পর্ব – 3
অফিসে ঢুকেই চমকে গেল টুটুল। বিভিন্ন টেবিলে রজনীগন্ধার মালা , স্টিক , শ্বেতপদ্মের রিং , দেখেই বোঝা যাচ্ছে অফিসের কেউ মারা গেছে স্টাফেরা শ্রদ্ধা জানাতে চাইছে। তবে কি দত্ত সাহেব ? ওনার স্ত্রী ? টুটুলকে দেখে মিত্র বাবু এগিয়ে এলেন। টুটুলের মায়ের খবর নিয়ে বললেন -” এসেছো ভালোই হয়েছে, চলো”। কিংকর্তব্যবিমূঢ় টুটুল জানতে চাইলো কি হয়েছে আর কার হয়েছে , উত্তর পেলো গেলেই দেখতে পাবে। হতভম্ব টুটুল অন্য স্টাফেদের সঙ্গে গাড়িতে বসল। বেশ কিছুক্ষণ যাওয়ার পরে নিউ আলিপুর এলাকাতে গাড়ি ঢুকলো। এখানেই দত্ত সাহেবের বাড়ি। যদিও টুটুল কোনদিন আসে নি। একটা বাংলো টাইপ বাড়ির সামনে এসে গাড়ি দাঁড়ালো। বড় লোহার গেটটা হাট করে খোলা। ভেতরে অনেক লোকের ভীড়। অফিসের স্টাফেদের সঙ্গে টুটুল ভেতরে ঢুকে দেখে দূরে লনেতে একটা দামি খাটে কারুর মৃতদেহ শায়িত। তাকে ঘিরেই ভীড়। টুটুল একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে ইতিউতি দেখতে লাগল। একটু পরেই দূরে দত্ত সাহেবকে দেখতে পেয়ে নিশ্চিন্ত হলো যেমন ততটাই ভাবতে লাগলো তাহলে কি ওনার স্ত্রী ? আসলে একা থেকে থেকে টুটুলের ভীড় পছন্দ নয়। তাই দূরে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো কে মারা যেতে পারে। টুটুল দত্ত সাহেবের স্ত্রীকে আর রীতাকে দেখতে পাচ্ছে না। অবশ্য যা ভীড় । কিছুক্ষণ পরে ওর বিভাগের মৃন্ময় এসে একটা মালা হাতে দিয়ে বলল ” দাদা চলুন আপনি আগে দি’ন”। টুটুল মৃন্ময়ের সঙ্গে এগোলো। ওদের আসতে দেখে ভীড়টা সরে গিয়ে পথ করে দিল। খাটের কাছে এসে দেহ দেখেই টুটুল স্তম্ভিত , এ কা’কে দেখছে সে ! অসাড় হাত থেকে মালাটা মাটিতে খসে পড়লো, নির্বাক , নিস্পন্দ , বিস্ফারিত চোখে টুটুল দেখে চলেছে রীতার মৃতদেহটা । সে যে স্বপ্নেও ভাবেনি। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না টুটুল, মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। মিত্র দা আর মৃন্ময় এসে ওকে তুলে ধরে হাতে মাথাটা দিয়ে খাটের কাছে নিয়ে গিয়ে রীতার দেহে মালাটা দিতে বলল। ঘোরের মধ্যে থাকা টুটুল যন্ত্রের মত কাজ করলো। দুজনে টুটুলকে ধরে ধরে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গিয়ে একটা সোফায় বসিয়ে দিল। টুটুলের মাথা কাজ করছে না, শূন্যদৃষ্টি। কিচ্ছু ভাবতে পারছে না। ” টুটুল”- ধরা গলায় দত্ত সাহেবের ডাকে বাহ্যজ্ঞান ফিরলো,ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো দত্ত সাহেব পাশে দাঁড়িয়ে, দু চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় জল বইছে। “অ্যাকিউট লিউকোমিয়া ছিল” – বলে চলেছেন উনি- বছরে দু’বার ব্লাড পাল্টাতে হতো। খুব স্পিরিটেড মেয়ে ছিল, হার মানতে শেখেনি।আজ লড়াই করে হেরে গেল আমরা শেষ হয়ে গেলাম”- আর বলতে পারলেন না, ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। টুটুল এতক্ষণে ধাতস্থ হয়েছে। উঠে ওনাকে সোফায় বসালো। ” ওর বাবার বদলির চাকরি ছিল তাই আমার কাছেই থেকে বড় হয়েছে, আমাদের বুক আজ ফাঁকা, কি নিয়ে বাঁচবো”। এর উত্তর টুটুলের জানা নেই, চুপ করে থাকলো। ” আমাদের সম্পর্ক শুধু বাবা মেয়েতেই আটকে ছিল না, বন্ধু ছিলাম। তোমার ব্যাপারটা আমাকে বলেছিল, সব জেনে আমিই ওকে মানা করেছিলাম তোমার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে, মারণ রোগ নিয়ে আমার বেটিকে তোমার হাতে তুলে দিলে মহাপাতক হতাম আমি। তোমাদের সব চ্যাট আমাকে দেখাতো। তোমাকে প্রচন্ড ভালোবাসতো পম। সব আমার কপাল”। শেষ কথাটা শুনে টুটুলের বুকে জমে থাকা কান্নাটা ভিসুভিয়াসের মত বেরিয়ে এলো।” জানো টুটুল, মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে লড়তে ও তোমার মায়ের খবর নিয়েছিল”। পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে টুটুলের হাতে দিলেন, কাঁপা কাঁপা হাতের সেই লেখা পড়ে টুটুল মাটিতে বসে পড়লো।দত্ত সাহেব সান্ত্বনা দিয়ে ফের টুটুলকে রীতার দেহের কাছে আনলেন। টুটুল মাটিতে বসে রীতার নিথর হাতটা চেপে ধরলো।যে হাত আঙুল নেড়ে বলবে না- কাজ আগে, ফাইল এগিয়ে দেবে না,চ্যাটবক্সে কথার তুবড়ি ফোটাবে না।– কেওড়াতলা শ্মশানের চুল্লিতে রীতার দেহ তখন লাইনে। টুটুল দত্ত সাহেবকে একান্তে ডেকে নিজের মনের ইচ্ছে বলতে উনি টুটুলকে নিয়ে বাইরে এলেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই দু’জনে ফিরে এলো। টুটুল রীতার খাটের পাশে বসে পড়তেই দত্ত সাহেব টুটুলের হাতে তুলে দিলেন তার প্রয়োজনীয় বস্তুটা। প্যাকেট খুলে টুটুল রীতার সিঁথিতে পুরো সিঁদুর কৌটোটা ঢেলে দিয়ে শবদেহ জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে আর্তনাদ করে উঠলো। শ্মশানে উপস্থিত সকলের চোখ তখন জলে ভর্তি। অবসরের হয়েছে দু বছর , টুটুলের রোজ রাতের কাজ খেয়ে উঠে মায়ের ছবিতে প্রণাম করা আর রীতার ছবিতে হাত বুলিয়ে ল্যাপটপে চ্যাটবক্স খুলে দেখা রীতাকে করা তার শেষ মেসেজ আনসিন আর সবুজ আলো জ্বলছে। রীতার পাসওয়ার্ড দত্ত সাহেব টুটুলকে দিয়ে গিয়েছিলেন যে। আজও সবুজ আলো রীতার নামের পাশে জ্বলে।