সমুদ্র যাত্রা (Samudra Jatra) : 04
সেই থেকে আমি সতর্ক হয়ে যাই। যে সব কথা আমার মনে হয়, তা আমারই কথা। আর কাউকে বলার নয়। বললে তার অদ্ভুত অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া হতে পারে। এমনিতেই চুপচাপ। আমি আরও চুপ হয়ে যাই। ক্লাস করি, ওয়ার্কশপ করি, ল্যাবের সময়ে ল্যাব, রাত্তির অবধি পড়ি। বটানিকসে গিয়ে গঙ্গার ধারে বেড়াই, যখন দলের সঙ্গে তখন দলের মতো। যখন একলা তখন নিজের মতো। বটানিক্যাল গার্ডেনটাই আমার ঘরবাড়ি হয়ে ওঠে এক এক সময়ে। নদী সামনে নিয়ে বসতে আমার কেমন একটা স্বস্তি হয় আসলে। হস্টেলের ঘর বড় ছোট মনে হয়। নিজেকে ছড়াতে পারি না। ফার্স্ট ইয়ারে পুরনো বাড়িতে থাকতুম। সেগুলো অনেক উঁচু ছিল। এক এক সময়ে মনে হয়, এত ছাত কেন? এত দেয়াল কেন? ওপর থেকে একটা বোমা-টোমা পড়ে যদি ছাতটা ভেঙে যায় তো বেশ হয়। ঠিক একটা পুরনো অব্যবহৃত কুয়োর মতো ছন্ন দেখতে হবে ঘরখানা! নিজের ভাবনায় নিজেই এক এক সময়ে বিরক্ত হই। এরকম ধ্বংসাত্মক ভাবনা-চিন্তা কেন আমার? এদিকে তো আমি গড়তে শিখছি। তবে এ কেমন বিপ্রতীপ আচরণ মনের?
সকলে প্রতি সপ্তাহে বাড়ি যায় না। এগুলো ওদের নানা রকম মজার সময়। কী মজা আমি জানতে চাই না। ঠারে-ঠোরে যেটুকু শুনি। বাড়ি চলে যাই, সবাই খুব স্বস্তি পান, দাদুর মুখটা আলো হয়ে যায়। আর ফিনকির তো কথাই নেই। সারা সপ্তাহ কী কী কৌতুকজনক ঘটনা ঘটল, বাবা কতবার শুধু শুধু চেঁচালেন, দাদা চিঠিতে কী লিখেছে সব তার বলা চাই। সবচেয়ে কম সময়টা সে দেয় পড়াশোনাতে যার জন্য না কি প্রতি সপ্তাহে আমার আসাটা বাধ্যতামূলক।
—কী রে ফিনকি? তোর জোমেট্রি আজ? রাইডারগুলো পেরেছিস? —শোন না— ফিনকি এক পাক নেচে নিল, —দাদা না প্রেম করছে।
—কী?
—হ্যাঁরে! বউদিটার নাম সন্তোষ, হি হি মেয়েদের এ রকম নাম শুনেছিস?
—সন্তোষ?
—তুই কী করে জানলি প্রেম?
দাদু মাকে বলছিলেন— বউমা, সাগর প্রতি চিঠিতেই এই পঞ্জাবি মেয়েটির কথা লিখছে। মনে হচ্ছে হি ইজ ইন লাভ।
—মা কী বললেন?
—কিছু বলল না। কিন্তু মা কাঁদছিল।
—কাঁদছিলেন? কেন? তুই কী করে বুঝলি?
—মা দাদুর ঘরের বাইরে এসে চোখ মুছছিল।
খবরটা নতুন। মায়ের কোনও আলাদা সুখ-দুঃখ আছে বলে আমি জানতুম না। মা যেন এক কর্তব্যপুতলি। কারও কোনও ব্যবহারেই মায়ের কোনও বিকার দেখিনি। কথা দরকারের বেশি বলতেন না। নানা জনের সেবা করতে করতে, ফরমাশ খাটতে খাটতে নিজের ছেলেমেয়েদের দেখাশোনাই মা করে উঠতে পারেননি। মায়ের অভাব আমরা তেমন করে বুঝিওনি। দুই ঠাকুমারই তখন আর একটু কম বয়স ছিল। ভাত মেখে, গল্প বলতে বলতে খাইয়ে দিচ্ছেন এরকম একটা দৃশ্য আবছা মনে পড়ে। তারপর একটু বড় হতেই তো দাদুর আওতায়। দাদার এ নিয়ে বোধহয় একটু ক্ষোভ থেকে থাকবে। মাঝে মাঝে বলত— সবাইমিলে মাকে কেটেকুটে ভাগ করে নিয়েছে। আমাদের ভাঁড়ে মা ভবানী।
যখন কোনও জিনিস খুঁজে পেত না, বিশেষ কিছু খেতে ইচ্ছে করত, কিংবা অসুখবিসুখ করত, তখন এই ক্ষোভগুলো ওর চেগে উঠত। সেবার জল-বসন্ত হল। খুব গুটি বেরিয়েছে। দাদা মশারির মধ্যে শুয়ে থাকত একা। আমাকে দাদুর ঘরে শুতে দেওয়া হত তখন। দাদার ঘরের পাশেই অবশ্য মায়ের ঘর। মাঝখানের দরজা মা রাতে খুলে রাখতেন। কিন্তু একদিন শেষ রাত্তিরে কেমন হাউমাউ করে দাদা মশারি ছিঁড়ে, ঘর থেকে দালানে এসে রাগ আর কান্না মিশিয়ে চিৎকার করতে লাগল।
—বেশ, বেশ, বাঃ, বাঃ একটা রুগ্ণ ছেলেকে একা ফেলে নিজেরা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। কেমন মা, কেমন বাবা? এরা কেমন?
মা ঘুম চোখে বেরিয়ে এলেন— কী হয়েছে বাবলা?
—হ্যাঁ এখন বাবলা!— দাদা ভ্যাঙাল— চুলকোনিতে সারারাত বলে ঘুম নেই!
—আমি যে চন্দন লাগিয়ে দিলুম, নিমের পাতাসুদ্ধু ডাল দিলুম? চুলকোলেই বুলোতে হবে বলে দিলুম যে!
—ঘুমোব? না নিম বুলোব? জলপটিটাও নিজে দিয়ে নেব! থার্মোমিটারটাও নিজে নিজেই লাগিয়ে টেম্পারেচার দেখব! এবার এ ঘরে একটা স্টোভও রেখে যেয়ো, নিজের হরলিক্স-টিকসগুলো নিজেই করে নেব। চমৎকার।
বাবাও বেরিয়ে এসেছিলেন চেঁচামেচিতে!
—কী হল? জ্বর বেড়েছে, না কী?
—তোমাকে আর ওস্তাদি করতে হবে না। যাও যাও লুচি মাংস খেয়ে আড্ডা দিগে যাও। —দাদা চেঁচিয়ে উঠল।
—কী? আমাকে এত বড় কথা, এত্ত বড়! রুচি কাল থেকে আমাকে আর লুচি-মাংস দেবে না…কাল থেকে আমাকে…
দাদু উঠে এসেছেন নীচ থেকে।
—খোকা কী হচ্ছে? ছেলেটা অসুস্থ।
দাদা আবার হাইমাই করে উঠল— আমার মাথার কাছে রোজ পেতনি দাঁড়িয়ে থাকে জানো? আজকে গলা টিপে ধরবে বলে হাত বাড়িয়েছিল।
মা বললেন— ঠিক আছে, আজ থেকে আমি তোমার ঘরে থাকব, ব্যস আর কান্নাকাটি কোরো না।
দাদু বললেন,— এই রোগে এটা একটা খুব কমন হ্যালুসিনেশন বাবুভাই। মাথার কাছে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। যারা জানে না তারা বলে মা শীতলা।
তা যেন হল। কিন্তু আমার যেটা খারাপ লাগল মা সারাদিন ঠিক তেমনই উদয়াস্ত খেটে সারা রাত দাদার পাশে বসে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন, ছটফট করলে জল। সারাদিন তো সবকিছু করছেনই, সাবান, অ্যান্টিসেপটিক কাপড় পাল্টানো। কেউ নেই বলবার যে এটা একটু অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে। শেষ কালে আমি বলি— দাদু, আমিই দাদার ঘরে থাকব।
দাদু আকাশ থেকে পড়লেন— তুমি? তুমি সেবার কী জান? এইটুকু ছেলে?
—এত মা কেমন করে পারবেন? সারা দিন…তারপর সারা রাত…
দাদু অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন—তুমি ঠিকই বলেছ। আমরা তোমার মায়ের কাছ থেকে বড্ড বেশি ডিমান্ড করি। আমি, আমিই বরং বাবুর কাছে থাকব।
—তুমি?
—তুমি জানো না সমু। তোমার তিন বছর বয়সে টাইফয়েড হয়েছিল। এই ঘরে রেখে তোমার সেবা আমিই করেছি।
—কিন্তু এখন তোমার…তুমি তো এখন…
—বুড়ো হয়েছি? ঠিক কথা। কিন্তু মানুষ একবার যেটা শেখে সেটা আর ভোলে না। সাঁতারই বল আর সেবাই বল। এ রকম সঙ্কটের সময়েও আমি নিজের রুটিন নিয়ে আছি। আমার শেয়ার করা উচিত ছিল।
—আমি তা বলিনি দাদু। মা তোমাকে করতে দেবেনও না।
আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। রাতে দাদার বিছানায় মশারি ফেলে জল, নিমডাল সব গুছিয়ে রেখে মা যেমনি বেরিয়ে গেছেন অমনি আমি দরজা বন্ধ করে দাদার পাশে নিজের তক্তপোশে শুয়ে পড়লুম।
—তুই শুলি যে? —দাদা অবাক।
—আজ থেকে তোর কাছে আমি থাকব।
—কে বলেছে? দাদু?
—না।
—তবে কে ঠিক করল?
—কেউ না, আমি নিজে।
—কিন্তু তোর তো একবারও হয়নি। ছোঁয়াচ লাগলে?
—লাগবে, কী করা যাবে! তুই ভাবিস না, যেই দরকার হবে ডাক দিবি, আমি ঠিক উঠে পড়ব।
মা আরও রাত্তিরে এসে দরজার কড়া নাড়লে, আমি জানলা দিয়ে বললুম— দাদার কাছে আমি থাকছি। নিজের ঘরে ছাড়া আমার ঘুম হচ্ছে না।
—ওর অসুবিধে হবে সমু।
—হবে না। আমার ঘুম খুব পাতলা। তুমি যাও শুয়ে পড়ো গে।
মা আর কিছুক্ষণ আমার সঙ্গে তর্ক করলেন। কিন্তু মায়ের চিরকালই কথা কম, কাজ বেশি। শেষে রণে ভঙ্গ দিলেন।
আমি দাদাকে জিজ্ঞেস করি— তোর কি মাকেই বিশেষ করে দরকার? বাচ্চারা অসুখ করলে বেশি-বেশি মা-মা করে, সেই রকম?
দাদা বলল— একটা সত্যি কথা বলব?
—বল।
—তুই থাকলেই আমার বেশি সোয়াস্তি হবে। মা সারা রাত জেগে বসে থাকবেন। বললেও কিছুতেই শোবেন না। মাঝে মাঝে ঢুলে পড়ে যাচ্ছেন তার পরেই আবার চমকে জেগে উঠে হাতে পায়ে নিম ডাল বুলোতে থাকছেন। যেন কী রকম নিঃশব্দে স্যাক্রিফাইস করে চলেছেন বাবার জন্যে, দাদুর জন্যে, এবার আমার জন্যে। আই ডোন্ট লাইক ইট। আনইজি লাগে।
রাত ছমছম করছে। খোলা জানলা দিয়ে রাস্তার আলো ঢুকছে ঘরে। আমার মশারি, তার বাইরে খালি স্পেস। তারপরে দাদার মশারি, ভেতরে দাদার বিছানা। দাদার শরীরভরা জলবসন্তের ফোস্কা ফোস্কা গুটি, শরীরের দাদা এক, ভেতরে আর একটা দাদা, অভিমান, রাগ আবার অস্বস্তিতে ভুগছে, ভয়েও। তারও ভেতরে আর একটা দাদা যে পরিষ্কার চিন্তা করতে পারছে। যে হৃদয়ঙ্গম করেছে মায়ের শ্রান্তি। আমার আন্তরিক ইচ্ছার সেবা, সে এখন স্বস্তিতে। শান্তিতে। তারও ভেতরে আছে এই সাময়িক অসুস্থতা ও বিকারের বাইরের অন্য দাদা, যে টেবিলের ওপর কনুই রেখে অনন্য মনে পড়ে যায়, খালি পড়ে যায়, লেখে, অঙ্ক কষে, অন্যমনস্ক হয়ে থাকে, বি বি সি শোনে, কদাচিৎ কদাচিৎ একদম একা একা সিনেমা দেখে আসে, কী সিনেমা জিজ্ঞেস করলে শুধু মিটিমিটি হাসে। আমরা দুজন মানুষ এক ঘরের দুই প্রান্তে। এক বাড়ি এক পরিবার। একই বাবা-মা’র রক্ত, বংশের জিন আমাদের শরীরে, এই তো দাদাকে জল এগিয়ে দিচ্ছি। হরলিক্স দিলুম, ফ্লাস্ক থেকে ঢেলে, টেম্পারেচার দেখলুম, খুব কম, নিরানব্বই মতো… সবই… কিন্তু কোনওদিনই আমাদের চেনাশোনা হবে না। একজন আলাস্কান কিংবা জাপানি আমার কাছে যেমন অচেনা তেমনই থেকে যাবে। অথচ একই মনুষ্য লক্ষণ, রক্ত, একই জৈবনিক ওঠাপড়া। মস্তিষ্কের গঠন, কোষ সমূহ।
—সমু! সমু! দাদা চাপা ভিতু গলায় চিৎকার করছে। হ্যাঁ। চাপা কিন্তু চিৎকারই।
—সমু আমাকে তোর পাশে শুতে দে। সেই সাদা কাপড় মহিলা— যেই ঘুম আসছে অমনি।
আমি বললুম— তুই শুয়ে পড়, আমি যাচ্ছি। তখন রাত পাতলা হয়ে এসেছে। দপদপ করছে শুকতারা একটা স্টেনলেস স্টিলের টিপের মতো। একটু পরেই প্রথম ভোরের আলো ইরেজার দিয়ে ঘষে মুছে দেবে ওকে। দাদার বিছানার পাশে বসে কপালে আলতো হাত রাখি। এখন ওর সারা শরীরের অগুনতি গুটি শুকিয়ে এসেছে। কিন্তু মুখেরগুলো বেশির ভাগই দগদগে।
আধো ঘুমের ঘোরে দাদা বলল— কে হাত রাখল রে মাথায়? ওই সাদা কাপড় নয় তো! দেখিস।
শেষ রাত বড় অদ্ভুত সময়। অপার্থিব। মনে হয় এক মহাজাগতিক অনন্তে আস্তে আস্তে ফুটে উঠছি। আমার অস্তিত্ব এবং অনস্তিত্ব দুটোই সমান সত্য। পৃথিবীতে যেমন একটা সত্যি হলে অন্যটা মিথ্যে হয় তেমন নয়। খুব অদ্ভুত জায়গা, যদি জায়গাই বলা যায় ওটাকে, যেখানে সব বিপ্রতীপ সমান ঔদাসীন্যে অবস্থান করে। খুব বেশিক্ষণ এই অনুভবের মধ্যে থাকলে জীবনের সব কিছু খুঁটিনাটি কী রকম যেন অবান্তর হয়ে যায়। ঠিক ভয় করে না, কিন্তু আস্তে আস্তে আমি ওই মেজাজের বাইরে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করি। খুব বেশি জোর নয়। সামান্য চাপ দিলে যেমন কোনও কোনও বাক্সের ডালা খুলে যাবার একটা ব্যবস্থা থাকে সেই রকম! সামান্য চাপ। ধীরে ধীরে অনন্তর ভেতরের ঢাকনা খুলে যায়, সেই স্বল্প, অভ্যস্ত স্পেসের মধ্যে ঢুকে পড়ি এবং ঘুম এসে যায়। বুঝিওনি যে ঘুমিয়ে পড়েছি। ধীরে ধীরে আমার পাশে এসে দাঁড়ান একজন— সাদা কাপড় পরা, মাথায় ঘোমটা, মুখ দেখা যায় না, শেষ রাতের আবছায়ার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার। তিনি হাত বার করেছিলেন কি না বুঝিনি। কিন্তু স্পষ্টই দেখলুম দাদার মাথার ওপর একটা হাত। সেই হাতটার শীতল শুশ্রূষা আমার মাথাও ছুঁয়ে গেল মৃদু এক ঝলক হাওয়ার মতো।
আমি পুরোটাকেই সত্যি ভেবেছি। ঘুমের মধ্যেই ডেকেছি— মা? মা নাকি? কোনও উত্তর নেই।
ঝলমলে রোদে ঘর ভেসে যাচ্ছে। চোখের ওপর জ্বালা ধরানো সূর্যশলাকা। জেগে উঠে দেখি, বহু বেলা পর্যন্ত দুজনে ঘুমিয়েছি। জানলার কাছ থেকে মা আস্তে ডাকছেন সমু, সমু, এবার ওঠো, দরজাটা খুলে দাও।
দরজাটা খুলে দিতে মা খুব মৃদু গলায় বললেন— দেখেছ তো, রাত জাগার ফল কী! এখন তো স্কুলে যেতে হবে। চান করে নাও। একেবারে ভাত খাবে।
উঁকি মেরে দেখলেন— বাবলা ঘুমোচ্ছে? খুব, না?
—হ্যাঁ, ওর জ্বর একেবারে ছেড়ে গেছে।