সানাই
আজ গোধূলি লগ্নে আমার একমাত্র ছেলে পাপানের বিয়ে।
সারা বাড়িতে আমি ও আমার পিসি শাশুড়ি আছি।সবাই বরযাত্রী গেছে। মেয়ের বাড়ি বহরমপুর।ছেলে ও মেয়ে দুজনই ডাক্তার ,নিজেরাই দেখেশুনে বিয়ে করছে। বরযাত্রী সকাল বেলায় বর -বৌ নিয়ে বার হবে।
তাই পিসি মাকে খেতে দিয়ে রাত আটটার মধ্যে নিজের ঘরে শুয়ে পড়লাম।নুতন বৌ কাল আসবে। কাল অনেক কাজ।
গায়ে হলুদ পাঠানোর কাজ টা একটা বিশেষ নিয়মে হলো। ঘড়ির সময় বুঝে দুই বাড়িতে গায়ে হলুদ হয়।
তবুও হাজার কাজের ভিড়ে একটু হলুদ মনে করে পাঠিয়ে দিয়েছি।আসলে বালিগঞ্জ থেকে বহরমপুর ছেলের গায়ের হলুদ সময়মতো পাঠানো সম্ভব নয়।
আমার কর্তা বেশ কয়েকবার ভিডিও করে আমায় দেখিয়েছে।
শুতে গিয়ে মনে পড়ে আমার অতীতের কিছু পাতা। আমার বিয়ে , সন্তান সব এক এক করে চোখের উপর দিয়ে যেতে থাকে।
আজ শাশুড়ি মার কথা খুব মনে পড়ছে। আমি সৎমার কাছে অবহেলা , অবজ্ঞা পেয়েছি। কিন্তু আমার শাশুড়ি মা ছিলেন ভগবান।মনে পড়ে বিয়ের এক বছরের মাথায় আমাদের গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট হয়। আমি এমনভাবে আঘাত পাই।ডাক্তার বলেছিলেন বাচ্চা হবে না। কিন্তু শাশুড়ি দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়র অনাথ বাচ্চা আমাকে এনে দেন।বলে আজ থেকে তোর বাচ্চা। কাউকে কোনদিন বলার দরকার নেই। শাশুড়ির দাদা ডাক্তার ছিলেন। উনি এই বাচ্চাটা দেন।তবে সেই পাপান কে পাঁচ দিন থেকে মানুষ করতে করতে হাজার কাজের ভিড়ে সমস্ত অতীত ভুলে গেছিলাম।পাপান যে আমার নাড়িছেঁড়া ধন নয়।থাক এতদিন যখন ভাবি নি আজ শুভ দিনে অতীতে ফিরে যাব না।
তাও অতীতের নানা স্মৃতি উঁকি দিয়ে যায়।যখন জেনেছিলাম বাচ্চা হবে না তখন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বরের সাথে অকারণে তর্ক করতাম। তারপর পাপানকে পাবার পর মানসিক সুস্হিতি আসে। সংসারের কাজ ,পাপানকে মানুষের মতো মানুষ গড়ে তোলা।হয়তো যা চেয়েছিলাম তাই পেয়েছি। আমি ও যদি ভালো শাশুড়ি হই তবে বৌমা নিশ্চয় কোন দিন আমায় আঘাত করবে না। বাইরের মেয়েরা এক এক পরিবেশ থেকে আসে। শাশুড়ির একটু মানিয়ে নিতে হয়।উভয় পক্ষকে এক কিঞ্চিৎ জমি ছাড়তে হয়।তাহলে সংসার সুখের হয়। অবশ্য সব শাশুড়ি মার থেকে শেখা।আজ থেকে আমি ও শাশুড়ি হলাম ।
হাজার কাজের ভিড়ে সব কেমন ভুলে গেছিলাম ভাবতেই পারি নি।
সারা রাত ছটফট করে ভোরে
পিসির ডাকে ঘুম ভাঙে।
সকাল থেকে হালকা শব্দে সানাই এর সুর বাজছে। বরযাত্রী ,বর ও বৌ সব সাড়ে দশটার পর পৌঁছে যায়।
বৌয়ের নানান নিয়ম কানুন করে বর ও বৌকে আলাদা করা হয়।
সারা বাড়িটা হৈচৈ শুধু,গমগম করছে সারা বাড়ি।
বৌমা কে গহনা দিয়ে আশীর্বাদ করি।আর বলি তুই একটু ভালো বাসিস আমাকে, আমার সংসারকে আর দেখিস আমি তোকে অনেক অনেক ভালো বাসব।
ছেলে ও বৌমা কালরাত্রি কাটিয়ে বৌভাতের দিন সকালে মুক্ত ও স্বাধীন। আমি নানান কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।
ভাত কাপড়ের অনুষ্ঠান সুষ্ঠ ভাবে হয়।এরপর পরপর ধাপ এগোতে থাকে।
পাপান দেখি বৌভাতের সন্ধ্যায় বাবা কে বলে মা যেন যেখানে বৌভাতের অনুষ্ঠান হচ্ছে যায় কিন্তু।
বুকটা হু হু করে ওঠে। ছেলে তাহলে পর হয়ে যায় নি।না ইস আমি তো বেশ হিংসুটি।
আমি ছেলের বিয়ের বৌভাতে অবশ্যই যাব।
ছেলে বৌমা নিয়ে সপরিবারে ভালো আছি। শাশুড়ির কথা টা প্রতি মুহূর্তে স্মরণে আসে আমি যদি ভালো হয় তবেই সারা পৃথিবীর লোককে ভালো ভাবব।তবে এটা শেষ কথা। সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে।