সমরেশ বসু (Samaresh Basu)

নাম : সমরেশ বসু (সুরথনাথ বসু)
জন্ম : ১১ ডিসেম্বর ১৯২৪, বিক্রমপুর, ঢাকা
বাবা-মা : মোহিনীমোহন বসু, শৈবলিনী বসু
দাম্পত্যসঙ্গী : গৌরী বসু, ধরিত্রী বসু
পেশা : লেখক, ঔপন্যাসিক
ধরন : উপন্যাস, ছোটোগল্প
উল্লেখযোগ্য রচনাবলি : গঙ্গা, প্রজাপতি, দেখি নাই ফিরে
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার : সাহিত্য অকাদেমি
মৃত্যু : ১২ মার্চ ১৯৮৮ (বয়স ৬৩), কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
সমরেশ বসু (১৯২৪-১৯৮৮) ছিলেন একজন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি লেখক। তার জন্মনাম সুরথনাথ বসু; কিন্তু সমরেশ বসু নামেই লেখক পরিচিতি সমধিক। তিনি কালকূট ও ভ্রমর ছদ্মনামে উল্লেখযযোগ্য সাহিত্য রচনা করেছেন। তার রচনায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, শ্রমজীবী মানুষের জীবন এবং যৌনতাসহ বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সুনিপুণ বর্ণনা ফুটে উঠেছে।তিনি ১৯৮০ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।
শৈশব ও কৈশোর
তার শৈশব কাটে বাংলাদেশের বিক্রমপুরে আর কৈশোর কাটে ভারতের কলকাতার উপকণ্ঠ নৈহাটিতে। বাবার নাম মোহিনীমোহন বসু, মা শৈবলিনী বসু। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতায় তার জীবন ছিল পরিপূর্ণ। যেমন: এক সময় মাথায় ফেরি করে ডিম বেচতেন তিনি।
কর্মজীবন
১৯৪৩ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত ইছাপুর বন্দুক কারখানায় চাকরি করেছেন সমরেশ বসু। এই সময়পর্বের মধ্যেই কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। বিচিত্র বিষয় এবং আঙ্গিকে নিত্য ও আমৃত্যু ক্রিয়াশীল লেখকের নাম সমরেশ বসু। দেবেশ রায় তার মৃত্যুতে লেখা রচনাটির শিরোনামই দিয়েছিলেন, ‘জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি লেখক এবং পেশাদার লেখক’ (প্রতিক্ষণ, ৫ম বর্ষ, ১৭ সংখ্যা, ২-১৬ এপ্রিল ১৯৮৮)। লিখেছিলেন, ‘তিনি আমাদের মতো অফিস-পালানো কেরানি লেখক ছিলেন না, যাঁদের সাহস নেই লেখাকে জীবিকা করার অথচ ষোল আনার ওপর আঠারো আনা শখ আছে লেখক হওয়ার।’
১৯৫১ সালে জেল থেকে বেরিয়ে ইছাপুরের ইছাপুর বন্দুক কারখানার চাকরিটি হারান তিনি। চাকরি হারিয়ে এই সময়ে স্ত্রী গৌরী বসুর অণুপ্রেরণায় লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন তিনি। নৈহাটির আধাবস্তির টিনের ঘরে বসে তিনি একের পর এক কালজয়ী সৃষ্টি করে গেছেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘নয়নপুরের মাটি’। তিনি এই উপন্যাসটি মাত্র একুশ বছর বয়সে লেখেন। এই উপন্যাসটি ‘পরিচয়’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। কিন্তু সমরেশের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘উত্তরঙ্গ’। ১৯৪৬ সালে তাঁর প্রথম সামাজিক ছোটগল্প ‘আদাব’ প্রকাশিত হয় ‘পরিচয়’ পত্রিকায়। দেশভাগের সময় হিন্দু মুসলমানের দাঙ্গা সাধারণ মেহনতী মানুষের মধ্যে কি প্রভাব ফেলেছিল, তাই এই গল্পের বিষয়বস্তু। এই গল্পে মানবিক দিকটি বেশী করে উম্মোচিত হয়েছে। এরপর থেকেই একের পর এক তাঁর উপন্যাসগুলি প্রকাশিত হতে শুরু করে। ১৯৫২ সালে প্রকাশিত হয় ‘বিটি রোডের ধারে’, ১৯৫৩ সালে ‘শ্রীমতি ক্যাফে’, ১৯৫৭ সালে ‘গঙ্গা’, ১৯৫৭ সালে ‘ত্রিধারা’, ১৯৬০ সালে ‘বাঘিনী’ ১৯৬৬ সালে ‘তিন ভুবনের পাড়ে’, ১৯৭৭ সালে ‘মহাকালের রথের ঘোড়া’ ইত্যাদি। তাঁর উপন্যাসগুলিতে শ্রমিক ও মেহনতী মানুষের কথা, গ্রামীণ জীবনের কথা সামাজিক প্রেক্ষাপটে পরিবেশিত হয়েছে। সামাজিক গল্প ছাড়াও রাজনৈতিক গল্প এবং যৌনতা তাঁর গল্পে সুনিপুণভাবে স্হান পেয়েছে। ১৯৬৭ সালে সমরেশের উপন্যাস ‘প্রজাপতি’কে অশ্লীলতার দায়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এই সময়ে বিখ্যাত সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু তাঁর পাশে দাঁড়ান। ১৯৮৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে উপন্যাসটি সমস্ত দায় থেকে মুক্ত হয়। বড়দের পাশাপাশি তিনি খুদে পাঠকদের জন্যও রচনা করেছেন। ছোটদের জন্য তাঁর অন্যতম সৃষ্টি ‘গোয়েন্দা গোগোল’ চরিত্রটিকে তিনি প্রথমবার প্রকাশ করেন ‘শুকতারা’ পত্রিকায় যা পরবর্তীকালে ধারাবাহিক হিসেবে শুকতারায় প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে এই খুদে গোয়েন্দার উনিশটি গল্প নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘গোগোল অমনিবাস’। এই গল্পগুলি মধ্যে অন্যতম ‘আয়না নিয়ে খেলতে খেলতে’, ‘অদৃশ্য মানুষের হাতছানি’, ‘গোগোল কোথায়?’, ‘গোগোলের কেরামতি’ ‘রত্নরহস্য ও গোগোল’, ‘ইঁদুরের খুটখাঁট’, ‘মহিষমর্দিনী উদ্ধার’, ‘পশ্চিমের বারান্দা থেকে ‘, ‘টেলিফোনে আড়িপাতার বিপদ’ ইত্যাদি। পৌরাণিক চরিত্র ‘শ্বাম্ব’ সমরেশের অমর সৃষ্টি কাহিনী। এই উপন্যাসটি তিনি কালকূট ছদ্মনামে লিখেছিলেন। ‘কালকূট’ কথাটির অর্থ বিষ। প্রতিনিয়ত সমস্যার সাথে লড়াই করতে গিয়ে মানুষের জীবন বিষতুল্য দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। এই দুর্বিষহ জীবন থেকে মুক্তি খুঁজে অমৃতের সন্ধানের জন্য তিনি কালকূট ছদ্মনামে লিখতে শুরু করেন। মূলত পৌরাণিক চরিত্র হলেও বাস্তবে নিজের চোখের সামনে দেখা রোগজর্জরিত শিশুর যন্ত্রণাকে এই উপন্যাসের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন তিনি। এরই সঙ্গে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানসিকভাবে দুর্বল ও অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তিদের মনের জোর বাড়ানোর পথও তিনি দেখিয়েছেন এই উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে। এই উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায়। এর ঠিক দুবছর পরে ১৯৮০ সালে উপন্যাসটি সাহিত্য আকাদেমি পুরষ্কারে সম্মানিত হয়। কালকূট ছদ্মনামে প্রকাশিত সমরেশ বসুর উপন্যাস গুলি হল ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ (১৯৫৪), ‘কোথায় পাব তারে’ (১৯৬৮), ‘ঘরের কাছে আরশিনগর’ (১৯৮০), ‘চল মন রূপনগরে’ (১৯৮২), ‘অমৃত বিষের পাত্র’ (১৯৮৬), ‘জ্যোর্তিময় শ্রীচৈতন্য’ (১৯৮৭) ইত্যাদি। ‘ভ্রমর’ ছদ্মনামে সমরেশ তিনটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। এইগুলি হল ‘যুদ্ধের শেষ সেনাপতি’, ‘প্রভু কার হাতে তোমার রক্তে’, ‘প্রেম কাব্য রক্ত’। এই তিনটি উপন্যাসই শারদীয়া ‘প্রসাদ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি শেষ জীবনে রাম কিঙ্কর বেইজের জীবন নিয়ে ‘দেখি নাই ফিরে’ উপন্যাস লেখার কাজ শুরু করেছিলেন। তাঁর মাত্র কয়েকটি কিস্তিই ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বাকীগুলি থেকে যায় অসমাপ্ত।
রাজনৈতিক জীবন ও কারাবাস
১৯৪৩ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি ইছাপুরের বন্দুক ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। ট্রেড ইউনিয়ন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। এ কারণে তাকে ১৯৪৯-৫০ সালে জেলও খাটতে হয়। জেলখানায় তিনি তার প্রথম উপন্যাস ‘উত্তরঙ্গ’ রচনা করেন। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন।
ছদ্মনাম
কালকূট মানে তীব্র বিষ। এটি ছিল তার ছদ্মনাম। ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’, ‘কোথায় পাব তারে’ সহ অনেক উপন্যাস তিনি এ নামে লিখেছেন। বহমান সমাজ থেকে বাইরে গিয়ে একান্তে বেড়াতে ঘুরে বেরিয়েছেন আর সে অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন ভ্রমণধর্মী উপন্যাস । হিংসা, মারামারি আর লোলুপতার বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে যে জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল, সেখান থেকে বেড়িয়ে এসে তিনি অমৃতের সন্ধান করেছেন। তাই কালকূট নাম ধারণ করে হৃদয়ের তীব্র বিষকে সরিয়ে রেখে অমৃত মন্থন করেছেন উপন্যাসের মধ্য দিয়ে৷ অমৃত বিষের পাত্রে, মন মেরামতের আশায়, হারায়ে সেই মানুষে, তুষার শৃঙ্গের পদতলে ইত্যাদি এই ধারার উপন্যাস ।
ভ্রমর ছদ্মনামে লেখা তিনটে উপন্যাস ১৩৮৯, ১৩৯০ ও ১৩৯১ বঙ্গাব্দের শারদীয়া প্রসাদএ প্রকাশিত হয়:’যুদ্ধের শেষ সেনাপতি’ , ‘প্রভু কার হাতে তোমার রক্ত’ , ‘প্রেম – কাব্য – রক্ত’।
পুরস্কার
ছদ্মনামে লেখা শাম্ব উপন্যাসের জন্য তিনি ১৯৮০ সালের আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন।
সাহিত্য কর্ম
লেখক হিসেবে সমরেশ আমৃত্যু যে লড়াই করেছেন, তার কোনো তুলনা নেই। তার নিজের জীবনই আরেক মহাকাব্যিক উপন্যাস। ‘চিরসখা’ নামের প্রায় ৫ লাখ শব্দের বিশাল উপন্যাসে সেই লড়াইকে স্মরণীয় করে রেখেছেন তারই পুত্র নবকুমার বসু। ছোটদের জন্যে তার সৃষ্ট গোয়েন্দা গোগোল অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। গোগোলকে নিয়ে বহু ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখেছেন যা শিশুসাহিত্য হিসেবে সমান জনপ্রিয়তা পেয়েছে। গোগোলের দুটি কাহিনি গোয়েন্দা গোগোল ও গোগোলের কীর্তি নামে চলচ্চিত্রায়িতও হয়েছে।
উপন্যাস সমরেশ বসু প্রণীত উপন্যাসের সংখ্যা ১০০।
উত্তরঙ্গ (১৯৫১), গঙ্গা (১৯৫৭), বিবর (১৯৬৫), প্রজাপতি, দেখি নাই ফিরে, সওদাগর, কোথায় পাবো তারে (১৯৬৮) (কালকূট ছদ্মনামে), নয়নপুরের মাটি (১৯৫২), বাঘিনী (১৯৬০), চলো মন রুপনগরে, পাতক, মুক্তবেণীর উজানে, টানাপোড়েন, স্বীকারোক্তি, অপদার্থ, সুচাঁদের স্বদেশযাত্রা, যুগ যুগ জীয়ে (১৯৮১), মহাকালের রথের ঘোড়া (১৯৭৭), শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে (১৯৮৪), বাঘিনী, বিপর্যস্ত, শাম্ব, বিটি রোডের ধারে (১৯৫২), শ্রীমতি কাফে (১৯৫৩), অবশেষে, আম মাহাতো, কামনা বাসনা, কে নেবে মোরে, খন্ডিতা, গোগোল চিক্কুস নাগাল্যান্ড, ছায়া ঢাকা মন, জঙ্গল মহলের গোগোল, জবাব, তিন পুরুষ, দাহ, নাটের গুরু, নিঠুর দরদী, পথিক, প্রাণ, প্রতিমা, বাঘিনী, বিদেশী গাড়িতে বিপদ, বিবেকবান/ভীরু, ভানুমতী ও ভানুমতীর নবরঙ্গ, মহাকালের রথের ঘোড়া, রক্তিম বসন্ত, শিমুলগড়ের খুনে ভূত, শেখল ছেঁড়া হাতের খোঁজে, সেই গাড়ির খোঁজে, স্বর্ণচঞ্চু, হৃদয়ের মুখ, প্রচেতোষ
মৃত্যু
সমরেশ বসু ১৯৮৮ সালের ১২ মার্চ মারা যান। মৃত্যুকালেও তার লেখার টেবিলে ছিল দশ বছরের অমানুষিক শ্রমের অসমাপ্ত ফসল শিল্পী রামকিংকর বেইজের জীবনী অবলম্বনে উপন্যাস দেখি নাই ফিরে। এই উপন্যাসের চিত্রাঙ্কন করেন প্রচ্ছদ শিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্য।
Source : wikipedia