হচ্ছে। পিঁপড়ার একটা আচার বানিয়েছিলেন। সেই আচার তরকারির চামচে এক চামচ খাবার পর থেকে এই অবস্থা। আমাকেও খেতে বলেছিলেন। আমি খেতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে খাই নাই। স্যার, আমার উপর ময়মুরুব্বির দোয়া আছে।
সানাউল্লাহ বললেন, আমি এক্ষুনি বন্ধুকে দেখতে যাচ্ছি। হমডুকেও সঙ্গে নেব। এই হমডু। রেডি হয়ে যাও।
ড্রাইভার অবাক হয়ে বলল, কার সঙ্গে কথা বলেন স্যার?
সানাউল্লাহ বললেন, একটা ভূতের বাচ্চা বিপদে পড়ে আমার আশ্রয়ে আছে। তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি।
আমি তো কিছু দেখি না স্যার।
দেহধারণ করে না বলেই দেখছ না। দেহধারণ করলেই দেখবে। ভোমার সঙ্গে গাড়ি আছে না? আমাদের নিয়ে চলো।
ড্রাইভার বলল, আপনার হাসপাতালে যাওয়া ঠিক হবে না স্যার।
ঠিক হবে না কেন?
স্যারের অসুখের খবর পেয়ে শায়লা ম্যাডাম হাসপাতালে এসেছেন। তিনি রাতে থাকবেন। আপনাকে দেখলে শায়লা ম্যাডাম রাগারাগি করবেন। কারণ ম্যাডামের ধারণা আপনি স্যারকে পাগল বানিয়েছেন।
বলো কী?
জি। ম্যাডাম সবসময় এই কথা বলেন। তাছাড়া ম্যাডামের মন মেজাজ এখন। খুব খারাপ। সন্ত্রাসীরা তার চেম্বারে হামলা করেছিল। কাগজে উঠেছে, পড়েছেন
নিশ্চয়ই। স্যার, আমি যাই?
রাত অনেক হয়েছে। রফিক হিন্দি ছবি দেখছে। রফিকের পেছনে গা ঘেঁসে বসেছে হমড়ু এবং ডমরু। এরা দেহধারণ করে নি বলে রফিক তাদের দেখতে পাচ্ছে না। সানাউল্লাহ ভূতের লেখা নিয়ে বসেছেন। আজকের রচনার বিষয়—
ভূতের ভাষা। তিনি লিখছেন—
ভূতদের নিজস্ব ভাষা আছে। ব্যাকরণ আছে। তবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, তাদের নিজেদের কোনো বর্ণমালা নেই। পৃথিবীর আদিবাসী মানবগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের মিল লক্ষণীয়। অনেক আদিবাসীদের ভাষা আছে, কিন্তু বর্ণমালা নেই। যেমন, আন্দামানের নিকবর দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসী… জারোয়া, সেন্তেলিজ।