মোবারক হোসেন ভাত খেতে বসে
মোবারক হোসেন ভাত খেতে বসে তরকারির বাটির দিকে তাকিয়ে বললেন, এটা কী? তাঁর গলার স্বরে অদূরবর্তী ঝড়ের আভাস। মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর কিছু হয়ে যাবে।
মনোয়ারা অদূরবর্তী ঝড়ের সম্ভাবনা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে স্বাভাবিক গলায় বললেন, কী হয়েছে?
এটা কিসের তরকারি?
কৈ মাছের ঝোল।
কৈ মাছের ঝোলে তরকারি কী?
চোখে দেখতে পাচ্ছ না কী দিয়েছি! ফুলকপি, সিম।
তোমাকে কতবার বলেছি-ফুলকপির সঙ্গে সিম দেবে না। ফুলকপির এক স্বাদ, সিমের আলাদা স্বাদ। আমার তো দুটা জিভ না যে একটায় সিম খাব আর অন্যটায় ফুলকপি?
মনোয়ারা হাই তুলতে তুলতে বললেন, যে তরকারি খেতে ইচ্ছা করে সেটা নিয়ে খেলেই হয়। খেতে বসে খামাখা চিৎকার করছ কেন?
এই তরকারি তো আমি মরে গেলেও খাব না।
না খেলে না খেয়ো। ডাল আছে ডাল খাও।
শুধু ডাল দিয়ে ভাত খাব?
মনোয়ারা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, এটা তো হোটেল না যে চৌদ্দ পদের রান্না আছে।
মোবারক হোসেনের প্রচণ্ড ইচ্ছা হচ্ছে তরকারির বাটি ছুড়ে মেঝেয় ফেলে দিতে। এই কাজটা করতে পারলে রাগটা ভালো দেখানো হয়। এতটা বাড়াবাড়ি করতে সাহসে কুলাচ্ছে না। মনোয়ারা সহজ পাত্রী না। তার চীনামাটির বাটি ভাঙবে আর সে চুপ করে থাকবে এটা হবার না। মোবারক হোসেন কৈ মাছের ঝোলের বাটি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ধাক্কাটা হিসাব করে দিলেন, যেন তরকারি পড়ে যায় আবার বাটিটাও না ভাঙে।
মনোয়ারা বললেন, কী হল? খাবে না?
মোবারক হোসেন কিছু না বলে ভাতের থালায় হাত ধুয়ে ফেললেন। থালায় ভাত বাড়া ছিল। কিছু ভাত নষ্ট হল। হাত ধোয়ার দরকার ছিল না। তার হাত পরিষ্কার-খাওয়া শুরুর আগেই গণ্ডগোল বেধে গেল।
মনোয়ারা বললেন, ভাত খাবে না? মোবারক হোসেন বললেন, না। তোমার ভাতে আমি ইয়ে করে দেই।
বাক্যটা খুব কঠিন হয়ে গেল। রাগের সময় হিসাব করে কথা বলা যায় না। তবে কঠিন বাক্যেও কিছু হল না। মনোয়ারা খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তরকারির বাটি, ডালের বাটি তুলে ফেলতে শুরু করলেন। যেন কিছুই হয় নি। মোবারক হোসেন স্তম্ভিত হয়ে পড়লেন। পরিবারের প্রধান মানুষটা রাগ করে বলছে—ভাত খাবে না, তাকে সাধাসাধি করার একটা ব্যাপার আছে না? মনোয়ারা কি বলতে পারত না ভুল হয়েছে, ভবিষ্যতে আর কখনো সিম আর ফুলকপি একসঙ্গে রাধা হবে না। কিংবা বলতে পারত—দুমিনিট বোসসা চট করে একটা ডিম ভেজে দেই। শুকনা মরিচ আর পেঁয়াজ কচলে মরিচের ভর্তা বানিয়ে দেই। মরিচের ভর্তা তার অত্যন্ত প্রিয়। এই জিনিসটা বানাতে কতক্ষণ লাগে? তানা, ভাত তরকারি তুলে ফেলছে! ত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনের এই হল ফসল।
মোবারক হোসেনের তীব্র ইচ্ছা হল বাড়িঘর ছেড়ে গৌতম বুদ্ধের মতো বের হয়ে পড়েন। এ রকম ইচ্ছা তার প্রায়ই হয়। বাড়ি থেকে বের হন। রেলস্টেশনে গিয়ে ঘণ্টখানেক বসে থাকেন। মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। তাঁর রেলস্টেশন পর্যন্ত। মোবারক হোসেন নান্দাইল রোড রেলস্টেশনের স্টেশনমাস্টার। রাত নটায় একটা আপ ট্রেন ছেড়ে দিয়ে খেতে এসেছিলেন। খেতে এসে এই বিপত্তি সিম আর ফুলকপির ঘোঁট বানিয়ে বসে আছে।
মোবারক হোসেন মাফলার দিয়ে কান ঢাকতে শুরু করলেন। এটা হল তাঁর ঘর ছেড়ে বাইরে যাবার সংকেত। অতি সহজে তাঁর কানে ঠাণ্ডা লেগে যায় বলে সব সময় মাফলার দিয়ে কান ঢাকতে হয়। আর এ বছর তুন্দ্রা অঞ্চলের শীত পড়ছে। আগুনের উপর বসে থাকলেও শীত মানে না।
মনোয়ারা বললেন, যাচ্ছ কোথায়?
তিনি জবাব না দিয়ে গায়ে চাদর জড়ালেন।
স্টেশনে যাচ্ছ?
তিনি এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। হাতমোজা পরতে লাগলেন। হাতমোজা পরা ঠিক হচ্ছে না। মনোয়ারা মাত্র কিছুদিন আগে হাতমোজা বুনে দিয়েছেন। তার উচিত হাতমোজা জোড়া নর্দমায় ফেলে দেয়া কিন্তু বাইরে মাঘ মাসের দুর্দান্ত শীত। খোলা মাঠের উপর রেলস্টেশন। শীত সহ্য হবে না। গৌতম বুদ্ধ কপিলাবস্তুতে না থেকে যদি নান্দাইল রোডে থাকতেন এবং মাঘ মাসে গৃহত্যাগ করতেন তা হলে তিনিও হাতমোজা পরতেন। গলায় মাফলার বাঁধতেন।
রাতে ফিরবে? না ফিরলে বলে যাও। দরজা লাগিয়ে দেব।
যা ইচ্ছা করো।
আমি কিন্তু শুয়ে পড়লাম। রাতদুপুরে ফিরে এসে দরজা ধাক্কাধাব্ধি করবে না।
তোর বাপের দরজা? সরকারি বাড়ির সরকারি দরজা। আমার যখন ইচ্ছা ধাক্কাধাব্ধি করব।
তুই তোকারি করবে না। আমি তোমার ইয়ার বন্ধু না।
চুপ। একদম চুপ। No talk.
মোবারক হোসেন অগ্নিদৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। সেই দৃষ্টির অর্থ তুমি জাহান্নামে যাও। তিনি ঘরের কোনায় রাখা ছাতা হাতে বের হয়ে গেলেন। তিনি বের হওয়ামাত্র দরজা বন্ধ করার ঝপাং শব্দ হল। মোবারক হোসেন ফিরে এসে বন্ধ দরজায় প্রচণ্ড লাথি বসালেন। এতে তার রাগ সামান্য কমল। তিনি রেলস্টেশনের দিকে রওনা হলেন।