কোনো কথা দ্বিতীয়বার বলতে
কোনো কথা দ্বিতীয়বার বলতে তৌহিদের ভালো লাগে না। মানুষের জীবনটা এমন যে–যা ভালো লাগে না–নিজ জীবনে তা ফিরে ফিরে আসে। তৌহিদের বাবা কানে কম শুনতেন। তিনি প্রতিটি প্রশ্ন তিনবার চারবার করে জিজ্ঞেস করতেন। রিমি কানে খুব ভালো শোনে তবু তার বিশ্রী অভ্যাস, প্রতিটি প্রশ্ন কয়েকবার করে জিজ্ঞেস করে।
ডাক্তার বলল তোমার কোনো সমস্যা নেই।
হুঁ।
হুঁ আবার কী, ঠিক মতো বল, ডাক্তার কীভাবে বলল কথাটা?
বলল, আপনার কিছু হয় নি।
বললেই হল? আমার চোখের সামনে দেখছি তুমি নিঃশ্বাস নিতে পারছ না। দম বন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছ আর ডাক্তার বলেছে কিছু হয় নি।
বললে কী আর করা।
তুমি প্রতিবাদ কর নি?
প্রতিবাদ কি করব? আমি তো ডাক্তার না। স্কুল মাস্টার।
স্কুল মাস্টাররা প্রতিবাদ করে না?
না। ওরা ছাত্রদের ধমক-ধামক দেয়। ঐ পর্যন্ত। MRCP ডাক্তারের সঙ্গে প্রতিবাদ করব আমার এত সাহস আছে? তাছাড়া ডাক্তার ঠিক কথাই বলেছে।
ডাক্তার ঠিক কথা বলেছে?
বলেছে ওটা মনের অসুখ।
রিমি বিরক্ত গলায় বলল, তুমি পরিষ্কার করে কিছু বলছ না কেন? ওটা মনের অসুখ এই কথা ডাক্তার কখন বলল? গুছিয়ে বল তো ব্যাপারটা কী? শুরু থেকে বল— তুমি ডাক্তারের ঘরে ঢুকলে; তখন ডাক্তার কী বলল?
ডাক্তার বলল, বসুন।
তারপর?
তারপর আমি বসলাম।
তারপর?
আমি বললাম, স্লামালিকুম।
তৌহিদ টের পাচ্ছে রিমি রেগে যাচ্ছে। রিমি আগ্রহ নিয়ে বসে আছে সব কিছু শুনবে-তৌহিদ গুছিয়ে বলতে পারছে না। এই লোক ক্লাসে পড়ায় কী করে কে জানে?
তারপর কি হল বল। ডাক্তার সাহেব নিশ্চয়ই জানতে চাইলেন তোমার অসুখটা কি, তাই না?
হুঁ।
তুমি বললে?
তৌহিদ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, অনির জ্বর কমেছে?
হ্যাঁ কমেছে। তুমি তোমার কথা বল। তুমি কি বললে?
আমার এখন আর কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। অন্য সময় বলব।
তৌহিদ উঠে দাঁড়াল। সে এখন হাত ধুয়ে ফেলবে। তার প্লেটে এখনো অনেক। ভাত। সে ক্ষিধে আন্দাজ করতে পারে না। শিশুদের মতো স্বভাব। প্লেট ভর্তি ভাত রেখে সে উঠে পড়ে। প্রতিদিন ভাত নষ্ট করে। রিমির কষ্ট হয়।
বেসিনে হাত ধুতে-ধুতে তৌহিদ বলল, মেয়েটার হঠাৎ জ্বর এল কেন? রিমি মুখ শক্ত করে বসে রইল। তৌহিদের কথার জবাব দিতে ইচ্ছে করছেনা। তৌহিদ তার কথার জবাব ঠিক মত দিচ্ছে না, সে কেন দেবে? তার এত কী দায় পড়েছে? তৌহিদ হাত ধুতে-ধুতে বলল, মেয়েটাকে একটা ভালো ডাক্তার দেখানো দরকার। প্রায়ই জ্বরজ্বারি হয় এটা ভালো কথা না।
রিমি একটা কথার জবাব দিল না। আশ্চর্যের ব্যাপার, এতে লোকটা দুঃখিত হল না। সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঘর থেকে বের হল। জিতুকে বলল, একটা পান দে।
রিমির চট করে মনে পড়ল—ঘরে পান নেই। জিতুকে আনতে বলা হয়েছিল জিতু আনে নি। রিমি জানে তৌহিদের সঙ্গে রিমির কী কথা হবে। রিমি এই মানুষটাকে বাচ্চাদের বাংলা কোনো বইয়ের মধ্যে পড়ে ফেলতে পারে। দাঁড়ি-কমাসুদ্ধ বলতে পারে, একটুও এদিক-ওদিক হয় না। জিতু বলবে-ঘরে পান নেই। লোকটা বলবে-আচ্ছা ঠিক আছে।
হলও তাই। জিতু বলল, পান আনতে ভুলে গেছে। তৌহিদ বলল, ঠিক আছে। লাগবে না। ছাত্ররা এসেছিল?
হুঁ। বলছি আজ পড়া হইত না। স্যারের শইল খারাপ।
আচ্ছা, ঠিক আছে।
রিমির রাগ দ্রুত বাড়ছে। সব কিছুতেই আচ্ছা ঠিক আছে কেন? নিজের কোনো ইচ্ছা-অনিচ্ছা নেই? যে যা বলবে তাতেই আচ্ছা ঠিক আছে। বাড়িওয়ালা ঐদিন ডেকে নিয়ে এক ধাক্কায় পাঁচ শ টাকা বাড়ি ভাড়া বাড়িয়ে দিল। পানির ট্যাক্স বেড়েছে, ইলেকট্রিসিটির চার্জ বেড়েছে, হেনতেন কত কথা। লোকটা সবকিছু শুনে বলল,আচ্ছা, ঠিক আছে।
ঠিক থাকবে কীভাবে? এর মধ্যে ঠিক থাকার কী আছে? মুখের একটা কথাতেই বাড়ি ভাড়া পাঁচ শ টাকা বেড়ে যাবে? টাকা এত সস্তা? পাঁচ শ টাকা বেশি দিয়ে তারা এ বাড়িতে থাকবে কেন? ঢাকা শহরে বাড়ি কম পড়েছে?
অনি আজ বাবা-মার সঙ্গে শুয়েছে। রিমিদের খাটটা প্ৰকাণ্ড। বিয়ের সময় রিমির বাবা। মেয়েকে যেসব ফার্নিচার দেবেন বলে কথা দিয়েছিলেন তার মধ্যে খাট ছিল, ড্রেসিং টেবিল ছিল, সোফা ছিল। দেবার সময় দিয়েছে প্রকাণ্ড একটা খাট। আর কিছু না। ঐ খাট পেয়েই তৌহিদ খুশি। বিয়ের রাতেই কম করে হলেও তিনবার বলল, বাহু সুন্দর খাট তো! শুরুতে রিমির মনে হচ্ছিল ঠাট্টা করা হচ্ছে। সে লজ্জায় মরে যাচ্ছিল। তৌহিদের ছোট বোন খুব ক্যাটক্যাট করে কথা বলতে পারে সে কঠিন-কঠিন কথা শুনাচ্ছে—যা যা দেবার ছিল কিছুই দেয় নি—একটা ফুটবল মাঠে স্ট্যান্ড লাগিয়ে দিয়ে দিয়েছে। এর নাম নাকি খাট।
রিমির নিজেরও তার বাবার উপর খুব রাগ হয়েছিল। তার বাবা তাকে ঠকিয়েছে। অন্য বোনের বেলায় যেমন খরচপাতি করেছিলেন তার কিছু করেন নি। সব কিছু দায়সারা। ছেলেকে কাপড়চোপড় কেনার জন্যে দশ হাজার টাকা দেওয়ার কথা ছিল; ঐ টাকাটা পর্যন্ত দেন নি। তৌহিদ কোনো দিন এ নিয়ে কোনো কথা বলে নি।
রিমি জিতুকে দোকানে পাঠিয়ে পান আনাল এবং একটা সিগারেটও আনাল। শোবার ঠিক আগে-আগে পান এবং সিগারেট পেলে মানুষটা নিশ্চয়ই খুশি হবে। সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো কি এই মানুষটা মনে রাখে? তাকে খুশি করার এই ধরনের চেষ্টা যে রিমির মনে আছে তা কি এই মানুষটা টের পায়। সম্ভবত না। এক শ্রেণীর পাথর টাইপ মানুষ আছে জগৎ-সংসারের কোন কিছু যাদের স্পর্শ করে না।
রিমির হাত থেকে তৌহিদ পানের পিরিচ নিল। এমনভাবে নিল যেন সে জানত রিমি তার জন্যে পান-সিগারেট নিয়ে আসবে। এর জন্যে আলাদা করে কোনো ধন্যবাদ দেয়ার দরকার নেই।
তৌহিদ বসে আছে চেয়ারে। তার দৃষ্টি খাটের দিকে। খাটের মাঝখানে অনি কোলবালিশ নিয়ে ঘুমুচ্ছে। বিশাল খাটের মাঝখানটায় তাকে এতটুকু দেখাচ্ছে। তৌহিদ বলল, খাটটা আমার কাছে সমুদ্রের মতো লাগে। খাটটা কী বিশাল।
কী যে তুমি বল, এমন কী বিশাল? আমার দাদার আমলের খাট। ঐ সময় সব জিনিস বড়-বড় করা হত।
তা ঠিক। এখন আমরা যত সভ্য হচ্ছি; সব জিনিসও ছোট হচ্ছে।
ছোটই তো ভালল।
তা ঠিক, তবে কেন যেন শোবার খাটটা প্ৰকাণ্ড না হলে আমার আলো লাগে না। খাটটা হবে প্রকাণ্ড। যখন ঘুমুব মনে হবে সমুদ্রে শুয়ে আছি। তাই না?
রিমি তাকিয়ে আছে। হা, লোকটাকে এখন খুশি-খুশি মনে হচ্ছে। বেশ খুশি।
তৌহিদ বলল, ডাক্তার আমাকে কক্সবাজার যেতে বলল।
রিমি আশ্চর্য হয়ে বলল, কই, সে কথা তো বল নি।
আরে দূর-দূর, বললেই যাওয়া যায় না-কি?
কোনো কারণ আছে বলেই নিশ্চয় বলেছে।
কোনো কারণ নেই। কথার কথা; এম্নি বলেছে।
বিছানায় ঘূমতে যাবার ঠিক আগমহৰ্তে তৌহিদ বলল, একবার অবশ্য কক্সবাজার গেলে মন্দ হয় না। সমুদ্র কনো দেখা হয় নি। তুমি দেখেছ রিমি?
না।
তোমার দেখতে ইচ্ছে করে না?
না।
আমার খুব করে। কেন করে সেই কারণটি একদিন তোমাকে বলব।
আজই বল।
আজ থাক। ঘুম পাচ্ছে। আরেকদিন বলব।
ফরহাদের কথাটা তৌহিদকে বলা দরকার। কীভাবে বলবে তা রিমি ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারছে না। এই গল্পটি কি তাকে বলা ঠিক হবে? সব কিছু কি সবাইকে বলা যায়? বলা উচিত? না থাক, কিছু বলার দরকার নেই।
রিমি খুব সহজেই ঘুমিয়ে পড়তে পারে। আজ ঘুমুতে পারল না। প্রায় সারা রাত জেগে কাটাল। কয়েকবার উঠে বারান্দায় পায়চারি করল। মাথায় পানি দিয়ে এল। কিছুতেই কিছু হল না। তার চোখ নিষ্ঠুম। মাঝেমাঝে এমন নিষ্ঠুম রাত তার আসে। তখন খুব খারাপ লাগে, রাত পার করে দিতে হয় বারান্দায় হেঁটে-হেঁটে। এই বাড়ির বারান্দাটা চমৎকার, হাঁটতে ভালো লাগে। ভালো লাগলেও বেশিদিন হাঁটা যাবে না। বাড়ি ছাড়তে হবে। পাঁচ শ টাকা বেশি দিয়ে এই বাড়িতে কে থাকবে? তাদের কি টাকার গাছ আছে? না, তাদের কোনো টাকার গাছ নেই। প্রতিটি টাকা তাদের খুব সাবধানে খরচ করতে হয়।
তৌহিদ সমুদ্র দেখার কথা বলেছে এটাতো কিছুই না। এত কাছে সমুদ্র। তবু এখন মনে হচ্ছে এটা বিরাট একটা কিছু।
জোবেদা খানম তাঁর ঘর থেকে চেচালেন, কে হাঁটে বারান্দায়? কে?
আমি।
তুমি নাকি? বারান্দায় হাঁট কেন?
এম্নি হাঁটি।
অনির জ্বর নাই তো?
না।
তাহলে অনিকে আমার এখানে দিয়ে যাও।
ওকে এখন আনতে পারব না মা। বাবার সঙ্গে ঘুমুচ্ছে।
একা-একা থাকি, একজন কেউ পাশে থাকলে ভালো লাগে।
অনিতো সব সময়ই আপনার সঙ্গে ঘুমায়। একাত না ঘুমুলে কিছু হবে না মা। ওর বাবার কাছ থেকে এখন আনতে পারব না।
জোবেদা খানম খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তোমার কাছে যে লোকটা এসেছিল, সে কে?
কেউ না। আপনি ঘুমান তো। আপনার সব কিছু জানতে হবে না-কি?
এক সংসারে থাকি, কোথায় কী হচ্ছে জানব না? আমি তো একটা মানুষ। কোলবালিশ তো না। কোলবালিশ হলে চুপ করে থাকতাম। আল্লাহতালা আমাকে কোলবালিশ বানান নি। বানালেও কিছু করার ছিল না…
রিমি দরজার সামনে থেকে সরে এল। এইসব কথা শোনার কোনো অর্থ হয় না। এক-এক দিন এত বিরক্ত লাগে যে কাঁদতে ইচ্ছে করে।
বৌমা কি চলে গেলে না-কি? ও বৌমা….
জোবেদা খানম কোনো জবাব পেলেন না।
একটা সময় ছিল যখন কথার জবাব পাওয়া না গেলে মাথায় রক্ত উঠে যেত। এখন আর ওঠে না। জবাব না পাওয়াটাকেই স্বাভাবিক মনে হয়। একটা বয়সের পর মানুষ আর মানুষ থাকে না। কোলবালিশ হয়ে যায়। তিনি তাই হয়েছেন। এবং আশ্চর্য, এই জন্যে তাঁর খুব খারাপ লাগছে না। এই যে রিমি ফটফট করে বেড়াচ্ছে—সেও একদিন কোলবালিশ হবে। শুরুতে আরও খারাপ লাগবে; তারপর আর লাগবে না।
শুক্রবারে তৌহিদের কাছে কোনো ছাত্র পড়তে আসে না। আজ একজন এসে হাজির—মুনির। তৌহিদ কিছু বলবার আগেই মুনির বলল, গত সপ্তাহে দুদিন কামাই হয়েছে স্যার। তৌহিদের ইচ্ছা করছে ঠাস করে মুনিরের গালে একটা চড় বসিয়ে দিতে। তা না করে সে শান্ত গলায় বলল, আজ থাক।
কয়েকটা এক্সট্রা যদি দেখিয়ে দেন ভালো হয়।
অন্যদিন দেখাব। আজ না। আজ আমার শরীরটা ভালো না।
মুনির ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে রইল। মনে হচ্ছে ধাক্কা দিয়ে বের না করলে সে যাবে না। তৌহিদ ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বস দেখিয়ে দেই।
তৌহিদ পাঁচটা এক্সট্রা দ্রুত করে দিল। মুনির কিছু বুঝতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না। আসল উপপাদ্য যে জানে নাসে এইসব কঠিন এক্সট্টার কী বুঝবে? গাধা মার্কা ছেলে। একটা বুদ্ধিমান ছাত্র পাওয়া গেলে ভালো হত। পড়িয়ে আনন্দ। এইসব গরুগাধার পেছনে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।
মুনির বুঝতে পারছ তো?
পারছি স্যার। পানির মতো ক্লিয়ার।
ক্লিয়ার হলেই ভালো।
স্যার এই অঙ্কটা একটু দেখিয়ে দেন। এইটা কীভাবে করব স্যার? ঐকিক নিয়মে?
তৌহিদ শীতল গলায় বলল, তুমি অঙ্কে পাস করতে পারবে না। শুধু-শুধু পরিশ্রম করছ। সাধারণ অঙ্ক কোন নিয়মে করবে তাই যদি না জান…
মনির চোখ-মুখ শক্ত করে বসে রইল। তৌহিদ বলল, বিদ্যা যদি কোনো তরল পদার্থ হত তাহলে চামচে করে খাইয়ে দিতাম। বিদ্যা তরল পদার্থ না, বুঝলে?
মুনির কিছু বলছে না। তৌহিদ অঙ্কটা করল। সেই সঙ্গে এই নিয়মের আরো দুটো করে দেখাল। বই খুলে আরেকটা অঙ্ক বের করে বলল, এটা করতো, দেখি পার কিনা।
আজ থাক স্যার।
থাকবে কেন? কর।
দশটার সময় আমাকে স্যার আরেকজন চিটারের কাছে যেতে হবে। হরিবাবু, ইংরেজি পড়ান।
হরিবাবুর কাছে খানিকক্ষণ পরে গেলেও কোনো ক্ষতি নেই। অঙ্কটা শেষ করে তারপর যাও।
মনির খাতা খুলে অঙ্ক টুকতে-টুকতে বলল, একটু টাইম লাগবে স্যার।
অসুবিধা নেই। তুমি অঙ্ক করতে থাক, আমি ভেতর থেকে আসি।
রিমি রান্নাঘরে।
তৌহিদ রান্নাঘরে ঢুকল। ছুটির দিনে সে রিমির সঙ্গে রান্নাঘরে কিছুটা সময় কাটায়। চুপচাপ বসে থাকে। রিমি রান্নাঘরের কাজকর্ম সারে। মাঝে-মাঝে বিরক্ত গলায় বলে, কি বিশ্রী স্বভাব। রান্নাঘরে বসে আছ কেন?
তোমার তো কোনো অসুবিধা করছি না।
ধুঁয়ার মধ্যে শুধু-শুধু বসে থাকা। চা খাবে?
খাব।
শোন-চা খাওয়াটাও কমাও। মিনিটে-মিনিটে চা।
আচ্ছা কমাব।
তৌহিদ লক্ষ করেছে রান্নাঘরের সময়টায় রিমি রেগে-রেগে অনেক কথা বললেও মনে-মনে বেশ খুশি হয়। এই খুশি ভাবটা সে চেপে রাখতে পারে না।
আজ রিমি বেশ গম্ভীর। তৌহিদকে ঢুকতে দেখেও অন্যদিনের মতো বলল না, আবার রান্নাঘরে ঢুকলে?
রিমি এক ঝলক তাকিয়েই নিজের মনে কাজ করতে লাগল। তৌহিদ বেতের মোড়ায় বসতে-বসতে বলল, চা হবে?
তোমার ছাত্র গেছে?
না যায় নি। চলে যাবে। ব্যাটা আজ আমার মেজাজটা খারাপ করে দিয়েছে।
কেতলিতে পানি গরমই ছিল। রিমি কাপে ঢালতে-ঢালতে বলল, আজ রাতে একজনের দাওয়াত আছে—সে খাবে। তুমি সন্ধ্যার পর কোথাও বেরুবে না।
তৌহিদ বিস্মিত হয়ে বলল,আমি তো সন্ধ্যার পর সব সময় ঘরেই থাকি।
বলে রাখলাম আর কি।
কে আসবে?
তুমি চিনবে না। ফরহাদ ভাই। আমাদের ময়মনসিংহের বাসার সামনের বাসায় থাকতেন। ঐ দিন হঠাৎ এসে উপস্থিত। আমি প্রথমে চিনতেই পানি নি। উনি নিজ থেকেই বললেন শুক্রবারে তোমাদের এখানে খাব। আমি তো আর বলতে পারি না–না।
তা বলবে কেন? দাওয়াত দিয়ে ভালোই করেছ। বাইরের কেউ এলে সেই উপলক্ষে ভালো-মন্দ খাওয়া হবে। অনেক দিন ভালো কিছু খাওয়া হয় না।
ভালো কিছু করব কোত্থেকে? টাকাপয়সার যা অবস্থা।
আমার কাছে কিছু আছে। মজিদ ধার নিয়েছিল—কাল কী মনে করে দিয়ে দিল। ও তো আবার ধার নিলে ফেরত দিতে ভুলে যায়।
কত টাকা?
পাঁচ শ নিয়েছিল। তিন শ ফেরত দিয়েছে। পুরোটাই আছে। আমি খরচ করি নি।
একজন চাইতেই তুমি পাঁচশ টাকা দিয়ে দিলে? আশ্চর্য!
খাতা দেখার টাকা পেয়েছিলাম। চাইল, না করতে পারলাম না।
আগে নিজে চলবে; তারপর তা অন্যকে ধার দেবে। ধার দাও ভালো কথা, আমাকে বলবে না?
রিমির চোখ-মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। সে নিচু গলায় বলল, প্রতিটা টাকা আমি হিসাব করে খরচ করি। তুমি কিছুই বুঝতে চাও না। বাড়িভাড়া পাঁচশ টাকা বাড়িয়েছেঐ নিয়েও কিছু বললে না। এক কথায় রাজি হয়ে এলে।
রাজি হই নি তো। চুপচাপ ছিলাম। কিছুই বলি নি।
চুপচাপ থাকাই তো রাজি হওয়া। স্কুল মাস্টারি করে-করে তোমার স্বভাব হয়েছে মিনমিনে। এই যুগে শক্ত না হলে চলে?
তা ঠিক।
স্কুল মাস্টাররাও তো আজকাল ভালো আছে। সাতটা-আটটা টিউশানি করে। দুতিন ব্যাচ করে পড়ায়। ওদের বাসায় ফ্রিজ-টেলিভিশন সবই আছে। শুধু তোমারই কিছু নেই। একটা ভালো নাটক হলে বাড়িওয়ালার বাসায় যেতে হয়।
একটা টেলিভিশন এই বছর কিনে ফেলব।
চট করে বলে ফেললে কিনে ফেলব। কোত্থেকে কিবে? আকাশ থেকে টাকার বৃষ্টি হবে?
আজ তোমার মন মনে হয় বেশি খারাপ। ডাক্তার আমাকে কী বলেছে জান? ডাক্তার বলেছে যেদিন তোমার সঙ্গে আমার ঝগড়া হয় সেদিনই শ্বাসকষ্টটা হয়। এটা আমার এক ধরনের মানসিক ব্যাধি।
অন্য কোনো ডাক্তারকে দেখাও। ঐ গাধা ডাক্তারকে দেখিয়ে লাভ নেই। গত মাসে তোমার যে শ্বাসকষ্ট হল ঐদিন কি তোমার সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়েছিল। চিড়িয়াখানায় গেলাম। ফিরে আসার পরপর….মনে নেই?
আছে, মনে আছে।
তৌহিদ চা শেষ করে উঠে পড়ল। মনিরের খোঁজ নিতে হয়। গাধাটা এখনো বসে কলম কামড়াচ্ছে না চলে গেছে কে জানে।
মনির যায় নি। সে হাসিমুখেই বসে আছে। তৌহিদ ঘরে ঢোকামাত্র বলল, অঙ্কটা মিলেছে স্যার। রেজাল্ট মিলিয়ে দেখছি। এইটা ছাড়াও আরো দুটা করে ফেলেছি।
তৌহিদ দেখল—অঙ্কগুলো হয়েছে।
হয় নাই স্যার?
হয়েছে। গুড।
আপনার কী মনে হয় স্যার? অঙ্কে পাস করব?
করবে। রাগের মাথায় এইসব বলি। রাগের কথা কখনো ধরতে নেই।
আমি স্যার ধরি না। বকা দিলে মনটা খারাপ হয়। সব জায়গায় বকা খাই। বাসায় বকা, বাইরে বকা। আমার স্যার কপালটা খারাপ।
তৌহিদের মন খারাপ হয়ে গেল। এই ছেলেটাকে বকাঝকা করা উচিত হয় নি। আসলে টিচার হবার যোগ্যতাটা তার নেই। একজন টিচার কখনো ছাত্রদের ওপর রাগবেন না। বিন্দুমাত্র বিরক্ত না হয়ে একটা বিষয় দশবার বুঝবেন। তারপরও যদি ছাত্র বুঝতে না পারে সে ব্যর্থতা শিক্ষকের, ছাত্রের না।
স্যার আজ তাহলে যাই?
চল। আমিও তোমার সঙ্গে বেরুব। সিগারেট কিনব।
আগামী সপ্তায় আমি কি স্যার আসব না?
আসবে না কেন?
ম্যাডাম বলছিলেন, আপনারা কক্সবাজার যাচ্ছেন।
তাই নাকি? আমাকে তো কিছু বলে নি!
তৌহিদ খুবই বিস্মিত হল। রিমির স্বভাবের সঙ্গে সে পরিচিত। সে জানে রিমি ভেতরে কাজকর্ম অনেকদূর এগিয়ে একদিন হুট করে….এবারও তাই করছে। টাকাপয়সা কোত্থেকে জোগাড় করছে কে জানে। গয়না-টয়না বিক্রি করে দেয় নি তো? তার গয়না বিক্রির অভ্যাসও আছে। প্রয়োজনেই করে। গয়না বিক্রির পর কয়েকটা দিন খুব বিষণ্ণ থাকে। বেচারী। দরিদ্র শিক্ষকের ঘরে এসে খুব কষ্ট করল। সেই তুলনায় তার অন্য দুবোন রাজরানীর মতো আছে। তারাও ঢাকা শহরেই থাকে। নিজেদের বাড়িতে। দুজনেরই গাড়ি আছে। এই তিন বোনের মধ্যে রিমিই সবচে সুন্দরী। এখনো রিমির দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকাতে হয়। অথচ এই রিমিরই সবচে খারাপ বিয়ে হল। কোনো মানে হয় না।
তৌহিদ ফুটপাতে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। মাঝে-মাঝে তাকাচ্ছে আকাশের দিকে। মার্চ মাসের ঝকঝকে নীল আকাশ। এই নীল আকাশের ছায়া পড়বে সমুদ্রে। সমুদ্র এখন ঘন নীল। শ্রাবণ মাসে আকাশ যখন ঘন কালো রঙ নিয়ে নেবে তখন সমুদ্রও হবে কালো। আকাশ এবং সমুদ্র সব সময় একে অন্যের হাত ধরে চলে। তৌহিদের মনে হল, এদের দুজনের খুব মিল আছে। পৃথিবীর মানুষ জমি ভাগাভাগি করে নিয়ে নিয়েছে কিন্তু সমুদ্র এবং আকাশ এই দুটি নিতে পারে নি। কোনোদিন পারবে না।
বিকেল পাঁচটার মধ্যে রিমির রান্নাবান্না শেষ হয়ে গেল। অনেক কিছু করার ইচ্ছে ছিল করতে পারে নি। জিনিসপত্রের যা দাম। অল্প কয়েকটা পদ করতে গিয়েই সাড়ে তিন শ টাকার মতো খরচ হয়ে গেল। ঘরে আলো প্লেট ছিল না। দুটো প্লেট কিনতে লাগল চার শ। প্লেটের খরচও তো আজকের দাওয়াতের মধ্যে ধরতে হবে। রান্না কেমন হয়েছে কে জানে। ভালোই হবে। তার রান্না খারাপ না। পোলাওটা নিয়ে শুধু দুশ্চিন্তা। তার পোলাও কখনো ঠিক হয় না। হয় চাল থাকে, নয়ত নরম হয়ে যায়। পোলাও এখনো চড়ানো হয় নি। মেহমান এলে চড়ানো হবে।
রিমি গা ধুয়ে সবুজ রঙের একটা সুতির শাড়ি পরল। এটা তার পছন্দের শাড়ি। কোনো এক বিচিত্র কারণে এই রঙটাই তাকে মানায়। শুধু মানায় না-খুব বেশি রকম মানায়। এই শাড়ি নিয়ে কত কাণ্ড। বছর তিনেক আগে মেজো দুলাভাই তাকে সবুজ সিকের একটা শাড়ি দিলেন। সেই শাড়ি পরে তার পরদিনই সে মেজো দুলাভাইয়ের বাড়ি বেড়াতে গেল। নতুন শাড়ি পড়ে মেজো দুলাভাইকে আর আপাকে সালাম করবে।
দেখা গেল শাড়ি উপহার দেবার কথা রিমির মেজো বোন রূপা কিছুই জানে না। তার মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। রিমির দুলাভাই নাসিম সাহেব আমতা-আমতা করে বললেন, রিমি তার জন্মদিন উপলক্ষে আমার কাছে একটা শাড়ি চেয়েছিল—তাই দিলাম আর কি।
রিমি অবাক হয়ে বলল, আমি আবার আপনার কাছে কখন শাড়ি চাইলাম।
নাসিম সাহেব শুকনো গলায় বললেন, গত বছর চেয়েছিলে। তোমার মনে নেই।
রূপা খড়খড়ে গলায় বলল, ওর মনে নেই আর তুমি মনে করে বসে আছ? তোমার স্মৃতিশক্তি যে এত ভালো তা তো জানতাম না!
খুবই বিশ্রী অবস্থা। রূপা রিমিকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল, ও কি তোমাদের বাসায় প্রায়ই যায়?
রিমি বলল, না তো।
তোর মুখ দেখেই মনে হল তুই মিথ্যা কথা বলছিস। ও যায় প্রায়ই।
ছিঃ আপা!
আমাকে ছিঃ আপা করতে হবে না। আমি কচি খুকী না। আট বছর বিয়ে হয়েছে—আমাকে একদিন একটা শাড়ি কিনে দেয় নি, আর তোকে ঘরে গিয়ে শাড়ি দিয়ে এল?
রিমি ঐ শাড়ি আর পরে নি। ফেলে দিতে ইচ্ছে করছিল, ফেলতেও পারে নি। ন্যাপথলিন দিয়ে ট্রাংকের একেবারে নিচের দিকে রেখে দিয়েছে। কে জানে, হয়ত এর মধ্যে তেলাপোকায় কেটে দিয়েছে। কাটুক। কেটে ফেললে এই শাড়ি কাউকে দেয়া সহজ হবে।
সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখল। ভালোই তো দেখাচ্ছে। গলায় যদি শুধু সবুজ পাথর বসানো হার থাকত। চোখে একটু কাজল কি দেবে? ক্ষতি কি? রিমি। আড়চোখে পাশের খাটে শুয়ে-থাকা তৌহিদের দিকে তাকাল। তৌহিদ ঘুমুচ্ছে। ছুটির দিনে দুপুরবেলায় সে ঘুমুয়। ঘুম ভাঙে সন্ধ্যার আগে-আগে। আজো তাই করবে। করুক। রিমি চোখে কাজল দিল। আয়নায় নিজেকে দেখে এখন কেন জানি লজ্জালজ্জা করছে। লজ্জার কিছুই নেই। বাইরের একজন মানুষ আসবে—সেই উপলক্ষে একটু সাজগোজ করলে ক্ষতি কি? তার দামি পারফিউম নেই, পাউডার নেই। সামান্য একটু কাজল।
রিমি বারান্দায় এসে দাঁড়াল। জিতু মিয়াকে ভেজা ন্যাড়া দিয়ে বারান্দা মুছতে বলে গিয়েছিল। সে তা না করে অনির সঙ্গে খেলছে। অনি কাগজে ছবি আঁকছে, জিতু মুগ্ধ চোখে তাই দেখছে।
অনি মাকে দেখেই মুগ্ধ গলায় বলল, মা তোমাকে অন্য বাড়ির বৌয়ের মতো লাগছে। জিতুও তাকিয়ে আছে। তার চোখেও মুগ্ধ বিস্ময়।
জোবেদা খানম তাঁর ঘর থেকে ডাকলেন, ও বৌমা, বৌমা। একটু শুনে যাও তো।
নিতান্ত অনিচ্ছায় রিমি শাশুড়ির ঘরে ঢুকল।
আজ সারাদিনে তোমার দেখা পেলাম না। ব্যাপার কি মা?
ব্যাপার কিছুই না।
ভালোভালো জিনিস রান্না হচ্ছে। ঘ্রাণ পাচ্ছি। কেউ আসবে?
হ্যাঁ।
সেটা আমাকে বলতে অসুবিধা কি? তোমার বাপের বাড়ির দিকের কেউ? বাপের বাড়ির দিকের কারোর আসার কথা থাকলে রান্নাবান্নার ধুম পড়ে যায়। শ্বশুরবাড়ির দিকের কেউ আসলে ঠন-ঠনা-ঠন—বেগুন ভর্তা, ডাল চচ্চড়ি।
এইটা বলার জন্যেই ডেকেছেন, না আরো কিছু বলবেন?
ছাদে কাপড় থাকলে নামিয়ে আন মাঝড়বৃষ্টি হবে। ঐ দেখ পিঁপড়া মুখে ডিম নিয়ে যাচ্ছে। যখন দেখবে পিঁপড়া মুখে ডিম নিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাচ্ছে, তখন বুঝবে ঝড়বৃষ্টি হবে।
আপনি তো চোখেই দেখেন না। পিঁপড়ার মুখের ডিমও দেখে ফেললেন।
চোখে দেখি না তোমাকে কে বলল মা? রোজ যে কোরান শরীফ পড়ি শুনতে পাও না? গান-বাজনা তো সবই কানে ঢোকে। আল্লাহর পাক কালাম ঢোকে না? তুমি বাড়ির বৌ-নামাজ পড়বে। রোজা রাখবে। দুপাতা কোরান পড়বে। তা না–দিনরাত সাজসজ্জা।
সাজসজ্জার আপনি কি দেখলেন?
সবই তো দেখছি না। অন্ধ তো না। চোখ খোলা, কানও ভোলা। চারপাশে যা ঘটে সবই দেখি। সবই শুনি।
ভালো। আল্লাহ আপনার চোখ আরো ভালো করুক। কানও ভালো করুক।
রিমি ঘর ছেড়ে আবার বারান্দায় এল। জিতু মিয়া বারান্দা মোছা শুরু করেছে। ওকে দিয়ে বাড়িওয়ালার বাগান থেকে কয়েকটা গোলাপ এনে ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখলে কেমন হয়? চাইলে দেবে কিনা কে জানে। কেউ ফুলে হাত দিলে খ্যাক করে ওঠে।
জিতু মিয়া।
জ্বি আম্মা?
বারান্দার কাজ শেষ হলে তুই বাড়িওয়ালার বাসায় যাবি, উনার বড় মেয়েকে আমার কথা বলে বলবি কয়েকটা গোলাপ ফুল দিতে। আচ্ছা থাক, তোর যেতে হবে না। আমিই যাব। শুধু ফুল আনলে হবে না। একটা টেবিল ক্লথ আনতে হবে। পানির ভালো জগ নেই। ওদের বাসায় একটা ক্রিস্টালের জগ আছে। রিমির নিজেরই যাওয়া দরকার।
জোবেদা খানম পিঁপড়াকে মুখে ডিম নিয়ে যেতে দেখেছেন কি-না কে জানে; তবে সন্ধ্যা মেলাবার আগেই আকাশ অন্ধকার করে ঝড়বৃষ্টি শুরু হল। ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। হাওয়ার শোঁ-শোঁ গর্জন। দেখতে দেখতে গলির মোড়ে এক হাঁটু পানি জমে গেল। বাসার সামনের আমগাছের একটা ডাল ভাল বিকট শব্দে। অনি ভয় পেয়ে কাঁদতে লাগল।
নিমন্ত্ৰিত অতিথির আসবার প্রশ্নই ওঠে না। তবু রিমির মনে হল ফরহাদ ভাই আসবেন। যত রাতই হোক আসবেন। না এসে পারবেন না। তাঁকে আসতেই হবে।
তৌহিদ ক্ষিধে সহ্য করতে পারে না। সে দশটার সময় খেতে বসল। রিমি লাজুক গলায় বলল, আমি একটু অপেক্ষা করি। বৃষ্টি তত কমে এসেছে। এখন যদি আসেন।
তাহলে আমিও অপেক্ষা করি।
না, তুমি খেয়ে নাও।
বৃষ্টি ধরে এসেছিল এগারটার দিকে, আবার মুষলধারে শুরু হল। বারান্দায় বেতের একটা চেয়ারে সবুজ শাড়ি পরা রিমি একা-একা বসে রইল। তৌহিদ একবার এসে বলল, তুমি খাবে না?
রিমি জবাব দিল না। তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। সে খুব চেষ্টা করছে চোখের পানি সামলাতে পারছে না। নিজেকে খুব অপমানিত মনে হচ্ছে। যদিও অপমানিত মনে কার কোনো কারণ নেই। ফরহাদ ভাই ঝড়বৃষ্টির কারণে আসতে পারেন নি এটা তো বোঝাই যাচ্ছে।
তৌহিদ মৃদু গলায় ডাকল, এই রিমি।
কি?
তোমার কাছে উনার ঠিকানা আছে? ঠিকানা থাকলে দাও খোঁজ নিয়ে আসি।
খোঁজ নিতে হবে না। রাতদুপুরে তাকে কোলে করে আনতে হবে না-কি? আসার হলে এম্নি আসবে।
এস তাহলে ভাত খেয়ে নাও।
খাব না। আমার ক্ষিধে মরে গেছে।
একটু কিছু মুখে দাও, এত কষ্ট করে রান্নাবান্না করলে।
রিমি উঠে দাঁড়াল। তার ক্ষিধে মরে গেছে কথাটা সত্যি না, বেশ ক্ষিধে পেয়েছে। সে রান্নাঘরে চলে গেল। ঠান্ডা খাবার রিমি মুখে দিতে পারে না, রাতদুপুরে খাবার গরম করতে বসতে হবে।
জোবেদা খানম ডাকলেন, ও খোকা এদিকে একটু আয়।
তৌহিদ সবেমাত্র সিগারেট ধরিয়েছে। রানো সিগারেট ফেলে দিয়ে মার ঘরে ঢুকল।
এসব কী হচ্ছে খোকা? হচ্ছে কী এসব?
কিসের কথা বলছেন?
বৌমা যে আজ আমাকে খেতে দিল না। চৌদ্দ পদের রান্না হয়েছে ঘরে আর আমি না খেয়ে বসে আছি।
তৌহিদ বিব্রত স্বরে বলল, ভুলে গেছে বোধ হয়…..
ঘরে পোষা পাখি থাকলে লোকে তাকে দানাপানি দেয়, একটা বিড়াল থাকলে মাছের কাঁটাটা খাওয়ায়…।
আমি ভাত নিয়ে আসছি।
তোকে কিছু আনতে হবে না। তুই কাল ভোরে আমাকে ছোটনের বাসায় রেখে আসবি।
তৌহিদ মার ঘর থেকে এল রান্নাঘরে। রিমি একটা প্লেটে খাবার নিয়ে দাঁড়িয়েদাঁড়িয়ে খাচ্ছে। তৌহিদকে দেখেই বলল, চুলা ধরানো আছে, তুমি কি চা খাবে?
দাও এক কাপ। আর ইয়ে শোন, মাকে রাতে খাবার দাও নি?
তাই বুঝি বললেন?
হুঁ।
আমি মাকে আর অনিকে রাত আটটায় একসঙ্গে খাইয়ে দিয়েছি। আজকাল উনার কিছু মনে থাকে না।
একটা প্লেটে করে নাহয় অল্প কিছু ….
আশি বছর বয়সের একজন মানুষ রাতে দুবার যদি খায় অবস্থাটা কী হবে জান? যখন ঘর নোংরা করা শুরু করবেন তখন সেসব কে পরিষ্কার করবে, তুমি?
তৌহিদ আরেকটা সিগারেট ধরাল। আজ সারা দিনে এটা হচ্ছে চার নম্বর সিগারেট। দিনে দুটার বেশি খাবে না এই প্ৰতিজ্ঞা টিকছে না। রিমি কিছু বলছে না। অন্য সময় সিগারেট ধরালেই সে কড়াচোখে তাকায়। আজ তাকাচ্ছে না। আজ তার মনটা ভালো নেই। তৌহিদ সিগারেট হাতে শোবার ঘরে চলে এল। রান্নাঘরের সমস্ত কাজকর্ম শেষ করে রিমি ঘুমুতে এল রাত বারটার দিকে। তখনো বৃষ্টি পড়ছে। ঝুম বর্ষণ। রিমি হালকা গলায় বলল, এখন জেগে আছ?
হুঁ।
আচ্ছা শোন, আমি ঠিক করেছি কক্সবাজার যাব। তুমি আমার দিকে তাকিও না, কাপড় বদলাব।
তৌহিদ মুখ ঘুরিয়ে নিল। রিমি বলল, একটা রাফ হিসেব করে দেখেছি হাজার পাঁচেক টাকা হলে আমরা তিনজন সপ্তাহখানিক থেকে আসতে পারি।
এত টাকা আছে তোমার কাছে?
রিমি তার জবাব না দিয়ে বলল, তুমি স্কুল থেকে দিন দশেকের ছুটি নাও।
সত্যি-সত্যি যাচ্ছি না-কি?
হুঁ।
পাঁচ হাজার টাকা তো অনেক টাকা।
রিমি চুপ করে রইল। তৌহিদ ক্ষীণ স্বরে বলল, গয়না-টয়না বিক্রি কর নি তো?
গয়না আছেইবা কী; বিক্রি করবইবা কী?
তৌহিদ লক্ষ করল রিমি একবারও গয়না বিক্রির কথা অস্বীকার করল না। তার মানে এই রকম কিছুই সে করেছে। বাবার বাড়ি থেকে অল্প যা কিছু গয়না-টয়না পেয়েছিল একে-একে এইভাবেই যাচ্ছে। গয়না বিক্রি করে সমুদ্র দেখার কোনো মানে হয়?
বাতি নিভিয়ে রিমি ঘুমুতে এল। মশারির ভেতরে কিছু মশা রয়ে গেছে। কানের কাছে ভনভন করছে। রিমির খুব ক্লান্তি লাগছে। আবার উঠে বাতি জ্বালিয়ে মশা মারতে ইচ্ছে করছে না। ভনভন করতে থাকুক।
তৌহিদ বলল, ঘুমিয়ে পড়লে না-কি?
রিমি বলল, না। তোমার আর কিছু লাগবে? এই ইঙ্গিতটা অন্য ধরনের। এর মধ্যে ভালবাসা নেই। তৌহিদ বলল, না কিছু লাগবে না।
রিমি সহজ স্বরে বলল, এত রাত পর্যন্ত জেগে আছ তাই জিজ্ঞেস করলাম। আমাকে যখন প্রয়োজন হয় তখনি তুমি জেগে থাক। এই জন্যেই এই কথা বললাম। তুমি আবার রাগ-টাগ করে বস না।
তৌহিদ কিছু বলল না।
রিমি আগের মতো স্বরে বলল, ঘরের কাজকর্ম সেরে যখন ঘুমুতে আসি তখন দেখি তুমি আরাম করে ঘুমুচ্ছ। যেদিন দেখি জেগে আছ তখন বুঝি…..
রিমি কথা শেষ করল না। তৌহিদ বলল, রিমি ঘুমুও।
ঘুম এলে ঘুমুব। ঘুমের জন্যে আমাকে সাধাসাধি করতে হবে না।
আজ বোধহয় তোমার মনটা খারাপ।
মন থাকলে তো মন খারাপ হবে। আমার মনই নেই।
ঝগড়া করার চেষ্টা করছ বলে মনে হচ্ছে।
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে বিশ্বাস থাকতে হয়। যখন বিশ্বাস থাকে না তখন আর সেই সম্পর্কও থাকে না।
তৌহিদ বিস্মিত হয়ে বলল, বিশ্বাসের কী অভাব তুমি দেখলে?
তোমার মা বলল, তাকে খাবার দেয়া হয় নি; ওমি তুমি তা বিশ্বাস করে ফেললে।
আমি তা করি নি রিমি।
না করলে কেন আমাকে জিজ্ঞেস করতে এলে?
ভেবেছিলাম রান্নাবান্না, দাওয়াত এইসব নিয়ে তুমি ব্যস্ত ছিলে; ভুলে গেছ।
রিমি কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। তৌহিদ বলল, ঐ ভদ্রলোক কে?
কোন ভদ্রলোক?
যাকে তুমি খেতে বলেছ?
আমি কাউকে খেতে বলি নি। উনি নিজ থেকে আসতে চেয়েছেন। কেউ আসতে চাইলে আমি তাকে বলব আসবেন না?
তুমি শুধু-শুধু রাগ করছ। এসো ঘুমুতে চেষ্টা করি।
উনার সম্পর্কে আর কিছু জানতে চাও না?
না।
তুমি যা ভাবছ তা না।
আমি কী ভাবছি?
তুমি ভাবছ ঐ ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার গভীর প্রেম ছিল। আমি আমার প্রেমিককে নিমন্ত্রণ করেছি। সে আসে নি কাজেই রাগে-দুঃখে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
এরকম কিছুই আমি ভাবছি না।
অবশ্যই ভাবছ। মুখে বলছ না–মনে-মনে ভাবছ। একটা বাংলা বই আমি যেভাবে পড়তে পারি তোমাকেও সেইভাবে পড়তে পারি। তুমি কখন কী ভাব, কী ভাব না, সবই আমি জানি।
তুমি তাহলে অন্তর্যামী।
হ্যাঁ, আমি অন্তৰ্যামী। আমি তোমাকে যেভাবে জানি, তুমি আমাকে সেভাবে জান। না। কারণ তুমি জানতে চাও না। আমার প্রতি তোমার কোনো আগ্রহ নেই। কয়েকদিন পরপর আমার শরীরটা কাছে পেলেই তোমার চলে যায়।
তৌহিদ প্ৰসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে বলল, মশারির ভেতর কয়েকটা মশা আছে বলে মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ আছে। তবে এই মশা নিয়েও তোমার মাথাব্যথা নেই। তুমি উঠে বাতি জ্বেলে মশা মারবার চেষ্টা করবে না। মশার ব্যাপারে এই মুহূর্তে তুমি কী ভাবছ আমি বলব?
বল।
তুমি ভাবছ মশাগুলো এখন কানের কাছে ভনভন করে বিরক্ত করছে। সাময়িক একটা অসুবিধা সৃষ্টি করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এরা ভরপেট রক্ত খেয়ে ফেলবে তখন আর বিরক্ত করবে না। তখন আরামে ঘুমান যাবে।
তৌহিদ বিস্মিত হয়ে বলল, ঠিকই বলেছ।
আমি তো আগেই বলেছি, আমি তোমাকে, বইয়ের মতো পড়তে পারি।
তাই তো দেখছি।
রিমি পাশ ফিরতে ফিরতে বলল, ঐ ভদ্রলোক সম্পর্কে তোমার দুশ্চিন্তার কিছু নেই। এক সময় উনি আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। এর বেশি কিছু না।
বিয়ে হল না কারণ আমি তখন ক্লাস টেনে উঠেছি। খুব কম বাবা-মাই এত অল্প বয়েসী মেয়ে বিয়ে দিতে চান। তাছাড়া ঐ ভদ্রলোকদের চালচুলা কিছুই ছিল না। আমাদের বাসায় জায়গির থেকে পড়ত।
তুমি কিন্তু বলেছিলে তোমাদের সামনের বাসায় থাকত।
বিয়ের প্রস্তাব দেবার পর বাবা তাকে ঘর থেকে বের করে দেন। তখন তিনি আমাদের বাসার সামনে একটা মেস ভাড়া করে থাকতেন। কাজেই তোমার কাছে। আমি মিথ্যা কথা বলি নি।
তৌহিদ খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল, তোমার দিক থেকে কোনো আগ্রহ ছিল না?
না।
তৌহিদ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে মৃদুস্বরে বলল,আমি অবশ্যি শুনেছিলাম তুমি উনার সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলে। গৌরীপুর স্টেশন থেকে তোমাকে ধরে আনা হয়।
রিমি শান্ত গলায় বলল, তোমাকে কে বলেছে?
তোমার মেজো দুলাভাই।
কখন বললেন?
অনেক আগে। আমাদের বিয়ের পরপরই বললেন।
তুমি আমাকে এতদিন এটা বল নি কেন?
বললে কী হত?
রিমি রাগের চেয়েও শান্ত গলায় বলল, তখন আমার বয়স ছিল খুব কম। আমি ঠিক…
বাদ দাও। ঘুমাও।
রিমি ক্ষীণ স্বরে বলল, আমি কখনো তোমার সঙ্গে মিথ্যে বলি না—এই একটা বলেছি। আই অ্যাম সরি।
তৌহিদ বলল, আমার দিকে ফিরে ঘুমাও। একটা হাত আমার গায়ে রাখ। রিমি ফিরল না। তার শরীর মাঝে-মাঝে কেঁপে-কেঁপে উঠছে। মনে হয় সে কাঁদছে। বাইরে বৃষ্টির সঙ্গে বাতাস দিচ্ছে। বাতাসে জানালায় খটখট শব্দ উঠছে। যে মশাগুলি কানের কাছে ভনভন করছিল তারা এখন আর কিছু করছে না। সম্ভবত তাদের নৈশাহার সম্পন্ন হয়েছে।