Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

বংশ পরম্পরায় গোস্বামী গৃহের সকলেই কমবেশি ধর্মপ্রাণ। তাই, গৃহকর্ত্রী নাতনির নাম রাখলেন “সীতা”। সীতার মায়ের কপালে চিন্তার ভাঁজ। সীতা নামের মেয়েরা বড়ো অসুখী হয়। সে নিজে অল্পবয়সী বউ মানুষ। গিন্নীমাকে একথা বলার দুঃসাহস তার নেই। তখনকার সময়টাই ছিল এমন। নিশীথে পতিসেবার পরিসরে উৎকণ্ঠাটুকু আব্দার রূপে পরিবেশিত হল। এ কান সে কান পরিভ্রমণ করে কথা পৌঁছালো গৃহস্বামীর কাছে। আবেদন মঞ্জুর। বাড়ির মেয়ের ভাগ্য নিয়ে তো আর পরীক্ষা নিরীক্ষা করা চলে না। সীতা পরিবর্তিত হয়ে “বৈদেহী”। মেয়ের মা-ও খুশি । গৃহকর্ত্রীকেও বোঝানো হল তোমার নামই রইল। গৃহযুদ্ধের অবকাশ রইল না।

জন্মইস্তক ঈশ্বরের ভজন কীর্তন আরাধনা শ্রবণ। তাইজন্যই কিনা কে জানে! শিশুবয়েস থেকেই সঙ্গীতের অমোঘ আকর্ষণ বৈদেহীর। প্রথমে নামগান। ক্রমে ক্রমে সবধারার গানেই তার অনায়াস সুমধুর বিচরণ। আপ্লুত করত সকলকে। এই গানপাগল মেয়েটিকে ভালোবাসলো আর এক সঙ্গীতপ্রেমী। একই রাস্তার এ প্রান্ত ও প্রান্ত। বাবা মা তিনছেলে বৌমা নাতি নাতনী নিয়ে ভরভরন্ত ভটচাজ্ বাড়ি‌। গীতবাদ্য প্রেমী ছোটো ছেলেটির জন্য এক্কেবারে উপযুক্ত মনে হল বৈদেহীকে। চারহাত এক হতে সময় লাগল না। প্রথম প্রথম দিব্যি চলল বীণাপাণির আরাধনা। সংসারে এলো নতুন সদস্য “আঞ্জীর”।

ইদানিং স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই বেশ নাম ডাক হয়েছে। আজ এখানে অনুষ্ঠান তো কাল ওখানে। সকলের মাঝে আদরে (অনাদরে) বেড়ে উঠছে আঞ্জীর। বৈদেহী ব্যতীত অন্য দুই বউ গৃহবধূ। তাই নিত্যদিন বৈদেহীর বাইরে যাওয়াকে কেন্দ্র করে বিরূপতার রক্তিম মেঘ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল একটু একটু করে। আঞ্জীরের পড়াশোনা শুরু হতে আনুসঙ্গিক হাজারো দায়িত্ব বাড়ল। প্রথমে মল্লার রাগিনীতে সুরেলা অনুযোগ। ধীরে ধীরে তা মেদুর সিঁদুরে জলধর রূপে সংসারের সকলের মনের কোণে কোণে ঘনীভূত হল। অচিরেই বজ্রনাদ হয়ে জানান দিল প্রতিবেশী মহলে। গানই যে মেয়ের ধ্যানজ্ঞান নিঃশ্বাস প্রশ্বাস, তা বেমালুম বিস্মৃত হল প্রেমিক স্বামীটিও। সকলের অকাট্য যুক্তি,

“অনেক গান গেয়েছো। এখন ছেলে হয়েছে। সংসারের দায়িত্ব, ছেলের দায়িত্ব পালন করো। গান ফাংশন বন্ধ করো। এমন করে ফাঁকি মেরে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে আর কতদিন ঘুরবে?”

বিস্মিত বৈদেহী। একই প্রশ্ন করে স্বামীকে “তুমি পারবে!”

সংসারের খুঁটিনাটি কখনও শেখেনি সে। বড়ো-মেজো বৌ দুবেলা দুজন রান্না করে। তার দায়িত্ব পড়ল দুজনকে কেটে বেটে সাহায্য করা। যতটুকু পারে সবটুকু দেওয়ার চেষ্টা করে সে। কিন্তু মনটা যে পড়ে থাকে তানপুরায়। পদে পদে ভুলভ্রান্তি হয় তার। প্রতি কাজে কটাক্ষ বক্রোক্তি। মাছের ঝোলের আলু হয়ে যায় তরকারির মতো। মেয়ের যে মাথায় গান ছাড়া কিছুই ঢোকে না। অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,

“তাতে কি হয়েছে! লম্বা কাটো বা চৌকো, আলুর স্বাদ তো একই থাকবে।”

উত্তর প্রত্যুত্তরে নিত্যদিনকার কলহ আকাশছোঁয়া হয়ে ওঠে। যার আঁচ থেকে আর দূরে সরিয়ে রাখা গেল না, চিড় ধরে যাওয়া স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কও।

বৈদেহীর মায়ের অনুচ্চারিত বিলাপ,

“তবে কি বৈদেহী হয়েও মেয়ে সীতার দুর্ভাগ্যই বহন করে চলবে!!”

মেয়েকে অশান্তির লেলিহান শিখা থেকে পরিত্রাণ দিতে, একজন সহায়িকার ব্যবস্থা করল, বৈদেহীর বাবা-মা। সাংসারিক নৈমিত্তিকে সহায়তার সাথে, আঞ্জীরের খেয়ালও রাখবে। অগ্নিতে ঘৃতাহুতি হল। মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক। পিত্রালয়ের এই অনধিকার চর্চায় সকলে একজোট হয়ে একঘরে করল তাকে। একদিকে নিয়মিত গাইতে না পারায় নিজের সাথে লড়াই, বিপক্ষে যেন সংসারের সকল মানুষ। এত অসন্তোষ কোথায় ছিল!

এই অপ্রীতিকর কলহ বিবাদে সর্বোত্তম ক্ষতিগ্রস্ত হল আঞ্জীর। বৈদেহী চাইলেও তাকে না পারে সঙ্গীতের সাধনায় নিয়োজিত করতে, না তার পড়াশোনায় মনমতি হলো। শৈশব থেকে কৈশোরে প্রবেশ করতে যাওয়া বংশধর অনায়াসে আয়ত্ত করে নিল, সংখ্যাগরিষ্ঠের বুলি। মা কে ভালোবাসা তো দূর, প্রতি কথায় অবজ্ঞা, অবহেলা, অসম্মান। বড়োদের কাছ থেকে সে শিখে নিয়েছে, মা কিছুই পারেনা, কিছুই জানেনা। আর সেকথা মুখের উপর জানান দিতেও কোনো অসুবিধা নেই। ব্যাথাতুর মাতৃহৃদয় আত্মজকে অনুভূতিপ্রবণ করে তোলার চেষ্টায় ত্রুটি রাখে না। আশায় বুক বাঁধে। এবার হয়তো তাকে বুঝবে ছেলে। কিন্তু সবই সাময়িক। একদিন দুদিন চারদিন। পুনরায় অন্যদের প্রভাব পড়ে কিশোরের আচরণে বাক্যে। একমাত্র সন্তান। আজকাল বড়ো অসহায় লাগে বৈদেহীর।

সেদিন সন্ধ্যাবেলা। একঝুড়ি আনাজ নিয়ে বসতে হয়েছে তাকে। নয় নয় করে মানুষও তো চোদ্দ পনেরো জন। এমনিতেই মনটা আজ একটু বেশিই মেঘলা হয়ে আছে। গানের জগতের এক গুণমুগ্ধ ফোন করেছিল। আজকাল আর তাকে তেমনভাবে পাওয়া যায় না কেন! কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা! ইত্যাদি প্রভৃতি। এইসব ক্ষেত্রে তাকে অসত্যের আশ্রয় নিতেই হয়। কিন্তু এভাবে আর কতদিন! এমন সন্ধ্যাকালে যে তার ইমন বা মালকোষে প্লাবিত হওয়ার সময়। অশ্রুজলে বটির ফলা ঝাপসা হয়ে যায়।

এমনসময় শিস দিয়ে চটুল হিন্দিগানের সুর ভাঁজতে ভাঁজতে, সাইকেলের চাবির রিং আঙুলের ডগায় ঘোরাতে ঘোরাতে, ছেলে ঢোকে বাড়িতে। চোখের জল সামলে বৈদেহী বলে,

“ভালো করে হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বোস। আমি টিফিন নিয়ে যাচ্ছি”।

অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে উত্তর দেয় আঞ্জীর,

“আমি এখন টিভি দেখব। তুমি নিজের চরকায় তেল দাও”।

রাগতে গিয়েও সামলে যায় বৈদেহী। বলে,

“না বাবা, সন্ধেবেলা টিভি দেখতে নেই। পড়তে ভালো না লাগলে, হারমোনিয়ামটা নিয়ে একটু বোসো। সেদিন স্বরগমগুলো শেখালাম। টিভি নাহয় পরে দেখো”।

পাশের কোনো ঘর থেকে টিপ্পনী ভেসে এলো,

“তানপুরোধারী মা সরস্বতী”।

মুখের কথা শেষ হয় না‌। অশ্লীল আওয়াজ করে ছেলে ঝাঁঝিয়ে ওঠে,

“একদম জ্ঞান দেবে না তো। ওইসব সরগম টরগম তোমার মতো ফাঁকিবাজদের কাজ না করার অজুহাত। আমি টিভিই দেখব। তুমি বলার কে, আমি কি করব! আমার ব্যাপারে তুমি একদম নাক গলাবে না‌। আমার যা খুশি তাই করব। গানের নাম করে তুমি যে ফষ্টিনষ্টি করে বেড়াও আমি কিছু বলি তোমাকে?”

মুহূর্তে চোখের সামনে পৃথিবীটা দুলতে থাকে। কানে মাথায় পাগলা হাতির ঘন্টি। হাতের সামনে থাকা বটিটা নিয়ে ছুঁড়ে মারল দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য বৈদেহী। বাড়ির সকলে ছুটে এলো। এলো প্রতিবেশীরা। রক্তাক্ত অচৈতন্য আঞ্জীরকে নিয়ে অ্যামবিউল্যানস ছুটল হসপিটালে। ডান কনুইয়ের নিচ থেকে আর রাখা গেল না হাতটা। (অনিচ্ছাকৃত) খুন করার চেষ্টার অপরাধে হাজতবাস শুরু হল বৈদেহীর।

কিছুকাল পরের ঘটনা♻️

শ্বশুরবাড়ির কেউ ইত্যবসরে একদিনের জন্যও তার সঙ্গে দেখা করেনি। তাদের এফ-আই-আর’এর ভিত্তিতেই পুলিশ অ্যারেস্ট করেছিল বৈদেহীকে। কৃত-অকৃত সমস্ত অপরাধ স্বীকার করে নেয় অনুতপ্ত অসহায় অশ্রুমতি। আজ তার সাজা সম্পূর্ণ হয়েছে। একদিনের জন্যও ইতিমধ্যে সে ছেলেকে দেখতে পায়নি। বাবা মায়ের অনুরোধ উপেক্ষা করে সংশোধনাগার থেকে সোজা এসে উপস্থিত হয় শ্বশুর বাড়িতে। বুঝতে পারে সকলের জানাই ছিল, আজ তার শাস্তির মেয়াদ পূরণের দিন। বন্দীজীবনের অখন্ড অবসরে, আপন গতিপথ নির্ধারণ করে নিয়েছে বৈদেহী। অনুশোচনাদগ্ধ মা, আজ শুধুমাত্র নাড়ির অমোঘ আকর্ষণে এসেছে, সন্তানের ক্ষমাভিক্ষা করতে। আঞ্জীরকে চোখের দেখা দেখবে। যা শাস্তি সে দিতে চায় মাথা পেতে নেবে। বাড়িতে ঢুকতেই স্বামী দেবতার প্রশ্ন,

“কি চাই? এ বাড়িতে কেন?”

নিরুত্তরে ছেলের ঘরের দিকে পা বাড়ায় বৈদেহী। পিছন থেকে আওয়াজ আসে,

“জিনিসপত্র কোনোকিছুতে হাত দেবে না। এত বড়োলোক বাপ। সেখানে ঢুকতে দিল না বুঝি? যে চুলোয় খুশি গিয়ে মরো। এখানে জায়গা হবে না।”

ঘরে প্রবেশ করে বৈদেহী। মলিন বিছানায় ততোধিক মলিন তার অবিচ্ছেদ্য ধারা। ত্রস্ত, বিধ্বস্ত, অবিন্যস্ত। একপল থমকে যায় মায়ের গতি। মনে মনে বলে,

“শক্তি দাও ঈশ্বর। জীবনের কঠিনতম শাস্তির জন্য প্রস্তুত করো আমাকে”।

ঈশ্বরের মনে কি আছে তা তিনিই জানেন। পলকের নিমেষ মাত্র। বিছানা থেকে ছুটে এসে ছেলে জড়িয়ে ধরে মা’কে। যা বৈদেহী বহুবার চেয়েও পায়নি! আজ নির্বাক বিস্মিত বৈদেহী দেখে, আঞ্জীর একহাতে প্রাণপনে আঁকড়ে ধরছে তাকে। ঝুলে থাকা ডানহাতের অঙ্গটুকুও সর্বশক্তি নিয়ে উঠে আসছে তার দিকে। দুহাত দিয়ে দৃঢ় বন্ধনীর গ্রন্থন রচনা করে বৈদেহী। ইত্যবসরে হাজারো মন্দ কথার বন্যা বয়ে চলেছে ঘরের বাহিরে-অন্দরে। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বেরিয়ে এল সে। শুনতে পেল শ্বাশুড়ির গলা,

“আদিখ্যেতা করে নিয়ে যাচ্ছ নিয়ে যাও। খবরদার ফেরত দিতে আসবে না। ওই নুলো ছেলেকে আমরা পুষতে পারব না বলে দিলাম”।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *