চার নম্বর বিপদ-সংকেত
মাছ ধরার ট্রলারগুলোকে ফিরে আসার জরুরি বার্তা দেয়া হচ্ছে।
সমুদ্র সৈকতে বিপদ-সংকেতজ্ঞাপন লাল পতাকা উড়ছে। ছোট্ট সমুদ্র-শহর ঢেকে আছে অন্ধকারে। দমকা বাতাসে কয়েক জায়গায় বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে গেছে। – কিছুক্ষণ প্রবল বৃষ্টিপাতের পর ঝড়ো বাতাসে বৃষ্টি থেমে যাচ্ছে। থমথমে একটা অবস্থার সৃষ্ট হচ্ছে। আকাশে এক ধরনের অশুভ লাল আলো।
সার্কিট হাউস অন্ধকারে ডুবে আছে। ঘরে-ঘরে মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। মোমতাবির আলোয় সবকিছু কেমন অন্যরকম লাগছে। অনির ফুর্তির সীমা নেই। সে একটু পরপর বলছে, আমাদের খুব মজা হচ্ছে, তাই না মা?
রিমি বলল, হ্যাঁ হচ্ছে।
ঝড় আমাদের সবাইকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে, তাই না?
হ্যাঁ নেবে।
সমুদ্রের কাছে এলে এত মজা হয় কেন মা?
জানি না। এখন যাও তো তোমার বাবাকে গিয়ে বিরক্ত কর।
বড়রা এত বিরক্ত হয় কেন মা?
তাও জানি না।
এমন কেউ কি আছে যে সব প্রশ্নের উত্তর জানে?
উফ্ চুপ কর তো।
তৌহিদ বিষণ্ণ মুখে বসে আছে। তার প্রধান সমস্যা সিগারেট ফুরিয়েছে। ঝড়বৃষ্টির মধ্যে সিগারেট কেনার জন্যে কাউকে পাঠানোর প্রশ্ন ওঠে না। এই দীর্ঘ রজনী সিগারেট ছাড়া চলবে কীভাবে? এই মুহূর্তেই তার সিগারেট দরকার। একটা ছাতা জোগাড় হলে নিজেই বের হত। ছাতা সে পাবে কোথায়?
এখন অবশ্যি বৃষ্টি হচ্ছে না। বের হলে মন্দ হয় না। তৌহিদ শার্ট গায়ে দিতে-দিতে বলল, রিমি আমি একটু বাইরে যাচ্ছি, এক্ষুনি এসে পড়ব।
অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার, রিমি কিছুই বলল না। তৌহিদ নিছু স্বরে বলল, এখন বৃষ্টি হচ্ছে না। আবার শুরু হবার আগে-আগে চলে আসতে হবে।
রিমি বলল, যাচ্ছ যখন একটা মশারি কিনে এন। কাল রাতে অনিকে মশা কামড়েছে। এদের মশারি নেই।
ওষুধ তো আছে। ওষুধ স্প্রে করে দিক।
দরকার নেই, ওষুধের গন্ধে তোমার আবার শ্বাসকষ্ট শুরু হবে। মশারির সঙ্গে মনে করে সুতলিও কিবে আর একটা টর্চ। টাকা আছে তোমার কাছে?
আছে।
তৌহিদ ঘর থেকে বেরুবার পর কিছুক্ষণের মধ্যে আবার বৃষ্টি শুরু হল। সেই সঙ্গে দমকা বাতাস। অনি খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল বাবাকে কি বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে গেছে?
বড় বিরক্ত করছ অনি।
তুমিও বিরক্ত করছ মা।
যাও তো চুপচাপ শুয়ে থাক।
অনি রাগ করে তার বিছানায় শুয়ে পড়ল। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে ঘুমিয়েও পড়ল।
রিমি এখন একা।
প্ৰায়ান্ধকার ঘর। বাইরে ঝড়বৃষ্টির মাতামাতি। এর মধ্যে একা সময় কাটানোর আলাদা আনন্দ আছে। রিমি মনে-মনে ভাবল, তৌহিদ দেরি করে ফিরলে ভালো হয়। সে কিছু সময় একা থাকতে পারে। একা থাকার আনন্দ সে ভুলেই গেছে। বিয়ে হবার আগে একা থাকতে ইচ্ছা করলে ছাদে যেত। বর্তমানে বাড়ির ছাদে যাবার উপায় নেই। বাড়িওয়ালা সব সময় ছাদে তালা দিয়ে রাখে। একবার চাবির জন্যে জিতু মিয়াকে পাঠিয়েছিল। বলেছে চাবি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
বাথরুমে গোসলের সময়টা অবশ্য তার নিজের। রিমি দীর্ঘ সময় ধরে গায়ে পানি ঢালতে পছন্দ করে। তারও উপায় নেই। অনি এসে দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকবে, মা, ও মা। দরজা খোল মা।
পুরোপুরি নিঃসঙ্গ হবার কোনো ব্যবস্থা থাকলে ভালো হত। একটা ঘর থাকবে, যার দরজা বন্ধ করা মাত্র ঘরের আলো নিভে যাবে। বাইরের কোনো শব্দ সেই ঘরে ঢুকবে না।
রিমি ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল।
আর ঠিক তখন দরজার কড়া নাড়ল।
তৌহিদ কি এত তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে?
রিমি দরজা খুলে একজন অপরিচিত ভদ্রমহিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। মহিলা খুব মিষ্টি গলায় বললেন, আমি আপনাদের পাশের ঘরে থাকি। আমার স্বামীর সঙ্গে বোধ হয় আপনাদের পরিচয় হয়েছে জামাল হোসেন। আমার নাম রোকেয়া।
রিমি বলল, আসুন।
ভদ্রমহিলা ঘরে ঢুকতে-ঢুকতে বললেন, ও আজ দুপুরে আপনাদের অনেক গল্প করল। কাল আমরা চলে যাচ্ছি-ভাবলাম দেখা করে যাই।
খুব ভালো করেছেন। আমি যদি তুমি করে বলি তাহলে রাগ করবে? আমি বয়সে তোমার অনেক বড়। আমার বড় মেয়ে কলেজে পড়ে।
অবশ্যই আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন। বসুন। খাটে পা তুলে বসুন।
তোমার হাসবেন্ড কোথায়?
ও কোথায় জানি গেছে। কাঁচুমাচু মুখ করে বাইরে যেতে চাইল। বোধহয় সিগারেট আনতে গেছে।
মনে হচ্ছে খুব কঠিন শাসনে রাখছ। ঐ বুঝি তোমাদের মেয়ে?
জ্বি।
খুব না-কি ছটফটে মেয়ে? অনবরত কথা বলে?
রিমি হাসিমুখে বলল, ও আসলে খুব লাজুক। এখানে এসে যে কী হয়েছে, সারাক্ষণ কথা বলছে।
ভদ্রমহিলা বললেন, মুখে-মুখে কথা বলতে পারে এ রকম মেয়ে আমার খুব পছন্দ। আমার নিজের মেয়েটার মুখে কোনো কথা নেই। সমস্ত দিনে ছটা সাতটার বেশি শব্দ বলে কি-না সন্দেহ।
আপনার মেয়ের নাম কি?
মুনিয়া। খুব আশা ছিল মুনিয়া পাখির মত সারাক্ষণ কিচির-মিচির করবে। মেয়ে এ রকম হবে জানলে এর নাম রাখতাম উটপাখি। উটপাখি কোনো সাড়াশব্দ করে না।
ভদ্রমহিলা শব্দ করে হাসলেন।
রিমির মনে হল, মানুষে-মানুষে কত তফাৎ হয়। কত বড় অফিসারের স্ত্রী অথচ কী সহজ স্বাভাবিক ব্যবহার।
রিমি বলল, আপনাদের খুব মজা, দেশে-বিদেশে ঘুরেঘুরে বেড়ান।
তোমাদের বুঝি খুব বেড়াতে ইচ্ছা করে?
হ্যাঁ।
খুব ভালো ইচ্ছা বেড়াবে। বেড়ানোর মানেই যে দিল্লি-আজমির যেতে হবে তা তো না—তুমি যদি রিকশা করে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে যাও, গাছগুলোর দিকে তাকাও; সেটাও বেড়ানো। তাই না?
রিমি ভদ্রমহিলার সঙ্গে একমত হল না। তবু হা-সূচক মাথা নাড়ল। ভদ্রমহিলা বললেন, আমার বেড়াতে যে খুব ভাল লাগে তা না। বেনোর চেয়ে ভ্রমণকাহিনী পড়তে আমার ভালো লাগে। তবে জামাল অন্যরকম। সমুদ্র ওর খুব পছন্দ। এই যে বৃষ্টি হচ্ছে; ও বসে আছে সমুদ্রের পাশে।
রিমি বিস্মিত হয়ে বলল, সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি। সমুদ্র ওর কেন পছন্দ জান?
না।
ওর প্রথম স্ত্রী সমুদ্রের জন্যে পাগল ছিল। একবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সমুদ্রের পাশে থেকে সান-বাৰ্ন হয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। ওর শখ ছিল সমুদ্রের উপর যেখানে যত লেখা আছে জোগাড় করা। সে নিজেও সমুদ্র-বন্দনা নামে দীর্ঘ একটা রচনা শুরু করেছিল।
আশ্চর্য তো!
আশ্চর্যের কিছু নেই। প্রাণের প্রথম সৃষ্টি হয় সমুদ্রে। কাজেই বলা যেতে পারে আমরা উঠে এসেছি সমুদ্র থেকে। সমুদ্র হচ্ছে আমাদের আদি মাতা। আমাদের চোখের জল নোনতা, আমাদের রক্ত নোনতা, আমাদের রক্তে যে ঘনত্ব; সমুদ্রের পানিরও সেই একই ঘনত্ব। সমুদ্রের প্রতি আমরা এক ধরনের আকর্ষণ তো অনুভব করবই। আমাদের মধ্যে কেউ-কেউ সেই আকর্ষণ তীব্রভাবে অনুভব করে।
আপনি খুব গুছিয়ে কথা বলেন।
আমি গুছিয়ে কথা বলি, কারণ আমি একটা কলেজে পড়াই। কথা বলা হচ্ছে। আমার পেশা।
দমকা বাতাসে মোমবাতি নিভে গেল। রিমি বাতি জ্বালানোর জন্যে উঠে যাচ্ছে। ভদ্রমহিলা বললেন, উঠতে হবে না। তুমি বস। অন্ধকারই ভালো।
রিমি বলল, আপনার চিন্তা লাগছে না?
তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, চিন্তা লাগবে কেন?
উনি একা-একা সমুদ্রের কাছে আছেন।
ও তো ছেলেমানুষ নয়। ও যা করবে বুঝেশুনেই করবে।
যদি সমুদ্রে নামেন? নিশ্চয়ই খুব বড়-বড় ঢেউ উঠছে।
সমুদ্ৰে নামবে না। ও কখনো সমুদ্রে নামে না। আনুশকা যখন ছিল তখন তাকে নিয়ে নামত। সেই স্মৃতি ধরে রাখতে চায় বোধহয়। কিংবা হয়ত ওর সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল ওকে ছাড়া কখনো সমুদ্রেনামবে না। নববিবাহিত স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীরামজারমজার চুক্তি করে। কেউ-কেউ সেসব মনে রাখে। কেউ-কেউ রাখে না। আমি অবশ্য কখনো জিজ্ঞেস করি নি। জিজ্ঞেস করতে ভালো লাগে না।
তাঁর গলার স্বর কোমল। কিছুটা হয়ত আর্দ্র। তিনি কিছুক্ষণ চপ করে থেকে বললেন, তোমার হয়ত ধারণা হচ্ছে আমি প্রচুর বকবক করি। তাই না?
আমার এমন কিছু মনে হচ্ছে না। আপনি গল্প করছেন, আমার শুনতে ভালো লাগছে।
আমি যে খুব গল্প করি তাও না। আমার স্বভাবও অনেকটা আমার মেয়ের মতোই। চুপচাপ নিজের মনে থাকি। বইটই পড়ি।
আপনি যে আমার সঙ্গে কথা বললেন তার জন্যে কি আপনার খারাপ লাগছে?
না খারাপ লাগছে না। ভালোই লাগছে। তবে কেন এত বললাম সেটা তোমাকে ব্যাখ্যা করি। ব্যাখ্যা না করলেও হয়, তবু করি। তুমি দেখতে অবিকল আনুশকার মতো। ও আমাকে বলেছিল, আমি বিশ্বাস করি নি। তোমাকে দেখে বিশ্বাস হয়েছে।
আপনি কি উনাকে দেখেছিলেন?
না দেখি নি। ওর ছবি দেখেছি। আমাদের বাসায় তার অনেক ছবি বাঁধানো আছে। একজন মানুষের সাথে অন্য একজন মানুষের চেহারায় মাঝেমাঝে কাকতালীয় কিছু মিল দেখা যায়। সে রকম মিল। এই মিল ওকে খুব এফেক্ট করেছে। তোমাদের নিয়ে ও আজ হিমছড়ি গিয়েছিল, তাই না?
উনি যাচ্ছিলেন, আমাদের দেখতে পেয়ে তুলে নিলেন।
ব্যাপারটা তা না কিন্তু। সি-বীচে তোমাদের দেখে সে গাড়ি যোগাড় করল। আমাকে সব বলেছে। তুমি নিশ্চয়ই আমার কথা শুনে খুব বিব্রত বোধ করছ। তুমি পবিত্র ধরনের একটি মেয়ে। মানুষের বিচিত্র সব জটিলতার সঙ্গে তোমার হয়ত পরিচয় নেই। তোমাকে এসব জটিলতার সঙ্গে পরিচয় করানোও আমার উচিত হয় নি। তবু বলে ফেললাম। আমি আসলে খুব দুঃখী মেয়ে। ঝড়বৃষ্টির রাতে মানুষের মন দ্রবীভূত হয়ে থাকে। মনের কঠিন খাঁচা আলগা হয়ে যায়। গোপন দুঃখ সব বের হয়ে আসে। আমার দুঃখের গোপন কিছু কথা তোমাকে বলে ফেললাম, কিছু মনে করো না।
আমি কিছুই মনে করি নি।
আনুশকা যেভাবে ওর হাত ধরে সমুদ্ৰে নামতো আমারও তত সেইভাবে সমুদ্রে নামতে ইচ্ছা হতে পারে। পারে না?
নিশ্চয়ই পারে।
তুমি বাতি জ্বালাও, আমি এখন উঠব।
আরেকটু বসুন।
না যাই। তুমি মোমবাতিটা জ্বালাও তো।
রিমি বাতি জ্বালাল।
তিনি বললেন, আমি যদি তোমাদের মেয়েকে একটা উপহার দেই তুমি কি রাগ করবেঃ
রিমি বলর, কী যে বলেন। কেন রাগ করব?
আগে বল রাগ করবে না।
রাগ করব না।
তোমার মেয়ের জন্যে আমি একটা ক্যামেরা এনেছি। দেখতে মনে হয় খুব দামি, আসলে তেমন দামি নয়। তা ছাড়া জিনিসটা পুরানো। আমরা কিছুদিন ব্যবহার করেছি।
রিমি অস্বস্তি ভরা গলায় বলল, উনি ক্যামেরাটা দিতে বলেছেন তাই না?
হ্যাঁ। তুমি যদি না নাও, তাহলে ও কষ্ট পাবে।
আপনি উনাকে অসম্ভব ভালবাসেন?
তা বাসি। সবার ভালবাসা তো এক রকম নয়। আমি ভালবাসি আমার মতো করে। তুমি ভালবাসবে তোমার মতো করে। যাই, কেমন?
আপনারা কি কাল সকালেই চলে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ আমরা খুব ভোরে রওনা হব। তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে না।
তৌহিদ ফিরল রাত দশটায়।
সে কাকজো হয়ে আছে। মশারি একটা কিনেছে, সেই মশারি ভিজে ঢোল। তার কেনা সিগারেট অবশ্যি রক্ষা পেয়েছে। পলিথিনের ব্যাগ দিয়ে মোড়া ছিল বলেই এই অসাধ্য সাধন হয়েছে। তৌহিদ বিব্রত বোধ করছে। টর্চও কেনা হয়েছে। এতক্ষণ আলো দিচ্ছিল। কিন্তু সার্কিট হাউজের সিঁড়িতে পা দেয়া মাত্র টর্চের আলোও নিভে গেল। পানি চুইয়ে ভেতরে ঢুকে কিছু-একটা হয়েছে।
তৌহিদ অত্যন্ত বিব্রত বোধ করছে। সবচে বড় ভয় রিমিকে নিয়ে। সে যে ভয়াবহ রকমের রাগারাগি করবে, এটা বলার জন্যে জ্যোতিষী হওয়া লাগে না। এতক্ষণ ধরে বাইরে, সে নিশ্চয়ই ভয় পেয়েছে। খুব অন্যায় হয়েছে। ঘর থেকে বের হওয়াটা ঠিক। হয় নি। কী হত সিগারেট না খেলে?
রিমি কিছুই বলল না। শুকনো টাওয়েল এগিয়ে দিয়ে সহজ স্বরে বলল, মাথা মুছে ফেল। তার গলার স্বরে রাগের কোনো আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। অবশ্যি এটা ঝড়ের পূর্বলক্ষণও হতে পারে।
তৌহিদ ক্ষীণ স্বরে বলল, ঢাকার সঙ্গে এই জায়গার তফাৎ কি জান? ঢাকায় বৃষ্টি-বাদলায় রিকশা বেশি পাওয়া যায়। বেশি ভাড়ার লোভে সব রিকশাওয়ালা রিকশা বের করে ফেলে। এখানে আকাশ একটু অন্ধকার হলেই সব রিকশাওয়ালা রিকশা তুলে রেখে বাড়ি চলে যায়। খাবার দিয়ে গেছে রিমি?
হ্যাঁ।
অনি খেয়েছে?
হ্যাঁ।
তুমি বোধ হয় খাও নি। মোমবাতি তো শেষ হয়ে এল। আরো আছে, না এটাই সর্বশেষ?
আর একটা আছে। তুমি হাত-মুখ ধুয়ে আস। খেতে বসে যাই। সব বোধহয় ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।
তৌহিদ মনে-মনে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মনে হচ্ছে রিমি তেমন রাগ করে নি। অবশ্যি মুখের ভঙ্গি এখনো খানিকটা কঠিন।
আরো আগেই আসতাম। রাস্তা হারিয়ে ফেললাম। অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না।
টর্চ তো কিনেছ দেখি।
টর্চের আলোয় কিছু বোঝা যায় না। ছোট্ট একটা জায়গায় আলো পড়ে। আজ কী খাবার দিয়েছে?
মুরগির গোশত আর রূপচান্দা মাছ। ভাজি আছে, ডাল আছে। অনেক খাবার।
খাবার ঠাণ্ডা হলেও তৌহিদ প্রচুর খেয়ে ফেলল। পয়সায় কেনা খাবার নষ্ট করা ঠিক না এই বলে প্লেটে খাবার তুলতে লাগল।
রান্নাটাও ভালো হয়েছে, তাই না রিমি?
হ্যাঁ।
ঝাল অবশ্যি বেশি দিয়েছে। ঝালটা মাকের জন্যে খারাপ তবে হার্টের জন্যে ভালো। বিশেষ করে কাঁচামরিচ। কাঁচামরিচ হ্ৰষসিসের জন্যে একটা চমৎকার মেডিসিন। তুমি যদি ডেইলি একটা করে কাঁচামরিচ খাও; তোমার কোনদিন থ্রম্বসিস হবে না।
রিমি বলল, তুমি দেরি করে আসায় আমি রাগ করি নি। কাজেই আমাকে খুশি করার জন্যে শুধু-শুধু কথা বলতে হবে না।
তৌহিদের অস্বস্তির সীমা রইল না। তার অকারণে কথা বলার রহস্য রিমি ঠিকই ধরেছে।
আজ আর কার্পেট বিছানো হল না। ঠাণ্ডা পড়েছে। কম্বল গায়ে দিতে হবে। খাটেই বিছানা তৈরি হল। তৌহিদ বলল, তুমি বরং অনির সঙ্গে শোও। ও একা আছে। বিদ্যুৎ চমকালে ভয়-টয় পাবে।
ভয় পাবে না।
মোমবাতি নিভিয়ে রিমি ঘুমুতে এল। তৌহিদ বলল, তুমি কি জরুরি কিছু আমাকে বলবে?
হ্যাঁ। কী করে বুঝলে?
তুমি যেমন আমার মনের কথাটা ধরে ফেল, আমিও তোমারটা ধরতে পারি। সব সময় পারি না। মাঝে-মাঝে পারি। কী বলবে?
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে রিমি বলল, তুমি কি আমাকে ভালবাস?
অবশ্যিই বাসি।
না বাস না। আমাকে তুমি ভয় পাও। ভালবাস না।
যাকে ভয় পাওয়া যায় তাকে বুঝি ভালবাসা যায় না?
হয়ত যায়; তবে আমার জন্যে তোমার মনে কোনো ভালবাসা নেই।
এমন গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার কখন করলে? আজ?
আবিষ্কার অনেক আগেই করেছি, আজ শুধু বললাম।
কী দেখে তুমি এমন সিদ্ধান্তে চলে এলে, সেটা আমাকে বল। আমি তোমাকে নিয়ে কোনো কবিতা লিখি নি বা রং-তুলি দিয়ে তোমার ছবি আঁকার চেষ্টা করি নি। তার কারণ তোমার প্রতি আমার ভালবাসা নেই তা কিন্তু না, তার কারণ আমি কবিতা লিখতে পারি না। ছবিও আঁকতে জানি না।
রিমি হালকা গলায় বলল, আবিষ্কার কখন করলাম জান?
কখন?
ফরহাদ ভাইয়ের ব্যাপারটা জানার পরও তুমি যখন চুপ করে রইলে, কোনোরকম কৌতূহল দেখালে না তখন বুঝলাম আমার প্রতি তোমার কোনো আগ্রহ নেই। আমি অতীতে কী করেছি না করেছি তাতে তোমার কিছুই যায়-আসে না।
তৌহিদ শান্ত গলায় বলল, ব্যাপারটা সেরকম নয় রিমি। তখন তোমার বয়স ছিল নিতান্তই অল্প। অল্প বয়সে একটা ভুল করেছ…
ভুল করেছি বলছ কেন? এমনও তো হতে পারে ঐ দিন যা করেছিলাম ঠিকই করেছিলাম। বল, হতে পারে না?
হ্যাঁ পারে। হতে পারে।
ফরহাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে হতে পারত, পারত না? না?
হ্যাঁ পারত।
আজ আমার যে সংসার আছেতাঁকে নিয়েও এম্নি একটা সংসার নিশ্চয়ই হতে পারত। আজ যেমন তোমাকে নিয়ে সমুদ্রের কাছে এসেছি, তখন তাঁকে নিয়ে আসতাম। তুমি আমার হাত ধরে আমাকে সমুদ্রমানে নিয়ে যাও নি। তিনি হয়ত যেতেন। কাজেই তাঁর সাথে পালিয়ে গিয়ে ভুল করেছি আর তোমাকে বিয়ে করে শুদ্ধ কাজটা করা হয়েছে এটা বলছ কেন?
তৌহিদ কিছু বলল না। রিমি যে খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে তা সে জানে। বিশেষ করে সে যখন রেগে যায় তখন খুব যুক্তি দিয়ে কথা বলে। এমনভাবে কথা বলে যে প্রতিটি বাক্য বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে।
তৌহিদ ঠিক করল সে একটি কথাও বলবে না। চুপ করে থাকবে। কথার পিঠে কথা না বললেই উৎসাহ হারিয়ে রিমি চুপ করে যাবে।
রিমি চুপ করল না। সে কথা বলে যেতে থাকল আপন মনে। কাউকে শোনাবার জন্যে নয়, যেন সে নিজেকেই শোনাতে চায়। রিমির গলার স্বর নিচু কিন্তু সে প্রতিটি বাক্য খুব স্পষ্ট করে উচ্চারণ করছে। রিমি বলছে, তোমার সঙ্গে বিয়ে হবার আগে একজন ডাক্তারের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছিল। ঐ ডাক্তার এফআরসিএস করতে বিলেত যাচ্ছিলেন। তাঁর সঙ্গে বিয়ে হলে আমিও বিলেত যেতাম, আমার অন্য একটা জীবন। হত। সেই জীবনটাও নিশ্চয়ই ভুল হত না?
এই আলোচনা থাক।
না থাকবে কেন? আমার অনেক কথা বলার আছে; আমি সেগুলি তোমাকে বলতে চাই। একজন আমি মেজরের সঙ্গে আমার বিয়ের কথা প্রায় পাকাপাকি হয়ে গিয়েছিল। তিনি প্রমোশন পেয়ে এতদিনে নিশ্চয়ই ব্রিগেডিয়ার-ফ্রিগেডিয়ার হয়েছেন। আর তুমি এগার বছর মাস্টারি করার পর এ্যাসিসটেন্ট হেডমাস্টার হয়েছে। তাও এ্যাকটিং পোষ্টে।
আমার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে এই কারণে তুমি কি মনে-মনে কষ্ট পাও?
হ্যাঁ পাই। আমি কখন স্কুল মাস্টার বিয়ে করতে চাই নি।
কী আর করবে বল, তোমার দুর্ভাগ্য।
দুর্ভাগ্য তো বটেই। উঠে যাচ্ছ কোথায়?
একটা সিগারেট খাব।
কেন, মাথা জাম হয়ে গেছে?
তৌহিদ উত্তর দিল না। বিছানা থেকে নেমে সিগারেট ধরাল। দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। বৃষ্টি থেমে গেছে। তবে এখন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সমুদ্র এখান থেকে অনেক দূরে। তবু সমুদ্রের হুমহম ক্রুদ্ধ গর্জন কানে আসছে। রিমিও তৌহিদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে কান্না-কান্না গলায় বলল, আমার ভাগ্য আসলেই খারাপ।
তৌহিদ বলল, আমারও মনে হয় তোমার খুব ভালো একটা বিয়ে হতে পারত। ভালোভালো সব সম্পর্ক ভেঙে গিয়ে আমার মতো একজন অপদার্থের সঙ্গে তোমার বিয়ে হল এটাই আশ্চর্য।
কেন হল জান? হল কারণ তোমার মতো খোজখবর না নিয়ে কেউ বিয়ে করে। না। যাদের সঙ্গে বিয়ের কথা হয়েছে তারাই খোঁজখবর করেছে। যখন জানতে পেরেছে আমি একটা ছেলের সঙ্গে একবার পালিয়ে গিয়েছিলাম তখনি পিছিয়ে গেছে। অবশ্যি ঐ মেজর সাহেব আমাকে দেখে এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তারপরও তিনি রাজি ছিলেন। বিয়ের দিন-তারিখও হয়ে গিয়েছিল।
তাহলে বিয়েটা হল না কেন?
হল না কারণ মেজর সাহেব একটা উড়ো চিঠি পেলেন। ঐ উড়ো চিঠিতে লেখা ছিল—আমি যে শুধু পালিয়ে গিয়েছিলাম তাই না, গৌরীপুরের একটা হোটেলে রাতও কাটিয়েছিলাম। হোটলটার নাম শাস্তি বোর্ডিং। তোমরা এরকম কোনো উড়ো চিঠি পাও নি?
না।
যদি পেতে হলে কি বিয়ে ভেঙে দিতে?
তোমার কী হয়েছে বল তো রিমি। আমি দেরি করে ফেরায় তুমি যদি রাগ করে থাক তাহলে হাতজোড় করে ক্ষমা চাচ্ছি। এস আমরা ঘুমুতে যাই। সকালে ঘুম ভাঙলে মন শান্ত হবে।
আমার মন শান্তই আছে। তোমার মনও শান্ত। তোমার শান্ত মনকে একটু শুধু অশান্ত করব। গল্পটা পুরোপুরি বলব। আজই শুধু বলব। আর কোনোদিন বলব না। বস, চেয়ারটায় বস। আমার দিকে তাকাও।
তাকালেও তো তোমাকে দেখতে পারছি না। বারান্দা অন্ধকার।
অন্ধকার হলেও তাকাও।
তৌহিদ তাকাল। রিমি কথা শুরু করল, ওর সঙ্গে আমি রওনা হলাম ভোরবেলা। ট্রেনে করে। গৌরীপুর স্টেশনে আমরা নামলাম। উনি আমাকে লেডিজ ওয়েটিং রুমে বসিয়ে চা আনতে গেলেন। আমি বসে আছি, হঠাৎ মেজো চাচা সেখানে ঢুকে অবাক হয়ে বললেন, তুই এখানে কোথায় যাচ্ছি, কার সঙ্গে যাচ্ছি? আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। কী বলব ভেবে পেলাম না। মেজো চাচা বললেন, কি রে, তার বাবা-মা কোথায়? কার সঙ্গে এসেছিস? আমি বললাম, মার সঙ্গে নেত্র চাচা বললেন, তোর মা কোথায়? আমি বললাম, চাচা আপনি এখানে দাঁড়ান, আমি মাকে ডেকে আনছি। মা কলে হাত ধুতে গেছে। বলেই ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। ঘর থেকে বের হয়েই ফরহাদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হল। দুজনে ছুটলাম ওভার ব্রিজের দিকে। মেজো চাচা আমাদের আর খুঁজে পেলেন না।
একরাত আমরা কাটালাম গৌরীপুরের সেই হোটলে। পরদিন সেই হোটেল থেকে আমাকে উদ্ধার করা হয়। মেজো চাচা ছিলেন, থানার ওসি ছিলেন, আরো অনেকেই ছিল—এই হচ্ছে আমার গল্প।
তৌহিদ বলল, রিমি, এই গল্প আমি জানি।
তুমি জান।
হ্যাঁ জানি। বিয়ের পর শুনেছি শান্তি বোর্ডিং-এর দোতলায় ছয় নম্বর ঘরে তোমরা ছিলে। তোমাদেরভাবভঙ্গি দেখে বোর্ডিং-এর ম্যানেজারের সন্দেহ হয়। সেই পুলিশে খবর দেয়। তুমি ঐ বোর্ডিং-এ পা দেয়ার পর থেকেই খুব কান্নাকাটি শুরু করেছিলে।
রিমি বলল, তুমি ছাড়া এই ঘটনা আর কে জানে? তোমার মা জানেন?
হ্যাঁ জানেন।
তিনি শুনে কী বলেছিলেন?
তিনি বলেছিলেন, ও বাচ্চা একটা মেয়ে। এরা অনেক ভুল করে। সে একটা ভুল, করেছে—তুই ক্ষমা করে দে।
রিমি শব্দ করে হাসল। তৌহিদ কঠিন গলায় বলল, হাসছ কেন? মা কি কোনো হাসির কথা বলেছিলেন?
অবশ্যই। তিনি বলেছিলেন গা বাঁচানো কথা। তোমার মা অত্যন্ত বুদ্ধিমতী মহিলা। তিনি পরিবারের স্ক্যান্ডেল প্রচার হোক তা চান নি। তুমিও চাও নি। তুমি চাও নি কারণ তুমি হচ্ছ মেরুদণ্ডহীন একজন স্কুল মাস্টার। তোমার কিল খেয়ে কিল হজম করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। তুমি খুব ভালো করেই জানতে একটি বউকে বিদেয় করে দিলে দ্বিতীয় একজনকে জোগাড় করা তোমার জন্যে শক্ত। তারচে এই তো ভালো। সুন্দরী একটি মেয়েমানুষ হাতের কাছে আছে। ঘরের কাজকর্ম করছে। রাতে শারীরিক প্রয়োজনেও তাকে পাওয়া যাচ্ছে। তৌহিদ নিচু গলায় বলল, তুমি একটা জিনিস ভুলে যাম্ রিমি। আমি খুবই তুচ্ছ এবং নগণ্য একজন মানুষ তা ঠিক, কিন্তু তুচ্ছ নগণ্য একজন মানুষের হৃদয়ও তো বড় হতে পারে।
বড় হৃদয়ের কথা আমাকে বলবে না। বড় হৃদয়, বড় মহৎ এইসব খুবই বাজে কথা। তুমি হচ্ছ গা-বাঁচানো মানুষ। তোমার কি মনে আছে, তোমাকে নিয়ে নিউ মার্কেটে গিয়েছিলাম? প্রচও ভিড়ের সুযোগে একটা লোক আমার বুকে হাত দিল।
তোমার মনে আছে?
আছে।
তুমি দেখেও না দেখার ভান করলে। এটা করলে কেন? তোমার হৃদয় বড় বলে? না, তা কিন্তু না। তুমি গা বাঁচাতে চাইলে। ঝামেলা এড়াতে চাইলে। তুমি যা চাও তা হচ্ছে কোনো ঝামেলা, কোনো যন্ত্ৰণা ছাড়া জীবনটা পার করে দিতে। স্ত্রীকে সামান্য ভালবাসলে যদি ঝামেলা কমে তাহলে সেই সামান্য ভালবাসাও তুমি দিতে প্রস্তুত আছ। আমার কথা শেষ হয়েছে, চল ঘুমুতে যাই।
চল।
আরেকটা শেষ কথা শুধু—এরপর থেকে আমি কিন্তু আর কোন দিন তোমার সঙ্গে শোব না। কোনদিন আমার গায়ে হাত দিতে পারবে না। আমার যাবার জায়গা নেই; কাজেই আমাকে থাকতে হবে তোমার সঙ্গে। কিন্তু আমি আবার পড়াশোনা করব। আবার বি.এ. পরীক্ষা দেব। অবশ্যই পাস করব। তারপর একটা চাকরি খুজে তোমাকে ছেড়ে চলে যাব।
তোমার যা ইচ্ছা তাই করবে। আমি বাধা দেব না।
তা দেবে না। বাধা দিলেই ঝামেলা। তুমি চাও ঝামেলাহীন একটা জীবন। রিমি এসে অনির পাশে শুয়ে পড়ল। তার কপালের শিরা দপদপ করছে। মাথায় অসহ্য যন্ত্ৰণা। সে ধরেই নিয়েছে আজ সারারাত তার ঘুম হবে না। অথচ কী আশ্চর্য, বিছানায় শুয়ে গভীর ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল। শেষরাতের দিকে সে জোবেদা খানমকে স্বপ্নে দেখল।
বৃদ্ধা মহিলা খুব করুণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছেন, তার চেয়েও করুণ গলায় বলছেন, বৌমা, তুমি শুধু-শুধু খোকার ওপর রাগ করছ। ও একবার আমাদের নেত্রকোনার বাসার পেছনের পুকুরে ডুবে গিয়েছিল। তারপর থেকে পানি খুব ভয় পায়। তুমি তো এই খবর জান। তারপরও কেন রাগ কর? পানি ভয় পায় বলেই তোমাকে নিয়ে সমুদ্রে নামে না।
আমি এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না।
তুমি মাথা ঘামাচ্ছ। তুমি আমার খোকার কাছে যাও। ওর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
রিমির ঘুম ভেঙে গেল। স্বপ্নের কোনো মানে হয় না। স্বপ্ন স্বল্পই। তবু এই স্বপ্নে কী যেন আছে। স্বপ্ন হয়েও এটা যেন স্বপ্ন না।
তৌহিদ পানি অসম্ভব ভয় পায় এটা সে জানে। সমুদ্রের কাছে আসার উত্তেজনায় ভুলে গিয়েছিল। অবচেতন মন তা মনে করিয়ে দিয়েছে। এর বেশি কিছু না। শ্বাসকষ্টের কথাটা ঠিক না। শ্বাসকষ্ট হলে তৌহিদ তাকে ডাকত।
রিমি উঠে বসল। ইলেকট্রিসিটি এখনো আসে নি। সে হাতড়ে-হাতড়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে তৌহিদের কাছে এগিয়ে গেল।
তৌহিদ জেগে আছে।
তার মুখ হাঁ হয়ে আছে। তার কপালে ঘাম। অসম্ভব যন্ত্রণায় ঠোঁট নীল হয়ে যাচ্ছে। চোখ ঘলাটে। রিমি রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, তোমার এত কষ্ট, কেন তুমি আমাকে ডাকলে না? কেন ডাকলে না?
ফিসফিস করে, যেন অতি দূরের কোনো জায়গা থেকে তৌহিদ বলল, রিমি, আমি মরে যাচ্ছি।
না তুমি মরছ না। তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে। ধর, তুমি আমার হাত ধর।
অনিকে দেখব। আমি অনিকে একটু দেখব।
তোমার কাউকে দেখতে হবে না। তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে। এই দেখ আমি তোমার হাত ধরে আছি।
নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।
পারবে। নিঃশ্বাস নিতে পারবে। কতক্ষণ ধরে এমন হচ্ছে?
অনেকক্ষণ।
কেন তুমি আমাকে ডাক নি?
নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।
রিমি জানালা খুলে দিল। পৰ্দা সরিয়ে দিল। তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। বাতাস আসুক। প্রচুর বাতাস। সমুদ্রের টাটকা হাওয়া এই ঘরের বদ্ধ বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যাক। রিমি কাঁপছে। সে নিজেও বুঝতে পারছে না যে তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে।
রিমি।
বল।
এক গ্লাস পানি দাও, যন্ত্রণাটা একটু কমেছে।
রিমি পানি গ্লাসে ঢেকে এনে দেখে তৌহিদ ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রচণ্ড কষ্টের পর একটু কষ্টটা কমলেই চোখে ঘুম আসে। রিমি মোমবাতি নিভিয়ে বারান্দায় এসে চোখ মুছল। ভোর হচ্ছে। পাখি ডাকছে। একজন দুজন রওনা হচ্ছে সমুদ্রের দিকে।
পাশের ঘরের দরজা খুলে জামাল সাহেব বের হয়ে এলেন। রিমির দিকে চোখ পড়তেই সে বলল, স্লামালিকুম।
জামাল সাহেব বললেন, আজ খুব ভোরে উঠেছেন মনে হচ্ছে।
জ্বি, আপনারা আজ চলে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ।
আর কখনো আপনাদের সঙ্গে দেখা হবে না?
জামাল সাহেব হাসিমুখে বললেন, হতেও পারে। আবার যদি কখনো সমুদ্রের পাশে আসেন তাহলে দেখা হবে। আমি প্রায়ই আসি।
রিমি চাপা গলায় বলল, আমি আর কখনো সমুদ্রে আসব না। কখনো না।
জামাল সাহেব সহজ গলায় বললেন, আনুশকা প্রতিবার এই কথা বলত। আবার আসত। আপনিও আসবেন।
জামাল সাহেবের স্ত্রী বের হয়ে এলেন। রিমিকে দেখে বললেন, তোমার কর্তা এবং কন্যা দুজনেই ঘুমুচ্ছে?
জ্বি।
কাল তোমার কর্তাকে দেখলাম কাকভেজা হয়ে ফিরছে। জ্বর হয় নি তো?
জ্বি না। শরীর একটু খারাপ হয়েছিল। এখন ভালো, ঘুমুচ্ছে।
তাহলে তুমি চল আমাদের সঙ্গে। শেষবারের মতো সমুদ্র দেখে আসি।
রিমি কয়েক মুহূর্ত ভাবল, তারপর বলল, চলুন। এক সেকেন্ড দাঁড়ান, আমি স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে আসি।
ঝড়ের পর শান্ত সমুদ্র।
কী নীল, কী নীল।
আকাশে-সমুদ্রে মাখামাখি হয়ে আছে। কোথায় সমুদ্রের শেষ, কোথায় আকাশের শুরু-বোঝাই যায় না। মনে হয় আকাশ সমুদ্রমেশা।
তারা তিনজন চুপচাপ দাঁড়িয়ে। রিমি বলল, আমি কখনো সমুদ্ৰে নামি নি।
জামাল সাহেবের স্ত্রী বললেন, কেন বল তো?
একা-একা নামতে ভয় লাগে। ও কখনো নামবে না। ওর পানির খুব ভয়। ও একবার পানিতে ডুবে গিয়েছিল।
ভদ্রমহিলা বললেন, জামাল, তুমি ওর হাত ধরে ওকে একট সমদ্রে নিয়ে যাও।
জামাল সাহেব বিস্মিত চোখে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। ভদ্রমহিলা কিছু বলার আগেই রিমি তার হাত বাড়িয়ে দিল। সেই হাত বাড়ানোর মধ্যে কোনো দ্বিধা নেই, কোনো সংকোচ নেই।
জামাল সাহেব রিমির হাত ধরে এগিয়ে গেলেন। রিমি এগুচ্ছে নিঃসংকোচে। তার দৃষ্টি সমুদ্রের দিকে। সমুদ্রের জল তাদের দুজনের হাঁটু পর্যন্ত আসামাত্র রিমি বলল, আপনি কি আমার একটা অনুরোধ রাখবেন?
বিস্মিত জামাল সাহেব বললেন, নিশ্চয়ই রাখব।
আপনি কি কথা দিচ্ছেন?
জামাল সাহেব হাসিমুখে বললেন, পৃথিবীর তিনভাগ যে সমুদ্র ঢেকে রেখেছে তার মধ্যে দাঁড়িয়ে মানুষ যা বলে তাকে তা করতে হয়।
রিমি শান্ত স্বরে বলল, তাহলে আপনি আপনার স্ত্রীকে ডেকে আনুন। উনার খুব শখ আপনার হাত ধরে সমুদ্ৰে স্নান করবেন।
আমাকে তো ও কখনো বলে নি।
আমি দাঁড়াচ্ছি, আপনি উনাকে নিয়ে আসুন।
জামাল এগিয়ে যাচ্ছে। রিমি একা দাড়িয়ে আছে।
হঠাৎ তার কী যে হল—সে এগিয়ে যেতে থাকল সমুদ্রের দিকে। বড়-বড় ঢেউ আসছে। সে গ্রাহ্যই করল না।
জামাল সাহেব এবং তার স্ত্রী দুজনই ছুটে তার কাছে আসতে চেষ্টা করছে। বড়বড় ঢেউ ভেঙে পড়ছে। তারা কেউ এগুতে পারছে না। জামাল সাহেব প্ৰচণ্ড ধমক দিলেন, এইসব কী পাগলামি হচ্ছে? এই মেয়ে, তুমি কি আমাদের দুজনকে মারতে চাও?
প্রচণ্ড একটা ঢেউ এসে প্রবল বেগে রিমির গায়ে আছড়ে পড়ল। এই ঢেউ রিমিকে তীরে ছুঁড়ে ফেলতে পারে। আবার কোন এক অদ্ভুত কৌশলে নিজের কাছে টেনেও নিতে পারে। সে কী করবে, কে জানে।