বনের ভিতর দিয়ে
বনের ভিতর দিয়ে চলেছিলেন কৃষ্ণস্বামী। দ্রুতপদেই চলেছিলেন। অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। প্রায় সাতটা বাজে। রোগীরা এসে বসে আছে। অসুস্থ মানুষ। তাঁর ভগবান। প্লেসে আর দি পুওর ইন স্পিরিট : ফর দেয়ার্স ইজ দি কিংডম অফ হেভেন্। তারাই ভক্ত। নাহং বসামি বৈকুণ্ঠে যোগিনাং হৃদয়ে ন চ ভক্তের হৃদয়ে আমি বাস করি। ওরা অশিক্ষার মধ্যেও ভগবানকে ভক্তি করে। অন্ধকারের মধ্যে বাস করেও ওরা আলো চায়। ওরা জীবনের আলো নিভিয়ে অন্ধকার করে না। আলোর অভাবেই আলো বলে কাঁদে। ওদের মধ্যে ঈশ্বরের তপস্যা আছে।
বনে কোনো ফুল ফুটেছে। গন্ধ উঠেছে। পাখিরা কলকল করছে। সূর্য আজ মেঘের আড়ালে ঢাকা। বনভূমি বর্ষণের প্রত্যাশায় উন্মুখ হয়ে রয়েছে। প্রতিটি পাতার মধ্যে কৃষ্ণস্বামী। অনুভব করছেন উদ্ভিদ প্রাণের ব্যাকুল প্রত্যাশা।
হ্যালো, ড়ু ঈ হিয়ার? হ্যালো?।
চমকে উঠলেন কৃষ্ণস্বামী। নারী কণ্ঠস্বর, রিনা ব্রাউনের গলা। এই বনের মধ্যে? এই সকালে? এদিক-ওদিক তাকিয়ে কৃষ্ণস্বামী দেখলেন রিনা ব্রাউন বনের ভিতরে এক টুকরো ফাঁকা জায়গায় একটা একক বড় শালের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে আছে। পাশে একটা ফ্লাস্ক; হাতে সিগারেট। সেই পোশাক।
কৃষ্ণস্বামী শুধু বললেন, ইয়েস্?
কাম হিয়ার, সিট ডাউন। হ্যাভ এ ড্রিঙ্ক, এ স্মোক?
আই ডোন্ট ড্রিঙ্ক, ডোন্ট স্মোক। থ্যাঙ্ক ইউ।
এবার চিৎকার করে উঠল রিনা, কৃষ্ণেন্দু।
হেসে কৃষ্ণস্বামী বললেন, আমার রোগী বসে আছে রিনা—আমি যাই। আমাকে ক্ষমা কোরো। তারপর আবার বললেন, তুমি চিনেছ রিনা। কাল ভেবেছিলাম তোমার স্মৃতিও ভ্রংশ হয়ে গেছে।
গেছে। অনেক গেছে। কিন্তু ওথেলো ভুলি নি। লেট মি লুক অ্যাট ইয়োর আইজ, লুক ইন মাই ফেস্ বলে আমার দিকে যখনই তাকালে, তোমার দৃষ্টি আমি তখনই চিনলাম। কিন্তু।
সিগারেট টানতে লাগল রিনা। অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে ওর হাতের আঙুল কাঁপছে।
আমি যাই রিনা।
তুমি এখানে কী করছ? এ কী পোশাক? এ কী চেহারা?
আমি ক্রিস্টান হয়েছিলাম তুমি জান। তারপর হয়েছি সন্ন্যাসী। ভারতবর্ষের ক্রিস্টান সন্ন্যাসী! সন্ন্যাসীতে যা করে তাই করছি। ঈশ্বরকে খুঁজছি। অবশ্য মানুষের সেবার মধ্যে। আমি ডাক্তার, ওদের চিকিৎসা করি। কিন্তু মূল চিকিৎসা,–কুষ্ঠরোগীর চিকিৎসা।
রিনার হাত থেকে সিগারেটটা পড়ে গেল। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে রিনা বললে, জীবনটাকে নষ্ট করলে কৃষ্ণেন্দু! আই অ্যাম্ দি ক আই অ্যাম্ দি কজ–
না। জীবন আমার নষ্ট হয় নি। তুমি আমাকে যা বলেছিলে, তা মিথ্যা বল নি। পৃথিবীতে ঈশ্বরের চেয়ে বড় কিছু নেই।
আমি বলেছিলাম তোমাকে? হুঁ, আমি বলেছিলাম। আই অ্যাম্ দি কজ।
আমি যাই। গুড বাই।
দাঁড়াও। আমি আবার বলছি—আমি ভুল বলেছিলাম। এ পথ তুমি ছাড়।
না। আমি যাই। গুড বাই!
আর এক মিনিট। আমার কথা জিজ্ঞাসা করবে না?
না। তোমার কথা তোমার রূপের মধ্যেই প্রকাশ, রিনা। কী জিজ্ঞাসা করব?
আবার বলছি ঈশ্বর নেই কৃষ্ণেন্দু। আমি তোমাকে ভুল বলেছিলাম। দুঃখ দিয়েছিলাম। ঈশ্বর নেই।
উঠে দাঁড়াল রিনা ব্রাউন। তীব্ৰকণ্ঠে বলে উঠল—শোন আমার কথা। আমি বলছি ঈশ্বর নেই। নাথিং ইজ সিনপাপ নেই, পুণ্য নেই, ঈশ্বর নেই।
কণ্ঠস্বর তার তীব্রতর হয়ে উঠল। এগিয়ে এসে কৃ স্বামীর পথরোধ করে দাঁড়াল।
তুমি এসব ছাড় কৃষ্ণে। জীবনকে নষ্ট কোরো না। ফিরে যাও। নতুন জীবন আরম্ভ কর।
তোমার সঙ্গে?
হি-হি করে হেসে উঠল রিনা ব্রাউন। তীব্র তীক্ষ্ণ বীভৎস হাসি। হাসি থামিয়ে বললে, আমার এখন দাম অনেক কৃষ্ণেন্দু। তোমার দাম আমার কাছে সেদিনের চেয়ে কম, সেদিন ভয় করে বলেছিলাম। আজ করুণা হচ্ছে। হার্মলেস, ডোসাইল, ওয়ার্থলেস, ঈশ্বরবিশ্বাসী সন্ধানী তুমি, নির্বোধ তুমি, মূর্খ তুমি, আমার ঘৃণার পাত্র নও, করুণার পাত্র।
কৃষ্ণস্বামী আর কথা বললেন না, এগিয়ে চললেন।
পিছন থেকে রূঢ় চিৎকার করে উঠল রিনা ব্রাউন, শোন, আমার কথা শোন। ইউ মাস্ট লিভ দিস প্লেস। এখানে থাকতে তুমি পাবে না। চলে যাও। অনেক দূরে!
কৃষ্ণস্বামী ঘুরে দাঁড়ালেন।
রিনার এমন তীব্র মূর্তি তিনি কখনও দেখেন নি। তার দীর্ঘ ঘন কালো নেত্ররোমের স্বালু বেষ্টনীর মধ্যে আয়ত কালো চোখ যে এমন জ্বলন্ত হয়ে উঠতে পারে, তা তার কল্পনাতীত। চোখ দুটো তার জ্বলছে। ধকধক করছে।
রিনা বললে, তোমার ওই বাঙলোটা আমার চাই। আমি এখানে থাকব। অনেক দিন থাকব। তোমাকে আমি সহ্য করতে পারব না। তোমাকে এ অঞ্চল ছেড়ে চলে যেতে হবে। ইউ মাস্ট। না হলে আমি ওদের লেলিয়ে দেব। ওরা তোমাকে, ওরা কেন, আমিই তোমাকে গুলি করে মারব।
কৃষ্ণস্বামী কোনো উত্তর না দিয়ে নীরবে আবার চলতে শুরু করলেন। আর পিছন ফিরলেন না। ভীত তিনি হলেন। নিজের জন্য নয়। ওই ঝুমকির জন্য। সিন্ধুর জন্যও বটে।
রিনা ব্রাউন প্রেতিনীর মত গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে নিষ্ফল আক্ৰোশে ফুলছে। হয়ত ফ্লাস্ক খুলে মদ খাচ্ছে। অনুমান করতে এতটুকু বিলম্ব হল না তার।
ঠিক করলেন, ঝুমকি আর সিন্ধু গ্রামের ভিতরে গিয়ে থাকবে। লাল সিং ওদের আগলাবে। সেও যাবে। তিনি থাকবেন একা। তার ভয় নেই। ভয় কৃষ্ণের কোনো কালে ছিল না। কৃষ্ণস্বামী হয়ে তিনি ঈশ্বর খুঁজে বেড়াচ্ছেন, তিনি মৃত্যুকে ভয় করবেন কেন? আসুক মৃত্যু। অন্যায়কে প্রতিরোধ করে তিনি মরবেন। প্রেতিনী রিনা ব্রাউনের ভয়ে তিনি পালাবেন?
রাত্রি তখন নটা। তিনি বসে ছিলেন। প্রতিটি জিপের বা মোটরের শব্দে একটু সজাগ হয়ে উঠছিলেন। মধ্যে মধ্যে এক-একটা দীর্ঘ নিস্তব্ধতার মধ্যে মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলেন। আকাশ বর্ষার মেঘে ভরেছে। আজ, হয়ত আজই বর্ষা নামবে। দিগন্তে মৃদু বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কিন্তু তিনি ও-কথা ভাবছিলেন না। ভাবছিলেন নিষ্কলুষ পবিত্রতার প্রতিমূর্তি রিনার কথা। প্রেতিনী রিনা ব্রাউনের কথা। প্রেতিনী নয়, সাক্ষাৎ তামসী আজ রিনা ব্রাউন।
রাত্রি তামসী নয়। রাত্রির অন্ধকারে জীবনের মধ্য থেকেই তামসী বেরিয়ে আসে। বস্তুজগতে, স্থান-জগতে ক্ষোভের কারণ না থাকলে, অনিয়ম না ঘটলে সে জাগে না। ক্ষোভ মিটলেই সে শান্ত হয়, স্থিত হয়। জীবনের মধ্যেই সে সদাজাগ্রত, চেতনার মধ্যে অহরহ সে সক্রিয়। সুপ্তির মধ্যে সে দুঃস্বপ্ন, অবসর-বিশ্রামের মধ্যে সে কুটিল কল্পনা। শান্তির পথে, সুখের পথে, চৈতন্যের পথে মানুষকে এগুতে সে দেবে না। নিষ্ঠুর আক্ৰোশে পিছন থেকে অজগরের মত আকর্ষণ করছে। গ্রাস করতে চাইছে। একবার জড়িয়ে ধরতে পারলে গ্রাস না করে ক্ষান্ত হবে না।
তখন প্রায় মধ্যরাত্রি, তন্দ্ৰা এসেছিল কৃষ্ণস্বামীর। টর্চের আলোয় তন্দ্ৰা ছুটে গেল। তিনি উঠে বসলেন।
কে?
দূর-দিগন্তে বিদ্যুৎ চমকে উঠল। সেই ক্ষণিক আলোতেই দেখলেন, হ্যাঁ, সে-ই বটে। দীর্ঘাঙ্গী নারীমূর্তি এগিয়ে আসছে। একটু একটু টলছে। রিনা ব্রাউন উত্তর দিল, আমি। তুমি আমারই জন্যে প্রতীক্ষা করে আছ দেখছি!
আমি–শুধু তোমার নয়, তোমার সঙ্গে আরও লোকের প্রতীক্ষা করছিলাম। যারা ভয়ঙ্করী—লোলুপ ভয়ঙ্কর। যারা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলবে। আমি বুঝতে পেরেছি, এ বাড়িতে যত প্রয়োজন তোমার আমাকে তাড়ানো তার চেয়ে তোমার বেশি প্রয়োজন। তুমি স্বস্তি পাচ্ছ না। কিন্তু কেন?
একখানা চেয়ারে বসে রিনা বললে, ইউ মাস্ট গো অ্যাওয়ে ফ্রম হিয়ার। তোমাকে যেতে হবে।
নো। আই মাস্ট নট গো। ঈশ্বরের সাধনায় আমি এখানে শপথ নিয়ে এসেছি। এ আমার সাধনার আসন।
স্টপ। চিৎকার করে উঠল রিনা। আকাশের মেঘের দিকে তাকিয়ে সে বললে, সব মিথ্যে। ঈশ্বর নেই। কোনোদিন ছিল কি না জানি না। থাকলে সে মৃত। মানুষ তাকে মেরে ফেলেছে। আমার দিকে দেখো। আমি তার সমাধি। আমার বাবা সভ্য ইংরেজ, ধর্মবিশ্বাসী ক্রিস্টান—তাকে মেরে আমার মধ্যে সমাধি দিয়েছে। আমি তোমাকে বলছি। যা মৃত তা বাঁচে না। ঈশ্বর-বিশ্বাসের গলিত শবটা ছেড়ে দাও। চলে যাও এখান থেকে।
তুমি আজ যা-ই হয়ে থাক রিনা, তুমি ক্রিস্টান।
না, না, না। আমি ক্রিস্টান নই। এতক্ষণ শুনলে কী?
রিনা!
কোনোদিন ছিলাম না। আমার ক্ৰশ, আমার বইবেল আমি ফেলে দিয়েছি। কোনোদিন আমি ব্যাপটাইজড হই নি। দীক্ষা আমার বাবা নিতে দেয় নি। কোনো ধর্মই আমার নেই। বাবা জেমস ব্রাউন ইংরেজ, ধর্মে ক্রিস্টান, অত্যাচারী জমিদার। আমার মা হিদেন, হিন্দুদের মধ্যেও বন্য অস্পৃশ্য জাতের মেয়ে। লালসা চরিতার্থ করবার জন্য বাবা তাকে উপপত্নী হিসেবে রেখেছিল, তাকে কিনেছিল। আমি তার জারজ সন্তান। কৃষ্ণেন্দু, সেই আয়া, সেই কুন্তী আমার মা!
বিদ্যুৎচমকের মেঘগর্জনটা ঠিক এই মুহূর্তেই ধ্বনিত হয়ে উঠল রিনার কথার প্রতিধ্বনির মত। কৃষ্ণেন্দু বজ্ৰাহতের মতই স্তম্ভিত হয়ে গেল। কোনো কথা, একটা বিস্ময়সূচক মর্মান্তিক ধ্বনিও বের হল না। রিনা হেসে উঠল। হঠাৎ হাসি থামিয়ে কাঁধে-ঝোলানো ফ্লাস্ক থেকে খানিকটা মদ খেয়ে নিয়ে বললে, আরও শুনবে? আরও অনেক আছে। আমার ওই মা কুন্তী, সে হল মেদিনীপুরে যেখানে ব্রাউনের জমিদারি ছিল, সেখানকার জঙ্গল-মহলের পুরনো এক ছত্রী ইজারাদারের রক্ষিতা এমনি এক বুনো মেয়ের গর্ভজাত মেয়ে। ইজারাদারের রক্ষিতা ছিল এক ব্রাহ্মণের ব্যভিচারের ফল। আরও শুনবে? কালো মেয়েদের রক্তের সঙ্গে অনেক ফরসা রঙের মিলে হয়েছিল শেষ সাদা ইংরেজের রঙ। সবটা প্ৰকাশ পেল আমার মধ্যে। কালো চুল বড় বড় চোখের পাতা সাদা রঙ। রঙ-রূপ আমার যাই হোক, আমার কি কোনো ধর্ম আছে, আমার কি কোনো ঈশ্বর আছে? ঈশ্বরের ধর্মের আমি জীবন্ত সমাধি। মৃত ঈশ্বর আমার মধ্যে পচছে। গন্ধ উঠছে।
রিনা স্তব্ধ হয়ে গেল অকস্মাৎ। স্তব্ধ হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ।
কৃষ্ণস্বামীর মনে হল চোখ থেকে তার জল গড়িয়ে এসেছে। তিনি বললেন, তুমি কাঁদছ!
কাঁদছি? লুক—সে টৰ্চটা জ্বেলে নিজের মুখের উপর ধরলে। না, রিনা কাদে নি। চোখ দুটি তার নেশায় আরক্ত, দৃষ্টি তার অসহনীয় তীব্র।
চোখের জল আমার অনেক দিন শুকিয়ে গেছে। মরুভূমি হয়ে গেছে। অনেক কেঁদে জল শেষ হয়ে গেছে।
ধীরে ধীরে রিনা বললে, সব তোমার জন্যে কৃষ্ণেন্দু, ইউ আর দি ক, ইউ আর দি ক, আজ তোমার নাম স্পষ্ট উচ্চারণ করেই বলছি, ইউ আর দি ক একটু হাসলে রিনা। বোধ করি ওথেলোর এই দৃশ্যটির অভিনয়ের সুখস্মৃতি খানিকটা মাধুর্যের সঞ্চার করলে ক্ষণিকের জন্য।
তোমার মত ভালবাসার জনকে ফিরিয়ে দিলাম, তুমি ঈশ্বরকে, ধর্মকে অন্তরের সঙ্গে বিশ্বাস কর না বলে। কাল তোমার সঙ্গে দেখা হওয়া অবধি ভাবছি, আমার নিজেকে না দিয়ে। সেদিন আমার ঈশ্বর, আমার ধর্ম সব বোধহয় তোমাকে দিয়েছিলাম। তুমি সব কেড়ে নিয়ে এসেছিলে আমার অজ্ঞাতসারে।
আবার একটু স্তব্ধ থেকে বললে, আসানসোল থেকে ফিরে এলাম। ঈশ্বর এবং ধর্মকে আমি এত ভালবাসতাম কৃষ্ণেন্দু যে অন্তর হাহাকার করলেও আমি কাঁদি নি। সংকল্প করেছিলাম সারাজীবন নান হয়ে কাটিয়ে দেব। ব্রাউন সাহেবকে বাবা বলতে আমার ঘৃণা হয়। কৃষ্ণেসে তোমার কথা জিজ্ঞাসা করলে, সে কই? আমি তাকে বললাম, আমি তাকে। প্রত্যাখ্যান করেছি। সে জিজ্ঞাসা করলে, কেন? সে ক্রিস্টান হয়েছে, তুমি জান না? সে তোমাকে বলে নি? বললাম, বলেছে। জিজ্ঞাসা করলে, তবে? আমি তোমাকে যা বলেছিলাম, সব বললাম। কৃষ্ণেন্দু, এক মুহূর্তে তার মুখোশ খুলে গেল। চিৎকার করে উঠল, বাস্টার্ড বিচ। তারপর অনর্গল কুৎসিত, অশ্লীল গালাগাল। বললে, ক্রিস্টান? তুই ক্রিস্টান? ড়ু ইউ নো, হিদেন ওই কুন্তী, হিদেনদের চেয়েও ঘৃণিত ও। ওরা পর পর তিন জেনারেশন বাস্টার্ড, ওই তোর মা। বললে, জীবনে মুহূর্তের দুর্বলতা আমাকে এত বড় ভুল করালে। তোর সাদা রঙ দেখে আমি ভুলে গেলাম। তোকে বাঁচিয়ে রাখলাম।
একটা সিগারেট ধরালে রিনা। তারপর আবার কথা বলতে গিয়েই থমকে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললে, ইটস্ রেনিং। বৃষ্টি এল। হেসে বললে, কুন্তী-মা আমায় বলত, জল আইচে গ!
কয়েকটা বড় বড় ফোঁটা কৃষ্ণস্বামীর কপালে হাতে এসে পড়ল। দূরান্তরে শো-শে শব্দ উঠছে। আসছে বর্ষার বর্ষণ। মৃদুমন্দ নৈঋতী হাওয়া বইছে।
কৃষ্ণস্বামী বললেন, ভিতরে চল রিনা।
ঘরের ভিতরে? চল। কিন্তু তাতেই বা কী দরকার? আমি চলে যাই। শুধু বলে যাই, তোমাকে বলেছি, আবার বলছি, এখান থেকে তোমাকে সরে যেতে হবে। আমি স্বস্তি পাচ্ছি না। ইউ মাস্ট।
সে হবে রিনা। কিন্তু এই বৃষ্টিতে রাত্রির অন্ধকারে কোথায় যাবে?
ভিজতে ভিজতে চলে যাব। দুর্যোগ আমি ভালবাসি কৃষ্ণেন্দু। আগে ঝড়-জল এলে ভয় করতাম। এখন আনন্দ পাই। আই ফিয়ার নো ডার্কনেস, আই ফিয়ার নো স্টর্ম, আই ফিয়ার নো থান্ডার, লেট মি গো। বাট ইউ মাস্ট লিভ দি প্লেস।
না। বোসো।
ঘরের মধ্যে এসে স্তিমিত লণ্ঠনটি উজ্জ্বল করে দিলেন কৃষ্ণস্বামী।
নো। বলে তিনা এসে আলোটিকে কমিয়ে, নিভিয়ে দিল। পলতেটা পড়ে গেল। অন্ধকার—অন্ধকার ভাল। জান, ব্রাউনের কাছে সব কথা শুনে তিন দিন আমি অন্ধকারে পড়ে। পড়ে কেঁদেছিলাম। দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আলো জ্বালি নি। নিজের দিকে চেয়ে দেখতে ভয় হত আমার। আমার সঙ্গে সমানে কাঁদত আমার মা। কুন্তী। ব্রাউনকে আমি ঘৃণা করি। কুন্তীকে ঘৃণা করতে পারি নি। হতভাগিনী। ব্রাউনের ভয়ে ভয়ার্ত মূক জন্তুর মত সারাজীবন আমার আয়া হয়ে থেকেছে, কোনোদিন আমাকে মেয়ে বলে একবিন্দু স্নেহ শ্রদ্ধা আমার কাছে চাইতে পারে নি। অন্ধকারে দুজনে কাঁদতাম। নিজের কলঙ্কের ভয়ে—আমার মাতৃপরিচয়ের অমর্যাদা পাছে তাকে স্পর্শ করে, আমাকে স্পর্শ করে, তার লজ্জায়—সে আমাকে ক্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করে নি। আমাকে নার্সারিতে দিয়েছিল। কিন্তু আমার মায়ের তখনও রূপ-যৌবন ছিল। সে-রূপে নাকি এক বন্য মোহ ছিল। সে মোহ আশ্চর্য। আমার চুলে চোখে চোখের পাতায় তার পরিচয় আছে। তাকেও সে তাড়ায় নি। তাকে সে কিনেছিল। ভোগ করত, বর্বরের মত। ক্রিস্টান! ক্রায়েস্ট-সন অব গড! তিনি ছিলেন, ক্রুশে বিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিলেন। রোমান ইম্পিরিয়লিস্টরা মেরেছিল তাকে। লোকের বিশ্বাস, তিনি পুনরুজ্জীবিত হয়েছিলেন। হয়ে থাকলেও ইম্পিরিয়লিস্টরা যে এখনও মরে নি। তারা যে তাকে ক্রুশে নিত্য বিঁধে মারছে। প্রতিদিন ক্রুশবিদ্ধ হচ্ছেন।
হাসলে রিনা। হেসে বললে, এরা কিন্তু একটা জায়গায় মহৎ। ক্লেটন আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, কিন্তু এই খাঁটি ইংরেজ জমিদার তার আভিজাত্য বজায় রেখে আমার সব বৃত্তান্ত তাকে। জানিয়েছিল। ক্লেটনের বাবা ধন্যবাদ জানিয়েছিল ব্রাউনকে। তুমি হিদেন বলে তোমাকে সত্য বলার প্রয়োজন মনে করে নি। আমি ক্রিস্টান নই, তবু তোমাকে ক্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত না করে আমার সঙ্গে বিয়েতে মত দেয় নি। আমি হিসেনের গর্ভজাত মেয়ে, আমাকে বাইবেল আর ক্ৰশ দিয়েছিল খেলার ছলে। তার কোনো মূল্য নেই। ঈশ্বর ধর্ম কোনো কিছুর উপর আমার কোনো অধিকার নেই। ঈশ্বর মূক, কোনো ভাষা নেই তার, তিনি প্রতিবাদ করেন নি, ধর্মের ঘরের তালা রীতির কোডে মেলে নি বলে খোলে নি। আমি সামনে পেয়েছি নরকের সিংহদ্বার খোলা—তার মধ্যে ঢুকেছি। সে সিগারেট ধরাল।
বাইরে তখন প্রবল বেগে বর্ষণ নেমেছে। চারিপাশের সুদীর্ঘ বিশাল শালবনের পল্লবে ধারাপতনের শব্দে শব্দময় মেঘমল্লার বেজে বেজে উঠছে। বিচিত্র ঝরঝর এক সঙ্গীত। পৃথিবীর অন্য সব শব্দ ড়ুবে গিয়েছে। এমনকি, জিপ কি মোটরের শব্দও ভাল শোনা যাচ্ছে না।
হঠাৎ রিনা উঠে দাঁড়াল। একটা জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। জানালার ভিতর দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে বললে, কী সুন্দর রাত্রি! মনে হচ্ছে, বিশ্বজগতে তুমি আর আমি ছাড়া আর কেউ নেই, কিছু নেই।
কৃষ্ণস্বামী স্তব্ধ হয়ে রিনার কাহিনী শুনে সেই স্তব্ধ হয়েই বসে ছিলেন। বেদনায় করুণায় তাঁর অন্তর মুহ্যমান হয়ে গেছে। বাইরের ওই সজল বাতাসের প্রবাহের মত হায়-হায় করে। সারা হয়ে গেল। এমনি করেই কাঁদছে। হে ভগবান, তুমি ওর অন্তরে পুনরুজ্জীবিত হও। ওর অন্তরের কবরখানা বিদীর্ণ করে জেগে ওঠ। তোমার স্পর্শে কুষ্ঠরোগীর নিরাময় হওয়ার মতই। কঠিন আঘাতে বিকৃত ব্যাধিগ্রস্ত অন্তরকে সুস্থ সুন্দর করে তোল। সুন্দর রিনা, এখনও সুন্দর। এখনও সেই মাধুরী তার সর্বাঙ্গে, এখনও তার দীর্ঘ ঘনকৃষ্ণ পক্ষ্মঘেরা আয়ত কালো চোখ দুটি মানস-সরোবরের মত স্বচ্ছ গভীর আকাশের প্রতিবিম্বে এখনও সে নীলাভা প্রতিফলনের শক্তি। হারায় নি। মেঘ তুমি কাটিয়ে দাও, অপসারিত কর। হে ঈশ্বর! নরকের মুখে উন্মাদ যাত্রীকে তুমি ডাক ফিরে আয় বলে।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে তিনি এগিয়ে এসে বললেন, রিনা, ঈশ্বরের সমাধি বার বার রচনা করবার চেষ্টা করেছে ঈশ্বরের বিপরীত শক্তি। আলো আর কালো। ভাল আর মন্দ। কিন্তু বার বার মন্দ হেরেছে, ভাল জিতেছে। ঈশ্বর সে সমাধি বিদীর্ণ করে পুনরাবির্ভূত হয়েছেন। হায় রিনা, অনেক দুঃখ তুমি পেয়েছ, অনেক বেদনা। আমার দুর্ভাগ্য, আমি তখন দূরে চলে গেছি। আমি জানলে এ দুঃখ তোমাকে পেতে দিতাম না। বলতাম জীবন, সে ঈশ্বরের অংশ। সৃষ্টির মধ্যে মানুষের জীবনেই ভগবান কথা কন, হাসেন, কদেন, ভালবাসেন, নিজেকে নিজে বলি দেন, বিশ্বের কাছে বিলিয়ে দেন, মানুষের মধ্যেই তিনি প্রত্যক্ষ। মানুষের মধ্যে জীবন, সে যেখান থেকেই উদ্ভুত হোক, সে সমান পবিত্র। ব্রাহ্মণ নেই, চণ্ডাল নেই, ক্রিস্টান নেই, হিদেন নেই, ধনী নেই, দরিদ্র নেই। গোত্র কুল ইতিহাস পরিচয় থাক না-থাক, মানুষ সমান পবিত্র, তার মধ্যে ঈশ্বর সমান মহিমায় আত্মপ্রকাশের জন্য ব্যাকুল। তোমাকে নিয়ে আমি মহা আনন্দে এই তপস্যা করতাম।
পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, যে ঈশ্বরকে তুমি সমাধিস্থ করেছ বলছ, তিনি আবার উঠবেন। তুমি শান্ত হও।
ডোন্ট টাচ মি প্লিজ। ডোন্ট। ডোন্ট কৃষ্ণেন্দু! আমাকে স্পর্শ কোরো না। চিৎকার করে উঠল রিনা। সে যেন আর্তনাদ।
পিস্ অ্যান্ড বি স্টিল, রিনা। ওথেলো মনে পড়িয়ে দিয়ে তার অন্তরে স্বপ্নবেশের স্নিগ্ধতা সঞ্চারের চেষ্টা করলেন কৃষ্ণস্বামী।
কিন্তু রিনা অধীর কণ্ঠে বললে, শান্তি আমার নেই। স্থির আমি হতে পারব না, কৃষ্ণেন্দু। তুমি জান না। ওসবের কোনো কিছুতেই আমার আর অধিকার নেই। আমার ব্যভিচারী জন্মদাতা ব্রাউন আমাকে বলেছিল—আমার ধর্মে অধিকার নেই ঈশ্বরে অধিকার নেই পবিত্রতায় অধিকার নেই। যেমন করে ওরা সাম্রাজ্যে সাম্রাজ্যে জবরদস্তি বলছে-তোমাদের। কোনো অধিকার নেই—আর তাদের থাকছে না-হারাচ্ছে। তারাও বিশ্বাস করছে। আমার তাই হয়েছিল—আমার অধিকার নেই বলে নিজেই ছুটে গিয়ে ঝাঁপ দিয়েছিলাম নরককুণ্ডে। সেখানে পাকের মধ্যে ফুলের মত আমি পচতে লাগলাম আজ আমার ভিতরটা নিঃশেষে পচে গেছে। শয়তান আমাকে অধিকার করেছে। আমি অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু পবিত্রতার কথা আর ভাবতেই আমি পারি না। দুর্দান্ত ক্রোধে অন্তর আমার ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, প্রচণ্ড আক্ষেপ জেগে ওঠে শরীরে। আমি কাঁদতে পারি না। আমি ব্রাউনের উপর রাগে আক্ৰোশে বেরিয়ে এসেছিলাম, ফেলে দিয়েছিলাম বাইবেল; পাছে তোমার সঙ্গে দেখা হয় এই ভয়ে লুকিয়ে ছিলাম জঘন্য পল্লীতে। সঙ্গে আমার মা। সে এই রাত্রির মত। অন্ধকার মূক। পাপ কর, পুণ্য কর, কোনো কিছুতে প্রতিবাদ নেই, শাসন নেই, বরং নীরব প্রশ্রয় আছে; কালো সর্বাঙ্গে কাপড়ের কালো ঘের দিয়ে ঢেকে রাখে, প্রকাশ হতে দেয় না। জীবন আরম্ভ করলাম রিপন স্ট্রিট অঞ্চলে। নাইট ডেনের জীবন। ফিটনের কোচম্যান, ডেনের বয়েরা যার পরিচালক। সেখান থেকে হোটেলে গিয়ে পড়লাম। হোটেল থেকে এই যুদ্ধের মধ্যে দেহ বিক্রি করে ঘুরে বেড়াচ্ছি। শয়তান বেঁধে রেখেছে আমাকে। আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ।
রিনা! শিউরে উঠলেন কৃষ্ণস্বামী।
না। দোষ কাউকে দেব না। সব আমার জন্মফল। আমার জন্ম থেকেই পঙ্ককুণ্ড কৃষ্ণেন্দু, সেখানে তুমি পাকের কবরে চাপা পড়েছ, ঈশ্বর পড়েছে, ঈশ্বরের পুত্র পড়েছে, ব্রাউন সাহেব দিয়েছে চাপা।
রিনা! হাতখানি টেনে নিলেন কৃষ্ণস্বামী।
আমাকে চাও তুমি? প্রেম নেই। দেহ দিতে পারি আমি। প্রাণ নেই। মন নেই। মনও গেছে। প্রেমও নেই। চাও তুমি প্ৰাণহীন, মনহীন শুধু কোমল মাংসপিণ্ডের এই দেহ?
হাত ছেড়ে দিলেন কৃষ্ণস্বামী। বললেন, ভগবান তোমাকে দয়া করুন—
নো! না! নো! ও নাম কোরো না।
মৃতকে তোমার ভয় কী?
ভয় নয়, ঘৃণা। শোন কৃষ্ণেন্দু, তুমি এখানে থাকতে আমি স্বস্তি পাব না। তোমাকে এখান থেকে। যেতে হবে। তুমি যাও, কৃষ্ণেন্দু! না হলে হয়ত আমি তোমাকে গুলি করে মারব। কিংবা ওরা মারবে। ওরা যদি জানতে পারে তোমার জন্যে আমি চলে যাব, তা হলে ওরা ক্ষমা করবে না।
কৃষ্ণস্বামী অন্ধকারের মধ্যেই যেখানে দেওয়ালে ক্রুশবিদ্ধ যীশুর একটি মূর্তি টাঙানো ছিল। সেই দিকে তাকিয়ে রইলেন : হে অবিনশ্বর। নিজেকে প্রকাশ কর তুমি।
কৃষ্ণেন্দু, তুমি যাবে কি না বল।
না।
না?
না।
অন্যত্র গিয়ে তুমি তোমার কাজ কোরো। আমাকে উত্ত্যক্ত কোরো না তুমি।
না।
কেন? কিসের জন্য? আমার জন্য? আমার দেহ চাও?
অত্যন্ত স্থির সঞ্চালনে ঘাড় নাড়লেন কৃষ্ণস্বামী। বললেন, না। তোমার দেহ নিয়ে কী করব? আমি চাই তোমার আত্মাকে। তোমার মনকে। দেহ মরে যায় পচে যায়। আত্মা অমর। যেনাহং নামৃতা স্যাম্ কিমহং তেন কুর্যাম্। সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিলেন, কী হবে ওতে? আমি তোমার আসল তোমাকে চাই। তোমার চিরন্তন তোমাকে। ইহকালের পরকালের তোমাকে।
সে নেই। পাবে না। তবে কেন, কিসের জন্য থাকতে চাও এখানে? কিসের জন্য? মরবে? চিৎকার করে উঠল রিনা।
মরব। শান্ত কণ্ঠে কৃষ্ণস্বামী বললেন– দ্যাট উইল বি মাই শিফিকেশন। আই এ্যাঁম। হিয়ার টু বি কুশিফায়েড এগেন।
বলতে বলতেই রিনার হাত থেকে টৰ্চটা নিয়ে তিনি জ্বালালেন। ছটাটা গিয়ে পড়ল ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মূর্তির উপর।
পরমুহূর্তেই রিনা ক্ষিপ্ৰবেগে কী টেনে বের করলে। পিস্তল। পিস্তলটা, তুলে গুলি করলে। মূর্তিটা ভেঙে পড়ে গেল। কৃষ্ণস্বামী চিৎকার করে উঠলেন-–রিনা!
রিনা বেরিয়ে চলে গেল কক্ষচ্যুত উল্কার মত। এতক্ষণে সচেতন হলেন কৃষ্ণস্বামী। দ্রুত বেরিয়ে এলেন–ডাকলেন–-রিনা! রিনা! রিনা!
নো! নো! নো! উত্তর ভেসে এল দূর থেকে–নো।
সেই অন্ধকার বর্ষণমুখর রাত্রিতে তিনি পথের ধারে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তার ধারণা হল—রিনা নিশ্চয় ফিরবে। কিন্তু রিনা ফিরল না।
পরদিন তিনি গেলেন পিয়ারাডোবা। রিনা ব্রাউন কোথায়? কোনো খোঁজ মিলল না। বনের ভিতরটা তিনি খুঁজলেন। রিনার মৃতদেহ মিলল না। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলেন মরেছে সে? উত্তর পেলেন–না, সে মরে নি। নিজে সে মরবে না। না।
সেই থেকে আর রিনাকে দেখা গেল না।
আরও কতদিন কৃষ্ণস্বামী গেলেন পিয়ারাডোবা; কতদিন মোরারে রাস্তার তেমাথায় দাঁড়িয়ে রইলেন। কতদিন রামচরণের ফটকে অপ্রয়োজনে বসে রইলেন। কত জিপ গেল। কত বিলাসিনী গেল। কিন্তু রিনা নেই তাদের মধ্যে।
রামচরণ, রামচরণের ছেলে বললে, সি মেমটো কোথা গেল বাবাসাহেব?
কৃষ্ণস্বামী কী বলবেন? বলেন, কে জানে!
কে জানে সে কোথায়? কোন্ দূরান্তরে দূরবিস্তৃত যুদ্ধের সীমানায় রিনা তামসী উল্কার মত ছুটে বেড়াচ্ছে। অথবা অন্ধকারচারী সরীসৃপের মত। কে জানে?