Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সমুদ্র যাত্রা || Bani Basu » Page 12

সমুদ্র যাত্রা || Bani Basu

এত বড় জঙ্গল, এত ঘন, নিবিড় কিন্তু আমি আর দেখিনি। দেখেছি ঝাড়গ্রামের কাছে কোঁকড়াঝোড় কিন্তু এরকম গহিন নয়। লম্বা লম্বা গাছ। কী এগুলো? শাল না কি? কিন্তু অনেক ধরনের গাছ আছে। লম্বাই, কিন্তু একরকম নয়। গাঢ় সবুজ প্রায় কালচে পাতা, আবার কিছুটা হালকা সবুজ। হাঁটতে হাঁটতে পথের সামনে আড়াআড়ি পড়ে থাকে গাছের ভাঙা ডাল, পায়ের ধাক্কায় সরিয়ে ফেলি, ঝোপ ঝাড়ে নিশ্ছিদ্র হয়ে যায় পথ। একটু এদিক-ওদিক দেখে টপকে পেরিয়ে যাই ঝোপ। সড়সড় করে চলে যাচ্ছে ওটা কী সাপ? এ রকমের সাপের কথা আমি জানি না। ঘোর বাদামি রং, বেশ কাছির মতো মোটা। আলো পিছলোচ্ছে এমন মসৃণ গা। কোথা থেকেই বা এই আলো আসছে? তারপর বুঝি, সাপটা, সাপটার ভেতর থেকেই আসছে আলোটা। আলোর সাপ। বিজ্ঞানীরা তো বলেন সাপের মাথার মণি-টনি সব বাজে কথা। কিন্তু এটার কী ব্যাখ্যা দেবো? কোনও অভ্যন্তরীণ মণি থেকেই এ-আলো যদি বেরোয়। পৃথিবীতে কত আশ্চর্যই তো আছে! না হয় একটা বাড়লই। মনে মনে নোট করতে থাকি কী লিখব, এটা নিয়ে একটা অন্তত প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ লেখা উচিত। ইতিমধ্যে সাপটা আমার খুব কাছে চলে এসেছে, খেয়াল করিনি। ফণা তুলে দাঁড়িয়েছে। ফণাও আছে তা হলে? ফণার ওপর ধবধবে সাদা সব চিহ্ন, কী সুন্দর প্রাণী! আমার ভয় করছে না কেন। আমার কি ভয়ও নেই? সাপটা আমাকে জড়িয়ে জড়িয়ে উঠছে। কেমন ভয় না পাও দেখি! একেবারে গলার কাছে চলে এসেছে, আমি প্রাণপণে টেনে তাকে নামাবার চেষ্টা করছি। পারছি না। তারপর গলাটা বুজে আসতে লাগল, আমি একটা ঝটকা মারলুম। আইলের সিট আমার, পাশে এক ভদ্রলোক নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছিলেন, আমি বোধহয় ঝটকাটা সত্যি মেরেছি। ঘুমে লাল চোখে আড় নয়নে দেখছেন। ঝটকাটা আমি মেরেছি না উনি নিজেই নিজেকে মেরেছেন স্থির করতে পারছেন না।

আমি বলি— স্যরি, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কী করেছি…

খুব বিরক্ত চোখে উনি অন্যদিকে চাইলেন। আমাদের তিনটে সিট মাঝখানে দীপারটা ওদিকে, বাঁয়ের প্রথম। ও বেচারি এই সিটটা ভদ্রলোকের কাছ থেকে চেয়ে ছিল। উনি বলেছিলেন—স্যরি, আই কান্‌ট ওবলাইজ ইউ।

আমার বেশ হাসি পেল। দীপার কথা শুনলে এই ঝটকাটা ওঁকে খেতে হত না। দীপাই খেত। খুব বেঁচে গেছে মেয়েটা, ভদ্রলোক এখনও গালে হাত বুলোচ্ছেন। ঝটকা খেলে দীপা আমার যা খোয়ার করত। আমিও সে হিসেবে বেঁচে গেছি।

হোটেলে নিজের নিজের ঘরে গিয়ে স্যুটকেস রাখি, টয়লেট যাই, মুখ হাত ধুই, এ বার এখান থেকে সোজা কনফারেন্স-রুমে। এই হোটেলেরই দোতলায় কনফারেন্স-রুম। দেখি দীপা পাশের ঘর থেকে একইসঙ্গে বেরোলো কিন্তু পোশাক আমূল পাল্টে গেছে। এসেছিল সালোয়ার কামিজ পরে, এখন একটা একরঙা সিল্কের শাড়ি পরেছে। একটু বোধহয় প্রসাধনও করে নিয়েছে। খুব সুন্দর একটা গন্ধ বেরোচ্ছে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল— ড্রেসটা ঠিকই আছে। কোনও ওডিকলোন কি আফটার-শেভ মাখো না?

—নাঃ।

—কেন? শেভ করে কী লাগাও তা হলে?

—অ্যালাম। ফটকিরি।

—এখানেও এনেছ? হেসে ফেলল দীপা।

—নিশ্চয়ই, কখন কী ইনফেকশন লেগে যায়, রক্তটক্ত পড়লে বন্ধও তো করতে হবে।

দীপা বলল— দাঁড়াও, আগে একবার গ্রাউন্ডে চলো তো।

—কেন?

—চলোই না।

গ্রাউন্ড মানে বেসমেন্ট। প্রচুর আলো, ঝলমলে সব দোকান। দীপা চট করে একটা দোকান থেকে এক বোতল কিছু কিনল। বাইরে এসে স্প্রে করে দিল আমার গলায়। হাতের কবজিতে। বলল— শার্টটা একটু ফাঁক করো।

যা ইচ্ছে করুক বাবা, আমি শার্টের ওপর বোতাম খুলি।

ও গেঞ্জির ওপর স্প্রে করে দেয়,— কেমন গন্ধটা?

—চমৎকার, থ্যাংকিউ। তোমাকেও তবে কিছু কিনে দিই একটা?

—পরে। এখন দেরি হয়ে যাচ্ছে।

ঠিক কনফারেন্স নয়। ওয়ার্কশপ ব্যাপারটা। অন্তত ছ-সাতটা রাজ্যের প্রতিনিধি এসেছে। দুটো বক্তৃতা— একটা তার মধ্যে বেশ ক্লান্তিকর। তারপর দলে দলে বিভক্ত হয়ে আমরা আলোচনায় বসলুম, লাঞ্চের পর, প্রত্যেক গ্রুপের আলোচনার সংক্ষিপ্তসার শোনা হবে।

খানিকটা ওয়ার্কশপের সময়ে, খানিকটা লাঞ্চেও অন্তত সাত-আটজনের সঙ্গে রীতিমতো ভাব জমিয়ে ফেলল দীপা। ও ছাড়া আর একজনই মেয়ে। মহিলা। খুব সম্ভব দিল্লির হবেন, পঞ্জাবি। ইনি পরের দিন বক্তৃতা দেবেন। একটু বয়স্ক। রাশভারী এই মহিলা তাঁর পরিচিতদের সঙ্গেই কথা বলছিলেন। দীপা তারই মধ্যে ফাঁক খুঁজে ওঁর সঙ্গে পরিচিত হয়ে এল। হাতে খাবারের প্লেট। অন্য হাতে ফর্ক, দেখি রাশি রাশি কথা বলছে। উনিও বলছেন। চোখে বেশ আগ্রহ। পারেও।

সেদিনের কাজ শেষ হবার পর, দীপা প্রস্তাব দিল, বেড়াতে যেতে হবে। ঠিক আছে বাবা।

একটা ট্যাক্সি নিয়ে আমরা যাই মেরিন ড্রাইভ। চৌপাটিতে খাই। তখন এলিফ্যান্টা থেকে টুরিস্টরা ফিরে আসছে। একটার পর একটা বোট। স্বল্প তরঙ্গ এই সাগর, ফিরতি বোটের ফুটকি, একটু সাদাটে আকাশ, এখনও যথেষ্ট আলো। পুরো দৃশ্যটাই আমায় একটা শান্ত, স্থির নীরবতায় নিয়ে যায়। মাথার মধ্যে একটা আলো জ্বলছে, স্নিগ্ধ প্রদীপের মতো, ক্রমশ সন্ধ্যা হয় আর তিন দিকে হিরে জহরতের জৌলুসে জোড়া বম্বে শহর জেগে ওঠে।

—কী হল সমুদ্র, ধ্যানস্থ হয়ে গেলে না কি?

সত্যিই উদ্ভট আমার এই নীরবতা। পাশে একটি মেয়ে, এত আগ্রহ করে আমাকে বেড়াতে নিয়ে এসেছে। আর আমি চুপ। জেগে জেগেই যেন ঘুমোই মাঝে মাঝে।

—ভাল লাগছিল খুব। জাস্ট চুপ করে ভাল লাগাটা এনজয় করছিলুম। তুমি কিছু মনে করলে?

—বেশ কিছুদিন ধরে তোমাকে স্টাডি না করলে মনে করতুম।

—স্টাডি?

—ইয়েস। আচ্ছা সমুদ্র তুমি কি মানে যোগটোগ করো?

—যোগব্যায়াম আমি নিয়মিত করি। সকালে চা আর খবরের কাগজের মতো যোগব্যায়ামটাও আমার অভ্যাস।

—সেইজন্যেই তোমার স্বাস্থ্য এত ভাল, টাচ উড, আর কী বলব— চেহারার একটা গ্লো আছে। কিন্তু আমি ব্যায়ামের কথা বলিনি। যোগ, মানে ধ্যান প্রাণায়াম, এ সবের কথা বলছি।

—তুমি জানো না ধ্যান প্রাণায়ামও যোগাসনের একটা অঙ্গ। তাদের অবশ্য শাস্ত্রটাস্ত্রর ছোঁয়াচ বাঁচাতে বলা হয় মেডিটেশন, ব্রিদিং একসারসাইজ।

দীপা হাসল— তুমি কি খুব শাস্ত্র মানো? দীক্ষা-টিক্ষা নিয়ে ফেলেছ না কি?

—না তো? আমি অবাক হয়ে বলি। কেন না আমাদের বাড়ির ত্রিসীমায় কোনও দীক্ষা জাতীয় ব্যাপার নেই। দাদু অশীতিপর মারা গেলেন, ঘরে অবশ্যই কিছু মহাপুরুষের ফটো ঝুলত। শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ, শ্রীঅরবিন্দ, সুভাষচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথ। অর্থাৎ শুধু আধ্যাত্মিক নয়, অন্য ক্ষেত্রেরও মহামানবদের। কিন্তু দীক্ষা নিয়েছেন বলে কখনও শুনিনি। দিদারা বালগোপাল, লক্ষ্মী, কালী সব পুজো করতেন। তাঁরা কোনও গুরুর কথা কখনও বলেননি। কিন্তু জপ করতেন। দীক্ষা ছাড়া কি কেউ জপ করে? জানি না। বাবার তো কথাই নেই। মাকেও আমি কখনও ভাঁড়ার ঘরের তাকে রাধাকৃষ্ণর মূর্তিকে ফুল জল দেওয়া ছাড়া অন্য কিছু করতে দেখিনি। তবুও শপথ করে কিন্তু বলতে পারব না— এঁদের আধ্যাত্মিক মত কী। সত্যিই কারও বা কোনও পথের অনুসরণ করেন কি না। কী আশ্চর্য! নিজের পরিবার সম্পর্কে কত কম জানি আমি। আমার বোধহয় লজ্জা হওয়া উচিত।

—কীসে তোমার মনে হল?

—তোমাকে কী রকম আনরিয়্যাল বলে মনে হয় সমুদ্র।

—আনরিয়্যাল?— কথাটা আমার মনের মধ্যে একটা টইটম্বুর জলাশয়ে যেন ঢিলের মতো পড়ল, চারদিক ঘিরে বৃত্ত রচনা হতে লাগল। বৃত্তে বৃত্তে আলোড়ন… আনরিয়্যাল… আনরিয়্যাল… ঠিক এই শব্দটাই আমাকে মাঝে মাঝে ছুঁয়ে যায়। চারদিকে যা দেখছি, যা শুনছি, যা শিখছি সবই যেন অবাস্তব। কখনও বাস্তব, কখনও অবাস্তব। বেশির ভাগ সময়েই একটা বায়বীয় শূন্য পেরিয়ে আমি এখানে পৌঁছই। এটা আমাকে কখনও কখনও মৃদু ভাবিয়েছে। কিন্তু আমি জলজ্যান্ত মানুষটা …আমি কী করে অবাস্তব বলে প্রতিভাত হতে পারি কারও চোখে?

—আমাকে তোমার ভূত-টুত মনে হয় না কি?— হাসবার চেষ্টা করে বলি।

—না, ঠিক তা নয়, দীপা এখন খুব গম্ভীর— কেমন যেন মনে হয় তুমি…তোমার সঙ্গে কিছুর কোনও যোগ নেই। যে-কোনও জায়গা থেকে তুমি হঠাৎ কর্পূরের মতো উবে যেতে পার। কংক্রিট নয় একেবারে। অথচ তুমি খুব র‍্যাশনাল, এফিশিয়েন্ট, ভদ্র…এনিওয়ে ছাড়ো, আজ প্লেনে ওই ভদ্রলোক আর তোমার মধ্যে ছোটখাটো একটা কী যেন হয়ে গেল? কী?

—আরে আর বোলো না, আমি ফিরে আসি অন্য মেজাজে— ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। উনিও। উনিও অঘোরে ঘুমোচ্ছিলেন। একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ঝটকা দিয়েছি। সেটাতে ভদ্রলোকের খুব লেগেছে।

—হঠাৎ দুঃস্বপ্ন? তোমাকে তো দুঃস্বপ্ন দেখার লোক বলে মনে হয় না।।

—দুঃস্বপ্ন দেখারও আবার লোক আছে না কি? হাসালে দীপা, দুঃস্বপ্ন সবাই কোনও না কোনও সময়ে দেখে। তুমি আমাকে কী ভাবো বলো তো? কোনদিন বলবে তোমাকে তো খিদে-টিদে পাওয়ার, ঘুম-টুম পাওয়ার লোক বলে মনে হয় না।

দীপা হাসল।—খিদে তোমার শারীরিক নিয়মে পায় ঠিকই। কিন্তু আমার মনে হয় না কোনও বিশেষ চাহিদা তোমার আছে খাবার-দাবার বিষয়ে। তা ছাড়া দেখো স্বপ্ন লোকে দেখে, মনের ভেতরে কোনও অবদমিত ভয়, চিন্তা, আকাঙক্ষা যদি থাকে। তুমি বিগতস্পৃহ টাইপ। তোমার ভয়, আকাঙক্ষা কিছুই আছে বলে মনে হয় না। এনিওয়ে কী স্বপ্ন দেখলে?

—সাপ। একটা বাদামি রঙের অদ্ভুত চকচকে সাপ আমাকে পেঁচিয়ে ধরছে। গলার কাছটায় আসতে দমবন্ধ লাগল। ঝটকাটা তখনই মারি।

দীপা সমুদ্রের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। মুখে কথা নেই। আমি বলি— সাপের স্বপ্ন দেখলে বংশবৃদ্ধি হয় শুনেছি, আমার দাদা দিল্লিতে, বিয়ে থা করেছে। নিশ্চয় আমাদের একটি বংশধরের শুভাগমন হচ্ছে এবার।

দীপা আমার দিকে তাকাল— এই সব কুসংস্কারে তুমি বিশ্বাস করো?

আমি ঠোঁট ওলটাই— বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা কে বলছে? লোকে বলে, বিশ্বাসটা তাদের অনেক যুগের, আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে কী আসে যায়? তা ছাড়া স্বপ্নের আর মানে কী?

দীপা আমার দিকে তাকাল, বলল— স্বপ্নের কিন্তু মানে থাকে সমুদ্র। তোমার স্বপ্নেরও মানে আছে। সাপের স্বপ্ন আরও দেখেছ না কি? প্রায়ই দেখো।

ভেবে দেখলুম—হ্যাঁ তা দেখি। দেখি বটে। বলি কথাটা ওকে।

এ একটু লালচে মুখে চাইল— কিছু মনে করবে না তো?

—কেন? মনে করব কেন?

—ইউ নিড এ উওম্যান।

—হঠাৎ? একটু চুপ করে থেকে, লাল হয়ে আমিও জিজ্ঞেস করি।

—হঠাৎ নয়। ওই স্বপ্নটার ব্যাখ্যা দিলুম। সাপের মনস্তাত্ত্বিক একটা মানে আছে, প্রতীক, মেল সেক্স।

অনেকক্ষণ দুজনে চুপ করে বসে থাকি। মনের ভেতরে বহু কথা ঘুরতে থাকে। এঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সেই দিনগুলো, যখন হঠাৎ বন্ধুদের সঙ্গে খারাপ পাড়ায় গিয়েছিলুম। দাদু বললেন—‘তুমি বড় হয়ে গেছ।’

—তুমি কিছু মনে করবে না দীপা, আমিও একটা কথা বলি?

—না, না মনে করব কেন? আই লাইক ফ্র্যাংকনেস।

—মেয়েরা কি কখনও সাপের স্বপ্ন দেখে না? আমার বোন ফিনকি একদিন বলছিল—ছোড়দা, একটা কী ভয়ানক সাপের স্বপ্ন দেখেছি রে! তো? তুমিও কি দেখ না?

—দেখি তো! তখনও তার মানে একই থাকে। মেল সেক্স সিম্বল। বেসিক ইনস্টিংক্ট।

সাগরের জল এখন কালো। চারপাশের জড়োয়া আলো তার মধ্যে বিম্বিত হয়ে আছে স্থির। দূরে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছোট জাহাজ। তার মাস্তুলে একটা আলো। হাওয়ায় তারা উড়ছে, চাঁদ উড়ছে, সেই ওড়ার ভাঙা ভাঙা ছবিও সাগরে। এই বিম্বরা তো সব সাগরেই। হঠাৎ দেখলে তো মনে হতেই পারে সবই আছে সাগরের ভেতরে। জল ভেদ করে উঠে আসছে আলো। শিশু হলে নিশ্চয় হাত বাড়াবে, চাঁদ ধরতে যাবে, ‘আয় চাঁদ আয় চাঁদ’ ছোটবেলা থেকে শুনেছে যে! সেই চাঁদকে হাতের এত কাছে পেয়ে ধরতে ঝাঁপ দিতে চাইবে না? অথচ সবই বিম্ব, সমস্ত আলো, সমস্ত রূপের অবস্থান অন্য কোনওখানে। কোনটা সত্যি? যদি আমি, আমরা সবাই, স-ব বিম্ব হই?

—তোমার সেক্স-এক্সপিরিয়েন্স আছে?—দীপা পরিষ্কার গলায় জিজ্ঞেস করল। —উত্তর দিতে আমি তোমায় জোর করছি না। বেশির ভাগ পুরুষেরই থাকে তাই জিজ্ঞেস করছি।

—আছে আবার নেইও।

—সেটা কী রকম?

তখন আমি আমার থার্ড ইয়ারের সেই অভিশপ্ত শনি রবির কথা ওকে বলি। কীভাবে নেশা সত্ত্বেও মেয়েটির উলঙ্গ দশা আমার মধ্যে বিবমিষা জাগিয়েছিল। মুহূর্তে চলে গিয়েছিল সব ক্ষুধা। সে যে কী কুৎসিত, কী কুৎসিত। গলিত কুষ্ঠের মতো, জঘন্য যৌনরোগের ক্ষতর মতো, অকথ্য আঁস্তাকুড়ের মতো।

এ সব কথা আমি কাউকে কখনও বলিনি। এমনকী পুলককেও না। শুধু পাপবোধে নয়, সত্যি-বন্ধু কেউ ছিল না বলে। সাক্ষী আছে মৃণাল। সাক্ষী আছে নৃপেশ। সেদিন নিষ্ঠুর ঠাট্টায় আমাকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে দিয়েছিল। আমি ন্যাকা, আমি পুরুষত্বহীন, আমি সমকামী… আরও কী কী সব। সে সব কথা শুনলে পুলক খেপে যেত, পিটিয়ে ছাতু করে দিত ওদের। কিন্তু আমার তখন পেটের সমস্ত নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসার জোগাড়। আমি টলতে টলতে চলে আসি। পরে যখন ওরা সাহস দেয়, বলে প্রথমটা ও রকম লাগলেও পরে ঠিক হয়ে যাবে, আমি ওদের কীভাবে ঠান্ডা গলায় বলি— আমি নপুংসক, তোমরা আমাকে ফার্দার বিরক্ত করবে না।

এই সমস্ত আমি বলি। দীপাকে।

আর একটু রাত হলে বিচে হাঁটতে থাকি। দীপার সাদা-কালো সিল্ক শাড়ির সাদাগুলো ঝলকায়, কালোগুলো সাদার পটে ফুটে ওঠে। ওর ছোট ঢেউ খেলানো চুলের দোল দেখতে পাই। এগুলো আগে কখনও দেখিনি। অন্ধকারে ওর সাদা চৌকো গড়নের চোয়াল জেগে থাকে, চোখে মাঝে মাঝে আলো পড়ে, মাঝে মাঝে অন্ধকার। হাতের সোনার বালা সোনালি সরীসৃপের মতো ঘিরে থাকে মণিবন্ধ। আমার সাদা পাঞ্জাবি ওড়ে। রুমাল বার করে মুখ মুছি, হঠাৎ হাত থেকে রুমালটা উড়ে যায়। কোথায় কে জানে? চলতেই থাকি, চলতেই থাকি, কিছুক্ষণ পর পেছনে— সাব, সাব, মেমসাব, মেমসাব! ভেলপুরিওয়ালা আমার রুমাল দিয়ে যায়। তাতে ভিজে বালি আটকে আছে।

ঘুম আসে না। যদি বা একটু আসে, মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। নিশুত রাতেও বম্বের বহুতল হোটেলের সর্বোচ্চ তলায়ও রাস্তার আলো ঢুকে অন্ধকারকে পাতলা করে দেয়। রাত-আলো জ্বালবার দরকার হয় না। লাল কার্পেট এখন জমাট রক্তের মতো কালচে দেখায়। টেবিল-চেয়ার-কৌচ— সব আলোর উল্টোদিকে বস্তুপিণ্ডের শিলুয়েৎ। আমি টয়লেটে যাই, চান কি করব এই মাঝরাতে? সাদা মার্বেলের বাথ-টবটা আমায় খুব লোভ দেখায়। ঠান্ডা জল, ঠান্ডা স্বচ্ছ, তলা অবধি দেখা যাবে। কোথাও কোনও রহস্য নেই। ডুবে থাকব, শীতল হয়ে যাবে কঠিন শরীর। যদি চান করতে করতে ডুবে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়ি! যদি মাথাটা পিছলে জলের মধ্যে পড়ে যায়? জলের তলায় বিম্ব। অনেক আলো, অনেক শ্বেত-শুভ্র, অর্চিষ্মান, অনেক অবর্ণনীয় রূপ!

স্টপার লাগিয়ে টবটা ভরতে দিই। অনেকটা সময় নেয়, কিন্তু ভরে যাওয়ার পরেও আমি তাতে পা ডোবাই না। খুব কৌতূহলের সঙ্গে দেখি। বিরাট টব। চমৎকার জল। তারপর হঠাৎ ফিরি। ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসি, চাবি দিই। একটা ঘর পরে দীপার ঘর। নক করি। সামান্য সময়, তার পরে দরজা খুলে যায়।

রাত-পোশাক পরা কোনও মেয়ে আমি কখনও দেখিনি। অসাধারণ সুন্দর এই পোশাক। লেসে-লেসে ভরা, সেই এলিজাবেথীয় কিংবা ভিক্টোরীয় যুগের গাউন-টাউনের মতো। শুধু কোমরের কাছ থেকে ওই রকম কৃত্রিম ভাবে ছড়িয়ে যাওয়া নেই। কুঁচিতে কুঁচিতে কোমর ঘিরে বড় মোহন ভঙ্গিতে লুটিয়ে রয়েছে। দীপা আমার পেছনে দরজা বন্ধ করে দেয়।

—দীপা আই নিড ইয়ু।

—ইউ নিড আ উওম্যান সমুদ্র, আই টোল্ড ইউ। মনে হল ওর চোখে জল চকচক করছে।

জল? না আলো! বুঝতে পারি না। জল ভেতর থেকে আসে, আলো বাইরে থেকে।

জিজ্ঞেস করি— তফাতটা কী?

—তফাত? তোমার কাছ থেকে এটা আশা করিনি।

—আই মীন তুমি, তোমাকেই আমার বড্ড দরকার।

—তুমি কি নিশ্চিত? না আজকের কথাবার্তার একটা ফল…

—হতে পারে। কিন্তু ভেতরে তো ছিলই।

—সমুদ্র, সাপ থাকে বাইরে… ভেতরে… ভেতরেরটাকে হয়তো বাইরেরটা উসকে দেয়। কথা… পরিবেশ… নির্জনতা এই সব সুযোগের অপেক্ষায় থাকে সে…। আমি হয়তো সেই সাপিনী, …এসব সময়ে মন থাকে না, …শরীর শুধু শরীর থাকে।

আমি অনভ্যস্ত আবেগে দৃঢ় থেকে বলি— আমি কখনও কোনও ভগবানকে ডাকিনি দীপা, কেন না কারও কাছে আমার কোনও প্রার্থনা ছিল না। আজ আজই একমাত্র আমার ভেতর থেকে প্রার্থনা উঠে আসছে, তোমার জন্য।

দীপা দু’হাতে মুখ ঢাকল। আর আমার যে কী হয়ে গেল। আমি তার হাত সরিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট রাখি। অসহ্য সুস্বাদ, তুলতুলে, আমার ভেতরটা যেন ক্রমে গলে যাচ্ছে। নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরি তাকে বুকে। আমার স্ফীত পেশির ওপর তার তুলতুলে বুক এক দাহহীন জ্যোতির্ময় আগুন জ্বালায়। আমার ইস্পাত ক্রমাগত মহাসুখে মহাপ্রেমে ও মহা নিষ্ঠুরতায় আঘাত করতে থাকে তাকে যতক্ষণ না সে আমাকে পথ করে দেয়।

আহ্‌ সমুদ্র আহ্! আরও আরও ছিঁড়ে ফেলো আমাকে, ধ্বংস হয়ে যাই।

‘নক্‌, নক্‌, নক্‌’— ভোর-চায়ের জন্য ডাক এসেছে। জানে না এখানে দু’জন মানুষ খুন হয়ে গেছে। আমার বুকের ওপর শুয়ে ঘুমোচ্ছে সে। আস্তে জাগিয়ে দিই। জেগে সে ছেলেমানুষের চোখে চারদিকে তাকায়। তারপর লাফিয়ে নামে, কার্পেটে একটা বেড়াল লাফাবার হালকা শব্দ হয়। বড় বড় পা ফেলে দরজা খোলে সে, সামান্য—‘চায় নহি চাইয়ে’, দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর ফিরে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার বুকে, এবার আমি ভোরের আলোয় তার চোখ দেখি। নাক, কান, ঠোঁট, যাকে সমগ্রে পেয়েছিলুম তাকে খণ্ডে খণ্ডে পেতে চাই। নরম হাতে আদর করি, তার রাত পোশাকের ফাঁস খুলে দিই, তারপর ভোরের বিছানায় সেই বাদামি সর্পিণীকে দেখি। ভেতরের আলোয় ভাস্বর। ফণায় শুভ্র আলপনা। এক হাতে তার চিত্রিত ফণা আর এক হাতে তার উত্তেজক লেজ মুঠো করে ধরে আমি তার অমৃত ছোবল নিই, ফিরিয়ে দিই, বারবার, বারবার।

রাতের ধরা ঠান্ডা জলে ডুব স্নান। মাথায় শ্যাম্পু। বাথসল্টের গভীর থেকে সুগন্ধ। কী সব ছোট ছোট বোতল। বডি লোশন। মেয়েরা মাখে, না কী? পুরুষ বোর্ডারের ঘরে মেয়েদের জিনিস রাখবে এমন দরের হোটেল তো এ নয়? ফাইভ-স্টার না হোক ফোর-স্টার। লোশনটা মেখে ফেলি। সুগন্ধ চারিয়ে যায়। খুব তাজা লাগে। গায়ে শার্ট চড়াই, ট্রাউজার্স। নাঃ টাই আমার আসে না। টাইটা বেশি পরে এগজিকিউটিভ ক্লাস। আমাদের কাজ করতে হয় ভাই। মোজা পরে জুতো গলাই, ফিতে বাঁধি। ঘরের দরজা বন্ধ করি। চাবিটা কাউন্টারে জমা দিই। সবটাই একটা ঘোরের মধ্যে। কনফারেন্স রুমে শেষ বক্তৃতা। তারপর এরাই হোটেল থেকে বন্দোবস্ত করে আমাদের কিছু সাইট-সিয়িং-এ নিয়ে যায়। সমুদ্রের মৃদু ঢেউয়ের মধ্যে দিয়ে পথ কেটে কেটে বোট এলিফ্যান্টা যায়। দাঁড়িয়ে থাকি ছ’ফুটের লম্বা সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের দেবমূর্তির সামনে। সৃষ্টি হয়ে গেছে, স্থিতি চলছে, এবার প্রলয়ের অপেক্ষা।

—সমুদ্র!— দীপা আস্তে করে ডাকল। এতক্ষণ ও দিল্লির সেই ভদ্রমহিলার সঙ্গে একটার পর একটা শিবমূর্তি দেখে বেড়াচ্ছিল। যেন ও প্রত্ন-গবেষক, শিবমূর্তির এক্সপার্ট।

আমি মুখ ফিরিয়ে তাকাই— দেখো দীপা শিবমূর্তি! এত শিবমূর্তি। ইনি তো ধ্বংসের দেবতা, এঁকে লোকে শিবই বা বলে কেন, ভালই বা বাসে কেন?— আমি জিজ্ঞেস করি।

দীপা আমার মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর বলল— স্যরি। আ অ্যাম স্যরি সমুদ্র।

কেন এ কথা ও বলল আমার ভাল বোধগম্য হল না। ও কি মনে করছে ও আমাকে সিডিউ্‌স করেছে? আমার অনুতাপ হচ্ছে? উঁচু-নিচু পাহাড়ের গা টপকে টপকে নেমে আসতে থাকি। সব মূর্তি, পাহাড়, সমুদ্র, এতগুলো মানুষ, দূর থেকে ক্রমশ এগিয়ে আসা গেটওয়ে অব ইন্ডিয়া সমস্ত কেমন অবাস্তব লাগে। উজ্জ্বল হলুদ সালোয়ার কামিজ পরা ওই বিষণ্ণ কিন্তু তীব্র মেয়েটি কে? বোধহয় অলৌকিক।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress