Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সমুদ্র বিলাস (১৯৯০) || Humayun Ahmed » Page 2

সমুদ্র বিলাস (১৯৯০) || Humayun Ahmed

সমস্যাটা কী বলুন তো

আপনার সমস্যাটা কী বলুন তো?

ডাক্তার পূর্ণ চোখে তাকিয়ে আছেন। ইনি খুব ব্যস্ত ডাক্তার। রুগীর দিকে শুধু-শুধু তাকিয়ে নষ্ট করার সময় তাঁর নেই। প্রশ্ন করা মাত্রই জবাব চান। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, তৌহিদ কখনোই খুব গুছিয়ে কিছু বলতে পারে না। রিমিকে সঙ্গে নিয়ে এলে হত। রিমি আসত কিন্তু আজ সকালেই অনির খুব জ্বর এসেছে। রিমি অনিকে নিয়েই ব্যস্ত।

বলুন আপনার কী অসুবিধা?

তৌহিদ ইতস্তত করে বলল, তেমন কোনো অসুবিধা নেই।

ডাক্তারের চোখে বিরক্তি আরো গাঢ় হল, তিনি হাতের কলম নামিয়ে চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন। যেন এক্ষুনি জেরা শুরু করবেন। কোর্টে বসে-বসে জেরা করার নিয়ম থাকলে এইভাবেই জেরা করা হত।

অসুবিধা নেই তবে এসেছেন কেন? আমার ভিজিট দুশ টাকা। শুধু-শুধু দুশ টাকা দিতে আসেন নি।

তৌহিদ বলল, মাঝে-মাঝে আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।

এটাতো ভয়ানক অসুবিধা। অসুবিধা নেই বলছেন কেন? কত দিন পরপর এরকম হয়?

অনেক দিন পরপর হয়।

অনেক দিন মানে কত দিন? পাঁচ দিন, দশ দিন?

দু-তিন মাস পরপর একবার।

আপনি নিশ্চয়ই আমার আগেও অন্য ডাক্তারের কাছে গিয়েছেন। কারণ, ঢাকা শহরের রুগীরা ডাক্তার বদলাতে খুব পছন্দ করে। যেই একজন বলল, অমুক খুব ভালো ডাক্তার, অন্নি দলবেঁধে সবাই ছুটল তার কাছে। আপনিও নিশ্চয়ই তাই করেছেন?

জ্বি।

ওদের প্রেসক্রিপশন আছে? ইসিজি, x-ray এইগুলো করিয়েছেন?

জ্বি।

দেখি?

ডাক্তার হাত বাড়িয়ে কাগজপত্র নিলেন। গভীর মনোযোগ কাগজপত্র দেখতে লাগলেন। তৌহিদের এই দৃশ্য ভাল লাগল। সাধারণত এক ডাক্তার অন্য ডাক্তারের কাগজপত্র এত মনোযোগ দিয়ে দেখেন না। বেশিরভাগ দেখতেই চান না।

আপনি কী করেন?

শিক্ষকতা করি।

স্কুল মাস্টার?

জ্বি।

কী পড়ান?

অঙ্ক। জিওগ্রাফি।

প্রাইভেট টিউশনি করেন?

করি।

তাহলে তো হাজার-হাজার টাকা কামান।

তা না। অল্প কয়েকজন ছাত্র। সংসার চালাতে হয়।

মদ্যপান নিশ্চয়ই করেন না?

জ্বি না।

ধূমপান করেন?

খুব কম।

স্পেসিফিক্যালি কথা বলুন। অঙ্কের টিচার হয়েও স্পেসিফিক্যালি কথা বলতে পারছেন না—এটা কেমন কথা। খুব কম মানে কত?

তিন-চারটা। কোনো কোনো দিন খাইও না।

ডাক্তার সাহেব খুব গম্ভীর গলায় বললেন, আপনার কোনো অসুখ নেই।

তৌহিদ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ডাক্তার সাহেব ভারি গলায় বললেন, অসুখ যদি কিছু থেকেও থাকে তবে তা আপনার মনে। আপনার শরীর পুরোপুরি সুস্থ।

শরীর সুস্থ?

জ্বি। আমার ধারণা কোনো বিশেষ কারণে আপনার মন খারাপ থাকলে তবে এই শ্বাসকষ্টটা হয়। আপনি বরং সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে কথা বলুন।

তৌহিদ বলল, আমি কি চলে যাব?

চলে যাওয়াটাই তো উচিত। নাকি আরো কিছু বলতে চান?

জ্বি না।

প্রেসক্রিপশানে লেখা আপনার শ্বাসকষ্টটা রাতে হয়, যে রাতে কষ্টটা হয় সেই রাতে কি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আপনার ঝগড়া হয়? কিংবা সেই দিন অফিসে বসের সঙ্গে ঝগড়া? মনে করে দেখুন তো?

তৌহিদ বলল, আমার স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া হয়।

আরে ভাই স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া তো আমার রোজই হয়, তাই বলে আমার শ্বাসকষ্ট হয় না। শোবার সময় দশ মিলিগ্ৰাম ফ্রিজিয়াম খাই, মরার মতো ঘুমাই। আপনাদের ঝগড়া কি খুব বেশি হয়?

জ্বি না।

তাহলে এই অবস্থা কেন? আপনি এক কাজ করুন। স্ত্রীকে নিয়ে বাইরে কোথাও যান। ঘুরে-টুরে আসুন। তাতে মনের ওপর থেকে চাপ কমবে। কক্সবাজার চলে যান না। শুধু স্বামী-স্ত্রী। আণ্ডাবাচ্চা নিবেন না। হাত ধরাধরি করে সমুদ্রের পারে হাঁটবেন, দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে।

আচ্ছা দেখি।

দেখি-দেখি করে বাঙালি জাতি শেষ হয়ে গেল। কোনো ডিসিশান নিতে পারে না-বলে দেখি। এত দেখাদেখির কী আছে?

রিমি খুবই গোছানো মেয়ে।

আজ অনেকগুলো ঝামেলা ছিল। সবই সে সুন্দর করে সামলাল। মেয়ের জুর অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল। গা ঠাণ্ডা পানি দিয়ে মুছে দিল। তাপ অনেকটা নাম। বাকিটা নামল এ্যানালজেসিক সিরাপ খাইয়ে। রিমির ঘরে গৃহ চিকিৎসা বলে একটা চটি বই আছে। এই বই রিমির প্রায় মুখস্থ। ছোটখাট চিকিৎসা এখান থেকেই করে। জুর নেমে যাবার পরপরই অনি ঘুমিয়ে পড়ল। এই ফাঁকে রিমি রান্না সেরে ফেলল। ঘরে নদশ বছর বয়সী একটি কাজের ছেলে আছে। সে ঘুমানো ছাড়া কোনো কাজই ভালোমলত পারে না। তবু তাকে রিমি রেখেছে কারণ অসংখ্যবার দোকানে এটা-ওটা আনতে যেতে হয়। এই লবণ ফুরিয়ে গেল, এই তেল ফুরিয়ে গেল। ছেলেটির নাম জিতু।

ও জিতু মিয়া।

জ্বি আম্মা।

বাইরে দাঁড়িয়ে থাক। তোর স্যারের ছাত্ররা এলে বলবি আজ পড়াবে না। স্যার ডাক্তার দেখাতে গেছে।

জ্বি আচ্ছা আম্মা।

ওদের কাল আসতে বলবি।

জ্বি আচ্ছা।

আরেকটা কথা জিতু মিয়া, তোকে কতবার বলেছি আমাকে আম্মা ডাকবি না—আপা ডাকবি।

জিতু মিয়া দাঁত বের করে হাসল।

রান্না শেষ করে রিমি শোবার ঘরের পর্দাগুলোও ধুয়ে দিল। চারদিক ঝকঝকে পরিষ্কার থাকার আলাদা আনন্দ। এটা কেউ বুঝতে চায় না।

জোবেদা খানম বারান্দার ইজিচেয়ারে কাত হয়ে বসে আছেন। আজ তাঁর শরীরটাও ভালো না। মাথা কেমন ঝিমঝিম করছে। রিমিকে কয়েকবার বলেছেন, রিমি তেমন গা করে নি। শান্ত মুখে বলেছে, প্রেসার বোধ হয় বেড়েছে, চুপচাপ শুয়ে থাকুন।

একজন ডাক্তার খবর দাও মা। এই বয়সে হুট করে প্রেসার বাড়া কোনো কাজের কথা না। প্রেসার থেকে স্ট্রোক হয়।

কথায় কথায় ডাক্তার ডাকার অবস্থাতো মা সংসারের না। অনির যে এক শ তিন জ্বর উঠল—আমি কি ডাক্তার ডেকেছি?

ওর বয়স আর আমার বয়স কি এক হল মা? ও যা সহ্য করতে পারবে আমি তা পারব?

ঠিক আছে ও আসুক। ও এসে ডাক্তার ডেকে আনবে।

জোবেদা খানম চিবিয়ে-চিবিয়ে বললেন, কিছু-কিছু কাজ মা ইচ্ছা না থাকলেও করতে হয়, যেমন বুড়ো শাশুড়ির চিকিৎসা। বিনা চিকিৎসায় মারা গেলে তোমরা লোকের কাছে মুখ দেখাতে পারবে না। লোকে তোমাকে দেখিয়ে বলবে, শাশুড়িমারা বেী।

রিমি কঠিন কন্ঠে বলল, বলুক।

এখনই বলে, বুঝ না বৌ, এখনই বলে। তোমার নিজের মেয়েই বলে। তোমারে বলে কাচকচানি। সারাদিন যে কাচৰ্কাচ কর এই জন্যে বলে।

অনি কিছু বলে না। অনিকে আপনি শিখিয়ে দেন। ক্ৰমাগত আজেবাজে সব কথা আমার সম্পর্কে বলেন।

একটা কথাও মিথ্যা বলি না বৌমা। এইটা মিথ্যা বলার বয়স না।

রিমির এর উত্তরে কঠিন-কঠিন কথা তৈরি ছিল। বলা হল না। জিতু এসে বলল, একজন ভদ্রলোক না-কি আসছে। চোখে কালো চশমা। চোখে কালো চশমা থাকলে চেনা লোককেও অচেনা মনে হয়। এই লোকটি বোধহয় আসলেই অচেনা। রিমি চিনতে পারল না।

লোকটির গায়ে একটা গোলাপি রঙের গেঞ্জি। ত্রিশ বত্রিশ বছরের কোনো মানুষ কি গোলাপি গেঞ্জি গায়ে দেয়। পরনের প্যান্টের রঙ ঘন নীল। পায়ের জুতো সাদা। সাদা-নীল-গোলাপি এই তিনটি রঙের আলাদা কি কোন প্রভাব আছে? এত চমৎকার লাগছে তাকিয়ে থাকতে।

লোকটি রিমিকে দেখেও উঠে দাঁড়াল না। যে ভাবে বসা ছিল সেই ভাবেই বসে রইল। একটা পায়ের ওপর অন্য পা-টা রাখা। সেই পা অল্প-অল্প দুলছে। রিমি বলল, কে?

লোকটি বলল, আন্দাজ কর তো কে?

রিমি সঙ্গে-সঙ্গে চিনতে পারল। তার সারা গা বেয়ে শীতল সম্রাত বয়ে গেল। কেন সে প্রথম দেখাতেই চিনল না? নাকি প্রথম দেখাতেই চিনেছিল—শুধু ভান করেছিল যে চিনতে পারে নি? এই লোকটিকে কি এখন ভালো করে চেনা উচিত? বা চিনতে পারলেও কি বেশি সময় তার সামনে থাকা উচিত?

রিমি, চিনতে পেরেছ তো?

রিমি জবাব দিল না। চুপ করে রইল।

তুমি কি দাঁড়িয়ে থাকবে না বসবে? তোমার নিজের ঘরে তো আর তোমাকে আমি বসতে বলতে পারি না। আমি নিজেই তোমার অনুমতি ছাড়া বসে আছি।

রিমি বসল।

আমি যে আজই প্রথম এসেছি তা না, আগেও একদিন এসেছিলাম। তোমাদের কারো সঙ্গে দেখা হয় নি। তুমি, তোমার স্বামীকেউ ছিলে না। তোমার ছোট মেয়েটির সঙ্গে দেখা হয়েছে। ওর নাম বোধহয় অনি, তাই না?

হুঁ।

অনি বলে নি আমার কথা?

বলেছে—সেটা যে তুমি বুঝতে পারি নি।

রিমি বুঝতে পারছে তার কপাল ঘামছে। বুক ধকধক করছে। তার পরিষ্কার মনে পড়ছে সেদিন অনির হাতে ছিল বিশাল এক টিন চকলেট। অনি শুধু বলেছে একটা লোক তাকে দিয়েছে। লোকটা কে, কী, কিছুই বলে নি। অচেনা-অজানা একটা লোকের কাছ থেকে চকলেটের টিন নেবার জন্যে রিমি বরং রাগই করেছে। সেই অচেনা লোকা যে এতা কে জানত।

লোকটা হাসতে হাসতে বলল, প্রায় তের বছর পর দেখা, চিনতে পারবে কি পারবে না ভয়টা সব সময়ই ছিল। একবার ভাবলাম দাড়িগোঁফ কামিয়ে আসি। মুখ ভর্তি দাড়িগোঁফ অবস্থায় তো তুমি আমাকে কখনো দেখ নি—আমি নিজেই একনাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছি। তুমি তো কিছুই বলছ না। তোমার কি অস্বস্তি লাগছে?

না।

অস্বস্তি লাগা উচিত নয়। তের বছর আগে তোমার সঙ্গে কিছু পরিচয় ছিল, ঐ পরিচয়ের সূত্র ধরে এসেছি। আমি এর মধ্যে অন্যায় কিছু দেখছি না। তুমি দেখছ কি-না জানি না।

তুমি বস, আমি এক্ষুনি আসছি।

তোমাকে উঠতে হবে না। আমি চা-কফি, খাবারদাবার কিছু খাব না। তিন মিনিটের মধ্যে উঠব। আমার একটা এ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। তা ছাড়া তুমি খুব বেশি রকম নার্ভাস হয়ে আছ। এত নার্ভাস হবার কোনো কারণ দেখছি না।

আমি নার্ভাস হই নি।

হয়েছ। আগে তুমি আমাকে কখনো তুমি করে বল নি। এখন বলছ। এটা নাভাস হবার লক্ষণ। এত নার্ভাস হচ্ছ কেন?

রিমি কিছু বলল না। মুখ লাল করে বসে রইল। আসলেই তো ফরহাদ ভাইকে সে কখনো তুমি করে বলে নি। সে এত বড় ভুল কী করে করল?

তোমার ঘর-দুয়ারতো খুব গোছানো।

আপনি কি ভেবেছিলেন অগোছানো দেখবেন?

আমি যা ভেবে রেখেছিলাম তা হয় নি। আমি ভেবেছিলাম খুবই বড়লোকের ঘরে তোমার বিয়ে হবে। বিরাট বাড়ি থাকবে, গাড়ি থাকবে, মালী থাকবে।

আমার মতো দরিদ্র অবস্থা দেখে নিশ্চয়ই মনে-মনে খুশি হয়েছেন?

খুশি হব কেন? আমি যে ছোট মনের মানুষ না-তা তো তুমি জান রিমি, জান না?

জানি।

উঠি। তিন মিনিট হয়ে গেল। অন্য এক সময় এসে তোমার স্বামীর সঙ্গে পরিচয় করে যাব।

কবে আসবেন? তুমিই বল।

রিমি কিছু বলতে পারছে না। তার সব কিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সে এই মানুষটাকে সত্যি-সত্যি আসতে বলছে। বলা কি উচিত?

ফরহাদ উঠে দাঁড়াতে-দাঁড়াতে বলল, শুক্রবার যদি তোমাদের কোনো প্রোগ্রাম না থাকে তাহলে তোমাদের সঙ্গে এসে ডিনার করতে পারি। আছে কোন প্রোগ্রাম?

না।

তাহলে এই সেটেড হল। আমি সন্ধ্যা সাতটা সাড়ে সাতটার দিকে চলে আসব।

ফরহাদ চলে যাবার পরেও এই ঘরে প্রায় পনের মিনিট রিমি একা-একা বসে। রইল। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। শরীর কাঁপছে। বুক ফেটে যাচ্ছে তৃষ্ণায়।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress