সমকামি – অষ্ঠাদশ পর্ব
অন্যন্যা কেবিনের কাছে গিয়ে নক করলো: আসবো স্যার? আরে অন্যন্যা, আসুন। অন্যন্যা ভিতরে গিয়ে প্রশ্ন করলো: আমাকে ডাকছিলেন? কৃষ্ণেন্দু বলে: বসো। যেটা বলতে ডাকা সেটা হলো: তোমাকে আমি কয়েকটা ফাইল একসাথে দিয়ে দিচ্ছি ফাইলগুলো তোমার ড্রয়ারে সাবধানে চাবি দিয়ে রাখবে আর সেন সাহেব কোনো কাজের কথা যদি বলে তুমি বলবে আমার অনেকগুলো ফাইল তোমার কাছে অলরেডী দেওয়া আছে যদি ওনার তাড়া থাকে তাহলে এখন তুমি পারবে না নতুন ফাইল ধরতে। বাকিটা আমি ম্যানেজ করে নেব। লোকটা সুবিধের নয় আমি চাই না তুমি ওনার বেশি কাজ করো কোনো না ভাবে তাহলে তোমাকে ঝামেলায় ফেলার চেষ্টা করবে। ও আর একটা কথা আজ ক্যান্টিনে কি হয়েছে? অন্যন্যা অবাক হয়ে জানতে চায়: তুমি না মানে আপনি কি করে জানলেন? এটা ইম্পর্ট্যান্ট নয় কি ভাবে জানলাম? গম্ভীর হয়ে উত্তর দেয় কৃষ্ণেন্দু। রাম দা বলেছেন!!! আজকে আমি লাঞ্চ ক্যান্টিন থেকে আনতে পাঠিয়েছিলাম আর তখনই তোমাদের ঝামেলাটা হয়। এই পিয়ালি মেয়েটাকে নিয়ে একটু ভাবতে হচ্ছে আমাকে। সেন সাহেবের আড়াল নিয়ে নিজেকে অনেক বড় কেউকেটা ভাবছে ও। ঠিক আছে তুমি যাও। অন্যন্যা বেরিয়ে যাবার জন্য উঠতে গেলে কৃষ্ণেন্দু বলে সাড়ে সাতটায় বেরিয়ে বাস স্ট্যান্ডেই থেকো। অন্যন্যা কৃষ্ণেন্দুকে বলে: এটার কি সত্যি রোজ রোজ কোনো দরকার আছে? আমি আগে ও অফিস এসেছি ফিরেওছি। কৃষ্ণেন্দু অন্যন্যার মুখের দিকে তাঁকিয়ে বলে: না, সেই ভাবে দেখতে গেলে সত্যি কোনো দরকার নেই। কিন্তু আসলে কি তোমার সাথে গল্প করতে করতে কিছুটা সময় কাটানো যায় ঘরে গিয়ে তো সেই একা একটা কথা বলার মানুষ ও নেই। তবে তোমার যদি আপত্তি থাকে তাহলে থাক আমি তোমাকে অস্বস্থিতে ফেলতে চাই না। আর এটাও তো ঠিক যে অফিসে আমার জন্য তোমাকে অকারণে বাজে কথা শুনতে হচ্ছে। একটু মুচকি হেঁসে কৃষ্ণেন্দু বললো: নেভার মাইন্ড অন্যন্যা তুমি এসো। অন্যন্যা আর কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে যায় কৃষ্ণেন্দুর কেবিন থেকে।
অন্যন্যা নিজের ডেস্কে এসে কাজে মন দিলেও কৃষ্ণেন্দুর কথাগুলো বার বার ওর মনে হতে থাকে। ওর কাজ তখন প্রায় শেষ কিন্তু খুব একটা অসস্তি হতে থাকে অন্যন্যার। কি করবে বুঝতে পারে না ও। হঠাৎ ওর তৃণার কথা মনে হয়। তৃণাকে ফোন করে অন্যন্যা। ফোন ধরে ওপার থেকে তৃণা বলে: কি রে কি খবর তোর? কেমন আছিস তুই? অন্যন্যা রাগের সুরে বলে: ও আচ্ছা আমি ফোনটা করলাম তাই মনে হলো আমি কেমন আছি? একটা খোঁজ নিয়েছিস এই কটাদিন? রাগ করিস না প্লিজ আসলে আমি খুব আটকে গেছিরে এর মধ্যে দুদিনের জন্য জামশেদপুর গেছিলাম অফিসের কাজে। জবটা ছেড়ে দেবো রে খুব ছোটাচ্ছে রোজ ভাবি ফোন করবো অফিসে ঢুকে লাঞ্চের টাইম দিচ্ছে না আর বাড়ি ফিরতে রাত 10 টা কি তার ও পরে ব্যাস এই চলছে আমার। তুই কেমন আছিস? আর ওইদিকের কি খবর? আর কোনো ডিস্টার্ব করেছে তোকে? এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলতে থাকে তৃণা। অন্যন্যা আসতে করে বলে খবর অনেক কিছুই আছে তোর সাথে দেখা হওয়া খুব দরকার এই ভাবে ফোনে এতো কথা বলা যাবে না। তোর কবে সময় হবে সেটা বল? তৃণা উত্তর দেয় যদি খুব সমস্যা না হয় আমি স্যাটারডে হাফ ডে নিচ্ছি যদিও আমার অফিসে ও অনেক চাপ অনেক সমস্যা হচ্ছে কিন্তু আমি চেষ্টা করবো যদি তুই আসবি বলিস। কথাগুলো তোকে ছাড়া আর কাকেই বা বলবো? তুই প্লিজ একটু ম্যানেজ কর। তৃণা একটু চুপ থেকে বলে: ওকে আমি তোকে আজ রাতেই কনফার্ম করে দিচ্ছি আমি পারবো কিনা। তাহলে স্যাটারডে আমরা যেখানে বসতাম সেখানেই যাবো। অন্যন্যা উত্তর দেয়: ওকে ডিয়ার থ্যাংস। ফোনটা রেখে দেয় অন্যন্যা। তারপর আবার কাজে মন দেয়। ঘড়িতে তাঁকিয়ে দেখে তখন প্রায় সাতটা পনের। কৃষ্ণেন্দুর কথাগুলো মনে পড়ে ওর। তখন ও বুঝতে পারছে না কি করবে ও। তারপর নিজেই ঠিক করে যে !!! যে মানুষটা ওকে এতটা হেল্প করছে তাঁকে হয়তো ওর কষ্ট দেওয়া ঠিক হবে না। ও না দাঁড়ালে কৃষ্ণেন্দুর খারাপ লাগতে পারে ও ইনসাল্টটেড ফিল করতে পারে আর সেটা ওর কখনোই করা উচিত না। তাই অন্যন্যা কৃষ্ণেন্দুকে একটা টেক্সট করে: ” আমি বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করবো”। কিছুক্ষণ বাদে একটা রিপ্লাই আসে: ওকে।
অন্যন্যার সব গুছিয়ে বেরোতে একটু দেরী হয়ে যায়। এসে দেখে কৃষ্ণেন্দু গাড়ি নিয়ে দাঁড়ানো। গাড়িতে উঠে বসে অন্যন্যা। অন্যন্যার গাড়িতে ওঠার পরেই কৃষ্ণেন্দু প্রশ্ন করে: কি হলো অন্যন্যা এতো চিন্তিত লাগছে কেনো? অফিস নিয়ে চিন্তা করছো? আমি যতদিন আছি তোমার কেউ কোনো ক্ষতি করতে পারবে না এই অফিসে। এইটুকু কথা তোমাকে আমি দিতেই পারি। আজ যদি তুমি নাও আসতে আমার সাথে আমি কিছু মনে করতাম না কারণ আমি বুঝতে পারছি তোমার দিকটা ও। অন্যন্যা কোনো উত্তর দেয় না কৃষ্ণেন্দুর কথার। কৃষ্ণেন্দু আবার জিজ্ঞাসা করে কি হলো কিছু বলছো না যে? অন্যন্যা এবার কৃষ্ণেন্দুর দিকে তাঁকিয়ে বলে: খুব মাথা ধরে গেছে আজকাল কি যে হয়েছে খালি মাথা ধরে যাচ্ছে। কৃষ্ণেন্দু জিজ্ঞাসা করে চা খাবে বা কফি? হুমম হলে ভালো হয় । আচ্ছা চলো দেখি একটা চায়ের দোকান দেখে গাড়ি দাঁড় করাই অব্বশ্য কোনো ক্যাফেতে তে ও বসা যায়। কিছু তো খাওয়া হয়নি সন্ধ্যে থেকে। না এখন কিছু খাবো না ভালো লাগছে না। আজকাল এতো মাথা ধরে যাচ্ছে কেনো বুঝতে পারছি না। কৃষ্ণেন্দু ড্রাইভ করতে করতেই উত্তর দেয়: মাথার আর কি দোষ? এতো টেনশন কি নিয়ে করছো? তোমাকে তো বললাম আমি আছি।
এরপর ব্রিজের ধার ঘেঁষে একটা চায়ের দোকানে গাড়িটা দাঁড় করায় কৃষ্ণেন্দু। তারপর অন্যন্যাকে উদ্দেশ্য করে বলে: চলুন আপনার চায়ের দোকান এসে গেছে ম্যাডাম। দুজনে নেমে দাঁড়ায় গাড়ি থেকে তারপর চায়ের কথা বলে কৃষ্ণেন্দু বলে এখানে বসো অন্যন্যা। অন্যন্যা কৃষ্ণেন্দুর দিকে তাঁকিয়ে হেঁসে বলে না এখানে একটু দাঁড়াই বেশ ভালো লাগছে কতো সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে ভালো লাগছে না তোমার? কৃষ্ণেন্দু এক দৃষ্টিতে অন্যন্যার দিকে তাঁকিয়ে থাকে। অন্যন্যা বুঝতে পেরে লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নেয়। এরমধ্যে চায়ের দোকানের বাচ্চা ছেলেটা অন্যন্যার হাতে চায়ের কাপটা দিয়ে বলে দিদি তোমার চা। দাদাবাবু আপনার টা ও । বাচ্চা ছেলেটা অন্যন্যাকে জিজ্ঞাসা করে বিস্কুট দেবো দিদি? অন্যন্যা উত্তর দেয়: না,রে!! এই তুই এই দোকানে কাজ করিস? পড়াশুনা করিস না। ছেলেটি বলে!!! করি দিদি রাতে বাড়ি গিয়ে পড়ি আর সকালে দুধ দিয়ে তারপর স্কুলে যাই, বাড়ি ফিরে এখানে কাজ করি তারপর রাতে গিয়ে পড়ি। আসলে বাপটা আমাদের রেখে পালিয়ে গেছে মার একার রোজগারে সব হয় না তাই আমি এখানে কাজ করে মাকে সাহায্য করি আর নিজের পড়াশুনা চালাই। অন্যন্যার ভীতর থেকে যেনো একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। ও কৃষ্ণেন্দুকে বলে: কতো বাচ্চার শৈশব এই ভাবেই হারিয়ে যায় তাই না? তারপর গাড়িতে ওঠার সময় ছেলেটিকে ডেকে ওর হাতে কিছু টাকা দেয় অন্যন্যা আর বলে এই টাকাটা দিয়ে বই কিনে পড়বি বুঝলি? তারপর ওরা বেরিয়ে যায় ওখান থেকে। কিছুটা রাস্তা যাবার পর অন্যন্যার ফোনটা বেজে ওঠে। ও নিজে নিজেই বলে ওঠে বাড়ি থেকে ফোন আসছে হয়তো। তারপর ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে দেখে লইয়ার সান্যাল এর ফোন। তাড়াতাড়ি করে ফোনটা ধরে অন্যন্যা।
ওপার থেকে একটা গম্ভীর গলা ভেসে আসে: আমি লইয়ার সান্যাল বলছি!! অন্যন্যা উত্তর দেয়: হ্যাঁ, স্যার আমি বুঝতে পেরেছি। লইয়ার সান্যাল বলে: অন্যন্যা আপনার কাগজ সব রেডী হয়ে গেছে আপনি দু এক দিনের মধ্যে এসে সই করে দিয়ে গেলেই আমি ওটা পাঠিয়ে দিতে পারবো। আপনি এসে সইটা করে দিয়ে যান। অন্যন্যা উত্তর দেয়: আমি স্যাটারডে আসছি স্যার যদি বিকেলের দিকে আসি তাহলে কোনো সমস্যা নেই তো? স্যাটারডে বিকেল? হুমম, না কোনো সমস্যা নেই তবে আটটার মধ্যে আসবেন। ওকে স্যার আমি আটটার মধ্যেই আসবো। বলে ফোনটা কেটে দেয় অন্যন্যা। তারপর কৃষ্ণেন্দুর দিকে তাঁকিয়ে বলে লইয়ার সান্যালের ফোন। কৃষ্ণেন্দু উত্তর দেয়: হুমম বুঝতে পেরেছি আমি কি বললো? কাগজ সব রেডী হয়ে গেছে সইটা করে দিয়ে আসলে উনি ওটা পাঠিয়ে দিতে পারবেন। কৃষ্ণেন্দু বলে: very good, তাই তুমি শনিবার বললে? অন্যন্যা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। কৃষ্ণেন্দু একটু চিন্তিত হয়ে বলে: তুমি শনিবার বলে তো দিলে কিন্তু যতদূর বুজলাম ও তোমাকে আটটার মধ্যে যেতে বললো কি তাই তো? অন্যন্যা মাথা নাড়ায়। কৃষ্ণেন্দু ড্রাইভ করতে করতেই বলে: দুজন একসাথে তাড়াতাড়ি কি করে বেরোবো? অন্যন্যা তাঁকিয়ে থাকে কৃষ্ণেন্দুর দিকে। তারপর বলে তুমি চিন্তা করো না আমি চলে যাবো কোনো সমস্যা হবে না। তাছাড়া তৃণা থাকবে সেদিন আমার সাথে। কৃষ্ণেন্দু একটু ভ্রু কুঁচকে উত্তর দেয়: তৃণা? সে আবার কে? তোমার মুখে এর কথা আগে তো শুনিনি কখনো? অন্যন্যা বলে: তৃণা আমার বান্ধবী!!! আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। কৃষ্ণেন্দু হুট করে বলে ওঠে: আমার থেকে ও বেস্ট? অন্যন্যা চমকে উঠে জানতে চায়: মানে? কৃষ্ণেন্দু এবার জোড়ে হেঁসে বলে: আরে মানে কিছু নেই। সব কিছুতে এতো ভয় কেনো পাও? আমি তোমার কোনো ক্ষতি করবো না বিশ্বাস করতে পারো আমাকে। আমি তো শুধু মজা করলাম। অন্যন্যা কোনো উত্তর দেয় না। অন্যন্যার বাড়ির কাছে চলে আসে ওরা। নামার সময় কৃষ্ণেন্দু বলে: বান্ধবীকে নিয়ে যেতে চাইছো যাও কিন্তু ছুটির মেইলটা কালকেই অফিসে গিয়ে করে দিও যাতে সেদিন বেরোতে অসুবিধা না হয়। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় অন্যন্যা। গাড়ি থেকে নেমে যাওয়ার পর কৃষেন্দু বলে আমি খুব চিন্তায় থাকবো তুমি একা যাবে তোমাকে অন্য করো সাথে একা ছাড়তে আমার মন চায় না চিন্তা হয় আমার। আমি ফোনটা করলে অন্তত ধরো!! অন্যন্যা কিছু বলতে যাবে তার আগেই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে যায় কৃষ্ণেন্দু।