জাবিন দুবাই এয়ারপোর্ট পর্যন্ত চলে এসেছে
জাবিন দুবাই এয়ারপোর্ট পর্যন্ত চলে এসেছে। সেখান থেকে খুশি খুশি গলায় বাবাকে টেলিফোনে জানিয়েছে, বাবা, আর মাত্র বারো ঘণ্টার মধ্যে তোমার সঙ্গে দেখা হবে।
সানাউল্লাহ বললেন, একা আসছিস না-কি জামাইও সঙ্গে আছে?
জাবিন বলল, ওকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। ঢাকায় অনেক কাজকর্ম, তাকে সেইসব দেখতে হবে।
ঢাকায় আবার কী কাজকর্ম?
জাবিন বলল, তুমি ভুলে গেলে! তোমার জমিটা ডেভেলপারকে দিতে হবে? ওদের সঙ্গে চুক্তি করতে হবে না?
সানাউল্লাহ বললেন, তাই তো। তাই ভো। ভুলে গিয়েছিলাম।
তুমি আছ কেমন বাবা?
আমি ভালো আছি। হমড়ু ডমরু ভালো আছে। হমডু গতকাল বৃষ্টিতে ভিজছে বলে ক্রমাগত হাঁচি দিচ্ছে। এমন অবাধ্য হয়েছে। বললাম বৃষ্টিতে ভিজবি না।
আবার হমডু-ডমরু?
আচ্ছা থাক হমডু-ডমরুর কথা। আর কিছু জানতে চাস?
আবু করিম চাচার শরীরের অবস্থা কেমন?
খুবই ভালো।
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন?
যেভাবে ছাড়া পাবার কথা সেভাবে ছাড়া পায় নি। আমি আর তোর হামিদ আংকেল আমরা ধমকাধমকি দিয়ে তাকে হাসপাতাল থেকে বের করে নিয়ে এসেছি।
কী বলছ এসব?
সানাউল্লাহ বললেন, পুলিশ তোর হামিদ আংকেলকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে। এই নিয়ে সামান্য ঝামেলা হয়েছে। তোর হামিদ আংকেল অ্যারেস্টের সময় বিএনপির পক্ষে একটা জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়েছেন। তিনি ভুলে গেছেন যে এখন তিনি আওয়ামী লীগের। অ্যারেস্টের সময় সাংবাদিকরা ছিল তো। সব পত্রিকায় ছবিসহ ছাপা হয়েছে। আওয়ামী নেতারা অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছেন। তারা। এক বিবৃতিতে বলেছেন, এটা বিএনপির একধরনের কারসাজি। তারা হামিদকে আওয়ামী লীগের কর্মী বলে প্রচার করতে চাচ্ছে, আসলে তিনি কখনো আওয়ামী লীগে ছিলেন না।
অদ্ভুত অদ্ভুত সব কথা বলছ বাবা।
সানাউল্লাহ বললেন, অদ্ভুত কথা কিছু বলছি নারে মা। পুলিশ আমাকেও খুঁজছে।
কী বলছ তুমি?
তোর হামিদ আংকেলের সঙ্গে আমিও তো ছিলাম। তবে তোর চিন্তার কিছু নাই। পুলিশ আমাকে খুঁজে পাচ্ছে না। আমি পলাতক।
কোথায় পালিয়ে আছ?
সেটা তো মা তোকে বলা যাবে না। শেষে পুলিশের চাপে তুই বলে ফেলবি। রিমান্ডে নিয়ে গেলে কথা বলা ছাড়া উপায় নেই। জেলে যেতে আমার কোনো সমস্যা নেই। হমভূ-ডমরুকে নিয়ে সমস্যা। বিনা কারণে ওরা কেন আমার সঙ্গে জেল খাটবে? আরে শোন, তুই কোনো চিন্তা করবি না। বাসায় রফিক আছে।
বলেই সানাউল্লাহ টেলিফোন রেখে দিলেন। এখন কথা বাড়ানো মানেই ঝামেলা।
নরুন্দ সাহেব কঠিন চোখে তাকিয়ে আছেন। রাগে গনগন করছেন। কথাও ঠিকমতো বলতে পারছেন না। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। মুখে থুথু এসে পড়ছে।
নরুন্দ বললেন, আপনি কী মনে করে চার লোক নিয়ে আমার বাড়িতে এসে উঠলেন? কোন সাহসে এই কাজটা করলেন। আমার বাড়িটা কি সরাইখানা?
সানাউল্লাহ হাসি হাসি মুখে বললেন, এরা সবাই সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, একজন ডাক্তার। বাকি দুজনের পরিচয় এখনো জানি না। এই দুজন এখনো ঘোরের মধ্যে আছেন। ঘোর কাটলেই পরিচয় পাব। তবে এই দুজনও বিশিষ্ট ব্যক্তি।
বিশিষ্ট ব্যক্তির আমি কেঁথা পুড়ি।
সানাউল্লাহ বললেন, শুধু শুধু কথা পুড়বেন কেন স্যার? আমরা একটা ঘরে সবাই থাকব। কথায় আছে না, যদি হয় সুজন তেঁতুল পাতায় নজন। আমরা মাত্র পাঁচজন।
আমি আপনার সুজন।
আপনার কথা বলছি না স্যার। আমরা পাঁচ বন্ধু সুজন। আমাদের একটা ঘর। দিলেই চলবে। আর কিছু লাগবে না। মেঝেতে পার্টি পেতে সবাই শুয়ে থাকব।
আমার ঘর কোথায় যে থাকবেন?
বসার ঘরে শুয়ে থাকব। এবং তার জন্যে পেইং গেস্ট হিসেবে আপনাকে টাকা দেব।
এই কথায় নরুন্দ খানিটা নরম হলেন। বিরক্ত গলায় বললেন, পার পারসন কত করে দেবেন।
সেটা স্যার আপনি ঠিক করে দিন। ফুড এন্ড লজিং। বাইরে হোটেলে খাওয়া আমাদের জন্যে সমস্যা। খাওয়া নিয়ে চিন্তা করবেন না। যা খেতে দিবেন তাই খাব। সিম্পল ডাল-ভাতও চলবে। আমাদের কাছে নানা ধরনের আচার আছে। আচার দিয়ে খেয়ে ফেলব।
জনপ্রতি প্রতিদিন একহাজার করে টাকা দিতে হবে। রাজি আছেন কিনা বলুন। এক পয়সা কম হবে না।
সানাউল্লাহ বললেন, আমি রাজি। শুধু একটা অনুরোধ, আমার সঙ্গে দুটা ভূতের বাচ্চা থাকবে। ওদের ফ্রি করে দিতে হবে।
নরুন্দ হতভম্ব গলায় বললেন, ফাজলামি করছেন?
সানাউল্লাহ বললেন, ফাজলামি করব কেন স্যার? এই যে এরা দুজন আপনার সামনেই আছে। দুই ভাইবোন। ভাইটার নাম হমডু, বোনটার নাম ডমরু। এই তোমরা সালাম দাও। ইনি বিখ্যাত ভূত বিশেষজ্ঞ নরুন্দ সাহেব।
নরুন্দ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন। সানাউল্লাহ বললেন, স্যার, এরা আপনাকে সালাম দিয়েছে।
নরুন্দ বললেন, আপনার চেহারা দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই যে আপনি বিরাট এক ফাজিল লোক। মায়ের কাছে মাসির গল্প ফেঁদেছেন। আমার কাছে ভূতের বাচ্চার গল্প।
সানাউল্লাহ বললেন, এই মুহূর্তে আপনি ওদের দেখতে পারছেন না কারণ এরা দেহধারণ করে নি। আপনার উগ্র মেজাজ দেখে ভয় পেয়েছে। ভয় পেলে এরা দেহধারণ করতে পারে না।
নরুন্দ হুঙ্কার দিলেন, Stop your cheater.
সানাউল্লাহ চুপ করে গেলেন। হমডু ডমরু ভালো ভয় পেয়েছে। দুজনই লাফ দিয়ে সানাউল্লাহর কোলে উঠে পড়েছে। ডমরু নানা ভঙ্গিমায় নন্দ সাহেবকে ভেংচি দিচ্ছে। রক্ষা যে তিনি সেই ভেংচি দেখছেন না। দেখতে পেলে তাঁর খবর হয়ে যেত।
পত্রিকায় সানাউল্লাহর হাসি হাসি মুখের ছবি ছাপা হয়েছে। ছবির ওপরে লেখা–
এঁকে ধরিয়ে দিন।
সমাজের উপকার করুন।
বিজ্ঞাপন দিয়েছেন ডাক্তার জোহরা খানম এবং তাকে ধরিয়ে দেবার জন্যে নগদ দশ হাজার টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করেছেন। পত্রিকায় ঘটনার বিবরণ হিসেবে বলা হয়েছে সানাউল্লাহ নামের এই লোক ক্লিনিকে শুধু যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে তা-না, ক্লিনিকের প্রতিটি সদস্যকে কমোডের নোংরা পানি খেতে বাধ্য করেছে। ক্লিনিকের তিনজন ভয়ঙ্কর মানসিক রোগীকেও নিয়ে পালিয়ে গেছে।
পত্রিকা কোলে নিয়ে জাবিন স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। জাবিনের পাশে তার স্বামী মাসুদ। রফিক দুজনকেই চা দিয়েছে। জাবিন চায়ের কাপে চুমুক দেয় নি। মাসুদ তৃপ্তির সঙ্গেই চা খাচ্ছে। মাসুদ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কিছু মনে করো নী। তোমার বাবা অতি বিপদজনক একজন ব্যক্তি।
জাবিন বলল, আমার বাবা বিপদজনক ব্যক্তি?
হ্যাঁ। তুমি আমার কথায় রাগ করবে, তারপরেও বলি–যে মানুষ দেশে বিপদজনক সে বিদেশেও বিপদজনক।
জাবিন বলল, তুমি চাচ্ছ না যে আমার বাবা বিদেশে যাক? সে তার মেয়ের সঙ্গে বাকি জীবনটা কাটাক।
মাসুদ বলল, আমার অনেস্ট ওপিনিয়ন হলো No. তিনি যে ধরনের মানুষ তাকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখতে হবে। সেই সময় তোমার নেই। আমারও নেই।
জাবিন বলল, আমার চার বছর বয়সে মা মারা গেলেন। বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন নি। আমাকে একা বড় করেছেন। তিনি তার জীবনটা দিয়ে দিলেন আমার জন্যে। তার উত্তরে আমি কী করলাম? বাবাকে ফেলে রেখে বিদেশে সুখের সংসার পাতলাম।
মাসুদ বলল, ইমোশনাল কথাবার্তা বলার তো এখানে কিছু নাই। পুরো ব্যাপারটা আমাদের র্যাশনালি দেখতে হবে। তোমার বাবার আছে তার জীবন। আমাদের আছে আমাদের জীবন।
জাবিন চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়াল। রফিককে বলল, রফিক! আমার জন্যে একটা ইয়েলো ক্যাব নিয়ে এসো।
মাসুদ বলল, কোথায় যাচ্ছ?
জাবিন বলল, হামিদ চাচার কাছে যাচ্ছি। বাবার ঘটনাটা কী জানি।
চল আমিও যাচ্ছি।
জাবিন বলল, তোমাকে যেতে হবে না। বাবা যে কী পরিমাণ বিপদজনক মানুষ এটা তুমি গবেষণা করে বের কর।
হামিদ জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। ত্রিশটা গাঁদা ফুলের মালা এবং দুটা টাকার মালা গলায় পরিয়ে তাকে জেল গেট থেকে খোলা জিপে তোলা হলো। তিনি হাসিমুখে সবার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়তে লাগলেন। জিপ কিছুক্ষণ চলার পরই তিনি ভুলে গেলেন যে তিনি জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন না-কি জেলে যাচ্ছেন। রব্বানি তাঁর পাশেই দাঁড়িয়ে। ইচ্ছা করলেই তাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। তা তিনি করলেন না। নেতার স্মৃতি নষ্ট হয়ে গেছে শুনলে শিষ্যদের মনোবল ভেঙে যেতে পারে। তিনি আদুরে গলায় ডাকলেন, রব্বানি!
রব্বানি বলল, জি ওস্তাদ।
হামিদ বললেন, ওস্তাদ বলবা না রব্বানি! ওস্তাদ বললে নিজেকে ট্রাক ড্রাইভার ট্রাক ড্রাইভার লাগে। এখন থেকে যতবার রব্বানি বলব তারই জি নেতা! বলে সাড়া দিবে।
অবশ্যই।
রব্বানি।
জি নেতা।
হামিদ জনগণের উদ্দেশ্যে চলন্ত জিপ থেকে হাত নাড়তে নাড়তে বললেন, রাজনীতিতে সবসময় নতুন কিছু করতে হয়। যেই নতুন কিছু করবে পাবলিক খাবে। সামনের ডাস্টবিনে কাক কা কা করছে, দেখেছ?
জি নেতা।
কাকদের দেখে মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। সব নেতার কাঙালি ভোজন করান। আমি করাব কাক ভোজন। গরুর মাংসের তেহারি বানিয়ে সব ডাস্টবিনে ডাস্টবিনে দিয়ে আসবে।
কবে করব?
আমার জন্মদিনে করবে। তবে আমার জন্মদিন কেউ জানে না। আমিও জানি। তোমরা বিবেচনা করে একটা তারিখ বের কর। আবার খেয়াল রেখ গুরুত্বপূর্ণ কোনো তারিখের সঙ্গে যেন ক্ল্যাশ না করে। বুঝতে পারছ?
পানির মতো পরিষ্কার। ৭ মার্চ, ১৫ আগস্ট এইসব তারিখ বাদ।
হামিদ ঘরে ফিরে দেখেন জার্কিন মুখ শুকনা করে বসে আছে। তিনি আনন্দে অভিভূত হলেন। হামিদ চিরকুমার মানুষ। জাবিন তার কাছে কন্যার চেয়েও বেশি। জাবিন কদমবুসি করতেই তার চোখে পানি এসে গেল।
জাবিন বলল, আপনার শরীরের এই অবস্থা কেন চাচা? গালটাল ভেঙে কি হয়েছে। চোখের নিচে কালি!
হামিদের মনে হলো তার সাঙ্গোপাঙ্গোদের কেউ কোনোদিন বলে নি তাঁর শরীরের অবস্থা খারাপ। এই মেয়েটা বলছে। হামিদ বললেন, জনগণের সেবা করতে গিয়ে এই অবস্থা মা।
জাবিন বলল, অনেক জনগণের সেবা করেছেন। আর লাগবে না। আমি বাবার সঙ্গে আপনাকেও অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যাব। এখানে আপনার দেখাশোনার কেউ নেই। বাকি জীবন আমি আপনাদের দেখাশোনা করব।
হামিদের চোখে দ্বিতীয়বার পানি এসে গেল।
জাবিন বলল, আপনার জন্যে কিছু উপহার এনেছি, দেখুন পছন্দ হয় কি না। এটা ভেড়ার লোমের গায়ের চাদর। এটা মানিব্যাগ। সাধারণ মানিব্যাগ না। এর ভেতর ট্রেকিং ডিভাইস আছে। ধরুন মানিব্যাগ চুরি গেল, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে খুঁজে বের করা যাবে কোথায় আছে। একটা সোলার এনার্জি টর্চলাইট এনেছি। ব্যাটারি ছাড়া চলবে।
দুপুর তিনটা বাজে। জাবিন ফেরে নি। মাসুদ একাই খেতে বসেছে। রফিক যত্ন করে খাওয়াচ্ছে। রফিকের রান্না ভালো।
দুলাভাই, আচার দিব? আচার দিয়া খাবেন?
মাসুদ বলল, দাও। বিদেশে থেকে আমার দিয়ে ভাত খাওয়া ভুলে গেছি। বিদেশ হচ্ছে সসের দেশ। সস কি কোনোদিন বাঙালি আচারের ধারেকাছে আসতে পারে?
মাসুদ তৃপ্তি করে আচার দিয়ে ভাত খেল। আচারটা অতিরিক্ত ঝাল, কিন্তু খেতে অসাধারণ। মাসুদ বলল, এটা কিসের আচাররে?
রফিক বলল, পিঁপড়ার আচার।
পিঁপড়ার আচার মানে?
রফিক বলল, করিম স্যার বানায়েছেন। এই আচারের নাম পিপিলিকা ক্রন্দন।
মাসুদ বলল, যেগুলিকে আমি রসুনের খোসা মনে করছি সেগুলি পিঁপড়া?
রফিক নির্বিকার ভঙিতে বলল, জি দুলাভাই। নজর কইরা দেখলেই বুঝবেন।
মাসুদ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে। রফিক বলল, বমি করবেন দুলাভাই? চিলুমচি আনি?
হামিদ জাবিনকে নিয়ে খেতে বসেছেন। তিনি বললেন, তোর বাবাকে পুলিশ খুঁজছে এটা কোনো বিষয়ই না। আগামীকালের মধ্যে রীট করে হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন নিয়ে নিব। তাতেও সমস্যা হলে গোপনে আগরতলা পাচার করে দিব। আগরতলায় আমার নিজের কেনা বাড়ি আছে। লোকজন আছে। কোনো অসুবিধা হবে না। বৎসরের পর বৎসর থাকতে পারে। তোর বাবা করেছেটা কী? মার্ডার।
জাবিন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, এইসব কী বলছেন চাচা! বাবা মার্ডার করবে কেন?
হামিদ বললেন, করলেও সমস্যা নাই। আমি আছি না? আমার উপর ভরসা রাখতে বল। আগরতলা পৌঁছামাত্র তার রেশন কার্ড হয়ে যাবে। ভোটার তালিকায় নাম উঠানোর ব্যবস্থা করব। ইন্ডিয়ান নাগরিক হিসাবে বাকি জীবন সেখানে থাকবে। হিন্দু ব্রাহ্মণ! নাম হরি ঠাকুর।
জাবিন বলল, চাচা, আপনার মাথা তো পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে।
হামিদ বললেন, নষ্ট হবার পথেই ছিল। ব্যাটারি চিকিৎসার কারণে এখনো কিছুটা কনট্রোলের মধ্যে আছে। ভালো কথা, তোর বাবা কাকে মার্ডার করেছে? গুরুত্বপূর্ণ কেউ না তো?
জাবিন বাসায় ফিরল সন্ধ্যার দিকে। মাসুদ বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে আছে। তার মুখ থমথমে। চোখের দৃষ্টিতে ভরসা হারা ভাব। জেট লেগের কারণে ঘুমে চোখে জড়িয়ে আসছে, তারপরেও সে জেগে আছে। জাবিনের সঙ্গে কিছু কথা বলা দরকার। বারান্দায় বসে জাবিনের সঙ্গে কথাবার্তা কি হবে তার রিহার্সেল দুবার দিয়েছে। রিহার্সেলে মনে হয় কাজ হবে না। আসল সময়ে এলোমেলো হয়ে যাবে। তাকে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে।
জাবিন বারান্দায় উঠে এসে বলল, হ্যালো।
মাসুদ তার পাশের চেয়ার দেখিয়ে বলল, জাবিন! কথা আছে বসো।
জাবিন বসতে বসতে বলল, দুপুরে ঠিকমতো খেয়েছ?
মাসুদ বলল, আচার দিয়ে একগাদা ভাত খেয়েছি। প্রতিটি আইটেম সুস্বাদু ছিল।
জাবিন বলল, গুড।
কিসের আচার দিয়ে ভাত খেয়েছি জানতে চাও?
জাবিন বলল, জানতে চাচ্ছি না। তুমি আরাম করে খেয়েছ এটা ইম্পর্টেন্ট। আমের আচার দিয়ে খেয়েছ না-কি মরিচের আচার দিয়ে খেয়েছ সেটা ইম্পর্টেন্ট না।
মাসুদ ঠাণ্ডা গলায় বলল, ইম্পর্টেন্ট। আমি পিঁপড়ার আচার দিয়ে খেয়েছি। কালো পিঁপড়ার আচার।
কী বললে?
কি বলেছি তুমি শুনেছ। দ্বিতীয়বার বলতে পারব না। আমি তোমার বাবাকে বিপদজনক মানুষ বলেছিলাম বলে তুমি রাগারাগি করে ঘর থেকে বের হয়ে গেলে। এখন বুঝেছ কেন বিপদজনক বলেছি? যে মানুষের ঘরে তিন বোতল পিঁপড়ার আচার সে কি বিপদজনক না।
জাবিন চুপ করে রইল। মাসুদ বলল, একজন সাধু পুরুষ আসেপাশে সাধু নিয়ে চলাফেরা করে। একজন বিপদজনক মানুষের আশেপাশে থাকে বিপদজনক মানুষ। কাজের ছেলে রফিক হচ্ছে তার উদাহরণ।
সে কী করেছে?
আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে চলে গেছে। কাগজে কী লেখা পড়ে দেখ। মাসুদ পকেট থেকে কাগজ বের করে জাবিনের হাতে দিল। সেখানে লেখা
দুলাভাই,
সালাম নিবেন। আপনার সাথে আমার পুষতেছে না। কাজেই চলিয়া গেলাম। স্যার ফিরত আসিলে আবার আসিব ইনশাল্লাহ।
ইতি
রফিক মিয়া
জাবিন বলল, রফিক চলে গেছে?
মাসুদ বলল, খালি হাতে যায় নি। আমার হ্যান্ডব্যাগ এবং একটা স্যুটকেস নিয়ে চলে গেছে। এই ছেলে আগেও চুরি করেছে। তোমার পিতা সব জেনেশুনে তাকে আবার রেখেছেন। কারণ তিনি বিপদজনক মানুষ। তিনি বিপদ পছন্দ করেন।
জাবিন বলল, বার বার বিপদজনক মানুষ বিপদজনক মানুষ বলার তো দরকার নেই। একবার বলেছ শুনেছি।
মাসুদ বলল, তোমার প্রতি আমার সাজেশন হচ্ছে— তুমি বাংলাদেশে তোমার বাবার সঙ্গে থেকে যাও। মহাবিপদ টেনে অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে যাবার কিছু নেই। তুমি দেশে থেকে বাবার সেবা কর। তোমার ভূত ভাই এবং ভূত বোনের সঙ্গে সময় কাটাও। তোমার জন্যে ভৌতিক পরিবারই দরকার।
জাবিন বলল, কী বলতে চাচ্ছ পরিষ্কার করে বলো। তুমি আমার সঙ্গে বাস করতে চাচ্ছ না?
মাসুদ বলল, আমাদের আলাদা থাকাই বাঞ্চনীয়। তোমার সঙ্গে থাকা মানে তোমার পিতার সান্নিধ্যে থাকা। আমার পক্ষে তা সম্ভব না। কিছু মনে করো না, আমি চলে যাচ্ছি একটা হোটেলে গিয়ে উঠব।
জাবিন বলল, আমি কী করব?
মাসুদ বলল, তুমি তোমার বাবার বাড়ি পাহারা দেবে। ভূত ভাইবোনদের নিয়ে সাপলুড়ু খেলবে।
জাবিন বলল, সামান্য একটা পিঁপড়ার আচার খেয়ে তোমার এই অবস্থা? মাসুদ কঠিন গলায় বলল, পিঁপড়ার আচার হয়তো সামান্য, কিন্তু পিঁপড়ার আচারের উদ্ভাবক সামান্য না। তিনি অসামান্য। আমি অসামানার সঙ্গে নেই। তাছাড়া পুলিশ উনাকে খুঁজছে। উনাকে না পেয়ে আমাকে ধরে নিয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের পুলিশ এই কাজটা করে। মূল আসামিকে না পেলে আত্মীয়স্বজন ধরে নিয়ে রিমান্ডে পাঠিয়ে দেয়। আমি হোটেল সোনারগাঁয়ে রুম বুক করেছি, ছয়শ তেইশ নাম্বার রুম। তুমি যদি তোমার বিপদজনক বাবার কথা ভুলে গিয়ে আগামী পরশু অস্ট্রেলিয়া ফেরত যেতে রাজি থাক, তাহলে হোটেলে চলে আস। চিন্তা করার জন্যে তোমাকে বারো ঘণ্টা সময় দিলাম।
জাবিন বলল, ইউ গো টু হেল।
মাসুদ বারান্দা থেকে নামল। শান্ত ভঙ্গিতে গেট পার হয়ে রাস্তায় নামল। ইয়েলো ক্যাব ডেকে উঠে পড়ল।
জাবিন প্রথম কিছুক্ষণ কাঁদল। চেষ্টা করল বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করার। রিং হয় কেউ ধরে না। খালি বাড়িতে তার ভয় ভয় করতে লাগল। শেষে তার হামিদ চাচাকে টেলিফোন করে বলল, চাচা, আমাকে আপনার বাড়িতে নিয়ে যান।
হামিদ সব কথা শুনে বিরক্ত গলায় বললেন, কান্নাকাটি বন্ধ কর তো মা। জামাইকে টাইট দেবার ব্যবস্থা করছি। এক ট্রিটমেন্টে তোর জামাই সরলরেখা হয়ে যাবে।
তুমি কী করবে?
আমি কী করব সেটা আমার ব্যাপার। তুই আজ সকাল সকাল খেয়ে শুয়ে পড়। কলি তোর অনেক কাজ।
কী কাজ?
হামিদ বললেন, কাল আমি কাকভোজন করাচ্ছি। ঢাকা শহরের যত কাক আছে সবাইকে তেহারি খাওয়ানো হবে। বাবুর্চি হাজি কাল্লু মিয়া রাঁধবেন। তুই থাকবি তদারকিতে।
রাত দশটায় রমনা থানার ওসি সাহেবের সঙ্গে হামিদ টেলিফোনে কথা বললেন। তিনি বললেন, অস্ট্রেলিয়া থেকে আমার ভাইস্তি তার স্বামীকে নিয়ে এসেছে। তাদের মধ্যে কী এক কারণে ঝগড়া হয়েছে। জামাই একা উঠেছে হোটেল সেনারগাঁয়ে। রুম নাম্বার ছয়শ তেইশ। এরপর থেকে আমার ভাইস্তিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি নিশ্চিত আমার ভাইস্তিকে খুন করে ডেডবডি বুড়িগঙ্গায় ফেলা দেয়া হয়েছে।
ওসি সাহেব বললেন, বলেন কী!
আপনি তদন্ত করলেই মূল ঘটনা বের হয়ে যাবে।
রাত এগারোটায় সোনারগাঁ হোটেলের বার থেকে মাসুদকে পুলিশ গ্রেফতার করল। মাসুদ তখন দুটা বিয়ার এবং চার পেগ ব্ল্যাক লেভেল হুইস্কি খেয়ে পুরোপুরি আচ্ছান্ন। ওসি সাহেব বললেন, আপনার স্ত্রীর ডেডবড়ি কোথায়?
মাসুদ বলল, আমার স্ত্রীর ডেডবডি আমার স্ত্রীর কাছে। এটা সবার জন্যেই সত্য। আমরা সবাই আমাদের ডেডবডি সঙ্গে নিয়ে ঘুরি। এটাই মানবজাতির নিয়তি।
ওসি সাহেব বললেন, ডেডবডি কি বুড়িগঙ্গায়?
মাসুদ বলল, বুড়িগঙ্গা বলা ঠিক না। নদী কখনো বুড়ি হয় না। নদী চিরযৌবনা। দয়া করে বলুন তরুণীগঙ্গা। এটা অপিনার প্রতি আমার বিনীত অনুরোধ।