Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সমুদ্র বিলাস (১৯৯০) || Humayun Ahmed » Page 6

সমুদ্র বিলাস (১৯৯০) || Humayun Ahmed

তারা কক্সবাজার পৌঁছল

তারা কক্সবাজার পৌঁছল দুপুর দুটায়।

তৌহিদ ভেবে রেখেছিল কোন একটা হোটেলে উঠবে। দামি হোটেল যেমন আছে, কমদামি হলেও নিশ্চয়ই আছে। প্রতিদিন এক শ বা দুশ টাকা দিয়ে থাকার মতো হোটেল নিশ্চয়ই আছে।

তৌহিদের হোটেল সমস্যার সমাধান হল নিতান্তই দৈবক্রমে। বাস স্টেশনে এক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বললেন, মাস্টার সাহেব না?

তৌহিদ তাঁকে চিনতে পারল না। তবু পরিচিত ভঙ্গিতে হাসার চেষ্টা করল। ভদ্রলোক বললেন, বেড়াতে এসেছেন বুঝি?

জ্বি।

আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন?

জ্বি না।

আমার দুই ছেলেকে আপনি পড়িয়েছেন। শিমু আর হিমু।

ও আচ্ছা-আচ্ছা।

দুই জনেই ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছিল আল্লাহর রহমতে। অঙ্কে লেটার মার্ক ছিল। তৌহিদ কিছুই মনে করতে পারল না, তবে ভঙ্গি করল যে মনে পড়েছে। আমি এখানেই আছি। কৃষি ব্যাংকে। আপনারা উঠবেন কোথায়? কোনো একটা হোটেল-টোটেলে।

সার্কিট হাউসে উঠেন না কেন? আপনি সরকারি হাইস্কুলের এ্যাসিসটেন্ট হেডমাস্টার, আপনার তো সার্কিট হাউসে থাকার রাইট আছে। এন ডি সি বললেই হবে। তাছাড়া এখন অফ সিজন, লোকজন নেই। সব খালি পড়ে আছে।

তৌহিদ বলল, দরকার নেই, ঝামেলা করে।

ঝামেলার তো কিছু নেই। একটা ডাবল সিটেড রুমের ভাড়া মাত্ৰ যোল টাকা। আপনি খামাখা কেন তিন চার শ টাকা দেবেন।

তৌহিদ অসহায় ভঙ্গিতে রিমির দিকে তাকাল। সারাদিনের পরিশ্রমে তারা সবাই ভয়ানক ক্লান্ত। ইচ্ছা করছে দ্রুত কোনো একটা হটেলে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে বিছানায় শুয়ে পড়তে। তাছাড়া অনির শরীর খারাপ করেছে। বাসে তিনবার বমি করেছে। ওদের রাস্তায় ফেলে রেখে সে যাবে সার্কিট হাউসের খোঁজে সার্কিট হাউস হচ্ছে রুইকাতলাদের থাকার জায়গা! সে নিতান্তই একজন স্কুল টিচার।

ভদ্রলোক বললেন, আপনার স্ত্রী এখানে বসে অপেক্ষা করুন। চা-টা খান। আপনি চলুন আমার সঙ্গে আমি এন ডি সি সাহেবের সঙ্গে কথা বলে একটা ব্যবস্থা করে দি।

বাদ দিন।

রিমি বলল, তুমি যাও না উনার সঙ্গে।

অনির শরীরটা খারাপ।

শরীর খারাপ, শরীর ঠিক হবে। কতক্ষণ আর লাগবে। যাও না।

নিতান্ত অনিচ্ছায় তৌহিদ গেল। অচেনা-অজানা জায়গায় রিমিকে ফেলে চলে যাচ্ছে—কিছু হবে না জানা কথা।

তৌহিদের আশংকা অমূলক প্রমাণিত হল। এন ডি সি সাহেব শুধু যে সার্কিট হাউসে একটা ঘরের ব্যবস্থা করলেন তাই না, একটা জিপ দিয়ে দিলেন সার্কিট হাউসে পৌঁছে দেবার জন্যে।

ঘরে ঢুকে রিমি বলল, বাহ্।

কার্পেট ঢাকা ঘরে পাশাপাশি দুটা খাট। বসার জন্যে গদি আঁটা চেয়ার, প্রশস্ত ক্লসেট। চমৎকার বাথরুম। একজন এ্যাটেনডেন্ট এসে গ্লাসে খাবার পানি দিয়ে গেল। বাথরুমে নতুন সাবান এবং তোয়ালে রেখে গেল।

তৌহিদ বলল, এখানে খাবার ব্যবস্থা আছে?

এ্যাটেনডেন্ট বলল, পাহাড়ের উপর যে সার্কিক হাউস আছে ওখানে সব ব্যবস্থা আছে। এটা নতুন, সব ব্যবস্থা নাই। তবে স্যার, আমরা টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার এনে দেব। নিচে ডাইনিং রুম আছে, এখানে খেতে পারেন।

আশেপাশে হোটেল নেই?

পর্যটনের একটা রেস্টুরেন্ট আছে। পানাহার। হেঁটে যাওয়া যায়।

খাবারের দাম বোধ হয় খুব বেশি।

জ্বি স্যার, একটু বেশি। তবে খাবার ভালো।

রিমি বলল, আমরা গোসল-টোসল করে ঐখানেই যাব। তুমি কি ভাই একটু চা খাওয়াতে পারবে?

জ্বি, পারব।

ছেলেটি মুহূর্তের মধ্যে চা নিয়ে এল। চমৎকার কাপ। সুন্দর টি-পট। রিমি মুগ্ধ হয়ে গেল। অনির শরীর মনে হয় এখন ভালো লাগছে। সে বারান্দার এ-মাথা থেকে – মাথা পর্যন্ত ছোটাছুটি করেছে।

রিমি চায়ের কাপে চুমুক দিতে-দিতে বলল, এত সুন্দর একটা ঘরের ভাড়া মাত্ৰ ষোল টাকা! আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না। আমি ভেবেছিলাম প্রতিদিন দুশ আড়াই শ টাকা চলে যাবে ভাড়ায়।

অনি বলল, আমরা কখন সমদ্ৰ দেখব মা?

খুব শিগগিরই দেখব।

আমি চা খাব মা।

অন্য সময় হলে রিমি মেয়েকে কখনো চা দিতে না। আজ দিল। খুশি-খুশি গলায়। বলল, ঐ ভদ্রলোক আমাদের খুব উপকার করলেন। ভাগ্যিস উনার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল। ভদ্রলোকের নাম কি?

নাম জানি না।

নাম জান না মানে? তুমি উনার নাম জিজ্ঞেস কর নি?

না।

আশ্চর্য মানুষ তো তুমি। এত উপকার করলেন আর তুমি ভদ্রলোকের নামটা পর্যন্ত জিজ্ঞেস করলে না?

দেখা হবে নিশ্চয়ই তখন নাম জিজ্ঞেস করে নেব।

শুধু নাম জিজ্ঞেস করলেই হবে না। আমাদের সঙ্গে একবেলা চা খেতে বলবে।

আচ্ছা।

এরাতো মশারি দেয় নি। এখানে বোধহয় মশা নেই, তাই না?

হতে পারে। সমুদ্রের বাতাসে হয়তো মশা থাকে না।

তুমি আবার সিগারেট ধরাচ্ছ?

যাত্রায় নিয়ম নাস্তি রিমি।

তোমরা কী পাও সিগারেটে বল তো?

একটা টান দিয়ে দেখ না। দেখবে?

তৌহিদকে অবাক করে দিয়ে রিমি হাত বাড়াল—দাও। অনি হাততালি দিচ্ছে, তারস্বরে চেঁচাচ্ছে–মা সিগারেট খাচ্ছে। মা সিগারেট খাচ্ছে।

তারা সমুদ্র দেখতে বেরুল বিকেলে। রিমির খুব ঘুম পাচ্ছিল। ইচ্ছা করছিল মাথার উপরে ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে আরাম করে ঘুমায়। ঘুমুনোতো যেতেই পারে—এখন কোন দায়-দায়িত্ব নেই। ঘর গোছাতে হবে না, রাতে কী রান্না হবে তা নিয়ে ভাবতে হবে না, হঠাৎ লবণ ফুরিয়েছে—জিতু মিয়াকে লবণ আনতে পাঠাতে হবে না। নিশ্চিন্ত আরামে ঘুমুনো যায়। তবু রিমি বের হল অনির চাপাচাপিতে। সে এক্ষুনি সমুদ্র দেখবে।

তারা বেলাভূমিতে যখন পৌঁছল তখন সূর্য সমুদ্র স্পর্শ করেছে। সমুদ্রের একটি অংশ লাল, অন্য অংশটি গাঢ় নীল। ঢেউ বার-বার আছড়ে পড়ছে। ঢেউয়ের মাথায় দুধের মতো সাদা ফেনা।

প্রথম কয়েক মুহূর্ত রিমি কথা বলতে পারল না। এই দৃশ্যের জন্যে সে প্রস্তুত ছিল না। যখন কোনো জিনিস কল্পনাকে বহুগুণে ছাড়িয়ে যায় তখন মানুষ হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। মাথার ভেতর এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করে। রিমির সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করছে। সে জানত বিশাল একটা কিছু দেখবে তবু সেই জানাতেও ফাঁক ছিল। সে যে এত বিশাল কিছু দেখবে তার জন্যে মানসিক প্রস্তুতি তার ছিল না।

সে বিড়বিড় করে বলল, ভয় লাগছে।

তৌহিদ বলল, কিছু বলছ রিমি?

না।

কেমন লাগছে বল তো?

জানি না।

অনি ছুটে যাচ্ছে জল স্পর্শ করার জন্যে। ওকে ফেরানো দরকার। কে জানে হঠাৎ হয়ত বড় কোনো ঢেউ এসে তাকে নিয়ে যাবে। রিমি ছুটে যেতে পারছে না। মনে হচ্ছে তার পা বালিতে আটকে গেছে। সে ক্ষীণ স্বরে বলল, অনিকে নিয়ে এস।

তৌহিদ বলল, যাক না। কিছু হবে না। দেখ না কত বাচ্চারা খেলছে। তোমাকে এমন লাগছে কেন? শরীরটা খারাপ করেছে?

না। তুমি অনিকে নিয়ে এস।

তুমিও আস দুজন একসঙ্গে যাই।

না। আমি এইখানেই দাঁড়িয়ে থাকব। তুমি অনিকে নিয়ে এস।

তৌহিদ এগিয়ে গেল। অনি মহানন্দে পানিতে ছোটাছুটি করছে। ঢেউ এসে এক একবার পায়ে আছড়ে পড়ছে—সে খিলখিল করে হেসে উঠছে। সমুদ্র সবার মনে এক ধরনের ভয় এবং শ্রদ্ধার ভাব জাগিয়ে তোলে, শুধু শিশুদের মনে জাগায় ভালবাসা। শিশুরা কখনো সমুদ্র ভয় পায় না।

তৌহিদ ডাকল, অনি এস।

অনি ঘাড় বাঁকিয়ে বলল, না।

জামা ভিজে যাচ্ছে তো!

ভিজুক।

অসুখ করবে।

করুক।

তৌহিদের পাশে দাঁড়ানো মোটাসোটা ধরনের এক ভদ্রলোক বললেন, সমুদ্রের পানিতে ভিজলে অসুখ হয় না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।

তৌহিদ বেলাভূমির দিকে তাকাল। রিমি ঠিক আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়ানোর ভঙ্গি এবং তাকিয়ে থাকার ভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হয় নি। শেষ সূর্যের আলো পড়েছে তার চোখে-মুখে। বাতাসে তার চুল উড়ছে। রিমিকে রক্তমাংসের কোনো মানবী বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সমুদ্রের মতোই প্রাচীন কোনো হিরন্ময় মূর্তি।

সূর্যাস্ত দেখতে ভিড় করা ভ্ৰমণবিলাসীরা ক্যামেরায় ছবি তোলা নিয়ে ব্যস্ত। সূর্য ডুবে যাবার আগেই তাকে বন্দী করে ফেলতে হবে।

কয়েকটি অল্পবয়েসী তরুণী ভেজা বালিতে পায়ের ছাপ ফেলে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে। সম্ভবত নিজেদের মধ্যে কোনো বাজি ধরেছে। কে কার আগে যেতে পারে।

হানিমুন করতে আসা দুজোড়া স্বামী-স্ত্রীকেও দেখা গেল। দুজন স্বামীর পরনেই সিকের পাঞ্জাবি। গা থেকে ভুরভুর করে সেন্টের গন্ধ আসছে। বিয়ের প্রথম কিছুদিন পুরুষদের সিকের পাঞ্জাবি এবং সেন্টের প্রতি খুব আগ্রহ দেখা যায়। এই দুজন নববিবাহিত যুবকের হাতেও ক্যামেরা—তবে তাদের ক্যামেরায় তারা সূর্যাস্তের ছবি তুলছে না। ছবি তুলছে তাদের স্ত্রীদের। এদের কাছে এই মুহূর্তে তাদের স্ত্রীর রহস্য সমুদ্রের রহস্যের চেয়েও বেশি।

কয়েকজন শিশু মজার একটা খেলা আবিষ্কার করেছে। ভেজা বালিতে একটু গর্ত খুড়লেই নিচ থেকে পানি এসে গর্ত ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। এই আবিষ্কারে তারা মুগ্ধ ও বিস্মিত। এখন তারা বালি দিয়ে ঘরবাড়ি বানাচ্ছে, প্রতিটি বাড়ির পেছনে একটা করে পুকুর।

মাঝবয়েসী একজন ভদ্রমহিলাকে খুবই লজ্জিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। ভদ্রমহিলার স্বামী তাকে খুব ধমকামকি করছেন। উঁচু গলায় বললেন, পায়ের নিচ থেকে স্যান্ডেল সমুদ্র কী করে নিয়ে যায় এই জিনিসটাই তো বুঝলাম না। তোমরা এত কেলাস। এক পার্টি স্যান্ডেল শুধু-শুধু পায়ে পরে আছ কেন? এইটাও ফেলে দাও। তোমাদের নিয়ে কোথাও বের হওয়াই যন্ত্ৰণা। বেকুবের মত চলাফেরা। লজ্জায় এবং অপমানে ভদ্রমহিলার চোখে পানি এসে গেছে। তিনি প্রাণপণে সেই পানি আড়াল করার চেষ্টা করছেন।

তিনটি যুবতী মেয়ে এই সন্ধ্যাবেলায় স্নান করতে নেমেছে। তাদের সঙ্গে আছে দুজন পুরুষ। তারা একজন অন্যজনের উপর যেভাবে গড়িয়ে পড়ছে তা ঠিক শোভন নয়। অনেকেই সূর্যাস্ত বাদ দিয়ে এই দৃশ্যই খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছে। এদের মধ্যে দুজন প্রৌঢ়ও আছেন। এদের চোখের দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে এরা নিজেদের ঐ দুজন যুবকের জায়গায় কল্পনা করছেন।

একজন যুবক শ্যামলা মতে যুবতীটিকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে সুমদ্রের দিকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। যুবতীটি দুহাত ছুঁড়ে চেঁচাচ্ছে-ভালো হবেনা বলছি। ভালো হবে না বলছি। তখন একটি ঢেউ এসে এদের ডুবিয়ে দিল। ঢেউ সরে যাবার পর ওরা দুজন আবার উঠে দাঁড়াল। দেখা গেল, দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে আছে। মেয়েটি হাসছে। খিলখিল করে। যে দৃশ্য অন্য সময় কুৎসিত মনে হত, সমুদ্রের কারণে তা মনে হচ্ছে না। সুমদ্র অসুন্দরকে সুন্দর করতে পারে।

চকচকে লাল রঙের গেঞ্জি গায়ে একটি আট নবছর বয়েসী ছেলেকে উবু হয়ে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। তার সমস্ত ইন্দ্ৰিয় বালির দিকে। বালিতে ছোট-ছোট ফুটো। সেই ফুটো দিয়ে হুস করে লাল কাঁকড়া বের হয়ে আসছে। ছেলেটি চমকে উঠে গোঁগোঁ ধরনের শব্দ করছে। মনে হয় সে লাল কাঁকড়াগুলোকে খুব ভয় পাচ্ছে, তবু সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারছে না।

সমুদ্রে সন্ধ্যা খুব তাড়াতাড়ি নামে। সূর্য ডুবার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই অন্ধকার হয়ে গেল। এই বিপুল জলরাশির এক ধরনের প্রভা আছে। সেই প্ৰভায় সমুদ্র জ্বলছে অন্ধকার নামছে চারদিকে।

রিমি এখন আগের জায়গায়, তবে সে দাঁড়িয়ে নেই, বসেছে। তৌহিদ অনিকে নিয়ে ফিরেছে। অনি ঢেউয়ের ধাক্কায় উলটে পড়ে লোনা পানি গিলে বমি করে ফেলেছে। তার হাত-মুখ ধোয়ানো দরকার। তৌহিদ বলল, চল যাই। অনির মুখ ধেয়াতে হবে। কয়েকটি রেস্টুরেন্ট আছে, ঐখানে হাত-মুখ ধুইয়ে দি।

রিমি ক্লান্ত গলায় বলল, তুমি ওকে নিয়ে যাও। আমি খানিকক্ষণ বসি।

এই অন্ধকারে একা-একা বসে থাকবে?

একা কোথায়, কত মানুষ ঘুরছে!

চল আমার সঙ্গে, পরে নাহয় আবার এসে বসব।

না।

রিমির গলায় এই না খুব কঠিন শোনা। কিংবা সে হয়ত নিজের মতো করেই বলেছে, শোনাচ্ছে অন্যরকম।

সমুদ্রের ধার ঘেঁষে এক সারি ইলেকট্রিক বাতি জ্বলে উঠেছে। বাতি জ্বলছে সৈকত পুলিশের গোলাকার ঘরে। উত্তর দিকে পাহাড়ের উপর জোরাল সার্চ লাইট জ্বলছে। বাতি ঘুরে-ঘুরে জ্বলছে।

সমুদ্র এখন প্রবল গর্জন করছে। হুমহুম শব্দ উঠছে। যেন ক্ষণে ক্ষণে সে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। বার-বার বলছে, আমি আছি, আমি আছি।

রিমি একা-একা বসে আছে। সূর্যাস্ত দর্শনধারীদের প্রায় সবাই চলে গেছে। অল্প কিছু লোকজন আছে—তারা ঘুরছে জলের আশেপাশে। কোন বিচিত্র কারণে। রিমির মন অসম্ভব খারাপ হয়েছে। কান্না আসি-আসি করছে। গলার কাছে ব্যথা বোধ করছে।

আমি অনেকক্ষণ থেকে লক্ষ করছি, আপনি একা বসে আছেন। একা বসে থাকার জন্য জায়গাটা নিরাপদ নয়।

রিমি চমকে পেছনে ফিরে তাকাল। চশমাপরা রোগা একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। রিমি উঠে দাঁড়াল। ভদ্রলোক বললেন, আশা করি আপনি আমাকে ভয় পাচ্ছেন না? আপনার স্বামী এবং মেয়েটি কোথায়, ওদের তো দেখছি না।

রিমি জবাব দিল না। অপরিচিত এই ভদ্রলোকের কৌতূহল তার ভালো লাগছে না। গায়ে পড়ে কথা বলতে আসার কী মানে?

আপনারা তো সার্কিট হাউসে উঠেছেন। আমি এবং আমার স্ত্রী ঐখানেই আছি চার নম্বর কামরায়। বিকেলে আপনাদের বের হতে দেখেছি। এই পরিচয়ের দাবিতে কথা বলতে এসেছি। একা-একা বসে আছেন কেন?

রিমি এখনো জবাব দিল না। তবে তার মুখের কাঠিন্য কিছুটা কমে এল। ভদ্রলোক বললেন, এখানে কিছু দুষ্ট ছেলেপুলে আছে। পরশু সন্ধ্যায় এক ভদ্রমহিলার ব্যাগ নিয়ে ছুটে পালিয়েছে। আপনার স্বামী কোথায়?

ঐ রেস্টুরেন্টে গিয়েছে।

আপনিও চলুন। আপনাকে আপনার স্বামীর কাছে দিয়ে আসি।

রিমির একবার ইচ্ছা হল বলে, আমাকে আমার স্বামীর কাছে পৌঁছে দেবার জন্যে আপনি এত ব্যস্ত কেন? কিন্তু সে কিছু না বলে সঙ্গে-সঙ্গে আসতে লাগল।

রিমি ভেবেছিল হাঁটতে-হাঁটতে হড়বড় করে এই লোক প্রচুর কথা বলবে। ভাব জমানো ধরনের কথা। এক ধরনের মানুষ আছে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার সামান্যতম সুযোগও ছাড়ে না। মেয়েদের শরীরের সামান্যতম স্পর্শের জন্যেও ভূষিত হয়ে থাকে। রিমি কিছুটা বিস্মিত হল। কারণ এই ভদ্রলোক সারাপথে একটি কথাও বললেন না। দোকানগুলোর উজ্জ্বল আলোর কাছে এসে শুধু বললেন, ঐ যে ওদের দেখা যাচ্ছে। আপনি যান।

রিমি লক্ষ করল ভদ্রলোক আবার সমুদ্রের কাছে ফিরে যাচ্ছেন। রিমির মনে হল এই ভদ্রলোককে আপনাকে ধন্যবাদ জাতীয় কিছু বলা উচিত ছিল। বলা হল না। তার মনটা একটু খচখচ করতে লাগল।

অনি ঝিনুকের একগাদা জিনিস কিনেছে। বিকট-দর্শন শুকনো কাঁকড়া মাছের মতো কী একটা কিনেছে যার লেজ সুতীক্ষ্ণ সুচের মতো। হাঙ্গরের একটা দাঁত কিনেছে। আরেকটা কিনতে চায় দাদীমার জন্যে। তৌহিদ মেয়েকে বুঝানোর চেষ্টা

করছে, একদিনে সব কিনে ফেললে কীভাবে হবে। আমরা তো আবার আসব।

না এক্ষুনি কিনব।

ঝিনুকের দোকানী বলল, স্যার একটা শংকর মাছের লেজ দিয়ে বানানো চাবুক নিয়ে যান।

তৌহিদ বলল, চাবুক দিয়ে কী করব?

মারামারি করবেন।

তৌহিদ বিস্মিত হয়ে বলল, কার সঙ্গে মারামারি করব? দোকানী দাঁত বের করে হাসছে। তৌহিদ বুঝল এটা এই দোকানীর একটি প্রিয় রসিকতা। অনেককেই সে হয়ত বলেছে মারামারি করার জন্যে একটা চাবুক নিয়ে যান।

তৌহিদ বলল, চাবুকের দাম কত?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress