Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সানাউল্লাহর মহাবিপদ (২০০৯) || Humayun Ahmed » Page 4

সানাউল্লাহর মহাবিপদ (২০০৯) || Humayun Ahmed

সকাল আটটা বাজার আগেই

সকাল আটটা বাজার আগেই, হামিদুর রহমান উপস্থিত। সানাউল্লাহ তখন নাশতা শেষ করে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছেন। আরাম করে একটা সিগারেট ধরিয়েছেন। সিগারেট তিনি খান না। রফিক এক প্যাকেট কিনে এনেছে। প্যাকেটটা রেখেছে রান্নাঘরের ফ্রিজের ওপর। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, সিগারেট তো খাই না। তুই সিগারেট আনলি কেন?

রফিক বলল, টেকার ভাংতি পাই না এইজন্যে কিনলাম। কোনোদিন যদি মন মিজাজ খুব খারাপ থাকে একটা টান দিবেন। আবার যদি মন মিজাজ খুব ভালো থাকে আরেকটা টান দিবেন। গেল ফুরাইল।

সানাউল্লাহুর মন মেজাজ অজি অতিরিক্ত ভালো, সেই হিসেবে সিগারেট ধরিয়েছেন। হামিদকে দেখে তার কলিজা অনেকখানি শুকিয়ে গেল। হামিদ অতি পঁাচ খেলা লোক। হামিদের কথাই তিনি তার বন্ধু আবু করিমকে বলেছিলেন। স্বভাব গিরগিটির মতো। সরকার বদলের সঙ্গে দলবদল। নিজের ক্যাডার বাহিনী আছে। এদের দিয়ে তিনি যাবতীয় কুকর্ম করান।

হামিদ, সানাউল্লাহ্র খালাতো ভাই। যখন সানাউল্লাহর স্ত্রী জীবিত ছিলেন তখন বিপদেআপদে হামিদকে ডাকতেন। এখন যোগাযোগ নেই। হামিদ সানাউল্লাহর সামনের চেয়ারে বসতে বসতে কড়া গলায় বললেন, সিগারেট ফেল। সকালবেলা বিষ হাতে নিয়ে বসে আছ। সিগারেটের আরেক নাম যে Death stick তা জানো?

না।

এখন জানলে। সিগারেট ফেল।

সানাউল্লাহ্ আধখাওয়া সিগারেট ফেলে দিলেন। হামিদ বুকপকেট থেকে একটা কাগজ বের করলেন! গত রাতে জাবিনের সঙ্গে টেলিফোনে তাঁর কথা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলি তিনি কাগজে লিখে রেখেছেন। তাঁর আলজিয়ার্সের মতো হয়েছে। অনেক কথাই মনে থাকে না। কিছুদিন আগে ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা ঘটেছে। ওয়ার্ড কমিশনারদের এক মিটিং। মেয়র সাহেবের খাসকামরায় মিটিং শুরু হয়েছে। তখন তিনি ভুলে গেলেন তার দল কী। তিনি কি বিএনপির না-কি আওয়ামী লীগের। বক্তব্য দিতে হলে দল বিবেচনা করে দিতে হবে। আওয়ামী লীগ হলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাস্তবায়ন দিয়ে শুরু করতে হবে। তিনি বিএনপির কেউ হলে স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ জিয়ার আদর্শ নিয়ে শুরু করতে হবে। এত বড় একটা মিটিং হলো, অথচ তিনি কোনো কথাই বলতে পারলেন না। মেয়র সাহেব এক পর্যায়ে বললেন, হামিদ সাহেব! আজ দেখি আপনি চুপচাপ। কিছু বলবেন?

হামিদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, কিছু বলব না।

হামিদ হাতের কাগজের দিকে তাকালেন। প্রথমেই লেখা— ব্যাটারি খাওয়া। এ থেকে কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। আরো বিস্তারিত ভাবে লেখা উচিত ছিল। জাবিনের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখন সবই পানির মতো পরিস্কার ছিল। এখন সব ঘোলাটে লাগছে।

হামিদ গলা খাকাড়ি দিয়ে বললেন, গত রাতে জাবিন মার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে। সে কিছু বিষয় নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত। আমাকে বলেছে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। এখন বলো ব্যাটারি খাওয়া বিষয়টা কী? কোনো কিছু গোপন করবার চেষ্টা করবে না। আজ পর্যন্ত কেউ তথ্য গোপন করে আমার কাছ থেকে পার পায় নাই। বলো ব্যাটারি খাওয়াটা কী?

সানাউল্লাহ বললেন, ব্যাটারি খাওয়া মানে ব্যাটারির খোসা ছাড়িয়ে পেস্টের মতো যে ক্যামিকেল আছে সেগুলি খেয়ে ফেলা। শুধু কঠিন দন্ডটা খাওয়া যাবে TI

কে খাচ্ছে ব্যাটারি?

আমি খাচ্ছি।

কেন? এটা কি কোনো মেডিসিন?

সানাউল্লাহ বললেন, অবশ্যই মেডিসিন। নানান ধরনের ইলেকট্রলাইট সেখানে থাকে। শরীরের ইলেকট্রলাইট ব্যালেন্সের জন্যে কার্যকর।

হামিদ বললেন, কী কী অসুখে কাজ করে?

বাধর্ক্যজনিত অসুখে।

হামিদ বললেন, ভুলে যাওয়া রোগে কাজে আসবে? ইদানিং সবকিছু ভুলে যাচ্ছি।

সানাউল্লাহ বললেন, খেয়ে দেখতে পারে।

হামিদ বললেন, ডোজ কী? মানে দিনে কয়টা ব্যাটারি খাব?

সানাউল্লাহ বললেন, সাতদিনে একটা করে শুরুতে খেয়ে দেখতে পারেন। A সাইজ ব্যাটরি।

হামিদ বললেন, যা বলার পরিষ্কার করে বলো। অর্ধেক কথা পেটে রেখে দিলে তো বুঝব না। নতুন ব্যাটারি খাব, না-কি চার্জ শেষ হয়ে গেছে এমন ব্যাটারি?

নতুন ব্যাটারি।

হামিদ বললেন, তোমার কাজের ছেলেকে পাঠাও, কিছু ব্যাটারি নিয়ে আসুক। প্রথম ডোজ তোমার সামনেই খাই।

সানাউল্লাহ বললেন, রফিক ব্যাটারি কিনতেই গেছে। একপাতা ব্যাটারি কিনবে। সেখান থেকে আপনি চারটা নিয়ে নেবেন। এক মাসের ওষুধ।

খালিপেটে খেতে হবে?

এরকম কোনো নিয়ম নাই। ভাতের সঙ্গে আচারের মতোও খেতে পারেন।

হামিদ আবার কাগজের দিকে তাকালেন, সেখানে লেখা ডমরু। ডমুরু মানে কী? তিনি নিজে কি লিখতে ভুল করেছেন? ড়ুমুর লিখতে গিয়ে ডমরু লিখেছেন। তারপরেও নিশ্চিত হবার জন্যে বললেন, ড়ুমুর ব্যাপারটা কী?

সানাউল্লাহ বললেন, ড়ুমুর একটা ফল।

তা জানি। ড়ুমুরের ইংরেজিও জানি– Fig. জাবিন ড়ুমুরের বিষয়ে কী জানতে চাচ্ছে বুঝতে পারলাম না। ব্যাটারি খাবার পর ড়ুমুর খেতে হয় এমন কিছু?

সানাউল্লাহ বললেন, খেলে ভালো। না পাওয়া গেলে অন্য ফলও খাওয়া যায়।

ভূতের বাচ্চা বিষয়ে জানতে চেয়েছে। ভূতের বাচ্চার ব্যাপারটা কী?

ভুতের বাচ্চা হচ্ছে অল্পবয়স্ক ভূত। ইংরেজিতে বেবি ঘোস্ট বলা যেতে পারে। ভূতদের মধ্যে যেমন বুড়ো হাবড়া আছে আবার অল্পবয়স্ক ভূতও আছে।

হামিদ বললেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। সানাউল্লাহ বললেন, আপনি ভূত বিশ্বাস করেন?

অবশাই করি। ছোটবেলায় তেঁতুল গাছে একটা শাকচুন্নি বসে থাকতে দেখেছি। সে একটা ইতিহাস। এখনো মনে হলে গায়ে কাঁটা দেয়। এই দেখ গায়ে কাঁটা দিয়েছে।

সানাউল্লাহ বললেন, ঘটনাটা বলুন শুনি।

হামিদ বললেন, দাড়াও বলি— ভয়ঙ্কর ব্যাপার। শ্রাবণ মাস। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে…

এই বলেই হামিদ থেমে গেলো আর কিছুই তাঁর মনে পড়ছে না। তিনি হতাশ চোখে সানাউল্লাহর দিকে তাকিয়ে বললেন, আর কিছু মনে পড়ছে। তোমাকে বললাম আমার বিস্মরণ রোগ হয়েছে। ব্যাটারি আসুক, খেয়ে দেখি কোনো উপায় হয় কি-না। যে যা খেতে বলছে তাই খাচ্ছি। কোনো উপকার পাচ্ছি না। একজন বলল, ছাগলের লেদা মধু মাখিয়ে চুষে চুষে খেতে। স্মৃতি নষ্টের এটা না-কি ধন্বন্তরী ওষুধ। তাও একবার খেলাম।

উপকার হয়েছিল?

কী উপকার হবে! বমিটমি করে সর্বনাশ। জীবনের উপর বিতৃষ্ণা ধরে গেছে। ভোটার আই ডি করতে গিয়েছি। জিজ্ঞেস করল, স্যার আপনার বাবার নাম? কিছুতেই বাবার নাম মনে করতে পারলাম না। চিন্তা কর অবস্থা। বাবার নাম ভুলে গেছি। স্বীকারও করতে পারছি না।

তখন কী করলেন?

চট করে মাথায় বুদ্ধি এসে গেল। বললাম, বাবার নাম আদম। বাবা আদম আমাদের সবারই বাবা, সেই হিসাবে বললাম, আদম। বুদ্ধি ভালো বের করেছি না?

অবশ্যই।

রফিক একপাতা ব্যাটারি করে এসেছে। সেখান থেকে একটা ব্যাটারির অর্ধেকের কিছু বেশি হামিদ খেয়ে ফেললেন। মুক বিকৃত করে বললেন, অতি অখাদ্য।

সানাউল্লাহ বললেন, অখাদ্য তো হবেই। ওষুধ তো খাদ্য না।

তাও ঠিক। মেড ইন চায়না ব্যাটারি, এই নিয়ে একটু চিন্তা লাগছে। চায়নিজরা দুধের মতো শিশুখাদ্যে বিষাক্ত মেলামিন দিয়েছে। ব্যাটারিতে এরকম কিছু দিয়েছে কি-না কে জানে।

হামিদ এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খেয়ে ক্রমাগত ঢেঁকুর তুলতে লাগলেন। বিড়বিড় করে বললেন। ঢেঁকুরের সঙ্গে পিসাবের মতো গন্ধ আসছে।

সানাউল্লাহ বললেন, আপনি অ্যামোনিয়ার গন্ধে পাচ্ছেন। ব্যাটারি থেকে অ্যামোনিয়ার গন্ধ আসে।

বুক ধড়ফড় করছে।

সানাউল্লাহ বললেন, কিছুক্ষণ শুয়ে থাকবেন?

বুঝতে পারছি না। চায়নিজ ব্যাটারি খাওয়াটা ভুল হয়েছে। আমেরিকা বা ইউরোপের ব্যাটারি খাওয়া উচিত ছিল।

হামিদের চখ-মুখ কিছুক্ষণের মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কারণ ছেলেবেলায় শাকচুনি দেখার গল্পটা তার পুরোপুরি মনে পড়েছে। ব্যাটারি ওষুধের ক্ষমতায় তিনি মুগ্ধ। তিনি বললেন, চায়নিজ ব্যাটারি হলেও পাওয়ার খারাপ না। শাকচুন্নির ঘটনাটা মনে পড়েছে। বলব?

বলুন শুনি।

শ্রাবণ মাস। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। মাগরেবের নামাজ শেষ হয়েছে। আমি মূল বাড়ি থেকে বাংলাঘরে যাচ্ছি। বাংলাঘরের দক্ষিণে একটা তেঁতুল গাছ। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি তেঁতুল গাছের ডালে পা ছড়িয়ে একটা শাকচুন্নি বসে আছে। আমি বললাম, এটা কে? শাকচুন্নিটা বলল, তুই হামিদ না? তুই আমারে চিনস না? তোরে ধইরা একটা আছাড় যদি না দিছি।

বলেই সে দুটা লম্বা হাত আমার দিকে বের করল। আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম।

একবারই দেখেছেন, না আরো কয়েকবার দেখেছেন?

আমি একবারই দেখেছি। তবে আমাদের বাড়ির অনেকেই কয়েকবার করে দেখেছে। তেঁতুল গাছ কাটাবার কথা উঠল। তখন মা বললেন, ভিটাতে যেমন বাস্তুসাপ থাকে সেরকম বাস্তুভূতও থাকে। এদের তাড়ানো ঠিক না। সে থাকুক তার মতো। ক্ষতি তো তেমন করছে না। ছোট পুলাপানকে ভয় দেখায় আর টিনের চালে ঢিল মারে। এর বেশি কিছু তো করে না।

মার কথায় তেঁতুল গাছ আর কাটা হয় নি।

শাকচুন্নিটা এখনো আছে?

থাকতে পারে। রাজনীতিতে ঢোকার পরে দেশের বাড়িতে আর যাওয়া হয়। জনগণের সেবা করতে গিয়ে নিজের বাড়িঘর ভুলে গেছি, তার মূল্যায়ন কই! খামাখা তিন মাস জেল খাটলাম। পত্রিকায় ছবি দিয়ে নিউজ করল–সন্ত্রাসী গ্রেফতার। দেশের জন্যে কিছু করাই হয়েছে সমস্যা। আচ্ছা আজকে যাই।

হামিদ চলে যাওয়ার দুঘণ্টার মধ্যে জাবিন টেলিফোন করল। তিনি তখন নিউ মার্কেটে বইয়ের দোকানে। লাইব্রেরির মালিক কাদের খান, সানাউল্লাহর জন্যে সিঙ্গাড়া আনিয়েছেন। মিনি সিঙ্গাড়া। একসঙ্গে দুটা তিনটা মুখে দেয়া যায়। এমন সময় জাবিনের টেলিফোন। জাবিন মহা উত্তেজিত।

বাবা, তুমি হামিদ আংকেলকে ব্যাটারি খাইয়ে দিয়েছ?

সানাউল্লাহ বললেন, আমি কেন ব্যাটারি খাওয়াব? উনি নিজের আগ্রহে খেয়েছেন। তাও পুরোটা খান নাই। অর্ধেকের মতো খেয়েছেন। তিনটা সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন। পরে খাবেন।

বাবা, কী হচ্ছে আমি কি জানতে পারি?

তেমন কিছু হচ্ছে না রে মা, ব্যাটারি খাওয়া হচ্ছে। কেউ যদি আগ্রহ করে ব্যাটারি খেতে চায় সেখানে আমাদের কী বলার আছে? কথায় আছে আপরুচি খানা।

বাবা, তুমি কি খবর পেয়েছ ব্যাটারি খেয়ে এখন তার কী অবস্থা? প্রচণ্ড পেটে ব্যাথা। তাকে ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে। কথাবার্তাও বলছেন পাগলের মতো। ডাক্তার সাহেব হামিদ আংকেলকে জিজ্ঞেস করেছেন, আপনার নামটা বলুন। হামিদ আংকেল বললেন, নিজের নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। তবে আমার বাবার নাম আদম। আর মার নাম হাওয়া। এই দুজনের নাম মনে আছে।

সানাউল্লাহ বললেন, মা, এই বিষয়ে পরে কথা হবে। আমি সিঙ্গাড়া খাচ্ছি। সিঙ্গাড়া মুখে নিয়ে কথা বলতে অসুবিধা হচ্ছে। খাদ্য মুখে নিয়ে কথা বলা অত্যন্ত রিস্ক। শ্বাসনালিতে খাদ্য ঢুকে যেতে পারে।

সানাউল্লাহ মোবাইল ফোন পুরোপুরি বন্ধ করে দিলেন। কাদের খান কান। খাড়া করে সানাউল্লাহর কথাবার্তা শুনছিলেন। তিনি বললেন, স্যার যদি কিছু মনে না করেন ব্যাটারি খাওয়ার একটা প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ হচ্ছিল। কে ব্যাটারি খেয়েছে?

সানাউল্লাহ বললেন, আমার খালাতো ভাই। ব্যাটারি তার স্টোমাক নিতে পারে নি। কারণ ব্যাটারি মূলত ভূতদের খাদ্য। হামড়ু ড়ুমরু আগ্রহ করে খায়।

আপনার বাড়িতে যে দুটা ভূতের বাচ্চা থাকে তাদের কথা বলছেন?

হুঁ।

ওরা এখনো আছে?

যাবে কোথায়? বাবা মা ফেরার।

কাদের খান বললেন, স্যার, আপনাকে একটা ছোট্ট অনুরোধ করব। ভূতের বাচ্চা দুটাকে নিয়ে একটা বই লিখে ফেলেন। শিশুতোষ রচনা। আমরা ছাপব। ধ্রুব এষকে দিয়ে কভার করাব। ভেতরে চার কালারের ইলাসট্রেশন থাকবে। বাচ্চারা ভূত-প্রেতের গল্প খুব পছন্দ করে।

সানাউল্লাহ বললেন, ভূত নিয়ে একটা বই লেখার আমার পরিকল্পনা আছে। তবে গল্প-উপন্যাস না। গবেষণামূলক। যেমন ভূতদের সমাজ ব্যবস্থা। তাদের রাজনীতি। তাদের খাদ্যাভ্যাস। শ্রেণীভেদ।

কাজ কি শুরু করেছেন?

চিন্তাভাবনা শুরু করেছি। শিগগিরই লেখা ধরব। ভূত সম্পর্কে আমাদের অনেক অজ্ঞতা আছে, সেইসব দূর করতে হবে। যেমন ধরুন, আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করি পেত্নী এবং শাকচুন্নি এই দুয়ের মধ্যে তফাত কী? আপনি কি বলতে পারবেন?

জি-না।

সানাউল্লাহ বললেন, একজনের খোঁজ পেয়েছি— থিয়সফিষ্ট। প্রেতচর্চা করেন। ভালো মিডিয়াম। চক্রে বসে ভূতদের ডাকলেই তারা চলে আসে। তার সঙ্গে অনেক ঝামেলা করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছি। পরশু সন্ধ্যায় যাব।

কাদের খান বললেন, স্যার, আমাকে কি সঙ্গে নিয়ে যাবেন? আমার খুব শখ।

সানাউল্লাহ বললেন, আপনি যেতে চাইলে অবশ্যই যাবেন।

কাদের খান বললেন, স্যার, আপনি যে ভূতের বইটা লিখবেন তার নাম ঠিক করেছেন?

হুঁ। ভূতের ক খ গ।

নামটা বদলাতে হবে স্যার। তসলিমা নাসরিন এই ধরনের নাম ব্যবহার করে নানান কেচ্ছা কাহিনী বলেছেন। ভূতের ক খ গ শুনলে সবাই ভাববে ভূতদের প্রেমলীলা।

ভূতবৃত্তান্ত নামটা কেমন?

কঠিন নাম। আরো সহজ কিছু দিতে হবে। রবীন্দ্রনাথের গান ভেঙে একটা নাম দিলে কেমন হয় স্যার? রবীন্দ্রনাথের একটা গান আছে—দিনের শেষে ঘুমের দেশে। আপনি বইটার নাম দিলেন— দিনের শেষে ভূতের দেশে।

সানাউল্লাহ বললেন, নামটা খারাপ না।

কাদের খান বললেন, স্যার, আপনার এই বই আমরা ছাপব। আপনি আর কাউকে দিতে পারবেন না। পাঁচ হাজার টাকা দিচ্ছি স্যার। রয়েলটির অ্যাডভান্স। আপনি না বললে শুনব না।

সানাউল্লাহ রয়েলটির পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে একটা ভিসিডি প্লেয়ার কিনলেন। সন্ধ্যার পর তেমন কিছু করার থাকে না। হম ডমরুকে নিয়ে হিন্দি ছবি দেখা যেতে পারে।

শুধু মানুষের বিনোদন দেখলে চলবে না। ভূতের বিনোদনের ব্যাপারটাও মাথায় রাখতে হবে। পশুপাখি, কীটপতঙ্গ সবার বিনোদন দরকার।

ভিসিডি প্লেয়ারের সঙ্গে তিনি মেড ইন আমেরিকার দুটা A সাইজ ব্যাটারিও কিনলেন। হামিদকে হাসপাতালে দেখতে যাওয়া দরকার। খালি হাতে যাওয়া ঠিক না। আগে রোগী দেখতে হরলিক্সের কৌটা নিয়ে যাবার নিয়ম ছিল। কলেজে পড়ার সময় তার একবার জন্ডিস হয়েছিল। তার আত্মীয়স্বজনরা সবাই হরলিক্সের কৌটা নিয়ে রোগী দেখতে এসেছিলেন। সেবার সর্বমোট উনিশটা হরলিক্সের কৌটা পেয়েছিলেন।

এখন বাংলাদেশ বদলেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ হয়েছে। এখন আর হরলিক্সের কৌটা নিয়ে যাওয়া যায় না। ব্যাটারি নিয়ে যাওয়া যায়। মেড ইন আমেরিকা ব্যাটারির প্রতি হামিদ যথেষ্ট আগ্রহী ছিল। ব্যাটারি খাওয়া না-খাওয়া পরের কথা। ব্যাটারি পেয়ে সে খুশি হবে তা ধরে নেয়া যায়।

সানাউল্লাহ দুটা বর্ণমালার বই কিনলেন। ভূতছানাদের বর্ণমালা শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা। শিক্ষার ব্যাপারে ভূতরা কতটুকু আগ্রহী তিনি জানেন না। ওদের শেখাতে হবে কায়দা করে। তিনি রফিককে শেখাবেন, তাই দেখে দেখে ওরাও শিখবে। অনেকটা ঝি মেরে বৌকে শেখানো টাইপ।

তিনি নিজের জন্যে তিনশ পাতার চামড়ায় বাঁধানো খাতা এবং একডজন বলপয়েন্ট কিনলেন। ভূত বিষয়ক গ্রন্থ লিখে শেষ করতে হবে। এডভান্স টাকা নেয়া হয়ে গেছে। এখন আর কাজ ফেলে রাখা ঠিক না। দৈনিক দশপাড়া করে লিখলেও তিনশ পাতা লিখতে ত্রিশ দিন লাগবে। এক মাসের ধাক্কা।

ক্লিনিকে হামিদ আধামরার মতো পড়ে আছেন। তাঁকে স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। হামিদের দুজন ক্যাডার প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে কামরার বাইরে বসা। দুনিয়ার আত্মীয়স্বজন যেন ভিড় না করে সেই ব্যবস্থা। যে রোগী দেখতে যাবে সে ঘড়ি ধরে দুমিনিট থাকবে। দুমিনিটের বেশি কেউ থাকলে তাকে ঘাড় ধরে বের করে দেয়া হবে।

ক্যাডারদের একজনের চেহারা বাঁদরের মতো। কথাবার্তাও বাদরের মতো কিচকিচ করে বলে। সে বলল, স্যার হাতে ঘড়ি আছে?

সানাউল্লাহ বললেন, না।

অসুবিধা নাই। আমাদের সঙ্গে ঘড়ি আছে। দুই মিনিট টাইম। আমরা আউট বললেই দ্রুত বের হবেন। ওস্তাদের অবস্থা খুবই খারাপ। তাকে বিরক্ত করা ডাক্তারের নিষেধ আছে। ওস্তাদ কাউকে চিনতে পারছেন না। আপনাকেও চিনতে পারবেন না। নিজের পরিচয় দেবার জন্যে ব্যস্ত হবেন না। বুঝেছেন?

জি।

যান চুকে যান।

সানাউল্লাহ ঢুকে পড়লেন। হামিদ বিছানায় শোয়া। সানাউল্লাহকে দেখে মাথা তুললেন। সানাউল্লাহ বললেন, আপনার জন্যে মেড ইন আমেরিকা ব্যাটারি নিয়ে এসেছি।

হামিদ বললেন, এখন খাব? সেটা আপনার বিবেচনা। আমাকে কি চিনেছেন?

না। তবে তোমার পিতার নাম জানি— বাবা আদম। হয়েছে?

জি হয়েছে।

একটা ব্যাটারির খোসা খুলে দাও। খেয়ে ফেলি। ডাক্তাররা দেখলে খেতে দেবে না। ভালো কথা, ড্রেট অব এক্সপীয়রি দেখে এনেছ?

হ্যাঁ।

সানাউল্লাহ রোগীর পাশে রাখা ফলের প্লেট থেকে ছুরি নিয়ে অতি দ্রুত ব্যাটারির খোসা ছাড়িয়ে রোগীকে খাইয়ে দিলেন। হামিদ বললেন, এটার টেস্ট অনেক ভালো। আমেরিকা বলে কথা। একটা দেশ তো খামাখা এত বড় হয় না। কী বলো?

অবশ্যই।

ঐ ব্যাটারিটা আমার বালিশের নিচে রেখে দাও। সুযোগ বুঝে খেয়ে ফেলব।

সানাউল্লাহ বললেন, আমার একটা ছোট্ট কাজ করে দিতে হবে। একজনকে জনসমক্ষে চড় থাপ্পর দিতে হবে। কানে ধরে ঘুরতে হবে।

হামিদ বললেন, কোনো ব্যাপারই না। তার নাম। কোথায় থাকে। কখন পাওয়া যাবে সব লিখে ব্যাটারির সঙ্গে আমার বালিশের নিচে রেখে যাও। তোমার নাম এখন মনে পড়েছে। তুমি জাবিন মার বাবা। তোমার নাম সানাউল্লাহ। আমেরিকান ব্যাটারির গুণ দেখেছ? খাওয়ামাত্র অ্যাকশন।

সানাউল্লাহ নাম ঠিকানা লেখে বালিশের নিচে রাখলেন।

বাইরে থেকে বান্দরটা বলল, স্যার আউট। দুই মিনিটের বেশি হয়ে গেছে।

সানাউল্লাহ দ্রুত বের হয়ে এলেন।

রাত দশটা। ভিসিডিতে ছবি চলছে। ছবির নাম গজনি। বিরাট মারামারি কাটাকাটি। রফিক হা করে দেখছে। রফিকের পাশেই হুমড়ু ডমরু। রফিক এই দুই ভাইবোনকে দেখতে পাচ্ছে না। তবে সানাউল্লাহ দেখতে পাচ্ছেন। ছবির দিকে সানাউল্লাহর কোনো নজর নেই। তিনি খাতা নিয়ে বসেছেন। প্রথম পাতায় বড় বড় করে লিখলেন—

সানাউল্লাহ প্রণীত
দিনের শেষে ভূতের দেশে
ভূত বিষয়ক যাবতীয় তথ্যের প্রামাণ্য সংকলন

ক্রমাগত টেলিফোন বাজছে। নিশ্চয়ই জাবিনের টেলিফোন। তিনি টেলিফোন ধরলেন না। জরুরি লেখা নিয়ে বসেছেন। এখন কথা চালাচালির সময় না। টেলিফোন বেজেই যাচ্ছে। তিনি মহাবিরক্ত হয়ে সেট হাতে নিলেন।

বাবা, রাতে তোমার টেলিফোন করার কথা। তুমি টেলিফোন কর নি।

মারে, অসম্ভব ব্যস্ত। এত ব্যস্ত যে মাঝে মাঝে নিঃশ্বাস ফেলতেও ভুলে যাচ্ছি।

কী নিয়ে ব্যস্ত?

ভূতদের নিয়ে একটা গবেষণামূলক বই লিখছি। বইয়ের প্রকাশকও ঠিক হয়ে গেছে— মনোয়ারা পাবলিকেশন হাউস। মনোয়ারা হচ্ছে প্রকাশক কাদের সাহেবের স্ত্রী। বৎসর দুই আগে ভদ্রমহিলা মারা গেছেন। কাদের সাহেব স্ত্রীভক্ত মানুষ তো। তিনি স্ত্রীর নামে পাবলিকেশনের নাম দিয়েছেন। আগে নাম ছিল— স্বাধীন পাবলিকেশন লিমিটেড।

জাবিন বলল, হড়বড় করে এসব কী বলছ? আগে তো তুমি এত কথা বলতে। তোমার সমস্যা কী?

সানাউল্লাহ বললেন, লেখকদের যে সমস্যা আমারও একই সমস্যা। মাথার ভেতর লেখা ঘুরপাক খাচ্ছে তো। এই কারণে কী বলছি, কতক্ষণ ধরে বলছি তা অবান্তর হয়ে দাঁড়ায়। আমার বইটার নাম দিয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এটা একটা আশার কথা।

রবীন্দ্রনাথ কীভাবে নাম দেবেন? তিনি কি বেঁচে আছেন না-কি?

সানাউল্লাহ বললেন, তাঁর মতো মহাপুরুষদের মৃত্যু নেইরে মা। যে কারণে তিনি নিজেই নিজের মৃত্যু সম্পর্কে বলেছেন এনেছিলে সাথে তুমি মৃত্যুহীন প্রাণ। মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।

জাবিন বলল, বাবা, তুমি তোমার জামাইয়ের সঙ্গে কথা বলো। আমি তোমার কোনো কথাই বুঝতে পারছি না। নাও ধর।

সানাউল্লাহ অস্বস্তির সঙ্গে টেলিফোন ধরলেন। জাবিনের বরকে তিনি সামান্য ভয় পান। শ্বশুর হয়ে জামাইকে ভয় পাওয়া অত্যন্ত হাস্যকর ব্যাপার। মানবজীবন হলো হাস্যকর ঘটনাবলীর সমষ্টি।

বাবা, কেমন আছেন?

ভালো।

আপনার জন্যে একটি সুসংবাদ আছে। বলব?

বলো।

অস্ট্রেলিয়ায় ইমিগ্রেশনের জন্যে আপনার যে সব কাগজপত্র জমা দেয়া হয়েছিল সেখানে কিছু সমস্যা ছিল, তারপরেও আপনি ইমিগ্রেশন পেয়ে গেছেন।

ও।

বাবা Congratulation. বাকি জীবন আপনি অতি সুসভ্য দেশে থাকবেন। ক্যাঙ্গারু দেখবেন।

সানাউল্লাহ বললেন, হুঁ।

আগামী মাসের ২৭ তারিখের মধ্যে আপনাকে চলে আসতে হবে। আমি জানি আপনি নিজ থেকে আসবেন না। কাজেই আমি এসে আপনাকে নিয়ে যাব। বাবা, ঠিক আছে?

হুঁ।

ঢাকায় আপনার যে জায়গাটা আছে পাঁচ কাঠা না?

হুঁ।

জায়গাটা তো মোটামুটি প্রাইম লোকেশনে। আমরা একটা ডেভেলপারকে দিয়ে দিব। তারা মাল্টি স্টোরিড অ্যাপার্টমেন্ট হাউস বানাবে। দুটা থাকবে আপনার নামে। দেশে যখন বেড়াতে আসবেন নিজের অ্যাপার্টমেন্টে উঠবেন।

সানাউল্লাহ বললেন, একটা সমস্যা আছে।

কী সমস্যা?

আমার বাড়ির সামনে একটা কাঠাল গাছ আছে। ডেভেলপারকে দিলে তারা কাঁঠাল গাছটা কেটে ফেলবে। তখন ভূতের বাচ্চা দুটা যাবে কই? ওরা তো কাঁঠাল গাছেই থাকে।

বাবা, আমি তো নিজেই আসছি। তখন কাঁঠাল গাছে, গাছের ভূত এইসব নিয়ে Detail কথা হবে। গুড নাইট।

গুড নাইট।

সানাউল্লাহ লেখায় মন দেবার চেষ্টা করছেন। মন বসছে না। নিজের দেশ ফেলে ছাতার অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে থাকতে হবে। ক্যাঙ্গারু দেখতে হবে? দেখার মতো কী আছে এই অদ্ভুটার ভেতর? এত বড় জন্তু ব্যাঙের মতো লাফিয়ে চলে।

ভিসিভিতে ছবি শেষ হয়েছে। রফিক ঘুমুতে চলে গেছে। সানাউল্লাহ ডাকলেন, হমডু।

হমড়ু সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, জি।

তোদের নিয়ে গবেষণামূলক বই লিখছি। তোরা সাহায্য না করলে পারব না। আমার হাতে সময় কম। আমাকে চলে যেতে হবে অস্ট্রেলিয়ায়, ক্যাঙ্গারু দেখতে হবে। যাই হোক, তোরা রেস্ট নে আমি বইয়ের ইনট্রোডাকশনটা লিখে ফেলি।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress