Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সমুদ্র যাত্রা || Bani Basu » Page 2

সমুদ্র যাত্রা || Bani Basu

রাত আর বেশি নেই। আকাশ ময়লাটে, ঘোলাটে, হঠাৎ কদিন একটু বৃষ্টিবাদলও হচ্ছে। সময়টা বর্ষাই। পাখির ডাকে ঘুম ভাঙল। উঠোনের পেয়ারা গাছ, পাশের বাড়ির মিনারের মতো চিলেকুঠুরির ওপর ফ্ল্যাগ-স্টাফ। দু তিন বাড়ির মাঝখানে লেবু, বেল, নিম গাছ। এই জায়গাগুলো সবই পাখিদের আর প্রজাপতিদের প্রিয়। এখন ওই পাশের বাড়ির ফ্ল্যাগ-স্টাফের ওপর বসে ছোট্ট কালো পাখি শিস দিচ্ছে। দোয়েল বোধহয়। অনেকক্ষণ ধরে শিস দিচ্ছে দোয়েলটা। আমিও শুয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে শুনছি। আমার প্রিয় পাখি কাক একটা জানলার পাটে বসে ঘাড় বেঁকিয়ে ডাকল ক্বঃ। একদম সকালে ওদের গলা কী রকম আধো আধো থাকে। বাচ্চার মতো। বৃষ্টি-ভেজা হাওয়া ঢুকল এক ঝলক। আমার মনে হল ঠিক এই রকম দোয়েল এবং কাক, এই রকম ভেজা হাওয়া, ঠিক এই রকম ভোরের বিছানা আমার জীবনে আরও আরও অনেক বার এসেছে। ভোরের একটা কী রকম স্পর্শ তো থাকেই, কীরকম একটা গন্ধও। সেই গন্ধটা পাবার জন্য আমি বুক ভরে প্রশ্বাস নিই। ঠিক এই রকম কোথায়? কবে? এবং এই অনুভূতিটাও যে আমার এরকম আগেও হয়েছিল, কোথায়? কবে? ঠিক এই রকম। এ ঠিক গতানুগতিক মনে হওয়া নয়।

আজ থেকে আমি হস্টেলে চলে যাচ্ছি। কাল থেকেই মায়ের মুখ একটু শুকনো হয়ে আছে। ফিনকি কান্নাকাটি করছে। দাদা গত মাসেই অধ্যাপনার চাকরি নিয়ে দিল্লি চলে গেল। দাদু বলছিলেন— দিল্লির খরচ-খরচা বেশি বউমা। আজ ও হস্টেলে জায়গা পেয়েছে। হয়তো চিরকাল পাবে না, তারপর…ধরো চোখের আড়ালে চলে গেল, মানসিকতার পরিবর্তন হবে। তুমি ওর থেকে বেশি কিছু আশা কোরো না।।

মা ম্লানমুখে বললেন—সে যদি বলেন বাবা, আমি আপনি ছাড়া কারও কাছেই কিছু আশা করি না।

ঠিক এই সময়টাতেই আমি ঢুকলুম।

—মা আমি আমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়েছি। কালো প্যান্টটা কোথায় বলতে পার?

—ওটা ডাইংক্লিনিংএ দিয়েছি। পরের বার এসে নিয়ে যেয়ো। আর কী কী দরকার মনে করো। শেষে…

দাদু বললেন—একটা লিস্ট করেছ কী? বইপত্তর, জামাকাপড়, মিসেলেনিয়াস?

—করেছি। তবে আমি তো সব জিনিস একসঙ্গে নিয়ে যাব না। যদি দেখি ওখানে কাপড়-জামা কাচতে বেশি খরচ, কি বেশি সময় লাগছে, তো সপ্তাহে সপ্তাহে বাড়িতে দিয়ে যাব।

মা একটু উজ্জ্বল মুখে আমার দিকে চাইলেন। বললেন, প্রতি সপ্তাহে আসতে পারবে তো?

—পারতেই হবে। ফিনকিকে কথা দিয়েছি, রবিবার রবিবার ওকে পড়িয়ে দেব। আর দু’বছর পরেই তো…

আমি ফিনকির কথাটাই বললুম। কিন্তু আসলে আমি পুরো বাড়িটার কথাই ভাবছিলুম। দাদুর কথা, মায়ের কথা। যদিও তার কোনও বহিঃপ্রকাশ ছিল না। আমাদের পরিবারের সবাই-ই খুব শান্ত এবং চাপা, বাবা আর ফিনকি ছাড়া। বাবা অনর্গল কথা বলেন, অনর্গল রাগারাগি করেন, সামান্য কারণেই চেঁচামেচি, পাঁচজনের মুণ্ডপাত। আর ফিনকি সর্বক্ষণ কলকল করে। কোথায় ওর নতুন বন্ধু অদ্ভুত নামের প্রিসিলা। সে নাকি একেবারে মেমসাহেব, একমাত্র মনীষা অর্থাৎ আমাদের ফিনকিকে ছাড়া কাউকে পাত্তা দেয় না। ওদের প্রিন্সিপ্যাল কত রাগী, বাংলার টিচার বানান ভুল করেন। হিস্ট্রির টিচারকে ওরা কত ভালবাসে, পড়ান মোটামুটি কিন্তু চমৎকার চমৎকার শাড়ি পরেন, খুব গ্ল্যামার। গ্ল্যামারই, ঠিক সুন্দর নয়। সে যদি বলো সায়েন্সের বল্লী নায়ার খুব মিষ্টি। কালোর ওপর এত সুন্দর যে…।

এত কথা, প্রতিদিনের খুঁটিনাটি, তা ছাড়া মনের কথা প্রাণের কথা ফিনকি মোটের ওপর সবাইকেই বলে। দাদু থেকে শুরু করে আমি পর্যন্ত। দাদাকে ও একগাদা ফরমাশ করেছে। গালার চুড়িবালা, সালোয়ার কামিজ এবং দিল্লির চটি।

দাদা ভুরু কুঁচকে মিটিমিটি হেসে বলেছিল—মনে হচ্ছে আমার কলেজের পাশেই তোর গালা না ফালার দোকান, চটিগুলো বোধহয় গেটের কাছেই ফুটপাথে বসে।

—ওসব জানি না—মাথা ঝাঁকিয়েছিল ফিনকি—আমি কাগজের ওপর আমার পায়ের মাপ ভাল্লো করে এঁকে দিয়েছি। চটি ভীষণ সস্তা ওখানে, লাল সবুজ সব রকম দেখে এনো ঠিক।

দাদার দিল্লি যাওয়াটা ওর কাছে বেশ একটা আনন্দের ব্যাপার। দিল্লি একটা সব পেয়েছির দেশ— ওর কাছে। সে সব সরবরাহ করবার জন্যেই দাদা যাচ্ছে, চাকরি-টাকরি গৌণ। কিন্তু আমি হস্টেলে যাচ্ছি শুনে ওর ঠোঁট ফুলতে লাগল।

—তুই না দেখলে আমি পাশ করব কী করে?

বাড়িতে একমাত্র ফিনকির সঙ্গেই আমি অনেক সময় কাটাই। সব বিষয়ে পড়াশোনার জন্য ও আমার ওপর নির্ভর করে। ওকে আর মাকে আমিই আত্মীয় বাড়ি, সিনেমা ইত্যাদি নিয়ে যাই।

বলি—এই তো এইখানে শিবপুর, প্রতি সপ্তাহে আসব, ভাবনা কী?

—ঠিক আসবি তো?

—ঠিক। না হলে তুই পাশ করবি কী করে?—দুজনেই হাসি।

এই রকম একটা ভূমিকা তৈরি হয় আমার হস্টেল-যাত্রাকে ঘিরে। বড় একটা স্যুটকেস মা দিয়েছেন। বোধহয় মায়ের বিয়ের সময়কার। ভাল চামড়ার। ভেতরে বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড় থেকে যে বইগুলো আপাতত কিনতে পেরেছি সেগুলো, দাদুর দেওয়া ডায়েরিটা পর্যন্ত সবই আছে। মা গুছিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমি জানি মায়ের বহু কাজ, সময় বার করা খুব শক্ত। ফিনকি একটু আধটু সাহায্য করেছে। ব্যাস।

কিন্তু মা ও কথাটা বললেন কেন?— তা যদি বলেন বাবা, আমি আপনাকে ছাড়া কারও কাছেই কিছু আশা করি না।

এই প্রথম বাড়ির কারও কথা আমার মনে ঢেউ তুলল। সত্যিই, মায়ের কথা আমরা কে কতটুকু ভাবি? দাদা আর আমি নিজেদের নিয়ে থাকি। বাবাও এক রকমের তাই। আমরা নিঃশব্দ বাবা সশব্দ এইটুকু তফাত। আদুরে বোনটাও মায়ের চেয়ে বাবার কাছেই ঘেঁষে বেশি। বাকি তো থেকে যাচ্ছেন দাদুই। দিদারা দুই বৃদ্ধা, জপতপ, পুজো-অর্চনা নিয়ে থাকেন। তাঁদের প্রয়োজনগুলো মাকেই মেটাতে হয়। মটকার কাপড় পরে পুজোর জোগাড় করে দেওয়া, নিরামিষ রান্না উনুন পেড়ে করে দেওয়া। আমাদের রাঁধুনি মেয়েটি বামুন নয়। তার হাতে ওঁরা খান না। আমাদের এমনিতেই তিন চার রকম রান্না হয়, দিদারা পুরো নিরামিষ, দাদুর হাই ব্লাডপ্রেশার, নুন চলে না, বাবা মশলাদার রান্না ছাড়া খেতে পারেন না, আমরা তিন ভাই বোন মোটামুটি অল্প মশলা পছন্দ করি, কিন্তু কেউ এ ডাল খায় না, কেউ ও ডাল খায় না, কারও কাঠি আলুভাজা চাই, কারও গোল, মায়ের ঠিক কী পছন্দ, শেষ পর্যন্ত মা কী খান, জানি না। জানবার কথা আগে মনেও হয়নি। ইদানীং দাদু নিজের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তনের কথা আলোচনা করার পর থেকে একটু-আধটু লক্ষ করি। তারপর থেকে আমি রাত্তিরে মাছ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। বাজার আমিই করি। মা মাংস আনতে বললেও একদিনের বেশি আনতুম না। বলতুম—যাঃ ভুলে গেছি। সপ্তাহে অন্তত তিনদিন মাংস না হলে বাবা বড্ড চ্যাঁচামেচি করতেন। বকুনিটা খেতেন মা। সেদিন অমনই চুপচাপ বকুনি খাচ্ছিলেন। আমি নীচে নেমে গেলুম। খাবার ঘরে ঢুকে বললুম— মা আনতে বলেছিলেন, আমিই ভুলে গেছি। একটু চুপ করে বললুম, জিনিসপত্রের দাম খুব। ওই টাকায় কুলোতে পারি না। আমি চাকরি করি, তখন তোমাকে রোজ মাংস খাওয়াবো…।

বাবা আমার ইঙ্গিতগুলো বুঝেছিলেন মনে হয়। চুপ করে গেলেন। বাবা বোধহয় আমাদের অর্থাৎ দাদাকে ও আমাকে কিঞ্চিৎ ভয় করতেও শুরু করেছিলেন। আমরা তাঁকে যতটা, তিনি আমাদের তারও বেশি।

মা ইদানীং খুব রোগা হয়ে যাচ্ছিলেন। আমার কেমন মনে হচ্ছিল আমাদের ঠিক আগের মতো খাওয়াতে গিয়ে মা নিজের খাওয়া-দাওয়া কমাচ্ছেন। এমনিতেও তেমন যত্ন-আত্তি করতেন না। নিজেকে নিজে যত্ন করতে মায়েরা চিরকাল লজ্জা পেয়ে এসেছেন। তখন পরীক্ষা শেষের ছুটি চলছিল, একদিন দুপুরে সন্তর্পণে নীচে নেমে গেলুম, খাবার ঘরের দরজা দিয়ে উঁকি মেরে দেখি মা এক থালা ভাত খাচ্ছেন, সুদ্ধু ভাত, একটু গলা-গলা, দুটো কাঁচা লঙ্কা, দুটো পেঁয়াজ, একটু কাঁচা সর্ষের তেল ঢেলে নিলেন।

আমাকে মা দেখতে পাননি। চুপচাপ ওপরে চলে এলুম। পর দিন খাবার সময়ে বললুম—মা, আমার একটা জিনিস খেতে ইচ্ছে করছে, দেবে? মা একটু সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন, মুখটাতে কালি নামছে, ছেলে কী চাইছে, তিনি দিতে পারবেন কি না। আমি বললুম— দুটো কাঁচা লঙ্কা, দুটো কাঁচা পেঁয়াজ যদি থাকে, আর একটু কাঁচা সর্ষের তেল।

মা স্তব্ধ হয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলেন। কিন্তু আমাদের মধ্যে এমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল না যে আমি মাকে খাওয়া-দাওয়া নিয়ে বকাবকি করি বা মা তা নিয়ে আর কিছু বলেন।—যা দিচ্ছি এখন খাও তো! পাকামি করতে হবে না-গোছের। মাছ খাওয়াও আমি ছেড়ে দিলুম। বললুম— ওয়াক ওঠে।

এরপর দাদু একদিন খাওয়ার পরে ডাকলেন— সমু। তুমি আজকাল মাছ খাচ্ছ না। ওয়াক ওঠে তোমার মা বলছিলেন। এ তো মুশকিলের কথা, ডাক্তার দেখাতে হয়, জনডিস-টিস হল না কি? তুমি না কি সর্ষের তেল দিয়ে ভাত মেখে কাঁচা লঙ্কা পেঁয়াজ দিয়ে খাচ্ছ!

আমি বললুম— গরিব লোকেরা তো এ রকমই খায় দাদু।

দাদু বললেন— তুমি অনর্থক আমার অবস্থাটাকে বড্ড বেশি খারাপ মনে করছ ভাই, এতটা দরিদ্র হইনি যে তোমাকে পেঁয়াজ লংকা দিয়ে ভাত খেতে হবে। ওসব কথা তোমাকে বলা বোধহয় আমার ঠিক হয়নি।

আমি বললুম— মা’র রেগুলার এই-ই ডায়েট আজকাল, যতদিন মা খাবেন আমিও ওই-ই খাব। আমার কোনও অসুবিধে নেই।

দাদুর মাথা ঝুলে গেল। কোনও কারণে খুব দুঃখ পেলে, লজ্জা পেলে দাদুর এটাই ছিল ভঙ্গি।

আমি বারবার ফেল করছি— উনি বললেন— তোমার মা সারাদিন শরীর পাত করে আমাদের সেবা করছেন। আমি ওঁর কোনও খোঁজ রাখিনি, ছিঃ! তুমি আমায় মাফ করো সমু।

মাকে উনি কী বলেছিলেন জানি না, পরদিন মা দুপুর দুটোর সময়ে আমাকে ডাকলেন। নীচে নামতে বললেন— কী খাচ্ছি দেখে যাও সমু। এই দ্যাখো আমার ডাল, মাছ, তরকারি। আশা করি কাল থেকে আর আমায় জ্বালাবে না।

—আমি তো রোজ রোজ ইন্‌স্‌পেকশনে আসতে পারব না!

—আচ্ছা, আমি তোমায় কথা দিচ্ছি।

—আশা করি, তোমার মিথ্যে কথা বলার অভ্যেস নেই।

মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তারপর আমার চোখে চোখ রেখে বললেন— না।

—মা আমি কিন্তু তোমাকে বিশ্বাস করছি।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *