সমকামি – ত্রয়োদশ পর্ব
খাওয়া দাওয়ার পর্ব মিটলে বিকাশ বাবু যখন দেখলেন রিনা দেবী বিশ্রাম নিচ্ছেন সেই সময় তিনি অন্যন্যার ঘরে এলেন।
আসবো রে মা?
এমা, বাবা তুমি? তুমি আমার ঘরে ঢোকার জন্য অনুমতি নিচ্ছ? হ্যাঁ রে মা, সবাই তোরা বড় হয়ে গেছিস এগুলো নেওয়া দরকার। যাই হোক আমি যেটা বলতে এসেছিলাম!!! দেখ এতো কিছু করা হয়ে গেলো কিন্তু তোর মাকে কিছুই জানানো হচ্ছে না। এরপর কেস শুরু হলে সবটা কি ওর থেকে লুকানো ঠিক হবে? আর সত্যি বলতে সেটা কি সম্ভব? এবার তোর মাকে সব খুলে বলা দরকার, ওকে বোঝাতে হবে। জানি ও টেনশন করবে আরও বকাঝকা বেড়ে যাবে কিন্তু।
না, তুমি ঠিকই বলেছ বাবা। উত্তর দেয় অন্যন্যা। পেপারস রেডী হোক সাইন করে নিয়ে তারপর না হয় জানানো যাবে সব। আগে বললে যদি কেসটাই করতে না দে়য় তাহলে তো এই সম্পর্কটা থেকে আমি কোনোদিন বেরিয়েই আসতে পারবো না বাবা। মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় বিকাশ বাবু। সেটা তুই ঠিকই বলেছিস। ঠিক আছে। তবে মা তুই খুব সাবধানে থাকিস। আমি ও তোকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় থাকি রে।
বাবার হাতটা শক্ত করে ধরে অন্যন্যা বলে: বাবা তুমি চিন্তা করো না। আমি সাবধানে থাকবো। আমি আমার বা তোমাদের কারো কোনো ক্ষতি হতে দেবো না।
মেয়ের মাথার উপর বিকাশ বাবু হাত রেখে বলেন: ভালো থাক মা খুব ভালো থাক। নে একটু বিশ্রাম নে এবার আমি যাই, কাল থেকে তো আবার দৌড়।
পরেরদিন সকালে অফিসে যেতেই পিয়ন এসে অন্যন্যাকে বলে: ম্যাডাম, আপনাকে কৃষ্ণেন্দু স্যার ডাকছেন।
অন্যন্যা উত্তর দেয়, আচ্ছা তুমি যাও আমি যাচ্ছি। অন্যন্যাকে কৃষ্ণেন্দুর ঘরের দিকে যেতে দেখে পিয়ালি ( অন্যন্যার অফিসে কলিগ) এগিয়ে আসে অন্যন্যার দিকে আর বলে: কিরে অন্যন্যা, আজকাল কৃষ্ণেন্দু স্যার তো দেখছি তোকে ছাড়া কাজ দেবার জন্য অফিসে আর কাউকে খুঁজেই পাচ্ছে না। সবাই চলে যাচ্ছে তোরা অফিসে দুজন এতো কি কাজ করেছিস রে? দেখিস বাবা, লোকটার কিন্তু শুনেছি স্বভাব একদম ভালো না। তুই আর কিছু বলবি পিয়ালি? না হলে আমি যাই স্যার ডাকছেন। একটু বিরক্ত হয়ে উত্তর দেয় অন্যন্যা। ও বাবা, তোকে তো সাবধান করতে গেলাম উল্টে তুইই। ঠিকই বলে সবাই ভালো মানুষের ভাত জোটে না। কোনো কথার উত্তর না দিয়ে এগিয়ে যায় অন্যন্যা।
অন্যন্যা এগিয়ে যায় কৃষ্ণেন্দুর কেবিনের দিকে। আসবো স্যার? আরে অন্যন্যা আসুন। আবার স্যার কেনো? না, আসলে অফিসে স্যার ডাকাই ভালো। সবাই সবকিছু ভালো ভাবে নাও নিতে পারে। শুধু শুধু এটা নিয়ে জল ঘোলা করবে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কৃষ্ণেন্দু উত্তর দেয়: হুমম, সেটা আপনি ভুল বলেননি। এমনিতেই আমি অফিসে সবার খুব একটা পছন্দের মানুষ নই। শুধু শুধু আপনাকে নিয়ে ও বলবে ওরা। একটা কথা বলবো? জানতে চায় অন্যন্যা। আরে অনুমতি নেবার কি আছে বলুন না হেঁসে উত্তর দেয় কৃষ্ণেন্দু। অন্যন্যা বলে সবাই কি বলছে সেই নিয়ে সত্যি কি ভাববার কোনো দরকার আছে আপনার? যে যাই বলুক আপনি নিজে তো জানেন আপনি কি? লোকের কাজ বলতে হবে বলে ওগুলো নিয়ে ভাববেন না।
কৃষ্ণেন্দু অন্যন্যার দিকে তাঁকিয়ে বলে: আপনি একদম আমার মার মতো বললেন কথাটা। আমার মা ও এই এক কথা বলতো। মা চলে যাবার পর থেকে জানেন তো এই প্রথম আমি এই ভাবে কথা বলছি।অন্যন্যা বলে আপনার মা? হুমম, মা মারা গেছেন দুবছর হলো। আচ্ছা থাক সে কথা একটু নড়েচড়ে বসে বলে কৃষ্ণেন্দু। আপনার বাড়িতে কোনো সমস্যা হয়নি তো? আপনার মা রাগারাগি করেননি তো? অন্যন্যা হেঁসে ফেলে, আপনার তো দেখছি সব মাথায় থাকে!!! আরে মাথায় থাকবে না? এমনি এমনি কোম্পানি এতো বড় একটা পোস্টের দায়িত্ব দিয়েছে? একদম এটা আপনি একদম ঠিক কথা বলেছেন সম্মতি জানায় অন্যন্যা।
আচ্ছা অন্যন্যা এবার একটু কাজের বলি? হ্যাঁ বলুন না!!! কৃষ্ণেন্দু একটা ফাইল অন্যন্যার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে: এই ফাইলটা ভালো করে দেখে বুঝে নিন। এটাও কিন্তু খুব ইম্পর্ট্যান্ট যতটা তাড়াতাড়ি পারা যায় কমপ্লিট করে দিন। ওকে স্যার, আমি খুব তাড়াতাড়ি কমপ্লিট করে দেবার চেষ্টা করছি, উত্তর দেয় অন্যন্যা। হুমম, আমি জানি আপনি পারবেন।
ফাইলটা নিয়ে নিজের ডেস্ককে আসতেই পিয়ালি আবার এসে দাঁড়ায় অন্যন্যার ডেস্কের কাছে। কিরে? আজকাল কৃষ্ণেন্দু স্যার এর কেবিনে ঢুকলে সহজে তো বেরোস না দেখছি!!! অন্যন্যা এবার খুব রেগে গিয়ে বলে: তোর সমস্যাটা কি পিয়ালি? সারাক্ষণ এসব না করে একটু কাজ ও তো করতে পারিস। সকাল থেকে দেখছি একটা অদ্ভুত ব্যাবহার করছিস!! কেনো বলতো? কোনো উত্তর না দিয়ে সেখান থেকে চলে যায় পিয়ালি।
সারাদিনের কাজে অন্যন্যা বেশ ক্লান্ত। ঘড়িতে তখন প্রায় সাতটা বাজে একে একে সবাই প্রায় বেরিয়ে যাচ্ছে। সমীর এসে বললো অন্যন্যা দি বেরোবে না? সাতটা তো বাজে। ও সমীর তুই!!!! হ্যাঁ রে, এই বেরোব। তুই আজ এখনও যাসনি যে? আজকে আসতে একটু দেরী হয়ে গেছে তাই জন্যই। তুমি বেরোবে তাহলে আমি দাঁড়াতাম তোমার জন্য। অন্যন্যা একটু অবাক হয়ে জানতে চাইলো: একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো সমীর? সমীর উত্তর দিলো: হ্যাঁ বলো না। অন্যন্যা জানতে চায়: তুই কি আমাকে কিছু বলবি? না, মানে তুই আমার জন্য দাঁড়াতে চাইছিস কেনো? কোনোদিন তো বলিস না।
সমীর কিছুক্ষন মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থেকে বললো: হ্যাঁ তুমি ঠিকই ধরেছো অন্যন্যা দি। আমার তোমার সাথে কিছু কথা আছে। লাঞ্চ টাইমে ও তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু তখন সুযোগ ছিল না তাই। তুমি যদি কিছু মনে না করো তাহলে আসলে অফিসের বাইরে গিয়ে বলতে পারলেই ভালো হয়।
আচ্ছা, তুই একটু অপেক্ষা কর আসছি আমি। তারপর একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেলো অফিস থেকে। বেরিয়ে অন্যন্যা বললো: বল কি বলতে চাস? সমীর বলে অন্যন্যা দি তুমি একটু সাবধানে থেকো অফিসে। অন্যন্যা অবাক হয়ে জানতে চায়!!! হঠাৎ এই কথা কেনো বলছিস? কি হয়েছে? সমীর একটু থমকে দাঁড়িয়ে বলে: পিয়ালি দি আর পুষ্পেন্দু দা তোমাকে আর কৃষ্ণেন্দু স্যার নিয়ে নানান রকম কথা বলে বেড়াচ্ছে অফিসের ভিতরে। তুমি তো এমনিই জানো পিয়ালি দি করো ভালো সহ্য করতে পারে না। আর এখন দোসর পেয়েছে ওই পুষ্পেন্দু দা কে মানুষ দুটো অদ্ভুত। কি যে সমস্যা সবাইকে নিয়ে বুঝতে পারি না।
অন্যন্যা এতক্ষন চুপ করে শুনছিল সমীরের কথাগুলো। তারপর বললো!!! হুমম, সেটা আমিও বুঝতে পারছি। তবে তোকে অনেক থ্যাংকস কথাটা জানানোর জন্য। এরপর থেকে আমি আরো সতর্ক থাকবো। আমি তাহলে আসি সমীর। তুইও সাবধানে যাস। আচ্ছা অন্যন্যা দি তুমি ও সাবধানে যেও। এরপর যে যার রাস্তায় চলে গেলো।
অন্যন্যা তখন বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়ানো হঠাৎ অন্যন্যার ফোনটা বেজে ওঠে। অন্যন্যা ফোনটা বের করে দেখলো কৃষ্ণেন্দু ফোন করেছে। ফোনটা রিসিভ করলো অন্যন্যা!!! হ্যাঁ, স্যার বলুন। ওপার থেকে কৃষ্ণেন্দু বললো: আপনি কি অফিসে থেকে বেরিয়ে গেছেন অন্যন্যা? হ্যাঁ, মানে এই মাত্রই বেরোলাম। কেনো কোনো কাজ আছে কি? আমি কি ফিরে আসবো? আমি বাস স্ট্যান্ডেই দাঁড়ানো।
ও আপনি বাস স্ট্যান্ডে ঠিক আছে আপনি দাঁড়ান ওখানে আমি আসছি। অন্যন্যা একটু ইতস্তত করে উত্তর দেয় আচ্ছা স্যার।
কৃষ্ণেন্দু গাড়ি নিয়ে এসে দাঁড়ায় অন্যন্যার সামনে। গাড়ির দরজাটা খুলে দিয়ে বললো: উঠে আসুন অন্যন্যা। আপনি আবার কেনো কষ্ট করে এলেন? আমি বাসে করেই চলে যেতাম দেরী তো বেশি হয়নি। কৃষ্ণেন্দু হেঁসে উত্তর দেয়!!! হ্যাঁ পারতেন তো, আমি কি বললাম আপনি পারতেন না। এখন উঠে আসুন বাকি কথা যেতে যেতে বলছি। গাড়িতে উঠে বসে অন্যন্যা।
বেশ কিছুটা রাস্তা চুপচাপ যাওয়ার পর কৃষ্ণেন্দু বললো: আপনি কি কিছু নিয়ে টেনশনে আছেন? বড্ড চুপচাপ লাগছে আজকে আপনাকে। কিছু কি হয়েছে?
না, না তেমন কিছু না এমনিই স্যার।
কৃষ্ণেন্দু এবার বলে: আচ্ছা আপনি অফিসে স্যার বলেন তার তো একটা কারণ বুজলাম। আপনি এখন আমাকে কেনো স্যার বলছেন?
অন্যন্যা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, স্যার বলবো না? তাহলে কি বলবো?
কৃষ্ণেন্দু এবার হা হা করে হেঁসে ফেলে এই ভাবে কেউ তাঁকে কোনোদিন হাসতে দেখেনি। তারপর বলে: কেনো? কৃষ্ণেন্দু বলবেন আচ্ছা আচ্ছা সেটাতে অসুবিধা থাকলে তাহলে কৃষ্ণেন্দু দা বলুন। অফিসের বাইরে স্যার না হয় নাই বা বললেন। বোঝাতে পারলাম?
ঘাড় কাত করে সম্মতি জানায় অন্যন্যা।আচ্ছা তাহলে তাই ডাকবো।
গুড গার্ল। এবার বলুন তো আপনাকে এতো চিন্তিত কেনো দেখাচ্ছে? জানতে চায় কৃষ্ণেন্দু।
কোথায়? না তো। না, না চিন্তা নেই কিছু।
দেখুন অন্যন্যা আমি কিন্তু এই কটাদিনে আপনাকে বেশ বুঝতে শিখে গেছি। আপনি কখন টেনশনে থাকেন কখন খুশিতে থাকেন আমি সেটা বুঝতে পারি। ঠিক তেমনি এখন বুঝতে পারছি যে আপনি কিছু একটা নিয়ে চিন্তায় আছেন। বলতে পারেন আমাকে যদি আপনার অসুবিধা না থাকে।
কৃষ্ণেন্দুর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাঁকিয়ে থাকে অন্যন্যা। চিন্তা করতে থাকে সমীরের বলা কথা গুলো কৃষ্ণেন্দুকে বলা ঠিক হবে কিনা?