চারদিকে কুয়াশামাখা জ্যোৎস্না
চারদিকে কুয়াশামাখা জ্যোৎস্নার ভূতুড়ে আলো, বেশি দূর অবধি চোখ যায় না। মাঝে-মাঝে শেয়ালের দৌড়-পায়ের আওয়াজ, হুতুম প্যাচার গম্ভীর ডাক শোনা যায়। একটা-দুটো বাদুড় চাঁদের চারদিকে চক্কর মেরে উড়ে গেল। উত্তরে হিম বাতাস বইছে খুব। নবীন আর নিমাই কখনও পাশাপাশি, কখনও আগু-পিছু হয়ে হাঁটছে। নিমাইয়ের ডান কাঁধে লাঠিগাছ।
নিমাই হঠাৎ বলল, “কেল্লাটা আর কতদূর বলো তো?”
“আর মিনিট দশেক হাঁটলেই ভাঙা কেল্লা। হরিপুরের অর্ধেক পথ।”
“বাঃ বেশ! এসেই গেলুম প্রায়, কী বলো?”
“তা বটে, তবে আমরা তো আর কেল্লায় যাচ্ছি না, যাচ্ছি হরিপুর। তার এখনও ঢের দেরি। বললাম না, অর্ধেক পথ।”
“ওই হল। কেল্লা এসে গেলেই মার দিয়া কেল্লা। বাকি পথটুকু উড়ে বেরিয়ে যাবে, কী বলে? কথায় বলে না কেল্লা ফতে!’তা ওই কেল্লাটায় কী আছে বলো তো?”
নবীন হেসে বলল, “কী আর থাকবে! ইঁদুর, বাদুড়, চামচিকে, সাপখোপ আছে বলেই তো শুনি! ভূতপ্রেতও নাকি আছে।”
“ভিতরে গেছ কখনও?”
“না। গাঁয়ের গুরুজনরা কেল্লায় যেতে বারণ করত।”
“কেন বলো তো!”
“নানা লোকে নানা কথা বলে। কেল্লা নাকি ভাল জায়গা নয়।”
“দুর, দুর! কেল্লা তোফা জায়গা। আমার তো খুব ইচ্ছে, আর একটু বয়স হলে কেল্লার একধারে একটু সারিয়ে-টারিয়ে নিয়ে থাকব। চারদিকটা ভারী নিরিবিলি।”
“অনেকে কেল্লায় গুপ্তধন খুঁজতেও যায়।” বলে নবীন হাসল।
নিমাই গম্ভীর হয়ে বলল, “হাসির কথা নয়। পাঁচশো কি সাড়ে পাঁচশো বছরের পুরনো কেল্লা। গর্ভগৃহে সোনাদানা থাকা কিছু বিচিত্র নয়। আগের দিনে সোনাদানা সব পুঁতে রাখারই রেওয়াজ ছিল কিনা। আমিও ভাবছি কেল্লায় ডেরা বাঁধার পর রোজ গুপ্তধন খুঁজব। সোনাদানা না পাই, সময়টা তো বেশ কেটে যাবে! কী বলো!”
“আর পেলে?”
“ওঃ, তা হলে তো কথাই নেই। অনেকদিনের ইচ্ছে, একটা মন্দির বানাব, মন্দিরের চুড়োটা হবে সোনায় মোড়া।”
“কোন ঠাকুরের মন্দির?”
“সেইটেই এখনও ঠিক করে উঠতে পারিনি। আসলে আমাদের তো মেলা ঠাকুর!”
নিমাই হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে বলল, “আচ্ছা, একটা মন্তর পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে না! এই রাতে উদোম মাঠের মধ্যে মন্তর পড়ছে কে বলো তো!”
নবীন অবাক হয়ে বলল, “কই, আমি তো শুনতে পাচ্ছি না!”
নিমাই চারদিকটা দেখে নিয়ে বলল, “কী কাণ্ড রে বাবা! তুমি শুনতে পাচ্ছ না, কিন্তু আমি যে বেশ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি, গুনগুন করে কে যেন মন্তর আওড়াচ্ছে! গম্ভীর গলা, দূর থেকে আসছে মনে হয়।”
নবীন কান খাড়া করে খানিকক্ষণ শুনল। ঝিঁঝির ডাক আর বাতাসের শব্দ ছাড়া কিছুই কানে এল না তার। বলল, “ও আপনার মনের ভুল।”
“মনের ভুল! বলো কী? এই তো স্পষ্ট শুনছি। আস্তে শোনা যাচ্ছে। বটে, কিন্তু গমগমে গলা।”
“তা হলে আমি শুনতে পাচ্ছি না কেন নিমাইদা? আমার কান তো খুব সজাগ। বাগানে একটা শুকনো পাতা খসে পড়লেও শুনতে পাই।”
একথা শুনে নিমাই হঠাৎ গুম হয়ে গেল। আর দ্বিরুক্তি না করে গম্ভীর মুখে ফের হাঁটতে লাগল। এবার আর দুলকি চালে নয়, বেশ হনহন করে। তার সঙ্গে তাল রাখতে রীতিমতো বেগ পেতে হচ্ছিল নবীনের।
কিছুক্ষণ হাঁটার পর ফের নিমাই জিজ্ঞেস করে, “কেল্লাটা আর কতদূর?”
নবীন বলল, “এসে গেছি প্রায়। ওই বটগাছটা পেরোলেই কেল্লা দেখা যাবে।”
“মন্তরের জোরটা বাড়ছে, বুঝলে? কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে।”
“কীসের মন্তর তা বুঝতে পারছেন?”
“তা জানি না। দাঁড়াও, ভাল করে শুনে বলছি। সংস্কৃত তো আর জানা নেই, উচ্চারণ ভুল হতে পারে। এই তো! হ্যাঁ বলছে, মা ম্রিয়স্ব, মা জহি, শকশকশ্যতে চেৎ মৃত্যুমঅবলোপয়। এর মানে জানো?”
“না।”
ফের কিছুক্ষণ শুনে নিমাই বলল, “আরও বলছে যেনাত্মনস্তথান্বেষাং জীবনং বৰ্দ্ধনং চ অপি প্রিয়তে সঃ ধর্মঃ। দদদদ দদাতু জীবনবৃদ্ধি নিয়-নিয়তং স্মৃতিচিদযুতে। বুঝতে পারলে কিছু?”
“না তো! কিন্তু আমি কিছু শুনতে পাচ্ছি না কেন?”
নিমাই দাঁড়িয়ে উদভ্রান্তের মতো চারদিকে চাইতে লাগল, তারপর ভয়-খাওয়া গলায় বলল, “ভূতুড়ে গলাটা কোথা থেকে আসছে বলো তো?”
“জানি না তো নিমাইদা।” ঠিক এই সময়ে কেল্লার দিক থেকে একটা জোরালো টর্চবাতির আলো জ্বলে উঠেই নিভে গেল।
নবীন চমকে উঠল, বলল, “নিমাইদা, কেল্লায় টর্চ জ্বালল কে?”
নিমাই উদভ্রান্তের মতো চারদিকে চেয়ে হঠাৎ কাঁধ থেকে লাঠিটা নামিয়ে সেটার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর চাপা গলায় বলল, “এ লাঠি কোথায় পেয়েছ?”
“একজন দিয়েছে। কেন বলুন তো!”
নিমাই সভয়ে বলে উঠল, “এই লাঠির ভিতর থেকেই মন্তরের শব্দ আসছে। কানের কাছে নিয়ে দ্যাখো, শুনতে পাবে।”
নবীন লাঠিটা নিয়ে ডান কানে ছোঁয়াতেই শুনতে পেল, গম্ভীর সুরেলা একটা গলা মন্ত্র পাঠ করছে, “মা শ্রিয়স্ব মা জহি, শক্যতে চেৎ মৃত্যুমঅবলোপয়। যেনাত্মস্তথান্বেষাং জীবনং বৰ্দ্ধনং চ অপি প্ৰিয়তে সঃ ধর্মঃ। দদাতু জীবনবৃদ্ধি নিয়তং স্মৃতিচিদযুতে।”
নিমাই ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বলল, “ওটা ভুতুড়ে লাঠি। যদি বাঁচতে চাও তো ফেলে দাও।”
নবীন কিন্তু আদপেই ঘাবড়াল না। বরং লাঠিটা বেশ শক্ত করে ধরে কাঁধে ফেলে বলল, “এটা আমার কাছেই থাক।”
নিমাই কেমন উদভ্রান্তের মতো বলল, “না না, ওটা ফেলে দেওয়াই ভাল, কাছে রাখা ঠিক হবে না। এসব জিনিস ভাল নয়।”
নবীনের হঠাৎ যেন জেদ চেপে গেল। সে গম্ভীর হয়ে মাথা নেড়ে বলল, “এটা আমার লাঠি, আমার কাছেই থাকবে।”
ঠিক এই সময়ে কেল্লার দিক থেকে চার-পাঁচটা টর্চের আলো এসে সামনের পথে পড়ল।
নবীন থেমে সভয়ে সেই দিকে চেয়ে নিজের ট্যাঁকে হাত রাখল। ত্রিশ হাজার টাকা গ্রামদেশে বড় কম টাকা নয়। টর্চের আলোগুলো তার ভাল ঠেকছে না। এই নির্জন মাঠের মধ্যে হঠাৎ টর্চের আলো মানেই বিপদ সংকেত।
“নিমাইদা, দেখতে পাচ্ছেন?”
নিমাই গম্ভীর গলায় শুধু বলল, “হুঁ।”
টর্চের আলো তাদের দিকেই বেশ ধেয়ে এল। আলোর পিছনে ছায়ামূর্তির মতো দশ বারোজন লোক। আবছায়াতেও তাদের হাতে লাঠিসোঁটা দেখতে পেল নবীন। হঠাৎ গলাটা শুকিয়ে গেল তার, হাতে-পায়ে খিল ধরার অবস্থা।
“ওরা কারা নিমাইদা?”
“বুঝতে পারছি না। মতলব খারাপও হতে পারে। ওরা দশ বারোজন আছে, হাতে অস্ত্র।”
“তা হলে?”
“আমরা তো ওদের সঙ্গে পেরে উঠব না নবীন। চাইলে যা আছে দিয়ে দিয়ো। আর হাতে লাঠি দেখলে কিন্তু ওরা বিগড়ে যাবে, হাতের অস্তর চালিয়ে দেবে। তুমি বরং লাঠি ফেলে হাতজোড় করে দাঁড়াও।”
নবীনের কেমন যেন সেরকম করতে ইচ্ছে হল না। সে বরং লাঠিটা আরও জোরে চেপে ধরে বলল, “আগে তো দেখি ওরা কারা!”
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে দৌড়পায়ে এসে লোকগুলো তাদের ঘিরে ফেলল। ওদের টর্চের আলোতেই নবীন দেখতে পেল, শুধু লাঠিই নয়, ওদের হাতে বড় বড় ছোরা, দা, বল্লম আর বন্দুকও আছে। এরা কারা তা বুঝতে আর কোনও কষ্ট নেই।
একটা লম্বা লোক দল থেকে দু’পা এগিয়ে এসে গম্ভীর হিংস্র গলায় বলল, “হাতে লাঠি কেন রে তোর? মারবি নাকি রে? অ্যাঁ! মারবি?”
নবীন বলল, “আজ্ঞে না।”
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ও কথাটা সে বললেও মুখ দিয়ে কিন্তু বেরোল সম্পূর্ণ অন্য কথা, “দরকার হলে মারব।”
লোকটা অবাক হয়ে দু’সেকেন্ড তার দিকে বড় বড় চোখে চেয়ে থেকে হঠাৎ হাঃহাঃ করে হেসে বলল, “বাপ রে! সত্যিই মারবি? আমার যে বড্ড ভয় করছে রে!”
নবীন কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “আমাকে ছেড়ে দিন। টাকাপয়সা দিয়ে দিচ্ছি, জানে মারবেন না।” কিন্তু এবারেও আশ্চর্যের বিষয় তার মুখ দিয়ে ও কথা না বেরিয়ে বেশ গম্ভীর আওয়াজে বেরোল, “ভয় পাওয়াই তোমার পক্ষে ভাল।”
“বটে!” বলে গ্যানা গম্ভীর হল।
তারপর বলল, “শোন, আজ রাতেই আমার আরও তিনটে ডাকাতি আছে। নইলে তোর সঙ্গে আরও একটু রগড় করতাম। মারধর, রক্তারক্তি করতে চাইনা, ট্যাঁকে যা আছে দিয়ে যা।”
নবীন ট্যাঁকের দিকে হাত বাড়াল বটে, কিন্তু হাতটা ওদিকে মোটে যেতেই চাইল না। লাঠিটা ডান হাতে ধরা ছিল,এবার বাঁ হাতটাও এসে চেপে ধরল সেটা। তারপর হাতেরা দু’ভাই লাঠিটা আস্তে আস্তে উঁচু করে তুলে ধরতে লাগল।
ঠিক এই সময়ে কোথা থেকে দুটো উটকো লোক দুটো শাবল উঁচিয়ে তেড়ে আসতে আসতে চেঁচাচ্ছিল, “কোথাও ভয় নেই রে নবীন, এই আমরাও তোর সঙ্গেই মরব। এসে গেছি রে?”
এই চিৎকারে ডাকাতেরা ভারী অবাক হল, খানিকটা হকচকিয়েও গেল। গ্যানা বজ্রকণ্ঠে বলল, “চালা অস্তর! নিকেশ কর সব ক’টাকে!”
চোখের পলকে চারদিক থেকে লাঠির বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। আবছায়া আলোয় কিছুই ভাল দেখা যাচ্ছিল না। নবীন শুধু বুঝতে পারল তার দু’হাতে ধরা লাঠিখানা বিদ্যুৎগতিতে চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর খটাখট শব্দ তুলছে। মাঝে মাঝে বাপ রে’, ‘উঃ’, ‘ওরে বাবা’ এরকম সব আর্তনাদ শোনা যাচ্ছিল। তার মধ্যেই কে যেন হেঁকে বলল, “মাহেন্দ্রক্ষণ কি শুরু হয়েছে রে জগাই?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, অনেকক্ষণ।”
“মরার আগেই যেন পেরিয়ে না যায়, দেখিস!”
“না না, সে আমার খুব খেয়াল আছে।”
ফের ধুন্ধুমার সব শব্দ হতে লাগল। কী হচ্ছে নবীন ঠিক বুঝতে পারছিল না। শুধু এটা বুঝতে পারছে যে, এরকম হওয়ার কথা ছিল না। এ যা হচ্ছে তা একেবারে হিন্দি ছবির ঝাড়পিট।
তবে এ-ও বোঝা যাচ্ছিল প্রতিপক্ষ একটু একটু করে পিছু হটছে। আবছায়ায় একটা লোককে দেখা গেল, ল্যাংচাতে-ল্যাংচাতে পালাচ্ছে, একজন মাথা চেপে ধরে ‘বাপ রে, চোখে যে অন্ধকার দেখছি’ বলে দিকশূন্য দৌড়ে হাওয়া হল। একজন পেট চেপে ধরে বসে পড়ে তারপর হামাগুড়ি দিয়ে গায়েব হল, একজন ‘আর পারি না বাপ’ বলে খোঁড়াতে-খোঁড়াতে অকুস্থল ত্যাগ করল। শেষ পাঁচ-সাতজন কিছুক্ষণ লড়াই দিয়ে আচমকা সব ক’টা একসঙ্গে কেল্লার দিকে ছুটতে লাগল। তারপর সব ভোঁ ভাঁ। শুধু বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে আছে জগাই মাধাই।
বিস্মিত নবীন হাঁ হয়ে কিছুক্ষণ পরিস্থিতিটা বোঝবার চেষ্টা করল। যা ঘটে গেল তা কি সত্যি? স্বপ্ন দেখছে না তো? অনেকক্ষণ লাঠি চালিয়ে একটু হাঁফিয়ে গেছে সে। বড় বড় কয়েকটা শ্বাস নিয়ে সে জগাই আর মাধাইয়ের দিকে চেয়ে করুণ গলায় বলল, “কী হল বলো
তো জগাইদা, মাধাইদা? কিছু বুঝলে?”
জগাই-মাধাই সবেগে ডাইনে বাঁয়ে মাথা নেড়ে এক বাক্যে বলল, “কিছুই বুঝতে পারলুম না।”
মাধাই হ্যাদানো গলায় বলল, “মাহেন্দ্রক্ষণটা কি পেরিয়ে গেল নাকি রে জগাই?”
“তা গেল বোধ হয়।”
“ইস, আমাদের তো দেখছি মরাই হল না! ভাল যোগটা ছিল রে!”
“আহা, মাহেন্দ্রক্ষণে বেঁচে থাকাটাও কি খারাপ মাধাইদা?”
“বেঁচে থেকে হবেটা কী বল! আমাদের কি কোথাও ঠাঁই আছে? পানুবাবুর অত্যাচারে বাপ-পিতেমোর ভিটে ছাড়তে হচ্ছে, কোথায় যাব, কী খাব তারই ঠিক নেই। বরং মরলে ফের আঁটঘাট বেঁধে জন্মানো যেত।”
“না গো মাধাইদা। আগে তাই মনে হচ্ছিল বটে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমরাও কম যাই কীসে? গা বেশ গরম হয়েছে আমার। তিনটে বদমাশকে যা ঢিট করেছি তা আর কহতব্য নয়। মার খেয়ে এমনভাবে তাকাচ্ছিল যেন ভূত দেখছে!”
মাধাই বলল, “তা গা আমারও গরম হয়েছে বটে। আমি তো শাবল দিয়ে একটার হাঁটু ভেঙেছি, একজনের কনুই, তিন নম্বরটার ঘাড়টাই গেছে বোধ হয়।”
“তবেই বোঝে। আমাদের ভিতরে যে এত খ্যামতা ছিল, তা কি আমরাই এতদিন বুঝতে পেরেছি?”
“তা বটে। তবে এত মেহনতের পর খিদেটা যখন চাগাড় দেবে তখনই যে মুশকিল।”
নবীন একটু ধাতস্থ হয়েছে। পায়ের কাছে একটা টর্চ পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সেটা কুড়িয়ে নিয়ে আলো জ্বেলে হাতের লাঠিটা খুব মন দিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল। এতক্ষণ এই লাঠির ভিতর থেকে যে মন্ত্রোচ্চারণ হচ্ছিল সেটা এখন আর নেই। সাধুর দেওয়া লাঠি, কী জাদু আছে এর ভিতরে কে জানে! তবে এ যে যেমন-তেমন লাঠি নয় তা সে খুব বুঝতে পারছে। লাঠিটা দু’হাতে আড় করে ধরে ভক্তিভরে কপালে ঠেকাল সে।
তারপর জগাই আর মাধাইয়ের দিকে ফিরে বলল, “তোমাদের কী হয়েছে জগাইদা?”
“না, এই মাধাইকে বলছিলাম আর কী, গা-টা বেশ গরম হয়েছে।”
“তোমরা এই বিপদের মধ্যে হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হলে বলো তো!”
মাধাই বলল, “সে অনেক কথা রে ভাই। তবে তোমার যে এলেম দেখলাম তাতে আমাদের আর হাত লাগানোর দরকার ছিল না।”
নবীন বলল, “ধুস, কিছুই দ্যাখোনি। আমি কখনও লাঠিটাটি খেলিনি, মারপিটও করিনি। ও আমার কোনও কেরদানি নয় গো। অন্য ব্যাপার আছে।”
“কী ব্যাপার বলো তো!”
“তা আমিও ঠিক বুঝতে পারছি না। কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল!”
মাধাই বলল, “এখন আর এখানে দাঁড়িয়ে থেকো না। গুন্ডা বদমাশদের বদ মতলব ফের চাড়া দিতে পারে। এইবেলা রওনা হয়ে পড়ো। হরিপুর এখনও অনেকটা পথ।”
“তোমরা না খিদের কথা বলছিলে?”
জগাই লাজুক গলায় বলল, “ও কিছু নয়। আমাদের যখন-তখন খিদে পায়, সয়েও যায়। ওসব হচ্ছে দেখন-খিদে। একপেট জল খেলেই খিদে উধাও হবে।”
মাধাইও সায় দিয়ে বলল, “ও ঠিক খিদেও নয়। একটু ফাঁকাকা ভাব হয় আর কী! তুমি বরং এগিয়ে পড়ো, আমরাও গঞ্জের দিকে ফিরি।”
নবীন মাথা নেড়ে বলে, “সেটি হচ্ছে না। এই বিপদের মধ্যে আমাকে ফেলে যদি চলে যাও তোমাদের কিন্তু অধর্ম হবে।”
জগাই আর মাধাই পরস্পরের দিকে একটু মুখ তাকাতাকি করে নিল। তারপর জগাই একটু হেসে বলল, “তা অবিশ্যি ঠিক। ভুরফুনের মাঠে শুধু চোর-ডাকাতই তো নয়, তেনারাও আছেন। কী বলো মাধাইদা?”
“আর বলিসনি। দুটো যা স্যাম্পেল দেখলাম, তাতেই পিত্তি চটকে গেছে। না হে নবীনভায়া, তোমাকে একা ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। চলো, বরং তোমাকে হরিপুর অবধি এগিয়েই দিয়ে আসি। ফিরতে একটু রাত হবে। তবে আমাদের আর কিবা দিন, কিবা রাত্রি, কী বলিস রে জগাই?”
“তা যা বলেছ।”
তিনজনে রওনা হয়ে পড়ল। নবীনের হাতে লাঠি, দু’জনের হাতে শাবল। হাঁটতে হাঁটতে নবীন হঠাৎ বলল, “আচ্ছা গরম রাঙা চালের ভাতের উপর যদি সোনামুগের ডাল ঢালা হয় তা হলে কেমন শোভা হয় বলো তো?”
জগাই সুড়ুত করে জিভের জল টেনে নিয়ে বলল, “ওঃ, সে একেবারে মারদাঙ্গা ব্যাপার।”
নবীন একটু হেসে বলল, “সঙ্গে দু-চারটে ঝাল কঁচালঙ্কা, না?”
মাধাই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “ওতেই ভাত সাবাড়।”
নবীন ফের বলল, “আরে তা কেন? সঙ্গে একটু পোস্ত চচ্চড়িও তো খারাপ নয়! কী বলো!”
জগাই হঠাৎ আর্তনাদ করে উঠল, “বাপ রে!”
“কী হল জগাইদা?”
“পোস্তর কথা কি আমাদের শুনতে আছে? ওসব বড়লোকের ব্যাপার, আমাদের শুনলেও পাপ।”
মাধাই বলল, “তা যা বলেছিস।”
নবীন ফের মৃদু হেসে বলল, “আহা, শুনতে দোষ কী? ধরো, ওই সঙ্গে যদি ফুলকপি দিয়ে তেলালো কই মাছের একখানা জম্পেশ ঝোল হয়, তা হলে?”
মাধাই মাথা নেড়ে বলে, “তা হলে বাঁচব না। ওসব হয় না রে নবীনভায়া। ও হচ্ছে রূপকথার গল্প।”
জগাইও মাথা নেড়ে বলে, “কই মাছ নাকি বর্ষাকালে খানিকটা গাছেও ওঠে। তা আমাদের ভাগ্যের কই মাছ গাছ ছেড়ে পাহাড়ের চুড়োয় গিয়ে উঠে বসে আছে।”
নবীন মিটিমিটি হেসে বলল, “কই মাছের পর কারও কারও নাকি আবার রুই মাছের কালিয়া চাখতে ইচ্ছে যায়।”
মাধাই বলল, “যায় নাকি? তা দুনিয়ায় কত পাগল আছে।”
জগাই বলল, “কালিয়া পর্যন্ত পৌঁছোনো বেশ শক্ত।”
নবীন বলল, “অবশ্য ওসব একটু বেশি রাতে। তার আগে কয়েকখানা গরম বেগুনি আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে ছোট ধামার একধামা করে লাল টাটকা মুড়ি খেতে কেমন লাগে বলো তো! মুড়ি খেলে খিদে মজে না, বরং একটু বাদে দ্বিগুণ চাগিয়ে ওঠে। তাই না?”
মাধাই বলল, “বুঝলি রে জগাই, নবীন কিন্তু জানে অনেক।”
জগাই সায় দিয়ে বলল, “তা জানবে না! কত লেখাপড়া শিখেছে! বারোঘরের নামতা জিজ্ঞেস করে দ্যাখো, মুখস্থ।”
.
ওদিকে কেল্লার একটা ঝুরঝুরে ঘরের ভিতরে দু’খানা মোমবাতি জ্বলছে। তার মৃদু আলোয় দেখা যাচ্ছে, যেন ঘরের মধ্যে একটা শোকসভা। কারও মুখে কথা নেই বটে, তবে ‘উঃ’, ‘আ’, ‘গেলুম রে’ ইত্যাদি চাপা কাতরধ্বনি শোনা যাচ্ছে। জনাচারেক মেঝেতে সটান শুয়ে কাতরাচ্ছে। যারা বসে বা দাঁড়িয়ে আছে তাদের অবস্থাও সুবিধের নয়। কারও কপালে কালশিটে, কারও কনুই ভাঙা, কারও পায়ে জখম, কারও মাথায় রক্ত জমে ঢিবি হয়ে আছে। দু’থাক ইটের একটা পাঁজার উপর গম্ভীর মুখে নিজের বাঁ হাতের কবজি ডান হাত দিয়ে চেপে ধরে বসে আছে গ্যানা। অনেকক্ষণ কারও মুখে কথাটথা নেই।
এতক্ষণ দীর্ঘশ্বাসের পর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে যাচ্ছিল গ্যানা। এইবার কথা কইল। বলল, “ওরে, তোরা খোঁজ নে তো, কাশী না গয়া কোন জায়গাটা ভাল হবে।”
গ্যানার ডান হাত কালু এতক্ষণ বসে বসে কোঁকাচ্ছিল। এবার চোখ তুলে বলল, “কেন ওস্তাদ?”
“আর কি এ সমাজে মুখ দেখানোর জো রইল রে আমার? নাঃ, সব ছেড়েছুঁড়ে কাশীবাসী না হয়ে আমার আর উপায় নেই। একটা পুঁচকে ছোঁড়ার হাতে এতগুলো ঘায়েল হলুম! ছিঃ ছিঃ, কী লজ্জার কথা! গত দশ বছরে আমাকে কেউ হাতে-হাতে লড়াইয়ে জখম করতে পারেনি। সেই গ্যানা ওস্তাদের কবজি ভেঙে দিয়ে গেছে সেদিনকার দুধের ছোঁকরা! গলায় দড়ি দিলে নাকি মরার পর গতি হয় না, নইলে তাই দিতুম। ওরে কালু, কালকেই কাশী বা গয়া যে জায়গা ভাল হয় তার একখানা টিকিট কেটে আনবি। আর এ-সংসারে নয় রে। আর আমার মুখ দেখানোর উপায় রইল না। বুক ফুলিয়ে গায়ে-গঞ্জে ঘুরে বেড়াতাম, হাজারটা লোক সেলাম ঠুকত। এখন দুয়ো দেবে। ছেলেরা ছড়া কাটবে। আমার গলায় জুতোর মালা পরাবে এবার। সেই অপমান আমার সহ্য হবে না।”
কালু ভাঙা গলায় বলল, “আপনি কাশীবাসী হলে যে দল ভেঙে যাবে সর্দার। আমরা যে না খেতে পেয়ে মরব।”
“সেটাই তোদের প্রায়শ্চিত্ত। আজ যা বীরত্ব দেখালি তাতে তোদের অনশনে মরাই উচিত।”
কালু হঠাৎ তেড়ে উঠে বলল, “সর্দার, সব দোষ ওই নিমাইয়ের, ওই তো আমাদের বলেছিল যে, এবারের শিকার একদম জলভাত। হুড়ো দিলেই নাকি টাকার বান্ডিল বের করে দিয়ে হাতে-পায়ে ধরে প্রাণটা ভিক্ষে চাইবে।”
নিমাই এতক্ষণ একধারে দেওয়াল ঘেঁষে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বসে ছিল। তারও মাজায় চোট হয়েছে। সনাতন ওস্তাদের চেলা হয়ে কিনা সে মার খেয়েছে জগাই-মাধাইয়ের মতো আনাড়ির কাছে! ব্যাপারটা তার কাছে পরিষ্কার হচ্ছে না। বড্ড ভাবিয়ে তুলেছে।
গ্যানা রক্ত চক্ষুতে নিমাইয়ের দিকে চেয়ে ঠান্ডা গলায় বলল, “কালু, রামদাখানা কার কাছে রে? ওটা নিয়ে আয়। এটাকে আজ দু’ আধখানা করে কাটলে তবু খানিক জ্বালা জুড়োবে। কেটে কেল্লার পিছনের পুরনো ইদারায় ফেলে দে।”
কথাটা শুনে নিমাই হঠাৎ সোজা হয়ে বসে বলল, “গ্যানা, তুমি একটা আহাম্মক।”
গ্যানা তাজ্জব হয়ে অপলক চোখে নিমাইয়ের দিকে চেয়ে বলল, “কী বললি? আহাম্মক না কী যেন! হ্যাঁ রে কালু, ঠিক শুনেছি তো, নাকি কানটা গড়বড় করছে?”
কালু দাঁত কড়মড় করে রামদাখানা পাশ থেকে টেনে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, “ঠিকই শুনেছেন। গলা কাটবার আগে ওর জিভটা কেটে ফেলব, তারপর দশ মিনিট বাদে গলা।”
নিমাই বুঝল, সামনে ঘোর বিপদ! সে বলল, “দাঁড়াও, আগে কথাটা শুনে নাও। তারপর গলা কেন, যা খুশি কেটো।”
গ্যানা হুংকার দিয়ে বলে, “কী কথা রে তোর মর্কট? তুই নাকি মস্ত লাঠিবাজ, সনাতন ওস্তাদের চেলা! তা নিজে লেঠেল হয়ে আর একজন লেঠেলকে চিনতে পারলি না! বলে দিলি জলভাত? তা সেই জলভাত দুধের ছোঁকরা যে আমাদের মতো ষণ্ডাদের পিটিয়ে ঢিট করে দিল তা দেখে তোর লজ্জা হচ্ছে না? মরতে ইচ্ছে যাচ্ছে না? মুখে চুনকালি মেখে বেড়ানো উচিত বলে মনে হচ্ছে না?”
নিমাই ঠান্ডা গলায় বলল, “না হচ্ছে না। তার কারণ, নবীন কস্মিনকালেও লেঠেল নয়। ও লাঠি ভাল করে ধরতেও জানে না।”
“বাঃ বাঃ! তা হলে আনাড়ির কাছে মার খেয়ে এলি বল! তা হলে
তো তোর আরও লজ্জা হওয়া উচিত। বাদুড়ের মতো হেঁটমুন্ডু হয়ে ঝুলে থাক। ওরে কালু, কড়িবরগা থেকে একটা দড়ি ঝুলিয়ে এটাকে হেঁটমুন্ডু করে রেখে দে তো!”
নিমাই একটু ঠোঁট চেটে নিয়ে বলল, “সর্দার, ভাল করে শোনো। মাথা ঠান্ডা রাখো। আমরা মোটেই নবীনের হাতে মার খাইনি। আমার কথায় যদি বিশ্বাস না হয়, কাল সকালে হরিপুরে তোক পাঠিয়ে খবর নিলেই জানতে পারবে, নবীন জীবনে লাঠিখেলা শেখেনি।”
“তা হলে লাঠিটা খেলল কে? ভূতে?”
“সেই কথাটাই বলতে চাইছি। কাণ্ডটা ভূতুড়েই বটে। লাঠিটা গঞ্জ থেকেই আমার হাতে ছিল। কাঁধে ফেলে নিয়ে আসছিলাম। মাঝ রাস্তায় হঠাৎ শুনি, লাঠিটার ভিতর থেকে মন্ত্র পড়ার শব্দ আসছে। প্রথমটায় বুঝতে পারিনি। একটু বাদেই টের পেলাম। প্রথমটায় ভয় খেয়ে আমি লাঠিটা নবীনের হাতে দিয়ে দিই।”
গ্যানা একটু ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলে, “বিপদে পড়ে এখন মন্ত্রতন্ত্রের গল্প ফেঁদেছিস রে ছুঁচো! তোর একটা কথাও আমি বিশ্বাস করি না। এই, তোরা ওকে পিছমোড়া করে বাঁধ তো! বেশ কটকটে করে বাঁধবি কিন্তু।”
সর্দারের হুকুম তামিল করার ইচ্ছে থাকলেও জখম গুন্ডাদের তেমন উৎসাহ দেখা গেল না। সবাই যে-যার ব্যথা-বেদনায় কাতরাচ্ছে, ঘ্যাঙাচ্ছে, কোঁকাচ্ছে। বাঁধবার ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। এমনকী কালু রামদাখানা তুলতে গিয়ে মাজায় খটাং করে শব্দ হওয়ায় ফের উঃ’ বলে বসে পড়েছে। নইলে নিমাইয়ের বিপদ ছিল।
নিমাই বলল, “শোনো সর্দার, আমি তো আর পালাচ্ছি না। আমার বিচার করার সময় পরে অনেক পাবে। তার আগে কাজের কথাটা হয়ে যাক।”
গ্যানা ধমকে ওঠে, “চোপ! তোর মতো বিশ্বাসঘাতকের সঙ্গে আবার কাজের কথা কী রে উল্লুক? তুই বেইমান, নেমকহারাম, বজ্জাত, মিথ্যেবাদী!”
“যা বলতে চাইছি তা যদি খেয়াল করে শোনো, তা হলে আখেরে তোমার মস্ত লাভ হবে। আমার উপর বীরত্ব ফলিয়ে কী হবে? কথাটা শুনে তারপর যা হয় কোরো।”
“কী কথা?”
“লাঠি।”
“লাঠি! ফের লাঠি? তোর লজ্জা হচ্ছে না লাঠির নাম উচ্চারণ করতে? লেঠেলদের বংশে তুই তো কুলাঙ্গার।”
“না সর্দার, আমি ভাল লেঠেল। আর পাকা লেঠেল আমি খুব চিনি। ধরতাই দেখেই বুঝতে পারি। নবীন লেঠেল নয়, কিন্তু তার ওই লাঠির মধ্যে মস্ত কোনও লেঠেলের আত্মা লুকিয়ে আছে। আজ যা দেখলে এ তারই কাণ্ড। ওই লাঠি যদি তোমার হাতে আসে তা হলে গোটা পরগনায় তোমার সঙ্গে কেউ পাল্লা টানতে পারবে না। তোমার সাহস আছে, রোখও আছে, কিন্তু বুদ্ধি নেই, দেখার চোখও নেই। সত্যি কথাটা বললাম। এবার তোমার যা বিচার হয় তাই করো।”
গ্যানা একটু ধন্দে পড়ে গেল। তারও যেন কেন এখন মনে হচ্ছে, কাণ্ডটা স্বাভাবিক নয়। নবীন যদি লেঠেলও হয়ে থাকে, তবু তার দলের এত পাকা লোককে একা পিটিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়াটা অশৈলী কাণ্ড। একটু ভেবে সে বলল, “খোঁজ আমি নিচ্ছি। তা বলে তুই কিন্তু রেহাই পাবি না। যদি আবোলতাবোল বলে ধোঁকা দিয়ে থাকিস, তা হলে যা-যা বলেছি তাই-তাই করব।”
“ঠিক আছে সর্দার। তবে এও বলে রাখছি, ও লাঠির দাম কিন্তু লাখ লাখ টাকা। আজকে যা ঘটল তা চাউর হতে বেশি সময় লাগবে না। বহু পাজি লোকের কানে কালকেই কথাটা চলে যাবে। তখন দেখো, ভাগাড়ে শকুন পড়ার মতো লোক এসে হামলে পড়বে লাঠিটা বাগানোর জন্য। দেরি করলে কিন্তু তুমি পস্তাবে।”
গ্যানা আর-একটু ভেবে বলল, “ঠিক আছে। আজ রাতেই লাঠিটা তুলে আনছি। ওরে কালু, কাউকে হরিপুরে এখনই পাঠিয়ে দে তো বাপু, লাঠিটা নিয়ে আসুক।”
হুকুম শুনে সবাই সিটিয়ে গেল। হরিপুর অনেকটা রাস্তা। কারওই শরীরের তেমন ক্ষমতা নেই যে, এখনই লাঠি চুরি করতে হরিপুর যাবে।
কালু বিমর্ষ মুখে বলে, “আমিই যেতাম সর্দার, কিন্তু মাজায় যা ব্যথা দু’কদম হাঁটার সাধ্যি নেই।”
অন্য কারওই হরিপুর যাওয়ার কোনও উৎসাহ দেখা গেল না। গ্যানার বিস্তর তর্জন-গর্জন এবং শেষে কাকুতি-মিনতি বা বকশিশের লোভেও না।
তখন নিমাই বলল, “আর কেউ যেতে না চাইলে আমি যেতে রাজি আছি।”
গ্যানা বলল, “তোকে বিশ্বাস কী? তুই শিয়ালের মতো চালাক। লাঠিটা হয়তো নিজেই বাগিয়ে নিবি।”
“তোমার তো বন্দুক আছে। যদি বেইমানি করি তা হলে গুলি করে আমাকে মেরো না হয়। লাঠি তো বন্দুকের সঙ্গে পারবে না।”
“তুই লাঠির যা ক্ষমতার কথা বলছিস তা যদি সত্যি হয়, তা হলে ওই লাঠি হয়তো বন্দুকের গুলিও ঠেকাতে পারবে।”
নিমাই হতাশ হয়ে বলল, “তা হলে কি লাঠিটা হাতছাড়া করবে সর্দার?”
গ্যানা গম্ভীর গলায় বলল, “না, না, তোকে ছেড়ে দিচ্ছি। শুধু একটা কথা মনে রাখতে বলি, যদি বেইমানি করিস তা হলে তোর গাঁয়ে গিয়ে রাতের বেলা তোর ঘরবাড়িতেই আগুন দেব। একটা লোকও বাঁচবে না। বুঝেছিস?”
নিমাইয়ের চোখ দুটো একবার যেন দপ করে জ্বলে উঠেই নিভে গেল। সে চাপা গলায় বলল, “ঠিক আছে।”
“তবে যা, কাল সকালের মধ্যে লাঠি আমার হাতে আসা চাই।”
নিমাই দ্বিরুক্তি না করে উঠে পড়ল। কেল্লার বাইরে এসে সে চারদিকটা একটু দেখে নিয়ে হনহনিয়ে হাঁটা ধরল।
ন’টায় হরিপুরে নিশুতি রাত। এবার শীতটাও খুব জেকে পড়েছে। তার উপর এই সময়ে আশপাশে চিতাবাঘের উপদ্রব হয় খুব। কাজেই সন্ধের পরেই যে-যার ঘরে ঢুকে যায়। শুধু বাজারের দিকটায় কিছু লোক চলাচল আছে, তবে তাদের সংখ্যা হাতে গোনা যায়, দু-চারজন সবজি আর মাছের ব্যাপারী এখনও আশায়-আশায় টেমি জ্বেলে বসে আছে। গোটাকয়েক দোকানি এখনও ঝাঁপ ফেলেনি। হালুইকর পীতাম্বর এখন বসে বসে ছাঁচে ফেলে বাতাসার সাইজের সন্দেশ তৈরি করে যাচ্ছে। দরজি ননীগোপাল সেলাই মেশিনে কার যেন লেপের ওয়াড় বানাচ্ছে। ডাক্তার গিরিধারী দাস তার চেম্বারে নব্বই বছর বয়সি খগেন মণ্ডলের নাড়ি টিপে চোখ বুজে বসে আছে। আর সব শুনশান।
নিমাই চাঁদরে মাথা-মুখ ঢেকে নিয়ে সন্তর্পণে বাজারের এলাকাটা পার হল। রাতবিরেতে উটকো লোকের গাঁয়ে আনাগোনা লোকে পছন্দ করে না। হরিপুর নিমাইয়ের চেনা জায়গা নয়, জানাশোনাও নেই কারও সঙ্গে। সুতরাং সাবধান না হলে বিপদ।
পিছন থেকে কে যেন হাঁক মারল, “কে রে? শ্যামাপদ নাকি?”
না, সে শ্যামাপদ নয়। তবু নিমাই দাঁড়িয়ে পড়ল। অচেনা জায়গায় মাথা ঠান্ডা রাখা ভাল। দৌড়ে পালালেই বিপদ। লোকটা কাছে আসতেই সে বিনয়ের সঙ্গে বলল, “না, আমি শ্যামাপদ নই। আমি হলুম নবীনের দূর সম্পর্কের ভগ্নিপোত।”
লোকটা খুশি হয়ে বলল, “ও, ওই লাঠিটার জন্য এসেছ বুঝি? তা ভাল। আজ সবাই তো ওখানে গিয়েই জুটেছে। আমি যদিও বুজরুকিতে বিশ্বাস করি না, তবু কাণ্ডটা কী তা দেখতেই যাচ্ছি। চলো, চলো!”
নিমাই প্রমাদ গুনল। সর্বনাশ! লাঠির কথা ইতিমধ্যেই তা হলে চাউর হয়ে গেছে! তবে ভিড়ের যেমন অসুবিধে আছে, তেমনই আবার সুবিধেও আছে। সে ভাবতে ভাবতে লোকটার পাশে পাশে হাঁটতে লাগল।