সমুদ্র যাত্রা (Samudra Jatra) : 01
ঘুমের মধ্যে আমি বাড়ি দেখি। জঙ্গলের মতো জনহীন, দিঘির মতো অথই, দুর্গের মতো নিচ্ছিদ্র, ফাংগাসের মতো ছত্রাকার, আবার ফাঁকা হাতায় লম্বা দেউড়ি নিয়ে ব্যাপক বাড়ি। কোনওটাই ছোটখাটো নয়। এত বিরাট যে তাদের এ মুড়ো থেকে ও মুড়ো, নীচ থেকে ওপরে যেতে অনেক সময় লাগে। অত সময় ঘুম কাউকে দেয় না। তাদের আদি-অন্ত, নীচ-মহল ওপর-মহল আমার অজানাই থেকে যায়। দেউড়ি থেকে শুরু করি, কখনও কোনও রহস্য-চাতালে, কখনও অফুরান বারান্দার মাঝ-মধ্যিখানে শেষ।
দুর্গ-বাড়িটা একটা কালো মাঠের মধ্যে। কালো, খোলা মাঠ। কিন্তু সে খোলা মাঠ আটকে দিয়েছে গম্ভীর পাঁচিল। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকি দিনের পর দিন। ছায়া-শরীরেরা ইশারায় আমায় ডেকে নিয়ে যায়। এ ঘর থেকে ও ঘর, ও ঘর থেকে সে ঘর, সব ঘর থেকে সব ঘরে যাওয়া যায়। কিন্তু একটা দরজা বন্ধ করে দিলেই সব শেষ। ভেতরে-যাওয়া কিংবা বাইরে আসা। কোথাও কোনও জানলা নেই। ভয় পেয়ে ছুটে বেরিয়ে আসি। দরজার পাল্লাগুলো মরচে-ধরা কব্জার ওপর ক্যাঁচ-কোঁচ শব্দে নড়ে। ভয়াল ভ্রূকুটি করে চাপা গর্জন করে দুর্গ। যেন ভীষণ বদমেজাজি রাগী মানুষ একটা, কথার অবাধ্যতা সইতে পারে না। তারপরে দেখি আমার পরনে একটা সুতোও নেই। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ি। কেন না অনেক দূর দিয়ে ছায়া-মানুষেরা যাচ্ছে। তাদের কেমন চেনা-চেনা মনে হয়। ঘামে ভিজে গেছি দেখি।
ছত্রাকার বাড়িটা আরও অদ্ভুত। তার ঘর উঠোন বারান্দা সব আলাদা আলাদা দাঁড়িয়ে আছে। যেন কেউ বাড়িটাকে একটা বিশাল কৌটোর মধ্যে ঢুকিয়ে প্রচণ্ড রকম ঝাঁকানি দিয়ে দশ-পঁচিশের ঘুঁটির মতো ছড়িয়ে দিয়েছে। সব ঘর বারান্দার ছাত খুলে গেছে। এক ঘর থেকে আরেক ঘরে আমি লাফ দিয়ে চলে যাই। নষ্ট কুয়োর মতো গোল ঘর। শ্যাওলার চৌবাচ্চার মতো চৌকো ঘর। ঘুরে বেড়াই নিশ্চিন্তে। কেন না আমি উড়তে পারি। আগে যে কথাটা জানতুম না সেটা আশ্চর্য মনে হয়। আফসোস হয়, আগে জানা থাকলে কত নতুন দেশে ভেসে যাওয়া যেত। লোকে কি সেভাবেই যায়? দেশভ্রমণে, তীর্থযাত্রায়? অথচ ট্রেন, অথচ বাস, জাহাজ, উড়োজাহাজ! কেন? কেন! তখন বুঝতে পারি অন্য কেউ পারে না, আমি একাই পারি, জলের তলার অদৃশ্য ডাঙায় লগি দিয়ে ঠ্যালা মেরে যেমন নৌকাযাত্রা, সেরকমই। গুপ্ত ক্ষমতা। আমার একার।
আবার অনেক সময়ে প্রশস্ত হাতায় উড়ে বেড়ায় শুকনো শালপাতা, খড়কুটো, বহুদিনের চাপা ধুলো। বড় বড় থামের মাথায় কবুতর কুবকুব করে, দেখে বুঝি। আওয়াজ শুনি না। তিন মানুষ উঁচু সিং দরজা। খোলা হা হা করছে। চলে যাও, কেউ তোমাকে বাধা দেবে না, ঢুকে যাও। রোয়াক দিয়ে ঘেরা চৌকো উঠোন দ্যাখো। ওপর দিকে চেয়ে দ্যাখো আদ্যিকালের সিসে রং আকাশ, যেন কোনও বহুদিনের পুরনো সিন্দুক থেকে বার করে টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। ছ্যাতলা-পড়া সাদা পাথরের ঘর। দরজার মতো বড় বড় জানলা। বাইরে তাকালে পড়ো জমি, চোখ অন্ধ করা ভগ্নস্তৃপ—কোনও ঘর, ছাত, দালান ধসে পড়ে আছে। বাড়ি ঘিরে ভেতর বাড়ির গোলবারান্দা, বাইরেও দোতলা তিনতলা, চারতলা ঘিরে বারান্দা চলেছে এক অন্তহীন পথের মতো। বাড়ির গাঁট থেকে দেওয়াল ফাটিয়ে, ফুঁড়ে উঠেছে ভূতের মতো বট-পাকুড়। তাদের বিস্তৃত শেকড়ের নিশ্বাস আমি শুনতে পাই। ছড়িয়ে যাচ্ছে দেওয়ালময়। ভয়, বিস্ময়, আহ্লাদ তেমন কিছু তো কই হয় না। বাড়িটা তার ঘর, দোর, দালান, উঠোন, বারান্দা, থাম, তার ভগ্নতা ও ভয়াল আগাছা নিয়ে এক ধরনের বাস্তব। ছায়া-বাস্তব। কোথাও ওর কিছুই স্বীকার বা অস্বীকার করা যাবে না। আমি এখানে কেন? আমার সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক? কী খুঁজছি? কিছু খুঁজছি কী? না কি কেউ আমাকে এই বাড়িগুলো পর পর দেখিয়ে যায়, বাড়ির দালালরা যেমন দেখায়। যদি কোনওটা পছন্দ হয়।
সারা জীবন এই স্বপ্নগুলো না-ছোড় ফিসফিস করে। ফিরে ফিরে আসতে ওদের কোনও ক্লান্তি নেই, লজ্জা নেই।
যারা খুব অন্তরঙ্গ একমাত্র তাদেরই আমি এই স্বপ্নের বাড়ির কথা বলেছি। এরকম মানুষ আমার জীবনে খুব কম। যেমন দাদু। দাদুই বোধহয় ছিলেন সবচেয়ে কাছের মানুষ। তাঁর, একমাত্র তাঁরই সারাদিনের কার্যক্রম আমি খুব আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ করতুম। একই কাজ করছেন, কিন্তু প্রতিদিন যেন নতুন করে, কেমন একটা ছন্দ আছে, তাতে কোনও একঘেয়েমি নেই। বামুন ঠাকুরের পড়া পাঁচালি নয়, বেশ যত্ন নিয়ে শব্দ বেছে বেছে লেখা এক উপাখ্যান। পুরনো দিনের একটা রাজকীয় স্টুডিবেকারে চড়ে স্যুট-কোট-টাই পরে, হাতির দাঁতের মুণ্ড-অলা ছড়ি নিয়ে তিনি হুস করে অফিস যেতেন। সেটা ছিল তাঁর কর্মজীবনের শেষ দিক। তাঁর চুলগুলো সব ধবধবে সাদা হয়ে গিয়েছিল। তিনি এক কোটি-কোটিপতি ব্যক্তির এস্টেট-ম্যানেজার ছিলেন। কোনও কোনও সংস্থার ডিরেক্টরও ছিলেন। যেমন এক গ্লাস ফ্যাক্টরি। বাব্ল উঠে যাওয়া কাচের জিনিস আমাদের বাড়িতে প্রায়ই আসত। বড় বড় রঙিন ফুলদানি, সুন্দর সুন্দর গ্লাস, কিন্তু একেকটা একেক রকম, প্লেট আসত ছাপ ঠিকমতো ওঠেনি, ভাল পালিশ হয়নি। এইসব খুঁতো, বুড়বুড়ি ওঠা জিনিসই ডিরেক্টরদের বাড়ি আসত। কেউ এ নিয়ে কোনও প্রশ্ন তুলত না, খালি মা দুঃখিত গলায় মাঝে মাঝে বলতেন— কখনও কি নিখুঁত জিনিস আপনাকে দেওয়ার কথা মনে হয় না কারও? এত করছেন!
দাদুকে বলতে শুনেছি— মানুষ যেমন নিখুঁত হয় না, জিনিসও তেমন। যা পাচ্ছি, যা পাচ্ছ বউমা, যার হাত দিয়ে যেমনই আসুক সব ঈশ্বরের দান, খুঁতো বলে কি তুমিই ফেলে দিয়েছ? কত যত্ন করে যে সাজিয়ে রেখেছ!
আমার নিজের ঠাকুমা আমার জন্মের আগেই মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু আরও দুই ঠাকুমা ছিলেন—বড়দিদা আর ছোড়দিদা। আর কোনও দাদু বেঁচে ছিলেন না। জ্যাঠামশাই বিয়ে করেননি, কোথায় যে থাকতেন, তখন জানতুম না, কাকা ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের চাকুরে, খুব বদলি হতেন, আমার যখন জ্ঞান হয়েছে তখন কাকা আমেদাবাদে। পরে সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে কানাডা চলে যান, আমি তাঁকে কখনও দেখিনি। আমার বাবা, বলবার মতো বড় কিছু করতেন না, কিন্তু তাঁর দাপট ছিল খুব। নাম রাজকুমার। দাদুকে গরিব-গুর্বো লোকেরা ভালবেসে রাজাবাবু বলত, তারাই বোধহয় মুখে মুখে রাজকুমার নামটা চালু করে। দাদুর দ্বিতীয় সন্তান আমার বাবা ছিলেন রীতিমতো সুপুরুষ। একটা বি. এ ডিগ্রি ছিল। দাদুর দৌলতে বড় বড় পোস্টে চাকরি পেতেই পারতেন। কিন্তু নিতেন না। তাঁর মত ছিল বাবার বন্ধু বলে যাঁরা তাঁকে স্নেহ করেন, খাতির করেন, তাঁদের তিনি ওপরওয়ালা ভাবতে পারবেন না। সাফ কথা। ভাল ছাত্রও ছিলেন, কিন্তু ইউনিভার্সিটির ছায়া মাড়াননি। ডিগ্রি নিয়ে কী হবে? তিনি কি কোনও ডিগ্রিধারীর থেকে কম পড়াশোনা করেন? সুতরাং তিনি থাকতেন তাঁর মর্জি মেজাজ অনুযায়ী রাজকুমারেরই মতো। বাড়িতে তিনটি বুড়ো মানুষ ও নিজের মেজাজি স্বামীকে সামলাতে মা হিমশিম খেতেন। আমরা জ্ঞান হয়ে থেকে তাঁর সঙ্গ তেমন পাইনি। বাবাকে ঘোর ভয় পেতুম এবং অপছন্দও করতুম। আমার একমাত্র আকর্ষণ ছিল দাদু নামে সেই বৃদ্ধ অথচ কর্মঠ, বাস্তববোধসম্পন্ন অথচ স্নেহশীল মানুষটির প্রতি।
সন্ধেবেলা দাদু ফিরে এসে শরবত কি এক গ্লাস হরলিক্স খাবেন, তারপর আমাদের নিয়ে বসবেন। দাদা এত ভাল ছাত্র ছিল যে নিজেই সব বুঝে করে নিতে পারত। খুব মাঝে মাঝে ছাড়া সাহায্য দরকার হত না। ফিনকি আমার বোন সন্ধে হলেই মায়ের আঁচল ধরে ধরে ঘুরবে। বাকি রইলুম আমি। পড়ি, গল্প করি। যত প্রশ্ন যত মনের কথা পাঠ্য এবং পাঠ্যের বাইরে সবই দাদুর কাছে, দাদুর সঙ্গে। পড়ছি, পড়ছি হঠাৎ হয় তো বইটা ঠেলে সরিয়ে রাখলুম।
—কী হল? বুঝতে পারছ না? না ভাল লাগছে না?
—আচ্ছা দাদু, স্বপ্নের কোনও মানে থাকে?
—খারাপ স্বপ্নের মানে থাকে না। ভাল স্বপ্নের মানে থাকে— দাদু হেসে বললেন— কী স্বপ্ন দেখেছ, ভয় পেয়েছ?
—না বাড়ি। খালি বাড়ি…
স্বপ্নগুলো দাদুকে সবিস্তার বলি।
দাদু কখনও আমার কোনও কথা উড়িয়ে দিতেন না। মন দিয়ে শুনতেন, তর্ক-বিতর্কও করতেন যেন আমি তাঁর সমান বয়সি। ভুরু কুঁচকে একটু ভাবলেন। তারপর বললেন—তুমি তো মাৰ্বল প্যালেস দেখেছ?
—হ্যাঁ। তুমিই তো নিয়ে গিয়েছিলে!
সারা শীতকাল দাদুর সঙ্গে মিউজিয়াম, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল, হুগলির ইমামবাড়া, ব্যান্ডেল চার্চ, চন্দননগরের স্ট্র্যান্ড, কিছু না হোক আমাদের গঙ্গার ঘাট, ফোর্ট উইলিয়ামের ঢালু জমির ওপর বেড়াতে বেড়াতে মাঝ গঙ্গায় নোঙর করা বড় জাহাজ দেখা ছিল আমাদের তিন ভাইবোনের কাজ।
—স্বামী বিবেকানন্দর বাড়িটাও দেখেছ!
—হ্যাঁ, উনি কোন ঘরটায় জন্মেছিলেন সেটাও।
—ঘিঞ্জি, পড়োমতো, না?
—হ্যাঁ।
—আর দেবেদের বাড়ি? ও বাড়ির একটি ছেলে তোমার বন্ধু না? গেছ?
—কতবার।
—তা হলে ওই বাড়িগুলোই স্বপ্নে নানারকম ভোল পাল্টে পাল্টে আসে। খুব একটা ইমপ্রেশন পড়েছে তোমার মনে, ভাল লেগেছে, বুঝেছ? নাও এবার এসেটা কী লিখলে দেখি।
—আমার ভাল লাগেনি।
—তা হলে খারাপ লেগেছে?
—তা-ও না। আমি ঠিক বোঝাতে পারছি না। ভাল না খারাপও না। তুমি থাকলে হয়তো ভাল লাগত।
—ঠিক আছে, এবার থেকে তোমার স্বপ্নের মধ্যে আমায় ডেকে নিয়ো।
আমি স্বস্তি পাই না— স্বপ্ন যদি তোমায় ঢুকতে না দেয়?
—ঠিক কথা— দাদু চিন্তিত মুখে বলেন— জোর করে কি আর কারও স্বপ্নে ঢোকা যায়?
যায় না বোধহয়। তাই আমার স্বপ্নগুলো ছিল জনহীন।
আমাদের বাড়ি আর স্কুলের খুব কাছেই গঙ্গা, বাগবাজারের ঘাট। ঘাটে নাও এসে লাগে। বড় বড় খড়বোঝাই। আবার ছোট ছোট দাঁড়ের নৌকো। তার পাটাতনের তলায় কী আছে কে জানে, ছই থাকলে তার ভেতরটা দেখতে পাই না। একটা অন্ধ কোটর মতো। পাটাতনের ওপর কুণ্ডলী করা জাল, কাক ঠুকরোচ্ছে। জালের সুতো ঠোঁটে চেপে ধরে একবার এদিক একবার ওদিক। তারপরে হঠাৎ হয় তো একটু পাখনা ঝেড়ে নিল। গলা অবধি সমস্ত শরীরটা তখন পালক-পালক। কাক আমার ভাল লাগে। খুব কর্কশ ডাক কাকের, এঁটো কাঁটা খায়, মাথায় ঠোক্কর মারে, বাসা বাঁধতে জানে না, চামচ মুখে করে নিয়ে চলে যায় হরদম। কিন্তু কাক যখন হালকা গরমের দুপুরে একলা গাছের মাঝডালে বসে থাকে, চুপচাপ, চোখ বাঁকানো নেই, খাবার খোঁজা নেই, কেমন যেন উদাস, ধ্যানস্থ, তখনই কাকের আসল রূপটা ধরা পড়ে। প্রতিদিনের উঞ্ছতা ছাড়িয়ে কাক তখন একা একা জীবন ভাবে, অদ্ভুত নির্লিপ্ত দেখায় তাকে। কালো গা, মিশকালো নয়, কেমন ছাতারে কালো। যা-ই খাক না কেন, কাকের চেহারা খুব সাফসুতরো, আমি কোনওদিনও কোনও মোটা কাকও দেখিনি। ছিপছিপে, হালকা পলকা।
কাকটা জাল ঠোকরাচ্ছে। মাঝি খুব অলস ভাবে একবার তাড়া দিল হু শ্ শ্… কাক একটু পিছিয়ে যায়। আবার তুড়ুক তুড়ুক ফিরে আসে। মাঝি আর ফিরে দেখে না। উবু হয়ে বসে গভীর ভাবে বিড়ি টানে। যেন বিড়ি টানাটা একটা ভীষণ জরুরি কাজ। একটা ঝুপসি গাছের তলায় বসে আমি এইসব দেখি। আশেপাশে তাকিয়ে একটা দুটো ঢিল খুঁজি। তারপর একটার পর একটা জলে ছুড়ে দিই। খুব বেশি দূর যায় না। কেন? হাতের জোর নেই আমার? ইচ্ছের জোর? পুলুও তো আমার মতো রোগা, ওর ঢিল তো অনেক দূর যায়। নৌকাটার আশেপাশে যদি পড়ত ঢিলটা! শব্দ হত টু প্ প্ প্। মাঝি মুখ তুলে দেখত। সে যদি একবারও আমাকে লক্ষ করে তো আমি কৃতার্থ হয়ে যাই। সে নৌকা বায়, দূর-দূর দিক-দিগরে যায়, জাল ফেলে মাছ ধরে, মাছের গায়ে রুপো চিক চিক, দুপুরের রোদ চলকে চলকে পড়ছে মাঝির গায়ে, নাওয়ের গলুইয়ে, গঙ্গার ঘোলা জল তখন আর ঘোলা থাকে না, অজস্র চকচকে আঁশ তার জলে চলকায়। এক জীবনে সে কত ঘাট জানল, জলের কত নিবিড় খবর তার কাছে। মাঝি খুব অবাক মানুষ। কেমন একটা সম্ভ্রম হয়, বিশেষ করে যখন দূরে নিজের ডিঙিতে বসে দোল খায়।
পুলু এসে ডাকল— ঠিক জানি তুই এখানে বসে আছিস। কী গরম! রোদের কী ভাপ রে এখানে?
কথা বলি না। মাথার ওপর ঝুপসি গাছের ছাউনিটা দেখিয়ে দিই। পাতা-পাতলির মধ্যে দিয়ে চকরাবকরা রোদ এসে পড়েছে আমার শাদা শার্টের ওপর। কালো কালো ছায়া-পাতার নকশা।
—তাতে কী? ভাপটা তো বেরোচ্ছে মাটি থেকে! গরম হচ্ছে না?
—আমার হচ্ছে না। তোর হলে চলে যা।
তখন গরমের ছুটি। স্কুলে একটা স্পেশ্যাল ক্লাস হয়। হেড সার নিজে পড়াতেন, অঙ্কের জন্যে ছিলেন যতীনবাবু, সব বাঘা বাঘা মাস্টারমশাই। কোচিং ক্লাস সেরে বাকি দুপুরটা বাড়ি যেতে মন চাইত না। নিঝঝুম বাড়ি। দিদারা ঘুমোচ্ছেন। দাদা খুব শান্ত ধরনের, ভীষণ পড়ুয়া ছেলে, তার থাকা না থাকা সমান, ফিনকি গল্পের বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছে, মা খুটুর খুটুর করে আলমারি গোছাচ্ছেন, কী সব সেলাই টেলাই নিয়ে বসেছেন, তারপর একটা বই নিয়ে শুয়ে পড়েছেন ফিনকির পাশে। কেমন স্যাঁতসেঁতে মরা বাড়ি। আমি নিজেও যে খুব হই-চইয়ে দুরন্ত ছেলে, খুব বলিয়ে-কইয়ে তা তো একেবারেই নয়। আমার ভেতরের স্তব্ধতাটা যেন আরও জো পেয়ে যেত এমন দুপুরে। তার চেয়ে গঙ্গার ধারে ঝুপসি বটতলায়…— ভাল। অন্যদিন দুপুরে বেরোলে বলে বেরোতে হত, খালি স্পেশ্যাল কোচিং-এর দিনগুলোয় কোনও জবাবদিহি নেই। দেড় ঘণ্টা, দু ঘণ্টা, আড়াই ঘণ্টা ক্লাস, তারপর স্কুলেই হুটোপাটি। গান, গল্প। যতক্ষণ না দীনবন্ধু দারোয়ান চাবির তোড়া নিয়ে উদয় হত ততক্ষণ দু চারখানা খোলা ঘরে আড্ডা। গলা খাঁকারি, চাবির ঝন ঝন, তার মানেই দীনবন্ধুদা আসছে, উঠে পড়ো এবার।
অন্যান্য দিনে স্কুলে কী রকম একটা গমগমে ভাব। সারেদের পড়ানোর আওয়াজ। ছেলেদের যাওয়া-আসা, একটু-আধটু কথা হাসি সব মিলিয়ে একটা জমজমাট হাওয়া। কিন্তু এই সব গ্রীষ্ম দুপুরের তাতে স্কুলটা যেন একটা অতিকায় কিন্তু খুব নিরীহ জন্তু। তার বিশ্রামের সময়ে কয়েকটি বালখিল্য সামান্য উৎপাত করছে তাতে সে কিছু মনে করত না। সামান্য আওয়াজ করলেই সেটা যেন লাউড-স্পিকার-এ ঘোষণা হয়ে যেত। আমি খুব সন্তর্পণে কান পেতে স্কুল বাড়িটার নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পেতুম। একটা ভারী শরীরের শ্বাসযন্ত্রে যেমন হয়। আড্ডা হয়। কিন্তু আমি যে তাতে যোগ দিই না, শুধু হাসি, অনেক সময়ে হাসির জায়গায়ও হাসি না, কেমন অন্যমনস্ক থাকি এটা একমাত্র পুলুই লক্ষ করত।
—কী ভাবিস রে? এই সমু?
—কই কিছু না তো!
—কিছু হয়েছে?
—কী হবে?
—তা হলে এরকম চুপচাপ…
—কিচ্ছু ভাবি না।
—বলবি না তাই বল।— এক ঝটকায় ইয়ো-ইয়ো ঘোরাতে শুরু করে পুলু।
আমি অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বলে উঠি— যা মাঞ্জা বানাব না! এবার গোপালদের সব ঘুড়ি কাটতে হবে।
—কী রং দিবি?
—ম্যাজেন্টা, ঘোর ম্যাজেন্টা, আকাশেও সুতোটা দেখা যাবে!
—আমি হলে অরেঞ্জ দিতুম… অরেঞ্জটাও খুব… টিউটোরিয়্যাল থাকলে খুব মজা না রে তোর?— মাঞ্জার প্রসঙ্গ থেকে ছিটকে টিউটোরিয়ালের প্রসঙ্গে চলে যায় ও। ও আমার কাছ থেকে কথা বার করতে চাইছে। আমার ভেতরে বসে কে যেন ক্রমাগত বলতে থাকে— বলে না এসব বলতে নেই… বলতে নেই….।
বটগাছতলায় বসে গঙ্গার অনর্গল বয়ে যাওয়া দেখছি। ক্লান্ত কাকের ক্বঃ ক্বঃ… মাঝির দোল খাওয়া… পালতোলা নৌকো দূর দিয়ে যাচ্ছে… পুলু বলল—তুই এমন চুপ করে বসে থাকিস কেন রে?
—ভাল লাগে।
—ভাল তো আমারও লাগে। কিন্তু এ রকম চুপচাপ না। দ্যাখ কী রকম এক দফা সাঁতার দিয়ে নিই।
সাঁতার আমিও জানি। দেশবন্ধু পার্কের পুকুরে শিখেছি। ফ্রি-স্টাইল যাকে গোরাদা বলেন আনতাবড়ি, তার পরেও চিৎ সাঁতার ডুব সাঁতার। ডুব সাঁতার দিচ্ছি একদিন, হঠাৎ জলের মধ্যে থেকে কে আমায় ডাকল—সমর্পণ। স ম-র্পণ। আমার নাম সমর্পণ নয়, তবু মনে হল আমাকেই ডাকছে। কোন পাতালঘর থেকে ভুড়ভুড়ি কাটতে কাটতে ডাকটা বেরিয়ে এল। আমার কানের কাছে এসে যেন ফেটে গেল। তাড়াতাড়ি ভেসে উঠি। এইভাবে দ্বিতীয়বার ডাকলে আমাকে ডুবতে হবে আরও গভীরে। সেখান থেকে ভেসে ওঠবার ক্ষমতা আমার হবে কি না আমি জানি না।
এর পরেই একদিন একটা দুর্ঘটনা হল। ঘোষেদের বাড়ির মনু, মনসিজ পুকুরটাতে ডুবে গেল। বাড়িতে মাকে ভাত বাড়তে বলে এক ছুটে চান করতে গিয়েছিল। চান করা মানে একবার অন্তত এপার-ওপার করা। মনু খুব ভাল সাঁতার জানত। সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিল ওর মতো চ্যাম্পিয়ন সাঁতারু কী করে ডুবে যায়! আমি আন্দাজ করতে পারি। ওকে কেউ ডেকেছিল। ডাকটা পুকুরের অতল থেকে পাক খেতে খেতে উঠে এসে মনুর কানের কাছে ফেটে যায়। ও ডাকটার উৎস খুঁজতে গিয়েছিল। আর ওপরে উঠতে পারেনি। সকলে বলত পুকুরের ভেতর একটা কুয়ো আছে, মরণফাঁদ। জানি না কিন্তু আমার মনে হত ওই কুয়োর মধ্যে ঠিকঠাক মতো ডাইভ দিতে পারলে সোজা অন্য কোনও অজানা ভূখণ্ডে পৌঁছনো যায়। সেখান থেকে কারা আমাদের ডাক পাঠায়, বড্ড একা লাগে ওদের। ওরা কেমন? মানুষই হবে, কিন্তু খুব একা, সঙ্গী-খোঁজা ছায়ামানুষ। তাদের খোঁজে যাব কী! পুকুরটা এরপর কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে দেওয়া হল। ট্রেনিং বন্ধ রইল এবং মা দাদুকে বলে আমার পুকুরে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন।
—যাবি না সাঁতারে? পুলু শার্টটা খুলে আমার দিকে ছুড়ে দিল। তারপর ঝাঁপ দিল। কিছুক্ষণ পরে সোঁপাট ভিজে উঠে এল প্যান্ট নিংড়োতে নিংড়োতে।
—গেলি না?
—আমি তো যাব বলিনি!
—ভয় পাস?
—আমার এখন সাঁতারের সময় নয়।
—কীসের সময় এখন তা হলে! পুলু একটা তীব্র দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে, তারপর শার্টটা ছিনিয়ে নিয়ে প্যান্টের জল নিংড়োতে নিংড়োতে চলে গেল। রাগ হয়েছে।
সত্যিই তো! সাঁতারের সময় নয়তো কিসের সময়? পড়ার সময়, খেলার সময়, শোওয়ার সময়… তেমন কি সাঁতারেরও নির্দিষ্ট সময় থাকে?
গাছের গুঁড়ি বেয়ে কাঠপিঁপড়ে নেমে আসে। ঝুরি বেয়ে কাঠবেড়ালি উঠে যায়। এত সুন্দর প্রাণী, আমার ধারণা ছিল ওদের ডাক পাখির শিসের মতো হবে। ইঁদুর-কিচকিচ শুনে প্রথমটা খুব অভক্তি হয়, এখন সয়ে গেছে। ঘাটে এই পড়তি দুপুরেও চানে নেমেছে জনা দুই লোক। গামছা পরা। গামছার তলা থেকে বেরিয়ে আছে খুব লোমঅলা শুকনো ডালের মতো পা। বুক জলে নেমে ওরা সামনের জল সরিয়ে সরিয়ে ডুব গালছে, কুলকুচি করছে। একজন কুলকুচির জলটা গাল ফুলিয়ে সামনে ফেলে দিল, আর একজন ফোয়ারার মতো উঁচুদিকে মুখ করে ছুড়ছে। …ওরা উঠে আসছে। ভিজে গামছা নিংড়িয়ে পরল। ভেতরে ইজের পরা। একজন কুচকুচে কালো, আরেকজন একটু কম। আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছে।
—কী খোকা ইস্কুল পালিয়েছ?
আমি চমকে উঠি। ওদের গায়ের আঁশ-আঁশ জল-চিকচিক চামড়া, কড়া বুড়ো ঘাসের মতো হাত পায়ের লোম, না কামানো নারকোল-ছোবড়ার মতো মুখ… খুব মন দিয়ে দেখছিলুম, ওরা যে আমাকে লক্ষ করতে পারে ভাবিইনি। কেন না আমি তো নিশ্চিহ্ন হয়েছিলুম। গঙ্গার জলে, ভাসমান নৌকোয়, গুটোনো জালের কুণ্ডলীতে, বটের ঝুরিতে একেবারে ঢুকে গিয়েছিলুম, আমার ফুটকির মতো দেহটার একটা দৃশ্যমান অস্তিত্ব আছে এটা একেবারে ভুলে। তাই থতমত খেয়ে যাই।
বলি— এখন গরমের ছুটি তো!
—কোথায় থাকো? বাড়িতে বকেছে?
—না তো!
ওদের বোধহয় বিশ্বাস হয় না। আমার দিকে মাঝে মাঝে চাইতে চাইতে, নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে ওরা চলে গেল। ওদের পায়ের ছাপ ধুলোবালিতে শুষে নিয়েছে।
একদিন কোচিং ক্লাসের পর পুলুকে বললুম— পুলু আরেকটু থাক তোকে একটা জিনিস শোনাব।
সবাইকার পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেলে, খাতাপত্তর মুড়ে রেখে বললুম —শোন!
—কী শুনব বল!
—বলব না। তুই শোন। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে শোন।
মিনিট দুই তিন হয়ে গেলে ও অধৈর্য হয়ে কনুই দিয়ে ঠ্যালা মারল আমাকে— কী রে, কী শুনব?
—একটা ঝিঁঝির ডাকের মতো আওয়াজ পাচ্ছিস না?
—না, আমি কোনও ঝিঁঝি টিঁঝি শুনতে পাচ্ছি না।
—আশ্চর্য! শুনতে পাচ্ছিস না? অমন পষ্ট!
—না, বেশ, ওটা কী? দিন দুপুরে ঝিঁঝি ডাকে না— না হয় ডাকলই, তো কী?
—ঝিঁঝি নয় ওটা। আমাদের সবাইকার, সারেদের, পিওনদের, ছেলেদের সবাই সারাদিন যত কথা বলে, হইচই করে সব রেকর্ড করা রয়েছে।
—কী করে বুঝলি আমাদেরই। অন্যকিছুরও তত হতে পারে!
—অন্য কিছু?
ধর ভূত!— বলেই পুলু উঠে দাঁড়াল।
—ভূত নয়— আমি জোর দিয়ে বলি, ভূত-টুত নয়— আমি হেডসারের গলা মাঝে মাঝে চিনতে পারি, অবিনাশবাবুর, তমোনাশদার, ফার্স্টক্লাসের বিজয়মুকুলদা আর তথাগতদা ডিবেট করছিল একদিন। আমরা বাড়ি চলে যাই, আমাদের গলা থেকে যায়।
পুলুর চোখে অস্বস্তি, বলল— তুই শুনতে চাস শোন, আমি চললুম।
দোতলায় হচ্ছিল আমাদের ক্লাস। রুম নাম্বার ইলেভেন। পুলু চলে গেল, আমি বসেই রইলুম। কান পেতে শুনছি, বোঝবার চেষ্টা করছি। ক্রমে যেন ধ্বনি পরতের পর পরত খুলে যায়, খুব পাতলা পরতগুলো, একটার সঙ্গে আরেকটা জোড়া, ক্রমেই ভেতরের পরতের দিকে যেতে থাকি। আশ্চর্য হয়ে শুনি মেয়েদের গলার আওয়াজ। ভারী, সরু, মিঠে। সরু গলার চিৎকার, ভারী গলার ধমক। সবই কিন্তু খুব আবছা। কী এগুলো? আমাদের স্কুলে ভোর সাড়ে ছটা থেকে সাড়ে দশটা মেয়েদের ক্লাস হয়। সেই আওয়াজগুলো কি এখনও রয়ে গেছে! তার মানে আজকের, গতকালের, পরশুর, অনেক বছর আগেকার ধ্বনিরাও রয়ে গেছে? রয়ে যায়?
এই সময়ে পুলু হাতে খাতা নিয়ে ফিরে আসে। ভয়-ভয় গলায় বলে— এই সমু। আমি সিঁড়ি দিয়ে নামতে পারছি না। ভয় করছে, চল, আমার সঙ্গে চল, লক্ষ্মীটি।
—ভয়? কেন?
—তুই-ই তো ওইসব ভুতুড়ে কথা বলে ভয় ধরিয়ে দিলি আমার!
এখন সাড়ে তিনটে তো বেজে গেছেই! চারদিকে ঘেরা বারান্দা, মাঝখানে উঠোন। বারান্দা দিয়ে নীচের দিকে চাই। কেমন একটা চৌকো কুয়োর মতো, তার ভেতর জলে পড়ে রয়েছে, ঝরা পাতা, খড়কুটো। যে কোনও সিঁড়িতে পৌঁছতে হলেই আমাদের খানিকটা হাঁটতে হবেই। পুলু প্রায় আমার গা ঘেঁষে চলেছে। ওর ঘামের গন্ধ পাচ্ছি। চটচটে হাত, ঠান্ডা। সিঁড়িতে পা দিয়েই চিৎকার করে ডাকল— ‘দীনবন্ধুদা— আ— আ।’ ডাকটা সঙ্গে সঙ্গে অনেক দূর চলে গিয়ে আবার ফিরে এল। ‘দীনবন্ধুদা —আ —আ—আ— আ— আ।’ শিউরে উঠল পুলু।
আমি বললুম— ও তো প্রতিধ্বনি। ভয় খাচ্ছিস কেন?
আমরা বেরিয়ে যাচ্ছি প্রায়, স্কুলের দোতলার তিনটে ঘর খোলা, সদর ফটক, কোল্যাপসিব্ল খোলা। কী করে যাই? পুলুকে বলি— চল, দীনবন্ধুদাকে ডেকে আনি। খুব অনিচ্ছাসত্ত্বেও পুলু আমার সঙ্গে চলে।
পেছন দিকে স্কুলবাড়ি থেকে নেমে প্লে গ্রাউন্ড। তার একদিকে ছোট্ট একটা ঘর দীনবন্ধুদার। ঘরে তালা মারা। কোথায় গেল? জানে না গেটে তালা দিতে হবে? আমরা আবার সামনে আসি। খোলা গেটের সামনের ধাপে বসে থাকি। পশ্চিমে ময়লা কাপড়ের মতো রোদ ঝুলছে বাড়িগুলোর বারান্দা, ছাত থেকে। তাপ নেই তেমন। কিন্তু ঘাম হচ্ছে, আবার যখন গঙ্গার দিক থেকে হাওয়া আসছে ঝলক ঝলক তখন ঘামের ওপর হাওয়া লেগে খুব আরাম।
পুলুর এখন ভয় অনেকটা কেটেছে। সামনে রাস্তা দিয়ে লোকজন যাতায়াত করছে। হেঁটে, সাইকেলে। রিকশা চলে গেল কয়েকটা ঠুনঠুন করতে করতে।
আজকে আর গঙ্গার ধারে যাওয়া হল না। নির্মলদা যাচ্ছিল, সাইকেল থামিয়ে বলল— কী রে। এখানে বসে?
আমরা কৈফিয়ত দেবার আগেই দীনবন্ধুদা এসে গেল। হাতে মাটির ভাঁড়, একটা কাগজের ঠোঙা, ঠোঙাটা তেলে ভিজে উঠেছে।
—কোথায় গিয়েছিলে?
—খাবে? তেলেভাজা?
—দাও— আমি, পুলু, নির্মলদাও হাত বাড়ায়, আমাদের হাতে একটা করে লম্বা লম্বা বেগুনি দেয় দীনবন্ধু। প্রত্যেকটাতে একটা করে কাঁচা লংকা সাঁটা।
—হরি ঘোষের ইষ্ট্রিট থেকে ভাজিয়ে আনলুম। কখন গেছি, তখন তোমরা ক্লাস করছ খোকা। বেজায় ভিড়।
বেগুনি মুখে দিয়েই খিদে পেয়ে গেল। পুলুকে বলি—চ’, আমাদের বাড়ি থেকে খেয়ে খেলতে যাব।
—ধুৎ, আমার খেলার মেজাজ নেই।
—কেন?
—কেমন মন খারাপ লাগছে।
—বাড়ি গিয়ে কী করবি?
—তা-ও তো! চল তোদের বাড়িই যাই। তারপরে দেখা যাক।
লুচি ভাজার গন্ধ আসছে। প্রায় পাঁচটা। এই সময়ে আমি, দাদা, বোন কয়েক মিনিট পর পর ফিরি। বোন এখন ছুটিতে বাড়িতেই আছে। এই সময়ে রোজ লুচি কিংবা পরোটা ভাজা হয়। ডালডায়। প্রতি মাসে এত এত ডালডার টিন আসে আমাদের বাড়িতে। ফুরিয়ে গেলে সেগুলো আমরা দখল করি। যত বড় হচ্ছি, ডালডার খালি টিনগুলো অবান্তর হয়ে যাচ্ছে। মার্বেল ভর্তি, সমুদ্রের ঝিনুক কড়ি ভর্তি, খুচরো পয়সা ভর্তি টিন সব। অনেক সময়ে মা আমার কাছ থেকে খুচরো পয়সা চান— দাও তো তিন টাকা, পরে দিয়ে দেব। মা সেভাবে আর কোনওদিনই ফেরত দেন না। তবে টাকাপয়সা তো আমরা মোটামুটি পাই-ই। জন্মদিনে, পয়লা বৈশাখে, দোল, রথ, সরস্বতী পুজো, দুর্গা পুজো, এ রকম অনেক উপলক্ষ আছে। লুচি ভাজার বোদা জ্বলা-জ্বলা গন্ধটা আমার ভাল লাগে না। কিন্তু খাবার সময় অত গন্ধ পাই না। আলু চচ্চড়ি দিয়ে মুড়ে খেয়ে নিই। আলু মরিচ করলে মা একটু মাখন দ্যান, সেটা খেতে আমি বেশি ভালবাসি।
সদর-দরজাটা আধ-ভেজানো, ভেতরে আমাদের উঠোনের একটা সরু রেখা দেখা যাচ্ছে। খুলি। রোদ ঢুকে যায়, একেবারে পড়তি বেলার ঝিমঝিমে রোদ। উঠোনে ঢুকেই কিছু দূরে একটা পেয়ারা গাছ, এটা আমাদের বাসনমাজার লোক মঙ্গলা পুঁতেছিল। চকচকে মচমচে গাঢ় সবুজ হালকা সবুজ পাতা নিয়ে সুন্দর দাঁড়িয়ে থাকে গাছটা। পেয়ারা গাছের পেছনে লোকজনেদের কলঘর। বেশ বড় একটা চত্বর জুড়ে জায়গাটা। বড় চৌবাচ্চা, ভেতরে কল বাইরেও কল। কাপড় মেলার জায়গা আছে। পায়খানা ডানদিকে। আমি দেখেছি। ওটা রোজ পরিষ্কার করান দাদু। লোকজন যে-ই ব্যবহার করুক, কিন্তু তবু আমার ঘেন্না করে। কী রকম একটা কৌতূহলও হয়, মাঝে মাঝে মুখ বাড়িয়ে দেখি— একটু পুরনো রঙের সাদা প্যান। দুটো ধাপি, পাশেই কল, কলের তলায় একটা এত বড় পেতলের গাড়ু বসানো থাকত আগে। সেটা চুরি হয়ে যাবার পর এখন একটা মরচে-ধরা টিনের মগ থাকে। আমার মনে হয়, এই জায়গাটুকু একটা ভিন্ন দেশ, অচেনা, অজানা, পুকুরের মধ্যেকার কুয়োর উল্টো দিকের দেশের মতো। কখনও কখনও জলভর্তি চৌবাচ্চাটার ধারে দাঁড়াই। ভেতর বাড়ির কলঘরে এত বড় চৌবাচ্চা নেই। দাঁড়ালে জলের মধ্যে আমার ছায়া পড়ে।
—তুমি এখানে থাকো? জলের মধ্যে? —কেমন ঝাপসা চুল, ঝাপসা চোখ মুখ ছেলেটার। টুপটাপ করে পেয়ারা পাতা খসে পড়ে, সামান্য একটু চিড় খায় জল, ছায়া ভেঙে ভেঙে যায়। ও আমার কথার জবাব দেবে না। লুকিয়ে পড়ল। ওকে ধরতাই দিল পেয়ারা গাছ, হাওয়া, হাওয়ার ভেতর মিশে থাকা ধুলো, আলো, ছায়া। জানি ওটা আমারই ছায়া। কিন্তু জলের মধ্যে সে যেন অন্য কেউ। চেনা আবার অচেনা। ছায়া মানুষ। আর এক জীবন, অন্য ধরনের। সে আমাকে কিছুতেই ধরা-ছোঁয়া দেবে না।
লুচি দিয়ে কুমড়োর ছোঁকা খেয়ে আমরা লুডো খেলতে বসি। আমি, পুলু আর বোন, প্রত্যেকবার কী কৌশলে বোন জিতে যায়, বেস্ট অব থ্রি, বেস্ট অব ফাইভ, বেস্ট অব সেভেন…তাতেও। নিজের ঘুঁটি হোমে উঠিয়ে ও বলে—তোরা খেলা শেষ কর। আমি চট করে ঘুরে আসছি। —ঘুরে আসছি মানে ও পুতুলদের কাপড় পাল্টাবে। ছোট বড় কাঠ মাটি কাচ গাদা পুতুল ওর। সেগুলো নিয়ে খেলে। নাইলন ডল সাজিয়ে রেখে দেয়।
ও আমার চেয়ে বেশ ছোট। আমি যেমন শান্ত, চুপচাপ, ও তেমন দস্যি। মুখে খই ফুটছে। বাবার খুব আদুরে ও। একমাত্র ওকেই বাবা কখনও বকেন না। দাদা এখন কলেজে, তবু দাদা মাঝেমধ্যে বাবার খারাপ মেজাজের আঁচ পায়। আমি তো পাই-ই। তবে আমি পারতপক্ষে বাবার ত্রিসীমায় যাই না, বকা-ঝকা খাওয়ার মতো কিছু তো করিও না। তবুও কোনও কারণে মেজাজ খারাপ হলেই বাবা গর্জন করে আমাকে আর মাকে বকেন।
—কী খেতে দাও ছেলেটাকে? এত রোগা? এত কালো? নিজেও যেমন হচ্ছ, এ ছেলেটাকেও তেমন করছ। অ্যাই সমু কোনওদিনও যেন আর না শুনি যে তুমি দুধ খাওনি। ট্যাং ট্যাং করে রাস্তায় ঘুরতে দেখি না যেন।
বাবা কী করে আমায় রাস্তায় ঘুরতে দেখবেন? ফেরেন তো রাত নটার আগে নয়। তখন আমার খেলাধুলো, পড়াশোনা, খাওয়াদাওয়া সব শেষ। তখন আমি কোনও বই বা পত্রিকা পড়ছি। আর দুধ? দুধ যে কবে শেষ খেয়েছি আমি মনে করতেই পারি না। দুধ দেখলে আমার বমি আসে। মা, দিদারা এমনকী দাদু পর্যন্ত এই কঠিন সত্যটা মেনে নিয়েছেন যে আমাকে দুধ বা ছানা খাওয়ানো যাবে না। আর বাবা সে খবরই রাখেন না! বাবাকে আমি খুব এড়িয়ে চলি। যত বড় হচ্ছি তত ভয়বোধটা চলে যাচ্ছে, তার জায়গা নিচ্ছে বিরক্তি। দাদার সঙ্গে তো ক্রমে বাবার কোনও কথাবার্তাই থাকছে না। দাদা, আমি, ফিনকি সবাই একসঙ্গে খেয়ে নিই। তখন বাবা কোথায়? জুতোর মচমচ শব্দ শুনলেই দাদা শেষ গরসটুকু হাপুস-হুপুস করে খেয়ে নিয়ে, বা পাতে ফেলে রেখে উঠে পড়ে, চৌকাঠ পেরিয়ে পগারপার। নিজের থালাটা পর্যন্ত দাদা উঠোনে কলের নীচে নামিয়ে রেখে যায়। আর আমি? মা যদি ‘তোমার বাবা’… দিয়ে কোনও কথা শুরু করেন, আমি বলি—আহ্—ছাড়ো তো।
দাদু বাবাকে খোকা বলেন, খুব সমীহ করেন, কিন্তু দাদুর মতামত, আমাদের সঙ্গে ব্যবহার বাবার একেবারে বিপরীত। দাদু আমাদের এগিয়ে দ্যান, সাহস দ্যান, বাবা বাগড়া দ্যান। বয় স্কাউট-এ ভর্তি হব, বাবা বললেন—না। দাদু বললেন—ডিসিপ্লিনের শিক্ষা হবে খোকা ও ভর্তি হোক।
—বাবলুর বেলায় তো বলনি?
—বাবলু চায়নি। যে যেটা ভালবাসে, আপনি করে।
—তবে ও বয় স্কাউটে যাবেই!
—আমি তো সেটাই উচিত মনে করি।
বাবা শব্দ করে চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখেন। ভীষণ জলদ গলায় হাঁকতে হাঁকতে চলে যান ওপরে—আমি আজ সাড়ে আটটায় ভাত খেতে নামব। তরকারি যেন কাঁচা না থাকে।
মা মাথায় আধ-ঘোমটা দিয়ে দাদুর ঘরে ঢোকেন।
—কী হল, বাবা?
—সমু বয় স্কাউট করতে চাইছে।
—পছন্দ নয়?
—না।
—কেন?
—পছন্দ নয়, পছন্দ নয়। খোকার অপছন্দের কি কোনও মাথামুণ্ডু থাকে বউমা! দেখো গতকাল হয়তো আপিসে হিসেব মেলেনি।
মাসের শেষে হিসেব মেলাটা ছিল বাবার প্রতি মাসের ক্রাইসিস। ওই সময়টা বাবা একেবারে অন্যমনস্ক এবং তিরিক্ষি হয়ে থাকতেন। আসল কথা, বিদ্যা, ঝোঁক, মেজাজ সব ধরতে গেলে বাবার হওয়া উচিত ছিল অধ্যাপক। কিন্তু হতে হয়েছিল হেড-আপিসের বড়বাবু। ছোটবাবু থেকে শুরু করে আমাদের যখন ভালমতো জ্ঞান হয়েছে তখন বড়বাবু। ওই কাজ করতে ওঁর ভাল লাগত না। এদিকে নিজের পায়ে কুড়ুলটি তো নিজেই মেরেছেন। তার ওপর ষোলো আনার জায়গায় তাঁর কাজে নিষ্ঠা ছিল ষোলো আনা, ভয় আঠারো আনা। টাকাপয়সা নিয়ে কারবার! কাজেই ক্রাইসিস, মেজাজ খারাপ।
বাবাকে স্বাভাবিক সাবধানতায় এড়িয়ে চলতুম। আর এই সময়টা একেবারে ধারেকাছে থাকতুম না। সেবার হল কি রাত্তিরে ফিরেই বাবা হাঁকডাক শুরু করে দিয়েছেন।
দাদুকে বলছেন—কত বার বলেছি তুমি রাতে আমার জন্যে অপেক্ষা করবে না। বুড়োমানুষ ঠিক সময়ে খাওয়া ঘুম চাই, কিছুতেই কথা শুনবে না?
দাদু—আমি যদি বুড়ো মানুষ হই তো তুই কী! আমার তো মনে হয় তুই-ই বুড়োমানুষ। বাহাত্তুরে ধরলে তখন মানুষ খামোখা এমন অশান্তি করে। কী হল তোর? আবার হিসেব মেলেনি!
—আর বোলো না, কে যে ভুলটা করে বসে আছে এখনও ধরতেই পারিনি।
—মাথা ঠান্ডা করে, টেন্স্ না হয়ে দ্যাখ ভাল করে। ঠিক বেরোবে।
-বলছ?
—বলছি। না বেরোবে তো যাবে কোথায়?
—কালই বেরোবে তো? তোমার মনটা কী বলছে?
—কালই বেরোবে।
—দেখি। তোমার কথা তো সচরাচর মিথ্যে হয় না। একটু ঠান্ডা হলেন এইভাবে, তারপরই—বাবলা, বাবলা কোথায়?
বাবলা মানে আমার দাদা।
—তার খোঁজে তোর কী দরকার? দাদু বলে উঠলেন।
—সারাদিনের পর বাড়ি ফিরে নিজের সন্তান-সন্ততির খবর নিতে পারব না! বা বাবা বা!
মা মাথার ঘোমটাটা একবার তোলবার ভঙ্গি করলেন, ধীর গলায় বললেন, বাবলা খেয়েদেয়ে এখন পড়াশোনা করছে।
—এত রাত্তির অব্দি? চোখ-ফোক খারাপ হয়ে গেলে?
দাদু বললেন—এখন মোটে সাড়ে ন’টা, বাড়ি ফেরবার পক্ষে দেরি কিন্তু বি. এসসি-র পড়া করবার পক্ষে দেরি নয়। তুই যা, হাত পা ধুয়ে খেতে বোস গে।
সে সময়ে আমরা মেঝেতে খেতুম। ছোট কিন্তু খুব পরিষ্কার সবুজ মেঝের ঘরখানা। গরমকালে খুব শীতল থাকত। শতরঞ্চির চৌকো চৌকো আসন পাতা থাকত। সোজা উল্টো বোঝবার জন্যে মেজদিদা আসনের এক পিঠে একটা চিহ্ন দিয়ে রাখতেন। সেলাইয়ের ফোঁড় তুলে খানিকটা গিঁট পাকানো। যদি কোনওদিন ভুলক্রমে উল্টো দিকটা ওপরের পিঠে পড়ত তো বাবার বিরক্তি দেখতে হয়! তার ওপরে আবার লুচি ফোলেনি। বেগুনভাজা ভেতরশক্ত, মাংসের ঝোলটা কেন জলের মতো… একটার পর একটা বাবা খুঁত ধরতে থাকতেন। রাঁধুনি কাঠ হয়ে যেত। শেষে দাদু ডাক পাড়তেন ফিনকি! ফিনকি! ফিনকি আমার বোনের নাম। ও তখন ঘুমে ঢুলছে। আমি ওকে বেশ করে নাড়া দিয়ে বলতুম—শুনতে পাচ্ছিস না! দাদু ডাকছেন, একবার নীচে গিয়ে দ্যাখ।
মুঠো দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে কোঁকড়া ঝাঁকড়া চুল দুলিয়ে নোদলগোদল করে নেমে যেত ফিনকি—বাঁব্বাঃ, এঁকটুখানি ইতিহাঁস পঁড়ছিলুম। তোমরা আমাকে একটু পঁড়তেও দিলে না। পঁরীক্ষাতে খাঁরাপ হঁলে বলতে পারবে না কিন্তু। খালি কাঁজ আর কাঁজ আর কাঁজ… এইভাবে গজ গজ করতে করতে নেমে যেত ফিনকি। আর তার মিষ্টি গলার পাকা পাকা কথা শুনতে শুনতেই বাবা ক্রমে অট্টহাস্যে ফেটে পড়তেন।
দাদু ফিনকিকে ডেকে দিয়েই ঘটনায় ইতি টেনে দিতে পেরেছেন জেনে এবার শুতে চলে যেতেন। এবার উনি বই পড়বেন। বিছানায় শুয়ে শুয়ে পড়তে পড়তে যে-ই ঘুমে চোখ বুজে আসবে, অমনি বেড সুইচটা টিপে অফ্ করে দিয়ে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়বেন। পরদিন ভোর চারটে সাড়ে চারটেয় উঠে ছোটখাটো ব্যায়াম করবেন, চান করবেন। বেলপোড়া আর কাঁঠালিকলা খাবেন। তারপর গীতা কিংবা মহাভারত কিংবা ভাগবত একটা কিছু পড়বেন।
এদিকে ফিনকি খাবার ঘরে ঢুকে বলবে—একটু শান্তি করে পঁড়তেও তুমি আমাকে দেবে না বাঁবা। উঃ! কী চিৎকার, কী চিৎকার, ঠিক যেন বাঁড়িতে ডাঁকাত পড়েছে।
বাবা হাসতে হাসতে বলবেন—তা তুই যে ডাকাতদলনী আছিস! ভয়টা কী! এই নে একটা লুচি খা তো এখন!
—আমরা বিকেলে লুচি খেয়েছি বাবা, আর খাব না। রাত্তিরে মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাই। আমার পেটটা ঠাসা।
—একটা খা না! ওগো, ফিনিকে একটা লুচি আলুভাজা দিয়ে দাও তো!
—ও পারবে না, অসুখ করবে— মায়ের জবাব।
—অসুখ করবে? না, থাক তবে…
তারপর বাবার প্রবল উৎসাহে গল্প শুরু হয়ে যাবে। একটু পরে ফিনকি ঢুলতে ঢুলতে ওখানেই ঘুমিয়ে পড়বে। বাবা বলবেন জোছনায় ফিনিক ফুটেছে।
আঁচিয়ে টাঁচিয়ে কোলে করে ফিনকিকে নিয়ে ওপরে উঠবেন বাবা, মায়ের বিছানায় শুইয়ে দেবেন আস্তে।
আমি এই পুরো সময়টা, দাদার টেবিলে-চেয়ারে বসে গল্পের বই পড়তুম। রবিনসন ক্রুসো, মাস্টারম্যান রেডি, টোয়েন্টি থাউজ্যান্ড লিগস আন্ডার দা সি। এই সব। আমার চারপাশ ঘিরে জল, অরণ্য কিংবা আকাশ। মাঝে মাঝে নীচ থেকে হাসি, কথার টুকরো ওপরে উঠে আসছে, যেন মহাকাশে একটা স্যাটেলাইট চলে গেল। সমুদ্রে একটা ভেলা, কোথায় ভেসে চলে যাচ্ছে, সমুদ্র যেমন তেমনই। আমার সমুদ্র আকাশ অরণ্যে কখনও চিড় ধরে না। হঠাৎ দাদা বলে ওঠে— কী রে সমু, কখন থেকে ডাকছি শুনতে পাচ্ছিস না?
তবে কি দাদা অনেকক্ষণ ধরেই ডাকছে? আমি শুনতে পাইনি তো!
দাদা বলে— এই ডায়াগ্রামটা আমায় করে দে তো! আমি ততক্ষণ চ্যাপটারটা শেষ করে নিই। লেবেলিং করতে হবে না, আমি করে নেব।
ডায়াগ্রামটা কিছুক্ষণ উল্টেপাল্টে দেখি। তারপরে সেট স্কোয়্যার, কম্পাস, রুলার দিয়ে এঁকে ফেলি।
—বাঃ তুই এগুলো এত চমৎকার আঁকিস, তুই আর্কিটেকচার নিয়ে পড়িস, বুঝলি? এত গল্পের বই পড়িস কেন?
—পড়ব না? পড়লে কী হয়!
—পড়বি না বলিনি। এত পড়াটা ঠিক নয়। মগজটা অলস হয়ে যাবে।
—গেলে?
—গেলে আর কী! ডিফিকাল্ট কিছু ধরতে পারবি না, ধৈর্য চলে যাবে।
আমি বইটা উল্টে রেখে দিই।
সত্যি কথা বলতে কি আমার অসুবিধে হয় না। নানান রকম ভাবনা-চিন্তা বই-টই সত্ত্বেও লেখাপড়ার ব্যাপারটা আমার ভালই আসে। হাতের লেখা ভাল। ছোট্ট করে গুছিয়ে সব লিখে দিতে পারি। অঙ্ক বেশির ভাগই ঠিক হয়। আশি নব্বুই কক্ষনও পাই না। সব সারই বলেন, তুমি বড় কম লেখো সমুদ্র, সুন্দর স্পষ্ট উত্তর, কিন্তু বড্ড ছোট্ট। এ কথার মানে কী আমি বুঝি না। যেটার ব্যাখ্যা চাওয়া হচ্ছে সেটা তো পরিষ্কার বুঝিয়ে দিতে পেরেছি। তবে? এর চেয়ে বেশি বলতে লিখতে আমার ভাল লাগে না। তাতে ফার্স্ট সেকেন্ড না হলুম তো না-ই হলুম।
দাদা বলল— তুই কেন এত নির্জীব রে? ভাল করে খাস না, না কি!
সত্যি কথাই, আমার খাওয়া একটু কম। ঠাকুমারা এ নিয়ে অনেক বকাবকি করেছেন। মা বলেন ওর পেটের খোল যদি ছোট হয় তো ও কী করবে বড়মা?
—খেলাধুলো করো না? —দাদু জিজ্ঞেস করেন।
—খেলি তো!
—কী, কী?
—ফুটবল না। কিন্তু ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন তো প্রায়ই খেলি।
দাদা বলল— একটু এক্সারসাইজ কর দেখি। স্বাস্থ্যটা ভাল হবে। রোজ রোজ এই কালো রোগা স্বাস্থ্য স্বাস্থ্য শুনতে শুনতে বিরক্ত লাগে।
তখন আমি সত্যিই ব্যায়াম করতে আরম্ভ করি। গোরাদাদেরই একটা ক্লাব আছে। সেখানে খালি হাতে ব্যায়াম, যোগাসন, বার্বেল, ডাম্বেল মুগুর এসব নিয়ে সব রকমেরই শেখায়। আমি বললুম— গোরাদা, আমার যাতে চেহারাটা বেশ তাগড়াই হয়, খাওয়া বাড়ে তেমন কিছু শেখান তো!
—যাতে খাওয়া বাড়ে? কে বলেছে? এই মাগ্গি গণ্ডার দিনে? গোরাদা হাসতে লাগল।
—সব্বাই, আমিও হেসে বলি।
ভাল করে দেখে শুনে গোরাদা বলল— তুই দু’চারটে ফ্রি হ্যান্ড কর, তারপর তোকে যোগ-ব্যায়াম শেখাব। দেখবি চমৎকার চেহারা হয়ে যাবে।
সত্যিই কিন্তু আমি যখন হায়ার সেকেন্ডারিতে কলেজে ভর্তি হই তখন আমার খুব চমৎকার স্বাস্থ্য! আয়নায় নিজেকে দেখতে নিজেরই গর্ব হয়। ঠিক যাকে বলে পেশিবহুল দেহ তা নয়। কিন্তু দৈর্ঘ্যের অনুপাতে ঠিকঠাক চওড়া, পেশি দিয়ে সুন্দর ভাবে ঢাকা কাঠামোখানা, তার ওপরে মাছি পিছলোনো চকচকে চামড়া। এখন আর কণ্ঠা জেগে নেই। চোখের কোল বসা নয়, আঙুলগুলো খ্যাংরা ঝাঁটার কাঠির মতো নয়। আমার অখণ্ড মনোযোগের ক্ষমতা পরীক্ষার খুব কাজে লেগেছে। বাড়িতে সবাই খুশি। আমাকে নিয়ে আর তেমন সমস্যা নেই।
সমস্যা অবশ্য আগেও ছিল না। কিন্তু আমি অত রোগা-টোগা বলে, খাওয়া-দাওয়া তেমন করে করতুম না বলে, আর লোকের সঙ্গে মিশতে পারতুম না বলে বোধহয় ভাবনা ছিল, মা আর দাদুর মধ্যে এ নিয়ে নিশ্চয় কথা হত। কেন না একদিন দাদুই কথাটা বলেছিলেন— যাক সমুভাই, এখন তোমার স্বাস্থ্যটা আর ভাবাচ্ছে না।
—ভাবাচ্ছিল বুঝি? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি।
—হ্যাঁ তা তো খানিকটা বটেই। স্বাস্থ্য ভাল না হলে মানুষ ঠিকঠাক জীবন উপভোগ করতে পারে না। আর উপভোগ না হলেই মনমরা হয়ে থাকে।
—আমি কি মনমরা থাকতুম, দাদু? কই, আমি জানি না তো!
—জান না? নিজে অনেক সময়ে বুঝতে পারা যায় না।
তখন আমার ইলেভ্ন্ থেকে টুয়েলভে ওঠার পরীক্ষা এসে গেছে। প্রিপারেশনের ছুটি চলছে। পরীক্ষার জন্যে আমার আলাদা করে পড়ার দরকার হত না। তাই সারা বছরের রুটিনই চলত। কিন্তু তাতে তো সবার মন উঠত না। দাদাই তো ধমক মারত। একগাদা প্রবলেম দিত সল্ভ্ করতে। বেশির ভাগই পারতুম। কয়েকটা হয়তো পারলুম না। দাদা বলত— দেখছিস তো? প্র্যাকটিস চাই। ভাল রকম অনুশীলন।
বাবা নিজের ভুল হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলেন বলেই থেকে থেকে বলছিলেন পড়াশুনো ঠিকঠাক হচ্ছে তো? দেখো ফাঁকি দিয়ো না, পস্তাবে।
মায়েরও খুব টেনশন হচ্ছে ভেতরে ভেতরে, বোঝা যেত। একটু বেশি করে মাছ দিলেন হয়তো, খেতে আপত্তি করলে বলতেন— মাছ খেলে মগজ পরিষ্কার হয় সমু।
সেই সময়ে একদিন দাদু একটু সকাল-সকাল বাড়ি ফিরলেন। মুখটা গম্ভীর। হাত-মুখ ধুয়ে বাড়ির ঢোলা পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরলেন। আমিও তখন সবে বাড়ি ঢুকেছি। দাদু বললেন— সমু ভাই, তোমার একটু সময় হবে?
—হ্যাঁ, কেন হবে না? —আমি বসে পড়ি।
দাদু অনেকক্ষণ ধরে আমাকে দেখতে থাকেন। যেন জরিপ করে নিচ্ছেন কিন্তু একটু অন্যমনে। আমি ধৈর্য ধরে বসে থাকি। হঠাৎ দাদু কথা বলেন।
—সাম হাউ আমার মনে হয়, তুমি একটু আলগা, মানে বাড়ির সঙ্গে তোমার সম্পর্কর কথা বলছি।
আমি চুপ করে থাকি।
—শুধু বাড়ি কেন, সমু, পুরো সংসারটার সঙ্গেই যেন তোমার কোনও ঘনিষ্ঠতা নেই। ঠিক কি না?
এটা সরাসরি প্রশ্ন। জবাব দিতেই হয়।
—কেন এ কথা বলছ? আমি তো আজকাল বাজার পর্যন্ত করি। ফিনকিকে পড়া দেখিয়ে দিই, আমি ভাবতে থাকি তারপর বলি, আর ধরো হঠাৎ ডাক্তার ডাকতে হলে, ওষুধ কিনতে হলে… বাড়িতে কেউ এলে মিষ্টি-টিষ্টি কিনতে হলে…।
দাদু বললেন— সেটাই তো ভাবাচ্ছে। এমন নয় যে তুমি দায়িত্বশীল নও, কিছু করতে বললে সেটা তুমি পালনও কর। আমি জানি, তোমার বয়সে একটু বাইরের টান বেশি হয়। বন্ধু-বান্ধব। কিন্তু এটা আজকের ব্যাপার নয় সমু। ছোট্ট থেকেই তোমাকে এমনই দেখছি। পুলু ছাড়া কোনও বন্ধুকেও তো আসতে দেখি না। বন্ধু হয়নি তোমার? কলেজে, ক্লাবে?
—হ্যাঁ, অনেক তো!
—না, না, আমি জাস্ট পরিচিত সমবয়সিদের কথা বলছি না। বন্ধু, যার সঙ্গে তোমার কোনও বন্ড আছে, যাকে তুমি সব কথা বলতে পার।
আমি চুপ করে থাকি। ভেবে দেখতে গেলে সত্যিই তেমন প্রাণের বন্ধু কেউই নেই আমার। অথচ কতজনের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়। ক্লাবে ব্যায়ামের পর খালি গায়ে তোয়ালে কাঁধে যখন বসে থাকি, কত গুলতানি হয়, আমি তো থাকি, মাঝে মধ্যে ফোড়নও দিই।
—অখিলদা আজকাল খুব ডাঁটে থাকে… দেখেছিস? মোটরবাইকটা কেনার পর থেকে… কেউ হয়তো বলল।
—এবার পেছনে কোমর জড়িয়ে বসার কেউ এলে তো আর দেখতে হচ্ছে না, কী বল সমু? বিনুনি উড়বে, আঁচল উড়বে। পথ যদি না শেষ হয়… আরেকজন।
আমি হাসি।
—এবার জুনিয়র সেকশনে বান্ধব-সমিতির একটা ছেলে নিখিল ভারত যোগকুমার হয়েছে… কী নাম রে ছেলেটার? …আমি বলি।
—সঙ্কর্ষণ বোধহয়…
—গোরাদার ক্ষমতা নেই ওরকম একটা বার করে, কী বল সমু? একজন মন্তব্য করে।
—কেন? আমরা তো বেশ ভালই আছি!
—এতদিন শরীর-চর্চা করছি, একটা অ্যাম্বিশন থাকবে না?
—আমার তো এটাই অ্যাম্বিশন ছিল। ভাল স্বাস্থ্য, সত্যিই আজকাল সব সময়ে বেশ ফ্রেশ লাগে। —আমি বলি।
কলেজের আড্ডা আবার অন্য রকম। বেশির ভাগ ছেলেই মেয়েদের নিয়ে আলোচনা করে।
—প্রীতি খুব স্মার্ট, কী রকম গটমট করে যায়, টকাটক উত্তর দেয়!
—মুখটা ভ্যাঁটকা। সুইট হল রীনা…মুখার্জি না মিত্র রে?
—কেন তাতে কী দরকার? পদবি মিলিয়ে প্রেম করবে গুরু? কী বলে সেই? পাল্টি ঘর?
—যাঃ, প্রেম-ফ্রেম কে করতে চাইছে?
—পেটে খিদে, মুখে লাজ, বাবা! আছ হোস্টেলে, চুটিয়ে যা করবার করে নাও এই বেলা।
মেয়েদের বিষয়ে আমার যে খুব একটা শুচিবাই আছে তা কিন্তু নয়। আমিও দেখি—প্রীতিকে। ওর স্মার্টনেস আমার ভাল লাগে। রীনা সত্যি সুন্দর। এত সুন্দর হাসে। এ ছাড়াও আছে রত্নাবলী, নন্দিতা, সুমিতা। সুমিতা খুব ভাল ছাত্রী, চোখে হাই-পাওয়ারের চশমা, ও খুব পড়ুয়া টাইপ। কারও দিকে বড় একটা মন দেয় না। রত্নাবলী ধনী লোকের মেয়ে, গাড়িতে আসে যায়, গা থেকে ভুরভুরে সেন্টের গন্ধ বেরোয়, একেক দিন একেক রকম শাড়ি। নন্দিতা কালো, রোগা, গম্ভীর। মনে হয় ও অম্বলের অসুখে ভুগছে। এ ছাড়াও অনেক আছে— অর্ণব, সুকান্ত, চঞ্চল, আদি, প্রণব… অনেক, অনে-ক।
আমি গ্যালারির সর্বোচ্চ বেঞ্চে বসে ওদের কালো কালো মাথা দেখি, একটা স্থির কালো নদী যেন। বাবরিতে, বিনুনিতে, কদম ছাঁটে, বব-চুলে বয়ে বয়ে চলেছে। ক্লাস শেষে নদীতে ঢেউ ওঠে, ভেঙে ভেঙে যায় সব।
পুলক বলে—কী রে, যাবি না!
যেন ঘুম ভেঙে উঠি—অ্যাঁ? হ্যাঁ! চল।
দাদু আবার বলেন— বন্ধু না থাকাটা একটু…
আমি বলি—বন্ধু নেই, তা নয়, আছে। তবে মনের কথা বলার মতো… তা ছাড়া মনের আবার আলাদা করে কথাই বা কী! কোনও কথা নেই তো!
—তুমি যে সেই বাড়ির স্বপ্নের কথা বলতে! জানলাহীন বাড়ি। বট অশ্বথত্থ গজিয়েছে… দেওয়াল থেকে।
আমি চমকে উঠি। আগের রাতেই দেখেছি। ঘরের পরে ঘর, তারপরে আরও ঘর, ভগ্নস্তূপ। দেওয়াল আঁকড়ে আছে শেকড়-বাকড়। চুন বালি খসা দেওয়াল…
—দেখি, মাঝে মাঝে।
—শোনো, প্রায়ই যখন দ্যাখো ও স্বপ্নের কোনও একটা মানে আছে।
আমার একটু আগ্রহ হয়। আমিও নিশ্চিত স্বপ্নটার কোনও মানে আছে। কিন্তু সেটা কী ধরনের মানে তা আমি বুঝতে পারি না। যেভাবে বলা হয় ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়। ভবিষ্যতের ছবি দেখা যায়। সাপের স্বপ্ন মানে বংশবৃদ্ধি। এইভাবে কী? আমি জানি না, কিন্তু জানতে চাই। নিজে নিজে বুঝতে পারলেই সবচেয়ে ভাল।
—তুমি কি কবিতা লেখ?— দাদু জিজ্ঞেস করেন।
—না, না, —আমি খুব প্রতিবাদ করে উঠি।
—কেন সমু, কবিতা লেখা তো খারাপ কিছু নয়? তোমাদের বয়সে তোমাদের বাবাও অনেক কবিতা লিখেছে। সে স্টেজটা স্থায়ী হয়নি। যাদের স্থায়ী হয় তারাই কবি হয়।
—আমি কবিতা লিখি না দাদু, কিন্তু আমার প্রতিদিন কত কী মনে হয়!
—শোনো সমু, সেই মনে-হওয়াগুলো অনর্থক মনের মধ্যে না রেখে একটা ডায়েরি-টায়েরিতে লিখে ফেল। তুমি…তুমি বোধহয় তোমার বয়সের তুলনায় বেশি ম্যাচিওর, হয়তো সেই জন্যেই সমবয়সিদের মধ্যে বন্ধু পাও না। যেটুকু কথা বলো সে এই বুড়ো মানুষটার সঙ্গে, কেমন?
দাদুর কথা শুনে আমি হাসি।
—আজকে তোমাকে কয়েকটা দরকারি কথা বলতে ডেকেছি ভাই।
—বলো!
দাদু বললেন— কীভাবে বলব…তুমি কী এসব শোনবার মতো বড় হয়েছ? জানি না। সমু আমাদের আয়টা অনেক কমে যেতে চলেছে। আমি এবার অবসর নেব ভাবছি।
আমি শুনছি চুপচাপ।
দাদু থেমে থেমে বলতে লাগলেন— পালিতসাহেব মারা যাবার আগে একটা উইল করে গেছেন বলে শুনেছিলুম। উনি নিজেই আমাকে নিশ্চিন্ত থাকতে বলেছিলেন। যতদিন চাকরি করব, ততদিন। তো ধরো স্যালারি ড্র করবই, তা ছাড়াও… কিছু পার্কস… ধরো টেলিফোন, ইলেকট্রিসিটি, গাড়ি উইথ শফার, পেট্রল, বাইরে বেড়াতে যাবার খরচ, বাড়িতে কোনও উৎসব-টুৎসব হলেও উনি আমাকে সওগাত পাঠাতেন। …ধরো তোমার বাবা-মা’র বিয়েটা বা তোমাদের অন্নপ্রাশন আমি খুব ঘটা করে দিতে পেরেছিলুম… কেন না অনেকগুলো খাতে খরচ পালিতসাহেবই করেছিলেন। কিন্তু কেউ জানে না তোমায় বলছি সমু, উনি আমাকে আমার যোগ্য মাইনে দিতেন না। জমিদারি যাবার পর ওঁরা টাকাপয়সা লাগান কোলিয়ারিতে। চা-বাগানে। লসে চলছিল। আমি আসার পর ওঁরা ফুলে ফেঁপে ওঠেন, বহু স্থাবর সম্পত্তি, ঘোড়া এ সমস্ত আমার উদ্যোগেই হয়েছে। কুর্গ ভ্যালির চা-বাগান আমারই প্ল্যান। তা ছাড়া রেসহর্স। এই সব সম্পত্তির চার ভাগের তিন ভাগই আমার করা। উনি বলতেন গাড়িটা তুমি অবসর নেওয়ার পরও পাবে। ওটা তোমারই। ম্যান্ডেভিলার বাড়িটা তোমায় দিয়ে যাব, কিছু ভাল শেয়ার, পেনশন তো থাকবেই। পালিতসাহেব তো হঠাৎই মারা গেলেন। উইল পড়ে দেখা যাচ্ছে, ওসব কিছুই উনি আমাকে দ্যাননি। শুধু হাজার টাকা পেনশন……আমার ধারণা জুনিয়র পালিতেরও কিছু কারসাজি আছে এতে। ও কোনওদিন আমাকে তেমন…। আসলে ওর বাবা আমাকে বেশি বিশ্বাস করতেন তো! …এখন কিছুকাল ওর আন্ডারে কাজ করলুম। সুবিধে হচ্ছে না। সংসারের কথা ভেবে… আর বোধহয় চালানো ঠিক হবে না। মানীর মান রাখতে জানে না। কী? ঠিক করছি তো? বয়সও আমার অনেক হল। অন্য চাকরি করলে কবে রিটায়ার করে যেতুম।
—হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। যেখানে মান থাকবে না… দাদু এত বৈষয়িক কথা আমাকে বলছেন! আমাকে!
—এগজ্যাক্টলি। যেখানে আমিই হর্তা-কর্তা ছিলুম সেখানে পদে পদে—বিসাইডস ও ছেলেটা ভাল তৈরি হয়নি, বুঝলে? এ সম্পত্তি ও রাখতে পারবে না। তখন খুব কষ্ট পাব, তিল তিল করে গড়া একটা সাম্রাজ্য তো… তবে তোমার বাবার সঙ্গেও কথা বলেছি… সে-ও একই কথা বলেছে। সে সব ঠিক আছে। আমার কথাটা হল, স্টেটাস, আয় সবই কমে যাবে। তোমরা এখনও কেউ তৈরি হওনি… তোমাদের ওপর এর প্রভাব অনেকটাই.. তোমরা যদি বলো তো আরও কিছুদিন…।
—না, না, দাদু। আমাদের জন্যে… অসম্ভব। তা ছাড়া আমি তো গাড়িও চড়ি না, টেলিফোনও তত ব্যবহার করি না। ছোটবেলায় অবশ্য তোমার সঙ্গে অনেক বেড়িয়েছি।
—জানি। তুমি বললে শুনে ভাল লাগল। তোমার দাদার… কিন্তু মত অন্য রকম।
—অন্য রকম?
—হ্যাঁ, ও খুব ক্ষুব্ধ মনে হল। এম. এসসি ফাইন্যাল ইয়ার ওর, কী করবে না করবে …আমি যেটা বলছিলুম সমু, তুমি যদি হায়ার সেকেন্ডারিটা পাশ করে এঞ্জিনিয়ারিং পড়ো, তা হলে চট করে দাঁড়িয়ে যাবে। আমি জানি তোমার সাহিত্য-দর্শন এ সবের দিকে ঝোঁক। তাই-ই… একটু…
—কে বললে? না তো! সাহিত্য পড়তে আমার ভাল লাগে। ফিলসফিক্যাল থটস নিয়ে পড়তেও ভাল লাগে…। কিন্তু ঠিক আছে আমি চেষ্টা করব এঞ্জিনিয়ারিংই পড়তে।
—থ্যাংকিউ, আমার একটা ভাবনা গেল। তোমার দাদা আমাকে কেস করবার কথা বলছিল।
—কীসের কেস!
—ওই যে উইলটা! আমাকে এক রকম বলেছিলেন, আরেক রকম বার হল! কনটেস্ট করতে বলছিল। এ বিষয়ে তোমার কী মত?
—মুখে বলেছিলেন, সেটা উইলে সত্যিই লিখেছিলেন কিনা… শিওর না হয়ে তো… আমি অবশ্য এ সব ব্যাপারে…।
—সেটাও একটা কথা, তা ছাড়া পালিতসাহেব খুব কৃপণও ছিলেন। একটু মীন মাইন্ডেড যাকে বলে। কাজ করিয়ে নিয়ে পরে হাঁকিয়ে দেওয়া ওর চরিত্রে ছিল। আনপ্রেডিক্টেবল। আমার উচিত ছিল সোঁদা কথায় না ভিজে স্যালারিটা বাড়িয়ে নেওয়া। লোকের জন্য এত বিষয়সম্পত্তি করলুম অথচ নিজের বেলায়… ঠকে… ঠকেই তো গেলুম। ইমপ্র্যাকটিক্যাল!
দাদু মাথা নিচু করে বসে রইলেন। এরকম পরাজিত রূপ তাঁর কখনও দেখিনি। এভাবে নিজের কর্মক্ষেত্র, বিষয়সম্পত্তি, মালিকের সম্পর্কে কথা তাঁকে বলতেও শুনিনি। অদ্ভুত মানুষ, আমাদের কাছেও উনি এক রকম জবাবদিহি করছেন, পরামর্শ চাইছেন।
আমার দাদুর জন্য কেমন কষ্ট হল। কেমন একটা ধূসর কষ্ট। তীক্ষ্ণ নয়। সমস্ত মনটাতে যেন শীতের সন্ধে নামল। ইনি এত সচ্ছল ছিলেন যে এঁর ছেলে রাজকুমার আখ্যা পায়। ইনি গাড়ি চড়ে চলাফেরা করতেন। সাহেব-সুবোর মতো ধরনধারণ। এখন কী অপমানজনক ভাবে ইনি বঞ্চিত হয়েছেন। ঠকে গেছেন। দাদুর সঙ্গে আমার সুখ-দুঃখ যে অনেকটাই গাঁটছড়া বাঁধা ছিল সেদিনই স্পষ্ট বুঝেছিলুম। এবং হয়তো সেই দিন থেকেই আমরা প্রকৃত বন্ধু হলুম। সতেরো আর সাতাত্তর।