সমুদ্র মেখলা -9
বিয়ে বাড়ির কোন ঝামেলাই নেই ।সবাই কে আলাদা করে কাজের দায়ভার দেওয়া হয়েছে । রাজার ওপর কোন কাজের দায়িত্ব ছিল না । শুধুমাত্র অতিথির আপ্যায়ন করা ই প্রধান কাজ । তা ছাড়া প্রবাসী বাঙালিরা একটু কমই ত্রুটি বিচ্যুতি ধরতে অভ্যস্ত । পার্ক হোটেলেই বিয়ের অনুষ্ঠান হবে । খাওয়া দাওয়া সব দায়িত্ব হোটেলের । প্রায় দুই হাজার স্কোয়ার ফিট এর একটা হল এর মাঝখানে হবে ছাদনা তলা । জিনিস পত্র সব এসে গেছে ছাদনাতলা সাজাবার ।
বিশাখাকে ওর মা ডাকলেন। বললেন- ‘এ গুলো পরিস ‘। বলে হাতে একটা গহনার বাক্স ধরিয়ে দিয়ে আবার বিশাখার মা বলেন- তোকে তো কিছুই তো দেবার ই সুযোগ হলো না । আপত্তি করতে গিয়ে ও থেমে গেল বিশাখা । মা অনেক আগের থেকেই এ গুলো বিশাখার জন্য ই বানিয়ে রেখেছেন । বিশাখা বলল- রাজার মায়ের গহনা ও কিছু রয়েছে ।
বিশাখার মা আবার বলেন–এগুলো তোর জন্য ই করা। তুই ছাড়া আমাদের আর কে আছে । সবই তো তোর । বলতে বলতে বিশাখার মায়ের দু’ চোখ জলে ভরে ওঠে । বিশাখা দুহাত দিয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরল ।
কাক ডাকা ভোরেই চিন্না ওয়ালটেয়র এর বাড়িতে সুছন্দার দধিমঙ্গল হয়ে গেল । সুছন্দাকে গহনা, শাঁখা, পলা সব পড়িয়ে দেওয়া হল । কিছু স্ত্রী আচার হওয়ার পর বিয়ে বাড়িতে প্রাণ সঞ্চার হল ।
বিশাখা বার বার নিজেকে সুছন্দার জায়গায় বসিয়ে দেখছিল । তখন রাজি হলে সেই কবেই বিশাখার বিয়ে হয়ে যেত । এতদিনে সন্তান ও হয়ে যেত । ভাবতে ভাবতেই রাঙা হয়ে উঠল ওর মুখ খানা । রাজার কথাটা মনে হল, “ওয়ান মাস্ট বি ডটার” ।
শ্বশুরের ঘরে শাশুড়ির একখানা বাঁধানো বড় ছবি ছিল । বিশাখা দুখানা বড় মালা আনিয়ে রেখেছিল মামনির ছবিতে দেবে বলে । পরিস্কার একখানা কাপর দিয়ে ছবি খানা যত্ন সহকারে মুছলো বিশাখা। চন্দন পাটা থেকে চন্দন কাঠিতে তুলে শাশুড়ির ছবিতে আঁকছে ধ্যান মগ্ন বিশাখা ।
সুছন্দা র গলার আওয়াজ কানে এল বিশাখার, – বৌদি ,তখন থেকে তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি । বলতে বলতে ঘরে ঢোকে সুছন্দা দৃষ্টি পড়ল বিশাখার দিকে । বিশাখার তখন গভীর দৃষ্টি শাশুড়ির ছবিতে । এই মা ও তার নিজের মায়ের মতোই ভালবাসতেন । সুছন্দার চোখে জল । বিশাখা বুঝলো ‘ বিশাখার গলার কাছে একটা কষ্টের দানা বেঁধে রয়েছে ।
এই মহিলার সাধ ছিল বিশাখাকে ছেলের বৌ করে ঘরে আনার । বিশাখার মায়ের ও সেই ইচ্ছে ছিল । তাই ছেলেবেলা থেকেই সুছন্দার মা মনি ছাড়া ডাকেন নি । রাজা তাই ‘যেন তেন প্রকারেন’ ‘বিশাখাকে বিয়ে করার জন্য বন্ধ পরিকর হয়েছিল । চন্দন পরান হলে, চন্দনের বাটিটা রাখতে গিয়েই বিশাখার নজরে পড়ল সুছন্দা কাঁদছে । বিশাখা সুছন্দাকে জড়িয়ে ধরল । বিশাখার মনটা ও ভার হয়ে আছে । বিশাখা মাসীমা বলে ডাকলেই তিনি বলে উঠতেন—“-আমাকে মাসীমা বলে কখনও ডাকবি না ,মামনি বলে ডাকবি ” ।
বিশাখা সুছন্দাকে বলল- মা মনি আমাদের সঙ্গেই আছেন। কাঁদিস না । মালাটা মামনিকে পড়িয়ে দে ।
সুছন্দা চোখ মুছে মায়ের ছবিতে মাথাটা পড়িয়ে দিল। পাশের ঘর থেকে ডাক পড়তেই সুছন্দা চলে গেল । বিশাখা মামনির ছবির সিঁথীর সিঁদূর আর ও গাঢ়ো করে রাঙিয়ে দিলো । এবার ছবিটা নিয়ে গেল ড্রইং রুম এ, যেটা সর্ব সমক্ষে থাকবে । একটা কোনে, যেখানে সকলের দৃষ্টি পড়বে সেখানেই ছবিটা রাখল । আর ও একটা মালা পড়িয়ে দিল ছবিতে । মা মনির পরণের হলুদ কাঞ্জিভরম সিল্কের শাড়িটা ছবি বলে মনে হচ্ছে না । যেন আসল সিল্কের ফাইবার, মনে হচ্ছে এই মাত্র পাট ভেঙে পড়েছে । ধুপের গন্ধ ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে । বিশাখা মামনির মতো মাথায় আঁচল তুলে মামনির উদ্দেশ্যেই প্রণাম করল। হঠাৎই ডুকরে কান্না এসে গেল বিশাখার । মামনির কাছে ওর অন্যায়ের যেন কোন সীমা নেই । পিঠে স্নেহের স্পর্শে কান্নার বেগটা আরও বেড়ে গেল ।
পিছনে রাজার বাবার কন্ঠ। – রাজা ,ওকে ভেতরের ঘরে নিয়ে যা । আনন্দের দিনে চোখের জল ফেল না মা । তোমার শাশুড়ির সাধ তো পূর্ণ হয়েছে । ও তোমাকে বরণ করেই চলে গেছে । রাজা বিশাখাকে ভেতরের ঘরে নিয়ে যেতে রাজার বাবা সোফায় বসলেন । চশমাটা খুলে চোখ মুছলেন ।
বিশাখাকে রাজার মা ই পছন্দ করেছিল সেই ওদের ছোট বেলার থেকেই । বৌ এসেছে, মেয়ের ও বিয়ে হচ্ছে , কিন্তু কিছুই সে দেখতে পেল না । মনটা হাল্কা করতেই উঠে গেলেন বাইরে ।
ছেলের বাড়ি থেকে গায়ে হলুদের তত্ত্ব এসে গেছে । বারোটার মধ্যেই গায়ে হলুদ হয়ে গেল । তনয় এসেছে। আবার আগের মতই হৈহৈ শুরু করে দিয়েছে বিশাখার সাথে । বিশাখার চোখ জোড়া বার বার ছুটে চলেছে তার প্রেমিক স্বামীর দিকে । রাজার চোখ দুটো যেন ফালা ফালা করে দিচ্ছে বিশাখাকে । এখন সেই মানুষটাকে দেখে কে বলবে যে সেই এসে অবধি বিশাখার প্রেমে আচ্ছন্ন হয়ে ছিল । তনয়ের ছবি তোলা চলেছে একে একে । আর সব ছবিতেই বিশাখাকে টেনে দাঁড় করাচ্ছে । আর তখন রাজার দৃষ্টি ওদের অনুসরণ করে চলেছে ।
সুছন্দার খোঁপা বাঁধছিল বিশাখা ,তনয় কোথা থেকে এসে হাজির। ছবি তুলে চলেছে একে একে । আর সব ফটোতেই বিশাখাকে চাই । রাজার দৃষ্টি ওদের দুজনকে অনুসরণ করে চলেছে । সুছন্দার খোঁপা বাঁধছিল বিশাখা হঠাৎই তনয় এসে বিশাখার মুখখানা দুহাতে ধরে ওর দিকে ফিরিয়ে বলল- বিশাখা এদিকে তাকা । তারপর ই বিশাখার শাড়িটা ঠিক ঠাক করে দেয়। যেন বিশাখা কোন মেয়েই না । বিশাখার দৃষ্টি রাজার শক্ত চোয়ালের দিকে । বোঝে রাজার রাগের কারণটা । দৃষ্টিতে রাজাকে অনুনয়ের ভঙ্গি বিশাখার । রাগে রাজা ওঘর থেকেই বেড়িয়ে গেল ।
সুছন্দাকে সাজানো হয়ে গেলে সুছন্দা বিশাখাকে বলল। – এবার তো সব হয়ে গেল । তুই এখন তনয়ের সাথে ও বাড়ি চলে যা । বিশাখা- তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে ? দেখলি না তনয় কে ছবি তুলতে দেখে তোর দাদার মুখভঙ্গী? তায় আবার তনয় ! তাছাড়া কতো লোক আসবেন। আমি না থাকলে হয় ! সুছন্দা- সব ব্যবস্থা করা আছে । তুই আমার বৌদি হলেও তার আগে আমার বন্ধু । দাদার ইচ্ছে টা পূরণ করতে হলে তোকে ও বাড়ি চলে যেতে হবে । বুঝেছিস? বিশাখা হেসে বলল- ঠিক আছে যাব । একবার অতিথিদের মুখখানা দেখিয়ে নেই । শোন, আর যাই করিস কর, আমাকে নাম ধরে ডাকিস না ,বুঝলি? শেষে দেখব তোর বর অবধি আমায় নাম ধরে ডাকছে । সুছন্দা দু কানে হাত দিয়ে বলে, ও কে বাবা, এবার থেকে বৌদি, তুমি । ঠিক আছে ? দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরল ।
পাশের ঘরে যেতেই বিশাখার মা বললেন । – দেখ তো , তখন অমত না করলে কতো জাঁক করে তোর বিয়ে দিতাম ।
বিশাখা বলল – ভেরি সরি, মা । তোমাদের অনেক কষ্ট দিয়েছি । তুমি বিশ্বাস কর মা যেভাবেই আমার বিয়ে হোক না কেন আমি তাতেই খুশি । তোমরা কষ্ট পেয়োনা । মেয়ের হাতে একটা শাড়ির প্যাকেট দিয়ে বলেন, – লাল শাড়িটা এখন , আর অন্য টা সুছন্দার বৌ ভাতের দিন পরবি ।